চেরি_ব্লসমের_সাথে_এক_সন্ধ্যা,পর্ব: ০২

0
1200

#চেরি_ব্লসমের_সাথে_এক_সন্ধ্যা,পর্ব: ০২
#লেখা: ইফরাত মিলি
_____________

রেশমী আন্টিদের বাড়ির পিছনে যে এত সুন্দর গার্ডেন আছে সেটা আগে দেখেনি মিতুল। ফ্রেশ হয়ে হলরুমে নামার পর ব্যাক ডোরে চোখ পড়তে কী ভেবেই যেন বের হয়েছিল। বের হয়ে যা দেখলো তাতে মন অনেকখানি ভালো হয়ে গেছে। গার্ডেনের বেশির ভাগ জায়গাই ফুল গাছে ভরা। বসন্ত তাই সব গাছেই ফুল ধরে আছে। অনেক ফুলের নাম অজানা ওর।
গার্ডেনে আছে অনেক ফল ও শাক-সবজির গাছও। আপেল, স্ট্রবেরি, চেরি, কমলা, আঙ্গুর, গাজর, আনারস, লেবু, বাঁধাকপি, লেটুস, পালং, সুইস চার্ড আরও কত কী। ওদিকে গার্ডেনের শেষ প্রান্তে বড়ো একটা পাইন গাছের ডালে দড়িতে এক টুকরো কাঠ ঝুলছে। দোলনাটা অনেক আগের তৈরি মনে হচ্ছে। এ বাড়িতে আবার দোলনায় দোল খায় কে?
গার্ডেনের পিছন দিকটা ঝংলা টাইপের। বিশাল জঙ্গল বোধহয়। একটা সরু রাস্তার মতো দেখা যাচ্ছে। যেটা সোজা জঙ্গলের অন্ধকার রাজ্যের দিকে চলে গেছে। মিতুল কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল রাস্তাটার দিকে। ওই জঙ্গলের মধ্যে মানুষ যায়?
রেশমী আন্টির ডাক কানে এলো। সম্ভবত ব্রেকফাস্ট করার জন্য ডাকছেন। মিতুল ঘরে চলে এলো। ডাইনিং রুমে রেশমী আন্টি বসে আছেন। মিতুলকে দেখে হাসলেন তিনি। মিতুলও হাসলো মৃদু। রেশমী আন্টি অহংকারী হলেও তার হাসিটা বরাবরই প্রাণবন্ত মনে হয়। ওই হাসিতে কোনো অহংকারের ছোঁয়া নেই।

ক্যামিলা খাবার রাখছে টেবিলে। ব্রেড, জ্যাম, কফি, কেক, দুধ দিয়ে তৈরি এক ধরনের পানীয় এবং স্পেশাল একটা খাবার। স্পেশাল খাবারটির নাম জানা নেই মিতুলের। এর আগে দেখেনি কখনও। দেখে অনেক সুস্বাদু মনে হচ্ছে।
মিতুল রেশমী আন্টির সাথে ব্রেকফাস্ট সারতে লাগলো। আর কাউকে দেখা গেল না ডাইনিং রুমে। মিতুল একটা জিনিস লক্ষ্য করেছে, এই বাড়ির কারোর খাওয়া-দাওয়ার ঠিক নেই। যার যে সময় ইচ্ছা সে সেই সময় খায়। এক সাথে বসে খায় না সবাই। যেমন, আজকে সকালের মতোই কালকে রাতে ডিনারের সময় ডাইনিং টেবিলে কেবল ও আর রেশমী আন্টিই ছিল। বাকিরা হয় আগে খেয়েছে, নয়তো পরে।

রেশমী খাওয়ার এক পর্যায়ে বললেন,
“ভাবছি আজকে তোমায় নিয়ে ঘুরতে বের হবো। গত কালকে জার্নি করে এসেছিলে, ভাবছিলাম রেস্টে থাকো। আজকে বের হবো বাইরে। ব্রেকফাস্ট শেষে রেডি হয়ে থেকো।”

মিতুলের মন ভালো হয়ে গেল। আনন্দ হাওয়া বইল মনে। এটাই তো চায়। কানাডা এসেছে কি ঘরে বসে থাকার জন্য? ঘুরে বেড়াবে বলেই তো এসেছে। ও নিজের উত্তেজনা, উদ্দীপনা চেপে রেখে ভদ্র কণ্ঠে বললো,
“ঠিক আছে।”

মিতুল হোয়াইট কালারের কাপড়ের উপর হোয়াইট সুতোর এমব্রয়ডারি করা একটা শর্ট টপস এবং নেভি ব্লু রঙের জিন্স পরলো। আর গলায় একটা স্কার্ফ পেঁচিয়ে নিলো। চুলগুলো খোলা রেখেছে। মিতুলের চুল তেমন লম্বা নয়। চুলগুলো কোনো রকম কাঁধ বেয়ে একটু নিচে নেমেছে। ইচ্ছা করেই চুল লম্বা রাখে না। লম্বা চুল ভালো লাগে না ওর।
মিতুল নতুন কেনা এক জোড়া বুট পায়ে দিয়ে, কাঁধে সাইড ব্যাগ ঝুলিয়ে বের হলো।
প্যাসেজওয়ে ধরে আসার সময় ওর রুম থেকে একটা রুম রেখে পরে যে রুমটা রয়েছে, সে রুমের বন্ধ দরজার আড়াল থেকে গানের সাউন্ড ভেসে এলো কানে। উচ্চৈঃস্বরে গান বাজছে। এই রুমটা কার? ওই বদমাইশের হতে পারে।
মিতুল ক্যামিলার কাছ থেকে জেনেছে, কালকে ওকে ‘ননসেন্স, ইডিয়ট, সিক গার্ল’ বলা মদখোর ছেলেটা রেশমী আন্টির ছোটো ছেলে। একটা জিনিস ও কিছুতেই বুঝতে পারছে না, রেশমী আন্টির ছোটো ছেলে বিদেশিদের মতো দেখতে কেন? বাবা-মা দুজনই তো বাংলাদেশি, তাহলে সে ওরকম দেখতে কেন? সার্জারি করেছে? চুলে কালার করেছে? মিতুল আকাশ-পাতাল ভাবতে ভাবতে হলরুমে নেমে এলো।

রেশমী আন্টির পরনে খয়েরি রঙের লং গাউন এবং মাথায় খয়েরি হিজাব। রেশমী আন্টিকে দেখতে ইয়াং লাগছে। মনে হচ্ছে বয়স বাড়েনি। বয়স যেন ত্রিশের কোঠায় আটকে আছে। অথচ ওনার বড়ো ছেলের বয়সই আঠাশ বছর। রেশমী আন্টির মুখে চিন্তার ছাপ উপস্থিত। মিতুল নিস্তেজ গলায় বললো,
“আন্টি, এনিথিং রং?”

মিতুল যে কখন পাশে এসে দাঁড়িয়েছে তা খেয়াল করেননি রেশমী। তাই হঠাৎ করে মিতুলের কণ্ঠ তাকে চমকে দিলো। তিনি শুকনো মুখে বললেন,
“একচুয়্যালি, আমার কাজিন হিমানি অসুস্থ। আমাকে ফোন করে জানিয়েছে এইমাত্র। ওরা ক্যালগারিতে থাকে। আমাকে সেখানে যেতে হবে এখন। তোমাকে সাথে নিয়ে যেতে পারি, কিন্তু অপরিচিত ব্যক্তির উপস্থিতি ওদের ভালো লাগবে না। ওরা আসলে এমনই। আর তাছাড়া তোমারও সেখানে থাকতে বোরিং ফিল হবে।” রেশমী খানিক বিরতি নিলেন।

মিতুলের মনে হলো রেশমী আন্টি পেঁচিয়ে কথা বলতে জানেন না। যা বলার সরাসরিই বলেন। তা না হলে এমন একটা কথা কিছুতেই এত সহজ ভাবে বলতে পারতেন না। ওর একটু মন খারাপ হলো। কোথায় ভেবেছিল আজকে একটু ঘুরতে বের হবে। কিন্তু সেটা আর হলো না!

আবারও রেশমী আন্টির গলা শোনা গেল,
“তুমি চিন্তা করো না। বাইরে ঘুরতে নিয়ে যাওয়ার জন্য অন্য একজন মানুষ দিয়ে যাচ্ছি তোমাকে।”

“গুড মর্নিং মম!” সিঁড়ি থেকে নামতে নামতে মমের দিকে উইশ ছুঁড়লো জায়িন। তারপর হলরুমে পা রেখে মিতুলকেও গুড মর্নিং জানালো।
মিতুলও প্রতিউত্তরে হেসে গুড মর্নিং জানায়।

“আমার একটা কাজ করে দাও মাই বেবি!” রেশমী বিনয় নিয়ে বললেন ছেলেকে।

“কী কাজ?”

“মিতুলকে একটু বাইরে ঘুরতে নিয়ে যাও।”

জায়িন অবাকের তুঙ্গে উঠে বললো,
“তোমার কি মাথা খারাপ মম? আমি কীভাবে বাইরে ঘুরতে নিয়ে যাব ওকে? আমি পারব না…”

জায়িনের কথা গায়ে লাগলো মিতুলের। অপমান বোধ করলো জায়িনের এমন কথায়। এই পরিবারের মানুষ প্রত্যেক কথায় বোধহয় মানুষকে অপমান করার ক্ষমতা রাখে। এদের প্রত্যেক কথায়ই কেমন যেন একটা ভাব থাকে। মানুষকে যেন মানুষ বলে মনে হয় না এদের।

“আমার অফিস আছে। অফিস বাদ দিয়ে কাউকে ঘুরতে নিয়ে যাওয়ার সময় আমার নেই। তাছাড়া আজকে রাশিয়ান ক্লায়েন্টদের সাথে মিটিং আছে। সো, আমার হাতে বাড়তি কোনো সময় থাকবে না।” জায়িন পরাপর কথাগুলো শুনিয়ে গেল মমকে।

রেশমী খুব করে চাইছিলেন জায়িনের সাথে মিতুলকে পাঠাতে, কিন্তু সেটা সম্ভব হবে না। তাই রেশমীর মন খারাপ হলো।
কেউ কোনো কথা বললো না মধ্যমে।

জায়িনকেই আবার বলতে শোনা গেল,
“একটা কাজ করো, জোহানের সাথে পাঠিয়ে দাও ওকে। জোহান তো সারাদিন ঘুরেই বেড়ায় বাইরে বাইরে। ওর সাথে গেলেই ভালো হবে…আসছি আমি। আবার দেখা হবে।” জায়িন বেরিয়ে গেল।

জোহান নামটা অপরিচিত মিতুলের কাছে। জোহান কে? জায়িনের ছোটো ভাই? মানে, ওই বদমাইশটা?

জোহান গুনগুন করে গলায় ইংলিশ গানের সুর তুলে আঙুলের চরকায় কারের চাবি ঘুরাতে ঘুরাতে নেমে আসছিল। মিতুলকে এবং মমকে দেখেও সে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালো না। আনমনে গুনগুন করতে করতে এগিয়ে চললো দরজার দিকে। দরজা থেকে কিছুটা দূরে থাকতেই রেশমী ডাক দিলেন।

“জোহান!”

জোহানের পথ চলা থামলো। সেই সাথে থামলো আঙুলের চরকায় ঘোরানো গাড়ির চাবিও। নির্বিকার ভাবে পিছনে ফিরে বললো,
“হোয়াট?”

রেশমী ইংরেজদের মতো গলায় টোন তুলে জোহানের বোধগম্য ইংলিশে বললেন,
“কোথায় যাচ্ছ? ফ্রেন্ডসদের সাথে টাইমপাস করতে?”

“মম, আমি তো তোমাকে বলেছিলাম আমার ফ্রেন্ডস সার্কেলের সবাই গ্রামের ওদিকে পিকনিকে গেছে। ওরা কেউ নেই এখানে। শুধু আমি ছাড়া। কি বলিনি?”

মিতুল লক্ষ করলো জোহানের কথা বলার মাঝে কেমন যেন এক বিরক্তির সুর ফুঁটে ওঠে। যেন ওই সুরটা ছাড়া কথা বলতে পারে না সে। আর মিতুল কালকে জোহানকে পরিচিত মনে হওয়ার কারণটা ধরতে পেরেছে। জোহানের চেহারায় কিছুটা রেশমী আন্টির প্রতিফলন। যার কারণে কাল জোহানকে চেনা চেনা লাগছিল।

“ঠিক আছে, বুঝতে পেরেছি আমি। এখন আমায় একটি বিষয়ে সাহায্য করো।”

“হোয়াট’স দ্যাট?” আবারও নির্বিকার ভাবে প্রশ্ন করলো জোহান।

“ওকে নিজের সাথে নিয়ে যাও এবং শহরটি ঘুরিয়ে দেখাও।” রেশমী হাত দিয়ে মিতুলকে দেখিয়ে দিলো।

জোহান মমের হাত অনুসরণ করে তাকালো মিতুলের দিকে। ওর দিকে তাকিয়ে থেকে কী যেন ভাবলো একটু। তারপর কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললো,
“ও কে, নো প্রবলেম। লেট’স গো!” শেষের ‘লেট’স গো’ কথাটি মিতুলের উদ্দেশ্যে বললো। তারপর আঙুলে চাবি ঘোরাতে শুরু করে, গুনগুন করতে করতে বেড়িয়ে গেল ঘর থেকে।

মিতুল যতক্ষণে গ্যারেজে এসে পৌঁছলো, ততক্ষণে জোহান ড্রাইভিং সিটে বসে সিট বেল্টও বেঁধে ফেলেছে। মিতুল পিছনের সিটে বসার জন্য গাড়ির পিছনের দরজা খুলতেই সামনে থেকে জোহান গলা খাঁকারী দিয়ে বললো,
“হেই, এটাকে কি ট্যাক্সি পেয়েছো তুমি? সামনে এসে বসো।”

জোহানের এহেন আচরণে মিতুলের মেজাজ খারাপ হলো। এমনিতেই গত কালকের সন্ধ্যার ঘটনাটা মিতুলের চোখে এখনও জ্বালা ধরিয়ে দেয়। ও খোলা দরজাটা জোরে শব্দ করে বন্ধ করলো। বন্ধ দরজার কাছে দাঁড়িয়ে জোহানের দিকে তাকিয়ে অস্ফুটে বললো,
“বদমাইশ বেক্কল!”

মিতুল গাড়ির পিছন ঘুরে গিয়ে জোহানের ড্রাইভিং সিটের পাশের সিটে বসলো। ও সিটবেল্ট ঠিক মতো বাঁধতেও পারলো না, তার আগেই জোহান গাড়ি স্টার্ট দিয়ে গ্যারেজ থেকে ড্রাইভওয়েতে নামিয়ে ফেললো। মিতুল কোনো রকম সিট বেল্টটা লাগিয়ে নিলো তাড়াতাড়ি।

কোলাহলহীন শান্ত রাস্তায় জোহানের ব্ল্যাক কারটি এগিয়ে চলছে ধীর গতিতে। মিতুল ব্যস্ত উইন্ডো থেকে বাইরের পরিবেশ দেখতে। আশেপাশে শুধু রঙিন ফুলের ছড়াছড়ি। অনেক গাছ আছে যাতে কোনো পাতাই নেই, আছে শুধু ফুল। যেগুলো নিজেদের সৌন্দর্যের বাহার ছড়াচ্ছে।
কারের ভিতরে চলছে নীরবতা। গাড়িতে ওঠার পর কোনো কথা হয়নি দুজনের। জোহান রাস্তার বাম দিকে বাঁক নিয়ে প্রথম মুখ খুললো,
“হেই গার্ল, হোয়াট’স ইওর নেম?”

জোহানের প্রশ্নে মিতুল বাইরে থেকে দৃষ্টি এনে জোহানের মুখে নিক্ষেপ করলো। জোহানের বাদামি চুলগুলো কপাল জুড়ে পড়ে আছে। বাদামি চোখ জোড়া ঢাকা সানগ্লাসে। মিতুল চোখ সরিয়ে নিলো। সামনের গ্লাসের ভিতর থেকে সামনের দৃশ্যমান রাস্তাটাকে দেখতে দেখতে বললো,
“মিতুল দিলরাবা।”

“হোয়াট? হোয়াট ডিড ইউ সে? তুলতুল?”

মিতুলের শান্ত চোখ জোড়া হঠাৎ বিস্ফোরিত হয়ে উঠলো। তুলতুল? ওর এত সুন্দর নামটাকে পর্যন্ত ব্যঙ্গ করলো? কেমন মানুষ এরা? এরা কি পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করেছে কেবল মানুষকে অপমান করার জন্য? মিতুলের দাঁতে দাঁত লেগে এলো। ভিতরটা প্রস্তুত হলো কয়েকটি কঠিন কথা শোনানোর জন্য। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পারলো না। মায়ের কথা মনে পড়লো। মায়ের কানে কিছু গেলেই খবর হয়ে যাবে ওর। নিজেকে শান্ত রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করলো ও। কঠিন বুলি ছুটতে চাওয়া মুখটি খুব ভালো করে বোঝানোর চেষ্টা করলো,
“তুলতুল নয়। মিতুল। মি…তুল।”

“ওহ আচ্ছা, মি-তুল! নট ব্যাড। তুলতুলের থেকে ভালো আছে।”

মিতুল সন্দ্বিগ্ন চোখে তাকালো। ‘নট ব্যাড’ এবং ‘তুলতুলের থেকে ভালো আছে’ কথা দ্বারা কী প্রমাণ করতে চাইলো? ওর নামটা খারাপ?
হুহ্, এমন একটা ভাব করছে যেন নিজের নাম কত ভালো! নিজের নাম কী? নিজের নাম তো জোহান। যে নাম বাপ-দাদার জন্মেও শোনেনি কখনো। নিজে একটা অহেতুক নাম নিয়ে চলছে, আবার সে আসছে অন্যের নামকে ব্যঙ্গ করতে! মিতুল জোহানের অগোচরে ভেংচি কাটলো ওকে।

“কী করো তুমি?” আবারও জোহানের প্রশ্ন।

“কিছু না, লেখাপড়া করছি।”

“বাংলাদেশ থেকে এসেছো, তাই না?” কেমন গা ছাড়া ভাবে জিজ্ঞেস করলো।

“হ্যাঁ।”

জোহান এমন একটা ভঙ্গি করলো যেন বাংলাদেশ থেকে আসাটা নিছক একটা উটকো ব্যাপার ছাড়া আর কিছুই নয়। জোহান বিরক্ত ভরা কণ্ঠে বললো,
“এই বাংলাদেশি মানুষদের আমি একদমই পছন্দ করি না। এখানে অনেক বাংলাদেশি থাকলেও কোনো বাংলাদেশি বয়-গার্লদের আমি আমার ফ্রেন্ড সার্কেলে ঢুকাইনি। বাঙালিরা বোকা এবং নিষ্কর্মা হয়। এই জন্যই ওদের পছন্দ নয় আমার। অপছন্দ করি ওদের। আর সবচেয়ে বেশি অপছন্দ করি বাঙালি মেয়েগুলোকে। ওরা ছেলেদের থেকে অনেক বেশি বোকা হয়। গাধা টাইপের। ওদের মগজ বিক্রি করলে হাফ ডলারও পাওয়া যাবে না বোধহয়।”

জোহানের কথায় মিতুলের গায়ের রক্ত টগবগ করে উঠলো। কথাটি যে বিশেষ করে ওকে ইঙ্গিত করে বলেছে সেটা বুঝতে ওর এক সেকেন্ডও লাগলো না। এরকম কথা শোনানোর জন্যই বোধহয় এক বাক্যে নিজের সাথে ঘুরতে আনতে রাজি হয়েছে! মিতুল তীব্র ক্রোধের সাথে গর্জে উঠলো,
“হ্যাঁ, বাঙালি মেয়েরা তো গাধা টাইপের। ওদের মগজ বিক্রি করে হাফ ডলারও পাওয়া যাবে না। তুমি তো স্বয়ং বুদ্ধির ডিব্বা একটা। তুমি গিয়ে নিজের মগজ বিক্রি করে কোটিপতি হও না, কে নিষেধ করেছে তোমায়?”

মিতুলের চ্যাঁচানো কণ্ঠ শুনে অবাক হয়ে তাকালো জোহান।
“হ্যাঁ? কী? কী বলছো তুমি?”

মিতুল নিজের হুঁশে ফিরলো। এতটাই ক্ষুব্ধ ছিল যে বাংলা ভাষা বলে ফেলেছে? অবশ্য এতে স্বস্তি অনুভব করলো মিতুল। যাক, বাংলাতে বলায় কিছুই বুঝতে পারেনি মনে হয়। বাংলা ভাষায় অবগত নয় হয়তো। যদি অবগত হতো তাহলে ওর কপালে ভোগ নেমে আসতো। মিতুল দুই পাশে মাথা নেড়ে হাসার চেষ্টা করে বললো,
“নাথিং।”

জোহান চোখ সরিয়ে নিয়ে সামনে দৃষ্টিপাত করলো। কিছুটা ক্ষোভ নিয়ে বললো,
“বাংলাদেশের মানুষদের যেমন অপছন্দ করি, ঠিক তেমনি অপছন্দ করি বাংলা ল্যাঙ্গুয়েজটাকেও। বাজে ল্যাঙ্গুয়েজ একটা। ফ্যামিলি থেকে এই বাজে ল্যাঙ্গুয়েজটাই আবার বাধ্যতামূলক করেছে। ড্যাম ইট! সব সময় টপার স্টুডেন্ট ছিলাম। হাইয়েস্ট মার্ক ছিল সব কিছুতে। কিন্তু এই বাংলা ল্যাঙ্গুয়েজটা আমার সকল ইমেজ নষ্ট করে দিয়েছে। আমার এই চব্বিশ বছর লাইফের প্রায় তিন ভাগের এক ভাগ সময়টা আমি ছুটেছি এই বাংলা ল্যাঙ্গুয়েজের পিছনে। কিন্তু কী হলো? পাজি ল্যাঙ্গুয়েজটা কিছুতেই ঠিকঠাক ভাবে আমার আয়ত্তে এলো না। সামথিং যা শিখেছি তাও চর্চা না করলে ভুলে যাওয়ার মতো অবস্থা। স্প্যানিশ ল্যাঙ্গুয়েজ শিখতেও আমার এত ঝামেলা পোহাতে হয়নি। মাত্র কয়েক মাস লেগেছিল শিখতে। অথচ এই স্টুপিড ল্যাঙ্গুয়েজটা…”

মিতুলের হাত-পা রাগে নিশপিশ করছে। খুব করে ইচ্ছা করছিল জোহানের কথার মাঝে ওর দু গালে চব্বিশ মণ ওজনের দুটো চড় মারে। কিন্তু নিজের গাল দুটোর কথা ভেবেই আবার ইচ্ছা দমে যায়। জোহানের গালে চড় মারলে নিজের গাল দুটোও চড় খেয়ে লাল টমেটো হয়ে যাবে। মায়ের হাতের জোরের কথা মনে আছে। সেই ক্লাস ফাইভে বাংলায় কম মার্ক পাওয়ার কারণে চড় খেয়েছিল মায়ের হাতে। সে যে কী ব্যথা ছিল! মনে হতেই মিতুলের গা শিরশির করে উঠলো।

গাড়ি এসে চেরি ব্লসমের রাজ্যে প্রবেশ করলো। রাস্তার দুই পাশে দাঁড়িয়ে আছে কিছু চেরি ব্লসম ট্রি।
বাতাসের তালে তালে গাছ থেকে ঝরে পড়ছে চেরি ব্লসম পাপড়ি। আহ, কী মনোরম! কী নয়নাভিরাম!
মিতুল মুগ্ধ নয়নে চেরি ব্লসম ঝরে পড়া দেখছিল উইন্ডো থেকে। শখও জেগেছিল হাত বাড়িয়ে ছুঁয়ে দিক একটু পাপড়িগুলো। কিন্তু সেই সুযোগ ও পেল না। তার আগেই উইন্ডো কাঁচ ধীরে ধীরে উপরে উঠে উইন্ডো বন্ধ করে দিলো। কী হলো ব্যাপারটা? মিতুল চকিতে চাইলো জোহানের দিকে।
জোহান কণ্ঠে বিরক্তি ঝরিয়ে বললো,
“একদম ভালো লাগে না এই ঝরা ফুল। এত ধীর গতিতে ঝরে যে জাস্ট বিরক্তিকর!”

মিতুলের নাক রাগে ফুলে উঠলো। ওর বুঝতে বাকি নেই, আসলে ফ্যামিলির মধ্যে সবচেয়ে অহংকারী, হিংসুটে, পাজি মানুষটি হলো এই জোহান!

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here