#চেরি_ব্লসমের_সাথে_এক_সন্ধ্যা,পর্ব: ৪২
#লেখা: ইফরাত মিলি
____________
মিতুল রুমে এসে বসতে না বসতেই জোহানের থেকে ম্যাসেজ পেল। জোহান লিখেছে,
‘সন্ধ্যা নয়, এখনই রেডি হতে শুরু করো। রেডি হয়ে রুমেই অপেক্ষা করবে আমি না আসা পর্যন্ত।’
মিতুলের মন ঘোর বিরোধিতা জানাচ্ছে। জোহানের কথা শোনার কোনো দরকার নেই। জোহানের কথা মতো কেন রেডি হয়ে থাকবে ও? জোহান যখন-তখন যা অর্ডার করবে, তাই মানতে হবে ওর? এমন কোনো কোনো আইন আছে? না, নেই তো। হবে না রেডি। যাবে না জোহানের সাথে।
পর মুহূর্তে আবার সায় দিয়ে মন বললো, যাওয়া উচিত জোহানের সাথে। জোহান কী দেবে সেটা দেখা উচিত। এর আগে কত দিনই তো গেল জোহানের সাথে, আজ না হয় শেষ বারের মতো একবার যাক। জোহান কী দেওয়ার কথা বললো সেটা অবশ্যই দেখা উচিত ওর।
জোহানের সাথে যাবে, কি যাবে না ভাবতে ভাবতেই রেডি হতে লাগলো মিতুল।
সাদার উপর গোলাপি রঙের ফ্লাওয়ার পেইন্টিং করা একটা কুর্তি পরলো। সাদা মাটা মেকআপ করলো সাথে। উঁচু একজোড়া হিল পায়ে পরা কালীন দরজায় নক হলো। নক করার সাথে সাথে জোহানের কণ্ঠও শোনা গেল।
“রেডি হয়েছো?”
“হ্যাঁ।” ভিতরে বসে কাঠ গলায় উত্তর দিলো মিতুল।
“ও কে ভালো। আমি নিচে যাচ্ছি। তুমিও ন্যানো সেকেন্ডের মধ্যে এসে পড়ো নিচে।”
“ন্যানো সেকেন্ড মানে?” আবারও কাঠ গলায় বললো মিতুল।
“কথা না বলে নিচে আসো তাড়াতাড়ি।”
“কোথায় নিয়ে যাবে তুমি আমায়?”
“কোথায় নিয়ে যাব সেটা তো গেলেই দেখতে পাবে। অযথা প্রশ্ন করো কেন?”
মিতুলের মেজাজ বিগড়ে গেল। সহজ ভাবে কথা বলতে পারে না বদমাইশটা। প্যাঁচিয়ে কথা বলার স্বভাব। মিতুল আর কথা বললো না কোনো। কথা বাড়তে থাকলে ঝগড়া বেঁধে যাবে সেটা শিওর।
ওপাশ থেকেও আর কোনো সাড়া শব্দ আসলো না।
গ্যারেজের সামনে এসে দেখলো সাইকেল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে জোহান। সাইকেল দেখে মিতুলের মেজাজ আরও খারাপ হলো। এখন এই সাইকেলে করে নিয়ে যাবে ওকে?
জোহান মুখে হাসি ফুঁটিয়ে বললো,
“সাইকেল দেখে খুব খুশি হয়েছো তাই না? আমরা এটায় করেই যাব আমাদের গন্তব্যে।”
মিতুল রাগের সাথে বললো,
“সাইকেল কেন? তোমার গাড়ির কী হয়েছে?”
“কিছুই হয়নি গাড়ির। ইচ্ছা করেই সাইকেলে যাব আমরা।”
মিতুল জেদ ধরে বললো,
“আমি সাইকেলে যাব না।”
“তাহলে হেঁটে যেতে হবে। চলো, হাত ধরাধরি করে দুজনে রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে যাই।”
মিতুলের মেজাজ গুরুতর খারাপ হলো।
মিতুলের রাগে ফুলো নাক দেখে একটু হেসে সাইকেলে উঠে বসলো জোহান।
মিতুল অনিচ্ছা সত্ত্বেও সাইকেলের পিছনে উঠে বসলো।
“ধরে বসো আমাকে। নয়তো পরে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে তোমার। খুবই দ্রুত চালাবো আমি।”
মিতুল গলা যথা সম্ভব কঠিন রাখার চেষ্টা করে বললো,
“ধরবো না আমি তোমাকে। আস্তে চালাবে তুমি।”
“স্যরি আস্তে সাইকেল চালানোর কোনো হিস্টোরি নেই আমার।”
জোহান মুখে এটা বললেও, আস্তেই সাইকেল চালালো। তবে মিতুল ধরেই বসলো জোহানকে।
অনেকক্ষণ সাইকেল চালিয়ে অনেক দূরে আসার পর রাস্তার পাশে সাইকেল থামালো জোহান। সূর্যটার এখন নিভু নিভু ভাব। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই ওই পশ্চিম দিগন্ত থেকে বিদায় নেবে সে।
মিতুল জানে না জোহান ওকে কোথায় নিয়ে এসেছে। শুধু বুঝতে পারলো ওরা বাড়ি থেকে অনেক দূরে কোথাও চলে এসেছে। দেখতে পাচ্ছে কোলাহলহীন একটি রাস্তা এটা। রাস্তার দুপাশে কিছু গোলাপি চেরি পুষ্পের গাছ। সংখ্যায় কয়েকটি হলেও এদের সৌন্দর্য বহুগুণ। অনেক ঝরা পাপড়ি পড়ে রয়েছে রাস্তায়। রাস্তার এক পাশে ঘন সবুজ ঘাসে ঘেরা বড়ো ফিল্ড। চেরি ব্লসমের মাঝে এসে মিতুলের রাগ একটু কমলো। আশপাশটা দেখতে দেখতে সাইকেল থেকে নামলো ও। জোহানও নামলো।
চেরি গাছের নিচে দাঁড়ানো ওরা। মাথার উপর চেরি সজ্জিত ডাল। মিতুল বললো,
“এটা কোথায় এসেছি আমরা?”
জোহান মিতুলের প্রশ্নের উত্তর দিলো না। কিছুটা নীরব থেকে বললো,
“কার্লকে এখনও পছন্দ করো তুমি?”
কার্লের নামটি মিতুলের মনের অন্তঃস্থলে কিছুটা ব্যথার উপস্থিতি জুড়ে দিলো।
“কার্ল? কার্লের কথা বলবে বলে এখানে নিয়ে এসেছো আমায়?”
মিতুল প্রথমে জোহানের কথাটি পুরোপুরি খেয়াল করেনি। কিন্তু যখন খেয়াল হলো তখন বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল ও। চোখ ছেয়ে গেল বিস্ময়বিমূঢ়তায়।
“তু…তুমি কীভাবে জানো আমি কার্লকে পছন্দ করি?” মিতুলের কম্পিত গলা।
“তুমি যে কার্লকে পছন্দ করতে সেটা দেখলেই বোঝা যেত। তুমি যেভাবে তাকাতে ওর দিকে, যে কণ্ঠে কথা বলতে ওর সাথে, তাতে এটা সুস্পষ্ট ছিল।”
জোহানের কথায় মিতুল আরও আশ্চর্যান্বিত হলো। তার মানে জোহান অনেক আগে থেকেই জানতো? মিতুলের কাছে অবিশ্বাস্য ঠেকছে সব কিছু । কিন্তু ও নিজের দুর্বলতা দেখালো না জোহানের কাছে। ব্যাপারটাকে সহজ ভাবে মেনে নেওয়ার চেষ্টা করলো। কণ্ঠকে স্বাভাবিক করে বললো,
“শুধু এই কথাটা জিজ্ঞেস করার জন্যই এখানে নিয়ে এসেছো আমায়? এ কথা তো বাড়িতেই জিজ্ঞেস করতে পারতে। এখানে আনার তো কোনো দরকার ছিল না।”
“এটা জিজ্ঞেস করবো বলে তো এখানে নিয়ে আসিনি। তোমাকে অন্য কিছু বলার আছে আমার।”
“কী বলবে?”
জোহান একটু সময় নিয়ে বললো,
“আমি…” বলতে গিয়েও কণ্ঠ আবার থেমে গেল। মিতুলকে ভালো করে দেখলো কিছু সময়।
মিতুল তাকিয়ে আছে।
জোহান যা বলতে চাইলো তা বললো না। হঠাৎ করে বললো,
“আমি অসুস্থ মিতুল!”
জোহানের প্রতি মিতুলের যে একটু রাগ অবশিষ্ট ছিল, তা নিঃশেষ হয়ে এবার ব্যাকুলতার সৃষ্টি হলো। মিতুল ব্যাকুল কণ্ঠে বললো,
“অসুস্থ? কী হয়েছে তোমার? জ্বর এসেছে?”
“না, সেরকম অসুস্থতা নয়।”
“তাহলে?”
জোহান আচমকা মিতুলের ডান হাত এনে নিজের বুকের বাম পাশে চেপে ধরলো। চমকে উঠলো মিতুল।
জোহান বললো,
“হৃদয় অসুস্থ আমার।”
মিতুল বিস্ময়ান্বিত চোখে তাকিয়ে আছে জোহানের দিকে। জোহানের দ্রুত হৃদস্পন্দনের গতি টের পাচ্ছে ও। জোহানের সাথে সাথে ওর হৃদস্পন্দনও বেড়ে যাচ্ছে। ঝড় বইছে হৃদয়ে। তুমুল আকারের ঝড়।
জোহান শান্ত কণ্ঠে বললো,
“তোমার উচিত কার্লের প্রতি তোমার অহেতুক ভালো লাগার এখানেই সমাপ্তি ঘটানো।”
মিতুল নির্বাক। ওর মাথায় তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। শ্বাস ভারী হচ্ছে।
মিতুলকে এসব বলতে জোহানের হৃদয় কাঁপছে। হৃদয়ের এমন কাঁপন এর আগে কখনো উপলব্ধি করেনি ও। গলাও কাঁপছে একটু। জোহান নিজের শুকিয়ে যাওয়া গলাটা ঢোক গিলে ভিজিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে বললো,
“আমি তোমাকে পছন্দ করি মিতুল!”
মিতুলের হৃদয়ে বয়ে চলা তুমুল ঝড় আরও সাংঘাতিক রূপ ধারণ করলো। অশান্ত, বেপরোয়া সেই ঝড় হৃদয় ভাসিয়ে নিচ্ছে যাচ্ছে ওর। হৃদয়ের এই বেসামাল ছটফটানি আর সহ্য তুল্য নয়।
একটু দমকা হাওয়া বইলো। সেই দমকা হাওয়ার সাথে গাছ থেকে উড়ে পড়তে লাগলো কিছু কোমল চেরি পাপড়ি। জোহান মিতুলের বিস্ময় ঘেরা আতঙ্কিত মুখ থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে হাত বাড়িয়ে একটা চেরি পাপড়ি মুঠো বন্দি করলো।
মুঠো বন্দি হাতটা মিতুলের সামনে এনে খুলে বললো,
“তুমি যতটা এই চেরি ব্লসম পছন্দ করো, তার থেকে অনেক অনেক বেশি পছন্দ করি আমি তোমাকে। ভালোবাসি! ভালোবাসি তোমায়!”
মিতুলের হাত-পা সব দুর্বল হয়ে পড়ছে। শক্তি বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে ক্রমে ক্রমে। কী করবে ও? ভাবনায় কিছুই ধরা দিলো না এই মুহূর্তে। বিস্ময়কর চমকপ্রদ এই পৃথিবীর সবকিছুই যেন ফেরারি হয়ে গেছে ওর মস্তিষ্ক থেকে।
জোহান ওর হাতের চেরি পাপড়িটি মিতুলের হাতে গুঁজে দিলো। তারপর আবার মিতুলের দিকে তাকিয়ে বললো,
“আমি আমার কথা বলে দিয়েছি। তুমি কী করবে? তোমার কী মনে হয়? তুমি কি তোমার মনের আসল চাওয়াটা ধরতে পেরেছো? কী ভাবো তুমি? আমাকে পছন্দ তোমার?”
মিতুল যেন উত্থাল সমুদ্রের বুকে ঢেউয়ের সাথে পাক খাচ্ছে। কী করবে ও? কী করা উচিত? কিছু বলা উচিত জোহানকে? কী বলবে? মিতুল হাতের চেরি ব্লসম পাপড়িটা শক্ত করে আঁকড়ে ধরলো। কাঁপা কণ্ঠে বললো,
“আসলে…আমি…”
কিছুই বলে উঠতে পারলো না মিতুল।
“কী? বলো।”
“আসলে…”
এবারও বলতে পারলো না কিছু।
জোহান মিতুলের এমন ইতস্তত ভাব দেখে হঠাৎ মিতুলের হাত ধরে টান দিয়ে মিতুলকে আরও কাছে এনে ফেললো।
ভীষণ ভাবে চমকে উঠলো মিতুল। মনে হচ্ছে ওর হৃৎপিণ্ড গলার কাছে উঠে এসেছে। একটুখানি সময়ের মধ্যেই দেহ ত্যাগ করবে সে। আর তারপরই জোহানের সামনে ও লুটিয়ে পড়বে মাটিতে।
জোহান মিতুলের দিকে গভীর চোখে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। তারপর বললো,
“আসলে কী, তা তুমি জানো না। আমি জানি। তুমি আসলে…পছন্দ করো আমাকে। আর সেটা অনেক আগে থেকে। যেটা বুঝতে পারোনি তুমি।”
মিতুলের মনে হলো ও ভুল শুনছে। অনেক আগে থেকে জোহানকে পছন্দ করে ও? কবে থেকে?
মিতুল একটু ভাবতে চাইলো ও কবে থেকে পছন্দ করে জোহানকে। কিন্তু ওর ভাবনা সেই পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছতে পারলো না। ওর ধ্যান, জ্ঞান, ভাবনা সবকিছু এখন এখানেই নিবদ্ধ। বর্তমানের এই ক্ষণ ছেড়ে কিছুতেই অতীত হাতড়াতে যেতে পারলো না ও।
মিতুল দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না আর জোহানের সামনে। পা তাল হারিয়ে ফেলছে। শরীর ঘেমে যাচ্ছে। ও কোনো রকম বললো,
“বাড়ি ফিরি চলো।”
“বাড়ি ফিরতে তাড়া তোমার? না কি আমার থেকে পালাতে চাইছো?”
মিতুল দুই পাশে মাথা নাড়িয়ে বুঝালো, না ও পালাতে চাইছে না।
“ও তাই? পালাবে না তুমি? কী করে বুঝবো? প্রমাণ দাও। জড়িয়ে ধরো আমায়।”
মিতুলের হৃদয় ছ্যাত করে উঠলো। জড়িয়ে ধরবে মানে?
জোহান মিতুলকে স্থির দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কিছুটা অভিমানী সুরে বললো,
“ওহ! বুঝেছি। তুমি আসলে মিথ্যা বলেছো আমাকে। তুমি ঠিকই পালাতে চাইছো।”
জোহান অভিমান করেছে এমন একটা ভঙ্গিতে মুখ ঘুরিয়ে নিলো অন্যদিকে।
কিছুটা সময় নীরব কেটে গেল।
জোহান হঠাৎ টের পেল কেউ একজন ওর বাম হাতের বাহু জড়িয়ে ধরছে। জোহানের বুঝতে বাকি নেই এটা মিতুল। মিতুল ছাড়া কেই বা আছে এখানে?
জোহান পাশে তাকালো। মিতুল হাত জড়িয়ে ধরে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। জোহান প্রশস্ত হাসলো। মিতুলের রাগহীন নাকটাকে আলতো করে টেনে বললো,
“আমার বোকা তুলতুল বোধহয় একটু বুদ্ধিমান হবে এবার। তবে তুলতুলের রাগে ফুলো নাকটা যে আজীবন দেখতে পারব, সেটা কনফার্ম।”
বলে আবারও হেসে ফেললো জোহান।
মিতুল মুগ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে আছে জোহানের দিকে। জোহানের হাসি এত মিষ্টি সেটা আগে কখনো খেয়াল করেনি কেন ও?
মিতুল জোহানের বাহু ধরেই হাঁটতে হাঁটতে সাইকেলের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এক সমুদ্র জড়তাকে ছাপিয়ে এক আকাশ প্রশান্তির মাঝে হারিয়ে গেছে ও।
প্ৰকৃতির এই সন্ধ্যা যে এত অনন্য মায়াময় হতে পারে, সেটা আগে জানা ছিল না মিতুলের। চেরি ব্লসমের সাথে কাটানো আজকের এই সন্ধ্যা, সারাজীবনের সবগুলো সন্ধ্যার থেকে শ্রেষ্ঠ হয়ে থাকবে। এই শুভ্র চেরি পুষ্প, এই সন্ধ্যা, এই ঝাপসা আলো আঁধারের পরিবেশ ওর মনের গাঢ় অনুভূতির সাক্ষী হয়ে থাকবে। এই অনুভূতি ফুরোবে না কোনো দিন। সেই সাথে ফুরোবে না এই সন্ধ্যার রেশ। সারাজীবন মনে থাকবে এই সন্ধ্যাকে। মনে থাকবে ওর জীবনের শ্রেষ্ঠ সন্ধ্যা ছিল, চেরি ব্লসমের সাথে এক সন্ধ্যা।
বাড়ি ফিরতে ফিরতে রাত হলো। গ্যারেজে এসে সাইকেল থামাতেই মিতুল দ্রুত নেমে পড়লো সাইকেল থেকে। কোনো দিকে না তাকিয়েই দ্রুত পায়ে ছুটতে লাগলো ঘরের দিকে। কিছুদূর চলে এলেই পিছন থেকে বাতাসের সাথে সাথে দুটি শব্দ এসে কর্ণ কুহরের কড়া নাড়লো,
“হেই তুলতুল!”
মিতুলের পা অলৌকিক শক্তিতে থেমে গেল যেন। পিছন ফিরে তাকানোর সাহস নেই ওর। তবুও কীসের একটা টানে যেন ফিরলো।
জোহান হাত দিয়ে লাভের আকৃতি করে বাংলায় বললো,
“ভালোবাসি!”
তারপর আবার ইংলিশে বললো,
“এটাই তোমার পাওয়া বাকি ছিল। ভালোবাসা!”
বলে মিষ্টি হাসি ফোঁটালো মুখে।
মিতুলের মনে হলো ও পাগল হয়ে যাচ্ছে। দ্রুত চোখ ফিরিয়ে আনলো জোহানের উপর থেকে। তারপর আবারও ছুটতে শুরু করলো।
___________
ঘুমাতে পারছে না মিতুল। একটু চোখ বন্ধ করলেই জোহানের মুখ ভেসে উঠছে। ও এই শুয়ে পড়লেই, আবার এই উঠে যাচ্ছে। এবারও কম্বল সরিয়ে উঠে বসলো। আস্তে করে কয়েকটা কিল বসালো বুকে। কিন্তু এই কিল ওর অন্তর পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছলো না। হৃদয়ের ঝড় থামলো না। হেরফের হলো না কোনো কিছু। পাগলই হয়ে যাচ্ছে বোধহয়।
ইশ, কালকে কী করে মুখ দেখাবে জোহানকে? জোহানের সামনে পড়লেই তো লজ্জায় মাটির সাথে মিশে যেতে ইচ্ছা হবে ওর। হায় আল্লাহ! কী করবে এখন? না, এই কানাডা শেষমেশ পাগল করেই ছাড়বে ওকে। উহ! কোথায় যাবে ও? জোহানের কথাগুলো কানে বেজে উঠছে ওর,
“তুমি যতটা এই চেরি ব্লসম পছন্দ করো, তার থেকে অনেক অনেক বেশি পছন্দ করি আমি তোমাকে। ভালোবাসি! ভালোবাসি তোমায়!”
মিতুল এবার উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ে উত্তেজনায় কয়েকটা কিক বসিয়ে দিলো বেডে। অসহ্য রাতটা একটু তাড়াতাড়ি কেটে যাক।
______________
মেঘনা নদীতে আছে মিতুল। ছোটো একটি নৌকাতে ও। নৌকার এক প্রান্তে মাঝি, অন্য প্রান্তে ও এবং জায়িন। জায়িনের বুকে মাথা রেখে জায়িনকে জড়িয়ে ধরে বসে আছে ও। এখন গোধূলি লগ্ন। আকাশের রূপটা এখন দেখার মতো। আকাশের মনোরম প্রতিচ্ছবিটি থলথলে পানির উপর ভাসছে। মিতুল প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য এক পলক দেখে নিয়ে বড়ো করে নিঃশ্বাস ছেড়ে চোখ বন্ধ করলো। নিশ্চিন্ত মনের নিঃশ্বাস বলে একে। জায়িনের শান্ত কণ্ঠ কানে ভেসে এলো,
“এখানে থাকতে ভালো লাগছে তোমার দিলরাবা?”
কথাটি সম্পূর্ণ শুদ্ধ বাংলায় বললো জায়িন।
জায়িনের মুখ থেকে দিলরাবা ডাকটি শুনে মিতুলের অন্তর জুড়িয়ে গেল। দিলরাবা! হ্যাঁ, জায়িন ওকে ভালোবেসে দিলরাবা বলে ডাকে। জায়িনের মুখ থেকে এই দিলরাবা ডাকটি শুনলেই ওর মনে হয় এটা ওর জীবনের সবচেয়ে পরম পাওয়া। মিতুল চোখ বন্ধ রেখেই বললো,
“হুম ভালো লাগছে। বিশেষ করে তোমার বুকে মাথা রাখতে ভালো লাগছে আমার।”
বলেই মিতুল হঠাৎ করে কেন যেন চোখ খুলে ফেললো। ওদের সামনা সামনি মাঝিটাকে দেখলো। মাঝি দূরে বসে থাকলেও ও স্পষ্ট মাঝির মুখ দেখতে পাচ্ছে। মাঝির পরনে লুঙ্গি, গায়ে সাদা গেঞ্জি। ঘাড়ের উপর থেকে একটা গামছা ঝুলিয়ে রেখেছে। চুলগুলো বাদামি রঙা, চোখের মণিও বাদামি। চেহারা দেখে প্রথমে মনে হয় সার্জারি করে এত সুন্দর বানানো। পর মুহূর্তে আবার মনে হয় সার্জারি করা নয়। সত্যিই এমন। নৌকাতে ওঠার পর এই প্রথম মাঝির চেহারা দেখলো মিতুল। এই মুখটা খুব চেনা চেনা লাগছে ওর। অনেক বার যেন দেখেছে এই মুখ। কোথায় দেখেছে? মিতুলের চোখে জোহানের হাস্যজ্জ্বল মুখ ভেসে উঠলো। বিস্ময়ে কপালে ভাঁজ পড়লো ওর। ও অস্ফুট স্বরে উচ্চারণ করলো,
“জোহান!”
হঠাৎ করে একটা দমকা হাওয়া বইলো। সেই দমকা হাওয়া গায়ে লাগতেই জোহান কুয়াশার মতো হয়ে একসময় চোখের অদৃশ্য হয়ে গেল!
মিতুলের বুকটা কষ্টে দুমড়ে-মুচড়ে যাচ্ছে। জোহান কুয়াশা হয়ে গেল কেন? কোথায় গেল জোহান?
ঘুমন্ত মিতুলের চোখের কোণ বেয়ে এক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়লো নিশ্চুপ। ও একটু নড়েচড়েই জেগে উঠলো হঠাৎ। চোখ মেলতেই ওর সব কিছু এলোমেলো লাগলো। এ কোথায় আছে ও? কোন জায়গা এটা?
মিতুল কম্বল গায়ে পেঁচিয়ে ফ্লোরে পড়ে আছে। ‘পড়ে’ না ঠিক। কালকে রাতে ঘুম আসছিল না দেখে বিছানা ছেড়ে উঠে গিয়েছিল। কম্বল গায়ে জড়িয়ে পায়চারি করছিল কিছুক্ষণ রুমের ভিতর। মনের অশান্ত ছটফটানি কমছিল না কিছুতেই। তাই এই জ্বালা নিয়ে এক সময় অতিষ্ঠ হয়ে ফ্লোরেই শুয়ে পড়েছিল। হ্যাঁ, ফ্লোরে। মিতুলের সবটা মনে পড়তেই ধরফড়িয়ে উঠে বসলো। আশেপাশে উদ্বিগ্ন চোখ বুলালো। হ্যাঁ, ও তো ওর রুমে।
“আহ্!” মাথার পিছনটা হঠাৎ ব্যথা করে উঠলো। ও আলতো হাত রাখলো মাথার পিছনে। সারারাত এই ফ্লোরে পড়ে ছিল বালিশ ছাড়া?
মিতুল গায়ের কম্বলটা আঁকড়ে ধরে উঠে দাঁড়ালো। সারারাত ধরে তো ফ্লোরে ছিল না। ফ্লোরে শুয়েই তো ছিল একেবারে শেষ রাতের দিকে। তাহলে সারারাত হলো কীভাবে? শীতে হাত-পা কাঁপছে ওর। এত শীত কেন? হঠাৎ জানালার দিকে চোখ পড়লো। জানালা খোলা! মিতুল দৌঁড়ে এসে জানালা বন্ধ করলো। জানালা খোলা রেখে ফ্লোরে এই শীতের মাঝে কীভাবে শুয়েছিল ও? জোহানের জন্য সত্যি সত্যিই কি মাথা খারাপ হয়ে গেল না কি ওর? হ্যাঁ, মাথা খারাপই হয়ে গেছে। তা না হলে এই শীতে কি কেউ জানালা খোলা রেখে ফ্লোরে ঘুমাতে পারে?
মিতুল শরীর থেকে কম্বলটা সরিয়ে একটা জ্যাকেট চাপিয়ে নিলো। তারপর এগিয়ে এলো জানালার কাছে।
বাইরে ঘন কুয়াশা। কুয়াশার আস্তরণ পেরিয়ে চোখ কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। মিতুল নিজের স্বপ্নটার কথা ভুলেই গিয়েছিল প্রায়। হঠাৎ মনে পড়ে গেল। নৌকা, জায়িন, ও এবং সেই মাঝি! ছি ছি ছি! কীভাবে এমন একটা স্বপ্ন দেখতে পারলো ও? জায়িনকে জড়িয়ে ধরে তার বুকে মাথা রেখে…ছি! এ যে ওর ভাবনারও বাহিরে। আর মাঝি? জোহানকে মাঝি হিসেবে দেখেছে ও? জোহান মাঝি? হাহ! ওর ভাবনাতো দেখছে দিনকে দিন লিমিট ছাড়িয়ে যাচ্ছে।
জায়িনের বুকে মাথা রাখার দৃশ্যটা আবারও মনে পড়লো মিতুলের। গা ঘিনঘিন করে উঠলো ওর।
(চলবে)