চৈতালি_পূর্ণিমা,#পর্ব-৪৭ [বর্ধিতাংশ]

1
2371

#চৈতালি_পূর্ণিমা,#পর্ব-৪৭ [বর্ধিতাংশ]
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat

কাঁচা রাস্তার উপর রিকশা চলছে আপন গতিতে। অসমান জায়গায় চাকা পড়তেই ঝাঁকুনি দিয়ে উঠছে সশরীর। যতবারই এমন হচ্ছে সামনের দিকে হেলে পড়ছে স্পৃহা। বিরক্তি খেলা করছে চোখে মুখে তার।নাহিদ বিষয়টা খেয়াল করে নিঃশব্দে রিকশার হুট তুলে দেয়। স্পৃহার সামনে দিয়ে হাত নিয়ে অপরপাশে কাঠটা ধরে বসে থাকে সে৷ স্পৃহা এক পলক তাকিয়ে দৃষ্টি সরিয়ে নেয়। কিছু বলে না সে। মনে জাগে একটা প্রশ্ন, “নাহিদ কি তাহলে এখনো তার চিন্তা করে?”
তাদের প্রণয়ের সূচনা হয় সাদামাটাভাবেই। কক্সবাজার থেকে আসার পর সোশ্যাল মিডিয়ায় কানেক্টেড ছিল তারা। কথা চলতো প্রতিনিয়ত। ধীরে ধীরে, স্পৃহার অজান্তেই নাহিদ তার মনে বিশেষ একস্থান দখল করে ফেলে। আলাদা এক ভালোলাগা কাজ করতে শুরু করে তার প্রতি। আর এই ভালোলাগা যে কবে ভালোবাসায় পরিণত হয়ে যায় কে জানে। তবে মনের কথা প্রথমে নাহিদই বলেছিল। স্পৃহাও ফেরাতে পারিনি তাকে। সেখান থেকেই রচিত হয়েছিল তাদের প্রেমকথন। খুনসুটির মাঝেই যেতে শুরু করে তাদের সময়। তবে প্রণয়ের শুরু নাহিদ করলেও শেষ করেছিল স্পৃহা। বিশ্বাস ভেঙেছিল স্পৃহার যার দরুন আর এক প্রহর না ভেবে নাহিদের সাথে সকল সম্পর্ক ছিন্ন করে বসে সে। যদিও কারণটা ছিল দুইজনের কাছেই স্পষ্ট তবুও নাহিদের বলার ছিল অনেক কিছু। শুধু অপেক্ষায় ছিল একটি সুযোগের যা কি-না গিয়ে পেল আজ সে।

লোকালয় হতে কিছুটা দূরে অবস্থিত একটা পার্কে এসে বসে স্পৃহা আর নাহিদ। দুইজনই নিশ্চুপ। কথা শুরু করবে কোথা থেকে সেই দ্বিধায় আছে হয়তো। সময় গড়ায় ঈষৎ৷ স্পৃহা মাথা নুয়ে বসে ছিল তখন, নাহিদ বলে ওঠে, “ওই ভিডিওটা ওপেন কর তো যেটা সে রাতে তুমি আমাকে দিয়েছিলে।”

স্পৃহা দৃঢ় চোখে তাকায় নাহিদের পানে। ভিতরটা হাহাকার করে উঠে পরক্ষণে। মানুষটা কি ইচ্ছে করে করছে এসব? তাকে কষ্ট দিতে চাইছে? কম্পিত গলায় বলে সে, “কেন? আমাকে আরও কষ্ট দেওয়া বাকি আছে আপনার?”

নাহিদ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায়, “তোমাকে যদি আমার কষ্ট দেওয়ারই হতো তাহলে এখানে নিশ্চয়ই আনতাম না আমি তোমায়। এতক্ষণে তুমি আ….”

বাকি কথাটুকু আর না বলে হজম করে নেয় সে। অসম্পন্ন বাক্যটুকু স্পৃহাকে অস্বস্তিতে ফেলে দিবে ভেবে। নিজের রাগ কোনমতে সংযত করে বলে, “মাথা গরম কর না স্পৃহা। যা বলছি তা কর।”

স্পৃহা ক্ষণকাল স্থির হয়ে বসে থেকে ফোন ঘেটে সেই ভিডিওটি চালু করলো। ভিডিওতে দুইজন ব্যক্তি পাশাপাশি বসে আছে। তার মধ্যেই একজন হচ্ছে নাহিদ। পাশে এক রমনী, তাকে চিনে না স্পৃহা৷ অকস্মাৎ নাহিদ সেই রমনীর দিকে তাকিয়ে ‘আই লাভ ইউ’ বলে ওঠে। বিপরীতে রমনীটি খুশিতে আপ্লূত হয়ে ‘আই লাভ ইউ টু’ বলে নাহিদের গলা জড়িয়ে ধরে তার গালে ঠোঁট ছুঁয়ে দেয়। ভিডিওটি শেষ হয় এখানেই, পলকে চোখের কোণে জল ঝরে স্পৃহার। বক্ষঃস্থলে অস্বাভাবিক ব্যথা অনুভব হলো। ভালোবাসার মানুষটাকে অন্যের বাহুদ্বয়ে আবদ্ধ দেখা কোন নারীই বা সহ্য করতে পারে? আদৌ কেউ কি পারে?
স্পৃহা সে অবস্থায় পুনরায় সেই একই প্রশ্ন যে-টা সে মাস খানেক আগে করেছিল, “এবার বলুন, ভিডিওটা মিথ্যে। সব ছলনা। আপনি বলেন নি মেয়েটাকে ভালোবাসি কথাটা। বলুন!”

নাহিদ ঈষৎ সময় নীরব থেকে দ্বিতীয়বারের মত সেই অনাকাঙ্ক্ষিত স্বীকারোক্তিটিই করে, “ভিডিওটি মিথ্যে নয়।”

স্পৃহা তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে। চোখ ঘুরিয়ে তাকায় অদূর নিস্তেজ বৃক্ষের দিকে। নাহিদ বলে ওঠে, “তবে সত্যও নয়। এর পিছে অন্য কাহিনী আছে। ওয়েট!”

স্পৃহা ফিরে তাকায় না। পাথরের ন্যায় বসে থাকে। নাহিদ সেটা দেখে ফোন বের করে কাউকে কল করে। কয়েকবার রিং হতেই কল ধরে কেউ। প্রফুল্ল কন্ঠে বলে উঠে, “আরেহ কি ব্যাপার! আজ সূর্য কোনদিক দিয়ে উঠছে যে নাহিদ আমাকে ফোন করেছে? আ’ম ফিলিং ব্লেসড।”

নাহিদের চোয়াল শক্ত হলো, “জাস্ট সার্ট আপ তুহিনা। তোমার আজাইরা কথা শুনতে ফোন করিনি আমি। আমি শুধু আমার কয়েকটা প্রশ্নের উত্তর চাই।”

“এমন কি প্রশ্ন শুনি যে-টা নাকি তোমাকে বাধ্য করলো আমাকে ফোন করতে?”

“তুমি জানো না বুঝি? স্পৃহাকে ওই ভিডিও কেন দিয়েছ তুমি?”

তুহিনা হাসে। বলে, “ওকে সত্যিটা জানাতে। তুমি আর আমি দুইজন দুইজনকে ভালোবাসি, ও আমাদের মাঝে থার্ড পার্সোন। সো ওকে দূরে সরানোর দায়িত্ব আমার নয় কি?”

নাহিদ রেগে গিয়ে বলে, “ইউ বি*! কিসের ভালোবাসার কথা বলছো তুমি? তুমি আর আমি দেড় বছর আগেই ব্রেকাপ করে ফেলেছি। ফর গট সেক! বানোয়াট কাহিনী রটাবে না।”

“বাট আই স্টিল লাভ ইউ। তোমাকে ছাড়া আমার পক্ষে থাকা সম্ভব না। চল না আবার একসাথে হয়ে যাই৷ তোমাকে পাওয়ার জন্যই তো স্পৃহাকে আমি আমাদের সেই ভিডিওটা দিয়েছিলাম যাতে সে আমাদের মাঝ থেকে সরে যায়। আর ও গিয়েছেও, এখন তো কোন বাঁধা নেই। ফিরে আসো আমার কাছে।”

“গো টু হেল!”

কথাটা বলে নাহিদ ফোন কেটে দিয়ে নাম্বারটা ব্ল্যাকলিস্টে ফেলে দেয়। অতঃপর স্পৃহার দিকে তাকিয়ে বলে, “এবার বুঝেছ পুরো কাহিনী? নাকি এখনো না?”

স্পৃহা বলে না কিছু। শুধু আড়চোখে তাকায়। এতদিনের পরিচয়ে নাহিদের এমন রাগান্বিত রূপ প্রথমবারেই দেখছে সে। যার দরুণ কেমন ভীতি কাজ করছে তার প্রতি। এদিক নাহিদ দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলে, “তুহিনা আমার এক্স। ওর সাথে আমার মাস দুই-এক এর সম্পর্ক ছিল যা কি-না দেড় বছর আগেই শেষ হয়ে গিয়েছে। তবুও মেয়েটা পিছেই পড়ে আছে আমার। বলতে সাইকো ও একটা। কিভাবে তোমার খোঁজ পেয়েছে আমি জানি না, তবে আমাদের সম্পর্ক নষ্ট করতেই এটা করেছে ও। ভিডিও সেই সময়ের ছিল। বুঝতে পেরেছ নিশ্চয়ই এবার কাহিনীটা কি?”

স্পৃহা মন্থর কন্ঠে জিজ্ঞেস করে, “আপনি তো আগে কখনো আমাকে তুহিনার কথা বলেন নি। তাহলে আমি জানব কি করে?”

“সেটা আমার ভুল আমি জানি। ও আমার লাইফের ইমপোর্টেন্ট কোন পার্ট ছিল না তাই জানানোর কথা আমার মাথায়ও আসেনি। আর আমি কি জানতাম নাকি ওই এমন এক কান্ড করে বসবে?”

স্পৃহা কথা বলে না। কি বাই বলবে সে? সম্পূর্ণটাই ছিল যে ভুল বোঝাবুঝি। সে এতদিন নাহিদকে ভুল এই বুঝে এসেছিল। সুযোগ দেয়নি একবারও নাহিদকে নিজের কথা রাখতে দেওয়ার। নিজে তো কষ্ট পেয়েছেই, নাহিদকেও দিয়েছে। এখন এ ভুল শুধরাবে কি করে সে? স্পৃহাকে চুপ থাকতে দেখে নাহিদ বলে, “আগে যদি আমাকে কথা বলার সুযোগটুকু দিতে তাহলে ঘটনাটা এতদূর গড়াতো না। কিছু না জেনে শুনেই ভুল বুঝে গেলে আমায়। জানি, বিষয়টা সহজে নিতে পারোনি। তোমার জায়গায় অন্য কেউ হলেও হয়তো এমনই করতো। কিন্তু একটা কথা জানো কি? একটা সম্পর্কের প্রথম ভিত্তি হচ্ছে বিশ্বাস। ভুল বোঝাবুঝি বহুবার হবে এবং সেটার সমাধান তোমাকেই করতে হবে। দোষী হলে শাস্তি দাও মানুষটাকে সমস্যা নেই কিন্তু সত্যটা জেনে নাও আগে।”

স্পৃহা মাথা নুয়ে ফেলে। চোখের চশমা ঝাপসা হয়। মৃদু কন্ঠে বলে, “সরি। এসব আমার দোষই।”

“তোমাকে আমি দোষ দিতে পারছি না কারণ আমি জানি তুমি এখনো ইমম্যাচিউর। এত ভাবনা নিয়ে তুমি কোন জিনিস পর্যবেক্ষণ কর না। কিন্তু এভাবে সম্পর্কও টিকে না।”

স্পৃহা তৎক্ষনাৎ নাহিদের হাত ধরে বলে, “আর কখনো আমি তোমায় ভুল বুঝবো না। আই প্রমিস! প্লিজ এবারের মত সব ভুলে যাও।”

নাহিদ ম্লান হাসে, “চাইলেই কি সব ভুলা যায়? কষ্ট তো কম দিলে না আমায়।”

স্পৃহা এবার ফোঁপাতে শুরু করে, “আ’ম সরি! আমাকে.. আমাকে ছেড়ে..”

বলতে পারলো না স্পৃহা। শব্দ সব আটকালো কণ্ঠনালির মধ্যখানে। নাহিদের মন গললো বোধহয়। প্রেয়সীর কান্না কি আর প্রেমিক পুরুষের মন সইতে পারে? না তো। সে আলগোছে স্পৃহাকে নিজের বুকে জড়িয়ে নিয়ে বলে, “হুস! কাঁদে না আর। তোমাকে ছেড়ে যাচ্ছি না আমি কোথায়। আছি তোমার পাশে। তবে, আমার আবদার একটাই কখনো বিশ্বাস হারিয়ে ফেলো না অন্যথায় আমাকেও হারিয়ে ফেলবে তুমি।”

স্পৃহা মাথা নাড়ে। অতঃপর নিবিড়ভাবে মিশে যায় প্রিয়তম মানুষটির আলিঙ্গনে।

_________________

প্রকৃতির বুকে এবং মানুষের জীবনে দুই জায়গাতেই বসন্তের প্রভাব নাকি বেশ। জীবনের সবচেয়ে স্মরণীয় স্মৃতি বলে বসন্তের মাতাল হাওয়ায় ঘটে৷ সত্যি বোধহয় তাই। জীবনের একুশটি বসন্ত সাদামাটাভাবে কাটিয়ে উঠে বাইশতম বসন্ত যে এত রঙিন,নিস্বর্গ হবে তা কি জানতো স্পর্শী? ফাগুনের আগুনে, মন রাঙিয়ে, মাতাল হাওয়া দোলে অন্ত নেই কোন যুবতীর উচ্ছাসে। সবই প্রেমমোহে সিদ্ধ যেন। চারদিকের আড়ম্বর বাড়াচ্ছে যুবতীর মনের ব্যাকুলতা। সময় কাঁটা গুণতে গুণতে অবশেষে প্রিয় প্রহরের দেখা মিলেছে। অবসান ঘটতে চলছে সকল অপেক্ষার,প্রতীক্ষার।

সর্বোচ্চ গতিতে ফ্যানটা ছেড়ে দিয়ে হাত মেলে বসেছে স্পর্শী। হাত ভর্তি তার মেহেদী। পাশেই কেয়া,নিধি বসে গল্পের আসড় জমিয়েছে। খাটের এক কোণে বসে চোখ বড় বড় তাকিয়ে আছে পার্শিয়া। যেন ঘটনা কিছুই বুঝতে পারছে না সে। চারপাশ প্রচন্ড ব্যস্ত। কোলাহল বাড়ছে ক্রমান্বয়ে। সন্ধ্যায় হলুদের অনুষ্ঠান আর দু’দিন পর বিয়ে। কাজের অন্ত কি আছে? সামি,মাহিন পর্যন্ত গাধার খাটুনি খাটছে বাহিরে। সোড়গোল বেশি হওয়ায় স্পর্শী অতিষ্ট হয়ে বলে, “নিধি দরজাটা লাগিয়ে দে তো। মাথা ধরে যাচ্ছে আমার।”

নিধি মাথা নাড়িয়ে দরজাটা লাগিয়ে দিল। বাহির হতে শব্দ কমে আসলো কিছুটা। সাহেলা কিয়ৎকাল আগেই ট্রে-তে করে জুস আর নাস্তা দিয়ে গিয়েছেন। নিধি সেখান থেকে জুসের গ্লাসটা উঠিয়ে নিয়ে খেতে খেতে বলে, “তা স্পর্শীর তোর অনুভূতি কি রে শুনি? তুই তো এখন অফিশিয়ালি মিসেস হিটলার হতে চলেছিস। ফিলিং সামথিং সামথিং?”

#চলবে

1 COMMENT

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here