#চেরি_ব্লসমের_সাথে_এক_সন্ধ্যা,পর্ব: ৫২
#লেখা: ইফরাত মিলি
____________
[দশ মাস পর]
কানাডা থেকে আসার পর প্রথম প্রথম কয়েকটা দিন খুব দীর্ঘ মনে হতো। কিছুতেই সময় কাটতো না। দিনগুলো কষ্টকর ছিল খুব। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে গেছে।
তবুও মাঝে মাঝে ফোনে কথা বলতে গেলে ভাষা হারিয়ে যায় দুজনের। একেবারে নিশ্চুপ হয়ে যায়। কোনো কথা আসে না মুখে। কেটে যায় সেকেন্ড, মিনিট। কখনো বা এই মিনিটের পরিমান প্রায় আধ ঘণ্টায় গিয়ে থামে। ফোনের দু প্রান্তে বসে দুজন নিশ্চুপ মানুষ দুজনের হৃদয়ের কথা পড়ে তখন। দুজনই দুজনের শূন্যতা অনুভব করে। কিন্তু সেটা মুখে প্রকাশ করে না কেউ। তবুও বেশ বুঝতে পারে দুজন দুজনকে। মিতুল মাঝে মাঝে অবাক হয়। এত চঞ্চল জোহানের মুখেও যখন কথা থাকে না তখন অবাক তো হওয়ারই কথা।
এই দশ মাসে জোহানের সাথে অডিয়ো, ভিডিয়ো কল এবং ম্যাসেজের মাধ্যমে যোগাযোগ চলেছে। জোহানের অবশ্য কল, ম্যাসেজ দেওয়ার কোনো ঠিক নেই। টাইম মেইনটেইন করতে জানে না জোহান। মিতুল ওকে বারবার নিষেধ করে দিয়েছে তার ক্লাস টাইমে যেন কল না দেয়। কিন্তু দেখা যায় মাঝে মাঝেই ক্লাস টাইমেও পাঁচ-ছয়টা মিসড কল উঠে থাকে জোহানের। শুধু এতটুকুই নয়, দেখা যায় রাত দুইটা-তিনটার সময়ও কল দিয়েছে জোহান। কানাডা তো তখন দিনের আলোতে রঙিন থাকে, কিন্তু বাংলাদেশ যে তখন গভীর রাতের আঁধারে ডুবে থাকে তা এই দশ মাসেও শিখিয়ে উঠতে পারলো না জোহানকে। পারবেও না বোধহয় জীবনে। আর শুধু জোহান নয়। ওর ফ্রেন্ডসগুলোরও কল দেওয়ার কোনো ঠিক ঠিকানা নেই। জোহানের মতোই। যখন ইচ্ছা তখন কল দেয়।
রেশমী আন্টি, ক্যামিলা, জায়িনও মাঝে মধ্যে কল দেয়। জায়িন দেয় খুবই কম। তবে সবচেয়ে কম কল দেয় কার্ল। এই দশ মাসে দুই বার হয়তো কল দিয়েছে সে। ভালোই হয়েছে। তার কল না দেওয়াই ভালো।
মিতুলের জায়িনের সাথে কথা বলতে অনীহা হয়। জায়িনের সাথে কথা বলতে গেলে অস্বস্তি লাগে ওর। এত দিনেও এই জায়িনের সাথে স্বাভাবিক হয়ে উঠতে পারলো না ও। ঠিক সেই আগের মতোই আছে। মাঝে মধ্যে জায়িন যখন কল দেয় তখন ওর মাথাতে কিছুই থাকে না। কী বলতে যে কী বলবে সেটাই খুঁজে পায় না। ওপাশে জায়িনের অবস্থাও ঠিক তেমনই। কল দিয়ে শুধু কেমন আছো জিজ্ঞেস করে। তারপর ও উত্তর দিয়ে সে কেমন আছে জিজ্ঞেস করলেই, ‘ভালো আছি’ বলে কল কেটে দেয়।
জায়িন যখন এমন করে তখন মিতুল অপমানে লাল হয়ে যায়। ওর ধারণা জায়িন ওকে অপমান করার জন্যই এমন করে। তা না হলে এমন করে কেউ কল কেটে দিতে পারে? এটা তো অপমান বৈ আর কিছুই নয়।
থাক এখন জায়িনের কথা বাদ দিলো, জোহানের কথায় আসা যাক। টরোন্টোতে সেই ফেস্টিবলের পর জোহানের গানের ব্যাপারটা বেশ ভালো উন্নতি লাভ করেছে। যতটা না জোহান আশা করেছিল তার থেকে অনেক বেশি উন্নতি করেছে।
টরন্টোর সেই ফেস্টিবলের পর টরন্টোর একটা গ্রুপ থেকে ওকে যোগ হওয়ার জন্য অফার করেছিল।
জোহানের স্বপ্ন ছিল একটা গ্রুপের সাথে এড হবে। সুযোগটা আপনা থেকেই ওর কাছে এসেছিল। কিন্তু জোহান নিজেই এই সুযোগটা ছেড়ে দিয়েছে। অফারটি গ্রহণ করেনি ও। গ্রহণ না করার কারণ? কারণ হলো, ওই গ্রুপে এড হলে ওকে টরোন্টো গিয়ে থাকতে হবে। নিজের প্রিয় এডমন্টন এবং প্রিয় ফ্রেন্ডসদের ছেড়ে টরোন্টো গিয়ে থাকতে নারাজ জোহান। তাই অফারটি গ্রহণ করেনি। তবে এতে ওর রিচ আটকে থাকেনি। ওই ফেস্টিবলে পারফর্মের পর এখন অনেক মানুষ চেনে ওকে। এই চেনার পরিমাণটা ক্রমশ আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে।
জোহান এখন গ্রুপে এড হওয়ার ব্যাপারটা বাদ দিয়ে একক ভাবে গান করছে। কয়েক মাস ধরে খুব পরিশ্রম করে চলেছে ও। দুই মাস আগেই ওর নতুন এ্যালবাম বের হয়েছে। এই এ্যালবামে সাড়া পেয়েছে প্রচুর। এই অ্যালবামে মোট ছয়টা গান। ছয়টা গানই বলতে গেলে দর্শক প্রিয়। তবে এই ছয়টা গান ছাড়াও এক মাস আগে রিলিজ প্রাপ্ত ‘Dark Town’ গানটা সবথেকে বেশি সুনাম কুড়িয়েছে। এই গানটা রিলিজ পাওয়ার পর ওর ফ্যান তরতর করে বেড়ে গেছে। এই গানটাই ওর স্বপ্ন অনেক দূর অবধি নিয়ে গেছে। এটা একটি উদ্যমী গান। গানটা গাওয়াও হয়েছে বেশ স্ট্রং কণ্ঠে। গানের প্রতিটা ওয়ার্ডে এবং জোহানের কণ্ঠে একটা তেজি ভাব জড়িয়ে আছে। মিতুলের গানটা ভালো লাগলেও গানের ভিডিয়োটা ভালো লাগেনি। পুরো ভিডিয়ো জুড়েই থ্রিলে ভরপুর। গানটার ভিতর জোহানের চাহনি এবং হাসি যে কী ভয়ঙ্কর, সেটা বলার মতো না। অথচ মানুষ এই চাহনি এবং হাসিতেই ফিদা হয়ে গেছে। কিন্তু ওর দেখলেই লাগে ভয়। গানটা দেখে বোঝার উপায় নেই জোহান বাস্তবে ঠিক কেমন। গানটা দেখলে মনে হয় জোহান মাফিয়াদের লিডার, একটা ভিলেন। অথচ ও গানটার হিরো। এক হাতে রিভলভার, আরেক হাতে ধোঁয়া ওঠা সিগারেট। উফ কী লুক! সামনেই আবার লাশ পড়ে রয়েছে।
গানটার সাথে ভিডিয়োটা এত মিলেছে, একদম খাপে খাপ। ওর চেনা জোহানের সাথে ভিডিয়োর জোহানের কোনো মিল নেই, এই জন্যই ভালো লাগে না ওর। কিন্তু ওর ভাইয়েরা গানটা দেখে একটানা দু দিন প্রশংসা করেছে। এমনকি রেশমী আন্টি একদিন কথায় কথায় জোহানের এই গানটার ব্যাপারে বলেছিল। সরাসরি প্রশংসা করেনি, কিন্তু যেমন ভাবে বলেছে তাতে বোঝা যায় তারও ভালো লেগেছে গানটা।
বলতে গেলে জোহান এখন ফেমাস।
কয়েকদিন ধরেই আবার জোহানের একটা ব্যাপার নিয়ে বেশ কথাকথি চলছে। জোহান এ পর্যন্ত ওর কোনো ফ্যানকে অটোগ্রাফ দেয়নি। অটোগ্রাফ না দিতে চাওয়ার কারণ জানতে চাইলে ও এক ইন্টারভিউতে বলেছে, ওর একজন বিশেষ মানুষ আছে, যাকে ও প্রথম অটোগ্রাফটা দিতে চায়। সে দূরে আছে বলে অটোগ্রাফটা দিতে পারছে না। এ জন্য ও আন্তরিক ভাবে দুঃখ প্রকাশ করেছে ওর ফ্যানদের কাছে।
সবাই খুব এক্সসাইটিং ওর সেই প্রথম অটোগ্রাফ দিতে চাওয়া মানুষটি কে সেটা জানার জন্য। যখন সবাই জানবে জোহানের সেই মানুষটি আসলে বাংলাদেশের একজন সাধারণ মেয়ে ছাড়া আর কিছুই না, তখন সবাই কেমন ভাবে নেবে ব্যাপারটা? সবাই কি হাসাহাসি করবে? মিতুল এই ভেবে বারবার চিন্তায় ডুবে যায়।
মিতুলের এখনও বেশ চিন্তা হচ্ছে। গতকাল রাতে মা ফোন করে জরুরি তলব করলেন বাড়িতে। বললেন, আজকেই যেন একটা ট্রেন ধরে বাড়ি চলে যায় ও। হঠাৎ করে কী হলো যে মা এমন করে বাড়ি ডাকছে? কারো কিছু হয়েছে কি না জিজ্ঞেস করলেও মা কিছুই বলেননি। বাড়িতে গিয়েই সবটা দেখতে বলেছেন। মায়ের কথা অমান্য করার কথা মিতুল ভাবতে পারে না, তাই তো মায়ের কথা মতো এখন ট্রেনে করে ঢাকার দিকে ছুটছে।
মিতুলের মাথায় আরও দুশ্চিন্তা আছে। এটা জোহানকে নিয়ে। জোহান হঠাৎ কয়েকদিন ধরে কেমন যেন পাল্টে গেছে! যে জোহান আগে এত এত কল দিতো, সেই জোহানকে এখন ও নিজে কল দিয়েও পায় না। মাঝে মধ্যে জোহান একটা দুটো ম্যাসেজ পাঠায়, তাও বিজি আছে সেটা লিখে। এরকম হচ্ছে পাঁচদিন ধরে। এর মধ্যে পুরো একটা দিন তো জোহানের কোনো খবরই ছিল না। জোহান কেন এরকম করছে বুঝতে পারছে না ও। পাঁচ দিন আগে যখন জোহান ফোন করেছিল তখন বলেছিল সারপ্রাইজ দেবে ওকে। একটা সারপ্রাইজ না, তিন তিনটা সারপ্রাইজ দেবে। সেটাই কি এখন দিচ্ছে না কি? এই যে কল দিচ্ছে না, সেটা কি একটা সারপ্রাইজ?
এরপরের সারপ্রাইজ কী হবে? প্রথম অটোগ্রাফ যে ওর জন্য তুলে রেখেছিল, সেটা অন্য কাউকে দিয়ে দেবে?
এরপরের সারপ্রাইজ? কী দেবে এর পরের সারপ্রাইজে? একদিন ফোন করে বলবে, ‘যাও তোমার সাথে ব্রেকআপ!’, এটাই কি?
জোহান এইসব সারপ্রাইজ দেবে ওকে? এটা কি জোহানের ফেমাস হয়ে যাওয়ার ফল? সবাই যেমন ফেমাস হয়ে যাওয়ার পর নিজের অতীত ভুলে যায়, জোহানও কি তেমনটা করছে? নিজের অতীতের সাথেই ঝেড়ে ফেলে দিচ্ছে ওকে? মিতুল এই চিন্তায় ডুবে রইল কিছুক্ষণ।
পরে নিজের প্রতি নিজে অতিষ্ঠ হয়ে উঠলো। মনে মনে নিজেকে নিজে বোঝালো,
‘ওহ কাম অন মিতুল! তোমার জোহান কখনোই এমন করতে পারে না। ও তোমাকে খুব ভালোবাসে। ওর অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ সবটা জুড়ে শুধু তুমিই থাকবে। তুমিই ওর ভালোবাসা।’
মিতুলের মন একটু বুঝলো। জোহান ব্যস্ত মানুষ। ব্যস্ত থাকতেই পারে। এটা নিয়ে এত অধৈর্য হলে চলবে না। ধৈর্য ধরতে হবে। এখনই এমন অধৈর্য হয়ে পড়লে ভবিষ্যতে কী হবে? জোহান যখন আরও ব্যস্ত থাকবে, তখন? না, ধৈর্যশীল হতে হবে। খুব ধৈর্যশীল!
ট্রেন জার্নি মোটামুটি ভালোই কাটলো। রেল স্টেশনে মিতুলকে নিতে নাবিল এসেছে। মিতুল ভাইয়ের কাছে এসে প্রথমেই জিজ্ঞেস করলো,
“ভাইয়া, বাড়িতে কী হয়েছে?”
“কী হবে আবার বাড়িতে?”
“কিছু হয়নি?”
“কিছু হয়েছে কি না সেটা বাড়িতে গিয়েই দেখিস।”
গাড়িতে করে বাড়ি পৌঁছতে বেশি সময় লাগলো না। বাড়ি এসে মিতুল দেখলো সব শান্ত, ঠিকঠাক। এমন কিছু ঘটেনি যে ওর রাজশাহী থেকে হুট করে ঢাকা চলে আসতে হবে। যখন কিছু ঘটেইনি তখন ওকে এভাবে বাড়ি আসতে বললো কেন মা?
মিতুল একটু ভাবতেই বুঝতে পারলো। ওর মা উপরে উপরে কঠিন থাকলে কী হবে, আসলে মায়ের মনটা হলো তুলোর মতো। খুব নরম। মা ওকে অনেক বেশি ভালোবাসে। দেখতে ইচ্ছা করছিল বলে ওকে এভাবে বাড়িতে আনলো। মিতুল আদুরে কণ্ঠে ডেকে উঠলো,
“মা!”
মিতুলের ডাক শুনে কিচেনের দরজায় চাইলেন মাহিরা। একগাল হেসে বললেন,
“এসে গেছো তুমি?”
চুলোর আঁচটা কমিয়ে মাহিরা এগিয়ে এলেন মিতুলের দিকে। বললেন,
“ফ্রেশ হয়ে এসো তাড়াতাড়ি। ভাত খাবে।”
মিতুল ফ্রেশ হতে চলে এলো রুমে। ওয়ার্ডোবের ভিতর থেকে গাঢ় গোলাপি রঙের একটা থ্রি পিস বের করলো। এই থ্রি পিসটা ভীষণ অপছন্দ ওর। গত বছর দার্জিলিং ঘুরতে গিয়েছিল ফ্যামিলিসহ। তখন বড়ো ভাই দিয়েছিল এটা। গাঢ় গোলাপি পছন্দ নয় ওর। ব্রো জানে সেটা। তারপরও এই গাঢ় গোলাপি রঙের থ্রি পিস দিয়েছে। মিতুল এটা এর আগে তিন চার বার পরেছে। পরতো না, কিন্তু থ্রি পিসটা দেখতে অনেক সুন্দর। তাই না পরেও পারে না। আজকেও হঠাৎ এই থ্রি পিসটা পরতে ইচ্ছা করলো।
মিতুল থ্রি পিস নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে গেল। শাওয়ার নিতে আধ ঘণ্টা সময় লাগলো। চুলগুলো শুকিয়ে নিয়ে তারপর বের হলো রুম থেকে। লিভিং রুমে চলে এলো। সোফার উপর বসেই জোহানকে কল দিলো। জোহান কেটে দিলো কল। একটু পর ম্যাসেজ পাঠালো,
‘আমি বিজি আছি। পরে কল দেবো।’
ম্যাসেজটা দেখে মিতুলের সারা শরীর জ্বলে গেল রাগে। পাঁচদিন ধরে এই একই ম্যাসেজ দেখছে শুধু! পরে কল দেবো! পরেটা হবে কখন? পরে কল দেবে বলে তো আর কোনো হদিস থাকে না। পাঁচ দিন হয়ে গেছে এখনও তার ব্যস্ততা শেষ হচ্ছে না। আদৌ কি ব্যস্ত? না কি ওকে এড়িয়ে চলার ধান্দা? জোহান কি সত্যি সত্যি এভয়ড করছে ওকে?
মিতুল রাগে টিভি অন করলো। প্রথমেই টিভিতে ভেসে উঠলো সিরিয়ালের দৃশ্য। মিতুলের মেজাজ আরও খারাপ হলো। একের পর এক চ্যানেল পাল্টিয়ে অবশেষে বক্সিংএ এসে থামলো। বক্সিং দেখলেই মনটা শান্ত হবে।
মাহিরা কিচেন থেকে ডাকলো,
“মিতুল খেতে এসো।”
মায়ের ডাক শুনে মনটা একটু নরম হলো। বললো,
“আমি খাবো না। খেতে ইচ্ছা করছে না।”
মিতুলের কথা শুনে মাহিরা কিচেন থেকে লিভিং রুমে এলেন।
“খাবে না মানে? টিভি অফ করে এখনই খেতে এসো।”
মাহিরার কড়া গলা।
মিতুল একটু ইতস্তত করে বললো,
“খেতে পারি। যদি তুমি খাইয়ে দাও।”
মাহিরার কণ্ঠ একেবারে ধীর, শান্ত হয়ে গেল।
“ঠিক আছে, ডাইনিংএ এসো। আমিই খাইয়ে দেবো।”
“উহু, ডাইনিংএ না। আমি খুব ক্লান্ত। এখান থেকে উঠে যে কিচেনে যাব সেই শক্তি নেই। তুমি ভাত নিয়ে এখানে এসো।”
মাহিরা বুঝলেন মিতুলকে বোঝানো যাবে না। তিনি ভাত নিয়ে লিভিং রুমে এলেন।
মিতুল মায়ের হাতে খেতে খেতে টিভি দেখতে লাগলো। বক্সিং রেখে এখন হলিউড এ্যাকশন মুভি দেখছে।
নাবিল নিজের রুম থেকে বের হয়ে মোবাইল টিপতে টিপতে মিতুলের পাশে এসে বসলো। মোবাইলে দৃষ্টি রেখেই বললো,
“বড়ো হয়ে গেছিস এখনও মায়ের হাতে খাস, লজ্জা করে না?”
মিতুল পাশ ফিরে ভাইয়ের দিকে তাকালো। বললো,
“আমি আমার মায়ের হাতে খাচ্ছি, অন্য মায়ের হাতে তো না। লজ্জা করবে কেন? আর বড়ো হওয়া এবং লজ্জার কথাই যদি ওঠে, তাহলে তো তোমার এবং ব্রোর মাঝে লজ্জার ছিটে ফোঁটাও পাওয়া যাবে না। আমার থেকে বড়ো হয়ে এখনও তোমরা মায়ের হাতে খাও। তোমাদের লজ্জা নেই?”
মিতুলের কথায় নাবিল জ্বলে উঠলো,
“কখন খাই আমরা মায়ের হাতে? মাসের ভিতর বেশি হলে পাঁচ কি ছয় বার খাই। এটা আর এমন কী?”
“আর আমি? আমি তো দেখা যায় দুই মাসে মাত্র একবার খাওয়ার সুযোগ পাই। আমি কি তোমাদের মতো এখানে থাকি?”
“আমরা মাসের ভিতর যে কয় বার খাই মায়ের হাতে, তা তো তুই রাজশাহী থেকে এসে দুই তিন দিনেই খেয়ে ফেলিস। তার কী হবে? হিসেব করে দেখ, মায়ের হাতে আমাদের থেকে বেশি তুই-ই খাস।”
মাহিরা এবার মুখ খুললেন,
“আহ্, থাম তোরা। নাবিল তুই যা এখান থেকে।”
“কোথায় যাব? যাওয়ার কোনো জায়গা নেই।”
“যাওয়ার জায়গা না থাকলে চুপচাপ বসে থাক।”
মাহিরা মিতুলের মুখে আরেক লোকমা ভাত তুলে দিলেন। তারপর জিজ্ঞেস করলেন,
“মিলান ফিরবে কখন?”
নাবিল বললো,
“পথে, আসতেছে।”
____________
মিতুল মাগরিবের নামাজ শেষে একটা বই নিয়ে বসলো। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘দত্তা’ উপন্যাস। উপন্যাসটা আগে দুই বার পড়েছে। না পড়া উপন্যাস অনেকগুলো জমা হয়ে আছে, তবে ওর এই মুহূর্তে এই পড়া উপন্যাসই পড়তে ইচ্ছা করলো। দুই পাতা পড়া হলেই বড়ো ভাই এসে রুমে ঢুকলো। একটা চকলেট বক্স, জুস এবং আইসক্রিম বিছানার উপর রেখে বললো,
“আসার পথে তোর জন্য নিয়ে এলাম। তোর প্রিয় চকলেট।”
মিতুল ভাইয়ের থেকে এসব পেয়ে খুশি হলো। ধন্যবাদ জানালো ভাইকে। তারপর জিজ্ঞেস করলো,
“আব্বু তোমাকে সাভারে পাঠিয়েছিল কেন?”
“আর বলিস না, কোন এক লোককে একটা চেক দিতে পাঠিয়েছে আমায়।”
“চেক দিয়েছো?”
“হ্যাঁ।”
মিলান আর বেশি কিছু না বলে চলে গেল।
মিতুল চকলেট খেতে খেতে বই পড়তে লাগলো। ঠিক পড়ছে না, দেখছে। মন এখন বইয়ের দিকে নেই। মন পড়ে আছে জোহানের দিকে। কতক্ষণ হয়ে গেল, জোহান কল দেবে বলে আর কোনো খবর নেই। না দিয়েছে কল, না দিয়েছে একটা ম্যাসেজ। জোহান সত্যি সত্যিই এভয়ড করছে ওকে। বেশ বুঝতে পারছে ও। মিতুলের কান্না পাচ্ছে। চোখ থেকে এক ফোঁটা পানি বের হতেই মুছে নিলো সেটা। গড়িয়ে পড়তে দিলো না। বুক ব্যথায় ছেয়ে গেল। নিজের সাংগতিক মনে একটা প্রশ্ন করে উঠলো,
“শেষ পর্যন্ত আমিও কি ঠকে গেলাম ভালোবেসে?”
কেটে গেল অনেকটা সময়। মিতুলের মনে হলো ও একটু বেশি বেশি ভাবছে। ওর এসব ভাবনা হচ্ছে ভিত্তিহীন। কোনো মানে নেই। জোহান কখনোই এমন করতে পারে না। জোহানকে ভালোবেসে ঠকে যাওয়ার তো কোনো প্রশ্নই ওঠে না। কিন্তু জোহান এমন কেন করছে? কথা বলছে না কেন ওর সাথে?
মিতুলের পাশে থাকা মোবাইলটা ম্যাসেজ এসেছে জানান দিলো। মিতুল দ্রুত তুলে নিলো মোবাইলটা। জোহানের ম্যাসেজ। কী লিখেছে? আবারও ব্যস্ত আছে সেটাই লিখলো না কি? সিন করলো ম্যাসেজ।
‘লিভিং রুমে এসো।’
ম্যাসেজটা দেখে মিতুলের ভ্রু কুঞ্চিত হলো। কী লিখেছে জোহান এটা? লিভিং রুম মানে? লিভিং রুম মানে কী? টাইপিং মিসটেক করেছে? মিতুলের মস্তিস্ক হঠাৎ সচকিত হয়ে উঠলো। মন বলে উঠলো, না, কোনো টাইপিং মিসটেক হয়নি। যে মিসটেক হয়েছে তা হলো, একজনের ম্যাসেজ ভুল করে আরেক জনের কাছে চলে এসেছে। কিন্তু কার ম্যাসেজ ভুল করে ওর কাছে চলে এলো? জোহান কাকে লিখেছে এই ম্যাসেজ?
মিতুলের মাথায় হঠাৎ যে শব্দটি উদয় হলো সেটি হলো, ‘মেয়ে’।
মিতুল বিস্ময়ে বাকরুদ্ধ হয়ে গেল। জোহান এমনও করতে পারে? কী করে অন্য একটা মেয়েকে লিভিং রুমে ডাকলো? কোন জায়গার লিভিং রুম এটা? বাড়ি না কি টাইম হাউজ?
“ওহ শিট!” দিশেহারা মিতুলের মুখ থেকে শব্দ দুটি বেরিয়ে গেল অজান্তেই।
দ্রুত কল দিলো জোহানের কাছে।
জোহান কল রিসিভ করলো না, উল্টো কেটে দিলো। সাথে সাথে মিতুল আবারও কল দিলো। এবারও কেটে দিলো জোহান।
মিতুলের শরীর থেকে ঘাম ছুটে গেল। নিজেকে খুব অসহায় লাগছে এখন। মিতুল দ্রুত ম্যাসেজ পাঠানোর জন্য টাইপিং করতে লাগলো। টাইপিংও হতে লাগলো ভুল। শেষমেশ কোনো রকম ঠিক করে পাঠালো।
‘লিভিং রুম মানে কী? লিভিং রুম দিয়ে কী বোঝাতে চাইছো তুমি?’
ম্যাসেজ সিন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই জোহান উত্তর পাঠালো,
‘তোমাদের লিভিং রুমের কথা বলছি তুলতুল। বেড রুম থেকে বের হয়ে লিভিং রুমে এসো দ্রুত।’
মিতুল ‘তুলতুল’ লেখাটা দেখে থমকে গেল। জোহান কি এর আগের ম্যাসেজটা ওকেই পাঠিয়েছে? মিতুল একটু শান্ত হলো। কিন্তু চিন্তা গেল না। লিভিং রুম দ্বারা কী বোঝাতে চাইছে জোহান? হঠাৎ করে লিভিং রুমের কথা এলো কোত্থেকে? ওর খবর না নিয়ে লিভিং রুম নিয়ে পড়লো কেন? কী আছে লিভিং রুমে?
মিতুল ম্যাসেজ পাঠালো,
‘কী লিভিং রুম, লিভিং রুম করছো? কোন লিভিং রুম?’
‘তোমাদের বাসার লিভিং রুম। এসো তাড়াতাড়ি।’
মিতুল জোহানের ম্যাসেজের আগা-মাথা কিছু বুঝতে পারছে না। জোহানের কি মাথা খারাপ হয়ে গেল? কী আছে লিভিং রুমে? এখন কি ভিডিয়ো কলে লিভিং রুম ঘুরিয়ে দেখাতে বলবে? ও বের হলো রুম থেকে।
লিভিং রুমের কাছাকাছি আসতেই থেমে গেল। লিভিং রুম এখনও চোখের সামনে আসেনি ওর, তবে লিভিং রুমে চলা কথাবার্তা কানে আসছে। ওর মায়ের কণ্ঠ এবং অন্য একটি মহিলা কণ্ঠ শুনতে পাচ্ছে। এই মহিলা কণ্ঠটি বেশ চেনা চেনা ঠেকছে। শুনেছে আগে। কিন্তু কোথায়?
মিতুল আর কয়েক পা এগিয়ে লিভিং রুমে উঁকি দিলো। চক্ষু দাঁড়িয়ে গেল ওর। অসম্ভব!
(চলবে)