চেরি_ব্লসমের_সাথে_এক_সন্ধ্যা,পর্ব: ১৪

0
851

#চেরি_ব্লসমের_সাথে_এক_সন্ধ্যা,পর্ব: ১৪
#লেখা: ইফরাত মিলি
_____________

আজ জোহানের মুখে গান শুনলো মিতুল। পার্টিতে থাকতে। বন্ধুদের অনুরোধে গান গেয়েছিল ও। রিকার্ডোর গিটার বাজিয়েছিল। গিটার বাজাতে তো আগেই দেখেছে, কিন্তু গান…
মিতুল ভাবতে পারছে না এই জোহান এত সুন্দর গান গাইতে পারে। বদমাইশটাকে দেখলে মনেই হয় না যে গান গাওয়ার মতো এত সুন্দর প্রতিভাও ওর আছে। গান গাওয়ার থেকে আরও বড়ো বিস্ময় ছিল, যে গানটা ও গেয়েছে সেটা ওর নিজেরই লেখা। এটা মিতুলকে খুব বেশি অবাক করেছে। গানের কথাগুলো মিতুলের কানে এখনও বাজছে।

‘You are my little angel,
You are my dream,
You are my only favorite in this long world!’

আর শুধু এতটুকুই নয়। মিতুল এর থেকে আরও বিস্ময়কর জিনিস শুনলো ওর ফ্রেন্ডসদের থেকে। জোহানের নিজস্ব গানের অ্যালবামও বের হয়েছে। ও তো প্রথমে কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারেনি কথাটি। কিন্তু যখন রিকার্ডো জোহানের গানের অ্যালবাম বের করে দেখালো, তখন বিশ্বাস না করে উপায় ছিল না। জোহানের গানের অ্যালবামের নাম, ‘Guilty Summer’

জোহান তেমন ফেমাস নয়। ওর গানের কদর কম। আজকে মিতুল জোহানের স্বপ্ন সম্পর্কেও জেনেছে। জোহানের স্বপ্ন হলো, একটি ব্যান্ড গ্রুপে এড হওয়া। কিন্তু এই সুযোগটা আসে না ওর জন্য! এই প্রথম মিতুল একটু দুঃখ অনুভব করলো জোহানের জন্য। আহারে বেচারা! নিজের স্বপ্নের পিছনে ছুটছে অথচ স্বপ্নটা ধরা দিচ্ছে না।

জোহান মিতুলকে নিয়ে অনেক আগেই পার্টি ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে। এখন প্রায় নিজেদের এলাকার কাছাকাছি এসে গেছে। মিতুল জোহানের দিকে তাকিয়ে আছে। জোহানের দৃষ্টি সামনে। দৃষ্টি সামনে থাকেলও মিতুল যে ওর দিকে তাকিয়ে আছে সেটা বুঝতে কষ্ট হচ্ছে না।
জোহানের প্রতি যে রাগটা ছিল সেটা এখন আর নেই মিতুলের। সে রাগ পার্টিতে বসেই শেষ। ওর বন্ধুদের সাথে পরিচিত হওয়ার পরই সেই রাগ পালিয়ে গিয়েছিল। মিতুল আরও কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললো,
“এটা আমাকে আগে জানাওনি কেন?”

“কোন বিষয়ে কথা বলছো?”

“তোমার গান।”

“এটা আগে জানানোর কী আছে? এটা কি আগে জানানোর মতো কোনো বিষয়?”

“নয় বলছো?”

“হ্যাঁ।”

“ঠিক আছে, না থাকলে নয়।”
মিতুল বাইরে চোখ দিলো। নিরিবিলি রাস্তা। আজকে আকাশে মেঘের আনাগোনা দেখা যাচ্ছে না। দেখা যাচ্ছে সুন্দর একটা চাঁদ। চাঁদের মোহনীয় আলোর মেলা আশপাশ সমস্তটা জুড়ে। দেখতে দেখতে গাড়ি চেরি ব্লসমের রাজ্যে ঢুকে পড়লো। রাস্তার দুই পাশে চেরি ব্লসম ট্রি। ঘন নয়। পাতলা করে কয়েকটা গাছ আরকি। নিঝুম রাতে জোৎস্না মেখে অপরূপ সৌন্দর্যে ঝরে পড়ছে চেরি পাপড়ি। এরকম অল্প অল্প করে না ঝরে যদি গাছ থেকে সব পাপড়ি গুলো একসাথে ঝরে পড়তো, তাহলে কেমন হতো? মিতুল খোলা উইন্ডো থেকে বাইরে হাত বাড়িয়ে দিলো।
হাতে একটা পাপড়ি এসে পড়তেই হাত মুঠো করে আঁকড়ে ধরলো পাপড়িটা। বাইরে থেকে হাত নিয়ে এলো আবার কারের ভিতরে। মুঠো খুলে পাপড়িটাকে দেখতে লাগলো। কী কোমল মনে হচ্ছে এই পাপড়িটাকে। যেন বিশ্বের সমস্ত সুখ নিজের এই ছোট্ট শরীরেই আবদ্ধ করে রেখেছে। কিন্তু বিশ্বের যত সুখ তা তো কেবল মানুষ লুটছে। মানুষ ছুটছে আর ছুটছে কেবল সুখ পাওয়ার সন্ধানে।

গাড়ি হালকা ঝাঁকি দিয়ে ব্রেক কষলো আচমকা। মিতুল নিজের ভাবনা থেকে বেরিয়ে এলো। প্রথমেই বিস্মিত চোখ জোড়া চলে গেল জোহানের মুখের উপর। তারপর জোহানের দৃষ্টি অনুসরণ করে সামনে।
মিতুলের কপালে ভাঁজ পড়লো। ও আবার তাকালো জোহানের দিকে। জোহানের মুখে হঠাৎ রাগের প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে। মুখটা কঠিন হয়ে আছে।
মিতুল জোহানের থেকে নিজের বিস্মিত চোখ জোড়া সরিয়ে আবারও গাড়ির গ্লাস ভেদ করে সামনে তাকালো। গাড়ির সামনে চারটা ছেলেকে দেখা যাচ্ছে। ওদের পথই আটকেছে ছেলেগুলো। মিতুল কিছুই বুঝতে পারছে না। ছেলে গুলো কেন ওদের গাড়ি থামালো?
জোহান দ্রুত ওর কারটা রাস্তার পাশে নিয়ে পার্ক করলো। তারপর ব্যস্ত গলায় বললো,
“কার থেকে নামবে না মিতুল, আমি আসছি।”

নিজের সিটবেল্ট খুলে দরজা খোলা দিলেই মিতুল জোহানের এক হাত টেনে ধরলো।
“কী হচ্ছে এখানে? ছেলেগুলো আমাদের গাড়ি কেন থামালো?”

জোহান নিজের হাতটা সরিয়ে নিয়ে বললো,
“গাড়ি থেকে নামবে না, যাই হোক না কেন।”

মোবাইল, গাড়ির চাবি নিজের সিটের উপর রেখে গাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল জোহান।
মিতুল অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল।
জোহান এগিয়ে গেল ছেলেগুলোর দিকে। রাস্তা বলতে গেলে প্রায় জনমানবহীন। কাউকে দেখা যাচ্ছে না তেমন। মিতুলের ভয় করছে। ছেলেগুলোর এভাবে রাস্তা আটকানো মোটেই সুবিধাজনক মনে হচ্ছে না। ও গাড়িতে বসে তাকিয়ে রইল সামনে।
জোহান ছেলেগুলোর সাথে কথা বলছে। মিতুল শুনতে পাচ্ছে না ঠিক। একটু শব্দ পাচ্ছে শুধু। গাড়ির থেকে দূরে দাঁড়ানো ওরা।
মিতুলের চোখের সামনেই হঠাৎ একটা ভয়ংকর দৃশ্য ঘটলো। একটা ছেলে জোহানের পেট বরাবর ঘুষি মারলো! মিতুলের চোখ বিস্ময়, আতঙ্কে ছেয়ে গেল। ঘুষির জোর বেশি ছিল। জোহান নুইয়ে পড়েছে।
মিতুলের বুকে হাতুড়ি পেটানোর শব্দ হচ্ছে। একেকটা হাতুড়ি পেটানোর শব্দ খুব ভয়াবহ ভাবে শুনতে পাচ্ছে ও।
আর একটা ছেলে জোহানের চুলের মুঠি ধরে জোহানের মুখ উচুঁ করলো। কী একটা বলতে বলতে জোহানের মুখে থাপ্পড় বসিয়ে দিলো। জোহানের মুখ হেলিয়ে গেল একদিকে। জোহানের মুখে আরও কয়েকটা থাপ্পড় পড়লো। একটা ছেলে জোহানের মুখে এত জোরে একটা ঘুষি মারলো যে জোহান রাস্তায় পড়ে গেল! ছেলেগুলো হাত দিয়ে জোহানকে আঘাত করে চলছে। ঘুষি মেরে রাস্তায় ফেলে দেওয়া ছেলেটা হঠাৎ জোহানের পেট বরাবর একটা লাথি মারলো। লাথিটা ছিল সবচেয়ে বেশি মর্মান্তিক। মিতুলের হৃদস্পন্দন থেমে গেল এক মুহূর্তের জন্য। চোখের সামনে দেখলো জোহান ব্যথায় কুঁচকে গেছে ।
এক হাত দিয়ে নিজের পেট চেপে ধরে নিজের যন্ত্রনা হজম করলো জোহান। এত মার খেয়েও জোহান কোনো শব্দ করলো না তেমন। ছেলে গুলোর মার যেন শেষ হচ্ছে না। মিতুলের চোখে পানি এসে গেছে। কখন থেকে যেন ঝরেও পড়তে লাগলো। ও চোখের সামনে জোহানকে এভাবে মার খেতে দেখতে পারে না। গাড়ি থেকে বের হওয়ার জন্য দরজা খুলতে চাইলো, কিন্তু দরজা খুলছে না। দরজা খুলছে না কেন? মিতুল টানাটানি করলো। কিন্তু খুললো না। ও ড্রাইভিং সিটের পাশের দরজাটার দিকে এগিয়ে এলো। খোলার চেষ্টা করলো, খুললো না। অনেক চেষ্টার পর দরজাটা খুলতে সক্ষম হলো। মিতুল গাড়ি থেকে বের হয়ে দৌঁড়ে জোহানের কাছে এলো। ছেলে গুলো এতক্ষণে চলে গেছে। জোহানের মুখ দেখে মিতুলের আত্মাটা ভয়ে কেঁপে উঠলো। জোহানের নাক থেকে রক্ত বের হয়েছে। গাল লাল। ঠোঁটের কোণেও রক্ত। জোহান চোখ খিঁচে রেখেছে। পেট চেপে ধরে আছে। মিতুল কী করবে কিচ্ছু বুঝতে পারছে না। কেঁদে যাচ্ছে শুধু। দুই হাতে জোহানকে ধাক্কা দিয়ে বলতে লাগলো,
“জোহান ওঠো।”

জোহান উঠলো না। মিতুল এবার একেবারে অসহায় হয়ে পড়লো। দ্বিগিদিক কিছু ভাবতে পারছে না।

“কী করা উচিত এখন? ইমারজেন্সি নম্বরে কল করা উচিত? না কি আশেপাশের একটা হাসপাতাল খুঁজে নিজেরই নিয়ে যাওয়া উচিত? কোনটা করা উচিত? হে আল্লাহ পথ দেখাও।”

মিতুল যখন উত্তেজিত ভাবে এসব বিড়বিড় করছিল, তখন জোহানের অস্পষ্ট কণ্ঠ শোনা গেল,
“হেই তুলতুল!”

জোহানের কণ্ঠ কানে আসতে মিতুল থমকে গেল। জোহানের দিকে তাকিয়ে দুই হাতে জোহানের মুখ ধরে ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বললো,
“তুমি জেগেছো? আমি এখন কী করবো? ইমারজেন্সি নাম্বারে কল করা উচিত? কী করা উচিত আমার? বলে দাও না।”

জোহানের ক্লান্ত গলা শোনা গেল,
“আমাকে দ্রুত গাড়িতে নিয়ে বসাও। এখানে বেশিক্ষণ থাকলে দুজনেই বিপদে পড়বো। পুলিশ দেখলে ধাওয়া করবে। তাড়াতাড়ি আমাকে নিয়ে গাড়িতে চলো।”

মিতুল বুঝদারের মতো বললো,
“ঠিক আছে।”

মিতুল জোহানকে ধরে উঠালো কোনো রকম ভাবে। কিন্তু জোহানের লম্বা দেহ মিতুলের মতো খাটো মেয়ে ঠিক সামলে ধরে রাখতে পারছে না। তাছাড়া জোহানকে ধরলেই জোহান কিছুটা রাগ দেখিয়ে বলছে,
“হেই, আস্তে ধরো। ব্যথা পাচ্ছি। আমাকে কী মনে হয় তোমার? এমন ভাবে ধরছো মনে হচ্ছে তোমার আঙ্গুল আমার শরীর ফুঁটো হয়ে ঢুকে যাবে। ভালো করে ধরো।”

এত মার খাওয়ার পরও বেশ ভালো জোরই আছে গলায়। মিতুল সেসবে পাত্তা দিলো না। জোহানকে ড্রাইভিং সিটের পাশে বসিয়ে দিয়ে দরজা আটকে দিলো। নিজে গিয়ে বসলো ড্রাইভিং সিটে।
জোহান এতক্ষণ চোখ বুজেই ছিল। এবার চোখ মেললো। লক্ষ করলো ড্রাইভিং সিটে নেই ও। জোহান মুখ দিয়ে জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে। মিতুলের দিকে তাকিয়ে বললো,
“এই…এখানে বসিয়েছো কেন আমায়? গাড়ি কি নিজে থেকে চলবে?”

“নিজে থেকে চলবে কেন? আমি চালাবো।”

“কী? ওখান থেকে…বেঁচে ফিরেছি, এখন তুমি কি আমায় কার এক্সিডেন্ট করিয়ে মারতে চাইছো? তোমার গাড়ি ড্রাইভ করার অভিজ্ঞতা আছে?”

মিতুল মাথা নাড়িয়ে বললো,
“আছে। আমার ছোটো ভাই আমাকে ড্রাইভিং শিখিয়েছে। আমি ড্রাইভ করতে পারি।”

জোহান আর কিছু বললো না। সিটের সাথে মাথা হেলিয়ে দিয়ে চোখ বুজলো।
মিতুল গাড়ি স্টার্ট দিতে গিয়েও আবার থামলো। জোহানের দিকে তাকিয়ে কাঁপা গলায় বললো,
“আ-আচ্ছা… আমার কাছে তো কোনো লাইসেন্স নেই। বলছি যদি বিনা লাইসেন্সে গাড়ি চালাই…তাহলে কি পুলিশে ধরবে না?”

জোহানের কাছে জিজ্ঞেস করার পর আবার নিজে নিজেই বলতে লাগলো,
“আমি কি কানাডা জেল খাটতে এসেছি? কিছুতেই জেল খাটতে পারব না আমি!”

জোহান চোখ খুলে মিতুলের দিকে তাকিয়েছে। মিতুলের কথা শুনে এমন মুহূর্তেও হাসি পাচ্ছে ওর। বললো,
“দ্রুত গাড়ি স্টার্ট করো। নয়তো এখানে বেশিক্ষণ গাড়ি নিয়ে থাকার কারণে জেল খাটতে পারো।”

“এ্যা?”

“হ্যাঁ।”

জোহান আবারও চোখ বুজে মাথা হেলিয়ে দিলো সিটে।
মিতুলের ভয় করছে। সত্যিই পুলিশে ধরবে? মিতুল গাড়ি স্টার্ট করলো।
ভালোই ড্রাইভ করেছে মিতুল। রাস্তায় কোনো পুলিশ ছিল না। এর জন্য মিতুল বার বার স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছিল। হয়তো এটা এলাকার রাস্তা সে জন্য পুলিশের দেখা পায়নি। মেইন রোডে থাকলে যে জেলে যেতে হতো, সেটা সুনিশ্চিত।
বাড়ি পৌঁছে গেছে। মিতুল গ্যারেজে নিয়ে এলো গাড়ি। গাড়ি ব্রেক করলো। জোহানের দিকে তাকিয়ে দেখলো জোহান চোখ বুজে আছে এখনও। মুখের রক্ত এখনও শুকায়নি। মিতুল গাড়ি থেকে নামলো। জোহানকে ধরে নামালো তারপর। জোহানকে দুই হাতে ধরে ঘরের দিকে নিয়ে যেতে লাগলো। কিন্তু জোহান মাঝপথে হঠাৎ থেমে গেল। মিতুলও থেমে গেল। ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলো,
“হোয়াট হ্যাপেন্ড জোহান?”

কেন যে ফিস ফিস করে কথা বললো সেটা ও নিজেও জানে না। ফিস ফিস করে কথা বলছে সেটা ওর খেয়ালই নেই।

জোহান বললো,
“ঘর নয়।”

“মানে?”

“বাড়ির পিছনের দিকে নিয়ে চলো।”

“বাড়ির পিছনে কী আছে? বাড়ির পিছনে কেন নিয়ে যাব?”

“বেশি কথা বাড়িয়ো না। দেখতে পাচ্ছ না আমি আহত? কোনো রোগীর সাথে এমন কথা প্যাঁচানো উচিত নয়। তাহলে রোগীর অবস্থা আরও গুরুতর হয়। যা বলছি তাই করো।”

মিতুলের কী যেন হলো। ওর উচিত ছিল এখানে জোহানের সাথে একটু হলেও তর্ক করা। কিন্তু ও তর্ক করলো না। এমনকি একটা কথাও বললো না। চুপচাপ জোহানের কথা অনুযায়ী ওকে বাড়ির পিছনে নিয়ে এলো।
গার্ডেনে লাইট জ্বলছে। বাড়ির মানুষের কোনো সাড়া শব্দ নেই। খুব নিঝুম পরিবেশ। মিতুল আবার ফিসফিস করে বললো,
“বাড়ির পিছনে তো নিয়ে এসেছি তোমায়, এখন কী করবো?”

জোহান জঙ্গলের ভিতরে চলে যাওয়া সরু রাস্তাটা দেখিয়ে বললো,
“ওই রাস্তা দিয়ে সোজা হেঁটে যাও।”

মিতুলের টনক নড়ে উঠলো। জঙ্গল? ওই রাস্তা দিয়ে হেঁটে ওকে কি জঙ্গলে যেতে বলছে? মিতুলের মনে ভয়ের দানা জমতে লাগলো। মাথার ভিতর সবকিছু কেমন দলা পাকিয়ে উঠছে। জঙ্গলের ভিতর তাকালে ভয়ে গলা শুকিয়ে যাচ্ছে ওর। মিতুল ঢোক গিললো। জোহান ওকে নিজ থেকে জঙ্গলে নিয়ে যেতে বলছে? কেন?

“কী হলো দাঁড়িয়ে আছো কেন?”
জোহানের প্রশ্ন কানে এলো।

মিতুলের কৌতূহল হচ্ছে। এতটাই কৌতূহল হচ্ছে যে ভয়কে পরোয়া না করে একবার জঙ্গলে গিয়ে দেখতে ইচ্ছা করছে। দুই বার যেতে চেয়েছিল। কিন্তু যেতে পারেনি। আর জঙ্গলের রহস্য উদঘাটন করাও হয়নি। একবার জোহান নিজে বাধা দিয়েছে, আরেকবার জায়িন। আর আজ সেই জোহানই ওকে জঙ্গলে যাওয়ার কথা বলছে! বিস্ময়কর!
মিতুল জোহানের দিকে তাকালো। জোহানের অবস্থা কাহিল। মিতুল মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলো ও যাবে। এই সুযোগ হাতছাড়া করা ঠিক না।
মিতুল জোহানকে নিয়ে রাস্তার দিকে এগিয়ে গেল। এক হাতে জোহানকে আগলে, আরেক হাতে মোবাইলে ফ্ল্যাশ লাইট জ্বালিয়ে ধরে জঙ্গলে ঢুকলো। সরু রাস্তা। রাস্তায় পাতা জমে স্তুপ হয়ে থাকার কথা, কিন্তু তেমন কোনো পাতা নেই। আশেপাশে গাছ গাছালি। কয়েকটা পাখি ডাকছে। মিতুলের গায়ের রক্ত হিম হয়ে যাচ্ছে। ও কি ঠিক করছে? না কি ভুল? ভুল শব্দটা সোজা হৃদয়ে এসে আঘাত করলো। আর সেই আঘাতে একটা চাপা পড়া দুঃস্বপ্ন ক্রমশ জেগে উঠতে লাগলো। চারিধারে কবর, শরীর মোটা দড়ি দিয়ে গাছের সাথে বাঁধা, আর কালো পোশাকে আবৃত জোহানের ভয়ংকর মুখটা চোখে ভেসে উঠলো। মুহূর্তেই মিতুলের হাত পায়ে কাঁপন ধরে গেল। জোহান টের পেল কি না কে জানে। ওকে বলতে শোনা গেল,
“হেই মিতুল, তুমি কি কাঁপছ না কি?”

মিতুল কিছু বলতে পারল না। হাত-পা কেঁপেই চলছে। কী করা উচিত এখন? কেন আসলো জোহানের কথা মতো এই জঙ্গলে? কী আছে কপালে এখন? এই জোহান যদি সত্যিই স্বপ্নের জোহানের মতো হয়? যদি আক্রমণ করে? তাহলে কী হবে? কী করবে তখন? এখান থেকে চিৎকার করে ডাকলে কি কেউ শুনবে?
যদি স্বপ্নের মতো সত্যি সত্যি একটা গাছের সাথে বাঁধে তখন? মিতুলের মনে পড়লো, আরে জোহান নিজেই তো আহত। আহত অবস্থায় কি আক্রমণ করতে পারবে? বাঁধতে পারবে গাছের সাথে? মিতুলের মনটা একটু নিশ্চিন্ত হতে নিয়েছিল, কিন্তু পারলো না। নতুন একটা চিন্তা তীরের মতো এসে মস্তিষ্কে বিঁধলো। আচ্ছা, জোহানের কোনো সাঙ্গপাঙ্গ আছে? তারা এখানে ওঁৎ পেতে নেই তো? প্রশ্নটা মনে হতেই মস্তিষ্কের চাপ বেড়ে গেল। চিন্তাময় মাথাটা আরও দ্বিগুন চিন্তায় ডুবে গেল। জোহান আহত সেটা ঠিক আছে, কিন্তু ওর সাঙ্গ-পাঙ্গরা? তারা তো আর আহত থাকবে না। তারা তো চাইলেই আক্রমণ করতে পারবে। গাছের সাথে বেঁধে ফেলা তো তাদের কাছে ওয়ান টু এর ব্যাপার। মিতুলের হাত পায়ের কাঁপন আরও বেশি বৃদ্ধি পেল। জোহানকে ধরে রাখার বাঁধন আলগা হয়ে এলো তাই।
জোহান মিতুলের এমন কাঁপা কাঁপি অবস্থা দেখে মেজাজ দেখিয়ে বললো,
“হেই কী করছো তুমি? ভালো করে ধরে রাখো আমায়। কী চাও এখানে ঠাস করে পড়ে গিয়ে আমার মাথা ফেঁটে যাক? সেটাই চাও তুমি?”

জোহানের বলা একটা শব্দও মিতুলের কর্ণ পর্যন্ত পৌঁছতে পারলো না। ওর কাঁপাকাঁপি চলতে লাগলো আগের ন্যায়।
জোহান নিজে মিতুলের হাতটা টেনে নিজেকে ভালো করে আগলে রাখতে চাইলো।

মিতুলের মাথায় এখন চিন্তার ঝড় বইছে। কান্না পাচ্ছে, খুব কান্না পাচ্ছে। মা, বাবা, আর দুই ভাইয়ের হাসি মাখা মুখ ভেসে উঠছে চোখে। ওর এখন তাদেরকে ডাকতে মন চাচ্ছে। কিন্তু ভয়ে গলাটা এত দুর্বল হয়ে পড়েছে যে একটা শব্দও বের হচ্ছে না। মিতুলের ভাবতে খুব কষ্ট হচ্ছে যে জোহান এরকম করতে পারে ওর সাথে! কী করে করতে পারে জোহান এটা? যে মানুষটা এত সুন্দর গান গায়, সেই মানুষটা এত নৃশংস হয় কীভাবে? কীভাবে হয়? মিতুলের কানে জোহানের গানের কণ্ঠটা ভেসে উঠছে,
‘You are my little angel
You are my dream…’

গানটার কথা মনে হতেই মিতুলের চোখ থেকে দু ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। যে এত সুন্দর গায়, যার মুখটা দেখতে বাচ্চা বাচ্চা লাগে, সে কী করে এমন নির্মম হতে পারে? জোহান কি আসলেই নির্মম?
মিতুলের কেন যেন মনে হচ্ছে জোহান অবশ্যই ওর সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে আক্রমণ করবে ওকে। না হলে এই রাতে কেন এভাবে জঙ্গলে নিয়ে আসার কথা বললো? আচ্ছা, জোহান যে মার খেলো একটু আগে, সেই রাগটা ওর উপর মিটাতে চাইছে না তো?
মিতুলের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো। জোহান ওর উপর রাগ মিটাতে চাইছে? এত দিন যে ও জোহানের সাথে কঠিন আচরণ করেছে, তার সব শোধ যদি জোহান আজ এক সাথে নেয়, তাহলে? মিতুলের শরীরে ভয়ের স্রোত বইছে। গায়ের ফোরাক বোধহয় ভিজে গেছে ঘামে। জোহান সত্যিই এটা করতে পারবে ওর সাথে? কী করে এত নিষ্ঠুর পরিচয় দিতে পারে জোহান? কী করে?
মিতুল চাইছে নিজের পা দুটোকে থামাতে। কিন্তু পা দুটো থামছে না, কোনো এক মায়া যেন ওর পা দুটোকে বশ করে ফেলেছে। ও থামছে না। ক্রমাগত হেঁটে চলছে, আর চলছে।

এতক্ষণে জঙ্গলের অনেক গভীরে ঢুকে পড়েছে বোধ হয়। আশপাশে তাকাতেও খুব বেশি ভয় লাগছে। তবুও একবার তাকালো চারপাশটায়। আরে গাছ পালা তো আরও বেশি ঘন হওয়ার কথা। কিন্তু না। গাছপালা ঘন তো নয়ই বরং যেন খুব বেশি পাতলা হয়ে এসেছে। চাঁদের আলো হুড়মুড় করে জঙ্গলে ঢুকে আশপাশটাকে আলোকিত করেছে। মিতুল আকাশের দিকে তাকালো। চাঁদটা যেন ওর সাথে সাথে হাঁটছে। ও ভেবেছিল জঙ্গলে এত গাছপালা থাকবে যে আকাশের তিল পরিমানও দেখতে পাবে না। কিন্তু এখন তো দেখলো আকাশটা বেশ ভালোই দেখা যাচ্ছে। তেমন কোনো গাছই নেই। বলতে গেলে ফাঁকা। মিতুল পিছনে ফেলে আসা পথটাকে দেখলো একটু পিছন ফিরে। ওদিকটায়ও ভালোই চাঁদের আলো। তবে একেবারে ওই দূরের জায়গাটা নিকষ কালো। আর ওই কালো অন্ধকার জায়গাটা ভেদ করেও ওপাশে সোনালী রঙের আভা দেখা যাচ্ছে ঝাপসা ভাবে। বাড়ির গার্ডেনের লাইটের আলো না কি?
মোবাইলে লাইট জ্বলছে। তবে মনে হচ্ছে লাইট না জ্বললেও ভালোই পথচলা যাবে। কারণ প্রচুর চাঁদের আলো প্রবেশ করেছে জঙ্গলে। মিতুলের মনে হচ্ছে ও যেই জঙ্গলকে দেখতো গার্ডেনে বসে, এটা সেটা নয়। মনে হচ্ছে ও ভুল করে অন্য কোনো জঙ্গলে এসে পড়েছে। কিন্তু এলো তো সেই পথ দিয়েই। কিছু বুঝতে পারছে না।
মিতুল আশপাশটা ভালো ভাবে দেখছে। স্বপ্নের কথা মনে করলো খুব ভালো ভাবে। স্বপ্নে দেখেছিল সারি সারি কবর আর প্রচুর গাছপালা। স্বপ্নে যা দেখেছে তার কানা কড়িও মিলছে না বাস্তবতার সাথে।
সরু রাস্তাটা বাঁক নিলো বামে। মিতুল বেশ কিছুটা দূরে আলোর মতো কিছু দেখতে পাচ্ছে। কী ওগুলো? ও এগিয়ে যেতে লাগলো ওই আলো লক্ষ করে। কিন্তু আর কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে যা দেখলো তা ছিল ওর কাছে অভাবনীয়!

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here