#চেরি_ব্লসমের_সাথে_এক_সন্ধ্যা,৫,৬
#লেখা: ইফরাত মিলি
#পর্ব: ০৫
_____________
মিতুল প্যাসেজওয়েতে পা রাখতেই দেখতে পেল ক্যামিলা জোহানের ঘরে ছুটছে ব্যস্তভাবে। কালকে রাতে যে ওটা জোহান ছিল একশ ভাগ নিশ্চিত মিতুল। কালকে জোহান অন্ধকারে হারিয়ে যাওয়ার পর বারান্দায় বসে ছিল ও। জোহান কখন জঙ্গল থেকে বের হয় সেটা দেখার জন্য। কিন্তু জোহান বের হয়নি। ও অপেক্ষা করতে করতে ঘুমিয়ে যায় বারান্দায়। যখন ঘুম ভাঙে তখন ভোরের আভা দেখা দেয়নি আকাশে। ও বারান্দা ছেড়ে নিজের রুমে যাওয়া দেয়, কিন্তু এক রুম পর জোহানের কক্ষের দিকে নজর পড়তে দাঁড়ায় আবার। জোহান ফিরেছে কি না প্রশ্ন উদয় হয় মনে। ও জোহানের রুমের দিকে এগিয়ে যায়। না, জোহান রুমে ছিল না। দরজা বাইরে থেকেই লক ছিল।
জোহান ওই ঘন অন্ধকার জঙ্গলে রাতে একা একা কী করতে গেল সেটা এখনও ভেবে পায় না মিতুল। কালকে রাতে গিটার বাজাতে দেখে দুঃখী ছেলে মনে হয়েছিল, কিন্তু জঙ্গলে ঢোকার পর সেই মনোভাব কেটে গিয়েছিল ওর। দুঃখী ছেলে মনে হচ্ছিল না তখন আর। অন্যকিছু মনে হচ্ছিল। কিন্তু অন্য কিছুটা ঠিক কী সেটাই ভেবে উঠতে পারছে না এখনও।
তবে এখন এই ভাবনার থেকেও বড়ো ভাবনা হলো ক্যামিলা এভাবে ছুটছে কেন জোহানের রুমে? ক্যামিলাকে অনুসরণ করে মিতুলও দ্রুত পায়ে ছুটলো জোহানের রুমে।
জোহানের রুমে পা রেখেই চোখ-মুখ কুঁচকে গেল মিতুলের। জোহান সারা রুম বমি করে মেখেছে। ওর ক্লান্ত দেহ উপুড় হয়ে পড়ে আছে ফ্লোরে। মুখ কাত হয়ে আছে, তাই ফর্সা বাচ্চা মতন মুখটির একপাশ দেখা যাচ্ছে। দু চোখ বন্ধ, মুখে কীসব বলে চলেছে বিড়বিড় করে। অস্পষ্ট, জড়ানো কণ্ঠ। একটা শব্দও বোঝা যাচ্ছে না। অবচেতন অবস্থায়ও হাতের ওয়াইন শূন্য বোতলটা শক্ত করে ধরে আছে। এক বোতল পান করলে এত বমি করার কথা নয়। রুমে শুধু একটা বোতলই দেখা যাচ্ছে। হয়তো আরও বেশি পরিমাণ পান করেছে কিন্তু বোতলগুলো এখানে নেই। জোহানকে দেখে আধমরা মনে হচ্ছে!
জোহানের রুমের অবস্থার জন্য মিতুলের শরীর ঘৃণায় রিরি করে উঠলো। হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরলো ও। বিষয়টা জায়িনের চোখ এড়ালো না। জোহানের রুমে সবাই উপস্থিত। রেশমী আন্টি, সাদাত আঙ্কল, জায়িন, বাসার দুই মেইড। ক্যামিলা অনবরত জোহানকে ডেকে যাচ্ছে, আর ওর চুলগুলোতে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। সাদাত আঙ্কল নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে আছেন। জায়িনও নিশ্চুপই দাঁড়ানো। তবে সাদাত আঙ্কলের নিশ্চুপতা একটু অন্যরকম। যেন নিশ্চুপতার থেকেও অধিক নিশ্চুপ।
রেশমী আন্টি মুখ বুজে নেই, সে একের পর এক বকা-ঝকা করেই চলেছে জোহানকে।
জোহান এখন যেই অবস্থায় আছে তাতে সেই বকা-ঝকা জোহানের মস্তিষ্কে পৌঁছাতে পারছে বলে মনে হয় না। বাসার দ্বিতীয় মেইডটি জোহানের রুম পরিষ্কার করায় ব্যস্ত। প্রথমেই জোহানের কাছের জায়গাটা পরিষ্কার করলো সে। কিন্তু পরিষ্কার করেও লাভ হলো না। জোহান সেই জায়গায় আবারও বমি করে দিলো।
মিতুল মুখ বিকৃত করে চোখ সরিয়ে নিলো অন্য দিকে।
রেশমী মিতুলের উপস্থিতি টের পেয়ে বললেন,
“মিতুল, এটা স্বাভাবিক ঘটনা। ভয় পেয়ো না। এই পরিবেশে থাকার দরকার নেই তোমার। তুমি তোমার রুমে যাও।”
মিতুল নিশ্চুপ বেরিয়ে এলো রুম থেকে। ওর পক্ষে আর ওখানে দাঁড়ানো সম্ভব ছিল না। গা গুলিয়ে উঠছিল। কাউকে বমি করতে দেখলে ওর নিজেরও বমি পায়। তবে মিতুল আরও একটা বিষয় খেয়াল করেছে। জোহানের ঠোঁটের কোণে রক্ত জমাট বেঁধে লাল হয়ে ছিল। চোখের পার্শ্ব স্থানেও ছিল লাল বর্ণের প্রতিক্রিয়া। দেখে মনে হচ্ছিল কেউ মেরেছে। কিন্তু মারলো কে?
হঠাৎ রেশমী আন্টির জোহানকে বলা একটি কথা মনে পড়লো ওর। রেশমী আন্টি বলেছিলেন,
‘নিষেধ করেছিলাম তোমাকে ওদের সাথে ঝামেলা না পাকাতে। আবার মার খেলে তুমি! আজকেও যদি ঘটনাটা পুলিশ স্টেশন পর্যন্ত যেত, তাহলে তোমাকে একেবারে মেরেই ফেলতাম!’
রেশমী আন্টি কাদের কথা বুঝিয়েছেন? জোহান কি এর আগেও মার খেয়েছে? পুলিশ স্টেশনে যাওয়ার কথা কেন বললেন? মারামারির জন্য?
মিতুল নিজের রুমে গেল না। এসব ভাবতে ভাবতে লনে চলে এলো। হাঁটতে হাঁটতে বাড়ির ছোট্ট গেটটি পেরিয়ে একেবারে বাইরে পা রাখলো। বাইরে শীতল হাওয়া বইছে। আজকে বেশ শীত পড়েছে। মিতুল সাদা ফুল হাতার গেঞ্জির উপর একটা ব্লু সোয়েটার পরেছে। মেইন শহর থেকে রেশমী আন্টিদের বাড়ি কিছুটা দূরে। এই এলাকাটা অনেক শান্ত। পরিষ্কার পিচ ঢালা রাস্তার দুই পাশেই সুন্দর সজ্জিত বাড়ি। বিদেশি বাড়িগুলো দেখতেই অন্য রকম হয়। ভালো লাগে ওর।
রেশমী আন্টিদের এক নেইবরহুডের বাড়ি থেকে একটা নীল পোরশে কার বের হতে দেখা গেল। গাড়িটা মিতুলকে অতিক্রম করে ধীর গতিতে সামনে এগিয়ে গেল। গাড়িটি চোখের আড়াল না হওয়া পর্যন্ত মিতুল তাকিয়ে রইল সেদিকে। গাড়িটা অদৃশ্য হলো কিছুক্ষণের মধ্যেই।
মিতুলের হঠাৎ চোখ পড়লো জায়িনের উপর। জায়িন ঠিক ওর পাশ থেকেই চলে যাচ্ছে সামনের দিকে।
জায়িন মিতুলের থেকে বেশ কিছু দূরত্বে গিয়ে হঠাৎ থামলো। অতিক্রম করে যাওয়া পথ হেঁটে আবার মিতুলের কাছে এসে বললো,
“তুমি কি মর্নিং ওয়াকে আমার সাথে জয়েন করতে চাও?”
জায়িনের অফার ফিরিয়ে দেবে কি না বুঝতে পারছে না। একটু আগে তো একেবারে অগ্রাহ্য করে চলে গেল, দেখেও কিছু বললো না! তাহলে এখন আবার ফিরে এসে এই অফার দেওয়ার মানে কী? মিতুল জায়িনের অফারটা ওর মুখের উপর ফিরিয়ে দিতে চাইছিল। কিন্তু শেষমেশ সেটা পারলো না। জায়িনের কথায় সায় দিয়ে বললো,
“ঠিক আছে।”
মিতুল জায়িনের সাথে হাঁটতে হাঁটতে এলাকাটা এক ঝলক দেখে নিচ্ছে। গাড়িতে করে গেলে কিছুই ভালো মতো দেখা যায় না। যেমন এখন খুব ভালো করেই সব কিছু দেখা যাচ্ছে, লক্ষ করা যাচ্ছে, সেটা গাড়িতে বসে হয় না। আজকে ছুটির দিন। তাই অনেককেই দেখা যাচ্ছে। অনেকে জায়িনকে হাস্যোজ্জ্বল মুখে সকালের শুভেচ্ছা জানাচ্ছে। মিতুলকে খুব একটা পাত্তা দিলো না কেউ। যেটা সোজা আত্মসম্মানে আঘাত হেনেছে মিতুলের।
দূরে ঘাস ঘন খোলা ফিল্ডে কয়েকটা কিশোর ছেলে সাইকেল চালাচ্ছে। একটা ছেলে নিজের সাইকেলে ব্রেক কষে জায়িনের উদ্দেশ্যে দূর থেকেই উচ্চৈঃকণ্ঠে বললো,
“হেই ব্রো, তুমি কি আমাদের সাথে এটেন্ড করবে?”
জায়িনও কিশোরটির মতো উচ্চৈঃকণ্ঠে বললো,
“এখন নয়।”
“ঠিক আছে। বিকেল বেলা দেখা হবে।”
ছেলেটা একটু বিরতি নিয়ে আবার বললো,
“তোমার সাথের মেয়েটি কে? তোমার গার্লফ্রেন্ড?”
ছেলেটার কথা শুনে মিতুল বেশ লজ্জা পেল। যদিও এখানে ওর লজ্জার থেকে বেশি রাগ হওয়া উচিত, ছেলেটার এমন না জেনে না শুনে কথা বলার জন্য। কিন্তু ওর রাগ হলো না। ও পেল লজ্জা। এত লজ্জা পাওয়ার কারণ ও নিজেই বুঝতে পারলো না।
মিতুলকে জায়িনের গার্লফ্রেন্ড ভেবে ছেলেটা উৎসুক হয়ে মিতুলকে দেখতে ওদের কাছে এগিয়ে এলো।
জায়িন ছেলেটার ভুল ভাঙিয়ে বললো,
“ও আমার গার্লফ্রেন্ড নয়। ও একজন অতিথি। কানাডা ঘুরতে এসেছে। আমাদের বাড়িতে আছে, আমাদের রিলেটিভ।”
“ওহ, আই সি…” বিজ্ঞের মতো হালকা মাথা দুলিয়ে বললো ছেলেটি। তারপর করমর্দনের জন্য মিতুলের দিকে হাত বাড়িয়ে দিলো।
“হাই, নাইস টু মিট ইউ। আই অ্যাম লর্স। হোয়াট ইওর গুড নেম?”
মিতুল করমর্দন করে বললো,
“নাইস টু মিট ইউ টু। আই অ্যাম মিতুল।”
“হোয়াট? মি…মিইইটুল?”
“নো, মিতুল।”
“ওহ, একটু কঠিন। মিটুল!”
মিতুল মুখে হাসলো, কিন্তু মন থেকে হাসতে পারলো না। বিদেশের মাটিতে পা রাখলে যে নিজের নাম হ্যান-ত্যান হয়ে যাবে সেটা আগে থেকেই জানতো। নাম ঠিকঠাক ভাবে উচ্চারণ করতে না পারা তো বিদেশিদের মুদ্রা দোষ। তবুও ভালো, ছেলেটা তো মিটুল বলে সম্মোধন করেছে। অন্যদিকে জোহান তো ওর এত সুন্দর নামটাকে ‘তুলতুল’ বলে ব্যঙ্গ করেছে।
জায়িন লর্সকে বিদায় জানিয়ে চলে এলো। হাঁটতে হাঁটতে বললো,
“এখানকার বাচ্চাদের সাথে আমার খুব ভাব। ছুটির দিনে ওদের সাথে ভালোই টাইমপাস হয়।”
মিতুল ছোটো করে বললো,
“ওহ।”
কিছু সময় নীরবতা গেল। প্রথমে নীরবতা ভেঙে জায়িন বললো,
“ওয়েদার নিউজে জানলাম আজকে রাতে তুষারপাত হতে চলেছে। তুমি জানো সেটা?”
মিতুলের জানা ছিল না। তুষারপাতের কথা শুনে ওর দু চোখ তৃষ্ণার্ত হয়ে উঠলো। এই রঙিন বসন্তের মাঝে তুষারপাত ব্যাপারটা কেমন হবে? মিতুলের এক্সাইটমেন্ট কাজ করছে। সেই সাথে হঠাৎ মনে পড়ে গেল সেই ধূসর চোখের মায়াবী মানুষটাকে।
মিতুল ভাবছে, কোনো এক তুষারপাতে যদি সেই মানুষটার হাতে হাত রেখে তুষার জমা পথে হেঁটে বেড়ানো যেত, তাহলে কেমন হতো? ও নিজের বাম হাত দেখলো একবার। হাতে শোভা পাচ্ছে কালো চিকন একটা হেয়ার রাবার। যেটা হাত থেকে খুলতে ভীষণ অনিচ্ছা ওর।
_______________
মিতুল গার্ডেনের পাইন গাছের ডালের সাথে ঝুলে থাকা এক টুকরো কাঠের সেই দোলনাতে বসে আছে। বাগানে মিষ্টি সুবাস ভেসে বেড়াচ্ছে বাতাসের সাথে। অনেক ফুলের সুবাস এক সাথে মিলিত হয়ে এক অনন্য পরিবেশের সৃষ্টি করেছে। মিতুলের দৃষ্টি জঙ্গলের ভিতর। যদিও গাছের ফাঁক ফোকর পেরিয়ে চোখ জঙ্গলের অন্তরালে প্রবেশ করতে পারছে না বললেই চলে। এডমন্টনে কেবল অন্ধকারের কিঞ্চিৎ আভা দেখা দিলেও, জঙ্গলের ভিতর তা এখন গভীর রাতের সমান। জঙ্গলের ভিতরটা এখন অন্ধকার রাজ্যের মতো। যেখানে কখনও কোনো আলো প্রবেশ করতে পারেনি বলে মনে হয়। জঙ্গলের ভিতর কয়েকটা পাখি এক সঙ্গে দল বেঁধে ডাকছে। ওই পাখির ডাক এখন মিষ্টি মনে হচ্ছে না মিতুলের কাছে। মনে হচ্ছে পাখিগুলোও যেন ওই অন্ধকার রাজ্যের অন্ধকার প্রাণী। যা কেবল ভয়ংকর। ওর মনে নানান প্রশ্নের উদয় হচ্ছে। অতো রাতে জঙ্গলে কী কাজ জোহানের? দিনের বেলা জঙ্গলের ভিতর ঢুকতেই তো বোধহয় হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসবে! সেখানে রাতের বেলা…
মিতুলের মনে ভয় হলেও ওর কৌতূহল ওর ভয়ের চেয়ে অনেক বেশি। ওর ইচ্ছা করছে একবার জঙ্গলের ভিতর ঢুকে দেখে আসলে কী আছে জঙ্গলে যার জন্য জোহান অত রাতে জঙ্গলে গিয়েছিল। ওর কৌতূহল ওকে সম্পূর্ন নিজেদের বশে এনে ফেললো।
ও কৌতূহলে বশীভূত হয়ে দোলনা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। জঙ্গলের ঘুটঘুটে অন্ধকারে নিজের চোখ আটকে ধীরে ধীরে এগোয় জঙ্গলের ভিতর চলে যাওয়া সরু রাস্তার দিকে। এগিয়ে এসে যখন সেই রাস্তায় পা রাখলো, তখন পিছন থেকে শুনতে পেল,
“হোয়াট আর ইউ ডুয়িং হিয়্যার?”
মিতুলের পা থমকে যায়। আঁতকে ওঠে হৃদপিণ্ড। সারা শরীর বেয়ে নেমে যায় ভয়ের স্রোত। কৌতূহলের ফাঁদে পা দেওয়া কি ভুল হয়েছে? মিতুল শুকনো ঢোক গিললো। ধীরে ধীরে পিছন ফিরে দেখতে পেল ওর থেকে কিছুটা দূরত্বে জোহান দাঁড়ানো। হঠাৎ আগমনে আর ঝাপসা আঁধারে জোহানকে দেখে ভয়ংকর মনে হচ্ছে মিতুলের!
(চলবে)
#চেরি_ব্লসমের_সাথে_এক_সন্ধ্যা
#লেখা: ইফরাত মিলি
#পর্ব: ০৬
_____________
জোহান এগিয়ে এলো মিতুলের কাছে। প্রায় এক হাতের মতো দূরত্ব রেখে দাঁড়িয়ে বললো,
“এখানে কী করছো? একটু পর রাত নামবে, এখানে কী কাজ তোমার?”
মিতুল কী বলবে বুঝতে পারছে না। এখন জঙ্গলের ভিতর ঢুকতে চাওয়া ছিল বড়োসড়ো একটা বোকামি। এখন এই অন্ধকারে জঙ্গলের ভিতর ঢুকে কী করতো ও? নিশ্চয়ই পথ হারিয়ে সারা রাত জঙ্গলেই কাটিয়ে দিতো! বোকা মেয়ে! দিনের বেলায় ঢুকতে চাইলেও একটা কথা ছিল, কিন্তু এই রাত্রি নামার ক্ষণে…
মিতুল চোখ তুলে জোহানের দিকে তাকালো। একটু আগে জোহানকে খানিক ভয়ংকর মনে হচ্ছিল। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে না। তবুও কেন যেন একটু ভয় লাগছে অবশ্য। জোহানের মুখে রাগের প্রলেপ নেই কোনো। গাম্ভীর্যের ছায়া দেখা যাচ্ছে একটু।
মিতুল মুহূর্তেই একটা কথা বানিয়ে বলে দিলো,
“আমি বনের ভিতরের গাছগুলো দেখছিলাম। আর কিছুই নয়।”
“গাছ কেন দেখছিলে? যেকোনো একটা গাছ চূজ করে তার সাথে প্রেম করতে চাইছিলে বুঝি?” কথাটা বলে গাম্ভীর্য মুখে ফিচেল হাসি ফোঁটায় জোহান।
মিতুল খানিক রেগে বললো,
“কীসব বলছো? গাছের সাথে আবার প্রেম করে কীভাবে?”
জোহান হাসি থামিয়ে মিতুলের আরেকটু নিকটে এসে দাঁড়ালো। একটু ঝুঁকে ছোট্ট(খাটো) মিতুলের সমানা হওয়ার চেষ্টা করে গলার স্বর খাদে নামিয়ে বললো,
“শোনো বেঙ্গলি মেয়ে, এই জঙ্গলে অনেক হিংস্র প্রাণী আছে। যাদের দেহ লোম দ্বারা আবৃত। যাদের আছে ধারালো বড়ো বড়ো দাঁত, বড়ো বড়ো নখ। যারা এক থাবায় তোমার বুক থেকে তোমার হৃদপিণ্ড বের করে আনতে পারে। বুঝেছো? তোমার ছোট্ট মস্তিষ্কে ঢুকেছে আমার কথাগুলো?”
মিতুলের আত্মা ভয়ে শুকিয়ে যাচ্ছে। হিংস্র প্রাণীতে ওর ভয় লাগছে কি না জানে না, তবে জোহান যেভাবে বললো তাতে ভয়ের তীব্রতা আষ্টেপৃষ্ঠে লেগে ছিল। মিতুল জোহানের দিকে তাকিয়ে থাকতে পারছে না। জোহানের থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। জোহানকে এড়িয়ে দ্রুত পদে এগোতে লাগলো ঘরের দিকে। এক সেকেন্ডের জন্যও নিজের গতি থামালো না।
এতটা দ্রুতই নিজের রুমে দিকে ছুটছিল যে, প্যাসেজ ওয়েতে বেখেয়ালে জায়িনের সাথে ধাক্কা লাগলো।
জায়িনের হাতে কিছু ফাইল পত্র ছিল, যা পড়ে যায় ফ্লোরে। মিতুল তাৎক্ষণিক দাঁড়িয়ে গেল এমন অপ্রত্যাশিত ঘটনায়।
জায়িন ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। হয়তো এত দ্রুত পদে ওর ছোটার কারণ ভাবছে সে। মিতুল জায়িনের থেকে চোখ সরিয়ে দ্রুত ফ্লোর থেকে ফাইলগুলো উঠিয়ে দিলো। স্যরি বললো জায়িনকে।
জায়িন কিছুই বললো না। কয়েক সেকেন্ড মিতুলের দিকে নীরব তাকিয়ে থেকে নিজের ফাইল নিয়ে নিচে নেমে গেল।
মিতুল পিছন থেকে মুখ বাঁকালো। ইশ, এমন একটা ভাব করে যেন রাজার ছেলে রাজপুত্র এসে গেছে। মিতুল আবারও একবার ভেংচি কেটে নিজের রুমের দিকে যেতে লাগলো।
_____________
রাত নামার কিছুক্ষণ পরেই তুষারপাত শুরু হয়েছে। উড়ে উড়ে পড়ছে শত সহস্র কুচি কুচি বরফদানা। কৃত্রিম আলোর রোশনাইয়ে ঝলমল করা এই রাত এবং শান্ত, ধীর গতিতে উড়ে উড়ে পড়া তুষারপাত, দুই মিলে পরিবেশ করছে এক অনন্য রাজ্য।
বসন্তের তুষারপাত উপভোগ করতে মানুষ এখন নিজেদের ঘর ছেড়ে বাইরে পদার্পন করেছে। গায়ে জড়িয়েছে পুরু উষ্ণ কাপড়। রাস্তায় কিছু বাচ্চা ছেলে-মেয়ে দৌঁড়াদৌঁড়ি করছে। রাস্তায় অল্প অল্প করে জমতে থাকা বরফে বাচ্চাগুলো পা আটকে পড়ে যাবে বলে মনে হয়, কিন্তু আসলে তা হয় না। তারা দিব্যি দৌঁড়ে বেড়াচ্ছে।
মিতুল নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে আছে। মন হারাচ্ছে অজানা, অচেনা মুগ্ধতায়। জীবনে এই প্রথম কাছ থেকে স্নো ফল দেখা। এক হাত বাড়িয়ে দিয়ে উচ্ছ্বসিত মনে তুষার ছুঁয়ে দেখছে নীরবে। তুষারের ঠান্ডা পরশে একটু-আধটু শিহরণ আঁকছে মনে।
জোহান দাঁড়িয়ে আছে বেশ কিছুটা দূরত্বে। সেলফি, ছবি তুলতে ব্যস্ত সে। একটা ছেলে জোহানকে ছবি তুলতে সাহায্য করছে।
মিতুল অবশ্য এ কাজটা আগেই শেষ করেছে।
জায়িন বাড়ির গেটের কাছে দাঁড়িয়ে আছে। সবার ভাব মূর্তি লক্ষ্য করছে সে। কিন্তু তার দিকে কারো বিন্দু মাত্র ভ্রুক্ষেপ নেই।
রেশমী আন্টি এবং সাদাত আঙ্কল হাঁটতে হাঁটতে বেশ দূরে চলে গিয়েছেন। আর একটু হেঁটে বামে বাঁক নিলেই অদৃশ্য হয়ে যাবেন দুজনে।
সবাই যখন নিজ নিজ ভাবে ব্যস্ত, তখন মিতুল মনে মনে একজনকে ভীষণ ভাবে মিস করছে। চোখের পর্দায় আলতো করে ভেসে উঠছে এক জোড়া ধূসর চোখ। যে চোখের গভীরতায় সাঁতার কেটে বেড়াতে ইচ্ছা করে ওর। মিতুল কল্পনা করছে, ও এবং ওর প্রিয় ধূসর চোখের মানুষটি একে অপরের হাত ধরে হেঁটে চলেছে। পাড়ি দিচ্ছে তুষার জমা পথ। আশপাশ জনমানবহীন। কেবল ওদের অনুভূতির সাক্ষী হয়ে ঝরছে মিহিদানার মতো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বরফ কণিকা।
তুষার মানব তৈরি করার কাজে হাত লাগিয়েছে জোহান। ওকে ছবি তুলতে সাহায্য করা ছেলেটাও তুষার মানব তৈরিতে সহায়তা করছে।
বড়ো আকারের একটা গোলাকৃতির তুষারখন্ড এরই মধ্যে তৈরি করে ফেলেছে জোহান। বড়ো খন্ডটার উপর আরেকটা ছোটো গোলাকৃতির খন্ড বসাতে হবে এরপর। সেটা তৈরিতে এখন জোরদার কাজ চালাচ্ছে। একের পর এক বরফ কণিকার আস্তরণ উল্টে-পাল্টে মেখে ছোটো খন্ডটি তৈরি করে ফেললো। তারপর সেটাকে বড়ো খন্ডটির উপরে বসিয়ে দিলো। ছোটো-খাটো একটা তুষার মানব তৈরি হয়েছে। সাফল্যের হাসি হাসলো জোহান। এরই মধ্যে ওর চোখ গেল কল্পনা বিমোহিত অন্যমনস্ক মিতুলের উপর। মিতুলকে দেখে জোহানের মনে দুষ্টুমির ভাবনা উদয় হলো। দুই হাতে রাস্তা থেকে কিছু তুষার তুলে নিলো, এবং তা ছুঁড়ে মারলো মিতুলের মুখ বরাবর।
আকস্মিক এমন ঘটনায় মিতুল প্রায় লাফিয়ে উঠলো। বেরিয়ে আসলো ওর কল্পনা জয়ী রাজ্য থেকে।
মিতুলের অবস্থা দেখে জোহান হাসতে হাসতে শেষ। পারলে এই বরফ জমা রাস্তাতেই লুটোপুটি খায় অবস্থা। এমন ভাবে হাসছে যেন এরকম মজা সে আগে কখনো পায়নি।
জোহানের হাসি দেখে মিতুলের প্রতিটা শিরা উপশিরায় রাগের তাপদাহ বয়ে যাচ্ছে। আশেপাশে মানুষজন থাকায় ও মুখে কিছু বললো না জোহানকে। মনে মনে হাজারও কথা শুনিয়ে নিজের তুষ্টি মেটালো।
জোহান রাস্তার ল্যাম্পপোস্টের আলোয় মিতুলের রাগে ফুলো নাকটা লক্ষ্য করলো। যা দেখে ওর হাসি আরও বেড়ে গেল।
জোহানের উপর কিছুটা রাগের প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে জায়িনের মাঝে। মিতুলের মুখে জোহানের তুষার ছুঁড়ে মারাটা একদমই ভালো লাগেনি জায়িনের। কেন এত খারাপ লাগলো ঠিক জানে না! কিন্তু এতটাই খারাপ লেগেছে যে, এখানে দাঁড়িয়ে থাকার মন মানসিকতা হারিয়ে ফেলেছে ও। জায়িন সত্যি সত্যি আর এখানে দাঁড়ালো না। তুষার জমা রাস্তা ধরে সোজা এগিয়ে যেতে লাগলো। নিজের বন্ধুদের সাথে গিয়ে মিলিত হবে এখন। ফ্রেডি অনেক আগেই ফোন করে ডেকেছিল ওকে। ‘এখনই আসছি’ বলে বাড়ি থেকে বের হয়েও কেন যেন তখনই নিজের বন্ধুদের উদ্দেশ্যে রওনা দিতে পারেনি ও। কিছুক্ষণ বাড়ির সামনেই অন্যদের সঙ্গে দাঁড়িয়ে রয়েছিল।
_______________
মিতুল বেড রুমের বিশাল আকৃতির উইন্ডোটি মেলে দিলো। উইন্ডোর গ্লাসে কুচি কুচি বরফ জমে আছে। বাইরে এখন নীরব পরিবেশ। স্নো ফল থেমে গেছে কিছুক্ষণ আগে। মোবাইলে মায়ের মিসড কল উঠে আছে। মিতুলের কল ব্যাক করতে ইচ্ছা করছে না। কল ব্যাক করলো না ও। পরে মা ফোন দিলে ফোন ধরতে না পারার কোনো একটা কারণ দাঁড় করিয়ে দেবে। গায়ের জ্যাকেটটা খুলে রেখে বিছানার নরম তুলতুলে কোলে গা ভাসালো ও।
মিতুলের মনে একটা জেদ চাপলো। কালকে যে করেই হোক সেই রেস্টুরেন্টে যাবে ও। না, রেস্টুরেন্টে খেতে যাবে না। খাওয়ার ছুতো দিয়ে সেই ধূসর চোখ জোড়াকে একবার দেখতে যাবে। একা যাওয়া যায়। কিন্তু একা গেলে ব্যাপারটা কেমন হবে? না, একা যাবে না। রেশমী আন্টির সাথে…না রেশমী আন্টির সাথে যাবে না। জোহানের সাথে যাবে। ওর সাথেই তো গিয়েছিল আগের বার। ওর সাথে আরেক বার ওখানে যেতে চাইলে নিশ্চয়ই কিছু মনে করবে না ও। জোহান অহংকারী, বদমাইশ হলেও তার পাশাপাশি একটু আহাম্মকও আছে। হ্যাঁ, কালকে জোহানের সাথেই যাবে সেই রেস্টুরেন্টে।
মিতুলের হঠাৎ খুশি খুশি লাগছে। লজ্জাও লাগছে একটু। প্রথম কাউকে মনে ধরেছে ওর। আর এমন একজনকে মনে ধরেছে যাকে চেনেই না। সামান্য নামটা পর্যন্তও জানা নেই। ইশ, কে ভেবেছিল যে এমন করে কারো প্রেমে পড়বে! মিতুল লজ্জায় নিজের মুখ লুকালো দু হাতে। শুয়ে রইল অনেকক্ষণ। ভেবে গেল কেবল ধূসর চোখ জোড়াকে।
এরপর উঠে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখতে লাগলো। আয়নায় নিজের প্রতিচ্ছবি দেখতে ভালো লাগছে। ওর মনে হচ্ছে ও আগের চেয়ে একটু সুন্দর হয়েছে। আসলেই কি আগের চেয়ে সুন্দর হয়েছে? না কি মনে তৈরি হওয়া সদ্য রঙিন অনুভূতির জন্য সবকিছু বেশিই সুন্দর মনে হচ্ছে? কোনটা?
মিতুল কাঁধ বেয়ে একটু নিচ ছুঁয়ে যাওয়া অদীর্ঘ চুলগুলো আঁচড়ে নিলো। শুকনো ঠোঁট লিপ জেলে ভেজালো। কণ্ঠে তুললো গুনগুন করে বাংলা গানের সুর। বাম হাতের হেয়ার রাবারটা খুলে চুলগুলো বেঁধে নিলো সযতনে। তারপর দরজা টেনে রুম থেকে বের হলো।
প্যাসেজওয়ে ধরে আপন মনে গুনগুন করতে করতে এগিয়ে যাচ্ছিল সিঁড়ির প্রান্তে পৌঁছানোর উদ্দেশ্যে, কিন্তু পথে জোহানের কক্ষ থেকে মিষ্টি গিটারের সুর ওর চলন থামিয়ে দিলো। গিটারের সুর বরাবরই ভালো লাগে ওর। মনে পড়লো কালকে রাতের কথা। কালকে রাতে জোহানকে গার্ডেনে দাঁড়িয়ে গিটার বাজাতে দেখেছিল। জোহান যে গিটার বাজানোয় দক্ষ সেটা বুঝতে পেরেছে ও। আচ্ছা, জোহান কি গান-টান করে না কি?
জোহানের রুমের দরজা একটুখানি ফাঁকা। মিতুল উঁকি দিলো সেখানে। রুমের ভিতর সোনালী আলোক রশ্মিতে জোহানকে দেখা যাচ্ছে। একমনে অনবরত গিটার বাজাচ্ছে ও। খুবই শান্ত একটি সুর বাজছে ওর গিটারে। একটুখানি ফাঁকা জায়গাটুকু দিয়ে মিতুল তাকিয়ে রইল জোহানের দিকে।
জোহানের গিটারে চালিত হাত দুটো হঠাৎ থেমে যায়। কোনো দিকে দৃষ্টিপাত না করেই বলে,
“লুকিয়ে লুকিয়ে আমার গিটার বাজানো দেখছো কেন?”
মিতুল চমকে গেল। কী করে বুঝলো যে এখানে দাঁড়িয়ে ওকে দেখছে? মিতুল প্রশ্নটা করেই ফেললো,
“কী করে বুঝলে যে আমি এখানে আছি?”
জোহান গিটার রেখে উঠে আসলো। একটুখানি ফাঁকা থাকা দরজাটা খুলে ফেললো সম্পূর্ণ। গাম্ভীর্যের সাথে বললো,
“চুপিচুপি আমাকে লক্ষ করা ব্যাপারটা আমি খুব অপছন্দ করি। কখনো করবে না আর।”
বলে নিজ অবস্থানে ফিরে যাওয়ার জন্য ঘুরে দাঁড়ালো।
মিতুল তাড়াতাড়ি পিছন থেকে বললো,
“একটা কথা ছিল তোমার সাথে।”
আর মনে মনে বললো,
“এই অহংকারী ছেলে, নিজেকে কি রাজপুত্র ভাবো তুমি? চুপি চুপি না হয় একটু তাকিয়ে থেকে তোমার গিটার বাজানোই দেখছিলাম। তাতে কি মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে গেছে?”
জোহান বিস্ময় নিয়ে পিছন ফিরলো। অবাক কণ্ঠে বললো,
“আমার সাথে? কী কথা আমার সাথে?”
মিতুল ভাবছে কালকে রেস্টুরেন্টে নিয়ে যাওয়ার কথাটা এখনই বলে দেবে। খানিক ইতস্তত করে বললো,
“কালকে আমাকে বাইরে নিয়ে যেতে পারবে?”
(চলবে)