#চেরি_ব্লসমের_সাথে_এক_সন্ধ্যা,৪৫,৪৬
#লেখা: ইফরাত মিলি
#পর্ব: ৪৫
____________
আজকে রিভার ভ্যালি পার্ক ঘুরতে যাচ্ছে মিতুল। জোহানের সাথে। বিকেল পর্যন্ত সেখানেই কাটাবে। এটা কিছুটা বনভোজনের মতো। মিতুলের আসলে জোহানের সাথে রিভার ভ্যালি পার্ক ঘুরতে যাওয়ার কথা ছিল না। রেশমী আন্টি এবং ক্যামিলার সাথে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু শপে অনেক কিছু কেনাকাটা করতে হবে দেখে রেশমী আন্টি যেতে পারবেন না। রেশমী আন্টির পার্কে যাওয়া বাড়িতে বসেই নাকোচ হলো তাই। এরপর কথা হলো শুধু ও এবং ক্যামিলা যাবে। কথা অনুযায়ী বাড়ি থেকে বের হলো ক্যামিলার সাথে। ওদের গাড়িটা যখন এলাকা থেকে বের হওয়ার পথে, তখন হঠাৎ জোহানকে দেখা গেল। হাত দিয়ে ইশারা করে গাড়ি থামালো জোহান। ক্যামিলা রাস্তার পাশে পার্কিং সাইডে গাড়ি থামিয়ে নেমে গেল গাড়ি থেকে। জোহান উঠে বসলো সেখানে। আর ক্যামিলার জায়গা হলো পিছনে।
মিতুল অবাক হয়েছিল এই কাণ্ডে। ও চুপচাপ অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখলো সবটা। জোহান ওদের সাথে পার্কে যাবে এমন কোনো কথা হয়নি। জোহান খুব সকাল বেলা বাড়ি থেকে বের হয়ে গিয়েছিল। যাওয়ার সময় বলেছিল, খুব ইম্পরট্যান্ট একটা জায়গায় যাচ্ছে। সারাদিন সেখানেই থাকবে। কেউ যেন ওকে মিস না করে আবার। মিস করার কথাটা যে মিতুলকে ইঙ্গিত করে বলেছিল, সেটা মিতুল বুঝতে পেরেছিল। সকাল বেলা অমন করে বিদায় জানিয়ে চলে গিয়ে এখন আবার এখানে এসে এই কাণ্ড ঘটালো।
জোহান গাড়িতে উঠে বসার পর মিতুল ভেবেছিল ওর এবং ক্যামিলার সাথে হয়তো জোহানও যাবে পার্কে। হ্যাঁ, জোহান যাচ্ছে ঠিকই। কিন্তু ক্যামিলা যাচ্ছে না। ক্যামিলাকে তার বাড়ি পর্যন্ত ড্রপ করে দিলো জোহান। ক্যামিলা সাধারণত নিজ বাড়িতে খুব কম আসে। রেশমী আন্টিদের বাড়িতেই থাকে সবসময়। ক্যামিলার বাড়ি এডমন্টনের ভিতরেই।
জোহান ক্যামিলাকে বাড়িতে ছেড়ে দেওয়ায় মিতুল জিজ্ঞেস করেছিল,
“ক্যামিলা যাবে না আমাদের সাথে?”
জোহান উত্তর দিলো,
“না, শুধু তুমি আর আমি যাব। কেন? আমার একার সাথে যেতে সমস্যা আছে তোমার?”
মিতুল জোহানের কথার উত্তর দেয়নি তখন। জোহানের সাথে যেতে ওর কী সমস্যা থাকবে? বরং ভালো লাগছে।
ক্যামিলার সাথে না কি জোহানের আগেই কথা হয়েছে এ ব্যাপারে। বাড়িতে যখন ঘুরতে যাওয়া নিয়ে কথা হচ্ছিল, মিতুল তখন জোহানের নামটাও বলতে চাইছিল। কিন্তু রেশমী আন্টির সামনে সেটা মোটেই পারেনি। কিন্তু দেখো কী আজব কাণ্ড! জোহানের পার্কে যাওয়ার কোনো নাম গন্ধ না থাকলেও, সেই জোহানের সাথেই যাচ্ছে ও এখন। মিতুলের মনটা বেশ খুশি খুশি লাগছে।
অল্প কিছুক্ষণের ভিতরই পার্কে পৌঁছে গেল ওরা। এই পার্কে প্রবেশ করতে ওদের অনেক পথ হেঁটে উপর থেকে নিচে নামতে হলো। এটা অনেকটা পাহাড়ে হাইকিং করবার মতো। কারণ, নদীর পাড়ে অবস্থিত হওয়ায় এই পার্কটা শহরের মূল ভূখন্ড থেকে কিছুটা নিচে অবস্থিত। পার্ক থেকে যাওয়ার সময়ও ওদের আবার একই পথ অবলম্বন করতে হবে। পার্কের হাইকিং এর পথটি একটি ঘন জঙ্গলের ভিতর দিয়ে চলে গিয়েছে।
ওরা নিজেদের সাথে নিয়ে আসা প্রয়োজনীয় সবকিছু ঘাসের চাদরে মোড়ানো ওপেন প্লেসে এনে রাখলো। প্রয়োজনীয় বলতে, ঘাসের উপরে বিছানোর জন্য একটা চাদর, একটা বালিশ এবং কিছু খাদ্য দ্রব্য।
জোহান বললো,
“চলো, আগে পার্কটা একটু ঘুরে দেখি।”
“এগুলো এখানে রেখে যাব? যদি কেউ নিয়ে যায়?”
“ওহ মিতুল, কে নেবে তোমার এসব জিনিস পত্র? তাকিয়ে দেখো, সবাই সবার প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে এসেছে। কেউ হাত দেবে না তোমার এগুলোয়।”
মিতুল আশেপাশে একবার তাকিয়ে দেখলো। বেশি না, মাত্র সাত-আট জন মানুষ ওপেন স্পেসগুলোতে শুয়ে বসে আছে।
মিতুল বললো,
“ঠিক আছে, চলো।”
পার্কটা ঘুরে দেখার সময় আরও অনেক মানুষকে চোখে পড়লো। তবে উইকেন্ডে এখানে মানুষের যে আনাগোনা থাকবে তার কাছে এটা খুবই নগণ্য।
রিভার ভ্যালি পার্কের পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে নর্থ সাস্কাচোয়েন রিভার। এই রিভারটি পার্কের মূল আকর্ষণ।
ওরা দুজন কিছুক্ষণ নদীর ধার ধরে হাঁটলো। মৃদু বাতাসের চলাচল মনে প্রশান্তির ছোঁয়া এনে দিলো মিতুলের।
জোহান বললো,
“এখানে বাতাসের গতিবেগ মাঝে মধ্যে খুবই প্রবল হয়। তখন নদীর ধারে হাঁটলে বিরক্ত ছাড়া আর কিছুই ফিল করতে পারবে না।”
“তুমি এই পার্কে এর আগে কতবার এসেছো?”
“এসেছিলাম বেশ কয়েকবার। একা এসেছি, আবার ফ্রেন্ডসদের সাথেও এসেছি। ফ্রেন্ডসরা মিলে পিকনিক করেছিলাম এখানে।”
“ও।” মিতুল আর কিছু বললো না। নীরব হয়ে গেল পরিবেশ।
এই রিভারটির এক পাশে পার্ক এবং অন্যপাশে ঘন জঙ্গল। জোহান বললো,
“এলাকার লোকজন প্রায়ই এখানে মর্নিং ওয়াক, ইভিনিং ওয়াক করতে আসে।”
মিতুল লক্ষ করলো নদীর ধারে বসবার ব্যবস্থা আছে। হয়তো নদীর ধারে বসে শান্ত সময় পার করবার জন্যই এই ব্যবস্থা। ওরা দুজন এগিয়ে এসে একটা বেঞ্চির উপর বসলো।
কিছুক্ষণ এখানে বসে থেকে নদীর সৌন্দর্য উপভোগ করলো। তারপর আশেপাশে কিছু জায়গা ঘুরে আবার ফেরত এলো ওপেন প্লেসে। ওপেন প্লেসগুলোতে মানুষ জনের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। মিতুল দেখলো ওদিকটায় একজন মা তার দুইটি যমজ সন্তান নিয়ে বসে আছে। মিতুলের ভুল না হলে বাচ্চা দুটির বয়স দুই বছরের বেশি না। মিতুল কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল মা এবং বাচ্চা দুটোর দিকে।
“ওদিকে তাকিয়ে কী দেখছো?” মিতুলকে দূরে তাকিয়ে থাকতে দেখে বললো জোহান।
“কিছু না।”
মিতুল ঘাসের উপর জোহানের বিছিয়ে দেওয়া চাদরটার উপর শুয়ে পড়লো। ওপেন প্লেসে থাকা মানুষগুলো ওদের থেকে দূরে নিজেদের অবস্থান করেছে। সকলেই একে অপরের থেকে বেশ দূরবর্তী।
মিতুল বড়ো করে একটা নিঃশ্বাস নিয়ে চোখ বন্ধ করলো। শান্তি শান্তি লাগছে। এমন খোলা জায়গায় বাতাসের মৃদু চলাচলের মাঝে এর আগে কখনো শোয়া হয়নি ওর।
মিতুল বেশ কিছুক্ষণ চোখ বুজে রইল। এর মাঝে হঠাৎ জোহানও শুয়ে পড়লো ওর পাশে। মিতুল ব্যাপারটা বুঝতে পেরেই ধরফর করে উঠে গেল।
“এ কি! এখানে শুয়েছো কেন? একটা মেয়ের পাশে কীভাবে এমন করে শুয়ে পড়তে পারো তুমি? লজ্জা নেই তোমার?”
“কী করবো? তুমিই তো মাত্র একটা চাদর আর একটা বালিশ নিয়ে এসেছো।”
“তো? একটা চাদর আর একটা বালিশই তো নিয়ে আসবো। আমি আর ক্যামিলা তো এই একটা চাদর আর বালিশেই শুতে পারতাম। বালিশটা বড়ো দেখে এনেছি। ক্যামিলার জায়গায় যে হুট করে তুমি আসবে এখানে, সেটা কে জানতো? তুমি কি বলে কয়ে এসেছিলে?”
“তাহলে এখন আমি কী করবো? তুমি আমাকে এই চাদর এবং বালিশ থেকে বঞ্চিত করবে?”
“হ্যাঁ, অবশ্যই।”
বলে উঠে দাঁড়ালো মিতুল। তারপর জোহানের এক হাত ধরে টানাটানি করে জোহানকে চাদর থেকে নামিয়ে ঘাসের উপর এনে ফেললো।
“শুধু ঘাসের উপর থাকবে তুমি।”
জোহান উঠে বসে বললো,
“এভাবে টর্চার করছো তুমি তুলতুল? আমার জন্য কি তোমার মায়া নেই?”
“না নেই।”
বলে মিতুল একাই পুরো চাদর হস্তক্ষেপ করে শুয়ে পড়লো।
জোহান বললো,
“এটা ঠিক করছো না তুমি।”
মিতুল জোহানের কথাকে গ্রাহ্য না করে চোখ বুজলো।
জোহান একটু ভেবে বললো,
“চলো চাদরটা আধা আধা ভাগ করি।”
মিতুল জোহানের কথা কানেই তুললো না।
জোহান নিজের প্রতি এমন অবহেলা দেখে বললো,
“তোমাকে বিয়ে করার পর আমার অবস্থা কী হবে সেটা ভেবে আমি এখনই শিহরিত।”
জোহানের কথা মিতুলের কান পর্যন্তই পৌঁছলো না মনে হয়। জোহানও আর কিছু বললো না। মিতুলের মুখের দিকে তাকিয়ে নিঝুম হাসলো। ওপেন প্লেসে বেশিরভাগ জায়গায়তেই রৌদ্র। এ রোদ গায়ে লাগার মতো নয়। বরং এই রোদ গায়ে জড়িয়ে শুয়ে থাকার মাঝেই শান্তি। ওরা গাছের ছায়ায় চাদর না বিছিয়ে রোদের মাঝেই বিছিয়েছে। রোদটা শান্ত, নিবিড় হলেও মিতুলের মুখখানিতে রোদের দখলদারি ভালো লাগলো না জোহানের। জোহান হাত দিয়ে মিতুলের মুখের উপর পড়া রোদকে আড়াল করলো। ছায়া দিলো মিতুলের মুখে।
মিতুল চোখ বুজে থাকলেও বেশ বুঝতে পারলো ব্যাপারটা। চোখ মেলে তাকালো ও।
জোহান বললো,
“কী দেখছো? যত্ন নিচ্ছি তোমার।”
মিতুল হেসে ফেললো। মাথার নিচ থেকে বালিশটা সরিয়ে পাশে ঘাসের উপর রেখে বললো,
“নাও। বালিশটা দিলাম তোমায়।”
জোহানও একটু হেসে মিতুলের দেওয়া বালিশে শুয়ে পড়লো ঘাসের উপর। পরিষ্কার ঘাস। চাদরের প্রয়োজন পড়ে না। জোহান গা থেকে খুলে রাখা কোটটা মুখের উপর দিয়ে নিলো।
জোহানের দেখাদেখি মিতুলও নিজের ওড়না দিয়ে মুখ ঢাকলো।
জোহান কোটের নিচ থেকে বললো,
“ডোন্ট ও্যরি তুলতুল। আমাদের যখন বিয়ে হয়ে যাবে, তখন আমরা আবার ঘুরতে এসে এক বালিশ আর এক চাদরে শোবো।”
মিতুলের গাল দুটো লাল হয়ে উঠলো লজ্জায়। যদিও তা ঢাকা পড়ে রইল ওড়নার আড়ালে। যত দিন যাচ্ছে ও ততোই বুঝতে পারছে, জোহানের লজ্জা আসলে বড্ড কম। বিয়ের কথা কী করে এমন ভাবে বলে দিলো? লজ্জা থাকলে কি কেউ এভাবে বিয়ের কথা বলে দিতে পারে?
____________
বিকেলের আলো পড়ে গেছে। প্রকৃতিতে অন্ধকারের বিরাজ হবে এরপর।
মিতুলের মন একটু খারাপ। জায়িনের সাথে বাইরে ডিনারে যেতে ইচ্ছা করছে না ওর। ওই অহংকারীটার সাথে কী করে একা একা ডিনার করবে? ভাবতেই মাথায় যন্ত্রণা ধরে যাচ্ছে। জায়িন আবার নিজ থেকে ওকে শাড়ি পরতে বলেছে। শাড়ি পরতেও ওর ভীষণ অনিচ্ছা। কিন্তু জায়িন নিজ থেকে বলার পরও যদি শাড়ি না পরে তবে কেমন হবে? শত হলেও ও এখন জায়িনদের বাড়িতে থাকছে। জায়িনদের একজন অতিথি ও।
মিতুল অনিচ্ছা সত্ত্বেও জায়িনের দেওয়া হলুদ রঙা শাড়িটা পরলো। সাজতে ইচ্ছা করলো না, তারপরও শাড়ি পরেছে বলে সাজলো হালকা-পাতলা।
শাড়ি পরে মিতুল প্রথমেই দেখাতে এলো জোহানকে। জোহান বেডে হেলান দিয়ে মোবাইলে গেমস খেলছিল। মিতুলকে দেখতে পেয়ে মিতুলের দিকে মনোনিবেশ করলো।
মিতুল মনে একটা চাপা আনন্দ নিয়ে বললো,
“কেমন লাগছে আমায়?”
জোহান বিরক্ত মুখে বললো,
“আবারও শাড়ি পরেছো তুমি?”
মিতুলের মন থেকে চাপা আনন্দটুকু বিলীন হয়ে গেল। মন খারাপ হলো একটু। ওর ধারণা ছিল জোহান আজকে ওর প্রশংসা করবে। যেহেতু ওরা এখন রিলেশনশিপে আছে। কিন্তু জোহান ওর ধারণা মিথ্যা করে দিলো। আজ পর্যন্ত শুধরালো না জোহান। মিতুল বললো,
“আমাকে কি খুবই খারাপ দেখাচ্ছে?”
“খারাপ দেখাচ্ছে আমি কি সেটা বলেছি?”
জোহান একটু থামলো। পরে আবার বললো,
“এই সন্ধ্যায় শাড়ি পরেছো কেন? কোথায় যাচ্ছ শাড়ি পরে? কার্লের কাছে যাচ্ছ না কি আবার? আমি থাকতে এখনও কার্লকে মনে জায়গা দিয়ে রেখেছো?”
মিতুলের রাগ হলো।
“আমি কি বলেছি আমি কার্লের কাছে যাচ্ছি? এত অগ্রিম বোঝো কেন তুমি? আমি কার্লের কাছে না, তোমার ব্রাদারের সাথে ডিনারে যাচ্ছি।”
“ব্রাদারের সাথে? ডিনারে?”
“হুম।”
“কেন?”
“মানুষ কেন যায় ডিনারে?”
জোহান আর মিতুলের প্রশ্নের উত্তর দিলো না। বললো,
“ঠিক আছে যাও।”
মিতুল জোহানের রুম থেকে বেরোনো দিলে জোহান ডাকলো আবার।
“শোনো…”
“কী?”
“সুন্দর লাগছে তোমায়।”
মিতুল লজ্জা পেল। মন খারাপের রেশটুকুও কেটে গেল। কিছু না বলেই দ্রুত বেরিয়ে এলো জোহানের রুম থেকে। জোহানের মুখের প্রশংসা যে এত লজ্জাদায়ক হবে জানতো না ও।
মিতুল নিচে নেমে দেখলো জায়িন রেডি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ওর জন্যই অপেক্ষা করছিল।
মিতুল কাছে আসতেই জায়িন একবার ওকে ভালো করে দেখে বললো,
“ঠিকই ধরেছিলাম। এই শাড়িতে খুবই সুন্দর লাগছে তোমাকে।”
জায়িনের মুখের প্রশংসা অতটাও ভালো লাগলো না মিতুলের। মিতুল একটু হেসে ধন্যবাদ জানালো জায়িনকে।
জায়িন মিতুলকে ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্ট কারি কাবাবে নিয়ে এসেছে। এটা এডমন্টনের একটি হালাল রেস্টুরেন্ট। এখানে এসে যা অর্ডার করার তা সব জায়িনই করলো। মিতুলকে কী খাবে জিজ্ঞেস করতে মিতুল কিছু বলতেই পারলো না।
জায়িন অনেক কিছুই অর্ডার করলো। নান, তান্দুরী চিকেন, চিকেন বিরিয়ানি, ল্যাম কোরমা, সমুচা, রসমালাই ইত্যাদি।
মিতুলের কোনো কিছুই খেতে ইচ্ছা করছে না। জায়িনের সাথে এখানে বসে থাকতেই অস্বস্তিতে মরে যাচ্ছে ও। এই জায়িনের সাথে কিছুতেই স্বাভাবিক হতে পারছে না। জায়িনের জায়গায় এখন জোহান থাকলে কী ভালোই না হতো!
মিতুল এমনিতেই অস্বস্তিতে ভুগছিল। এর মধ্যে আবার জায়িন একটা আজব প্রশ্ন করে বসলো।
“আচ্ছা মিতুল, তোমার কি বয়ফ্রেন্ড আছে?”
পৃথিবীতে এত প্রশ্ন থাকতে জায়িন এটা ছাড়া আর কিছু পেল না জিজ্ঞেস করার জন্য? হঠাৎ করে এই প্রশ্ন উঠলো কোত্থেকে? মিতুল খুব কষ্টে মুখের বিরিয়ানির অংশটুকু গিললো। ওর মনে বার বার জোহানের নামটা উদয় হচ্ছে। জায়িন নিশ্চয়ই এই একটা প্রশ্ন করে থামবে না। ও যদি বলে, হ্যাঁ আছে। জায়িন পরে নিশ্চয়ই আবার জিজ্ঞেস করবে,
‘কে সে?’
‘কোথায় থাকে?’
‘কী করে?’
জায়িনের সামনে জোহানের কথা কী করে বলবে ও? বানিয়ে অন্য কারো নাম বলতে গেলেও বিরাট ঝামেলা। ধ্যাত!
জোহানের কথা তো আর ঘুণাক্ষরেও জায়িনের সামনে বলবে না। জায়িনকে বললে এটা রেশমী আন্টির কানেও পৌঁছে যাবে। এরপর রেশমী আন্টির কান থেকে মায়ের কান। মা যদি জানে ও কানাডা এসে প্রেম করে বেড়াচ্ছে, তাহলে বাংলাদেশ ফিরে যে ওর জায়গা আর ঘরে হবে না সেটা নিশ্চিত।
মিতুল এর থেকে সহজভাবে বলে দিলো,
“আমার কোনো বয়ফ্রেন্ড নেই।”
জায়িন একটু বাঁকা চোখে তাকিয়ে বললো,
“তাই?”
“হ্যাঁ।”
জায়িন একটু হেসে বললো,
“দ্যাট’স গুড! আমিও মোটেই এসব প্রেম-ভালোবাসা পছন্দ করি না। এগুলো ফালতু বিষয় ছাড়া আর কিছুই না। অযথাই সময় নষ্ট।”
জায়িনের কথা শুনে মিতুল অবাক। প্রেম-ভালোবাসা পছন্দ করে না জায়িন? কিন্তু ও তো জোহানের কাছ থেকে শুনেছে জায়িনের না কি দুই দুইটা রিলেশন ছিল। মিতুল নিজের কৌতূহল আর চেপে রাখতে পারলো না। বললো,
“শুনলাম তোমার না কি দুই দুইটা গার্লফ্রেন্ড ছিল?”
মিতুলের কথা কানে আসতেই জায়িনের মুখে গাম্ভীর্য ছেয়ে গেল। একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো ও। মুহূর্তেই আবার সেটা কাটিয়ে উঠে কাঠ গলায় বললো,
“আমার দুই দুইটা গার্লফ্রেন্ড ছিল এ কথা কে বলেছে তোমায়?”
মিতুলের হকচকিয়ে যেতে হলো। ইশ, কথাটা বলেও ঝামেলায় পড়ে গেল। এখন কী বলবে? কার কথা বলবে? মিতুল ভুলেও জোহানের নাম মুখে আনলো না। বললো,
“ফে-ফ্রেডি…ফ্রেডি বলেছে।”
জায়িনের ভ্রু কুঁচকে গেল।
“ফ্রেডি?”
মিতুল দ্রুত মাথা নেড়ে সায় দিলো। কিন্তু ওর মনে সংশয় হচ্ছে। এভাবে মিথ্যা বলা কি ঠিক হলো? জায়িন যদি এ ব্যাপারে ফ্রেডির কাছে কিছু জানতে চায়?
জায়িন খানিক গম্ভীর ভাবে কী যেন ভাবলো। তারপর বললো,
“হ্যাঁ, ছিল দুটো রিলেশন। তা অনেক আগের। আর খুবই অল্প সময়ের জন্য। যখন বুঝতে পেরেছিলাম এসব রিলেশন, গার্লফ্রেন্ড সময় নষ্টের একটা মাধ্যম ছাড়া আর কিছুই নয়, তখন ব্রেকআপ করেছিলাম।”
“ও তাই? তুমি ব্রেকআপ করেছিলে?”
মিতুলের কথায় জায়িন থমকে গেল। ফ্রেডি কি দুটো গার্লফ্রেন্ড ছিল এর পাশাপাশি ওর গার্লফ্রেন্ডরা নিজ থেকে ব্রেকআপ করে চলে গিয়েছিল, সেটাও বলে দিয়েছে? জায়িন আমতা আমতা করে বললো,
“না মানে…একটা ব্রেকআপ আমি করেছিলাম। আরেকটা আমার ফার্স্ট গার্লফ্রেন্ড।”
“ও…”
মিতুল এটুকু বলেই থেমে গেল। জায়িনের সাথে এ নিয়ে আর কথা বাড়াতে ইচ্ছা করছে না।
মিতুলরা ডিনার শেষে এখন রেস্টুরেন্ট থেকে বের হওয়ার পথে। মিতুল দুঃস্বপ্নেও ভাবেনি যে রেস্টুরেন্ট থেকে বের হওয়ার পথে ওর কার্লের সাথে দেখা হয়ে যাবে। কার্লের সামনা সামনি পড়তেই মিতুল থমকে দাঁড়ালো। কার্লের সাথে চোখাচোখি হতেই ভিতরটা অজানা কারণেই দুলে উঠলো। মিতুল কার্লের পাশে নজর দিলো। অলিভার দাঁড়িয়ে কার্লের সাথে। অলিভারের দিকে তাকাতেই অলিভার হাসি মুখে বললো,
“হাই রাবা!”
মিতুলের মনে হলো ‘রাবা’ ডাকটির মতো তিক্ত আর কিছু নেই এই পৃথিবীতে।
(চলবে)
#চেরি_ব্লসমের_সাথে_এক_সন্ধ্যা
#লেখা: ইফরাত মিলি
#পর্ব: ৪৬
____________
মিতুলের সাথে অপরিচিত জায়িনকে দেখে কার্ল জিজ্ঞেস করলো,
“হু ইজ হি?”
মিতুল যতটা সম্ভব নিজেকে স্বাভাবিক করে নিয়েছে। বললো,
“হি ইজ জায়িন আহমেদ।”
কার্ল একটু মনে করার চেষ্টা করে বললো,
“ওহ, জাইন? জোহ্যানের বিগ ব্রো?”
বিস্ময়ে জায়িনের ভ্রু জোড়া একেবারে কুঁচকে আছে। কারা এরা? জায়িন মিতুলকে প্রশ্ন করলো,
“এরা কারা? কীভাবে চেনো তুমি এদের?”
মিতুল পরিচয় করিয়ে দিলো,
“ও হলো কার্ল। আমার ফ্রেন্ড। আর এ হলো ওর ওয়াইফ অলিভার।”
জায়িনের যদিও ভালো লাগেনি কার্ল এবং অলিভারকে, তবুও হাসার চেষ্টা করে ‘হাই’ জানালো।
মিতুল বললো,
“একটা রেস্টুরেন্টে কার্লের সাথে আমার দেখা হয়েছিল। ও সেখানকার স্টাফ। তো সেই দেখা থেকেই পরিচয়, বন্ধুত্ব।”
মিতুল চাইছিল সংক্ষেপে কথাবার্তা শেষ করে দ্রুত কেটে পড়বে কার্লের সামনে থেকে। কিন্তু কার্ল যেতে দিলো না। জোরাজুরি করে ওদের একটা টেবিলে এনে বসালো।
জায়িনের মোটেই ভালো লাগছে না এরকম অপরিচিত মানুষ জনের সাথে একসাথে বসতে। তবুও ধৈর্য ধরে বসলো।
কার্ল মিতুলকে ডেকে নিয়ে গেল ওপাশে আলাদা ভাবে কথা বলার জন্য।
মিতুলের মোটেই এরকম করে কথা বলতে ইচ্ছা করছিল না কার্লের সাথে। কিন্তু না এসে কোনো উপায় ছিল না। কার্ল প্রথমেই বললো,
“এটা কিন্তু আমি আগেই ধারণা করেছিলাম।”
মিতুল অবাক হয়ে বললো,
“কী?”
“এই যে তুমি এবং জোহ্যান খুব শীঘ্রই রিলেশনে জড়িয়ে যাবে সেটা।”
মিতুল বিস্ময়ের চূড়ায় পৌঁছে গেল। কার্ল কীভাবে জানলো ও এবং জোহান রিলেশনশিপে আছে? ও প্রশ্নটা করেই ফেললো,
“তুমি কীভাবে জানলে আমি আর জোহান রিলেশনে আছি?”
“জোহ্যান গত পরশু আমার সাথে দেখা করে বলেছে এটা। কেন তুমি জানতে না ও আমার সাথে দেখা করেছে?”
মিতুল জানতো কী, ও তো জানার ধারে কাছেও ছিল না। জোহান ওকে না জানিয়ে কীভাবে কার্লকে বলে দিলো এটা? এটা কেন বেছে বেছে কার্লকেই বলতে হবে? শত হলেও কার্ল তো ওর প্রথম ভালো লাগা ছিল। জোহানের প্রতি একটু রাগ হলো মিতুলের।
কার্ল বললো,
“কংগ্রাচুলেশন! আমি খুব খুশি হয়েছি। তোমাদের বিয়ে দেখার অপেক্ষায় থাকবো আমি।”
মিতুলের অস্বস্তি হচ্ছে। কার্লের সামনে ঠিক স্বাভাবিক থাকতে পারছে না। মিতুল একটু হাসার চেষ্টা করে ধন্যবাদ জানালো। আর মনে মনে শুকরিয়া আদায় করলো। ভাগ্যিস কার্ল আলাদা করে ডেকে এনে এসব কথা বললো। জায়িনের সামনে যদি এসব কথা বলতো তাহলে…
না, আর ভাবতেই পারছে না ও।
কার্ল এবং অলিভারের সাথে কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলে বাড়ি ফিরলো জায়িন, মিতুল।
রুমে ঢুকে শাড়ি পাল্টে, মুখের মেকআপ তুলে ফ্রেশ হলো মিতুল। তারপর একটু নিচে যাবে বলে বের হলো রুম থেকে। জায়িনের রুমের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় থেমে গেল ও। ভিতর থেকে একটু রাগি গলার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। মিতুলের ভিতরটা অজানা ভয়ের আশঙ্কায় কেঁপে উঠলো। ও কান পাতলো দরজায়। জায়িনের কথা শুনে মনে হলো ফ্রেডির সাথে কথা বলছে। মিতুল কথা বলার বিষয়টাও ধরতে পারলো। ডিনারের সময় ও যে ফ্রেডির নামে মিথ্যা বলেছিল, সেটা নিয়েই কথা বলছে জায়িন। মিতুল ভয়ে ভয়ে ঢোক গিললো।
জায়িনের সব কথা শুনে ফ্রেডি ফোনের ও প্রান্ত থেকে বললো,
“আরে আমি তো তোর দুটো রিলেশন ছিল সে ব্যাপারেই কাউকে বলিনি, তাহলে তোর গার্লফ্রেন্ডসরা নিজেরা ব্রেকআপ করে চলে গেছে, সেটা কীভাবে কাউকে বলতে পারি? আর মিতুলের কথা বলছিস? ওর সাথে তো আমার সেদিনের পর থেকে আর দেখাই হয়নি। জোহান ওকে সেদিন আমার সামনে থেকে টেনে নিয়ে যাওয়ার পর এক সেকেন্ডের জন্যও দেখা হয়নি ওর সাথে আমার। তাহলে আমি ওকে এ ব্যাপারে বললাম কখন?”
জায়িন ফ্রেডির কথা মোটেই বিশ্বাস করলো না। আত্মবিশ্বাসের সাথে বললো,
“তুই-ই বলেছিস ওকে। আমি নিশ্চিত তুই ছিলি এটা। ফার্স্ট মিটেই হয়তো এই কথাটা বলেছিস ওকে।”
“ফার্স্ট মিট…ফার্স্ট মিটেও তো আমি ওর সাথে তেমন কথা বলতে পারিনি। সে বারও জোহান এসে ঢুকে পড়লো কথা বলার মাঝে। আর ফার্স্ট মিটে কি কেউ এসব ব্যাপার নিয়ে কথা বলে?”
“বলে। আর কেউ না বললেও তুই বলিস। শোন, তোর সাথে এখন কথা বলতে চাই না আমি। তোর উপর এখন রাগ আমার। নেক্সট তিন দিন তুই আমার সাথে কোনো কথা বলতে আসিস না!”
“ওহ জায়িন, এটা অতিরিক্ত! আমি কাউকে কিছু বলিনি তোর ব্যাপারে।”
জায়িন এবং ফ্রেডির মাঝে আরও কিছুক্ষণ বাকবিতন্ডা চললো। মিতুল কান সরালো না দরজা থেকে। মনোযোগ সহকারে শুনতে লাগলো ভিতরে জায়িনের কথা। ওর মনে ধরা পড়ে যাওয়ার তীব্র আশঙ্কা!
জোহান সিঁড়ি বেয়ে দ্বিতীয় তলায় উঠতেই ব্রাদারের রুমের দরজায় মিতুলকে একেবারে কান মিশিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলো। জোহান বিস্মিত কণ্ঠে বললো,
“কী করছো তুমি?”
হঠাৎ করে জোহানের গলা মিতুলের হাত পা ভয়ে নাড়িয়ে দিলো। জোহানকে দেখতে পেয়েই মিতুল জায়িনের দরজার কাছ থেকে সরে দৌঁড়ে জোহানের কাছে এলো। কোনো কথা না বলে জোহানকে হাত ধরে টেনে নিয়ে এলো বারান্দায়।
“এসব কী করছো তুমি? এরকম আজব আচরণ করছো কেন?” নিজের হাত ছাড়িয়ে নিতে নিতে বললো জোহান।
“আমি বোধহয় ধরা পড়ে যাব জোহান!”
“…’ধরা’ মানে?”
মিতুল জোহানকে সব খুলে বললো।
“এখন আমি কী করবো? তোমার ব্রাদার যদি জানে আমি যা বলেছি তা মিথ্যা, আসলে ফ্রেডি নয়, তুমি আমাকে বলেছিলে তার রিলেশন সম্পর্কে, তখন?”
“সে আমি কী জানি? আমি কি তোমাকে আমার বদলে ফ্রেডির নাম বলতে বলেছিলাম?”
“তোমার ভালোর জন্যই তো বলিনি।”
“এখানে আমার ভালো হলো কোত্থেকে? কী ভালো করেছো তুমি আমার?”
“কোনো ভালো করিনি?”
“আমি তো দেখতে পাচ্ছি না। আর যদি ভালো করেও থাকো, তবে এখন আমার কিছু করার নেই। নিজের ঝামেলা নিজে সামলাও।”
মিতুলের মাথায় এবার রাগ চড়ে গেল।
“ও, তোমার ভালো করতে গিয়ে এখন আমার নিজের ঝামেলা নিজের সামলাতে হবে? ঠিক আছে, নিজের ঝামেলা নিজেই বুঝে নেবো আমি। একবার বাংলাদেশে যাই, আর জীবনে আসবো না এই কানাডা। কানাডার কোনো প্রান্তে তুমি আমার ছায়া দেখতে পাবে না আর কোনোদিন। এই আমি বলে দিলাম।”
“হেই তুলতুল, এত রুড সাজছো কেন তুমি? আমাকে ছেড়ে বাংলাদেশে তুমি একা একা থাকতে পারবে? কষ্ট হবে না তোমার?”
“তোমাকে ছাড়া থাকতে পারব না কেন? কে তুমি আমার? অবশ্যই পারব আমি। বিন্দু মাত্র কষ্ট হবে না আমার। বিপদে যাকে পাশে পাইনি তার জন্য আবার কী কষ্ট হবে?”
“কিন্তু আমার যে খুব কষ্ট হবে। কষ্টটা আমার অসুখ হয়ে দাঁড়াবে। মরণব্যাধি অসুখ। তোমাকে ছাড়া থাকতে পারবো না আমি। তুমি কানাডা এসে আমার পাল্টে যাওয়া জীবনে আরও পরিবর্তন এনে দিয়েছো। আমার জীবন আরও বেশি চঞ্চল করে তুলেছো তুমি। আমার ভিতরের চাপা কষ্টটাও প্রায় মুছে গেছে তোমার কারণে। তুমি আমার ঝাপসা অন্ধকার জীবনে এক চিলতে আলো।”
মিতুলের ভিতরটা আবেগী হয়ে উঠছে। ও বুঝতে পারছে জোহান ওকে ইমোশনালি ব্ল্যাকমেইল করছে। ও যথাসাধ্য কঠিন থাকার চেষ্টা করে বললো,
“যত যাই বলো না কেন লাভ হবে না। একবার চলে গেলে আর আসবো না কানাডা।”
বলে মিতুল দ্রুত পায়ে বারান্দা ত্যাগ করলো।
পিছন থেকে ডেকেও আর লাভ হলো না। মিতুল রুমে এসে দরজা বন্ধ করলেই জোহানের ম্যাসেজ এলো।
‘তোমার আসতে হবে না কানাডা। আমি গিয়ে নিয়ে আসবো। স্বেচ্ছায় না এলে জোর করে নিয়ে আসবো। তারপর ছোট্ট টাইম হাউজে থেকে আমরা আমাদের সংসার কাহিনী লিখবো। কী বলো, শ্রেষ্ঠ একটা কাহিনী হবে না এটা? জো এবং তুলতুলের সংসার কাহিনী!’
ম্যাসেজটা দেখে মিতুলের চোখ কপালে উঠলো। হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরলো ও। কী লিখলো জোহান এটা? জো, তুলতুলের সংসার কাহিনী? সংসার পর্যন্ত চলে গেছে জোহান? জোহানের লজ্জা কি আরও কমে যাচ্ছে?
____________
অনেকগুলো দিন কেটে গেল। জোহান এবং মিতুলের প্রেম সকলের অগোচরে ভালোই এগিয়েছে। গাঢ় হয়েছে ওদের প্রেম। তবে মাঝে মধ্যেই তুমুল ঝগড়া বেঁধে যায় ওর এবং জোহানের মাঝে। আর মিতুল তখনই জোহানকে বাংলাদেশ চলে গেলে আর কানাডা আসবে না বলে হুমকি দেয়।
এত কদিনে মিতুল আবার বেশ কেয়ারিংও হয়ে গেছে জোহানের প্রতি। এই তো এখন। এখনই জোহানের জন্য যত্ন করে কফি তৈরি করছে ও। কফি বানাচ্ছে মেশিনে। জোহানই তো ওকে মেশিনে কফি বানাতে শিখিয়েছিল। কফি বানানো হলে ক্যামিলার বানিয়ে দেওয়া ব্রেকফাস্ট নিয়ে জোহানের টাইম হাউজে যাবে। জোহানের সাথে কাল রাত থেকে দেখা হয়নি ওর। সন্ধ্যা বেলায় জোহান বন্ধুদের সাথে মিট করার জন্য বেরিয়ে গিয়েছিল। এসেছিল অনেক দেরিতে। ততক্ষণে ও ঘুমিয়ে গিয়েছিল। সকালে উঠে ক্যামিলার কাছ থেকে শুনলো জোহান টাইম হাউজে। তাই এখন টাইম হাউজে ব্রেকফাস্ট নিয়ে যাবে জোহানের জন্য। কফি বানানো হয়ে গেছে। ক্যামিলা জোহানের ব্রেকফাস্ট ট্রেতে করে সাজিয়ে দিলে, মিতুল কিচেন থেকে বের হলো ট্রে নিয়ে। এখান থেকেই হলরুমে চোখ পড়লো। জায়িন বসে আছে। ল্যাপটপ নিয়ে ব্যস্ত সে। জায়িনের অহংকারী ভাবটা অনেকটাই কমে গেছে বলে মিতুলের ধারণা। জায়িন এখন নিজে এসেই মাঝে মধ্যে কথা বলে ওর সাথে। যখন ও লন, হলরুম কিংবা বারান্দায় একাকী বসে থাকে। এর মধ্যে দুই, তিন বার জায়িন ওকে বাইরেও ঘুরতে নিয়ে গিয়েছিল। তবে মিতুলের জায়িনের সাথে ঘুরতে যেতে ভালো লাগে না। জোহানের সাথে ঘুরে বেড়াতে ইচ্ছা করে ওর। সকলের চোখ ফাঁকি দিয়ে মনের তৃপ্তি নিয়ে ঘোরেও জোহানের সাথে।
জোহান একদিন ক্যালগারিতে একটা ফাংশনে গিয়েছিল। দুই দিন ছিল সেখানে। মিতুলের তখন কিছুই ভালো লাগতো না। মোবাইল নিয়ে বসে থাকতো সবসময়। কখন জোহান কল দেবে সেই আশায়। ওর মস্তিষ্ক, হৃদয় সকল স্থান জুড়েই কেবল জোহানের বসবাস এখন। মিতুল কিচেনের সামনে দাঁড়িয়েই এসব ভাবলো। তারপর চুপিচুপি ধীর পা ফেলে বেরিয়ে এলো ব্যাক ডোর দিয়ে।
মিতুল টাইম হাউজে এসে দরজা খুলে ভিতরে প্রবেশ করলো। দরজা লক করা ছিল না। জোহানকে দেখতে পেল কাউচের উপর শোয়া। ঘুমিয়ে আছে বোধহয়। দরজা খোলা রেখে এভাবে ঘুমিয়ে ছিল? মিতুলের খানিক বিরক্ত লাগলো। ও জোহানের কাছে এসে দাঁড়াতে ওর চোখ চলে গেল জোহানের গালে। গালের উপরিভাগের অংশটা কিছুটা লাল। মিতুলের মন আপনা থেকেই জানান দিলো ওই রাবিশগুলো আবারও মেরেছে জোহানকে। নিশ্চয়ই ঘুষি মেরে জোহানের গাল লাল বানিয়ে ফেলেছে! রাবিশগুলোর প্রতি ভীষণ রাগ এবং জোহানের জন্য ভীষণ মায়া অনুভব হলো ওর।
ও জোহানকে ঘুম থেকে জাগানোর জন্য ডাকলো,
“জোহান!”
একটা ডাকেই জোহান জাগলো। মিতুলকে দেখে ঘুম ঘুম চোখে উঠে বসলো। মুখটা ফোলা ফোলা দেখাচ্ছে জোহানের। বাচ্চা বাচ্চা ছাপটা আরও ভালো ভাবে ফুঁটে উঠেছে তাই। কালো চুলগুলো উস্কোখুস্কো। কালো চুল! হ্যাঁ, কালো। জোহান নিজের হেয়ার কালার চেঞ্জ করেছে। বাদামি চুলগুলো কালো করে ফেলেছে। মিতুল তাতে মোটেই খুশি হয়নি। জোহানের বাদামি চুলই ওর প্রিয় ছিল। মিতুল জোহানকে হুকুম দিয়েছে খুব শীঘ্রই চুলগুলো আবার বাদামি করে ফেলার জন্য। বাদামি চুলে জোহানকে বিদেশি বিদেশি লাগতো। এখনও একটু একটু বিদেশি বিদেশিই লাগছে। তবে অতটা না। কিন্তু বাদামি চুলে লাগতো। কানাডা আসার প্রথম দিনেই তো জোহানকে বিদেশি ছেলে ভেবে ভুল করেছিল ও। ভুল করার মেইন কারণটা ছিল জোহানের বাদামি চুল এবং চোখ। মিতুলের মাঝে মধ্যে মনে হতো জোহান ফেস সার্জারি করেছে। এ নিয়ে একদিন জোহানকে প্রশ্নও করেছিল। মিতুলের প্রশ্ন শুনে জোহান হাসতে হাসতেই কাহিল। জোহান বলেছিল,
“এরকম একটা কথা তোমার মনে আসলো কী করে তুলতুল? ফেস সার্জারি…”
পুরো কথা শেষ না করেই জোহান আবার উচ্চৈঃশব্দে হেসে ওঠে। হাসি থেমেছিল খুব সময় নিয়ে। বলেছিল,
“সার্জারি করিনি আমি। এমনকি চোখে লেন্সও লাগাইনি। এমন চোখ তো অনেক বাংলাদেশিদেরই হয়ে থাকে। আমার দুই দুইটা কাজিনের চোখও এমন। আর হ্যাঁ, আমার লাভলি গ্রান্ডমাদারের চোখও আমার মতো। তবে আমি চুলে কালার করেছি সেটা ঠিক। আর তুমি যে বললে আমাকে কানাডিয়ানদের মতো লাগে, কোথায় লাগে? আমি তো দেখিনি কোনোদিন। আমার মম, ড্যাড দুজনই তো বাংলাদেশি। আমি কী করে কানাডিয়ানদের মতো হবো?”
“আমি জানি তোমার মম, ড্যাড দুজনই বাংলাদেশি। আর তোমার চেহারায় যে রেশমী আন্টির সদৃশভাব আছে, সেটাও জানি আমি। তবে তোমাকে দেখতে কিন্তু বিদেশি বিদেশিই লাগে।”
জোহান আবারও হেসে ফেলে।
“ওহ মিতুল, চুপ করো। তুমি এভাবে কথা বলতে থাকলে আমি কিন্তু হাসতে হাসতে মরে যাব।”
“তুমি আমার কথাকে ইয়ার্কি ভাবছো? তুমি জানো, আমি তোমাকে প্রথম যেদিন দেখেছিলাম, সেদিন বিদেশি ভেবে ভুল করেছিলাম?”
“ও তোমার চোখের ভুল। আমি দেখতে অত্যাধিক মাত্রার সুন্দর তো, সেজন্য তোমার অমন মনে হয়। এখানকার ছেলেরা তো ফর্সা হ্যান্ডসাম টাইপের হয় বেশির ভাগ। সেজন্য আমাকেও ওদের সাথে গুলিয়ে ফেলেছো।”
মিতুল গভীর ভাবে ভেবে দেখেছে জোহানের কথাটা। এটা কি ওর চোখের ভুল? না, এটা ওর চোখের ভুল নয়। চোখের ভুল হলে তো জায়িনকেও গুলিয়ে ফেলতো বিদেশি ভেবে। জায়িনও তো সুন্দর, ফর্সা, হ্যান্ডসাম একটি ছেলে। আসলে জোহানকে বিদেশি বিদেশিই লাগে। হোক সার্জারি করেনি জোহান। কিন্তু ফর্সা, হ্যান্ডসাম, বাদামি চুল-চোখে ওকে বিদেশি ছেলেই লাগে। জোহান সেটা খেয়াল করেনি হয়তো।
মিতুল পুরোনো স্মৃতিতে ডুবে গিয়েছিল। জোহানের কণ্ঠ ধ্বনিতে বর্তমানে ফিরে আসতে হলো আবার।
জোহান ঘুম ঘুম দৃষ্টি জোড়া ওর উপর ফেলে বললো,
“এত সকালে তুমি এখানে কেন?”
মিতুল জোহানের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে নিজেই পাল্টা প্রশ্ন করলো,
“তুমি নিজের চুলগুলো কবে বাদামি করবে আবার?”
“নেক্সট মানডে’তে।”
“মানডে’তে কেন? সানডে’র কী হলো?”
“তোমাকে না বললাম উইকেন্ডে আমরা কিছু বন্ধুরা মিলে বেড়াতে যাচ্ছি।”
মিতুল আর এ বিষয়ে কথা বাড়ালো না। অন্য প্রসঙ্গে এলো,
“তোমার গাল লাল কেন? ওই রাবিশগুলো আবার মেরেছে তোমায়?”
জোহান গালের লাল স্থানটায় হাত দিয়ে বললো,
“এটা তেমন কিছু না।”
“তেমন কিছু না বললেই হলো? ওই গবেটদের আমি পুলিশে দেবো।”
“তাহলে আমার নামটাও বলে দিয়ো পুলিশদের কাছে। ঝামেলা তো শুধু ওরা একা’রা করে না এখন। আমরাও করি।”
“হ্যাঁ, তোমার নামটাও পুলিশের কাছে বলা উচিত। আচ্ছা এই মারামারির সমাপ্তি ঘটাতে পারো না তোমরা? একটু সমঝোতা করতে পারো না? যদি এমন মারামারি করতে থাকো, তাহলে তো তোমার ট্রিটমেন্ট করতে করতেই আমার জীবন কেটে যাবে।”
“আমি তো সেটাই চাই। তুমি আমার একান্ত ডক্টর হয়ে থাকো সারাজীবন।”
জোহান একটু থেমে আবার বললো,
“আসলে কী জানো, আমি চাই না যে ওদের সাথে আমার মারামারির কোনো সমাপ্তি হোক। সত্যি কথা বলতে ওদের সাথে মারামারি করতে করতে ওদের বড্ড ভালোবেসে ফেলেছি আমি। এখন ওদের সাথে মারামারি না হলে অসুস্থ হয়ে যাব আমি।”
মিতুলের মুখ হা হয়ে গেছে জোহানের কথা শুনে।
“ওদের ভালোবেসে ফেলেছো মানে? ওদের কীভাবে ভালোবাসতে পারো? এমন শত্রুদেরও কেউ ভালোবাসে?”
“অনেকেই হয়তো বাসে। আবার নাও বাসতে পারে। এতগুলো বছর ধরে মারামারি করতে করতে আলাদা একটা মায়ার জন্ম হয়েছে ওদের প্রতি। ভালোবেসে ফেলেছি ওদের।”
“ওদের ভালোবাসলে তাহলে আমি কী? আমাকে ভালোবাসো না তুমি?”
“আরে ওদের ভালোবাসা আর তোমার ভালোবাসা কি এক হলো? তুমি তো আমার পুরো হৃদয় দখল করে আছো। আর ওরা হৃদয়ের আনাচে কানাচে একটুখানি জায়গায় ছিটকে পড়ে আছে।”
মিতুল লজ্জায় মাথা নুইয়ে ফেললো। মিতুল একটা জিনিস লক্ষ করছে। জোহানের যেমন দিনদিন লজ্জা কমে যাচ্ছে, ওর তেমনি লজ্জা দিনদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। মিতুল মাথা নুইয়ে রেখেই বললো,
“ফ্রেশ হয়ে এসো।”
জোহান কোনো কথা না বলে বেডরুমে চলে গেল।
মিতুল ভাবছে অন্যকথা। ওই রাবিশগুলোর সাথে ভালোবাসা-বাসি করতে করতে যদি জোহান এই জীবনে মারামারি না থামায়, তাহলে কেমন হবে? এই মারামারির সমাপ্তি যদি না ঘটায়, তাহলে তো সত্যি সত্যিই ওর জীবনটা জোহানের ট্রিটমেন্ট করতে করতেই কেটে যাবে। অসম্ভব! এই ভালোবাসা-বাসি ও সহ্য করবে না।
মিতুল টাইম হাউজের ছোট্ট কিচেনে এসে টেবিলের উপর ট্রে রাখলো। কফি একেবারে ঠান্ডা হয়ে গেছে। হলে হোক।
জোহান এসে গেল। চেয়ার টেনে বসতে বসতে বললো,
“কী কী এনেছো?”
মিতুল জোহানের সামনের চেয়ারটায় বসে ঢাকনা সরালো খাবারের উপর থেকে। ফ্রিটারস, ব্রেড, জেলি, ফ্রেশ স্যালাড এবং সাথে এক কাপ কফি।
“এই সামান্য ব্রেকফাস্ট এনেছো? আর কিছু ছিল না?”
মিতুল বিরক্ত কণ্ঠে বললো,
“ভাত ছিল। রেশমী আন্টি সকাল বেলা ভাত রান্না করতে বলেছিলেন খাবে বলে। তোমার জন্য ভাত নিয়ে আসলে তুমি খেতে?”
জোহান কিছু না বলে কফিতে চুমুক দিলো। মুখ বিকৃত করে বললো,
“এটা তো একেবারে ঠান্ডা।”
“ঠান্ডা থাকবে সেটাই তো স্বাভাবিক। তোমার জন্য তো আর কফি ঘণ্টার পর ঘণ্টা গরম থাকবে না। ঠান্ডা কফিই খাও।”
“আমি ঠান্ডা কফি খাই না। শুধু তোমাকে খুশি করার জন্য আর এক চুমুক খাবো আমি।”
জোহান কাপে চুমুক দেওয়ার জন্য কাপটা মুখের কাছে আনলো।
মিতুল আনমনে তাকিয়ে রইল জোহানের দিকে। মনটা বেশ খারাপ হয়ে পড়লো ওর। বাংলাদেশে ফেরার সময় প্রায় ঘনিয়ে এসেছে। আর অল্প কিছুদিন আছে এখানে। জোহানকে ছেড়ে দেশে গিয়ে কীভাবে থাকবে সেটা ভেবেই বার বার চিন্তায় পড়ে যায় ও। হৃদয়ে ব্যথা হয়। জোহানের হয়তো খেয়ালই নেই যে ওর কানাডা থেকে চলে যাওয়ার সময় খুব সন্নিকটে। মিতুলও জোহানকে বলেনি। আজকে বলবে ঠিক করেছে।
জোহান ব্রেডের গায়ে কামড় বসাতে যাবে এমন সময় মিতুল বললো,
“কানাডা থাকার সময় প্রায় ফুরিয়ে এসেছে। খুব শীঘ্রই বাংলাদেশে ফিরতে হবে আমার।”
জোহানের আর ব্রেডের গায়ে কামড় বসানো হলো না। মিতুলের দিকে তাকালো। মিতুলের মুখটা কালো হয়ে আছে। জোহান বললো,
“আর কতদিন বাকি আছে?”
মিতুল শুকনো মুখে বললো,
“এইতো অল্প কিছুদিন!”
জোহানের মুখ গম্ভীরপূর্ণ হলো কিছু সময়ের জন্য। হঠাৎই আবার সেই গম্ভীর মুখে হাসি ফুঁটিয়ে বললো,
“যাও বাংলাদেশ, সমস্যা নেই। পরে তো আবার তোমাকে কানাডা নিয়েই আসবো আমি। কোনো ট্যুরিস্ট হিসেবে নয়। বিয়ে করে একেবারে বউ বানিয়ে নিয়ে আসবো তোমায়।”
জোহানের কথায় মিতুলের মন খারাপিটা কোথায় যেন ছুটে পালালো। ও একটু হাসলো। লজ্জা লজ্জা একটা ভাবও দেখা দিলো ওর মাঝে।
জোহান খাচ্ছে নিশ্চিন্ত মনে।
মিতুল হঠাৎ বললো,
“একা একাই তো সেই থেকে খেয়ে যাচ্ছ। আমি যে সামনে আছি সেটা কি ভুলে গেছো?”
“তুমিও খাবে?”
মিতুল টেবিলের অপর প্রান্ত থেকে উঠে জোহানের পাশে গিয়ে বসলো চেয়ার নিয়ে। জোহান অবাক হচ্ছে।
মিতুল বললো,
“হুম খাবো আমি। তুমি খাইয়ে দেবে আমায়।”
জোহানের মুখে চমকিত ভাব ফুঁটে উঠলো।
মিতুল মুচকি হাসছে।
জোহানও নিজের চমকপ্রদ মুখে এক চিলতে হাসি ফোঁটালো। তারপর ফ্রিটারসের এক টুকরো চামচে গেঁথে মিতুলের মুখের দিকে নিয়ে আসলেই মিতুল বললো,
“উঁহু, চামচ দিয়ে খাবো না আমি। হাত। হাতে খাবো। হাত দিয়ে খাইয়ে দাও।”
জোহান আরও বেশি চমকে উঠলো। মিতুলের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বললো,
“এটা কি সত্যিই আমার তুলতুল?”
মিতুল শান্ত কণ্ঠে বললো,
“হুম, এটা আমি। তোমার তুলতুল। শত সহস্র ফুল প্রাপ্তিদার প্রিয়তমা তোমার। যে খুব সংগোপনে এসে কড়া নেড়েছিল তোমার হৃদয়ের…”
মিতুল হঠাৎ জোহানের কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বললো,
“এটা আমি, কেবল তোমারই লিটল এঞ্জেল।”
(চলবে)