#চেরি_ব্লসমের_সাথে_এক_সন্ধ্যা
#পর্ব: ৩০,৩১
#লেখা: ইফরাত মিলি
__৩০__________
আজকের দিন রোদ্রজ্জ্বল, ঝকঝকে। নায়াগ্রা ফলস দেখার জন্য এমন একটি দিনই সেরা। আবহাওয়ার পূর্বাভাসে দেখা গেছে আজকে সারাদিনই এমন রোদ থাকবে। মিতুল’রা দুপুরের দিকে বেরিয়ে পড়লো নায়াগ্রার উদ্দেশ্যে। টরোন্টোর একটি হোটেলে উঠেছে ওরা। এখান থেকে নায়াগ্রা পৌঁছতে এক ঘণ্টা ত্রিশ মিনিটের মতো লাগলো। টরন্টো থেকে নায়াগ্রার অবস্থান প্রায় ১৩০ কিলোমিটার দূরে।
নায়াগ্রা এলাকায় প্রবেশ করার পর মিতুলের চক্ষু চড়কগাছ। জলপ্রপাত কোথায়? সারি সারি ভবন, ক্যাসিনো, হোটেল-মোটেল, নানা রঙ-বেরঙের আয়োজন চারপাশে। অন্য এক ঝকঝকে শহর। কিছুক্ষণের মধ্যে ভুল ভাঙলো ওর। জানতে পারলো, মূলত নায়াগ্রা ফলসকে কেন্দ্র করে আশেপাশে বিনোদন নগরী গড়ে উঠেছে।
প্রথমেই মিতুলরা গিয়ে দাঁড়ালো নায়াগ্রার সেই অংশের পাশে, যেখানে প্রতি সেকেন্ডে এক লাখ ঘনফুট জলরাশি প্রায় একশ নব্বই ফুট নিচে আছড়ে পড়ছে। নিচ থেকে এ জায়গাটির উচ্চতা তেরো তলা ভবনের সমান। নায়াগ্রা জলপ্রপাতের অবস্থান কানাডা ও আমেরিকার মাঝখানে। একপাড়ে কানাডা, অন্যপাড়ে আমেরিকা। জলপ্রপাতের পানি পড়ে দুই পাহাড়ের মাঝখানে বিশাল নদী তৈরি হয়েছে। সারাক্ষণ প্রচণ্ড বেগে ঝরনা ধারা চলছেই। আর পাহাড়ের মধ্যেই শহর। সুবিশাল এলাকায় কয়েক’শ ফুট উঁচু থেকে জলের ধারা নামছে।
মিতুল রেলিং ধরে নিচের দিকে তাকালো। বিপুল জলরাশি নিচের পাথরে ধাক্কা খেয়ে অসংখ্য জলকণা সৃষ্টি করছে, যা আবার উপরে উঠে আসছে।
জলপ্রপাতটির পানির ধারার বেগ এতই যে, নদী থেকে ছিটকে কয়েক কিলোমিটার এলাকাজুড়ে কুয়াশার মতো ভাসতে থাকে। দেখে মনে হয় যেন ধোঁয়ার কুণ্ডলী। আর আশেপাশের এলাকায় বৃষ্টির মতো জল ঝরতে থাকে অবর্ণনীয়!
মিতুলরা যে জায়গাটিতে দাঁড়িয়ে আছে, সেটি নায়াগ্রার তিনটি প্রবাহের মধ্যে সর্বোচ্চ। এটির নাম, ‘হর্সসু’। হর্সসুয়ের বেশির ভাগটাই কানাডাতে পড়েছে।
মিতুলের হঠাৎ জোহানের কথা মনে পড়ে গেল। জোহানের কালকে বলা শেষ কথাটি এক বার মনে মনে আওড়ালো ও,
‘জোহানের সাথে এই মুগ্ধ, বিস্ময় প্রকৃতিতে হারিয়ে যাব আমি। আমার অবুঝ মনের আসল চাওয়া আমিও খুঁজতে পারি।’
এই কথাই তো জোহান ওকে বলতে বলেছিল মনে মনে। কিন্তু কেন? কী মানে এই কথার? ও কাল থেকে ভেবেও কোনো মানে দাঁড় করাতে পারেনি। ওর মনে হচ্ছে জোহান নিজেও জানে না নিজের এই কথার মানে। পাগলের মতোই একেক সময় আজব আজব কথা শোনায় ওকে। যেটার মানে জোহান নিজেই জানে না, সেটার মানে ওর খুঁজে বের করা তো ইম্পসিবল। মিতুল জোহানের কথা মাথা থেকে ঠেলে বের করে দিলো।
পাশেই মার্কেট এবং মিউজিয়াম রয়েছে। ওদিকে যাওয়ার আগ্রহ দেখা গেল না রেশমী আন্টি এবং জায়িনের মাঝে।
রেশমী আন্টি বললেন, মিউজিয়ামে আছে নায়াগ্রার ওপর তথ্য, ছবি ইত্যাদি।
চোখের সামনে প্রকৃতির অপার প্রাণময় সৌন্দর্য দেখে, তথ্যের জন্য মিউজিয়ামে যাওয়ায় মিতুলের মন টানলো না। ওর এসব তথ্য জানাজানিতে আবার ভীষণ অনীহা।
অনেকটা সময় ধরে মিতুলরা নায়াগ্রার পাশে থাকলো। যে জায়গাটায় পানি পড়ছে তার যতটা কাছে যাওয়া যায়, গেল। চেষ্টা করলো পানি পতনের শব্দ শুনতে।
সন্ধ্যার পরপরই হোটেলে ফিরলো মিতুলরা। ট্যাক্সি একেবারে হোটেলের সামনে এসে থেমেছে। সবার আগে ট্যাক্সি থেকে নেমেই দ্রুত পায়ে হোটেলে ঢুকে গেল জায়িন।
মিতুল লক্ষ করেছে জায়িন কেমন গম্ভীর ভাব নিয়ে থেকেছে সারাদিন। যদিও জায়িন একটু গম্ভীর স্বভাবেরই। তবে আজকে গাম্ভীর্য ভাবটা অন্য রকম ছিল। একটু বেশিই। শুধু আজকে না। কালকে থেকেই এমন করছে জায়িন। ওর মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দিয়ে অপমানও তো করলো কালকে। কালকের অপমানের কথা মনে পড়তেই মিতুলের মন বিষাক্ত হয়ে ওঠে বার বার। আজকে সারাদিন কত কষ্টে যে জায়িনের সাথে ছিল, তা শুধু ও জানে। যে লোকটা ওর মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দিয়ে কালকে অপমান করেছে, সেই লোকটার সাথে আজকে ঘুরে বেড়ানো কোনো স্বস্তির বিষয় নয়। কিন্তু জায়িনের হঠাৎ এত গাম্ভীর্যের মানে কী সেটা ও বুঝতে পারছে না। হঠাৎ করে কী হলো জায়িনের?
জায়িন রুমে এসেই উইন্ডোর কাছের আর্ম চেয়ারে বসে পড়লো। আজকের দিনটা বড্ড বাজে ভাবে কেটেছে ওর। টরোন্টোতে ওর কোনো কাজ নেই, অথচ নিজের অফিসের কাজ ফেলে টরোন্টো এসে বসে আছে। মম কীসের জন্য বলিয়ে, কইয়ে ছুটি নেওয়ালো? নিজেই তো মিতুলকে ঘুরিয়ে দেখাতে পারে সব। শুধু শুধুই ওকে এনেছে সাথে। ড্যাম ইট! জায়িন চেয়ার ছেড়ে উঠে জ্যাকেটটা খুলে রাখলো। ফ্রেশ না হয়েই গা এলিয়ে দিলো বিছানায়।
চোখ বন্ধ করতেই হঠাৎ গত কালকের কথা মনে পড়ে গেল। কালকে সকালে ফ্রেডি ফোন করেই জোহানের কথা জিজ্ঞেস করেছিল। বলেছিল, জোহানের কিছু হয়েছে কি না। হঠাৎ করে জোহানের সম্পর্কে এমন প্রশ্ন করার কারণ জানতে চাইলেই ফ্রেডি বললো, জোহান আজব আচরণ করেছে ওর সাথে। কফিশপে গিয়েছিল ও। সেখানে হঠাৎ মিতুলের সাথে দেখা হয়ে যায়। তো, মিতুলের সাথে কথাবার্তা বলছিল। এর মাঝেই জোহান হুট করে কোত্থেকে এসেই উগ্র টাইপ আচরণ করেছে ওর সাথে। মিতুলকে ওর সামনে থেকে হাত ধরে টেনে নিয়ে গেছে।
ফ্রেডির কাছ থেকে খবরটা শুনেই প্রচণ্ড রকমের মাথা গরম হয়েছিল জায়িনের। যদিও জোহানকে এ নিয়ে কিছু বলেনি ও। জোহানের সাথে কথা বলতেও অনিচ্ছা হয় ওর। জোহান কী করে ওর ফ্রেন্ডের সাথে এরকম বিহেভ করে সেটা এখনও বুঝে আসছে না ওর। জোহান দিনকে দিন নিজের উগ্র আচরণ ওর ফ্রেন্ডসদের সাথেও দেখানো শুরু করেছে! কত বড়ো স্পর্ধা জোহানের!
আর মিতুল! মিতুলের সাথে জোহানের এত ঘোরাঘুরি, হাত ধরে টেনে নিয়ে যাওয়া, এসব তো মোটেই স্বাভাবিক নয়। অস্বাভাবিক, দৃষ্টিকটু। যেটা ওর দৃষ্টি অতিক্রম করে ওর মনে ক্ষোভের সৃষ্টি করে সরাসরি। মিতুলের সাথে জোহানের এত মেলামেশা, ঘোরাঘুরি অত্যাধিক খারাপ লাগে ওর। সহ্য হয় না! ধীরে ধীরে এই অসহ্যের মাত্রাটা বেড়ে যাচ্ছে আরও। কেন এমন হচ্ছে জানে না ও। শুধু জানে জোহানের সাথে মিতুলের মেলামেশা অপছন্দ ওর। অসহ্য লাগে এসব। জোহান এবং মিতুলের ব্যাপার যে স্বাভাবিক নয়, সেটা ভ্যাঙ্কুভার থাকতেই টের পেয়েছিল। যেদিন জোহান উইনিপেগ থেকে ভ্যাঙ্কুভার এসেছিল।
______________
তিন দিনের সফর শেষ হলে এডমন্টন ফিরে এলো মিতুল’রা। আজকের সকাল নয় টার ফ্লাইটে এসেছে। মিতুলের চোখে এখনও নায়াগ্রা জলপ্রপাতের ঘোর লেগে আছে। কী বিস্ময়, মুগ্ধ ঘেরা প্রকৃতি। আসার আগে আরও একবার গিয়েছিল সেখানে। নায়াগ্রা জলপ্রপাত ছাড়াও টরন্টোর আরও কিছু দর্শনীয় স্থানে ঘুরেছে। আর্ট গ্যালারি অব অন্টারিও, হাই পার্ক, কাসা লোমা, টরন্টো জু ইত্যাদি জায়গায় ঘুরেছে।
বাড়ি ফিরেই বেশ উদাস উদাস অনুভব করছে মিতুল। টরোন্টো যাওয়ার পর জোহান একবারও কল দেয়নি ওকে। আর না দিয়েছে একটা ম্যাসেজ। জোহান কল, ম্যাসেজ দেয়নি দেখে রাগ করে ও নিজেও দেয়নি আর। বন্ধুদের সাথে সাত দিন ব্যাপী পার্টি করায় ওকে ভুলে গেল না কি জোহান? হ্যাঁ, যেতেই পারে। জোহানের দ্বারা এসব সম্ভব হতে পারে। কিন্তু ও ভুলে যায়নি। ঠিকই মনে রেখেছে জোহানকে। শুধু মনেই রাখেনি, টরোন্টো থেকে গিফটও কিনে নিয়ে এসেছে ওর জন্য। আর এই গিফটা দেবে বলেই ওর মন এত আকুপাকু করছে। কবে বাড়ি ফিরবে জোহান? সাত দিন এখনও হয়নি?
সকাল কাটলো কেমন একাকীত্ব একাকীত্ব নিয়ে। দুপুরটাও তাই। বিকেলটাও তেমনই কাটছে এখন। মোবাইল সাথে নিয়ে নিয়ে ঘুরছে। কিন্তু কোনো কলই আসছে না। হ্যাঁ, দুইবার এসেছিল। কিন্তু তা বাংলাদেশ থেকে আব্বু এবং ছোটো মামনির ছিল। জোহানের নয়।
মিতুল শেষমেশ আর নিজের ধৈর্য ধরে রাখতে পারলো না। ছুটে এলো ক্যামিলার কাছে।
ক্যামিলা এখন গার্ডেনে। আনারস কাটছিল। মিতুল এসেই বললো,
“জোহান কবে বাড়ি ফিরবে বলো তো?”
ক্যামিলা একবার চোখ তুলে তাকালো মিতুলের দিকে। তারপর আবার আনারস কাটায় মন দিয়ে বললো,
“জোহান কোথায় গেছে যে বাড়ি ফিরবে?”
মিতুল সন্দিহান দৃষ্টি মেলে চাইলো।
“মানে? জোহান রিকার্ডোর ফ্ল্যাটে নেই? সাত দিন ব্যাপী পার্টি করছে না ওরা?”
ক্যামিলা একটু হেসে বললো,
“না নেই। গিয়েছিল পার্টির জন্য। কিন্তু ওদের পার্টি হয়নি। জোহান বাড়িতেই আছে। এ কদিন বাড়িতেই ছিল। ও একটু আগেই ঘুম থেকে উঠে টাইম হাউজে গেছে।”
মিতুল হা হয়ে ক্যামিলার কথা শুনলো। জোহান বাড়িতে ছিল? একটু আগেও নিজের রুমে ঘুমাচ্ছিল? এর মাঝে ও টের পায়নি? সেই সকাল থেকে বাড়িতে, অথচ এক বারও দেখা হয়নি জোহানের সাথে? জোহান একবার দেখা করতেও আসলো না? এতটা বেইমান জোহান?
মিতুল দৌঁড়ে নিজের রুমে চলে এলো।
ছোটো একটা বক্স নিয়ে আবার বেরিয়ে গেল রুম থেকে। ফেরত এলো গার্ডেনে। না, গার্ডেনে আসেনি। টাইম হাউজে যাবে বলে এসেছে।
মিতুল জোহানের জন্য আনা গিফট নিয়ে জঙ্গলের পথে চলে গেল।
ক্যামিলা মিতুলের কাণ্ড দেখে নিঝুম হাসলো পিছনে বসে।
মিতুল টাইম হাউজের কাছাকাছি আসতেই জোহানকে দেখতে পেল। সিঁড়িতে গিটার নিয়ে বসে আছে। একেবারে কাছে এসে দেখলো সাথে পেপার, পেনও আছে।
মিতুল এসেই বলে উঠলো,
“তুমি কি মানুষ? তুমি এই চার দিনে একটা বারও কল দিলে না আমায়। একটা ছোটো ম্যাসেজও দাওনি। বাড়িতে বসে থেকে রিকার্ডোর ফ্ল্যাটে আছো এমন মিথ্যা বুঝে রেখেছো আমাকে। এমন কেন করেছো তুমি?”
জোহান নির্বিকার কণ্ঠে বললো,
“কল? ম্যাসেজ? আমি কি এমন কোনো ওয়াদা করেছিলাম যে তোমাকে প্রত্যেক দিন কল, ম্যাসেজ দেবো?”
মিতুল থতমত খেয়ে গেল। কিন্তু দমলো না।
“না আমার কাছে কেন এমন ওয়াদা করবে? কেনই বা আমার কাছে কল দেবে? গার্লফ্রেন্ড আছে না? গার্লফ্রেন্ডের সাথে কথা বলেই পুরো দিন পার করবে।”
মিতুলের কথায় বিরক্ত হয়ে এবার জোহান সিঁড়ি থেকে উঠে এলো।
“লিসন, ও আমার গার্লফ্রেন্ড নয়। একটা কথা বার বার কেন বলতে হয় তোমাকে?”
“আবারও ইনোসেন্ট সাজার চেষ্টা করছো?”
“ইনোসেন্ট সাজার চেষ্টা করছি না। আমি ইনোসেন্টই। কার্লের মতো ইনোসেন্ট সাজার অভিনয় করি না।”
কার্লের কথা গায়ে লেগে গেল মিতুলের।
“কথায় কথায় কার্লকে কেন টানো? কে বলেছে তোমাকে কার্ল ইনোসেন্ট সাজার অভিনয় করে? ও ইনোসেন্টই। অভিনয় করতে হয় না ওর। যা অভিনয় করার তা তো তুমি করো। অবশ্য তাও পারো না।”
“বাহ, কখনো ফ্রেডির জন্য টান লাগে তোমার, কখনো কার্লের জন্য। এদের জন্য এত টান অনুভব করো কেন তুমি? কী এমন বিশেষত্ব আছে ওদের মাঝে?”
“ফ্রেডির সাথে কার্লকে মিলাবে না। ফ্রেডির কোনো যোগ্যতা নেই কার্লের মতো হওয়ার। কার্ল অনন্য।”
“কী? অনন্য?” মুখ টিপে হাসলো জোহান।
যা খুব করে গায়ে লাগলো মিতুলের।
ইতোমধ্যে মিতুলের হাতের ছোটো বক্সটি নজরে এসেছে জোহানের। জোহান এ বিষয়ে আর কথা না বাড়িয়ে বললো,
“এটা কী?”
মিতুলের মন মুহূর্তে ভালো হয়ে গেল। ও বক্সটা উঠিয়ে বললো,
“এটা? এটা তোমার জন্য।”
জোহান বিস্ময়ের সাগরে ডুবে গেল।
“আমার জন্য?”
মিতুল হাসি হাসি মুখে মাথা নাড়িয়ে বললো,
“ইয়াহ, ইট’স ইওর।”
মিতুল বক্সটা খুললো। একটা কলম দেখা গেল ভিতরে।
জোহান বললো,
“পেন?”
মিতুল কলমটা তুলে নিলো। জোহানের এক হাতে কলমটা দিতে দিতে বললো,
“হুম পেন। নিজে গিয়ে কিনেছি তোমার জন্য। টরন্টোর শপ থেকে। যখন তুমি ফেমাস হবে, তখন অটোগ্রাফ দেবে এটা দিয়ে। ভেবো না যে সস্তায় কিনেছি। অনেক দামি এটা। জীবনে এত দামি পেন কিনিনি কারও জন্য। নিজের জন্যও না। ফেমাস হলে তো অবশ্যই দামি পেন দিয়ে অটোগ্রাফ দিতে হবে তোমার। সে কথা চিন্তা করে অনেক দাম দিয়েই পেনটা কিনেছি তোমার জন্য।”
জোহান একবার হাতের পেন দেখলো, আরেকবার মিতুলকে।
মিতুল হঠাৎ কেমন নিস্তেজ কণ্ঠে বললো,
“তুমি যখন ফেমাস হবে তখন তো আমি থাকবো না এখানে। আমি তো মাত্র তিন মাসের জন্য এখানে এসেছি। নয়তো ফেমাস হওয়ার পর প্রথম অটোগ্রাফটা আমিই নিতাম।”
মিতুল একটু থামলো। হঠাৎই আবার মুখে হাসি ফুঁটিয়ে বললো,
“থাক, কোনো ব্যাপার না। প্রথম অটোগ্রাফ আমি নিতে পারবো না তো কী হয়েছে। আমার দেওয়া পেন দিয়ে তুমি অটোগ্রাফ দেবে সেটা তো অনেক আনন্দের হবে, তাই না? আমার দেওয়া পেন দিয়েই কিন্তু অটোগ্রাফ দিও। ফেমাস হয়ে যাওয়ার পর আবার আমার পেনকে তুচ্ছ করে ফেলে রেখো না।”
বলে যাওয়ার পথ ধরলো মিতুল।
জোহান পিছন থেকে তাকিয়ে রইল।
মিতুল বেশ কিছুটা দূরে চলে যাওয়ার পর জোহান পিছন থেকে ডাকলো,
“হেই তুলতুল!”
জোহানের ডাক কানে আসার সাথে সাথে মিতুলের পা থেমে গেল। পিছন ফিরে তাকালো ও।
জোহান ঠোঁটে মৃদু হাসি ধরে রেখে এগিয়ে এলো ওর কাছে। কাছে এসে দুই হাতে মিতুলের চিবুক ধরে বললো,
“ফেমাস হওয়ার পর আমার প্রথম অটোগ্রাফ আমি তোমাকেই দেবো। তুলতুলের দেওয়া কলমেই অটোগ্রাফ দেবে জোহান। আর এই জোহান যখন ফেমাস হবে, তখন তুলতুল ওর সাথেই থাকবে। শুধু ফেমাস হয়ে যাওয়ার সময়েই নয়, তুলতুল সবসময়ই এই জোহানের সাথেই থাকবে।”
(চলবে)
#চেরি_ব্লসমের_সাথে_এক_সন্ধ্যা
#পর্ব: ৩১
#লেখা: ইফরাত মিলি
___________
সারারাত চোখে ঘুম ধরা দিলো না মিতুলের। মাথায় কেবল জোহানের চিন্তা ঘুরেছে। আঁখি ক্যানভাসে আলতো করে ভেসেছে একটা জঙ্গলের চিত্র।
সরু রাস্তা ধরে জোহানের এগিয়ে আসার দৃশ্য। জোহান এগিয়ে এসেছিল ওর কাছে। ওর চিবুকে দুই হাতের আলতো পরশ রেখেছিল। বলেছিল…
কী বলেছিল ও জানে না। ও শুনতে পায়নি জোহানের সম্পূর্ণ কথা। ওর হৃদয় এত বেশি শব্দ করছিল যে, সেই শব্দের সাথে সাথে ওর মস্তিষ্কও তখন অন্য কিছুতে বিভোর হয়ে পড়েছিল। জোহানের সম্পূর্ণ কথা তখন না তো ওর কর্ণ ধারণ করতে সক্ষম হয়েছিল, আর না তো ওর মস্তিষ্ক ধারণ করতে চেয়েছিল।
ও যেটুকু শুনেছিল তা ছিল,
‘ফেমাস হওয়ার পর আমার প্রথম অটোগ্রাফ আমি তোমাকেই দেবো।’
জোহানের এই কথায় কী ছিল কে জানে! এইটুকু শোনার পরই হৃদয়ের অশান্ত ছটফটানি শুরু হয়েছিল। ওর ধ্যান-জ্ঞান কিছুই জোহানের কথার দিকে ছিল না তখন। যার জন্য জোহানের বাকি কথাগুলো শুনতেই পায়নি ও। কিন্তু শোনা উচিত ছিল। মিতুল দুই হাত দিয়ে নিজের চিবুক স্পর্শ করে উইন্ডো দিয়ে বাইরে তাকালো। উইন্ডোর পাশে ফ্লোরে বসে আছে ও। কী সুন্দর সকাল।
সূর্যটা গাছপালার উপর দিয়ে উঁকি দিয়েছে। অথচ ওর চোখে ঘুমের উপস্থিতি নেই এখনও। ধীরে ধীরে সকাল আরও গাঢ় হলো।
বাড়ির সবাই জেগে গেছে। আর ও তো জাগ্রতই ছিল। নীরব পরিবেশের মাঝে হঠাৎ মোবাইলের রিংটোনের আওয়াজ মিতুলকে কাঁপিয়ে তুললো প্রায়। ওর পাশেই ফ্লোরের উপর মোবাইল। মোবাইল হাতে নিয়ে যার নাম স্কিনে দেখলো তাতে ওর মনের ভিতরের একটা চাপা কষ্ট হঠাৎ আবার মুক্ত হয়ে উঠলো। মনের সাদা আকাশ গ্রাসিত হলো কালো রঙের মেঘে। কার্ল! কার্ল ফোন করেছে। কার্লের ফোন রিসিভ করতে ভীষণ কষ্ট হবে ওর। গলা থেকে কথা বের হবে না। মিতুল চাইলো ও কার্লের কল রিসিভ করবে না। কিন্তু চাইলেও পারলো না। মায়া ওকে ছাড়লো না। মিতুল কল রিসিভ করলো।
কার্ল যে খবরটা দিলো তাতে মিতুলের হৃদয় আর হৃদয় থাকলো না। আগে থেকেই জানতো এমন হবে। তবুও মন মেনে নিতে চাইছে না।
আর দুই দিন পর কার্লের বিয়ে! কার্ল ওকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে বিয়েতে।
মিতুলের চোখ থেকে অজান্তেই এক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়লো নীরবে।
___________
জোহান ডাইনিং টেবিলে এসে দেখলো মিতুল পাথুরে মুখ নিয়ে বসে আছে। ও মিতুলের সামনের চেয়ারে বসলো। গ্লাসে জুস ঢালতে ঢালতে আস্তে করে বললো,
“জানো তুলতুল, আজ সারারাত ঘুম হয়নি আমার।”
জোহানের কথা কানে আসতেই চোখ তুলে তাকালো মিতুল। বললো,
“তোমারও ঘুম হয়নি আজকে?”
“…’তোমারও’ মানে?”
অবাক হয়ে জানতে চাইলো জোহান।
মিতুল জোহানকে বলতে পারলো না যে, জোহানের জন্য রাতে ঘুম হয়নি ওর। ও বললো,
“না, কিছু না। কীসের জন্য সারারাত ঘুম হয়নি তোমার?”
জোহান দুই পাশে মাথা নাড়িয়ে বললো,
“উহুম, সেটা তো তোমায় বলবো না। সেটা গোপনীয়।”
মিতুল এ নিয়ে বেশি আগ্রহ দেখালো না। কার্লের বিয়ের ইনভাইট পাওয়ার পর মন মরে গেছে ওর। কোনো কিছুতে আগ্রহ খুঁজে পাচ্ছে না এখন।
জোহান ব্রেকফাস্ট নিয়ে খাওয়া শুরু করেছে।
কিন্তু মিতুল বসে আছে চুপচাপ। ব্রেকফাস্ট খাওয়ার জন্য এসেও খেতে ইচ্ছা করছে না। মিতুল একসময় দুটো আঙ্গুল নাড়াচাড়া করতে করতে উদাসী কণ্ঠে বললো,
“জানো জোহান, কার্লের না দুই দিন পর বিয়ে। ওর গার্লফ্রেন্ডের সাথে।”
জোহান উৎফুল্ল হয়ে বললো,
“তাই না কি?”
মিতুল হ্যাঁ-বোধক মাথা নাড়লো।
জোহান বললো,
“যাক, এতদিন পর কার্ল কাজের মতো একটা কাজ করবে।”
এমনি সময় হলে এ নিয়েও জোহানের সাথে তর্ক করতো মিতুল। কিন্তু ও এখন তর্কের ধার দিয়েও গেল না। জোহানের কথা কান দিয়েই ঢোকেনি ওর। ও আগের মতোই উদাসী কণ্ঠে বললো,
“ওর বিয়েতে আমাকে ইনভাইট করেছে। আমার সাথে সাথে তোমাকেও ইনভাইট করেছে।”
জোহান ভারী অবাক হলো,
“আমাকে? আমাকে ইনভাইট করেছে?”
মিতুল মাথা নাড়লো।
জোহান বললো,
“ওয়াও! কার্লের প্রতি হঠাৎ কেন যেন আমার ভালোবাসা বেড়ে গেল। সত্যিই কার্ল খুব ভালো ছেলে। ইনোসেন্ট ছেলে।”
জোহানের কথা কেন যেন কটাক্ষ পূর্ণ মনে হলো মিতুলের কাছে। রাগ হলো একটু জোহানের উপর। এই রাগকে আরও গভীর করতে চায় না ও। এখানে থাকলে জোহানের সাথে যেকোনো সময় ঝগড়া শুরু হয়ে যেতে পারে। কিন্তু ও তো এখন একদমই ঝগড়া করার মুডে নেই। ও ব্রেকফাস্ট না করেই চুপচাপ ডাইনিং রুম থেকে বেরিয়ে সোজা নিজের রুমে চলে এলো।
_____________
জায়িন ভেবেছিল জোহানকে কিছুই বলবে না। কিন্তু জোহানকে কিছু না বলে শান্তিও পাচ্ছে না। ভিতরের রাগ মরছে না ওর। জোহান মনের ভিতর অশান্তির রাজ্য সৃষ্টি করে দিয়েছে। প্রায় এক ঘণ্টা ধরে হলরুমে বসে আছে জোহানের অপেক্ষায়। ক্যামিলার কাছ থেকে জেনেছে জোহান বাইরে গেছে। বাইরে থেকে আসলেই জোহানের সাথে কথা হবে ওর।
জোহান বাড়ি ফিরলো আরও সাত মিনিটের মাথায়। ঘড়িতে এখন রাত দশটা।
জোহান আঙ্গুলে কারের চাবি ঘোরাতে ঘোরাতে জায়িনের সামনে থেকে যাওয়া দিলেই ডাকলো জায়িন।
“দাঁড়া জোহান!”
জোহান দাঁড়ায়। ভাবলেশহীন চোখে তাকিয়ে বললো,
“কী?”
জায়িন সোফা ছেড়ে উঠে এলো জোহানের কাছে।
“ফ্রেডির সাথে খারাপ আচরণ করেছিস তুই?”
“ফ্রেডি এটাই বলেছে তোমায়?”
“তোর সাহস দিনকে দিন আকাশ ছুঁয়ে যাচ্ছে। আমার ফ্রেন্ডের সাথে বেয়াদবি করা ঘোরতর অন্যায় হয়েছে তোর। কোন সাহসে বেয়াদবি করেছিস ওর সাথে?”
“ও যা করেছে তাতে তো এবার শুধু বেয়াদবি করেছি। আবার কোনোদিন যদি ও এই কাজটা করে না, তবে শুধু বেয়াদবি নয়। ওর মুখের জায়গায় জায়গায় ক্ষত সৃষ্টি করে দেবো আমি।”
জায়িনের রক্ত গরম হয়ে গেল।
“কী বললি?”
“যেটা শুনেছো সেটাই।”
বলে জোহান যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো।
জায়িন বলে উঠলো,
“বাড়ির অতিথির সাথে উগ্র আচরণ করা কোন ধরনের ভদ্রতা তোর? এটা ঠিক যে তুই একটা অভদ্র। কিন্তু একজন বাইরের দেশের অতিথির সাথে এমন আচরণ করা নৈতিকতাহীন।”
জোহান বিরক্তিতে ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেললো। পিছন ফিরে বললো,
“বাড়ির অতিথির সাথে কেমন আচরণ করি সেটা নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না ব্রাদার। ওটা আমার ভাবনা। আর আমি যে অভদ্র সেটা নিয়ে আমি গর্ব করি। অনেক আগেই অভদ্রের খাতায় নাম লিখিয়েছি আমি। এখন আর ভদ্র হওয়ার কোনো ইচ্ছার উপস্থিতি নেই আমার ভিতর। আমি সারাজীবন অভদ্রই থাকতে চাই।”
জোহান আর দাঁড়ালো না। আঙ্গুলের চরকায় চাবি ঘোরাতে ঘোরাতে উপরে চলে গেল।
“ব্লাডি হেল!” জায়িনের কণ্ঠে ক্রোধ ঝরে পড়লো।
_____________
চেরি গাছগুলো আগের থেকে আরও বেশি ফাঁকা দেখাচ্ছে। বাতাস হতে একটা দুটো পাঁপড়ি ঝরে পড়ে নিজ মুগ্ধতা নিয়ে। গাছগুলোর এমন শূন্য শূন্য ভাব দেখে কষ্ট লাগছে মিতুলের। আগে কত ফুল ছিল গাছগুলোয়। এ কদিনেই এরকম ঝরে পড়ে গেল! এখনও যে বসন্তের অনেক সময় বাকি।
জোহানকে লন থেকে হেঁটে গেটের দিকে যেতে দেখলো মিতুল। গেট পেরিয়ে বাইরে চলে গেল জোহান। একটু আগেই তো ও বাইরে থেকে এলো। এখন আবারও বাইরে যাচ্ছে? সমস্যা কী জোহানের?
পিছনে কারো পায়ের শব্দ কানে আসাতে, মিতুল পিছন ফিরে চাইলো। দেখতে পেল, জায়িন এগিয়ে আসছে ওর দিকে। হাতে দুটো কফির মগ।
জায়িন মিতুলের কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়ে একটু হাসার চেষ্টা করলো। হাতে থাকা কফির মগ থেকে একটা মগ এগিয়ে দিলো মিতুলের দিকে।
“টেইক ইট।”
মিতুল কফির মগ থেকে চোখ সরিয়ে জায়িনের দিকে তাকালো বিস্ময়াভিভূত চোখে। জায়িন ওকে নিজ হাতে কফি দিচ্ছে এটা বিশ্বাস করা ওর জন্য কষ্টকর। কিন্তু কষ্ট করে হলেও বিশ্বাস করতে হবে ওকে। কারণ এটাই যে সত্যি। মিতুল জায়িনের হাত থেকে কফির মগ নিয়ে বললো,
“থ্যাঙ্ক ইউ!”
“ওয়েলকাম।”
জায়িন আর্ম চেয়ারে বসে বললো,
“আই অ্যাম এক্সট্রেমলি স্যরি!”
হঠাৎ করে জায়িনের স্যরি বলার রহস্য মিতুল বুঝতে পারলো না। তাই বললো,
“স্যরি কীসের জন্য?”
জায়িন একটু সময় চুপ থেকে বললো,
“আসলে…সেদিন…টরন্টো যাওয়ার দিন দুপুরে তোমার সাথে ওই রকম বিহেভ করা উচিত হয়নি আমার। আই মিন, তোমার মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দেওয়ার কথা বলছি আমি।”
কথাগুলো বলার সময় অনেক জড়তা ঘিরে ধরলো জায়িনকে।
মিতুল ভাবতে পারেনি অহংকারী জায়িনের মুখে এমন কিছু শুনতে পাবে। বাহ, জায়িনকে এই অহংকারহীন রূপে দারুণ লাগে। জায়িন অহংকার বাদ দিয়ে এমন সহজ ভাবে থাকতে পারে না?
আচ্ছা, জায়িনের কথার উত্তরে ওর কী বলা উচিত এখন?
মিতুল কিছু বলার আগে জায়িনই ফের বলে উঠলো,
“আসলে সেদিন আমার মুড প্রচণ্ড খারাপ ছিল। ফ্রেডি, জোহান, অফিসে ছুটি ম্যানেজ, এসব নিয়ে।”
জায়িনের মুখে ফ্রেডির কথা শুনতেই মিতুলের সেদিনের ঘটনা মনে পড়ে গেল! অসভ্য ফ্রেডিটা সেদিন কীভাবে জড়িয়ে ধরেছিল ওকে! কথাটা মনে হতে এখনও ওর গা ঘিনঘিন করে। কিন্তু এমন একটা গা ঘিন ঘিনে ব্যাপার জায়িনের কানে লাগালো কে? জোহান? না কি ফ্রেডি নিজেই? ছি! আসলেই ফ্রেডির কোনো লজ্জা শরম নেই। নির্লজ্জ অসভ্য!
মিতুল মনে মনে এসব ভাবাকালীন শুনতে পেল জায়িন বলছে,
“আর জোহানের তোমার সাথে অমন উগ্র আচরণ করার জন্য আমি স্যরি! আসলে জোহান এমন উগ্র টাইপেরই! তুমি কিছু মনে করো না। নিজের চোখেই তো দেখলে ফ্রেডির সাথে কী খারাপ আচরণটাই না করলো! ও কীভাবে ফ্রেডির সাথে খারাপ বিহেভ করতে পারে? ওর উগ্র আচরণ দিনদিন সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে!”
উগ্র? জোহান? মিতুল বুঝতেই পারছে না জোহান কবে ওর সাথে উগ্র আচরণ করলো? আর কখন-ই বা ফ্রেডির সাথে খারাপ আচরণ করলো? মিতুল নিজের মাঝে রাগের উপস্থিতি টের পাচ্ছে। আর এ রাগ জায়িনকে ঘিরে হচ্ছে। জায়িন কীভাবে নিজের ভাইয়ের সম্পর্কে এমন কথা বলতে পারে? সব মিথ্যা কথা। আর ও কি কোনো দিন জোহানের কথা জায়িনের কাছে বিচার দিয়েছিল? দেয়নি। তাহলে জায়িন ওর সাথে এসব কেন বলছে?
আর সেদিন ফ্রেডি ওর সাথে যা করলো, তারপরেও জায়িন সেই ফ্রেডির পক্ষ বাদীত্ব করছে ওর সামনে? আর জোহানের দোষ গাইছে? ও মানছে না এসব।
সেদিন ফ্রেডির সাথে ওই ঘটনার পর রাগের মাথায় মুখে যতই জোহানের সাথে তর্ক করুক না কেন, ওই ঘটনার জন্য তখন জোহানকে যতই দোষারোপ করুক না কেন, পরে মনে মনে হাজার বার ধন্যবাদ দিয়েছিল জোহানকে। জোহান এসে ওর থেকে ফ্রেডিকে আলাদা করায় ও কৃতজ্ঞ জোহানের কাছে।
মিতুল জায়িনকে বললো,
“তোমার ভুল হচ্ছে। জোহান মোটেই আমার সাথে উগ্র আচরণ করেনি। আর জোহান উগ্র নয়। ফ্রেডির সাথেও খারাপ আচরণ করেনি ও। ফ্রেডি যা করেছে তাতে ওটা ফ্রেডির পাওনা ছিল।”
“মানে? ফ্রেডি কী এমন করেছিল, ও তো জাস্ট তোমার সাথে কথাবার্তা বলছিল। তাতে জোহানের এমন রিয়াক্ট করার মানেই হয় না। আর তুমি ওকে সাপোর্ট করে যাচ্ছ?”
“ফ্রেডি জাস্ট কথাবার্তা বলছিল না আমার সাথে। ও তো…”
মিতুল থেমে গেল। জায়িনের সাথে ফ্রেডির ঘটনাটা বলতেও ওর রুচিতে বাধছে। এগুলোও কি জনে জনে বলে বেড়ানোর মতো কথা? মিতুল তারপরও বললো,
“হ্যাঁ, এদিকে এটা স্বাভাবিক ব্যাপার হতেই পারে। কিন্তু আমার কাছে এটা মোটেই স্বাভাবিক নয়। ও কীভাবে অন্য দেশের একটা মেয়েকে জড়িয়ে ধরতে পারে? সব দেশের কালচার তো আর এক না। জোহান ফ্রেডির সাথে যা করেছে, ঠিক করেছে।”
বলেই মিতুল বারান্দা থেকে চলে গেল।
জায়িন বুঝতে পারছে না সামান্য জড়িয়ে ধরা নিয়ে জোহানের কেন এমন করতে হবে? মিতুল ফ্রেডির পরিচিত ছিল, জড়িয়ে তো ধরতেই পারে। এটা খুবই স্বাভাবিক একটা ব্যাপার। ঠিক আছে, ধরে নিলো মিতুল এই কালচারের সাথে অভ্যস্ত নয়। ওর কাছে না হয় এটা অস্বাভাবিক ছিল। কিন্তু জোহান? যার জন্ম, বেড়ে ওঠা সবকিছু এখানে, তার কাছেও কি এটা অস্বাভাবিক ছিল? না মোটেই না। জোহান নিজেই তো এসবের সাথে অভ্যস্ত। তাহলে? আসলে জড়িয়ে ধরাটা অস্বাভাবিক ছিল না। অস্বাভাবিক ছিল জোহান আর মিতুল। দুজনের এত ঘোরাঘুরি, জোহানের উইনিপেগ থেকে ভ্যাঙ্কুভার যাওয়া, আর মিতুল এইমাত্র জোহানকে নিয়ে যে কথাগুলো বলে গেল, তাতে তো সব কিছু স্পষ্ট। জোহান আর মিতুল…
জায়িন হেসে ফেললো।
(চলবে)