চৈতালি_পূর্ণিমা,পর্ব-৩১

2
2919

চৈতালি_পূর্ণিমা,পর্ব-৩১
Writer_Asfiya_Islam_Jannat

প্রখর অনিলের দোলে আঁধারিয়া আকাশে এদিক-সেদিক ভেসে বেড়াচ্ছে কৃষ্ণমেঘের ভেলা৷ সবুজবর্ণ পাতাগুলোর কাগজী গায়ে বাতাসের দল আঁচড় কাঁটতেই মড়মড় শব্দ করে কুঁকড়ে উঠছে তারা৷ চারদিকে ধুলোবালি মিশে একাকার। মেঘ-বর্ষণের প্রতিক্ষায় ছত্রভঙ্গ নগরী। জানালার ঝারে অকৃত্রিম আলোর ছটা এসে হানা দিতেই নির্বাণ দৃষ্টি সেদিক গেল। একপলক সেদিকে তাকিয়ে পুনরায় ল্যাপটপের স্ক্রিনে নজর দিল৷ দক্ষ দ্রুতগামী হাত পুনরায় বিচরণ করতে শুরু করলো কি-বোর্ডেরের উপর। অসম্পূর্ণ ই-মেইলটি পূর্ণ করতে ব্যস্ত সে। স্পর্শী বিছানায় হেলান দিয়েই সেদিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। কাজ শেষ হওয়ার অপেক্ষায়। ধীরে ধীরে কি-বোর্ডের উপর থেকে তার হাতের গতি কমলো এবং একসময় স্থির হলো। স্পর্শী দৃষ্টি সরালো, মনে মনে সাহস সঞ্চয় করে ভাবা কথাগুলো আরেকবার গুছিয়ে নিল। নিম্নস্বরে জিজ্ঞেস করলো, “আপনার কাজ কি শেষ হয়েছে?”

নির্বাণ পিছন ঘুরে তাকালো, “হ্যাঁ প্রায় শেষ। এডিট করে জাস্ট সেন্ড করাই বাকি এখন। কেন?”

স্পর্শী দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললো, “কিছু কথা ছিল আপনার সাথে।”

নির্বাণ ল্যাপটপের স্ক্রিনে তাকিয়ে ফাইলটা সেভ করতে করতে বলল, “হুন বল।”

“কথাটা দরকারী নির্বাণ।”

জোর গলায় বলল স্পর্শী। নির্বাণ ভ্রু কিছুটা সংকীর্ণ হলো, সে স্থিরচিত্তে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো স্পর্শীর মুখ পানে, “আচ্ছা, দাঁড়াও।”

কথাটা বলে হাতের কাজটা সেরে ল্যাপটপটা অফ করে দিল নির্বাণ। পূর্ণ দৃষ্টিতে স্থাপন করলো স্পর্শীর দিক। স্পর্শী একটু নড়েচড়ে বসলো, সত্য বলার সাহসটুকু জুগিয়ে নিয়ে বলতে শুরু করলো, “আমার অতীত আপনার অজানা হলেও অতীতের কয়েকটা বিষয় সম্পর্কে আপনার জানা অতি জরুরি। কারণ আমি চাচ্ছি না সামনে গিয়ে এইটা আপনি বাহির কারো থেকে জানুন বা এ বিষয়গুলো নিয়েই আমাদের মাঝে কোন প্রকার ঝামেলা সৃষ্টি হোক। তাই আগেই আমি সবটা আপনার কাছে তুলে ধরতে চাইছি।”

নির্বাণের ভ্রু পুনরায় সংকীর্ণ হয়ে এলো, “কি বলতে চাইছো বল।”

স্পর্শী লম্বা নিঃশ্বাস নিল, “বিয়ের আগে আমি একটা রিলেশনশিপে ছিলাম এবং সেই রিলেশনের মেয়াদসীমা ছিল দুই থেকে তিনমাস। সম্পর্কটার বয়সসীমা কম হলেও এটি আমার জীবনের সাথে অনেক বাজেভাবে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে আছে। বলতে, পরোক্ষভাবে আমার বিয়ে করার পিছনেও এই সম্পর্কটাই কারণ ছিল।”

নির্বাণ অনিমেষ দৃষ্টিতে তাকালো, কোন শব্দ উচ্চারণ করলো না মুখে। নির্বাণকে নীরব থাকতে দেখে স্পর্শী মাথা নুয়ে নিল, থুতনি গিয়ে ঠেকলো গলার কাছে। বলতে শুরু করলো সে, “আমার ফ্রেন্ড নন্দিতার বয়ফ্রেন্ডের বন্ধু ছিল সে। রুদ্র নাম তার। নন্দিতার একবার তার বয়ফ্রেন্ডের সাথে দেখা করবে বলে আমাকে নিয়ে গিয়েছিল সেখানেই রুদ্রের সাথে প্রথম পরিচয় আমার। কথায় কথায় জানতে পারি আমাদের ভার্সিটিতেই পড়ে, মাস্টার্স কমপ্লিট করছে সে। তো সেদিনের পর থেকেই আমাদের টুকটাক কথা শুরু এবং ছয়মাসের মাথায় সে আমাকে প্রাপোস করে। আমি প্রথমে না করলেও ফ্রেন্ডরা বুঝায় যে ছেলে হিসাবে নাকি সে ভালো। নন্দিতাও আমাকে কনভিন্স করার চেষ্টা করে রুদ্র আমাকে অনেক ভালোবাসে, সে আমাকে ভালো রাখবে। এদিকে রুদ্রও আমার পিছনে একবার হাত ধুঁয়ে পড়েই ছিল। অতঃপর আমিও শেষে তাকে হ্যাঁ বলে দেই। তার প্রতি আমার ফিলিংস ছিল বা সে আমার দূর্বলতা ছিল এমন না, ফ্রেন্ডদের কথায় তাকে একটা সুযোগ দিয়েছিলাম। সেখান থেকেই সম্পর্কটার শুরু৷ আমি সবসময়ই চেষ্টা করেছি দূরত্ব মেনে চলাফেরা করার। হাত ধরা,কথায় কথায় গায়ে হাত দেওয়া, কাছাকাছি আসা এসব আমার কোনকালেই পছন্দ ছিল না তাই রুদ্রকে এইসব করতেই আগেই মানা করেছিলাম। সেও তখন আমার কথায় রাজি ছিল। দেড় মাস ভালোয় ভালোয় এই কেটে গিয়েছিল সময় কিন্তু সমস্যা শুরু হয় এরপরে। রুদ্র কেমন যেন বদলে যায়, কাছে আসার চেষ্টা করতে থাকে। তখন সবকিছু সর্বশেষ অপ্রীতিকর প্রস্তাব দিতেও পিছ-পা হয় না। ওর এমন আচরণে আমি বিরক্তি হয়ে গিয়ে শেষে ব্রেকাপের কথা বলি। তখন সে কিছুটা দমে গিয়ে আমার কাছে মাফ চায় এবং বলে সে আর এমন আর কখনো করবে না। প্রায় সপ্তাহ খানেক আমার পিছে লেগেছিল সে এবং শেষে আমিও আরেকটা সুযোগ দিয়েছিলাম। প্রথম কয়েক সপ্তাহ ভালো গেলেও শেষে একদিন রুদ্র আমায় এক নির্জন জায়গায় ডাক দেয়। জায়গায়টা আমার বাসা থেকে প্রায় ঘন্টাখানেকের দূরত্বে হওয়ায় আমি রাজি হয়নি, পাশের একটা পার্কেই ওকে বলি দেখা করতে। রুদ্র প্রথমে নাকচ করলেও পরবর্তীতে আসে এবং সেখানেই আমার সামনে একটা কু-প্রস্তাব রেখে দেয়। যা ছিল অতি মাত্রায় জঘন্য। আমি ওর মুখের উপর না বলে চলে আসতে নিলে সে আমার হাত টেনে ধরে এবং…….”

কথাটা শেষ না করেই স্পর্শী থেমে যায়। নয়ন জোড়ায় তখন তার আগ্নেয়গিরির ভয়ংকর উত্তাপ। কিয়দংশ সময় শব্দহীন থেকে স্পর্শী পুনরায় বলে উঠে, “এবং আমার সাথে জোড়াজুড়ি করা শুরু করে। পার্কে তেমন মানুষ না হলেও আশে-পাশে অল্পসংখ্যক মানুষ থাকায় তেমন জোড় দিতে পারেনি। আর আমি সেই সুযোগটাই কাজে লাগিয়ে চিল্লাতে থাকি, আমার আওয়াজ শুনে মানুষ জড়ো হলেই রুদ্র আমার হাত ছেড়ে দেয়। তখন আমি শুধু ওকে একটা থাপ্পড় মেরে তৎক্ষনাৎ সকল সম্পর্ক শেষ করে দৌড়ে চলে আসি। বাসায় এসে আগেই সকল জায়গায় থেকে ওকে ব্লক করে দেই৷ রাগে আমার শরীর তখন রি রি করে কাঁপছিল। না পারছিলাম কিছু বলতে, না পারছিলাম সইতে৷ বাসায় তখনও কেউ জানতো না আমার এই সম্পর্কের কথা, একমাত্র সামান্ত আপু বাদে৷ কিন্তু তখন আপু নেটওয়ার্কের বাহিরে ছিল বিধায় যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। অতঃপর বন্ধুদের জানিয়েছিলাম। নিজের রাগ-ক্ষোভ-ঘৃণা নিয়ন্ত্রণ আমার জন্য দায় হয়ে পড়েছিল।
নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ তো হচ্ছিলই না, তার উপর ঘটনাটা বার বার তাড়া দিচ্ছিল আমায়। এদিকে, সেই ঘটনার কয়েকদিন আগেই লতিফ আঙ্কেল আমার বিয়ের জন্য একটি সম্বন্ধ এনেছিল। পাত্র হিসাবে সেই ছেলেকেই বাবা-মার অনেক মনে ধরে যায় এবং আমাকে সেই সম্বন্ধে রাজি হয়ে যেতে বলে। আমি যখন রুমে বসে রাগে ফুঁসছিলাম তখনই মা আবার আসেন আমায় বিয়ের কথা বলতে৷ মাকে দেখে তখন আমার রাগ না বরং
গিল্টি ফিল হচ্ছিল কারণ আমি তাদের ভরসা ভেঙ্গে ছিলাম। তাদের কিছু না বলে এমন এক সম্পর্কে জড়িয়ে গিয়েছিলাম যেখানে কি-না আজই হয়তো আমার সর্বনাশ নিশ্চিত ছিল। নিজের গায়ে কলঙ্ক লাগতো তো লাগতো, বাবা-মাও অসম্মানিত হতো। সমাজে আমাদের অবস্থানই বদলে যেত। ঘটনার আকস্মিকতায়, ক্রোধে,ক্ষোভে,অনুশোচনা,বিমূঢ়টায় তখনই আমি পাত্রের কোন খোঁজখবর না নিয়ে, ছবি না দেখেই মাকে বিয়ের জন্য হ্যাঁ বলে দেই। এরপরের ঘটনাগুলো খুব তো দ্রুতই হয়েছিল তাই বেশি ডিটেইলসে আর বলছি না। ছোট করে বলতে, আমি হ্যাঁ বলার সপ্তাহখানেকের মধ্যে কথাবার্তা সব ঠিক হয়ে পাত্রপক্ষ এলো আমায় দেখতে। সেখানেই প্রথম দেখা হয় আপনার সাথে এবং ঘটনাক্রমে কিছু বুঝে উঠার আগেই আমাদের বিয়েটা হয়ে যায়।”

সবটা বলে স্পর্শী দম নেয়। সত্যটা বলার পর তার মনটা এখন হালকা হালকা লাগছে। সে দীর্ঘ এক নিঃশ্বাস ফেলে নির্বাণের দিকে তাকায়। নির্বাণ তখনও স্থিরচিত্তে বসে আছে, তার মধ্যে কোনপ্রকার হেলদোল দেখা দিল না। স্পর্শীর মনে এবার ভীতি কাজ করতে শুরু করলো, “নির্বাণ কিছু বলছে না কেন? সে কি আমাকে ভুল বুঝলো? বিষয়টা আমি বেশি আগোছালো করে ফেললাম?” কিছু জিজ্ঞেস করারও সাহস আর জুগাতে পারলো না স্পর্শী।

বাহিরে তখন ঝুম বৃষ্টির আবির্ভাব। শীতল পানির বড় বড় ফোঁটা হানা দিচ্ছে দক্ষিণা জানালার ধারে৷ মাঝে মধ্যে মেঘরাজ নিজের শক্তি প্রদর্শন করতে গর্জে উঠছে, অলৌকিক দ্যুতি ছড়াচ্ছে ঘনীভূত মেঘের অন্তরালে। জানালার অপরপ্রান্তে প্রকৃতির তান্ডব চললেও, তার এপ্রান্তের পরিবেশ প্রচন্ড নিভৃতে,নৈঃশব্দ্যে ঘেরা। কিয়ৎক্ষণ পর গম্ভীর পরিবেশটা ভেঙে নির্বাণ বলে উঠে, “তার সাথে কি তোমার এখনো যোগাযোগ আছে?”

“না নেই।” স্পর্শীর নিম্ন কন্ঠের উত্তর।

“রাস্তা-ঘাটে বা ভার্সিটিতে বিরক্ত করে তোমায়?”

স্পর্শী দৃষ্টি তুলে একপলক নির্বাণের দিকে তাকালো, “প্রথম দিকে একটু করেছি তবে এখন আর করে না।”

“ওই ছেলেটার ইনফরমেশন আমাকে দিও তো।”

“সেটা দিয়ে আপনি কি করবেন?”

“দরকার আছে।”

নির্বাণের শীতল কন্ঠে বাণী শুনে স্পর্শীর মন ক্ষুণ্ণ হলো। সে মুখ ছোট করে বলে, “আচ্ছা।”

সে ভেবেই নিল নির্বাণ তার প্রতি রাগান্বিত। হয়তো সত্যটা দেরিতে বলেছে বলে অথবা অন্য কারণও হতে পারে। তবুও স্পর্শী ক্ষুদ্র চেষ্টা করলো বিষয়টা
স্পষ্ট করার, “আপনার সাথে আমার সম্পর্ক প্রথম দিকে এত সহজ ছিল না, সে সাথে আমি সম্পর্কটার ভবিষ্যৎ নিয়েও অনিশ্চিত ছিলাম তাই আগে আপনাকে কথাগুলো জানানো প্রয়োজনবোধ করিনি। কিন্তু এখন আপনি আমার জীবনের খুব গুরুত্বপূর্ণ কেউ একজন, আমার সম্পর্কে প্রত্যেকটা কথা আপনার জানার অধিকার আছে তাই সত্যটা লুকালাম না৷ এখন আপনার মনে যদি আমাকে নিয়ে দ্বিতীয় কোন ধারণা থাকে তাহলে বলতে পারেন।”

স্পর্শীর কথা শুনে নির্বাণ একমুহূর্তের জন্য নিঃশব্দ রইলো। অতঃপর বলল, “যতক্ষণ পর্যন্ত তোমার বর্তমান আর ভবিষ্যৎ একান্ত আমি, ততক্ষণ পর্যন্ত তোমার অতীত নিয়ে আমার মনে কোন ভাবনা নেই। এখন তুমি যদি অতীত নিয়ে ভাবো তাহলে বলব, অতীতে তোমার গায়ে কলঙ্ক লাগলেও আমার জন্য এখন তুমি যা তাই থাকতে। কোন পরিবর্তন আসতো না তোমার প্রতি আমার আচরণে৷ তাই এসব নিয়ে ভেবো না৷ আমি আছি, আমি থাকব আজীবন৷”

কথাটা বলেই নির্বাণ স্পর্শীর সান্নিধ্যে এসে তার কপালে অঁধর ছুঁয়ে দিয়ে তার চুলের মাঝে হাত গলিয়ে দেয়। স্পর্শী আকস্মিক নির্বাণকে আলতোভাবে জড়িয়ে ধরলো, নিভৃতেই মুখ গুঁজলো তার বুকে। দুইজনের মাঝে চলল নীরব কথপোকথন। যা কি-না বর্ণ,অক্ষর,শব্দহীন হয়েও বুঝলো দুইজনেই। সম্পর্কের মানটা যেন বৃদ্ধি পেল এখানেই৷
দুইজনের মনের এক জায়গায় হলেও, নির্বাণের চোখের ভাষা ছিল অন্য। কিছুটা শুক্র, অনলপ্রভ মিশ্রিত। যেটা কি-না স্পর্শী ধরতেই পারলো না।

চলবে

2 COMMENTS

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here