চেরি_ব্লসমের_সাথে_এক_সন্ধ্যা,পর্ব: ৫৪

0
701

#চেরি_ব্লসমের_সাথে_এক_সন্ধ্যা,পর্ব: ৫৪
#লেখা: ইফরাত মিলি
____________

মেহরিনের সাথে কথা হলো মিতুলের। জোহান’রা ওদের বাড়িতে এসেছে বলেছে সেটা। মেহরিন শুনে তো প্রথমে বিশ্বাসই করেনি। পরে করতে হলো। মেহরিনকে আজকেই ঢাকা আসতে বলেছিল মিতুল। কিন্তু চাইলেই তো আর রাজশাহী থেকে ঢাকা চলে আসা যায় না এক দৌঁড়ে। মেহরিন সবকিছু ঠিকঠাক করে কালকে চলে আসবে। মেহরিনের বাড়ি রাজশাহী। ওর বাবার চাকরির জন্য ঢাকা এসেছিল ফ্যামিলিসহ। যখন ক্লাস সেভেনে পড়ে তখন ঢাকা এসেছিল, আর ইন্টার পাশের পরে আবার রাজশাহী চলে গিয়েছে। মেহরিনের জন্য মিতুলও ইন্টারের পর রাজশাহীতে ভর্তি হয়েছে। মেহরিনদের বাড়ি ভার্সিটি থেকে দূরে হওয়ার জন্য মিতুল আর মেহরিন একটা ফ্ল্যাট রেখে থাকে।
মেহরিনের সাথে কথা বলা শেষে মিতুল মায়ের রুমে এলো। মা কিছু জামা কাপড় ভাঁজ করছেন। মিতুল এসেই বেডের উপর বসে পড়ে বললো,
“বাজারে কে যাবে?”

“বাজারে তো গেছে মিলান আর নাবিল।”

“চলেও গেছে ইতোমধ্য? কী কী আনতে বলেছো?”

“যা যা লাগবে সবই আনতে বলেছি।”

“দেশি মাছ আনতে বলেছো?”

“হ্যাঁ, বড়ো মাছ নিয়ে আসতে বলেছি।”

“আর দেশি ছোটো মাছ?”

মাহিরা ভাঁজ করা জামা কাপড় আলমারিতে রাখতে গিয়েছে, মেয়ের কথা শুনে সেখান থেকেই ঘাড় ঘুরিয়ে চেয়ে বললেন,
“ছোটো মাছ দিয়ে কী করবে তুমি?”

“দরকার আছে। পুঁটি, ট্যাংরা, শিং এই মাছগুলো লাগবে।”

“কেন? বড়ো মাছ রেখে এসব ছোটো মাছ কেন দরকার?”

“ওনাদের জন্য।”

মাহিরা মেয়ের কথা শুনে বিস্মিত না হয়ে পারলেন না।
“অতিথিদের তুমি পুঁটি, ট্যাংরা দিয়ে খাওয়াবে?”

“তারা এই মাছই বেশি পছন্দ করে। বিদেশে থাকে না, এসব মাছ কি আর সেখানে পায়?”

“তাই বলে পুঁটি, ট্যাংরা? এই ছোটো ছোটো মাছ কাটবে কে? এমনিতেই আজকে ব্যস্ত একটা দিন। অনেক কিছু রান্না করতে হবে। ওই ছোটো ছোটো মাছ নিয়ে পড়ে থাকার সময় আছে কারো?”

“কেন সুরভী খালা(মেইড) আছেন না? তিনি কাটবেন এই মাছ।”

“সে কি কম ব্যস্ত থাকবে? এই ছোটো মাছ নিয়ে পড়ে থাকার সময় তার নেই।”

“ঠিক আছে, যদি সবারই এই মাছ কাটতে সমস্যা থাকে, তাহলে আমি কাটবো।”

“তুমি কাটবে মাছ?” মাহিরা বিস্ময়ের দীঘল প্রান্তে।

“হ্যাঁ, আমি।”

“জীবনে যে একটা মাছ ছুঁয়ে দেখেনি, সে কাটবে মাছ? তাও আবার পুঁটি, ট্যাংরা, শিং?”

“আগে ভাইয়েরা মাছ নিয়ে আসুক, তারপর দেখো মাছ কাটতে পারি কি না। চেষ্টা করলে সব সম্ভব। এখন দ্রুত ফোন লাগাও। বলো দেশি বড়ো মাছের পাশাপাশি ছোটো মাছও নিয়ে আসতে।”

“আমি পারব না। তুমিই ফোন দিয়ে যা যা লাগবে বলো।”

মিতুল আর সময় নষ্ট করলো না। নিজের রুমে এসে ভাইদের কাছে কল দিলো। মলা, ট্যাংরা, শিং অন্যান্য যে সকল ছোটো মাছ পাবে তা নিয়ে আসতে বলেছে। ভাইয়েরা শুনে প্রথমে একটু ক্ষেপে গিয়েছিল। মলা, ট্যাংরা, শিং এসব পাওয়া কি এখন মুখের কথা? এই মাছ খুঁজতে খুঁজতে পুরো বাজার তন্নতন্ন করে ফেলবে তারা? এমনিতেই সময় স্বল্পতা। কেনাকাটা আছে অনেক। মিতুল ভাইদের মুখের উপর বলে দিয়েছে,
“দরকার হলে তাই করবে। তবুও ছোটো মাছ চাই আমার।”
বলেই ফোন কেটে দিয়েছে।

এখন একটু জোহানের খোঁজ নেওয়া দরকার। রাতে ঘুম ঠিকঠাক হয়েছে কি না কে জানে। মিতুল একবার সবাইকে যাচাই করে দেখলো। রেশমী আন্টি মায়ের রুমে আছে সম্ভবত, আর জায়িন নিজের রুমে। মিতুল লিভিং রুমের সাথে লাগানো একটা দরজায় এসে নক করলো। এই রুমেই থাকতে দেওয়া হয়েছে জোহানকে। ভিতর থেকে কারো কোনো সাড়া পাওয়া গেল না। জোহান কি এখনও ঘুমে? মিতুল আবারও নক করলো। দরজা খুললো না, সাড়াও পাওয়া গেল না। মিতুল দরজার গায়ে মৃদু ঠ্যালা দিলো। দরজা খুলে গেল। দরজা লক না করে ঘুমাচ্ছে?
ভিতরে প্রবেশ করলো মিতুল। জোহানকে দেখতে পেল বিছানায় শোয়া। চোখের পাতা বন্ধ। ঘুমাচ্ছে। সারারাত বোধহয় ঘুমাতে পারেনি। এখন একটু ঘুমাচ্ছে। মিতুল ডিস্টার্ব করলো না। চুপিচুপি আবার বেরিয়ে আসতে চাইলো। দরজার দিকে পা বাড়াতেই জোহানের গলা শোনা গেল,
“এসেই আবার চলে যাচ্ছ কেন? আমার কাছে একটু থাকলে কী সমস্যা?”

মিতুল থমকে দাঁড়ালো। পিছন ফিরে দেখলো জোহানের চোখ খোলা।
“তুমি ঘুমাচ্ছিলে না?”

জোহান শোয়া থেকে উঠে বসতে বসতে বললো,
“ঘুম আসলে তো ঘুমাবো! ঘুমাতেই পারিনি আমি।”

মিতুলের একটু দুঃখ লাগলো। আহারে, সারারাত ঘুমাতে পারেনি জোহান! রেশমী আন্টি এবং জায়িনের কী খবর? তারা ঘুমাতে পেরেছে তো?

“তোমাদের ফ্যামিলিটা কিন্তু বেশ ইন্টারেস্টিং তুলতুল।”

জোহানের কথা শুনে মিতুল চোখ তুলে তাকালো।
“ইন্টারেস্টিং কেন?”

“ইন্টারেস্টিংই তো। তোমাদের তো MN ফ্যামিলি।”

“MN ফ্যামিলি মানে?”

“বুঝলে না? মানে হলো তোমার ফ্যামিলির প্রত্যেকের নামের শুরু M, N দিয়ে। M ফর মিতুল, মিলান, মাহিরা। আর N ফর নাহিদ, নাবিল। দ্যাট’স সো আমেজিং!”
জোহান একটু থামলো। তারপর আবার বললো,
“আমাদের ফ্যামিলিতে এমন নেই। শুধু আমার এবং ব্রাদারের নামের মিল আছে। J দিয়ে শুরু।”

মিতুল কিছু বললো না। এই কথায় কী বলা উচিত সেটা তো বুঝতে পারছে না।

জোহান ফের বললো,
“বাই দ্য ওয়ে, তোমাকে একটা কথা বলা হয়নি। তোমার ড্যাডকে কিন্তু আমার খুব পছন্দ হয়েছে।”

মিতুল অবাক হলো। ওর আব্বুকে পছন্দ হয়েছে জোহানের? কীভাবে?
ওর আব্বু একটু গম্ভীর স্বভাবের। আর একটু কঠোরও। জোহান যে রকম তাতে আব্বুর সাথে জোহানকে মেলে না কোনো ভাবে। মিল না থাকলে আবার পছন্দ হয়?

মিতুল বললো,
“আমার আব্বুকে কী দেখে পছন্দ হলো তোমার? তিনি তো গম্ভীর আর কঠোর স্বভাবের।”

“সে জন্যই তো আরও বেশি পছন্দ হয়েছে। আমি এমন গম্ভীর স্বভাবের ফাদার ইন ল’ই চাইছিলাম।”

জোহানের কথা মিতুলের ভিতরকে ভীত করে দিলো। মিতুল এদিক-ওদিক সন্দ্বিগ্ন দৃষ্টি বুলালো। জোহানের কথার কোনো লাগাম নেই। এরকম কথা কী আর এমন করে বলে দেওয়া ঠিক? দেয়ালেরও যে কান আছে।

“এদিক-ওদিক কী দেখছো?” মিতুলকে এদিক-ওদিক তাকাতে দেখে বললো জোহান।

মিতুল জোহানের দিকে তাকিয়ে বললো,
“এরকম কথা ফারদার আর বলবে না। যদি কেউ শোনে তাহলে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে।”

“সেটাই তো ঘটাতে চাই আমি। বিশাল আকারে একটা কেলেঙ্কারি হোক।”

মিতুল সন্দিহান দৃষ্টিতে দেখলো জোহানকে।

“এবার একটা কেলেঙ্কারি সত্যিই ঘটাবো আমি। বিয়ে করে নিয়ে যাব তোমায়।”
বলেই এক চোখ টিপে হাসলো জোহান।

মিতুল শুধু ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে রইল।

________________

এ বাড়িতে থাকতে জায়িনের অস্বস্তির শেষ নেই। কোথাও এক দণ্ড বসে থাকতেও বিরক্ত লাগে। মমকে কত করে বলেছিল এখানে থাকবে না। মম কোনো কথা শোনেনি। থাকতে বাধ্য করলো। কিন্তু সত্যিই আর থাকা সম্ভব নয় এখানে। আজকেই দাদা বাড়ি চলে যাবে। জায়িনের দাদা বাড়ি গুলশানে।
আজকে বিকেলে সেখানে চলে যাবে সে। মম এখন কিচেনে। রান্নায় টুকিটাকি সাহায্য করছে। জায়িন এইমাত্র ডেকে এসেছে মমকে।
এখানে যে আর থাকতে পারবে না সেটা জানাতে হবে মমকে। মমকে না জানিয়ে এখান থেকে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত কিছুতেই একা নেওয়া সম্ভব নয়।

রেশমী কিচেন থেকে লিভিং রুমে এসে গেলেন অল্পতেই।
“কী ব্যপার ডেকেছো কেন?”

জায়িন কিছুটা নিচু স্বরে বললো,
“এখানে থাকা আমার পক্ষে আর সম্ভব নয় মম। অস্বস্তিতে শেষ হয়ে যাচ্ছি আমি। আজকে বিকেলেই দাদা বাড়ি চলে যেতে চাই।”

রেশমীও জায়িনের মতো গলার স্বর নিচু করে বললো,
“দাদা বাড়ি চলে যেতে চাও মানে? তোমার কি মাথা খারাপ? এরকম পাগলামি করো না। মাহিরা শুনতে পেলে কী ভাববে! দু দিন এখানে থাকবো বলেছি। এখানে থাকতে সমস্যাটা কী তোমার? জোহান তো মানিয়ে নিয়েছে, তাহলে তুমি পারছো না কেন? ওদিক তাকিয়ে দেখো জোহান কীভাবে মানিয়ে নিয়েছে। সবার সাথে কীভাবে তাল মিলিয়ে চলছে ও।”

মমের কথায় জায়িনের চোখ নাবিলের রুমের দিকে চলে গেল। যে রুমে জোহানকে থাকতে দেওয়া হয়েছে। রুমের দরজা বন্ধ। ভিতর থেকে জোহানের গানের সুর ভেসে আসছে। এবং সেই সাথে মাঝে মাঝে জোহান, মিলান এবং নাবিলের একই সাথে হাসাহাসি, কথাবার্তার শব্দ।
জায়িনের হঠাৎ রাগ হলো। কিন্তু নিজের রাগকে দমিয়ে রাখলো। মমের দিকে তাকিয়ে নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধেই বললো,
“ঠিক আছে, থাকবো দুই দিন।”

রেশমীর মুখে একটু হাসি দেখা গেল। জায়িনের মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো,
“ওহ মাই লাভলি বয়, মন খারাপ করো না। কষ্ট হলেও একটু মানিয়ে নাও।”

“বুঝতে পারছি আমি।”

রেশমী আনন্দিত বোধ করলেন। ছেলের কপালে চুমু খেয়ে আবার কিচেনে চলে গেলেন সবার মাঝে।

________________

মিতুলের মন খারাপ। জোহানকে নিজের হাতে রান্না করে পুঁটি, ট্যাংরা এবং শিং মাছ খাওয়াতে চেয়েছিল। কিন্তু ওর সেই চাওয়া আর পূরণ হলো না। বাজারে মলা, ট্যাংরা মাছ পাওয়া যায়নি। শুধু শিং মাছ আর পাবদা মাছ পাওয়া গেছে। শুধু শিং আর পাবদা মাছ খাইয়ে তো মিতুলের তুষ্টি মিটবে না। ও তো আরও অনেক মাছ খাওয়াতে চেয়েছিল জোহানকে। ট্যাংরা মাছ তো লাগতো সবার আগে। জোহানের ট্যাংরা প্রিয়।

কোনো মাছ মিতুলের কাটতে হয়নি। সুরভি খালা সব মাছ কেটেছে। অবশ্য মাছ কাটা বোধহয় ওর পক্ষে সম্ভবও হতো না। মাছ কাটা যে কী কঠিন একটা কাজ এতক্ষণ বসে বসে দেখেছে সেটা। তবে এই শিং, পাবদা রান্না করবে ও নিজ হাতে। কাউকে হাত লাগাতে দেবে না। সকল রান্না-বান্না ইতোমধ্যে শেষ। এখন কেবল শিং আর পাবদা মাছ রান্না বাকি। ও রান্না করছে। কেউ এখন নেই কিচেনে। ফ্রেশ হচ্ছে সবাই।
একটু পর জোহানকে দেখা গেল কিচেনে। হাতে আইসক্রিম। চামচ দিয়ে আইসক্রিম খাচ্ছে।
জোহান মিতুলের পিছনে দাঁড়িয়ে বললো,
“এই গরমে তুলতুল আমার জন্য রান্না করছে, কষ্ট হচ্ছে না তুলতুলের?”

“না, হচ্ছে না।”

“আমার হচ্ছে। তোমাদের কিচেনে একটা এসি রাখা উচিত ছিল। প্রত্যেক রুমে এসি আছে অথচ কিচেনে নেই।”

“কিচেনেও ছিল। এক মাস আগে নষ্ট হয়ে গেছে।”

“ভেরি ব্যাড!” জোহানের যেন এসিটার উপরই রাগ হলো।

“তোমার বিগ ব্রো দোকান থেকে আইসক্রিম এনেছে। খাবে?”
হঠাৎ করে বললো জোহান।

“না, তুমি খাও। আমার জন্য ফ্রিজে রাখা আছে।”

“তাতে কী? আমি আমার আইসক্রিম থেকে খাওয়াবো তোমায়। দেখি, তাকাও আমার দিকে।”

মিতুল ফিরলো জোহানের দিকে। জোহান মিতুলের জন্য চামচে আইসক্রিম উঠিয়ে বললো,
“হাঁ করো।”

“আমি তোমার হাতে খাবো? যদি কেউ দেখে ফেলে?”

“কে আসবে এখন আমাদের বিরক্ত করার জন্য? তোমার ভাইয়েরা? তারা তো শাওয়ার নিচ্ছে।”

মিতুল কী যেন একটু ভাবলো। তারপর বললো,
“ঠিক আছে, দাও।”

মিতুল হাঁ করলো। জোহান কেবল চামচটা মিতুলের মুখের কাছে নিয়ে এলো, এর মাঝেই কিচেনের দিকে কারো এগিয়ে আসার পদধ্বনি হলো। পদধ্বনিটা খুবই ক্ষীণ। তাও মিতুলের মস্তিষ্ক নাড়িয়ে দিলো। মিতুল চকিতে জোহানের থেকে উল্টো ঘুরে অযথাই কড়াইয়ে খুন্তি দিয়ে নাড়াচাড়া শুরু করলো।
পিছনে শুনতে পেল মায়ের গলা,
“আরে, তুমি এখানে এই গরমের ভিতরে দাঁড়িয়ে আছো কেন বাবা?”

জোহান যেহেতু বাংলা ঠিকঠাক বোঝে না তাই মাহিরাকে ইংলিশেই বলতে হলো।

জোহান মিতুলের জন্য চামচে ওঠানো আইসক্রিমের অংশটুকু নিজের মুখে পুরে নিয়ে বললো,
“আসলে কী রান্না হচ্ছিল সেটাই দেখতে এসেছিলাম।”

মাহিরা একটু হেসে বললেন,
“সব রান্না তো শেষ। শুধু এই মাছ বাকি আছে। এ মাছও এতক্ষণে রান্না করা হয়ে যেত যদি আমরা রান্না করতাম। কিন্তু এ মাছ আমাদের রান্না করতে দিলো না মিতুল। বললো নিজে করবে। কী রান্না যে করছে তা তো নিজেই দেখতে পাচ্ছ। রান্না করতে করতে বোধহয় বিকেল বানিয়ে ফেলবে মেয়েটা।”
মাহিরা আরেকটু হাসলেন।
জোহানও হাসলো। তবে মনটা একটু খারাপ।
একবার মিতুলের দিকে তাকালো। মিতুল যে সেই ওদিক ঘুরে রান্নায় মন দিয়ে খুন্তি নাড়াচাড়া শুরু করেছে, আর পিছন ফেরেনি। খুন্তি দিয়ে সেই থেকে কী নাড়াচাড়া করছে কে জানে। জোহান মাহিরার দিকে তাকিয়ে বললো,
“ঠিক আছে, আমি যাচ্ছি। শাওয়ার নেওয়া হয়নি এখনও আমার।”
জোহান চলে গেল।

মিতুলের হাত থামলো এবার। মনে মনে শুকরিয়া আদায় করছে। ভয়ে শেষ ও। মা যদি কিছু দেখে ফেলতো তাহলে কী হতো?

“তোমার রান্না কতদূর?”

মায়ের প্রশ্নে মিতুল একটু হকচকিয়ে গেল।
“হ্যাঁ, এই তো হয়ে গেছে।” কথাটা বলতে একটু থতমত খেতে হলো।

______________

বিকেলে সবাই মিলে ধানমন্ডি লেক ঘুরতে গিয়েছিল। সবাই বলতে মিতুল, ওর ভাইয়েরা, জায়িন, জোহান এবং মিতুলদের নিচ তলার ভাড়াটিয়া দুই ভাই-বোন।
জায়িন প্রথমে যাবে না বলেছিল। কিন্তু পরে আবার রাজি হয়। সন্ধ্যার একটু আগে ওরা বাড়ি ফেরে। মিতুলের এইটুকু যেতেই আজকে খুব ক্লান্ত লাগলো। অন্য কারো ভিতর এই ক্লান্তিটা লক্ষ করেনি। সবাই বেশ চঞ্চলাই ছিল। অথচ ওর ক্লান্ত লাগছে। মিতুলের ধারণা ও দিন দিন আলসে হয়ে পড়ছে। ও চায় না ওকে এই আলসেমিতে ধরুক। ও একটিভ থাকতে চায়।
মাগরিবের নামাজের একটু পরই মাহিরা মিতুলকে ডাকতে এলো। লিভিং রুমে আসতে বললো দ্রুত। মা যখন এরকম করে ডাকছে তার মানে সবাই মিলে নিশ্চয়ই এখন আড্ডা দেবে লিভিং রুমে। মিতুল নিজের অগোছালো চুলগুলো সুন্দর করে আঁচড়ে নিয়ে, পরিপাটি হয়ে লিভিং রুমে এলো। যা ভেবেছিল, ঠিক তাই। সবাই আছে এখানে। মিতুলের চোখ জোহানকে দেখে নিলো একটু ভালো করে। জোহান মোবাইল ঘাটছে ওর ভাইদের পাশে বসে। ওপাশের সোফায়।
এপাশের সোফায় মা, রেশমী আন্টি এবং জায়িন। ওপাশের সোফায় একপাশে আব্বু, তারপর ভাইয়েরা এবং জোহান। সবাই এমন ভাবে বসে আছে যে জায়গার পরিমাণ খুব কম অবশিষ্ট আছে। মিতুল বুঝতে পারছে না ও কোথায় বসবে।
মিতুল একটা টুল এনে মায়ের পাশে বসলো।

খাবারের ব্যবস্থাও আছে এখানে। চা, কফি, বিস্কিট, স্যান্ডউইচ, সিঙ্গারা, পিঠা। মাহিরা মিতুলকে এক কাপ কফি এগিয়ে দিলো। মিতুল নিলো।

রেশমী চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে একটু আয়েশ করে বললেন,
“বাচ্চারা, এদিকে মনোযোগী হও।”

রেশমীর কথা শুনে সবাই তার দিকে মনস্থির করলো। জোহান বাংলা বুঝতে পারেনি। কিন্তু তাকেও মোবাইল রেখে মায়ের দিকে তাকাতে দেখা গেল। রেশমী বললেন,
“যে কারণে তোমাদের এখানে ডাকা হয়েছে…যদিও আমরা বড়োরা এই ব্যাপারটা অনেক আগে থেকেই জানি। এ নিয়ে আমাদের মাঝে কথাবার্তা হয়েছে অনেক। কিন্তু তোমাদের জানানো হয়নি…”

মিতুল কৌতূহল নিয়ে তাকিয়ে আছে রেশমী আন্টির দিকে। এটা তাহলে আড্ডা দেওয়ার আসর নয়। আড্ডার জন্য ডাকা হয়নি, ডাকা হয়েছে কোনো অজানা ব্যাপার জানানোর জন্য। কিন্তু কী সেটা? কী এমন কথা যেটা তারা জানে অথচ ওরা জানে না? মিতুলের চোখ হঠাৎ জোহানের উপর পড়লো। জোহানও হঠাৎ করে তাকালো ওর দিকে। ওকে তাকাতে দেখে নিজের ভ্রু নাড়লো জোহান।
মিতুলের হঠাৎ হাসি পেল, দ্রুত চোখ সরিয়ে ফেললো জোহানের থেকে। তারপর আবার মনোযোগ দিলো রেশমী আন্টির কথায়।

রেশমী বললেন,
“শুধু আমি একা নই, আমরা অভিভাবকরা সবাই মিলে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। সেটা হলো…”
রেশমী বলতে গিয়েও একটু থামলেন। তার মাঝে একটা আনন্দঘন উত্তেজনা। একবার উপস্থিত সবার ভাব ভঙ্গি দেখে নিয়ে বললেন,
“সেটা হলো মিতুলকে আমি আমার পুত্রবধূ করে নেবো।”

রেশমী আন্টির বলা কথাটা কয়েক বার প্রতিধ্বনিত হলো মিতুলের কানে। প্রথমে বুঝতে একটু কষ্ট হলো, কিন্তু যখন বুঝলো তখন লজ্জায় লাল হয়ে গেল একেবারে। মাথা নুইয়ে ফেললো। হায় আল্লাহ! এ কেমন পরিস্থিতি? এই জোহানটা সত্যিই…মিতুলের চাপা উত্তেজনা ভাব। লজ্জা, আনন্দ মিলেমিশে একাকার। কী করবে কিছুই বুঝতে পারছে না। জোহান কী করে বলে দিলো এটা? কী করে? উহ! সত্যিই জোহান একটা পাগল! লজ্জা শরমহীন একটা ছেলে। এত তাড়াতাড়ি এই কথাটা মমের কাছে জানিয়ে দেওয়ার কী দরকার ছিল?
মিতুলের মাথায় হঠাৎ ‘সারপ্রাইজ’ শব্দটি উদিত হলো। মাথায় ভাবনার সুতো প্যাঁচাতে লাগলো। এটাই কি তাহলে জোহানের দ্বিতীয় সারপ্রাইজ? এই সারপ্রাইজ দেওয়ার কথাই বলেছিল জোহান? ইশ! এই জোহানটাকে নিয়ে সত্যিই ও আর পারে না। এত তাড়াতাড়ি ওদের কথা রেশমী আন্টিকে জানিয়ে দিলো। মিতুলের আনন্দ, উত্তেজনায় দিশেহারা লাগছে। ইচ্ছা করছে এক ছুটে রুমে চলে যায়। এখানে বসে থাকা ওর জন্য দুষ্কর হয়ে পড়ছে। নিজের এই লজ্জা মাখা মুখ তুলে তো কিছুতেই তাকাতে পারবে না। কী করবে? মিতুল মাথা নিচু করেই বসে রইল ধৈর্য ধরে।
এর মাঝে শুনতে পেল আবারও রেশমী আন্টির কণ্ঠ,
“মিতুলকে আমি আমার জায়িনের বউ করে ঘরে তুলবো।”

মিতুলের লজ্জা মিশ্রিত আনন্দঘন অনুভূতি যেন দমকা হাওয়ার তান্ডবে সব লন্ডভন্ড হয়ে গেল! দু কান ঝাঁ ঝাঁ করে উঠলো। থমকে গেল ও। কী বলছেন রেশমী আন্টি এটা? মিতুল চকিতে চোখ তুলে তাকালো রেশমী আন্টির মুখের দিকে। রেশমী আন্টির মুখে মুচকি হাসি। সেই সাথে মা, আব্বুরও। মিতুলের মনে হলো ও কোনো এক দুঃস্বপ্নের সাগরে ভাসছে। ভাসছে না ঠিক, ও তলিয়ে যাচ্ছে সাগরের নিচে। দম বন্ধ হয়ে আসছে ওর। ভালো করে একটুখানি নিঃশ্বাস নেওয়ার জন্য বুকটা হাহাকার করছে!
মিতুল আতঙ্ক, বিস্ময়গ্রস্ত চোখ নিয়ে জোহানের দিকে তাকালো।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here