চেরি_ব্লসমের_সাথে_এক_সন্ধ্যা #পর্ব: ২৪,২৫

0
732

#চেরি_ব্লসমের_সাথে_এক_সন্ধ্যা
#পর্ব: ২৪,২৫
#লেখা: ইফরাত মিলি

_,২৪___________

কালকের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে মিতুলের। জোহানের বলা শেষ কথাগুলো মনে পড়ছে ওর।
‘আমার গিটার কোথায় সিস? মম নিয়ে গেছে আবার? মম আমার সাথে এমন করে কেন? মমকে নিষেধ করো আমার সাথে এমন করতে! আমার সাথে এমন করা উচিত নয় তার!’

কাল রাত থেকেই জোহানের কথাগুলো মিতুলের মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। জোহানের কথা দ্বারা তো বোঝায় যে রেশমী আন্টি এর আগে জোহানের গিটার নিয়েছিল। কিন্তু ওর গিটার কেন নেবে রেশমী আন্টি? আর, মমকে আমার সাথে এরকম করতে নিষেধ করো, এ কথার মানে কী ছিল? আগে জানতো মানুষ মদ খেলে গোপন সত্যি কথা বলে ফেলে। কিন্তু জোহান কীসব বললো? প্রথমে শোনালো ‘জো’র কাহিনী। আর শেষ সময় শোনালো এসব। যার কোনো মানেই বুঝলো না ও। কী ছিল এসবের মানে?

রুমের দরজায় ঠক ঠক করে করাঘাতের শব্দ হতেই মিতুল ওর ভাবনা স্থগিত করে দরজা খুললো গিয়ে।
দরজা খুলতেই জোহানের মুখখানা ভেসে উঠেছে। মিতুলকে দেখে জোহানের ভ্রু কুঁচকে গেল।
“তুমি এখনও ব্রাশ করোনি?”

“আমি ব্রাশ না করলে তোমার কী সমস্যা? এখানে এসেছো কেন? তোমার হ্যাংওভার কেটে গেছে?”

জোহান মিতুলের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বললো,
“তোমাকে খুবই ইন্টারেস্টিং একটা জিনিস দেখাতে নিয়ে যাব আমি।”

জোহানের কথা শুনে মিতুলের মন খুশিতে গদগদ হয়ে গেল।
“কী ইন্টারেস্টিং জিনিস দেখাতে নিয়ে যাবে?”

“সেটা গেলেই দেখতে পাবে।”
বলে জোহান স্থান ত্যাগ করলো।
___________

মিতুল বেশ কৌতূহল নিয়ে বের হয়েছিল জোহানের সাথে। জোহান ওকে ইন্টারেস্টিং জিনিস দেখাতে নিয়ে যাবে বলে মনে মনে খুবই উৎফুল্ল ছিল। কিন্তু জোহান ওকে যেখানে নিয়ে এলো তা দেখে ও অবাক। ওর উৎফুল্লতা নিমিষে চুপসে গেল।
হাসপাতালের সামনে গাড়ি থামিয়েছে জোহান। মিতুল গাড়িতে বসেই হাসপাতালের আশপাশটা দেখছে। এখানে নিয়ে এলো কেন জোহান? ইন্টারেস্টিং জিনিস দেখাবে বলে এখানে নিয়ে আসার মানে কী? মিতুল নিজের বিস্ময় চেপে রাখতে পারলো না। জিজ্ঞেস করেই ফেললো,
“হাসপাতালে নিয়ে এলে কেন আমাকে?”

জোহান ওর প্রশ্নের উত্তর দিলো না। সিটবেল্ট খুলে গাড়ি থেকে নেমে গেল। মিতুলও নামলো।
জোহান এগিয়ে গিয়ে গাড়ির পিছনের দরজা খুললো। ছোট্ট একটা ফলের ঝুড়ি বের করলো সেখান থেকে। ফলের সাথে আবার ফুলও আছে। মিতুল তো গাড়িতে বসে একেবারেই খেয়াল করেনি ঝুড়িটা। ফল নিয়ে হাসপাতালে এসেছে কেন? কোনো রোগীকে দেখতে এসেছে না কি? এই হাসপাতালে ওর কোনো পরিচিত রোগী আছে?

“চলো।” জোহান হসপিটালে ঢোকার জন্য ইশারা করলো।
মিতুল চুপচাপ জোহানের সাথে হেঁটে চললো। হাসপাতালে নিয়ে আসার রহস্য এখনও বুঝলো না ও।
জোহানের সাথে একটা রুমে এসে ঢুকলো মিতুল। প্রথমেই চোখ চলে গেল বেডের দিকে। দেখতে পেল এক যুবক ছেলে শুয়ে আছে বেডে। হাতে ব্যান্ডেজ। মাথায় ব্যান্ডেজ। মুখের কয়েক জায়গা প্লাস্টারে ঢাকা।

জোহান এগিয়ে গেল ছেলেটির দিকে। হাতের ঝুঁড়িটা বেডের পাশের টেবিলে রেখে, ছেলেটির বাহুতে কয়েকটি চাপড় মেরে হাসি হাসি মুখে বললো,
“হেই স্যানডি, হোয়াট’স আপ?”

ছেলেটার মুখ রাগে কঠিন হয়ে উঠলো। রাগী মুখে এক টুকরো হাসি ফোঁটানোর চেষ্টা করে জোর দিয়ে বললো,
“ইয়াহ, আই অ্যাম ফাইন!”

জোহান হঠাৎ ছেলেটার দিকে ঝুঁকে পড়লো। ছেলেটার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বললো,
“এখনও এই কথা বলবি? কালকের মারে কি এনার্জি ছিল না তেমন?”
কথাটা বলে মুখে ফিচেল হাসি ফোঁটায় জোহান। তারপর আবার সোজা হয়ে দাঁড়ায়।
জোহানের কথা শুনে ছেলেটার মুখ যেন আগের থেকে আরও বেশি কঠিন হয়ে উঠলো।

মিতুল ভ্রু কুঁচকে ব্যাপারটা দেখছে। কী হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছে না! কী বললো জোহান ছেলেটাকে? ছেলেটাকে কেমন চেনা চেনা লাগছে ওর। কোথায় যেন দেখেছে। কিন্তু কোথায়? ওর ভাবতে একটু বেগ পেতে হলো। কিন্তু মনে পড়লো কোথায় দেখেছে ছেলেটাকে। ছেলেটাকে চিনতে পেরে বিস্ময়ে মিতুল হতবাক হয়ে গেল। এ তো সেই ছেলে। জোহানকে মারধর করা চারটে ছেলের মধ্যে একটা!

ছেলেটা জোহানের দিকে তাকিয়ে চোয়াল শক্ত করে বললো,
“ডোন্ট ও্যআরি। এর সব কিছুই দশ গুণ বেশি বোনাস দেবো তোকে। জাস্ট ওয়েট।”

ছেলেটার কথা শুনে মিতুলের চক্ষু আতঙ্কে বড়ো হয়ে গেল। মানে কী ছেলেটার কথার? দশ গুণ বেশি মানে? ছেলেটার এভাবে আহত হওয়ার কারণ কি তাহলে জোহান? জোহান মেরেছে ছেলেটাকে এভাবে? মিতুল আতঙ্কগ্রস্ত চোখ দুটো জোহানের উপর নিক্ষেপ করলো। জোহানকে মোটেও বিচলিত দেখালো না। মুখে হাসি। জোহান বললো,
“সে তো তোদের দিতেই হবে বোনাস। না হলে তো নিজেদের মান হারাবি। চিন্তা করিস না। আমি সবকিছুর জন্যই প্রিপেয়ার থাকবো।”

জোহান ছেলেটার দিকে তাকিয়ে চুমু দেওয়ার ন্যায় ঠোঁটের আকৃতি করলো। তারপর প্রশস্ত হেসে ঝুঁড়ি থেকে একটা আপেল উঠিয়ে বললো,
“তোর জন্য টাটকা ফল নিয়ে এসেছি। খা। খেয়ে শক্তি বানা। দশ গুণ বেশি বোনাস দেওয়ার জন্য তো শক্তি জোগাতে হবে গায়ে। তাই না?”

জোহান আপেলটা আবার ঝুড়িতে রেখে মিতুলকে উদ্দেশ্য করে বললো,
“মিতুল, লেট’স গো।”

মিতুল দরজা থেকে কয়েক পা ভিতরে ঢুকে দাঁড়িয়ে ছিল। এর বেশি সামনে এগোয়নি আর। জোহান মিতুলের কাছাকাছি চলে এলে ছেলেটা হঠাৎ কেমন বাঁকা গলায় জিজ্ঞেস করলো,
“হু ইজ শি? ইওর গার্লফ্রেন্ড?”

ছেলেটার কথা শুনে মিতুল হকচকিয়ে গেল। ফট করে বলতে ইচ্ছা করছিল যে, ও জোহানের গার্লফ্রেন্ড নয়। কিন্তু জোহানের জন্য আবার ধৈর্য ধরলো। ওর ধারণা ছিল জোহান নিজে ছেলেটার ভুল ভাঙিয়ে দেবে। কিন্তু জোহান তা করলো না। যা করলো তা ছিল ওর জন্য অগাধ বিস্ময়পূর্ণ। জোহান ওর এক হাত ধরে টান দিয়ে ওকে নিজের কাছে এনে ফেললো। নিজের সাথে দাঁড় করিয়ে এক হাত দিয়ে ওকে আগলে ধরে বললো,
“ইয়াহ, শি ইজ মাই গার্লফ্রেন্ড। কেন? হিংসা হচ্ছে?”

মিতুল ভীত, বিস্ময় চোখে তাকিয়ে আছে জোহানের মুখের দিকে। এসব কী বললো জোহান?

জোহানের কথা শুনে ছেলেটা কেমন হেসে চোখ সরিয়ে ফেললো।
জোহানও একটু হেসে মিতুলের দিকে তাকিয়ে বললো,
“সুইটহার্ট, লেট’স গো!”

জোহানের কথা শুনে মিতুলের চোখ বড়ো বড়ো হয়ে উঠলো। সুইটহার্ট?

মিতুল হাসপাতাল থেকে বের হওয়ার পথে একটা কথাও বলেনি জোহানকে। ভিতরে ভিতরে রাগে ফুলেছে শুধু। প্রথম মুখ খুললো জোহান গাড়ি নিয়ে হাসপাতাল সীমানা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর।

“গার্লফ্রেন্ড? কে পারমিশন দিয়েছে তোমাকে আমাকে নিজের গার্লফ্রেন্ড বলার? এত্ত বড়ো মিথ্যুক তুমি! আমি তোমার গার্লফ্রেন্ড? আমি তোমার গার্লফ্রেন্ড হই? তোমার কি আর কাউকে চোখে পড়ে না? পৃথিবীতে এত মেয়ে থাকতে আমাকে কেন নিজের গার্লফ্রেন্ড বললে? হ্যাঁ? জবাব দাও। আমাকে দেখতে কি তোমার গার্লফ্রেন্ডের মতো লাগে?”

“বেশি বকবক করো না। তোমাকে যে আমার গার্লফ্রেন্ড বলেছি সেটা তোমার সাত জনমের ভাগ্য। হোক সেটা মিথ্যা।”

“ওরে, কী আমার মানুষটা! সে আমাকে গার্লফ্রেন্ড বললে না কি আমার সাত জন্মের ভাগ্য খুলে যাবে! নিজেকে কী মনে করো তুমি? প্রিন্স চার্মিং?”

“তার থেকে বেশি কিছু।”

মিতুলের মাথায় তাৎক্ষণিক অগ্নিদাহ বয়ে গেল।
“দেখো, আমার খারাপ মেজাজটা আরও বেশি খারাপ বানিয়ে দিয়ো না। এর ফল ভালো হবে না।”

“কী করবে তাহলে? নিজের ওই চোখ দিয়েই খুন করবে আমায়?”

“পারলে তাই করতাম।”

“..’পারলে’ বলছো কেন? পারোই তো তুমি। নিজের ওই চোখ দিয়েই বার বার খুন করো আমাকে।”
কথাগুলো বলে মিতুলের দিকে তাকালো জোহান। দেখলো মিতুল ওর দিকে রাগী চোখে তাকিয়ে আছে।

“হেই তুলতুল, এমন করে তাকিয়ো না। যদি আমি সত্যি সত্যিই খুন হয়ে যাই, তাহলে পৃথিবীর কোনো ডক্টর আর আমাকে বাঁচিয়ে তুলতে পারবে না। মৃত জোহানের সকল দায়ভার নিতে হবে তোমার। এই দায়ভার তুমি তোমার সারা জীবনেও আর কাটিয়ে উঠতে পারবে না। মৃত জোহানকে নিয়েই তোমার চলতে হবে সারাজীবন। কিছুতেই আর এই জোহানকে তাড়াতে পারবে না নিজের জীবন থেকে।” বলেই আবার সামনে তাকালো জোহান।

জোহানের কথা শুনে মিতুল কেন যেন খুব শান্ত হয়ে গেল। জোহানের কথার আগা-মাথা কিছুই বুঝতে পারেনি ও। তবুও জোহানের কথাগুলো শান্ত করে দিলো ওকে। নিঃশেষ করে দিলো ওর রাগকে। মিতুল খানিক চুপ থেকে বললো,
“তুমি যে ছেলেটাকে মেরেছো, এরপর আবার ওরা পাল্টা আক্রমণ করবে না তোমার উপর?”

“পাল্টা আক্রমণ করবে না আবার! দেখলে না কী বললো? দশ গুণ বেশি বোনাস পাবো আমি। মানে ওকে যা মেরেছি তার থেকে দশ গুণ বেশি। ওর তো শুধু একটা হাত ভেঙেছি। আমার তো ভাঙা হবে দুটো হাত। সাথে দুই পা। শরীরের আরও কী কী যে ভাঙা হবে তা তো আমার নিজেরই ধারণার বাইরে।”

“তোমার ভয় করে না এমন মারামারি?”

“ভয়? ভয় কীসের? জীবনে এ রকম একটা দুটো ভাঙা ভাঙির গল্প না থাকলে সেটা আবার কোনো জীবন হলো?”

“তোমাদের মাঝে এরকম মারামারির সম্পর্ক হওয়ার কারণ কী?”

“সে অনেক কাহিনী। এরকম ভাবে বলা যায় না। আমার এই কাহিনী আমি শুধু তাকেই শোনাবো, যে শুধু আর শুধুই আমার। তোমাকে কেন শোনাবো? তুমি কি আমার তেমন কোনো মানুষ?”

জোহানের কথায় মিতুল থমকে গেল। বুকের ভিতরটা অকারণেই ঢিপঢিপ শুরু করলো। জোহানের কথাটা কানে বাজছে।
‘তুমি কি আমার তেমন কোনো মানুষ?’

মিতুল ভাবনায় পড়ে গেল। কেমন মানুষ ও জোহানের?

______________

রুম ঝাপসা অন্ধকার। টিম টিম করে ড্রিম লাইট জ্বলছে। বাড়ির সবাই এখন ঘুমে আচ্ছন্ন। মিতুলের চোখ কেবল লেগে এসেছিল ঘুমে। এর মাঝেই আবার ফোন বেজে ওঠার শব্দে ঘুম ভেঙে গেল।
ও বালিশের পাশ হাতড়ে মোবাইলটা খুঁজে বের করলো। চোখ না মেলেই আন্দাজের উপর ফোন রিসিভ করে ঘুম ঘুম কণ্ঠে বললো,
“হ্যালো!”

“হেই তুলতুল, ঘুমাচ্ছ তুমি?”

“হু স্পিকিং?” ঘুম ঘুম কণ্ঠেই বললো।

“আমাকে চিনছো না তুমি? এটা আমি। জো।”

“জো? জোহান?”

“হ্যাঁ। ঘুম ছাড়ো। তাড়াতাড়ি হলরুমে এসো।”

জোহানের কথা শুনে মিতুলের ঘুম চলে গেল।
“হলরুমে আসবো কেন?”

“সাইক্লিং করবো আমি। তুমি থাকবে আমার সাথে।”

“এই গভীর রাতে সাইক্লিং করবে তুমি?”

“গভীর রাত কোথায়? এটা তো কেবল ঘুমের প্রথম ভাগের সময়। তাড়াতাড়ি এসো।”
জোহান কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে ফোন কেটে দিলো।

মিতুল জোহানের এমন আচরণে খুব বিরক্ত। জোহান কী পেয়েছে ওকে? এই মাঝরাতে ফোন দিয়ে বলছে সাইক্লিং করবে? বললেই কি যেতে হবে না কি ওর? মিতুল যাবে না যাবে না করেও আবার যাওয়ার মনস্থির করলো। গায়ে একটা সোয়েটার চাপিয়ে বেরিয়ে পড়লো রুম থেকে।

হলরুমে ড্রিম লাইট জ্বলছে। সবকিছুই ঝাপসা। মিতুল সিঁড়িতেই দাঁড়িয়ে গেল। জোহানকে দেখতে পাচ্ছে না কোথাও। আশ্চর্য তো! নিজে আসতে বলে নিজেই এখন উধাও? মিতুলের মেজাজ ক্রমশ খারাপ হয়ে যাচ্ছে। কেন আসতে গেল এখানে? কী দরকার ছিল এখানে আসার? এই জোহান তো কখনোই…

“হেই তুলতুল!” পিছন থেকে একটা ফিসফিসে কণ্ঠ কানে আসতেই মিতুল প্রায় লাফিয়ে উঠলো। জান বেরিয়ে গিয়েছিল ক্ষণিকের জন্য ওর। পিছন ফিরে তাকাতেই দেখলো জোহান মুখ চেপে হাসছে। ওর সাথে এমন করে মজা করলো জোহান? মিতুলের রাগ হলো। রেগে গিয়ে একটা ঘুষি বসিয়ে দিলো জোহানের বুকে। জোহান ‘আহ’ করে একটু শব্দ করে ঘুষি মারা জায়গাটায় হাত বুলাতে লাগলো। মিতুলকে ভ্রু নাচিয়ে নিচু স্বরে জিজ্ঞেস করলো,
“কী? ভয় পেয়েছিলে?”

“না। খুব মজা পেয়েছিলাম।”
জোহান মিতুলের কথার তেজটা বুঝতে পারলো।
জোহান হঠাৎ নিজের একটা হাত বাড়িয়ে দিলো মিতুলের দিকে।

মিতুল জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
“কী?”

“হাত ধরো।”

“কেন?”

“সিঁড়ি থেকে পড়ে যেতে পারো।”

“তোমাকে কেউ বলেছে যে আমি পড়ে যাব? অগ্রিম কথা বলো কেন?”

জোহান নিজের হাত গুটিয়ে নিয়ে বললো,
“তাহলে আমার পিছন পিছন এসো।”
বলে জোহান ধীরে ধীরে পা ফেলে নামলো।
মিতুল নামলো ওর পিছন পিছন। সদর দরজা দিয়ে বের হলো না ওরা। ব্যাক ডোর থেকে বের হয়ে গার্ডেন ঘুরে গ্যারেজে এলো। গ্যারেজের এক পাশে একটা সাইকেল রাখা। জোহান সাইকেলটা ড্রাইভ ওয়েতে নিয়ে এলো। মিতুলকে পিছনে উঠে বসতে বললো। মিতুল সাইকেলে উঠে জোহানের কাঁধে এক হাত রেখে বসলো।
জোহান সাই করে সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে এলো বাড়ি থেকে।
মুক্ত রাস্তা, আর মুক্ত রাতের হাওয়া! মিতুল বুক ভরে নিঃশ্বাস নিলো।
চলে এলো অনেক দূর। জোহানের সাথে আজকে বের না হলে একদম ভুল হয়ে যেত। শান্ত রাতের এডমন্টনকে দেখা হতো না ওর। আরও একটু সামনে এগোলেই মিতুলের চোখে পড়লো রাস্তার পাশে কিছু লাল রঙের ফুল। ফুলগুলোর কাছাকাছি আসতেই মিতুল এক হাত বাড়িয়ে একটা ফুল তুলে নিলো। ফুল তোলা হাতটা নিয়ে গিয়ে জোহানের বুকের বাম পাশের পকেটে ঢুকিয়ে দিলো ফুলটা।
সঙ্গে সঙ্গেই থেমে গেল চলন্ত সাইকেলটা। পিছন ফিরে তাকালো জোহান। জোহানের চোখে চোখ পড়তেই মিতুল ঘাবড়ে গেল। জানতে চাইলো,
“কী?”

জোহান কিছু বললো না। মিতুলের চোখের দিকে তাকিয়ে থেকে মুচকি হেসে বললো,
“বোকা মেয়ে!”

“কী?” অবুঝ প্রশ্ন করলো মিতুল।

জোহান সামনে তাকিয়ে আবারও সাইকেল চালু করলো। জোরে একটা শ্বাস ফেলে কিছুটা উচ্চঃস্বরেই বললো,
“একটা বোকা মেয়ে এই নির্জন রাতে আমার হৃদয় বরাবর ফুল গুঁজে দিয়েছিল, বাড়িয়ে দিয়েছিল আমার হৃদস্পন্দন। এটা কখনো ভুলবো না আমি। এই মুহূর্ত ভোলা সম্ভব নয়।”

(চলবে)

#চেরি_ব্লসমের_সাথে_এক_সন্ধ্যা
#পর্ব: ২৫
#লেখা: ইফরাত মিলি

____________

মিতুলের মন ছটফট করছে। বোকা মেয়ে! জোহান কেন ওকে বার বার বোকা বলছে? কী বোকামি করেছে ও? কালকে রাতে বোকা বললো, এর আগেও বোকা বলেছে! ও কী বোকামি করেছে নিজেই জানে না সেটা। অথচ জোহান ওকে বার বার বোকা বলছে! বোকাই যখন বলছে, তখন কী বোকামি করেছে সেটা কেন বলছে না? না না এভাবে তো চলতে দেবে না ও। জেনেই ছাড়বে কেন ওকে বার বার বোকা বলে ডাকা হচ্ছে।
মিতুল রুম থেকে বের হয়ে প্যাসেজওয়ে ধরে ধীর পা ফেলে জোহানের রুমের সামনে এলো। এখন ভোর সকাল। নিচ তলায় টুং টাং শব্দ হচ্ছে। ক্যামিলা উঠে গেছে বোধহয়। আর কেউ উঠেছে কি না সেটা ওর বোধগম্য নয়। জায়িন, সাদাত আঙ্কল উঠলেও এখন তারা বাইরে গিয়ে এক্সারসাইজ করছে। রেশমী আন্টিকে এত সকালে কখনোই রুম থেকে বের হতে দেখেনি। মিতুল খুব আস্তে জোহানের রুমের দরজায় করাঘাত করলো। এই আওয়াজ বোধহয় ঘুমন্ত জোহানের কান পর্যন্ত পৌঁছাতে পারেনি। মিতুল আবারও করাঘাত করলো। যেই সেই এক। রুমের ভিতর নিস্তব্ধতা। মিতুল এবার দরজায় জোরে একটা ঠ্যালা দিলো। ও ভাবেনি যে দরজাটা খুলে যাবে। কিন্তু দরজা খুলে গেল। রুম অন্ধকার। জানালা বন্ধ, পর্দা টানা। গ্লাস আর পর্দার ভিতর দিয়ে একটু ঝাপসা আলোক আভা ঢুকে রুমটাকে কোনো রকম ভাবে একটু দেখার উপযোগী করে তুলেছে। মিতুল সেই আভাতেই লক্ষ করলো জোহান রুমে নেই। ওয়াশরুমে আছে? মিতুল ওয়াশ রুমের দিকে এগিয়ে এলো। ওয়াশরুমেও নেই। কোথায় গেছে এই সাত সকালে? জগিংএ গেছে না কি? ওর কেন যেন মনে হলো জগিংএ যায়নি।
মিতুল একবার গ্যারেজ চেক করতে এলো। গ্যারেজে ওর গাড়ি সস্থানে দাঁড়িয়ে আছে। সাইকেলটাও দেখা যাচ্ছে। গেল কোথায় তাহলে? মিতুলের হঠাৎ জোহানের টাইম হাউজের কথা মনে পড়ে গেল। মনে হলো ওখানেই আছে। কিন্তু রাতে সাইক্লিং শেষে তো বাড়িতেই এসেছিল। তাহলে ওখানে গেল কখন? একবার গিয়ে দেখবে টাইম হাউজে? যেই ভাবা সেই কাজ।
মিতুল পথ ধরলো টাইম হাউজের। আজকে এই জঙ্গল পেরিয়ে যেতে ওর মোটেই ভয় করছে না। ভয়টা একেবারেই কেটে গেছে। গাছপালার ফাঁক ফোকর দিয়ে সূর্যটা উঁকি দিচ্ছে। পথঘাট সব পরিষ্কার ভাবেই দেখা যাচ্ছে। গাছে বসে কয়েকটা পাখি ডাকাডাকি করছে। মিতুলের আগে ভয় করতো এই জঙ্গলের পাখির ডাক। জঙ্গল নিয়ে একটা উদ্ভট চিন্তা ছিল বলেই এমন হতো। এখন আর ভয় হয় না।

জোহানের টাইম হাউজে এসে গেছে। দরজা ভিতর থেকে বন্ধ। তার মানে এখানেই আছে জোহান। দরজা বন্ধ, জানালা বন্ধ। সবসময় কেন দরজা-জানালা বন্ধ রাখতে হবে? কেউ কি এই জঙ্গলের ভিতরের টাইম হাউজ থেকে ওর সবকিছু চুরি করে নিয়ে যাবে? না কি দরজা খোলা থাকলে বাঘ, ভাল্লুক ঢুকে ওকে খেয়ে ফেলবে? কোনটা হবে?
মিতুল এবার দরজায় একের পর এক জোরে করাঘাত করতে লাগলো। জোহানের ঘুম ভাঙিয়ে ছাড়বে ও। ওর ঘুম কেড়ে নিয়ে নিজে এখন নাক টেনে ঘুমাচ্ছে? এখনই ওর শান্তিময় ঘুম ভাঙিয়ে দেবে। মিতুল দরজায় একটানা আঘাত করে যেতে লাগলো। বেশ ভালোই শব্দ হচ্ছে। তাও আবার অসহ্যকর শব্দ।
অনেক করাঘাত, ডাকাডাকির পর দরজাটা খুললো অবশেষে। এক ঘুম ঘুম চোখের বাচ্চা বাচ্চা চেহারা এসে উপস্থিত হলো দরজার ওপাশে।
জোহানের অকালে ঘুম ভেঙে যাওয়া চেহারা দেখে মিতুল মনে মনে বেশ শান্তি অনুভব করলো।
জোহান নিভু নিভু চোখে তাকিয়ে বললো,
“তুমি? এখানে এসেছো কেন?”

মিতুল আর কোনো ধৈর্যই ধরলো না। ফট করে বলে ফেললো,
“আমাকে বোকা বলো কেন? কী বোকামি করেছি আমি? কেন বার বার বোকা বলে ডাকা হয় আমাকে?”

“এই কথা জিজ্ঞেস করার জন্য এভাবে আমার ঘুমটা ভেঙে দিলে?” জোহানের চোখে-মুখে বিরক্তির গাঢ় ছাপ। নিজের বিরক্তি মুখ নিয়ে জোহান এসে কাউচের উপর বসলো।

মিতুলও ঢুকলো পিছন পিছন। বললো,
“এটা আমার জানা জরুরি। যে কেউ আমাকে বোকা বলবে, আর আমি সেটা চুপচাপ মেনে নেবো, এমনটা তো হবে না। বলো, কীভাবে বোকা হলাম আমি?”

“জানি না।”
বলে কাউচ ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো জোহান। বেড রুমের দিকে এগিয়ে গেল।
মিতুলও ছুটে এলো ওর পিছন পিছন।
“জানো না মানে? আমাকে বোকা বলার অধিকার কে দিয়েছে তোমাকে? বোকা বলে এখন আর কিছুই জানো না? একেবারে সাধু তুমি, তাই না?”

জোহান থেমে গেল। সাথে সাথে থেমে গেল মিতুলও। জোহান পিছন ফিরে বললো,
“লিসন, আমি এখন ওয়াশরুমে ঢুকবো ফ্রেশ হওয়ার জন্য। তুমি লিভিং রুমে গিয়ে বসো। না কি তুমিও আমার সাথে ওয়াশরুমে ঢোকার সিদ্ধান্ত নিয়েছো?”

জোহানের কথা শুনে মিতুল দমে গেল।
“কীসব বলছো? আমি তোমার সাথে ওয়াশরুমে ঢুকবো কেন?”
মিতুল বেরিয়ে এলো বেডরুম থেকে।
কিছুক্ষণ বসার পরই জোহান এলো। ওর কাছে এলো না, ঢুকে গেল কিচেনে। তারপর আবার দরজায় এসে ওকে ডাকলো,
“এদিকে এসো।”

“কেন? আবারও কফি বানিয়ে দিতে হবে তোমাকে? আগেই বলে রাখি, আমি আর কফি বানিয়ে খাওয়াতে পারব না তোমাকে। ভুলে গেছো, আগের বার কফি বানিয়ে খাওয়ানোর প্রতিদানে তুমি আমার বদনাম করেছিলে? বলেছিলে আমার বানানো কফি খারাপ, ভালো নয়। তবে এখন আবার কফি বানানোর জন্য কেন ডাকছো?”

“কে বললো যে কফি বানাতে ডাকছি তোমাকে? এত বেশি বোঝো কেন? আসতে বললাম, আসো।”

মিতুলের মুড গুরুতর খারাপ হয়ে গেল। আদেশের সুরে কথা বলছে ওর সাথে? নিজের দাসী ভাবে না কি ওকে?
মিতুল নিজের রাগকে কোনো রকম সংযত করে কিচেনে এলো। কিচেনে এসেই চোখ চলে গেল কিচেনের ব্যাক সাইডে থাকা দরজার দিকে। মিতুল দরজার কাছে এসে দাঁড়ালো। এখানে যে একটা দরজা আছে সেটা আগে খেয়াল করা হয়নি তো। বাড়ির পিছনটা দেখা যাচ্ছে। বাহ, ভালোই তো।

“ওখানে কী দেখছো? এদিকে আসো।”

মিতুল জোহানের কাছে চলে এলো।

“মেশিনে কফি তৈরি করতে পারো না তুমি, তাই না?”

মিতুল না বোধক মাথা নাড়লো।

“ঠিক আছে, আমি শেখাবো তোমায়।”

মিতুল প্রফুল্ল হয়ে উঠলো।
“সত্যি?”

“সত্যি নয়তো কি মিথ্যা? তোমার সাথে মিথ্যা বলবো কেন আমি? মিথ্যা বললে কি তুমি আমায় পারিশ্রমিক হিসেবে ডলার দেবে?”

জোহান মিতুলকে মেশিনে কীভাবে কফি বানাতে হয় সেটা দেখিয়ে দিলো। খুবই সহজ মেশিনে কফি বানানো। জোহানের কফি বানানো হয়ে গেছে। জোহান কফির মগ দুটো টেবিলে রাখতে রাখতে বললো,
“এখানে এসে বসো।”

মিতুল জোহানের সম্মুখ চেয়ারটায় বসলো।
কফির মগে এক চুমুক দিতেই জোহান হঠাৎ জিজ্ঞেস করলো,
“আমার টাইম হাউজটা কেমন?”

মিতুল এদিক-ওদিক চোখ বুলাতে বুলাতে বললো,
“হুম ভালো।”

“ইউ নো, আমার যখন বিয়ে হবে তখন আমি আমার ওয়াইফকে নিয়ে এখানে থাকব। এটা হবে তার এবং আমার নিজস্ব ছোট্ট একটি কুঠুরি।”

মিতুল জোহানের দিকে তাকিয়ে মনে মনে ভাবতে লাগলো,
“আরে বদমাইশ, তোর আবার বিয়েও হবে না কি? কে করবে তোকে বিয়ে? তোকে বিয়ে করার থেকে তো কচু গাছের সাথে ফাঁসি দেওয়াও বেটার বলে মনে করি আমি। যে মেয়ে তোকে বিয়ে করবে তার জীবন তো অকালে ধ্বংস হবে।”

মনে মনে এসব ভাবলেও মুখে বেশ আহ্লাদী ভাবে বললো,
“ও মা…তাই না কি?”

জোহান মাথা নাড়িয়ে বললো,
“হুম। কিন্তু আমি ভাবছি, আমরা দুজন না হয় এই ছোট্ট ঘরেই এডজাস্ট করে নিতে পারব। কিন্তু যখন আমাদের বেবি হবে, তখন? তখন কি এই ছোট্ট ঘরে বেবি নিয়ে থাকা যাবে? আমার এই ছোট্ট ঘরে বেবিটি খেলা করবে কোথায় বসে? খেলার জন্য তো একটা বড়ো-সড়ো জায়গা দরকার। আমার টাইম হাউজে তো তেমন জায়গা নেই।”

“তোমার টাইম হাউজে জায়গা নেই তো কী হয়েছে? টাইম হাউজের বাইরে তো আছে। বিশাল এক জঙ্গলে বাস করো তুমি। এখানে কি জায়গার অভাব আছে? নিজের বেবিকে জঙ্গলে ছেড়ে দেবে। তোমার বাচ্চা এই বিস্তর জঙ্গলে দৌঁড়াদৌঁড়ি করে খেলবে। সাথে তুমি এবং তোমার ওয়াইফও দৌঁড়াদৌঁড়ি করবে। এই জঙ্গলের ভিতর বসে লিখবে এক অনন্য সংসার কাহিনী।”

জোহান মিতুলের কথার বিদ্রূপটা ধরতে পারলো না। বললো,
“তাহলে বলছো আমার এই ছোট্ট ঘরে বউ-বাচ্চা নিয়ে থাকতে আমার কোনো সমস্যা হবে না?”

মিতুল একটু হাসার চেষ্টা করে বললো,
“হুম, কোনো সমস্যাই হবে না।”
কথাটা বলে মনে মনে জোহানকে ‘আহাম্মক’ বলে গালি দিলো।

___________

জোহানের সাথে একই সাথে বাড়ি ফিরলো মিতুল। জোহান বাড়ি ফিরেই রেডি হয়ে কোথাও একটা বেরিয়ে গেল।
মিতুল রেশমী আন্টির সাথে ব্রেকফাস্ট করতে বসলো। ব্রেকফাস্টের সময় জায়িনের অনেক গুণগান গাইলেন রেশমী আন্টি। এই যেমন– জায়িন তার খুবই বাধ্য ছেলে, সব কিছুতেই অনেক পারদর্শী জায়িন। লেখাপড়ায়ও খুবই ভালো ছিল, খুব অল্পতেই চাকরিতেও অনেক ভালো করেছে। উনি এমন ছেলের মা হতে পেরে সত্যিই অনেক গর্বিত। আরও অনেক কিছু বললো।
মিতুলের এসব শুনতে কেন জানি ভালো লাগছিল না। তবুও বাধ্য মেয়ের মতো মুখে হাসি ফুঁটিয়ে রাখলো। কারণ, মায়ের কড়া আদেশ মুখ গোমড়া করে রাখবে না কখনো। রেশমী আন্টি শুধু জায়িনের প্যাঁচালই পারছিলেন। জোহানের কথা একবারও মুখে আনেননি। তা দেখে মিতুল বললো,
“তোমার বড়ো ছেলে খুব ভালো তা তো বুঝলাম আন্টি, কিন্তু তোমার ছোটো ছেলে?”

মিতুলের কথায় যেন অপ্রস্তুত হয়ে পড়লেন রেশমী। কিন্তু পরপরই আবার মুখে দীর্ঘ হাসি ফুঁটিয়ে বললেন,
“ওর কথা আর কী বলবো? ও তো পাগল! দেখো না কোনো কাজকর্ম নেই, সারাদিন শুধু বন্ধু-বান্ধব নিয়ে হৈ-হুল্লোড় করে বেড়ায়। কোনো কথা শোনে না। লোকের কাছে বলার মতো আছে কিছু ওর সমন্ধে? কী বলবো বলো তো?”

রেশমী আন্টির কথা ঠিক পছন্দ হলো না মিতুলের। লোকের কাছে তো অবশ্যই জোহানের সমন্ধে বলার কিছু আছে। জোহান তো ভালো গান করে। অ্যালবামও বের হয়েছে ওর। এসব তো বলাই যায়। তাছাড়া জোহানও তো ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট। জোহানের মুখেই শুনেছিল এ কথা। এটাও তো বলতে পারতেন রেশমী আন্টি। মিতুল এ নিয়ে আর কথা বাড়ালো না রেশমী আন্টির সাথে। ঠিক স্বস্তি অনুভব করছে না জোহানকে নিয়ে কথা বলতে। তাই চুপচাপ ব্রেকফাস্ট সেরে লনে চলে এলো। মোবাইলে টাইম দেখলো একবার। নয়টা বাজে। বাংলাদেশে খুব বেশি রাত হয়নি এখন, নয়টা বেজেছে। এডমন্টনে এখন সকাল নয়টা, আর বাংলাদেশে রাত নয়টা। মিতুল ভাইদের কাছে কল দিলো।
ভিডিয়ো কলে অনেকক্ষণ কথা বললো দুই ভাইয়ের সাথে। একসাথেই দুই ভাইয়ের সাথে কথা হচ্ছে ওর। বড়ো ভাই এক সময় কথায় কথায় মজা করে বললো,
“কানাডা থেকে নিজের বর খুঁজে নিয়ে আয়।”

ভাইয়ের কথা শুনে মিতুল লজ্জায় লাল হয়ে গেল। কার্লের কথা মনে পড়ে গেল ওর। ভাইদের কাছে ও সব ব্যাপারই শেয়ার করে। কিন্তু কার্লের ব্যাপারটা কিছুতেই শেয়ার করতে পারেনি। শত হলেও বড়ো ভাই তারা। বড়ো ভাইদের কাছে কি আর নিজের পছন্দ এত সহজ ভাবে বলে দেওয়া সম্ভব?

মিতুল যখন লজ্জাতে মাথা নত করে রেখেছিল ভাইদের সামনে, ঠিক সেই সময় জোহান কোত্থেকেই যেন উপস্থিত হলো এসে। মিতুলের হাতের মোবাইলটা ছোঁ মেরে নিয়ে নিলো।
জোহানের হঠাৎ এমন কাণ্ডে চমকে গেল মিতুল। চমকে গেল ভিডিয়ো কলে থাকা ওর দুই ভাইও। জোহানের সামনে একেবারে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল দুজনে।
জোহান মোবাইলটা নিজের সামনে ধরে মিতুলের দিকে তাকিয়ে বললো,
“হেই তুলতুল, তোমার বয়ফ্রেন্ড আছে? নিজের বয়ফ্রেন্ডের সাথে কথা বলছো তুমি? কই আগে বলোনি তো!”

জোহানের কথায় লজ্জায় চোখ, কান কাটা গেল মিতুলের। নিজের ভাইদের সামনে এ কী বললো জোহান?

মোবাইল স্কিনে তাকিয়ে জোহানের ভ্রু কুঁচকে এলো।
“কিন্তু এখানে দুজন কেন? এই দুজনের মাঝে তোমার বয়ফ্রেন্ড কে?”

জোহানের কথা শুনে মিতুলের ভাইদের মুখ হা হয়ে গেল।

এদিকে মিতুলের অবস্থাও একই। এসব কী বলছে জোহান? নিজের আপন ভাইদের…

জোহান অগাধ বিস্ময়ে তাকালো মিতুলের দিকে।
“কী হলো বলছো না কেন? কে তোমার বয়ফ্রেন্ড?”

মিতুল ঠোঁটে আঙ্গুল দিয়ে জোহানকে চুপ করার জন্য ইশারা করলো।

কিন্তু জোহান কি আর চুপ করে! জোহান মিতুলের দিকে সন্দিহান দৃষ্টি মেলে তাকালো। আতঙ্কিত কণ্ঠে বলে উঠলো,
“হেই তুলতুল! এরা দুজনই তোমার বয়ফ্রেন্ড নয়তো?”

জোহানের কথা শুনে মিতুলের চোখ যাও কপালে ওঠা বাকি ছিল, তাও উঠলো এবার। ও দ্রুত জোহানের হাত থেকে মোবাইলটা কেড়ে এনে কল কেটে দিলো।

“একি… এ কী করেছো তুমি? কল কেটে দিলে কেন? তোমার বয়ফ্রেন্ডদের সাথে পরিচিত হতাম আমি। এরকম আচরণ করা একেবারেই উচিত হয়নি তোমার।”

মিতুলের মাথায় রক্ত উঠে গেছে।
“চুপ, একদম চুপ! কে বলেছে তোমাকে যে এরা আমার বয়ফ্রেন্ড? এরা আমার ভাই। আমার আপন ভাই।”

জোহান বুঝদারের মতো বললো,
“ওহ…ভাই? সেটা আগে বললেই পারতে। তাহলে তো এমন মিসআন্ডারস্ট্যান্ডিং হতো না আর!”

“কী করে বলবো? কী করে বলবো আমি? তুমি বলার কোনো সুযোগ দিয়েছো? তোমাকে এত অগ্রিম ভাবতে কে বলে? টুপ করে আমার ভাইদের আমার বয়ফ্রেন্ড ভাবা এটা কোন ধরনের চিন্তা-ভাবনা তোমার? এ কেমন ফালতু চিন্তা ভাবনা নিয়ে থাকো তুমি?”

“বুঝতে পেরেছি আমি, আমার একটা ভুল হয়ে গেছে। এখন কী করবো? তোমার ভাইদের কাছে কল দাও আবার। তাদেরকে স্যরি বলি এবং পরিচিত হই। দাও, কল দাও আবার।”

“থাক থাক কোনো দরকার নেই। তোমাকে বিশ্বাস নেই আমার। তুমি কী বলতে গিয়ে কী বলবে…বাদ দাও।”

মিতুল আবার ভাইদের কাছে কল দিতে রাজি না হলে, জোহান নিজেই মিতুলের মোবাইলটা আবারও ছোঁ মেরে নিয়ে এলো।

মিতুল বলে উঠলো,
“কী করছো তুমি?”

জোহান মিতুলের কোনো কথাই শুনলো না। ভিডিয়ো কল দিলো মিতুলের ভাইদের কাছে। কল রিসিভ করলেই জোহান হাত নাড়িয়ে বললো,
“হ্যালো ব্রাদারস! আমার জানা ছিল না যে তোমরা মিতুলের ভাই। আই অ্যাম স্যরি! আসো এখন তোমাদের সাথে পরিচিত হই। আই অ্যাম জোহান। জোহান ওরফে জো। চাইলে আমাকে জো, জোহান যেকোনো নামেই ডাকতে পারো। কোনো ব্যাপার না। এখন তোমাদের পরিচয় দাও।”

মিতুলের ভাইয়েরা প্রথমে একটু ঘাবড়ে গিয়েছিল। ধীরে ধীরে আশ্বস্ত হয়ে নিজেদের পরিচয় দিলো। একজন হলো, মিলান হাসান এবং আরেকজন হলো নাবিল মাহমুদ।
মিতুলের ভাইদের সাথে অনেক সময় ধরে আরও নানান কথাবার্তা বললো জোহান।
তা দেখে মিতুলের রাগ ধীরে ধীরে কমে এলো। ভাইদের সাথে জোহানের কথা বলা থেকে মিতুল বুঝতে পারলো, জোহান সহজে মানুষের সাথে মিশতে পারে। জায়িনের মতো ওরকম অহংকারী নয় জোহান।
__________

বিকেলে পড়েছে সময়। মিতুলের পরনে জোহানের দেওয়া লাল লেহেঙ্গা। মাথায় লাল হিজাব। হাতে জোহানের দেওয়া লাল চুড়ি। কাঁধেও ঝুলিয়েছে জোহানের দেওয়া ব্যাগটা। আজকে সেজেছেও খুব সময় নিয়ে। হালকা একটু মেকআপ করতে করতেই আজকে অনেক সময় লেগেছে ওর। মনে হয়েছে আজকে যেন খুব যত্ন করে সেজেছে।

মিতুল এখন গ্যারেজে। জোহানের ব্ল্যাক কারটির সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বার বার হাতের ঘড়ি দেখছে। জোহানের আসতে এত দেরি হচ্ছে কেন? সারা বিকেলটাই দাঁড় করিয়ে রাখবে না কি এখানে? এমনি সময় দেখো, ওকে পাঁচ-দশ মিনিট করে সময় বেঁধে দিয়ে যায় রেডি হওয়ার জন্য। আর আজকে এত সময় নিয়ে রেডি হওয়ার পরও জোহানের আসার কোনো খবর নেই। ধুর ভালো লাগে না!
কী করছে জোহান? নিজের রূপচর্চা করাই কি শেষ হয়নি এখনও? সারাদিন রূপচর্চা নিয়েই ব্যস্ত থাকে। রূপচর্চা শুরু করলে দুনিয়ার আর কোনো হুঁশ খেয়ালই থাকে না মনে হয়। একটা মেয়েকে কীভাবে এরকম ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড় করিয়ে রাখতে পারে? কমনন্সেস নেই কোনো? মিতুলের আর ভালোই লাগছে না। অস্থির অস্থির লাগছে কেমন। কী করবে? একবার গিয়ে দেখবে জোহান কী করছে? জোহানের কাছে যাওয়ার কথা ভাবলেই দেখতে পেল জোহান গুনগুন করতে করতে গ্যারেজের দিকে এগিয়ে আসছে। জোহানকে দেখা মাত্রই মিতুলের এতক্ষণের সকল অভিযোগ হাওয়া হয়ে গেল। মন কেমন ভালো হয়ে গেল ওর। মিতুলের এক্সাইটমেন্ট হচ্ছে। জোহান আজকে ওকে দেখে কী বলবে? জোহানের দেওয়া লেহেঙ্গা পরেছে। চুড়ি পরেছে। রুমে বসে আয়নাতে দেখেছে নিজেকে নিজে, বেশ সুন্দরই লাগছে। জোহান এসেই যদি আজকে ওর প্রশংসা করে বসে? যদি বলে,
‘বাহ মিতুল! আজকে তোমাকে খুবই সুন্দর লাগছে দেখতে।’ তখন কী করবে ও? কী করা উচিত তখন? খুবই মিষ্টি করে বলা উচিত কি, ‘থ্যাঙ্ক ইউ, জোহান!’? উহ, কী করা উচিত? ভেবে পাচ্ছে না ও।
জোহান প্রায় কাছে এসে গেছে। মিতুলের লজ্জা লাগছে। মাথা একটু নিচু করে রেখেছে। এই তো এখনই জোহান প্রশংসা করবে ওর। হ্যাঁ, আর এক পা বাকি। এক পা এগিয়ে এসেই জোহান বলবে…

“সরো। এখানে দাঁড়িয়ে আছো কেন? দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকলে উঠবো কীভাবে আমি? সরে যাও এখান থেকে।” জোহানের কথা কানে আসতেই মিতুলের মাথায় হাজার টুকরো কাচ ভেঙে পড়লো। মিতুল চোখ তুলে তাকালো জোহানের দিকে। মুখ থেকে অস্ফুট স্বরে বেরিয়ে এলো,
“কী?”

জোহান মিতুলের এক হাত ধরে সরিয়ে দিলো দরজার কাছ থেকে ওপাশে। তারপর ভিতরে উঠে বসলো।

মিতুল জোহানের এমন আচরণে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেল। জোহান কী করলো এটা? প্রশংসা করার বদলে এটা কী করলো?

মিতুলের মন খারাপ হয়ে গেল। গাঢ় কালো মেঘ জমতে লাগলো মনে। জোহান প্রশংসা করলো না ওর? কেন করলো না? এই পোশাকে কি ভালো লাগছে না দেখতে? এই পোশাকও কি পছন্দ নয় জোহানের? পছন্দ না হলে কিনে দিয়েছিল কেন? কেন দিয়েছিল? মিতুলের কান্না কান্না পাচ্ছে। এত যত্ন করে সাজলো, অথচ জোহান…

“কী হলো গাড়িতে উঠে বসছো না কেন?” সামনে থেকে জোহানের কড়া কণ্ঠ শোনা গেল।
জোহানের এমন কড়া কণ্ঠ এবার রাগিয়ে তুললো মিতুলকে। ও হিল পায়ে গটগট করে এসে গাড়িতে বসলো। রাগে সিটবেল্ট বাঁধলো না।
জোহান গাড়ি স্টার্ট দিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো।
মিতুল মনে মনে ক্ষুব্ধ, ভীষণ ক্ষুব্ধ। মুখ থেকেও ক্ষুব্ধ বুলি ছুটালো এবার ,
“তোমার কি কোনো কমনসেন্স নেই? তোমার কোনো ধারণা আছে আমি কতক্ষণ তোমার জন্য অপেক্ষা করেছি গ্যারেজে? একটা মেয়েকে কীভাবে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করাতে পারো তুমি? হিতাহিত জ্ঞান নেই তোমার? জ্ঞানশূন্য তুমি?”

জোহান অবাক হয়ে বললো,
“ঘণ্টার পর ঘণ্টা? মানে কী? মাত্র সাত মিনিট অপেক্ষা করে সেটাকে তুমি ঘণ্টার পর ঘণ্টা বানিয়ে দিলে? তোমরা বাংলাদেশি মেয়েরা কি সময়ের হিসাবও জানো না ঠিকঠাক ভাবে?”

“আবার? আবারও বাংলাদেশ টানছো তুমি? তুমি এত বেহায়া কেন বলো তো? একটা জিনিস নিষেধ করলে সেই জিনিসটা আরও বেশি করে করো কেন বেহায়ার মতো? বেহায়াপনা কি তোমার একটা অভ্যাস না কি?”

“হুম। আগে ছিল না এই অভ্যাসটা। তোমার সাথে দেখা হওয়ার পর থেকেই এই অভ্যাসটা তৈরি হয়েছে। তুমি হচ্ছ এই অভ্যাস তৈরিকারী ভাইরাস।”

“কী? ভা…ভাইরাস? তুমি আমাকে ভাইরাস বললে? আমি ভাইরাস?”

“ভাইরাস নও? তাহলে কী? তাহলে কি তুমি ছত্রাক?”

জোহানের কথায় মিতুলের সর্বাঙ্গ জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়ে গেল। ভাইরাস? ছত্রাক? প্রথমে প্রশংসা তো করলোই না, আর এখন এসব কথা শোনাচ্ছে? মিতুলের ভীষণ কষ্ট লাগলো। কঠিন আকারে মনোক্ষুণ্ণ হলো। ও প্রতিবাদে আর কিছুই বললো না। উইন্ডোর দিকে মুখ করে বসে রইল নীরব। খারাপ! জোহান খুব খারাপ! জোহান যে এত খারাপ সেটা আগে জানতো না।

গাড়ির ভিতরে ঝেঁকে বসলো নিস্তব্ধতার রাজ্য। মিতুল যে উইন্ডো মুখো হলো, আর ফিরলো না।
জোহান একটু পরপর মিতুলের দিকে তাকাচ্ছে। মিতুলের ফুলো নাকটা দেখতে পাচ্ছে না। মুখ ঘুরিয়ে রেখেছে একেবারে। মিতুলের এমন নীরবতা দেখে জোহানের হাসি পাচ্ছে। ও জানে মিতুলের এমন করার মানে কী। গ্যারেজে থাকতেই সেটা টের পেয়েছিল। জোহান সেই মানেটা এবার কাটিয়ে দেওয়ার জন্য বললো,
“হিজাবে তুমি অনেক সুইট মিতুল!”

জোহানের কণ্ঠ কানে আসতেই সচকিত হয়ে উঠলো মিতুলের কান। কী বললো জোহান?

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here