#চেরি_ব্লসমের_সাথে_এক_সন্ধ্যা,পর্ব: ৫৩
#লেখা: ইফরাত মিলি
____________
মিতুল চোখ ফিরিয়ে আনলো লিভিং রুম থেকে। মাথার ভিতরটা ভনভন করছে। জোহান কীভাবে এখন ওদের বাসায় থাকতে পারে? এটা কি চোখের ভ্রম? না কি জেগে জেগে স্বপ্ন?
মিতুল আবারও একটু উঁকি দিলো। লিভিং রুমে বসে থাকা জোহানের পাশে চোখ পড়তে ওর বিস্ময়ের ঘোর আরও বেড়ে গেল। জোহানের পাশেই রেশমী আন্টি, আর রেশমী আন্টির পাশে জায়িন। বিস্ময়ে মিতুলের মুখ হা হয়ে গেল। কিছুতেই না! জোহানরা কী করে বাংলাদেশ? এটা কি আসলেই চোখের ভ্রম? একসাথে এতজনকে দেখা চোখের ভ্রম হয় কী করে? না না এটা কিছুতেই চোখের ভ্রম হতে পারে না। যা দেখছে সব বাস্তব।
মিতুলের পাগল পাগল লাগছে। দিশা না পেয়ে রুমের দিকে দৌঁড়ে এলো। রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়ালো। মন আনন্দ, উদ্দীপনার জোয়ারে ভেসে যাচ্ছে। জোহানরা সত্যিই বাংলাদেশ? সত্যি সত্যিই ওদের ঘরে বসে আছে? কিন্তু কী করে? জোহান তো কিছু বলেনি ওকে। জোহান এমন একটা খবর না জানিয়ে কীভাবে থাকতে পারলো? এত ধৈর্যশীল কবে হলো জোহান? আর বাড়ির মানুষজনও তো কিছু বললো না। এত বড়ো একটা খবর ওকে না জানিয়ে পারলো কী করে সবাই? মিতুল ড্রেসিং টেবিলের দিকে ছুটে এলো। চেহারা দেখে চরম বিরক্তি লাগলো ওর। জার্নির ফলে চেহারার একটু অবনতি হয়েছে। মাথার চুলের দিকে নজর পড়তে দেখলো চুলগুলো এলোমেলো। মিতুল দ্রুত চুল আঁচড়ে নিলো। একটা সাদা পাথরের চিকচিকে ক্লিপ বসালো চুলে। মেকআপ করবে ঠিক করলো। মুখে প্রাইমার লাগাতে গিয়েও থমকে দাঁড়ালো। মেকআপ করার সময় এখন নেই ওর কাছে। ইশ! জোহানরা আসবে সেটা ওকে আগে জানালে কী ক্ষতি হতো? সেজেগুজে সুন্দর করে বসে থাকতে পারতো ও। এখন এই তাড়াহুড়োর ভিতর কী করবে?
হঠাৎ পরনের থ্রি পিসের দিকে খেয়াল হলো। এই উটকো রংটা একেবারে বিচ্ছিরি দেখাচ্ছে গায়ে। এত ড্রেস থাকতে আজকে কেন এই উটকো রঙের ড্রেসটাই পরতে ইচ্ছা করলো ওর? এটা পরে একদমই জোহানদের সামনে যাওয়া যাবে না। এখনই চেঞ্জ করতে হবে।
মিতুল ওয়ার্ডোবের ভিতর খোঁজাখুঁজি করতে লাগলো। খুব সুন্দর একটা ড্রেস দরকার।
মিতুল তন্নতন্ন করে খুঁজতে লাগলো। কিন্তু কোনো সুন্দর ড্রেস চোখে ধরা দিচ্ছে না। ব্যাপারটা কী? ওর কি কোনো সুন্দর ড্রেস নেই? ওর সেই সাদা ড্রেসটা কোথায়? মিতুল ক্লোজেটের দিকে ছুটে এলো। ক্লোজেট খুললেই মাহিরা প্রবেশ করলেন রুমে। মিতুল দরজা লক ছাড়া এমনি চেপে বন্ধ করে রেখেছিল।
মাহিরা মুখে হাসি রেখে মিতুলকে ডাকলেন,
“মিতুল, লিভিং রুমে এসো তাড়াতাড়ি। দেখে যাও কারা এসেছে।”
মিতুল ক্লোজেটের ভিতর ঢুকে সাদা ড্রেসটার সন্ধান অব্যাহত রেখে বললো,
“কারা এসেছে মা?”
জেনেও না জানার ভাণ ধরলো মিতুল।
“এসেই দেখো না কারা।”
“আমি আসছি, তুমি যাও।” মিতুল হাত এবং চোখ অনুসন্ধানে ব্যস্ত রেখেই বললো।
“ঠিক আছে তাড়াতাড়ি এসো।”
মাহিরা চলে গেলেন।
মিতুল খুঁজতে লাগলো। ড্রেসটা তো বাড়িতেই রেখে গিয়েছিল। মনে আছে ওর। সময়ের কালে কোনো জিনিসই ঠিকঠাক ভাবে পায় না ও। এমনি সময় হলে সেই ড্রেস সবার আগে চোখের সামনে পড়তো।
অনেকক্ষণ ধরে বসে থাকার পরও মিতুলকে দেখা গেল না। জোহান আবারও ম্যাসেজ পাঠালো।
‘কী হলো? আসছো না কেন তুমি?’
এবারের ম্যাসেজ সিনই হলো না।
মাহিরা এবং বাসার মেইড নাস্তা নিয়ে উপস্থিত হলেন লিভিং রুমে।
জোহান আর ধৈর্য ধরতে পারলো না। বসা থেকে দাঁড়িয়ে বললো,
“হুইস ইজ মিতুল’স রুম?”
জোহান আসার পরই মিলানের কাছ থেকে জেনে নিয়েছিল মিতুল রুমে আছে।
মাহিরা একটু অসম্মান বোধ করলেন। তার মেয়েটা বরাবর এক রকমই রয়ে গেল। এত বোঝানোর পরও কোনো কাজে সিরিয়াস হলো না। আসছি বলে আর কোনো খবর নেই।
মাহিরা মিলানকে বললেন,
“মিলান, মিতুলকে ডেকে নিয়ে আয়। ও এখনও জানে না ব্যাপারটা।”
জোহান বাংলা বুঝলো না ঠিকঠাক। তবে কয়েকটা শব্দ বুঝেই আন্দাজ করতে পারলো সবটা। বললো,
“আমি যাচ্ছি।”
জোহান মিলানের দিকে তাকিয়ে বললো,
“ব্রো, প্লিজ শো মি মিতুল’স রুম।”
জোহানের এই কথার পর আর কেউ কোনো কথা বলতে পারলো না।
মিলান বললো,
“কাম উইথ মি।”
মিলান জোহানকে মিতুলের রুম দেখিয়ে দিলো। কর্ণারের রুমটা মিতুলের। জোহান মিলানকে ‘থ্যাঙ্ক ইউ’ জানালো।
মিলান আর রুমে ঢুকলো না। চলে এলো।
জোহান রুমে প্রবেশ করতেই আয়নার সামনে দাঁড়ানো দেখতে পেল মিতুলকে। পরনে হোয়াইট কুর্তি এবং ডার্ক ব্লু প্লাজো, ওড়না। জোহান রুমে প্রবেশ করেছে টের পায়নি মিতুল। জোহান টের পাওয়ানোর জন্য পিছন থেকে বলে উঠলো,
“হলো তোমার সাজগোজ?”
জোহানের কণ্ঠ কানে আসতেই মিতুলের কান খাড়া হয়ে উঠলো। মুখে আর ফেস পাউডার দেওয়া হলো না। কতদিন দিন পর এই গলা এত কাছ থেকে শুনছে! ফোনের এ প্রান্তে বসে ও প্রান্তের কথা শুনেছে এতদিন। আর আজ কাছাকাছি। একই জায়গায়। মিতুলের মন মিষ্টি শুভ্র অনুভূতিতে হারালো।
জোহান দরজার কাছ থেকে সরে মিতুলের দিকে এগিয়ে আসতে লাগলো। মিতুল আয়নায় জোহানের মুখ দেখতে পাচ্ছে। কত কাছে এখন এই মুখ। ইচ্ছা হলেই ছুঁয়ে দেখা যাবে। হাত বুলানো যাবে ওই প্রিয় বাদামি চুলগুলোতে।
জোহান মিতুলের কাছে এসে মিতুলের এক হাত ধরে নিজের দিকে ফেরালো। মিতুলের হৃদয় দুলে উঠলো। জোহানের চোখে চোখ পড়তেই সকল ভাষা হারিয়ে গেল ওর। এই বাদামি চোখ জোড়াও কত আপন ওর!
জোহান মিতুলের দিক থেকে চোখ সরিয়ে মিতুলের হাতে দৃষ্টি রাখলো। মিতুলের বাম হাতটা তুলে নিলো নিজের হাতে। মিতুলের দেওয়া কলম দিয়ে মিতুলের হাতের তালুতে ছোটো করে নিজের নাম লিখলো। আর লিখলো, ‘You are always mine!’
তারপর বললো,
“ইট’স মাই ফার্স্ট অটোগ্রাফ! বলেছিলাম ফার্স্ট অটোগ্রাফ তোমাকেই দেবো। কথা রেখেছি আমি।”
মিতুল নিজের বিমোহিত চোখ জোড়া তুলে তাকালো।
জোহান একটু হাসলো। কলমটা পকেটে ঢুকিয়ে রেখে জিজ্ঞেস করলো,
“কেমন সারপ্রাইজ দিলাম?”
মিতুল কিছু বলতে পারলো না। শুধু খুশিতে একটুখানি হাসলো। এমন খুশি মিশ্রিত হাসি হাসেনি বহু দিন হয়ে গেছে। সব খুশি যেন আজ ওর ঘরে এসে ভিড় জমিয়েছে।
কয়েক মিনিট নিশ্চুপ কেটে গেল। মিতুল কিছু বলতে পারলো না। বলতে পারলো না জোহানও কিছু। শুধু নীরবে তাকিয়ে থাকাই হলো।
জোহানকে দেখার এক বুক তৃষ্ণা মিতুলের। বহুদিন পর সামনা সামনি দেখছে জোহানকে। জোহানকে দেখার তৃষ্ণার্ত মন বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। হঠাৎই তা আতঙ্কে রূপ নিলো। মিতুল ভীত কণ্ঠে বলে উঠলো,
“তুমি আমার রুমে এসেছো কেন? কেউ দেখে ফেললে কী হবে? এটা কি তোমাদের বাড়ি? যে মানুষের কোনো খোঁজ খবর থাকে না? দ্রুত চলে যাও এখান থেকে।”
“এটা কেমন আচরণ তুলতুল? এতদিন পর আমার সাথে তোমার দেখা হলো, কোথায় ভাবলাম আনন্দে আমাকে জড়িয়ে ধরবে, তা না, উল্টো আমাকে তাড়িয়ে দিচ্ছ! এটা কিন্তু মোটেই ঠিক নয়।”
“এটা মজা নয় জোহান। তোমাকে এখানে দেখলে সবাই সন্দেহ করবে।”
জোহান হেসে ফেললো।
“সন্দেহ করার কী দরকার? কনফার্মই হয়ে যাক সবাই। কোনো প্রবলেম নেই।”
“আমার আছে।”
“তুমি এখনও বড্ড বোকা আছো তো তুলতুল। সবকিছু নিয়ে এখনও বেশি ভাবো। আমি সবাইকে জানিয়ে, সবার সামনে থেকেই তো তোমার রুমে এলাম। তোমার ভাই তোমার রুম দেখিয়ে দিলো। কেউ ব্যাপারটা অন্য চোখে দেখেনি, অথচ তুমি…”
মিতুল বলার মতো কিছু খুঁজে পেল না। পাবেই বা কী করে, আছে কিছু পাওয়ার? আসলেই ও একটু বেশিই ভাবে। ঠিক কিছু ভাবে না, উল্টোটাই বেশি ভাবে সব সময়। জোহানের বাড়ি গিয়ে তিন মাস থেকে এসেছে, জোহান ওর পরিচিত একটা মানুষ, ওর সাথে দেখা করতে রুমে তো আসতেই পারে। এখানে সন্দেহ করার তো তেমন কিছু নেই। আর কেউ যদি সন্দেহ করেও থাকে, তাহলেও তো জোহানকে এভাবে রুম থেকে বেরিয়ে যেতে বলতে পারে না ও। দীর্ঘ দশ মাস পর দেখা হলো দুজনের।
মিতুলকে নীরব দেখে জোহান দুষ্টুমির সুরে বললো,
“হেই তুলতুল, একটা হাগ করবে না কি?”
মিতুল এই কথা শুনে একটু কঠিন থাকার চেষ্টা করলো। কিন্তু পারলো না। মুখ ফুঁটে হাসি বেরিয়ে গেল।
জোহানও হাসলো।
মিতুল বললো,
“বাংলাদেশ এসেছো আগে জানাওনি কেন সেটা?”
“জানালে কি সারপ্রাইজ হতো?”
মিতুলের মনে হলো ওকে ‘বলদ’ উপাধি দিলে মন্দ হবে না। জোহান ওকে এই সারপ্রাইজ দেবে বলেছিল। আর ও কি না কীসব…ধুর!
সারপ্রাইজ পেল সেটা না হয় ঠিক আছে। কিন্তু এই সারপ্রাইজের ব্যবস্থা কি সবাই মিলে করেছে? তা না হলে ঘরের কেউ জানায়নি ওকে, রেশমী আন্টিও বলেননি কিছু। দুই দিন আগেই রেশমী আন্টির সাথে কথা হয়েছে, তখন এ ব্যাপারে কিছুই বলেননি তিনি। সবাই মিলে ওর কাছে গোপন রেখেছে বাংলাদেশে আসার ব্যাপারটা। আর ওর বাড়িতে আসার জন্য মায়ের এত জরুরি তলবের ব্যাপারটাও বুঝতে পেরেছে এখন। রেশমী আন্টিরা আসবেন সে জন্যই ওকে এভাবে বাড়িতে এনেছে। মিতুল জিজ্ঞেস করলো,
“কবে এসেছো বাংলাদেশ?”
“চারদিন হলো।”
মিতুল অবাক হলো।
“চারদিন হলো এসেছো? অথচ আমাকে জানাওনি?”
মিতুল দ্রুত বেগে পা বাড়ালো লিভিং রুমে যাওয়ার জন্য। জোহানও পিছন পিছন যেতে লাগলো।
লিভিং রুমে এসে রেশমী আন্টি এবং জায়িনকে সালাম দিলো মিতুল।
রেশমী আন্টি সালামের জবাব দিয়ে বললেন,
“আরে এদিকে এসো। কতদিন পর আবার তোমাকে দেখলাম বলো তো।”
মিতুল রেশমী আন্টির পাশে গিয়ে বসলো। রেশমী আন্টি মিতুলের কপালে স্নেহের চুম্বন এঁকে দিলেন।
মিতুল বললো,
“আঙ্কল আসেননি বাংলাদেশ?”
রেশমী উত্তর দিলেন,
“না ও আসতে পারেনি। কাজের জন্য আটকে গেল।”
“ও…” মিতুল ছোটো করে উচ্চারণ করলো।
জায়িন চুপচাপই বসে ছিল। হঠাৎ করে বললো,
“আগের থেকে তুমি অনেক সুন্দর হয়ে গেছো মিতুল।”
জায়িনের কথা কানে আসতে মিতুল চমকে উঠলো। কী বললো জায়িন? মা, ভাইয়েরা সবাই আছে এখানে। কী ভাবলেন তারা? মিতুল লিভিং রুমে উপস্থিত সবার দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিলো। রেশমী আন্টি এবং মাকে মুখ টিপে হাসতে দেখা গেল। বাকিরা স্বাভাবিক ভাবেই হেসে ফেললো। জোহান ভাইয়ের সাথে তাল মিলিয়ে বললো,
“লম্বাও হয়েছে একটু।”
মিতুল অপমানে শেষ। দুই ভাই মিলে কি ওকে আবারও অপমান করতে উঠে পড়ে লাগলো না কি? সবার সামনে এভাবে ছোটো করতে পারলো কী করে? জায়িন পারলেও, জোহান পারলো কী করে? আবারও সেই খাটো নিয়ে মজা করলো জোহান? কোথায় লম্বা হয়ে গেছে ও? আছে তো সেই আগের মতোই। আর সুন্দর! কোথায় আগের থেকে সুন্দর হয়েছে? সুন্দর তো হয়ইনি বরং আরও কমেছে সৌন্দর্য। জার্নির ফলে চেহারার অবনতি হয়েছে। দুই ভাই মিলে এরকম অপমান না করলে কী পারতো না? সবার সামনে এটা কী করলো? মিতুলের মুডই নষ্ট হয়ে গেছে।
সবার কথাবার্তা চলতে লাগলো।
মিতুল আর নিজের আনন্দঘন মুডটি ফিরে পেল না। কথাবার্তা চললেও ও সেই কথাবার্তায় সামিল হলো না। চুপচাপ বসে রইল। খতিয়ে দেখতে লাগলো সবাইকে। সবাই হাসছে, কথা বলছে। অথচ এই দুই ভাই ওর মুখ থেকে হাসি, কথা কেড়ে নিয়েছে। ওর হাসি কেড়ে নিয়ে এখন নিজেরা হাসছে। মিতুলের বিরক্ত লাগছে। ইচ্ছা করছে রুমে চলে যায়। কিন্তু এখানে এত মানুষ রেখে রুমে চলে গেলে সেটা কি ভালো দেখায়? মিতুল ধৈর্য ধরে বসে রইল।
সবার কথায় কথায় এক সময় শুনতে পেল, জোহান’রা না কি দুই দিন থাকবে ওদের বাড়িতে। কথাটা শুনে মিতুল পুলকিত হয়ে উঠলো। আনন্দঘন মুডটি আরও দ্বিগুণ আনন্দ নিয়ে ফিরে এলো ওর কাছে। দুই দিন থাকবে জোহানরা? মিতুল নিজের আনন্দ ভাবটি কোনো রকম চেপে রাখলো।
কাকে কোন রুমে থাকতে দেওয়া হবে তা আগে থেকেই ঠিক করা ছিল। তিন জনের জন্য আলাদা আলাদা রুমই দেওয়া হলো। এর মাঝে নাবিলের রুমটা ছেড়ে দিতে হলো জোহানের জন্য। নাবিলের জায়গা হলো মিলানের রুমে।
মিতুল মনে মনে স্বস্তি অনুভব করলো। যাক, জায়িন, জোহানকে এক রুম দেওয়া হয়নি। দুই ভাইয়ের ভিতর দূরত্ব চলছে অনেক বছর ধরে। এক রুমে, এক বেড শেয়ার করে থাকা দুজনের কাছেই কষ্টকর হতো। দুজনের কেউই মানিয়ে নিতে পারতো না। আর ওর ভাইদের? ওর ভাইদেরও হয়তো একটু সমস্যা হতে পারে একসাথে থাকতে। তবে ওটা কোনো ব্যাপার না। ওদের ভাইদের মাঝে কোনো দূরত্ব নেই, খুব মিল।
_____________
ছাদের পরিবেশটা নাতিশীতোষ্ণ। ঝিরিঝিরি বাতাস বইছে। আকাশে অর্ধপূর্ণ চাঁদ। মাঝে মাঝে আবার মেঘ এসে চাঁদটাকে ঢেকে দিচ্ছে। আবার মেঘের কবল থেকে মুক্তি পাচ্ছে চাঁদটা। জোহান আর মিতুল পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে ছাদের রেলিং ঘেঁষে। এখন ওরা দুজনই আছে ছাদে। তবে একটু পর ওর ভাইয়েরাও এসে যাবে। জায়িনকেও ডাকা হয়েছিল, কিন্তু আসলো না। অহংকারীটা হয়তো সবার সাথে সহজ হতে পারবে না। তাই আসেনি।
মিতুল আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। কতদিন পর আবার জোহান ওর পাশে। ভাবতেই ভালো লাগছে। একটু বেশিই ভালো লাগছে। মনে পড়ে যাচ্ছে কানাডায় থাকাকালীন দিনগুলোর কথা। তখন তো ও আর জোহান কতই পাশাপাশি ছিল। মাঝখান থেকে দশ মাসের দূরত্ব তৈরি হয়েছিল। কবে দুজন সব সময়ের জন্য এরকম পাশাপাশি থাকতে পারবে? ভালো লাগে না দূরত্ব। দূরত্ব মাঝে মাঝে ভিতরটাকে পুড়িয়ে মারে।
“তোমাদের বাংলাদেশের আবহাওয়াটা ভালো না। খুব গরম। ঘেমে যাচ্ছি আমি।”
পাশ থেকে হঠাৎ জোহানের কণ্ঠ কানে এলো।
মিতুল তাকালো।
“কী বলো? এই ঝিরিঝিরি বাতাস, নাতিশীতোষ্ণ পরিবেশের মাঝে তুমি ঘেমে যাচ্ছ?”
“যাচ্ছি তো। নিজেই দেখো…”
জোহান মিতুলের এক হাত নিয়ে নিজের গলায় স্পর্শ করালো।
মিতুল দেখলো জোহান সত্যিই ঘেমে যাচ্ছে। মিতুল ওর হাতটা সরিয়ে আনতে চাইলো। কিন্তু জোহান হাত ছাড়লো না। গলা থেকে সরিয়ে আনলো, কিন্তু মিতুলের হাতটা নিজের হাতের মাঝেই রাখলো। আরও ভালো করে হাতটা আঁকড়ে ধরে বললো,
“হেই মিতুল, খুব বেশি মিস করেছো আমায়?”
মিতুল জোহানের প্রশ্নের উত্তর দিতে পারলো না। ও খুবই মিস করেছে জোহানকে। কিন্তু সেটা মুখে প্রকাশ করা দায়। সব কথা মুখে বলা যায় না।
জোহানই আবার বললো,
“আমার মোটেই ভালো লাগেনি। একা একা লেগেছে সারাক্ষণ। এখন বাড়িতে থাকতে ভালো লাগে না একদম। তুমি কানাডা যাওয়ার আগে যতটা মন টিকতো বাড়িতে, কিন্তু তুমি কানাডা থেকে আসার পর আর এতটুকুও মন টিকে না। আগে অনেক সময় কাটাতাম টাইম হাউজে। কিন্তু এখন টাইম হাউজেও যেতে পারি না। ওখানে গেলে তোমার শূন্যতা বেশি অনুভব করি। তোমায় মিস করি ভীষণ”
মিতুল নীরব রইল। কিন্তু মনের অনুভূতিগুলো নীরব রইল না। অনুভূতিরা নিজেদের প্রাচুর্য খুলে বসলো। মিতুল তাকিয়ে থাকলো জোহানের মুখখানিতে।
জোহান বললো,
“এই একাকীত্ব নিয়ে আমি বেশিদিন থাকতে পারবো না। আমার খুব কষ্ট হয়। তুমি পারবে এরকম থাকতে?”
জোহানের প্রশ্নটা মিতুলের হৃদয় ছেদ করে গেল। এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবে না ও। মিতুল এখনকার এই পরিবেশটা কাটিয়ে উঠতে বললো,
“তুমি ভীষণ হার্টলেস জোহান।”
মিতুলের কথায় জোহান অবাক হলো।
“আমি এতক্ষণ এতগুলো কথা বললাম, আমার অনুভূতি জানালাম, তোমাকে ছাড়া থাকতে পারব না সেটাও বললাম, তারপরও আমি হার্টলেস?”
“হ্যাঁ, তুমি হার্টলেস। তুমি পাঁচটা দিন আমার সাথে কথা বলোনি।”
“এটা সারপ্রাইজেরই অন্তর্ভুক্ত ছিল।”
“এটা আবার কেমন সারপ্রাইজ? তুমি বাংলাদেশ এসেছো সেটা না হয় নাই জানালে, কিন্তু তাই বলে কি কথা বলতে পারতে না? জানো, কত দুশ্চিন্তায় ছিলাম আমি! চিন্তায় চিন্তায় মাথাটা এলোমেলো হয়ে যাওয়ার অবস্থা হয়েছিল। তুমি আমার মন বোঝার চেষ্টা করোনি একদম! তুমি কীভাবে পারলে এমন?”
জোহানের ঠোঁটের কোণে হাসি ফুঁটলো। বললো,
“আসলে আমার অনেকগুলো কাজিন আছে। অনেক দিন পরে সবার সাথে দেখা হলো তো। তাদের নিয়েই বিজি ছিলাম। কথা বলার সময় পাইনি তাই।”
জোহান মনে মনে মিতুলকে রাগানোর বন্দোবস্ত করছে।
মিতুল সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকালো।
“কাজিন? কী রকম কাজিন? মেয়ে কাজিন না ছেলে কাজিন?”
“মেয়ে-ছেলে উভয়ই। তবে মেয়ের সংখ্যাটাই বেশি। আমার মেয়ে কাজিনগুলো তো আমাকে চোখের আড়ালই হতে দিতে চায় না। সারাক্ষণ সাথে সাথে থাকে। এই যে তোমাদের বাসায় আসলাম, এখানেও তো আমার সাথে কয়েকজন চলে আসতে চাইছিল। অনেক বুঝিয়ে রেখে আসতে হয়েছে তাদের।”
মিতুলের প্রচুর রাগ হচ্ছে। রাগে গরম নিশ্বাস পড়ছে। এই ছিল তবে কল না দেওয়ার আসল কারণ? কতগুলো মেয়ে পেয়ে ওকে ভুলে গিয়েছিল? আর মেয়েগুলোই বা কেমন? গায়ে পড়া স্বভাবের! পৃথিবীতে কি ছেলের আকাল পড়েছে? অন্য আরেক জনের মানুষকে নিয়ে তোদের এত মাতামাতি কীসের?
মিতুল জোহানের দিকে তাকালো। দু চোখে রাগ ঝরে পড়ছে। সেই সাথে এবার কণ্ঠেও ঝরলো,
“যখন তারা আসতে চাইলো, তখন তাদের নিয়ে এলে না কেন? না না তাদের নিয়ে আসার তো কোনো দরকার নেই, তুমিই থেকে যেতে তাদের সাথে। তাদের রেখে তুমি কেন এসেছো এখানে? পুরো বাংলাদেশ চষে বেড়াতে তুমি তাদের সাথে। কেউ তো নিষেধ করেনি তোমায়। আমার সাথে পাঁচদিন কথা না বললেই বা কী, আর একমাস কথা না বললেও বা কী! তাদের সাথে সময় কাটানোটাই হলো আসল।”
মিতুল এত রেগে গেলেও জোহান রইল খুব শান্ত। কিছু সময় শান্ত চোখে চেয়ে থেকে বললো,
“তোমার রাগে ফুলো নাকটা দীর্ঘ দশ মাস দেখতে পাইনি। বিরাট একটা শূন্যতা ছিল। এখন দেখে নিলাম। রাগলে তোমায় খুব সুন্দর লাগে। তোমার রাগী মুখটা খুব প্রিয় আমার।”
জোহান আরেকটু কাছে এসে বললো,
“নাক ফুলো তুলতুল, তোমার এই রাগী মুখটি আমায় ছাড়া আর কাউকে দেখিয়ো না। তোমার এত সুন্দর মুখটি অন্য কেউ দেখুক চাই না আমি। তোমার এই রাগী মুখটি শুধু আমিই দেখবো। তুমি শুধু আমার জন্যই রাগবে। করেছো না কি আবার কারো সাথে ঝগড়া-ঝাটি, রাগারাগি? সব জমিয়ে রাখতে বলেছিলাম তো আমার জন্য। রেখেছো তো?”
মিতুল নীরবের থেকেও অধিক নীরব। এই মুহূর্তে শুধু একটা ইচ্ছাই ভিতর জুড়ে শব্দ তুলছে। বাতাসেরাও যেন সেই শব্দের সাথে সহমত পোষণ করছে। কানে কানে এসে বলছে তারা,
‘হ্যাঁ, তোমার জোহানের বুকে মুখ লুকাও তুমি। জোহানের ওই উষ্ণ বক্ষ শুধু তোমারই।’
মিতুলের এই মুহূর্তে এটাই ইচ্ছা করছে। জোহানকে জড়িয়ে ধরে ওর বুকে মুখ লুকাতে ইচ্ছা করছে। চাইলে এখনই ইচ্ছাটা পূরণ করতে পারে। কিন্তু করবে না। এই ইচ্ছাটা তুলে রাখবে। যখন এটি পূরণের সময় হবে, তখন পূরণ করবে। পূরণের সেই ক্ষণ যে এখনও আসেনি। কখন আসবে সেই ক্ষণ? অপেক্ষায় আছে ও।
(চলবে)