#চেরি_ব্লসমের_সাথে_এক_সন্ধ্যা,০৩,০৪
#লেখা: ইফরাত মিলি
#পর্ব: ০৩
_____________
আকাশে হাজার তারার মেলা। মৃদুমন্দ বাতাস বইছে। সেই সাথে ঝরছে কিছু চেরি ব্লসমের পাপড়ি। মিতুল একটা চেরি ব্লসম গাছের পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। রেশমী আন্টি ক্যালগারি থেকে বাড়ি ফেরেননি। কালকে ফিরবেন। মিতুলের ভাবনা তা নিয়ে নয়, ও ভাবছে এই ফ্যামিলির মানুষগুলোর কথা। ফ্যামিলির ভিতরে কেবল একজন মানুষকেই নিরহংকারী এবং ভালো মনে হয়েছে ওর কাছে। আর সেই মানুষটি হলো, সাদাত আঙ্কল। বাকি প্রতিটা মানুষের মাঝেই কিছু না কিছু সমস্যা আছেই। বেশি সমস্যা হলো দুই ভাইয়ের মাঝে। এক ভাই তো সকাল বেলা খুব দাপট দেখিয়ে চলে গিয়েছিল অফিস, মিটিংয়ের ছুতো দিয়ে। আরেকজন ভাই কী করলো? গাড়ির ভিতরে বসে যা অপমান করার তা তো করলোই, আবার ঘোরানোর নামেও অষ্টরম্ভা। শুধু রাস্তায় রাস্তায় গাড়ি ড্রাইভ করে গেছে, আর ওকে পাশের সিটে বসিয়ে রেখেছে। সবশেষে যখন বাড়ি ফিরবে তখন বোকার মতো জিজ্ঞেস করেছিল, ‘কোথায় যেতে চাও?’। আচ্ছা এই শহরে কি সে থাকে, না কি ও? তাহলে এটা কেমন ধরনের প্রশ্ন? যেকোনো একটা জায়গায় নিয়ে গেলেই তো হতো। আহাম্মক একটা!
এখানে আসা যে কী পরিমাণ ভুল ছিল সেটা এখন হারে হারে টের পাচ্ছে ও। এই বাড়িতে ওঠা ছিল জীবনের সবথেকে বড়ো একটা ভুল। হোটেল রেখে কেন এই বাড়িতে থাকতে এসেছে? আব্বুর কথাই শোনা উচিত ছিল। আব্বু পই পই করে বলেছিল, ‘এখন কানাডা যাওয়ার কোনো দরকার নেই। বিয়ের পর বরের সাথে যাবে’।
এখানে আসার পর যে অপমান হতে হয়েছে তা বোধহয় আব্বুর কথা না শোনার শাস্তি!
হাতের বাহুতে হঠাৎ কিছুর আঘাতে ব্যথায় হাত দিয়ে বাহু চেপে ধরলো মিতুল। আঘাতের উৎস খুঁজতে গিয়ে মাটিতে পড়ে থাকা ক্ষুদ্র এক টুকরো গোলাকার, মসৃণ পাথর দেখতে পেল। এখানে পাথর এলো কোত্থেকে? মিতুল এদিক-ওদিক পাথর নিক্ষেপের উৎস খুঁজতে লাগলে জোহান দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে উচ্চস্বরে বললো,
“হেই, আই অ্যাম ইন হিয়্যার।”
মিতুল কণ্ঠস্বর অনুসর করে বারান্দায় তাকালো। জোহান হাত দিয়ে ইশারা করে বললো,
“এদিকে এসো।”
মিতুলের রাগে চোয়াল শক্ত হয়ে এলো। পাথরটা জোহান ছুঁড়ে মেরেছে? আঘাত করে এখন আবার অর্ডারও দিচ্ছে! ওর কথা মতো কেন যাবে বারান্দায়? নিজের দাস মনে করছে?
মিতুলকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে জোহান হাঁক পেরে বললো,
“কী হলো দাঁড়িয়ে আছো কেন? হারি আপ।”
মিতুল যাবে না যাবে না করেও কী ভেবেই যেন আবার পা বাড়ালো।
জোহান বারান্দার আর্মচেয়ারে আরাম করে বসে আছে। হাতে কোল্ড ড্রিঙ্কসের বোতল। মাঝে মাঝে সিপ দিচ্ছে বোতলে। মিতুলের মুখ বারান্দায় সদৃশ্যমান হতেই জোহান বললো,
“তোমরা বাংলাদেশের মেয়েরা এত স্লো কেন? নিচ থেকে এখানে আসতে এত সময় লাগে?”
“কেন ডেকেছো আমায়?”
জোহান প্রশ্নের জবাব না দিয়ে ওর পাশের আর্মচেয়ার দেখিয়ে বললো,
“সিট হিয়্যার।”
মিতুল চুপচাপ বসলো।
জোহান বোতলে সীপ দিয়ে বললো,
“ওখানে ভূতের মতো দাঁড়িয়ে ছিলে কেন?”
“ভূতের মতো মানে?”
“তা নয়তো কী? মনে হচ্ছিল একটা পিচ্চি মেয়ে ভূত দাঁড়িয়ে আছে গাছের নিচে। আচ্ছা, তুমি এত খাটো কেন?”
“আমি আল্লাহর সৃষ্টি। তিনি আমায় খাটো বানাবেন কী লম্বা বানাবেন সেটা একান্ত তার মর্জি। এখানে মানবজাতির এত মাথা ব্যথা না থাকলেও চলবে।” ফটাফট কথার জবাব দিলো মিতুল।
জোহান কিছু বললো না। শুধু নীরবে চুমুক দিলো বোতলে। কয়েক চুমুকে বোতল প্রায় খালি হয়ে এলো। জোহান হঠাৎ শূণ্য প্রায় বোতলটা মিতুলের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো,
“তুমি কি এটা পান করতে চাও?”
মিতুল একবার বোতল, আরেক বার জোহানকে দেখছে। একটা এঁটো খাওয়া জিনিস, যা কি না আবার তলানিতে পড়ে আছে, সেটা খাওয়ার জন্য অফার করছে ওকে? এটাও কি তাদের অপমান করার একটা টেকনিক? টেকনিক কি না জানে না, তবে মিতুল অপমানিত বোধ করছে।
“কী হলো? চাও না এটা?”
“আমি কারো খাওয়া জিনিস খাই না।”
জোহান শব্দ করে হেসে ফেললো।
“কারো খাওয়া জিনিস খাও না? পৃথিবীর সব খাবারই তো মানুষের খাওয়া। তাহলে তুমি কি খাবার না খেয়ে থাকো?”
মিতুলের জবাব দিতে মনে চাইলো না। জবাব দিতে গেলে চরম ঝগড়া বাঁধতে পারে এখানে।
এক চুমুকে বোতলে থাকা তরল বস্তুটুকু শেষ করে উঠে দাঁড়ালো জোহান। চলেই যাচ্ছিল, কিন্তু আবার কী ভেবে যেন থামলো খানিক দূরে গিয়ে। পিছন ফিরে মিতুলকে ডাকলো,
“হেই!”
মিতুল তাকাতেই, ‘ক্যাচ ইট’ বলে হাতের খালি বোতলটা মিতুলের দিকে ছুঁড়ে মারলো।
মিতুল দুই হাতে ক্যাচ ধরলো। যদি না ধরতো তাহলে বোতলটা সোজা ওর মুখ বরাবর এসে লাগতো।
জোহান বললো,
“আমার মনে হয় তোমার ওই বোতলটা খাওয়া উচিত। ওটা খাওয়ার রেকর্ড এখন পর্যন্ত গড়েনি। ওটা কেউ খায় না। ওটাই তোমার জন্য উপযুক্ত খাবার।”
মিতুল অবাক হয়ে বড়ো বড়ো চোখে দেখলো জোহানকে।
জোহান আর দাঁড়ালো না, চলে গেল।
মিতুল অগাধ বিস্ময়ে হাতের বোতলটা দেখলো। হে আল্লাহ! এ কোন অপমানের রাজ্যে এসে পড়েছে? এখানে কেউ তো ওকে মানুষ বলেই ভাবছে না! মিতুল বোতলটা খুব জোরে ফ্লোরে পতিত করলো। কাচের বোতলটা ভেঙে গিয়ে তিন টুকরো হলো। অপমানে জর্জরিত হয়ে দ্রুত স্থান ত্যাগ করলো মিতুল।
প্যাসেজ ওয়ে ধরে হেঁটে নিজের রুমের দিকে আসছে। এখানে আর থাকা সম্ভব নয়। পদে পদে অপমানের সম্মুখীন হতে হচ্ছে। এত অপমান সহ্য করে একটা মানুষ থাকে কী করে? রাগে ওর শরীর কাঁপছে, সেই সাথে কান্না পাচ্ছে। এই কানাডার মাটিতে কি অপমান কুঁড়াতে এসেছে? কেন এত অপমান এখানে?
রুমের দরজার কাছে আসতেই শুনতে পেল রুমে মোবাইল বাজছে।
মিতুল দ্রুত রুমে ঢুকে মোবাইল রিসিভ করলো। ওপাশের কলারকে মিষ্টি কণ্ঠে বললো,
“হাই মা।”
“এই পাঁচ বার কল দিলাম তোমায় আমি। এতক্ষণ কোথায় ছিলে?”
“আমি? আমি তো বারান্দায় ছিলাম। মোবাইল সাথে নিতে ভুলে গিয়েছিলাম। স্যরি আমি।”
“হয়েছে স্যরি বলতে হবে না। তোমার রেশমী আন্টির কাছে ফোন দিয়ে শুনলাম সে ক্যালগারিতে আছে। তাই তোমাকে নিয়ে চিন্তা হচ্ছিল আমার। কারো সাথে মিস বিহেভ করোনি তো আবার?”
‘তোমাকে নিয়ে চিন্তা হচ্ছিল আমার’ বাক্যটা শুনে মিতুল মনে মনে ভীষণ খুশি হয়েছিল। কিন্তু শেষের বাক্যটা ওর খুশি আর ধরে রাখতে পারলো না। মা আসলে ওকে নিয়ে চিন্তিত ছিল না। কারো সাথে মিস বিহেভ করেছে কি না সেটা নিয়ে চিন্তিত ছিল। মিতুলের সত্যি সত্যি কান্না পাচ্ছে এখন। কেন ওকে ঘিরে চারদিকে এত নির্মমতা?
_______________
মিতুলের যখন ঘুম ভাঙলো তখন এডমন্টনে কেবল ভোর হয়েছে। ভোরের দিকটায় শীতল অনুভব হচ্ছে। মনে হয় যেন শীতকাল চলছে। কিন্তু রোদ উঠে গেলেই দেখা যাবে আসলে শীতকাল নয়, বসন্ত চলছে। গাছে গাছে ফুঁটে থাকা রঙিন ফুলই তার প্রমাণ।
মিতুল ফ্রেশ হয়ে নিচে নামলো। বাড়িটা অদ্ভুত রকমের নীরব এখন। নীরবতার জাল চিরে কিচেন থেকে টুংটাং শব্দ ভেসে আসছে শুধু। ক্যামিলা ব্রেকফাস্ট তৈরিতে ব্যস্ত বোধহয়।
মিতুল দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এলো। ম্যাপল গাছের পিছন থেকে সূর্যটা উঁকি দিচ্ছে। বাতাসের চলাচল স্বাভাবিক। ঝোপের মাঝে ফোঁটা হলুদ ফুলগুলো মিষ্টি সুবাস ছড়াচ্ছে। মিতুল নিঃশ্বাসের সাথে ফুলের সুবাস টেনে নিলো কিছুটা।
সাদাত আঙ্কলকে ছোট্ট গেটটি অতিক্রম করতে দেখা গেল। জগিং করতে করতে এগিয়ে আসছেন উনি। বোধহয় জগিংয়েই বের হয়েছিলেন সকাল সকাল। সাদাত আঙ্কল কাছাকাছি আসলে মিতুলকে ‘গুড মর্নিং’ জানালো। মিতুলও গুড মর্নিং জানালো তাকে।
সাদাত আঙ্কল পায়ে মৃদু দৌঁড় অব্যহত রেখেই পাশ কাটিয়ে চলে গেলেন।
এর একটু সময় পর দেখা গেল জোহানকে। সাদাত আঙ্কলের মতো জগিং করতে করতে এগিয়ে আসছে। পরনে ট্রাউজার এবং টি শার্ট। মিতুল জোহানকে এক নজর দেখে আর তাকালো না ওর দিকে। মাথা নিচু করে ঘাসের দিকে তাকিয়ে রইল।
জোহান মিতুলকে দেখে এক ঝলক হাসলো। নিচু করে রাখা মুখে রাগের ছাপ স্পষ্ট মিতুলের। নাকের ছিদ্র দুটো স্বাভাবিক থেকে কিছুটা বড়ো আকার ধারণ করেছে ওর। জোহান মনে মনে বললো,
“নাক ফুলো মেয়ে তুলতুল!”
মিতুলের পাশ কাটিয়ে চলে যাওয়ার সময় ইচ্ছাকৃত ভাবে মিতুলকে ধাক্কা দিলো জোহান। হঠাৎ করে এমন হওয়ায় মিতুল কিছু বুঝে ওঠার আগেই পড়ে গেল মাটিতে।
মিতুলকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েও জোহান একবার পিছন ফিরে দেখলো না। কোনো ভ্রুক্ষেপ ছাড়াই সোজা চলে গেল ঘরে।
মিতুল কোথাও ব্যথা পেল না। কিন্তু জোহানের আচরণ ওর মস্তিষ্কে যন্ত্রণা ধরিয়ে দিলো। কোন সাহসে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলো ওকে? ওকে কি মানুষ মনে হয়নি? একটা মশা ভেবে তোয়াক্কা না করে চলে গেছে এভাবে? মিতুলের মুখ রক্তিম হয়ে উঠছে রাগে। মনে মনে খুব বাজে ভাবে গালি দিলো জোহানকে। তারপর উঠে দাঁড়ানোর জন্য উদ্ধুদ্ধ হলে ওর দিকে বাড়িয়ে দেওয়া একটা হাত চোখে পড়লো। হাতটা অনুসরণ করে মানুষটিকে দেখে অবাক হলো মিতুল। জায়িন!
জায়িন ওর দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে সেটা বিশ্বাস হচ্ছে না ওর। এই দুই ভাইকে কিছুতেই বিশ্বাস হয় না ওর। এরা ক্ষণে ক্ষণে রূপ বদলায়। ভালো মানুষের মুখোশ পরে থাকে। আসলে পিছনে অহংকারী শয়তান! মিতুলের মোটেও জায়িনের হাত ধরে উঠে দাঁড়াতে ইচ্ছা হলো না। কিন্তু হাত ধরে উঠে না দাঁড়ালে সেটা অভদ্রতা হবে। মিতুল জায়িনের হাত ধরেই উঠে দাঁড়ালো। সৌজন্যস্বরূপ ধন্যবাদ জানালো জায়িনকে।
জায়িন প্রতি উত্তরে কিছু না বলে ঘরে চলে গেল।
“হেই তুলতুল!” দূর থেকে জোহানের কণ্ঠস্বর ভেসে আসে কানে।
মিতুল তীব্র আক্রোশের সাথে তাকালো জোহানের দিকে। জোহান দোতলার বারান্দায় রেলিং ঘেঁষে দাঁড়ানো। মিতুলকে দেখে হাসছে।
“তোমরা বাংলাদেশি মেয়েরা তো দেখছি হালকা বাতাসে আকাশে উড়ো। একটু ধাক্কাতে কেউ এইভাবে পড়ে যায়?” জোহানের হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাওয়ার মতো অবস্থা।
মিতুলের কান থেকে উত্তাপ বের হচ্ছে রাগে। কথায় কথায় বাংলাদেশি মেয়ে বলে হেয় করে কথা বলা যেন জোহানের নেশা হয়ে গেছে। কীসে এই নেশা ছাড়বে ওর? দুই গালে কয়েকটা থাপ্পড় পড়লেই এই নেশা বাপ বাপ করে কেটে যাবে। ও পারলে এখনই জোহানের গাল থাপড়ে লাল করে দেয়। কিন্তু সেটা বোধহয় এই ইহজনমে পারবে না!
মিতুল অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে কটমট করে বললো,
“তোকে আমি পুকুরে চুবিয়ে মারবো বদমাইশ!”
“হোয়াট?” জোহান মিতুলের কথা স্পষ্ট ভাবে শুনতে পেল না।
“হোয়াট ডিড ইউ সে? ডিড ইউ স্পিক বেঙ্গলি এ্যাগেন?”
মিতুল রক্তচক্ষুতে নিষ্পলক তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর হনহন করে ঘরে ঢুকে সোজা নিজের রুমে চলে আসে।
_______________
মিতুল ঠিক করেছে আজকে একা একাই বাইরে বের হবে। ও তো আর ছোটো বাচ্চা নয় যে বাইরে বের হলে হারিয়ে যাবে। তাছাড়া একা বের হলে যে আনন্দটুকু উপভোগ করা যায় সেটা অন্য কারো সাথে বের হলে পাওয়া যায় না। হ্যাঁ, ও একাই বের হবে। এটা কালকেও ভাবা উচিত ছিল। কেন একজন লোক নিয়ে বাইরে বের হতে হবে? তাও আবার এই অহংকারী ফ্যামিলির!
ঠক ঠক করে দরজা নক করার শব্দ হলো। দরজা নক করছে কে? ক্যামিলা? মিতুল জানালার কাছের টুল ছেড়ে দরজা খুললো। দরজা খানিক খুলতেই জোহানের মুখ দেখা গেল। মিতুল খোলা দরজাটা আবার বন্ধ করার জন্য উদ্যত হলো, কিন্তু পারল না। জোহান হাত দিয়ে টেনে ধরলো দরজাটা। জোহানের প্রতি রাগ যাও একটু কমে এসেছিল তাও আবার বেড়ে গেল।
জোহানের কণ্ঠে থাকা তার সব সময়ের বিরক্ত সুরে বললো,
“শোনো, বেশি স্মার্ট সাজার চেষ্টা করো না। আগেই বলেছি তোমরা বাংলাদেশি মেয়েরা হলে আনস্মার্ট। যা একটু স্মার্ট সাজার চেষ্টা করো, ওগুলো সব উপরে উপরে। ওগুলো কোনো কাজের নয়। দশ মিনিট…না পাঁচ মিনিট। পাঁচ মিনিট সময় দিচ্ছি তোমায়। এর মধ্যেই গ্যারেজে উপস্থিত থাকবে। নয়তো রুমে এসে তুলে নিয়ে যাব তোমায়। আর আমার যদি এখানে দ্বিতীয় বার আসার প্রয়োজন পড়েই, তাহলে কিন্তু শুধু তুলে নিয়ে যাব না, মেরে হাড্ডিও ভেঙে দেবো। সো বি কেয়ারফুল। অ্যান্ড বি এ গুড গার্ল, ও কে?”
জোহান নিজের হাসি মুখখানা দেখালো একবার।
(চলবে)
#চেরি_ব্লসমের_সাথে_এক_সন্ধ্যা
#লেখা: ইফরাত মিলি
#পর্ব: ০৪
_____________
জোহান স্টিয়ারিং এ হাত রেখে গানের সঙ্গে নিজের গলা মিলাচ্ছে। ওর পাশের সিটেই ক্ষুব্ধ মনে বসে আছে মিতুল। এই বসন্তের মাঝে উইন্টারের গান একদম বিরক্ত লাগছে ওর। চোখ মুখ প্রায় কুঁচকে আছে বিরক্তিতে। কিন্তু জোহান বেশ উপভোগ করছে গানটা। মিতুলের ইচ্ছা করছে এক চাপে প্লে বাটন অফ করে দিতে।
“ব্রেকফাস্ট করেছো তুমি?” জোহানের থেকে হঠাৎ প্রশ্ন এলো।
“না। ব্রেকফাস্ট করার সুযোগ পেলাম কোথায়? তুমি কি সেই সুযোগ দিয়েছো আমায়?” গম্ভীর মুখে বললো মিতুল।
“চলো তাহলে কোনো রেস্টুরেন্টে গিয়ে ব্রেকফাস্ট করি।”
রাস্তায় তিনটা মোড় আসলে ডান দিকে মোড় নিলো জোহান।
বিশ মিনিটের ব্যবধানে রেস্টুরেন্টে এসে গাড়ি পার্ক করলো জোহান। রেস্টুরেন্টে ঢুকতে গিয়ে লক্ষ করলো মিতুল নেই সাথে। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে গেল জোহান। খুঁজতে গিয়ে দেখতে পেল রেস্টুরেন্টের নেম প্লেটের দিকে হা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে মিতুল। জোহান বিরক্ত হয়ে বললো,
“খাবার না খেয়ে রেস্টুরেন্টের নাম খেয়ে পেট ভরবে না কি? তাড়াতাড়ি এসো।”
জোহানের কথা খেয়াল হতে মিতুল দ্রুত পায়ে এগিয়ে এলো। গ্লাস ডোর অতিক্রম করতেই রেস্টুরেন্টের একজন মেয়ে কর্মচারী মিতুলদের স্বাগত জানালো। বাইরে থেকে দেখে যতটা না বড়ো মনে হয়েছে, ভিতরে তার থেকে অনেক বেশি বড়ো। ঝকঝকে পরিস্কার সব। প্রায় সব টেবিলই মানুষ জনে ভর্তি। সম্পূর্ণ দেয়ালের জায়গা জুড়ে থাকা বিশাল গ্লাসের কাছে একটা টেবিল দেখিয়ে জোহান বললো,
“চলো, ওখানটায় বসবো আমরা।”
জোহানের সামনা সামনি একটা চেয়ারে বসলো মিতুল। প্রথমেই ওর চোখ চলে গেল উইন্ডো গ্লাসের বাইরে। সকালের আমেজটা বড্ড প্রাণবন্ত। মিষ্টি সূর্য রশ্মি ছড়িয়ে আছে। পাতাবিহীন ফুল ভরা গাছ রাস্তার পাশে একরাশ সৌন্দর্য নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সমতল রাস্তা ধরে এগিয়ে চলছে নানান গাড়ি। পথচারীদের আনাগোনা চলছে স্বাভাবিক নিয়মে।
একজন ওয়েটার এগিয়ে এলো অর্ডার নিতে। জোহান মেনু কার্ড দেখে অর্ডার দিতে লাগলো।
মিতুল ভীষণ অবাক হলো। একই সাথে প্রায় ছয় আইটেমের খাবার অর্ডার দিয়েছে জোহান। এত খাবার খেতে পারবে?
“কী হলো? তুমি কিছু অর্ডার করবে না?”
জোহানের কথায় ধ্যান ভাঙলো মিতুলের। মেনু কার্ড হাতে নিতেই চক্ষু চড়ক গাছ। এত দাম!
এত খাবারের ভিতরে কী যে অর্ডার দেবে বুঝতে পারছে না। এ পাতা ও পাতা উল্টে অবশেষে অর্ডার দিলো, পিরি পিরি প্রন আর ফ্রুট স্যালাড।
জোহান কেমন মুখ বাঁকিয়ে বললো,
“মাত্র দুটো খাবার অর্ডার দিলে? আগে তো জানতাম বাংলাদেশি মেয়েরা প্রচুর খায়।”
মিতুল কিছু বললো না। জোহানের কথার জবাব না দেওয়ার চেষ্টা করছে সব সময়।
কিছুক্ষণের ভিতর খাবার চলে এলো। জোহান গরম খাবার ফুঁ দিয়ে একটু ঠান্ডা করে খাচ্ছে।
মিতুলের ফোনে রেশমী আন্টির কল আসলো। মিতুল কল রিসিভ করে সতেজ মৃদু কণ্ঠে বললো,
“গুড মর্নিং আন্টি!”
“গুড মর্নিং। তুমি কি জোহানের সাথে বাইরে বের হয়েছো?”
মিতুলের বলতে ইচ্ছা হলো,
‘জি না আন্টি, আমি তোমার ছেলের সাথে বের হইনি। তোমার বদমাইশ ছেলে আমাকে তার সাথে বের হতে বাধ্য করেছে।’
কিন্তু বললো,
“হ্যাঁ আন্টি, ওর সাথেই বের হয়েছি।”
“ঠিক আছে। ওর সাথে বেশি ঘোরাঘুরি করার দরকার নেই। তাড়াতাড়ি বাসায় চলে এসো।”
মিতুল নিস্তেজ গলায় বললো,
“ঠিক আছে।”
রেশমী আন্টি ফোন কেটে দিলেন। তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরতে বললেন কেন? অবশ্য ভালোই হয়েছে। এই বদমাইশটার সাথে থাকতে ভালো লাগছে না।
“তোমার মম আমাকে তাড়াতাড়ি বাড়ি যেতে বলেছে। একটু পর আমাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ো।”
জোহান ভাবলেশহীন কণ্ঠে বললো,
“তাড়াতাড়ি বাড়ি যেতে বলেছে তো যাও। আমাকে কেন বলছো? আমি কি তোমার ড্রাইভার? আমি কেন তোমায় বাড়ি পৌঁছে দেবো? একটা ট্যাক্সি ধরে চলে যাও।”
“একটা ট্যাক্সি ধরে চলে যাব মানে? আমাকে কে নিয়ে এসেছে এখানে? তুমি। তুমি আমাকে নিয়ে এসে এখন বাড়ি পৌঁছে দেবে না?”
“না।”
মিতুলের মাথাটা গরম হয়ে গেল। একটা বাক্যও বললো না আর। এই অহংকারী ফ্যামিলির একটা মানুষের সাথেও যে ও কথা বলে পারবে না, সেটা খুব ভালো করে বুঝতে পারছে।
খাওয়ার মাঝপথে জোহানের মোবাইলে ম্যাসেজ এলো। জ্যাকেট থেকে মোবাইল বের করে ম্যাসেজটা পড়লো জোহান। আবার মোবাইলটা পকেটে ঢুকিয়ে রেখে বললো,
“শোনো, আমার একটা কাজ আছে। আমি চলে যাচ্ছি। তুমি বিল মিটিয়ে দিয়ে সোজা বাড়ি চলে যেও।”
জোহান কথাটা বলে প্রায় দৌঁড়ে বেরিয়ে গেল রেস্টুরেন্ট থেকে।
মিতুল বিস্ময় নিয়ে শূন্য দরজার দিকে তাকিয়ে আছে। এটা কী করলো? যেখানে চলে যাওয়ার কথা ওর, সেখানে জোহান চলে গেল? আর বিল? বিল ওকে মিটিয়ে দিতে বলছে মানে? এত খাবার অর্ডার দিয়ে এত বিল বানিয়ে এখন ওর ঘাড়ে চাপিয়ে দিলো? একেকটা খাবারের যে দাম, এত ডলার এই মুহূর্তে পাবে কোথায় ও? এত ডলার নিয়ে কি বের হয়েছে? মিতুল দ্রুত নিজের ব্যাগ চেক করলো একবার। স্বস্তির নিঃশ্বাস পড়লো। যাক, ভালো পরিমাণ ডলার নিয়েই বের হয়েছে ভাগ্য গুনে। কিন্তু ওর কাছে যদি পর্যাপ্ত ডলার না থাকতো, তখন কী হতো?
মিতুলের খেতে সমস্যা হচ্ছে। খাওয়ার জন্য একটু নুলেই ছোটো ছোটো চুলগুলো মুখের উপর পড়ে বেশ ডিস্টার্ব করছে। এমনিতেই এই অচেনা জায়গায়, অচেনা পরিবেশে একার খুব অস্বস্তি লাগছে। তার উপর আবার চুলগুলোর জ্বালাতন। ইচ্ছা হচ্ছে এই মুহূর্তে চুলগুলো ঘ্যাঁচাৎ করে কেটে একেবারে ছোটো বানিয়ে ফেলে! ও কোথাও বের হলে হেয়ার ক্লিপ নিয়ে বের হয়। বাইরে খাওয়া পড়লে বা অস্বস্তি লাগলে নিজের জ্বালাময় চুলগুলো আটকে নেয়। কিন্তু আজকে জোহানের কথা মতো তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে চুলের জন্য কিছুই আনতে মনে ছিল না। আর জোহান যে হঠাৎ করে রেস্টুরেন্টে নিয়ে আসবে সেটাই বা জানতো কে?
মিতুল নিজের অবাধ্য চুলগুলো কোনো রকম সামলে এক চামচ খাবার মুখে পুরলো, ঠিক এই মুহূর্তে সামনে আবিষ্কার করলো একটা ছেলেকে। ধীরে ধীরে চোখ তুলে তাকাতেই ছেলেটার সহজ সরল মুখ ধরা দিলো চোখে। ছেলেটা একটা হেয়ার রাবার বাড়িয়ে দিয়েছে ওর দিকে। মিতুল অবাক হয়ে দেখছে ছেলেটাকে। ছেলেটা বোধহয় এখানের স্টাফ। গায়ে অন্য স্টাফদের মতো পোশাক। মাথা ভর্তি কালো, বাদামি সংমিশ্রণ চুলগুলো পরিপাটি। চোখের মণি ধূসর। মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। দেখে এক ঝলকেই বোঝা যায় ছেলেটা কানাডার অধিবাসী। কিন্তু ছেলেটা ওর দিকে হেয়ার রাবার বাড়িয়ে দিয়েছে কেন?
ছেলেটা মিতুলকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতে দেখে বললো,
“তোমার খেতে সমস্যা হচ্ছে। এটা দিয়ে নিজের চুল বাঁধো।”
মিতুলের হৃদয়ের অজানা কোনো জায়গায় থেকে থেকে এক মিষ্টি সুর বেজে উঠলো। এই প্রথম…কানাডায় আসার পর এই প্রথম কোনো মানুষকে ভালো লাগলো ওর। কী ভালো ছেলে! দেখতেও কী সুইট! দেখে মনে হচ্ছে শুভ্র এক গোলাপের পাপড়ি। মিতুলের চোখ সরাতে মন চাচ্ছে না। ইচ্ছে হচ্ছে আজীবন তাকিয়ে থাকুক ওই মুখপানে। ওই ধূসর চোখের মায়াতে হারিয়ে যাক আপোষে।
ছেলেটা একদৃষ্টিতে মিতুলকে তাকিয়ে থাকতে দেখে ডাকলো,
“ম্যাম!”
মিতুল শুনতে পেল না ছেলেটার ডাক। ছেলেটা আবার ডাকলো,
“ম্যাম…”
মিতুল এবার নিজের হুঁশে ফিরলো। দ্রুত নিজেকে সংযত করলো। ইশ কী করছিল? নির্লজ্জের মতো ছেলেটার দিকে তাকিয়ে ছিল? হায় আল্লাহ! ছেলেটা কী ভাববে ওকে?
ছেলেটা নিজের হাতের রাবারটা দেখিয়ে বললো,
“এটা নাও।”
মিতুল ছেলেটার হাত থেকে হেয়ার রাবারটা নিলো। নেওয়ার সময় অনুভব করলো ভীষণ অদ্ভুত এক অনুভূতি। এই অনুভূতি অপরিচিত ওর কাছে। আগে কখনও এরকম অনুভূতির সন্ধান পায়নি ওর মন।
_________________
মধ্যরাত। বাড়িটা স্বাভাবিক অর্থেই নীরব। ঘুমে তলিয়ে যাওয়া বাড়ি এখন পাতালপুরীসম। কিন্তু এই পাতালপুরীতে এখনও একজন জেগে আছে।
‘প্রথম দর্শনে প্রেম’ এই কথাটাকে বরাবরই গাঁজাখুরি বলে মনে হয়েছে মিতুলের। কিন্তু আজ বুঝলো, না গাঁজাখুরি নয়। এটা সত্য। সে প্রমাণ ও নিজে। মনের ভিতর এক মিষ্টি মধুর অনুভূতির উপস্থিতি সারাক্ষণ বিরাজ করছে। এই অনুভূতির ব্যাখ্যা জানে মিতুল। অবুঝ মেয়ে নয় ও। এই অনুভূতি সহজেই পড়ে ফেলতে পেরেছে। এই অনুভূতি প্রেমের! হ্যাঁ, প্রথম দেখাতে প্রেমে পড়েছে ও। সেই ধূসর, মায়াবী চোখের প্রেমে পড়েছে। পৃথিবীর সব মায়া যেন ওই চোখেতেই সমর্পণ করেছিল।
বসন্তের বাতাস ঠিক যেন মিতুলের হৃদয় পর্যন্ত ছুঁয়ে গিয়েছে। মিতুল টের পাচ্ছে ওর অনুভূতি গভীর থেকে আরও গভীরতায় হারাচ্ছে।
কালো হেয়ার রাবারটা মিতুল ব্রেসলেটের মতো হাতে পরে রয়েছে। রাবারটার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি করে হেসে ফেললো। প্রথম অনুভূতির কাছ থেকে প্রথম পাওয়া উপহার! মিতুলের কাছে এ তো উপহার নয়, এটা একটা ভালোবাসা! এই মুহূর্তে গান গাইতে মন চাইছে ওর। কী একটা গান যেন সেই থেকে মনে ঘুরঘুর করছে, কিন্তু গানের কথাগুলো স্পষ্টতর ধরা দিচ্ছে না। মনে করার চেষ্টা করছে। কী যেন গানটা? হ্যাঁ, মনে পড়েছে। মিতুল গুন গুন করে গেয়ে উঠলো,
“প্রেমে পড়েছে মন, প্রেমে পড়েছে
অচেনা এক মানুষ আমায় পাগল করেছে…”
মিতুল গান গাইতে গাইতে জানালার দিকে এগিয়ে এলো। আজকে জোৎস্না রজনী। জোৎস্নার শুভ্র আলোর মায়ায় জড়িয়ে আছে পুরো বাড়ি। লন জোৎস্নার আলোয় দৃশ্যমান। মিতুল গুনগুন করতে করতে রুম থেকে বের হলো। চলে এলো বারান্দায়। বারান্দা চাঁদের আলোয় মোহনীয়। ঝিরিঝিরি বাতাস পরম আদরে ছুঁয়ে দিচ্ছে। বাতাসের সাথে ফুলের সুবাস আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে। আহ, কী সুঘ্রাণ! মিতুল বড়ো করে নিঃশ্বাস নিলো।
বারান্দার টবে থাকা ফুলে হালকা হাত বুলিয়ে দিলো। এগোতে এগোতে বারান্দার শেষ প্রান্তে চলে এলো ও। আর এসেই থমকে গেল। থেমে গেল ওর গুনগুনানি। দীর্ঘ লম্বা বারান্দার শেষ প্রান্তে দাঁড়ালে বাড়ির পিছনের গার্ডেন দেখা যায়। মিতুল শুধু গার্ডেনই নয়, সেই সাথে দেখতে পেল একটা ছায়া মূর্তি!
মিতুলের হাত-পা জমে গেল। শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে গেল ভয়ের স্রোত। ওখানে ছায়ামূর্তিটা কীসের? ভূতের নয়তো? ভয়ে আত্মা শুকিয়ে যাওয়ার উপক্রম হচ্ছে, তবুও ওর কৌতূহল দমে না। ও ভালো করে দেখার চেষ্টা করলো ছায়ামূর্তিটা ঠিক কার। ভূতের? না মানুষের? ছায়ামূর্তিটা ওক গাছের নিচে দাঁড়িয়ে আছে। হাতে বিশাল আকৃতির কিছু একটা দেখা যাচ্ছে। কী ওটা? গিটার? দূর থেকে দেখলেও বোঝা যাচ্ছে ছায়ামূর্তিটা ওক গাছে হেলান দিয়ে হাতে থাকা গিটার বাজিয়ে চলছে অনবরত। আচ্ছা, ভূত কি গিটার বাজাতে পারে? একটু ভাবলো মিতুল।
না, মনে হচ্ছে পারে না। ভূতের এত ভালো গুন থাকে না কি?
ওক গাছের নিচে চাঁদের আলো প্রবেশের সুযোগ পায়নি পুরোপুরি। তবুও কিছুটা আলো ছুঁয়েছে ওক গাছের নিচের জমিন। আর সেই আলোতেই দেখা যাচ্ছে ছায়ামূর্তিকে। দেহের গড়ন দেখে মনে হচ্ছে ছায়ামূর্তিটা ছেলে।
মিতুল গিটারের সুর শুনতে পাচ্ছে না, তবুও ওর মনে হচ্ছে গিটারে স্যাড সুর বাজছে। মনে হচ্ছে কোনো এক দুঃখী ছেলে গিটারে দুঃখী সুর তুলছে এই নিস্তব্ধ জোৎস্না রাতে। মিতুলের হঠাৎ মায়া হলো ছেলেটার জন্য। কেন হলো জানে না। আচ্ছা, ছেলেটা কে? এ বাড়িতে আরও কোনো মানুষ থাকে না কি?
ছায়ামূর্তিটাকে নড়তে দেখা গেল। বোধহয় ওক গাছের নিচ থেকে বাইরে বের হবে এবার।
হ্যাঁ, ঠিক তাই। ছায়ামূর্তি ওক গাছের নিচ থেকে বেরিয়ে এলো। ছায়ামূর্তির উপর চাঁদের আলো পড়েছে এখন। দেখা গেল, চাঁদের আলোতে গিটার নিয়ে একটা ছেলে এগিয়ে চলছে। মিতুল সচকিত চোখ মেলে চাইলো। মুখ দেখা যাচ্ছে না ঠিক। মাথা নিচু করে হাঁটছে। মাথা উঁচু করলে বোধহয় মুখ দেখা যাবে। ছেলেটা হঠাৎ মাথা উঁচু করলো। মিতুল অগাধ কৌতূহল নিয়ে ওঁৎ পেতে আছে ছেলেটার মুখ দেখার জন্য। চাঁদের মিষ্টি আলো ছেলেটির মুখে পড়েছে। স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না ছেলেটির মুখ। কিন্তু ঝাপসা ভাবে দেখেও ছেলেটিকে চিনতে সমস্যা হলো না মিতুলের। ও বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেল। অস্ফুট স্বরে উচ্চারণ করলো,
“জোহান!”
জোহান চাঁদের আবছা আলো গায়ে মেখে এগিয়ে চলছে। এক পা, দু পা করে ক্রমশ চলছে ও। এগিয়ে যেতে যেতে জঙ্গলের ভিতরের দিকে চলে যাওয়া সোজা সরু রাস্তায় চলে গেল। হেঁটে চললো সরু রাস্তা ধরে। কিছুক্ষণের মধ্যে জোহানের শরীর হারিয়ে গেল জঙ্গলের গাঢ় অন্ধকারে।
(চলবে)