চৈতালি_পূর্ণিমা,পর্ব-১২
Writer_Asfiya_Islam_Jannat
নিশীথের শেষলগ্ন পেরিয়ে পুবাকাশে আর্বিভাব হলো প্রভাতের। নির্মল অনিলে ভাসছে পাখিদের মিষ্ট কন্ঠ। নিস্তব্ধতা কাটিয়ে বিকট শব্দ করে রাস্তার পাশ দিয়ে চলে যাচ্ছে দানব আকৃতির ট্রাকগুলো। সেই শব্দেই ব্যাঘাত ঘটলো স্পর্শীর ঘুমে। ঈষৎ নড়েচড়ে চোখ পিটপিট করে তাকালো সে। তন্দ্রা কাটেনি তখনও তার, চোখের পাতা বুঝে আসতে চাইছে বারংবার। বহু কষ্টে চোখের কপাট মেলে ধরলো সে। চারদিকে চোখ বুলিয়ে বুঝার চেষ্টা করলো নিজের অবস্থান। নিশ্চল মস্তিষ্কে মনে করার চেষ্টা করলো গতরাতের কথা। নিজের গন্তব্যের কথা মনে পড়তেই পাশ ফিরলো স্পর্শী। কপালে একহাত ঠেশ দিয়ে ড্রাইভিং সিটে মাথা হেলিয়ে চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে নির্বাণ। নির্বাণকে দেখে স্পর্শী নিজের অজান্তেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। অতঃপর আশেপাশে তাকালো। রাস্তার ধারে কোন এক রেঁস্তোরার সামনে গাড়িটি থামানো। একটানা ড্রাইভ করার পর হয়তো বিরতি নেওয়ার উদ্দেশ্যেই এইখানে গাড়ি পার্ক করেছে নির্বাণ, ধরে নিল স্পর্শী৷ সে আড়মোড়া ভেঙে উঠতে নিলে নিজের গায়ে জড়ানো কালো রঙের জ্যাকেটটি দেখে থমকালো। স্তম্ভিত, বিমূঢ়, কৌতূহলী চোখে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো নিজের দিকে। বিরবির করলো,
“এইটা কার? রাতে তো আমি গায়ে কিছু জড়িয়ে ঘুমাই নেই।”
পরক্ষণেই তাকালো নির্বাণের মুখপানে। ঘটনাক্রমে বুঝে উঠতে স্পর্শীর বেগ পেতে হলো না। উপরন্তু, জ্যাকেটের গা থেকে আসা পুরুষালি সুগন্ধি জানান দিয়েই দিচ্ছে নিজ মালিকানার। অজ্ঞাতসারে স্পর্শীর ঠোঁটের কোনে ফুটে উঠে সরু হাসি। পরক্ষণে খেয়াল করলো, তার সিটটি বেশ হেলানো। যেটাও সে করে নি। স্পর্শী পুনরায় তাকালো নির্বাণের দিকে। হাসিটা সমৃদ্ধ হলো এইবার। ধাতস্থ হলো মন, হৃদয়ের অন্তঃস্থলে ছেঁয়ে গেল মুগ্ধতা। সে গভীর দৃষ্টিতে তাকালো নির্বাণের পানে। মুখে ক্লান্তির রেশ বুঝা যাচ্ছে প্রখরভাবে। চুলগুলো আগোছালো হয়ে পড়ে আছে কপালে। বাদামী ঠোঁট দু’টি হাইড্রোজেনের অভাবে মরুভূমির দশা। রুক্ষ,শুষ্ক। ধূসর রঙ্গের ফুলস্লিভ শার্টটির হাতা কুনোই অব্দি গোটানো। এই প্রথমবারের মত স্পর্শীর খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলো শ্যাম পুরুষটিকে। মোহগ্রস্ত হলো আগোছালো মানুষটির উপর। সুপ্তভাবেই মনের একাংশ জায়গায় বরাদ্দ হলো একান্ত মানুষটির নামে।
অকস্মাৎ নির্বাণ চোখ খুলে। পাশ ফিরে স্পর্শীর দিকে তাকাতেই দুইজনের চোখাচোখি হয়ে যায়। মুহূর্তেই স্পর্শী অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। তটস্থ,ব্যগ্রতা ঘিরে ধরতেই দ্রুত নিজের দৃষ্টি সরিয়ে বাহিরের দিকে তাকায় সে। নির্বাণ তা দেখে কিঞ্চিৎ হাসে, মন্থর কন্ঠে জিজ্ঞেস করে, “ঘুমন্ত আমিটার থেকে তার চোখ সরে না আর জাগ্রত আমিটাকে তার চোখে পড়ে না। কি অদ্ভুদ!”
কথাটা কর্ণগোচর হওয়া মাত্র স্পর্শীর মেদুর গালে ছেঁয়ে গেল রক্তিমা। চোখে লজ্জার স্পষ্ট জানান। অভিব্যক্তি ঠিক হাতেনাতে ধরা পড়ে যাওয়া চোরের ন্যায়। স্পর্শী দৃষ্টি নত করে নিল, নিজেকেই আনমনে বকলো। কেন সে বেহায়ার মত এতক্ষন তাকিয়ে ছিল তার দিকে? আর নির্বাণই বা কেমন? মুখের উপর কিভাবে বলে দিল কথাটা? এইসব ভেবে পরক্ষণেই নিজের দোষকে লুকায়িত করার বৃথা চেষ্টা করে অস্ফুটস্বরে বলল,
“ভুল বুঝছেন আপনি, আমি আপনার দিকে তাকিয়ে ছিলাম না।”
নির্বাণ ভ্রু কুঁচকে বলে, “আমি কখন বললাম তুমি আমার দিকে তাকিয়ে ছিলে?”
স্পর্শী এইবার ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। বিহ্বল দৃষ্টিতে তাকায় নির্বাণের পানে, “তখন না বললেন?”
“আমি তো কারো নাম উল্লেখ করেনি। তুমি কিভাবে বুঝলে কথাটা আমি তোমাকে বলছি? তাহলে কি আমি ধরে নিব তোমার দৃষ্টিতে আমাতে নিবদ্ধ ছিল?”
স্পর্শী তটস্থ হয়ে তাকায় নির্বাণের পানে। মানুষটা যে নিদারুণভাবে কাউকে কথার জাল ফাঁসাতে পারে তা স্পর্শীর জানা হয়ে গিয়েছে। নির্বাণের সাথে কথা বাড়ানো মানেই নিজের পায়ে কুড়াল মারা৷ স্পর্শী নিজের দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিয়ে নিরুত্তর বসে থাকে। তা দেখে নির্বাণ ঈষৎ হেসে জিজ্ঞেস করে,
“কখন উঠেছ?”
স্পর্শী দৃষ্টি বাহিরের দিকে স্থির রেখে স্বগতোক্তি কন্ঠে বলে, “এইতো কিছুক্ষণ আগেই।”
“আচ্ছা! ফ্রেশ হবে?”
“হওয়া দরকার।”
“তাহলে বের হও। এইখান থেকে ফ্রেশ হয়ে একবারে নাস্তা সেরেই না-হয় আবার রওনা দিব।”
স্পর্শী একপলক নির্বাণের দিকে তাকিয়ে সম্মতি জানালো। নির্বাণ নেমে পড়তেই স্পর্শীও নীরবে নেমে পড়লো গাড়ি থেকে।
________________
বিস্তৃত এক বাড়ির সামনে এসে গাড়ি থামতেই স্পর্শী জানালার বাহিরে তাকায়। অতঃপর নির্বাণের দিকে তাকায় কৌতূহলী দৃষ্টিতে। নির্বাণ স্পর্শীর দৃষ্টির অর্থ বুঝতে পেরে বলে,
“এসে পড়েছি আমরা।”
স্পর্শী এইবার ধাতস্থ হয়। মিইয়ে যাওয়া কন্ঠে জিজ্ঞেস করে, “বিয়েটা আসলে কার? মা বলেছিল, তবে আমার খেয়াল নেই। ”
“আমার মামাতো ভাইয়ের। এইটা আমার নানাবাড়ি।”
স্পর্শী ঠোঁট গোল করে বলে, “অহ আচ্ছা।”
কিছুটা সময় নীরব থেকে নির্বাণ এগিয়ে এলো স্পর্শীর অতি নিকটে। নির্বাণকে কাছে আসতে দেখে স্পর্শী চোখ গোলগোল করে তাকায়। নির্বাণ সে দৃষ্টি তোয়াক্কা না করে স্পর্শীর দিকে হালকা ঝুঁকে খুলে দিল সিটবেলটি। অতঃপর খুব সপ্তপর্ণে স্পর্শীর পড়ে যাওয়া ঘোমটাটুকু পুনরায় মাথায় তুলে দিয়ে মিইয়ে যাওয়া কন্ঠে বলে, “নাও পার্ফেক্ট!”
নির্বাণের এত কাছে আসায় স্পর্শীর প্রায় রুদ্ধশ্বাস অবস্থা। অকস্মাৎ ভাবেই তার হৃদস্পন্দনের গতি বেড়ে যায় কয়েক’শ গুণ। অনুভূতিগুলো জট পাকিয়ে আসে। নির্বাণ ওর কাছ থেকে সরে আসতেই স্পর্শী দীর্ঘ এক নিঃশ্বাস নেয়। নির্বাণ তা দেখে বলে,
” নামো এখন।”
স্পর্শী বিনাবাক্যে নেমে পড়লো। অভিব্যক্তি এমন সে আর এক বিলম্ব নির্বাণের নিকট অবস্থান করলে তৎক্ষনাৎ হার্ট এট্যাক করে মারা পড়বে। লজ্জালু ভাব ছেঁয়ে আছে মুখশ্রী জুড়ে৷ স্পর্শীর কর্মকাণ্ড দেখে নির্বাণ ঠোঁট কামড়ে আসে। অতঃপর গাড়ি থেকে নেমে, পিছন থেকে ব্যাগগুলো নিয়ে এগিয়ে গেল ভিতরের দিকে। স্পর্শী তারই পিছু পিছু ছুটলো। কলিংবেল চাপতেই মধ্যবয়সী এক মহিলা এসে দরজা খুলে দেন। অতঃপর নির্বাণকে দেখতে পেয়ে স্মিত হেসে বললেন, “আরেহ নির্বাণ যে! পাশে কি বউ মা নাকি?”
নির্বাণ মন্থর কন্ঠে বলল, “হুম!”
আলিয়া স্পর্শীর দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাতেই স্পর্শী তাকে সালাম দেয়। আলিয়াও সালামের প্রত্যুত্তর করে তাদের ভিতরে নিয়ে আসে। ভিতরে আসতেই চারিদিকে চোখ বুলায় স্পর্শী। পরিবেশটা মাত্রাতিরিক্ত পরিমাণে নীরব। আশেপাশেও মানুষজন তেমন নেই। দুই-একজনকে দেখা যাচ্ছে ডায়নিং এর কাছাকাছি। বিয়ে বাড়ি হিসাবে যে আমেজ,কোলাহল,আড়ম্বর থাকে তার কিছুই নেই। উপরন্ত, রাতে হলুদ হওয়ার কথা। সে হিসাবে এত নীরব পরিবেশ ঠিক হজম হলো না স্পর্শী। সে বিভ্রান্ত দৃষ্টিতে তাকালো নির্বাণের দিকে। নির্বাণের কপালেও তখন সুক্ষ্ম ভাঁজ। নির্বাণ কৌতূহলী কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,
“মেজো মামি,কিছু কি হয়েছে? সবাই কোথায়? পরিবেশ এত ঠান্ডা কেন?”
নির্বাণের সম্মোধন শুনে এতক্ষণে স্পর্শী জ্ঞাত হলো সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটির পরিচয় সাথে। স্পর্শীও এইবার উৎসুক ব্যগ্র দৃষ্টিতে তাকালো আলিয়ার দিকে। আলিয়া স্বতঃস্ফূর্ত কন্ঠে বলে,
“বড় ভাইজান গতকাল সকালে স্ট্রোক করেছিলেন। তাকে দেখতেই অধিকাংশ মানুষ হসপিটালে গিয়েছে৷”
নির্বাণ বিস্ময়বিমূঢ় কন্ঠে বলে, “আমাকে আগে জানাও নি কেন? বড় মামার কি অবস্থা এখন?”
আলিয়া বলে, “তোর মা মানা করেছিল। চিন্তায় ফেলতে চায়নি তাই বলেনি কেউ তোকে। আর ভাইজান এখন মোটামুটি সুস্থ। মিনি স্ট্রোক করেছিলেন।”
“মা কোথায়?”
“তোর মা হসপিটালেই আছে। দুপুর হওয়ার আগেই হয়তো এসে পড়বে। তুই আসবি বলে আমি বাসায় ছিলাম।”
“কোন হসপিটালে নিয়েছে বড় মামাকে বল। আমি এখনই যাচ্ছি।”
আলিয়া আশ্বস্ত কন্ঠে বলেন, “আরেহ শান্ত হ। ভাইজানকে আজকের মধ্যে ছেড়ে দিবে, বাসায় আসলে দেখা করে নিস। এখন জার্নি করে এসেছিস, আগে হাত-মুখ ধুয়ে নে।”
নির্বাণ উৎকন্ঠা হয়ে বলে, “নামটা বলবে তুমি?”
আলিয়া দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে হসপিটালের নামটা বলে দেন। কারণ সে জানেন, হসপিটালের নাম না জানা অবধি নির্বাণ ক্ষান্ত হবে না। নির্বাণ ঠিকানা পেয়ে আলিয়ার দিকে তাকিয়ে বলে, “তুমি একটু ওর খেয়াল রেখো৷ নতুন পরিবেশ, কখন কি দরকার পড়ে বলা যায় না। আর ব্যাগগুলো কাউকে দিয়ে রুমে পাঠিয়ে দিও। প্রচন্ড ভারী এইগুলা।”
আলিয়া আশ্বস্ত কন্ঠে বলে, “আচ্ছা তুই যা। আমি খেয়াল রাখব নে।”
আলিয়ার কথায় ভরসা পেয়ে নির্বাণ স্পর্শীর দিকে তাকিয়ে দ্রুত গতিতে বলে,
“আমি এখন যাচ্ছি, কখন ফিরবো ঠিক নাই৷ তোমার কোন অসুবিধা হলে মেজো মামীকে বলবে।”
স্পর্শী দৃষ্টি নত করে বলে, “আমি যাই আপনার সাথে?”
নিবার্ণ একমুহূর্তের জন্য থমকে বলে, “আপাতত দরকার নেই। সারারাত জার্নি করেছ, ক্লান্ত তুমি। রেস্ট নাও। প্রয়োজন মনে করলে আমি এসে নিয়ে যাব তোমায়।”
স্পর্শী প্রত্যুত্তর করতে গিয়ে করলো না। কিছু একটা ভেবে নীরব থাকলো। অতঃপর আলতো ভাবে মাথা দুলিয়ে সম্মতি জানালো। নির্বাণ আর এক মুহূর্ত বিলম্ব না করে লম্বা লম্বা পা ফেলে বেরিয়ে গেল বাসা থেকে। স্পর্শীও সেই পানে তাকিয়ে থাকলো এক দৃষ্টিতে।
নির্বাণ চলে যেতেই আলিয়া এগিয়ে এসে বলে, “তোমার নাম কি?”
আলিয়ার কন্ঠ কর্ণপাত হতেই স্পর্শী দৃষ্টি দরজা থেকে সরিয়ে নিয়ে আলিয়ার দিকে তাকায়৷ মিইয়ে যাওয়া কন্ঠে বলে, “ইফাত আরা স্পর্শী।”
আলিয়া স্মিত হেসে বলে, “তোমার মত নামটাও বেশ মিষ্টি। এখন আসো, আমি তোমাকে রুম দেখিয়ে দেই। মুখ-হাত ধুঁয়ে নাস্তা করে নিও।”
স্পর্শী আলতো ভাবে মাথা হেলিয়ে সম্মতি জানালো। আলিয়া ভিতরের দিকে যেতে যেতে বললেন, “ছেলেতা ছোট থেকেই বড় ভাইজানকে অনেক মান্য করে, বুঝলা। তাই তার অসুস্থতার কথা শুনে স্থির থাকতে পারলো না, ছুটে গেল।”
স্পর্শী ছোট করে বলল, “জি!”
আলিয়া দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, “অবশ্য! বড় ভাইজান ওদের জন্য যা করেছেন এরপর মান্য না করে কি পারে? বাপছাড়া ছেলে দুইটার জন্য অনেক করেছেন তিনি৷ নিজের সন্তান থেকে কখনো কম ভাবেন নাই।”
কথাটার পৃষ্ঠে স্পর্শী ভ্রু কুঁচকে আসে। কিঞ্চিৎ পরিমাণ কৌতূহল জাগে মনের মাঝে, তবে প্রকাশ করে না৷ নীরব থাকে। আলিয়া স্পর্শীকে একটা রুম দেখিয়ে দিয়ে চলে যান। যাওয়ার আগে বলে যান, স্পর্শী কোন দরকার পড়লে তাকে যেন গিয়ে বলে। সে রান্নাঘরে আছে। আলিয়া চলে যেতেই একজন এসে নির্বাণ আর তার ব্যাগ রুমের মধ্যে দিয়ে যায়। লোকটি চলে যাওয়ার পর স্পর্শী দরজা ভিজিয়ে পার্স ব্যাগ থেকে ফোন বের করে সাহেলাকে জানিয়ে দেয় সে পৌঁছে গিয়েছে। অতঃপর কিছুক্ষণ কথা বলে ব্যাগ থেকে এক সেট কাপড় বের করে চলে যায় ফ্রেশ হতে।
চলবে