#চেরি_ব্লসমের_সাথে_এক_সন্ধ্যা,পর্ব: ৪৭
#লেখা: ইফরাত মিলি
____________
হলুদ রঙা আলসে, নিঝুম একটা বিকেল। ঝিরিঝিরি বাতাস ক্ষণে ক্ষণে এসে ছুঁয়ে দিয়ে যাচ্ছে আপন মনে। মিতুলের উদাসী ক্লান্ত চোখ দুটো বারান্দা থেকে চেরি ব্লসম ট্রির উপর দৃষ্টি রেখেছে। চেরি গাছগুলো ফাঁকা। ফুল নেই। ফুলহীন ডালগুলো ঝিমিয়ে পড়েছে। তারাও যেন বড্ড ক্লান্ত ফুল বিহীন।
মিতুলের বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসার জন্য হাঁসফাঁস করছে। মিতুল নিজের দীর্ঘশ্বাসটা নিজ বুকেতেই আটকে রাখলো। চেরি গাছের উপর থেকে চোখ এনে আকাশের দিকে স্থাপিত করলো। নীল-সাদায় সজ্জিত আকাশ। ফকফকা রোদ ছড়িয়ে আছে মেঘের কোল ডিঙিয়ে।
কারো হেঁটে আসার চাপা শব্দ হলো ফ্লোরে।
ওর দিকে কেউ এগিয়ে আসছে। উপলব্ধি করতে পেরে মিতুল তাকালো দেখার জন্য।
সুন্দরী একটা মেয়ে মুখ ধরা দিলো চোখে।
মিতুল শুকনো মুখে একটু হাসি ফোঁটানোর চেষ্টা করলো। কানাডা থেকে চলে যাওয়ার পর ক্যামিলাকেও খুব মিস করবে। কানাডার ভিতরে ওর অন্যতম প্রিয় মানুষ হলো এই ক্যামিলা।
ক্যামিলা কাছে এসে বললো,
“ম্যাম তোমায় ডাকছে মিতুল।”
মিতুলের ঠোঁট থেকে হাসির রেখাটুকু মুছে গেল।
“কেন ডাকছে?”
“এসেই দেখো একবার।”
মিতুল ক্যামিলার সাথে নিচে এলো। হলরুমে সোফায় বসে আছেন রেশমী আন্টি। মিতুল রেশমী আন্টির থেকে কিছুটা দূরত্ব রেখে বসলো।
“কিছু বলবে আন্টি?”
বাংলাতে জিজ্ঞেস করলো মিতুল। রেশমী আন্টির সাথে ও বাংলাতেই বেশি কথা বলে।
রেশমী আন্টিও বাংলাতে বললেন,
“তোমার তো আর কানাডাতে বেশি দিন বাকি নেই। যাওয়ার আগে আরও একটা দুটো জায়গা ঘুরিয়ে দেখানো উচিত তোমায়। আমার শরীরটা তেমন ভালো নেই, জ্বর এসেছে। সেটা তো তুমি জানো। এই জ্বর নিয়ে তোমাকে এডমন্টন ছেড়ে দূরে কোথাও ঘুরতে নিয়ে যাব সেটাও সম্ভব নয় আমার পক্ষে…” রেশমী আন্টি কথার মাঝেই খুক খুক করে কেশে উঠলেন। তারপর কাশি থামলে আবার বললেন,
“জোহান আমাকে বললো ও বন্ধুদের সাথে বানফ ঘুরতে যাচ্ছে। আমি চিন্তা করছি তোমাকেও ওদের সাথে সেখানে ঘুরতে পাঠাবো।”
মিতুল ভীষণ রকম চমকে গেল। রেশমী আন্টি নিজ ইচ্ছাতে ওকে জোহানের সাথে পাঠাতে চাইছে, সেটা মানতে কষ্ট হচ্ছে ওর। জোহান ওকে আজকে লাঞ্চের সময় নিজেদের সাথে ঘুরতে যাওয়ার অফার দিয়েছিল। মিতুল তো অফারটা পেয়ে আনন্দে আটখানা। জোহানের সাথে যেতে তো ওর কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু সমস্যাটা ছিল রেশমী আন্টিকে নিয়ে। এডমন্টনের ভিতর জোহানের সাথে ঘুরে বেড়ালেও সমস্যা নেই। ঘুরে বেড়ালেও সেটা কেউ জানতে পারবে না সহজে। ঘুরে ফিরে সময় মতো বাসায় ফেরা যায়। কিন্তু এডমন্টন থেকে দূরে বানফ ন্যাশনাল পার্ক ঘুরতে গেলে তো আর কাউকে না জানিয়ে হুট করে চলে যাওয়া যাবে না। ওখানে ঘুরতে যাওয়া তো আর দুই তিন ঘণ্টার ব্যাপার না। অবশ্যই রেশমী আন্টিকে জানিয়ে যেতে হতো। আর এই জানিয়ে যাওয়াটাই ওর কাছে দুঃসাহসিক একটা কাজ। রেশমী আন্টির কাছে জোহানের কথা এমনিতে একটু বলতে গেলেও ওকে সংশয় ঘিরে ধরে। সেখানে জোহানের সাথে বানফ ঘুরতে যাওয়ার কথা তো ও জীবনেও বলতে পারতো না। কিন্তু কী আজব! ওকে কিছু বলতেই হলো না, রেশমী আন্টি নিজেই বললেন।
“আমাকে কেন ডাকা হয়েছে এখানে?” সিঁড়ির কাছ থেকে জোহানের কণ্ঠ ভেসে এলো।
মিতুলসহ রেশমী এবং ক্যামিলাও তাকালো সিঁড়ির দিকে। নিভু নিভু ঘুম চোখে সিঁড়ি পার হয়ে নামছে জোহান। কালো চুল কপাল জুড়ে ছড়িয়ে আছে।
জোহান হলরুমে পা রেখে আবারও জিজ্ঞেস করলো,
“কেন ডেকেছো আমাকে?”
ক্যামিলা মিতুলকে ডাকার আগে রেশমীর কথা মতো জোহানকেও ডেকে এসেছে। জোহান তখন তন্দ্রাচ্ছন্ন ছিল। ক্যামিলার ডাকে ঘুম ভাঙলেও, সেই ঘুমকে সামলে উঠতে ওর এত সময় লাগলো।
জোহানকে দেখে রেশমীর বিরক্ত লাগলো। বিরক্তি কণ্ঠে বললেন,
“সারাদিন শুধু পড়ে পড়ে ঘুমাও কেন? কাজে একটু হাত দিতে পারো না? কতদিন বলেছি শপটার একটু দেখাশোনা করতে। যদি শপটার দিকে একটু খেয়াল রাখতে, তাহলে আমাকে কি এত পরিশ্রম করতে হতো? কোনো কাজেরই তো নও তুমি। তোমাকে দিয়ে কী উপকার হবে? কী লাভ হলো তোমাকে পৃথিবীতে এনে?”
মিতুলের একটু খারাপ লাগলো। রেশমী আন্টি সবসময় এমন করেই কথা বলে জোহানের সাথে। মিতুলের এটা ভালো লাগে না। ও চায় রেশমী আন্টি জায়িনের মতোই ভালোবাসুক জোহানকে।
জোহান হাত দিয়ে চোখ দুটো একটু ডলে নিয়ে তাকালো মমের দিকে। আবারও একই প্রশ্ন করলো,
“আমাকে কেন ডেকেছো সেটা বলো?”
“কাল বানফ ন্যাশনাল পার্ক ঘুরতে যাচ্ছ না তোমরা?”
“হ্যাঁ।”
“তোমাদের সাথে মিতুলকেও নিয়ে যেয়ো।”
জোহানের মাঝ থেকে ঘুম ঘুম ভাবটা একেবারে উবে গেল।
“কাকে নিয়ে যাব সাথে?”
“মিতুলকে।”
জোহান মিতুলের দিকে তাকালো।
মিতুলের মুখে খুশি খুশি ছাপ পড়ে গেছে। তবে ওর খুশি খুশি ছাপটা বেশিক্ষণ থাকলো না।
জোহান মমকে বললো,
“যেখানে আমরা ফ্রেন্ডসরা ঘুরতে যাচ্ছি, সেখানে ওকে কেন নিয়ে যাব? ওকে নেবো না আমাদের সাথে।”
জোহানের কথায় মিতুলের মুখ কালো হয়ে গেল। মিতুল বিস্ময়ের অগাধ প্রান্তরে। কী বললো জোহান এটা? ওকে নিজেদের সাথে নিতে অমত জানাচ্ছে? লাঞ্চের সময় জোহান নিজে ওকে যাওয়ার অফার দিয়ে, এখন এটা কী বলছে? এমন করে ওকে না নিয়ে যাওয়ার কথাটা কী করে বলতে পারলো জোহান? মিতুলের ভিতরটা রাগ, অপমানে বিষাক্ত হয়ে উঠলো।
রেশমী কড়া গলায় বললেন,
“আমি ওকে তোমাদের সাথে নিয়ে যেতে বলেছি মানে, ওকে নিজেদের সাথে নিয়ে যাবে। বাস! এর উপর আর কোনো কথা হবে না। জায়িন যদি ফ্রি থাকতো তাহলে তোমার সাথে কখনোই ওকে পাঠাতাম না। যেহেতু জায়িন ফ্রি নেই সেহেতু তুমিই নিয়ে যাবে ওকে।”
জোহানকে নীরব দেখালো। খানিক পর বললো,
“ঠিক আছে, নিয়ে যাব।”
মিতুল বেঁকে বসলো।
“আমি যাব না। বানফ ঘুরতে যাওয়ার কোনো ইচ্ছা নেই আমার।”
মিতুল আর একটু সময়ের জন্যও বসলো না। তীব্র রাগ নিয়ে সিঁড়ির দিকে পা বাড়ালো। জোহান এত বড়ো অপমান করার পরও ও জোহানের সাথে যাবে, সেটা ভাবাও ভুল।
রেশমীও এবার খুব রেগে গেলেন ছেলের উপর।
“দেখলে তো মেয়েটা কেমন ভাবে চলে গেল? কবে তুমি নিজের কথাবার্তা ঠিক করবে? কার সামনে কীভাবে কথা বলতে হয় জানো না?”
“জানি না, আর জানতেও চাই না।”
জোহান ক্যামিলার দিকে একটু তাকিয়ে আবার মমের দিকে তাকালো। বললো,
“সিস মানিয়ে নেবে ওকে। সিস গিয়ে একটু বললেই রাজি হয়ে যাবে ও।”
রেশমী বললেন,
“তোমার উপর ভরসা করে আমি মেয়েটাকে ছাড়তে পারি না। তুমি যে পরিমাণ কেয়ারলেস। আগেই ভেবেছিলাম ক্যামিলাকেও পাঠাবো মিতুলের সাথে। তোমার এমন কথার পরে এখন ক্যামিলাকে না পাঠিয়ে আর সত্যিই উপায় নেই। মিতুল এবং ক্যামিলা, দুজনকেই নিয়ে যাবে।”
রেশমী আর বসলেন না। রুমে যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়ালেন।
রেশমী চলে গেলে ক্যামিলা বললো,
“আমি বোঝাতে যাব মিতুলকে?”
জোহান হেসে বললো,
“তোমার যাওয়ার দরকার নেই সিস। নাক ফুলো তুলতুলকে আমিই বোঝাচ্ছি।”
মিতুলকে রুমে পেল না। বারান্দায় পেল। জোহান একবার পর্যবেক্ষণ করে নিলো মিতুলকে। মিতুলের নাকটার দিকে তাকাতেই বোঝা যাচ্ছে কতটা রেগে আছে মিতুল।
জোহান মিতুলের পাশে এসে বসলো।
মিতুল অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিলো। ওর ইচ্ছা করছে এই মুহূর্তে কানাডা ছেড়ে চলে যেতে। জোহান এভাবে অপমান করতে পারলো ওকে?
জোহান মিতুলের অন্যদিকে ঘুরিয়ে রাখা মুখটা দেখার চেষ্টা করে বললো,
“হেই তুলতুল, রাগ করেছো আমার উপর?”
মিতুল মুখ খুললো না। কাঠ হয়ে বসে রইল।
“রাগ করেছো। কিন্তু বেশি করোনি বোধহয়, তাই না?”
মিতুল মুখ বন্ধ রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করলো। কিন্তু পারলো না। বলে উঠলো,
“একটা কথাও বলবে না আমার সাথে। তোমাকে খুব ভালো করে চেনা হয়ে গেছে আমার। আমাকে সঙ্গে নিয়ে যেতে তোমার খুব সমস্যা, তাই না? চলে যাব। কানাডা ছেড়ে বাংলাদেশ চলে গেলে আর একবারও আসবো না।”
“আমার তুলতুল আসলেই বোকা আছে। কিছু বোঝে না। তোমাকে নিয়ে যাব না সে কথা তো বলেছি শুধু মমকে শোনানোর জন্য। তোমাকে নিয়ে যেতে আমার সমস্যা থাকবে কেন? আমি নিজেই তো তোমাকে লাঞ্চের সময় বলেছিলাম, তোমাকে সাথে নিয়ে যেতে চাই। সেটা কি ভুলে গেছো?”
“মিথ্যা বলো না একদম। আমাকে বোকা ভেবে ভুল করো না। আমি সবটাই বুঝি। তুমি আসলে আমাকে ভালোবাসো না।”
মিতুল মুখে এটা বললেও, ও ঠিকই জানে জোহান ওকে খুব ভালোবাসে। এটা নিছকই রাগের সাথে বলা কথা।
জোহান বললো,
“ভালোবাসি না আমি তোমায়?”
“না, বাসো না। আমি নিশ্চিত তোমার মনে ওই মেয়েটা ঘুরছে।”
“কোন মেয়েটা? সান্ডা?”
“না। ওই মেয়েটা!”
“কোন মেয়েটা?”
“যে মেয়েটা তোমাকে জড়িয়ে ধরেছিল!”
“উফ মিতুল! তুমি এখনও টারাকে নিয়ে পড়ে আছো? ও আমাকে জড়িয়ে ধরেছিল বলে তোমার এখনও হিংসা হচ্ছে? ঠিক আছে, তুমিও আমাকে জড়িয়ে ধরে নিজের হিংসা মিটিয়ে ফেলো…” শেষের কথাটা বলতে বলতে জোহান মিতুলের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। দুই হাত প্রসারিত করে বললো,
“গিভ মি অ্যা হাগ!”
মিতুলের মেজাজ আরও খারাপ হলো।
“আমার কথা তোমার কাছে মজা ঠেকছে?”
জোহানের প্রসারিত হাত নিজ অবস্থানে ফিরে এলো। সিরিয়াস কণ্ঠে বললো,
“বানফ ন্যাশনাল পার্ক কিন্তু খুব সুন্দর একটা জায়গা। লেক লুইসের নাম শুনেছো? ওটাও ওই পার্কের মধ্যে অবস্থিত।”
মিতুল শুনেছে লেক লুইসের নাম। বানফ ন্যাশনাল পার্ক সম্পর্কেও শুনেছে কিছু কিছু।
জোহান বললো,
“যাবে না বানফ ন্যাশনাল পার্ক দেখতে?”
মিতুলের রাগ পড়তে শুরু করেছে। মিতুল জোহানের দিক থেকে চোখ সরিয়ে শূন্যে দৃষ্টি স্থাপন করে বললো,
“যাব।”
জোহান হেসে বললো,
“ব্যাগপত্র গোছাতে সাহায্য লাগবে? করবো সাহায্য?”
“কোনো দরকার নেই। আমি নিজেরটা নিজে গুছিয়ে নিতে জানি।”
_______________
খুব ভোরে একইসাথে রওনা দিলো জোহান, মিতুল এবং ক্যামিলা। বানফ গিয়ে পৌঁছাতে প্রায় পাঁচ ঘণ্টার মতো লাগবে। জোহান যাওয়ার পথে রিকার্ডোর এপার্টমেন্টের সামনে রাস্তায় গাড়ি থামালো। এখান থেকে রিকার্ডোদের সাথে এক সাথে মিলিত হবে। রিকার্ডোর গাড়িতে আছে কেবল রিকার্ডো, জেমস এবং সারা। জোহানের বাকি ফ্রেন্ডসদের পক্ষে এখন বানফ ঘুরতে যাওয়া সম্ভব নয়।
ওদের গাড়ি দুটো এডমন্টনকে পিছনে ফেলে ক্যালগারিতে প্রবেশ করলো। ক্যালগারি হয়েই বানফ শহরে যাবে। মিতুল ড্রাইভিং সিটের পাশে বসে উইন্ডো থেকে উৎসুক দৃষ্টি নিবদ্ধ করে রেখেছে বাইরে। ক্যালগারি ঘুরতে এসেছিল ও। রেশমী আন্টি নিয়ে এসেছিল। খুবই পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন একটা শহর এই ক্যালগারি। আলবার্টার প্রধান এবং জনবহুল শহর এটা। ক্যালগারি থেকে মাত্র ১০০ মাইল পশ্চিমেই অবস্থিত বানফ শহর।
ক্যালগারি শহর থেকে বের হতেই দূরের রকি মাউন্টেন চোখে পড়লো।
দীর্ঘ জার্নির পর ওরা বানফ শহরে পৌঁছে গেছে। ক্যালগারি থেকে বানফ পর্যন্ত হাইওয়ে অনেক সুন্দর। রাস্তার দুই পাশেই বিস্তীর্ণ সবুজ মাঠ। মাঝে মধ্যেই চোখে পড়েছে গরু, মহিষের দল। কয়েকটা ঘোড়াও দেখেছিল। বানফ হলো পাহাড় ঘেরা ছোট্ট একটি শহর। শহরটা বানফ ন্যাশনাল পার্কের মধ্যেই অবস্থিত। বানফ শহরের চারপাশে প্রায় ছয় হাজার পাঁচশ স্কয়ার কিলোমিটার নিয়ে বানফ ন্যাশনাল পার্ক। বানফ শহরের বুক চিরে বানফ এভিনিউর দুই পাশে গড়ে উঠেছে রেস্টুরেন্ট, দোকানপাট, আর হোটেল। হোটেলগুলো দেখতে দুর্গের মতো।
প্রথমেই হোটেলে এলো ওরা। থ্রি স্টার একটা হোটেল আগে থেকেই বুকিং করা ছিল ওদের। বেশি সময় থাকলো না হোটেলে। অতিরিক্ত জিনিসপত্র হোটেলে রেখে, প্রয়োজনীয় যা দরকার তা নিয়ে বেরিয়ে পড়লো দ্রুত।
প্রথমেই যাবে লেক লুইস দেখতে। গাড়িতে করে বেরিয়ে পড়লো সবাই। কিছুক্ষণ যাত্রা শেষে দেখা দিলো কানাডিয়ান রকি মাউন্টেন। এই রকির কোলেই রয়েছে লেক লুইস। রকি মাউন্টেনের বরফ গলা পানি থেকেই এই লেকের উৎপত্তি। দুটি পাহাড়ের মাঝখানে যতদূর চোখ যায় ঘন নীল রঙের স্বচ্ছ পানি। মিতুলের মনে হলো এই লেকের সৌন্দর্য ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন। লেকের পাড়ে দাঁড়িয়ে পাহাড়ের দিকে তাকালে দৃষ্টি ফেরানো দায়। মিতুলের দুচোখ মুগ্ধতার অতল নেশায় ডুবে যাচ্ছে।
লেক লুইসের পাড়েই প্রায় দুইশ বছরের পুরোনো কানাডার বিখ্যাত ‘ফেয়ারমন্ট শাতো অন দ্যা লেক হোটেল’ অবস্থিত। জেমস বললো, এই দালানটি তার কাছে বেমানান লাগছে এই হ্রদের পাশে।
মিতুলের তা মনে হলো না। ওর মনে হলো দুইশ বছরের পুরনো এই বিশাল রাজকীয় দালানটি লেক লুইসের সৌন্দর্য বৃদ্ধি বৈ হ্রাস করেনি।
সবাই মিলে লেকের ধারে অনেকক্ষণ হাঁটাহাঁটি করলো। রিকার্ডো ক্যামেরা নিয়ে এসেছে। সেই ক্যামেরা দিয়ে বেশ কিছু ছবি তোলা হলো।
লেকের পানি অনেক ঠান্ডা। এই ঠান্ডা পানিতেই দুইটি ছেলেকে গোসল করতে নামতে দেখা গেল। ছেলে দুটোর সাথে থাকা অন্য ফ্রেন্ডসরা হৈ হৈ করে উঠলো। মিতুল অবাক হয়ে দেখলো সবটা। এত ঠান্ডা পানিতে কীভাবে নামলো ছেলে দুটো? শরীরের প্রতি মায়া নেই ওদের?
রিকার্ডো হঠাৎ জোহানকে বললো,
“হেই জোহান, আমরাও নামবো না কি?”
রিকার্ডোর কথার কিঞ্চিৎ সাউন্ড মিতুলের কানে এলেই মিতুল বলে উঠলো,
“অসম্ভব! কিছুতেই তোমরা এই ঠান্ডা পানিতে নামবে না।”
মিতুলের কথা শুনে সবাই হো হো করে হেসে উঠলো। রিকার্ডো নিতান্তই মজা করে পানিতে নামার কথা বলেছিল, যেটা মিতুল বুঝতে পারেনি। মিতুল এটা সিরিয়াসলি নিয়েছে। সবার হাসির পাত্র হওয়ায় মিতুলের খুব খারাপ লাগলো। অপমান বোধ হলো। বেশি খারাপ লাগলো জোহানও ওর বন্ধুদের সাথে তাল মিলিয়ে হাসলো দেখে।
মিতুলের মন খারাপি বেশিক্ষণ রইল না। জোহান ওর মন ভালো করে দিলো।
একপাশে একটি বোটহাউস ও জেটি আছে। সেখান থেকে একটি ক্যান্যু ভাড়া করলো জোহান। সবাই মিলে কিছুক্ষণ হ্রদে ঘুরে বেড়ালো।
দুপুরে লাঞ্চ করলো ‘ফেয়ারমন্ট শাতো অন দ্যা লেক হোটেল’ এর একটি রেস্টুরেন্টে।
লেক লুইসে প্রায় দুই-তিন ঘণ্টা সময় কাটিয়ে সবাই মিলে এরপর রওনা হলো লেক মোরেইনের দিকে। লেক লুইস থেকে লেক মোরেইন নিকটবর্তী। মোরেইন লেকের সাথে সাথে বো লেকেও গেল। এই লেক দুটোর পানির উৎসও পাহাড়ের ওপরের বরফ গলিত পানি। পানির উৎস এক হলেও একেক লেকের পানির রং একেক রকম। কোনোটা গাঢ় সবুজ, কোনোটা হালকা নীল, আবার কোনোটা স্বচ্ছ গাঢ় নীল।
ঘোরাঘুরি করতে করতে প্রায় সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো। এবার হোটেলে ফিরতে হবে।
হোটেলে আসার পথে বানফ ন্যাশনাল পার্কে থাকা বন্য পশুর সাথে দেখা হয়ে গেল। মিতুল একসাথে দুই, তিন প্রজাতির ভাল্লুক, হরিণ দেখতে পেল। লেকে যাওয়ার সময়ও দেখেছিল একটা দুটো প্রাণী। কিন্তু এই সন্ধ্যায় প্রায় ছয় ধরনের প্রাণী দেখতে পেল।
মিতুলের মনে হলো এই বানফ ন্যাশনাল পার্কটা না ঘুরে বাংলাদেশ ফিরলে বড়ো একটা অসম্পূর্ণতা থেকে যেত।
_____________
বানফ শহরের কেন্দ্রস্থলে অনেকগুলো ভালো মানের ক্যাফে আছে। মিতুল এবং জোহান এখন এভেলিন ক্যাফের দিকে যাচ্ছে। বাকিরা আগেই চলে গিয়েছে সেখানে।
ক্যাফেতে ঢুকতেই ক্যামিলা মিতুলের কানে ফোন ধরিয়ে দিলো। রেশমী আন্টি আছেন লাইনে। একটু সময় কথা হলো রেশমী আন্টির সাথে। এখানে জোহানদের সাথে থাকতে কোনো অসুবিধা হচ্ছে কি না, জোহান এবং ওর বন্ধুরা বেশি ফাজলামো করছে কি না ইত্যাদি বিষয়ে জানতে চাইলেন।
কফি অর্ডার করা হলো সবার জন্য। সাথে হালকা নাস্তা। বিল মেটানোর ভার পড়লো রিকার্ডোর উপর। রিকার্ডো ভালোয় ভালোয় মেনে নিলো সেটা।
খাওয়ার মাঝে রিকার্ডো হঠাৎ মিতুলকে জিজ্ঞেস করলো,
“আচ্ছা মিটুল, কোন জিনিসটা তুমি সবচেয়ে বেশি পছন্দ করো?”
মিতুল হঠাৎ করে এমন একটা প্রশ্ন করার মানে বুঝলো না। তবুও এর মানেটা আর জানতে চাইলো না। মনে মনে উত্তর ভাবতে লাগলো, কোন জিনিসটা ওর বেশি পছন্দ? মিতুলের মাথায় চেরি ছাড়া আর কিছু এলো না। মিতুল বললো,
“চেরি ব্লসম আমার সবচেয়ে বেশি পছন্দ।”
মিতুলের কথা শুনে সবাই হেসে উঠলো।
মিতুল ভীষণ অপমান বোধ করলো। আবারও ওকে নিয়ে হাসছে সবাই? মজা করছে? মিতুলের খুব খুব অসহায় লাগছে। এমন অসহায়ত্বে কাউকে পাশে পেল না। না জোহানকে, আর না ক্যামিলাকে। ওরা দুজনও হাসছে।
রিকার্ডো হাসি থামিয়ে বললো,
“নো মিটুল, চেরি ব্লসম নয়, অন্য কিছু বলো। চেরি ছাড়া আর কী পছন্দ তোমার? তোমার আর জোহানের বিয়ের পর না হয় তোমাদের এক মাসের ট্রিপে চেরির রাজ্যে পাঠাবো। দরকার হলে জাপান ট্যুরে পাঠাবো। কিন্তু এখন অন্য কোনো পছন্দ বলো।”
মিতুল ভাবতে লাগলো। চেরি ব্লসম ছাড়া আর কী পছন্দ ওর? চেরি ছাড়া আর কিছুই ভাবনাতে আসছে না ওর। মিতুল যখন ভাবনায় মগ্ন, তখন জোহান বললো,
“উফ, এত ভাবাভাবীর কী আছে? হেই রিক, লুক এট মি! এটা আমি। আমিই হলাম মিতুলের সবচেয়ে বেশি পছন্দের।”
জোহানের কথায় মিতুল একেবারে লজ্জায় পড়ে গেল। ফ্রেন্ডসদের সামনে এরকম করে না বললেই কি নয়?
জোহানের কথা শুনে আবার সবাই হাসিতে ফেঁটে পড়লো। রিকার্ডো হাসতে হাসতেই বললো,
“ওহ জো, শাট আপ। সিরিয়াস মুহূর্তে ফান করিস না। তোকে কিন্তু জাপান ট্যুর থেকে বাদ দিয়ে দেবো। মিটুলকে একা পাঠাবো জাপান চেরির রাজ্যে।”
“তাই না কি? আমাকে বাদ দিয়ে দিবি জাপান ট্যুর থেকে? শুনে রাখ, আমি না গেলে আমার তুলতুলও যাবে না।”
মিতুলের দিকে তাকিয়ে বললো,
“ঠিক বলেছি না?”
মিতুল লজ্জায় শেষ এবার। কী শুরু করলো জোহান? জোহানের লাজ লজ্জা যেটুকু ছিল, তাও বোধ হয় বানফ আসার পর শেষ হয়ে গেছে।
জেমস বললো,
“দেখো সারা, ওদের ভালোবাসা দেখো তুমি। তোমারও এমন হওয়া উচিত। তুমি যখন-তখন আমাকে ফেলে রেখে যেখানে-সেখানে চলে যাও।”
সারা রাগি চোখে জেমসের দিকে তাকিয়ে বললো,
“ও তাই? আমি তোমাকে ফেলে রেখে যেখানে-সেখানে চলে যাই? আর তোমার কথা কে বলবে? তুমি যে সেদিনও শ্যেনের সাথে একা ঘুরতে গেলে তখন? আমাকে তো জানিয়েও যাওনি।”
উত্তর, পাল্টা উত্তর চলতে লাগলো জেমস, সারার মাঝে।
রিকার্ডোর হিংসা লাগছে দুই দিকের এত প্রেম দেখে। অস্থির লাগছে। ওর গার্লফ্রেন্ড কানাডা থাকলে ও নিজেও এখন জোহান, জেমসের সাথে পাল্লা দিতে পারতো। রিকার্ডো অস্থিরতার মাঝ থেকে বলেই ফেললো,
“থামা তোদের ঝগড়া ঝাটি। আমার লিসা অস্ট্রেলিয়া না থেকে আজ কানাডা থাকলেই দেখতে পেতি। তোদের এসব প্রেম ভালোবাসা সব তুচ্ছ হয়ে যেত আমার আর লিসার ভালোবাসার কাছে। ওয়েট কর। নেক্সট মানথেই আমার লিসা আসছে অস্ট্রেলিয়া থেকে।”
সবাই হাসলো রিকার্ডোর কথা শুনে। শুধু মিতুল বাদে। সারা রিকার্ডোকে বললো,
“হিংসুটে! নিজের দিকে একবার তাকিয়ে দেখো রিক, কতটা হিংসুটে তুমি।”
সারার কথায় রিকার্ডো গর্জে উঠলো। বাকবিতন্ডা শুরু হলো এবার রিকার্ডো-সারার মাঝে। জোহান, জেমসও ওদের সাথে মাঝে মাঝে তাল মিলাচ্ছে।
ক্যামিলা সব দেখে চুপচাপ হাসছে মিটিমিটি।
মিতুল আছে ভালো যন্ত্রণায়! বেশ বুঝতে পারছে, জোহানের ফ্রেন্ডসগুলোও ঠিক জোহানের মতো। কোনো লাজ লজ্জা নেই কারো মাঝে। দেখো, একেক জন কী রকম কাণ্ড করে যাচ্ছে! এদের কাণ্ড-কলাপে মধ্যে থেকে ও লজ্জায় লজ্জায় শেষ হয়ে যাচ্ছে।
(চলবে)