#চৈতালি_পূর্ণিমা,#পর্ব-৪৮
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat
“তা স্পর্শীর তোর অনুভূতি কি রে শুনি? তুই তো এখন অফিশিয়ালি মিসেস হিটলার হতে চলেছিস। ফিলিং সামথিং সামথিং?”
স্পর্শী ভ্রু কুঞ্চিত দৃষ্টিতে তাকায়। কিছু বলার পূর্বে কেয়া বলে উঠে, “ভাব যদি এখন ও বলে, দিস ইজ মাই ফাস্ট টাইম। আ’ম ফিলিং সো গুউউউ।”
কেয়া কথা শোনামাত্র নিধি অট্টহাসিতে মেতে উঠে। কেয়াও যোগ দেয় তাতে। হাসতে হাসতেই স্পর্শীকে উদ্দেশ্য করে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়, “মিসেস হিটলারের কি আসলেই এমন ফিলিং হচ্ছে নাকি? হলে বল বাথরুমে দিয়ে আসার ব্যবস্থা করতাসি।”
কথাটা বলে আবার হাসতে শুরু করে নিধি৷ স্পর্শী কাঠ কাঠ কন্ঠে বলে, “ফাজলামো করার আর জায়গা পাস না? মিসেস হিটলার কি হ্যাঁ?”
নিধি হাসি থামিয়ে অবাক হওয়ার ভাণ করে বলে, “আরেহ বাহ! হিটলারের বউ মিসেস হিটলার হইব না তো কি হইব? মিসেস ফুলটুসি?”
স্পর্শী রোষানল দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে, “একদম তাকে হিটলার বলবি না। সে হিটলার না।”
কেয়া পাশ থেকে বলে উঠে, “ইশশ কি ভালোবাসা! তা ম্যাডাম এই নামটা কিন্তু আপনিই দিয়েছিলেন মনে পড়ে তো? আপনার থেকেই এই নামটা পুরো ভার্সিটিতে ছড়িয়েছিল আর ফেমাস হয়েছিল।”
নিধি গ্লাসের জুসটুকু শেষ করে বিছানায় এসে বসে বলে, “একদম ঠিক। নির্বাণ স্যারকে তো ওর দুই চোখের বিষ ছিল। নাম শুনলেই কেমন জ্বলে উঠতো। সহ্যই করতে পারতো না। আমাদের সামনে কত যে বকাবকি করসে। আর এখন দেখ ভালোবাসা কিভাবে উথলে পড়তাসে, একদম তাকে হিটলার বলবি না।”
শেষ বাক্যটি ব্যঙ্গাত্মক করে বলল নিধি। স্পর্শী তীর্যক দৃষ্টি তাকিয়ে বলে, “যেহেতু এখন সে আর তোদের স্যার নেই সেহেতু এই নামে তাকে ডাকাও নিষেধ। তাকে এই নামে ডাকার হলে আমি একা ডাকব। তোরা কেউ ডাকতে পারবি না।”
কেয়া বলে, “দেখ দেখ কিভাবে পলটি খাইতাসে। এজন্যই বলে, বিয়ের পর কেউ আপন থাকে না। আজ সেটার বাস্তব প্রমাণও পেয়ে গেলাম।”
স্পর্শী অবসন্ন কন্ঠে বলে, “তখনকার কথা ভিন্ন ছিল ভাই।”
নিধি ভ্রু নাচিয়ে বলে, “তাহলে এখন কি হ্যাঁ? নির্বাণ স্যার এমন কি করসে রে যে সে এখন তোর চোখে ভালো। বল বল আমরাও একটু শুনি।”
স্পর্শী দাঁতে দাঁত চেপে বলে, “তুই থামবি নাকি জুতাটা উড়িয়ে মারব তোর মুখে।”
নিধি কথা শুনলো না। আপন মনে বকবক করে গেল। সাথে কেয়াও। মাঝে মধ্যে নির্বাণের নাম তুলে টিজ করতে থাকলো স্পর্শীকে। এদিক হাতে মেহেদী থাকায় স্পর্শী কিছু করতে না পেরে দাঁতে দাঁত চিপে বসে রইলো। অবশেষে দড়জায় টোকা পড়াতে নিধি ও কেয়া দুইজনে ক্ষান্ত হলো। সাহেলা ডাকছেন কোন এক কাজে। তার ডাক শুনে নিধি আর কেয়া দ্রুত বেরিয়ে যেতে স্পর্শী হাফ ছেড়ে বাঁচলো। দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে তাকালো হাতের দিকে। মেহেদী শুকাতে এখনো ঢেড় সময় বাকি।
মেদুর আকাশে নেই আজ নক্ষত্রের মেলা। মেঘের আড়ালে লুকিয়ে আছে শুক্লপক্ষের পূর্ণ চাঁদটি৷ আবছা অবয়ব দৃশ্যমান। প্রকৃতির বুকে ফাল্গুনী বাহারে-চাঞ্চল্য শেষে চলছে চৈতালি উন্মত্ততা। নিশাচর জীব-জন্তুর হাক শোনা যাচ্ছে প্রখরভাবে। ঘড়ির কাঁটা চলছে দুইয়ের ঘরে। একটু শব্দ করে ওয়াশরুম খুলে বের হলো স্পর্শী। আদ্রতায় বেষ্টিত চুলের মাঝে তোয়ালে ডুবিয়ে৷ ঘড়ির দিকে একবার তাকিয়ে মন দিল নিজের কাজে। হলুদের অনুষ্ঠান শেষে সবেমাত্র অবকাশ মিললো তার। বারান্দায় যেতেই আড়ম্বরে ঘেরা আলোকসজ্জা চোখ বিঁধলো খুব করে। স্পর্শী বার কয়েক পলক ফেলে, স্থির দৃষ্টিতে তাকালো চারপাশে। জাঁকজমকের কমতি নেই কিঞ্চিৎ পরিমাণও। কি যেন ভেবে ঠোঁটের কোণে তার ফুটে লজ্জালু রেখা। কিছুক্ষণ সেখানে থেকে তোয়ালে মেলে দিয়ে রুমে এসে ক্ষান্ত হয়ে বসলো সে। কেয়া ও নিধি থাকেনি আজ, কাল থাকবে বলে। অনুষ্ঠান শেষে বাড়ি ফিরে গিয়েছে। সামি ও মাহিন তাদের এগিয়ে দিয়ে এসেছে।
আকস্মিক পরিবেশ কম্পিত করে ফোনটি বেজে উঠলো। স্পর্শী তাকালো সেদিক। নির্বাণের নাম কৃত্রিম পর্দায় জ্বলজ্বল করে ভেসে উঠতে তড়িঘড়ি করে ফোন তুললো সে। তবে কিছু বলল না, নীরব রইলো। অপরপাশ থেকে এক পুরুষালী কণ্ঠ বলে ওঠে, “ঘুমোও নি এখনো?”
মিহিস্বরে উত্তর দেয় স্পর্শী, “না। অনুষ্ঠান শেষই হয়েছে কিছুক্ষণ আগে, ফ্রেশ হলাম সবে।”
“অহ! তাহলে একটু ভিডিও কলে আসো।”
স্পর্শী ‘আচ্ছা’ বলে ফোন রাখে। দ্রুত কাবার্ড থেকে ল্যাপটপ বের করে অন করে। নেট কানেক্টড করা মাত্র কল আসে। স্পর্শী কল রিসিভ করতেই নির্বাণের শ্যাম উজ্জ্বল মুখশ্রী ভেসে উঠে পুরো পর্দা জুড়ে। দুইজনের দৃষ্টি বিনিময় হয় ঈষৎ মুহূর্তের। স্পর্শী দ্রুত অন্যপার্শ্বে তাকায়। হৃদস্পন্দন অকারণেই বেড়ে যাচ্ছে তার। নীরবতা শোভমান হয় কিয়ৎক্ষণ। নির্বাণ ভ্রু কুঁচকে বলে, “তোমার সমস্ত কিছু আমাকে তোমার কাছে আসার আমন্ত্রণ দিচ্ছে, সেটা কি তুমি উপলব্ধি করতে পারছো?”
স্পর্শী প্রশ্নবোধক নয়নে তাকায়। দ্বিধাগ্রস্ত কন্ঠে বলে, “কি?”
নির্বাণ নিচের ঠোঁট কাঁমড়ে তাকায়, বলে না কিছু। স্পর্শী ছোট ছোট নয়নে নির্বাণের দিকেই তাকিয়ে থাকে। অতঃপর নির্বাণের দৃষ্টি অনুসরণ করে নিজের দিকে তাকাতে খেয়াল হয় সে গায়ে ওড়না জড়ায়নি। সঙ্গে সঙ্গে ওড়না খোঁজায় মনোযোগী হয় সে। নির্বাণের কল পেয়ে এতটাই ব্যাকুল হয়ে পড়েছিল যে নিজের দিকে তাকাতে ভুলে গিয়েছিল সে। বিছানার একপাশ থেকে দ্রুত ওড়নাটা নিয়ে গায়ে জড়িয়ে নিল সে। হলদে আভা গাল তার তখন রক্তিম লাল। দৃষ্টি উঠাতে পারছে না সে কোনক্রমেই। নির্বাণ চোখ সরায় না। আজ স্পর্শীকে অন্যরকম সুন্দর লাগছে তার সামীপ্যে। আলাদা এক মাধুর্য খেলা করছে যেন। এর পিছনে লুকায়িত কারণ কি, কে জানে। অকস্মাৎ নির্বাণ জিজ্ঞেস করে, “হলুদের ছোঁয়ায় স্নিগ্ধতা প্রাচুর্য পায় নাকি?”
কথাটা শুনে স্পর্শী একপলক নির্বাণের দিকে তাকিয়ে পুনরায় চোখ নামিয়ে নেয়৷ পূর্বের ন্যায় দ্বিগুণ ব্রীড়ানত হলো মন। কন্ঠস্বরে হরতাল চললেও খুব কষ্টে বলে ওঠে সে, “চুপ করুন আপনি।”
নির্বাণ নৈঃশব্দ্যে হাসে। মেয়েটা অল্পতেই লজ্জা পেয়ে যায়। হয়তো তাই তাকে লজ্জায় ফেলতে তার ভালোও লাগে। স্পর্শীকে স্বাভাবিক করতে নির্বাণ এদিক-সেদিকের কথা বলে। যেহেতু দুই পরিবারের কোন অনুষ্ঠান একসাথে হচ্ছে না সেহেতু সেদিকের খোঁজটাই নিল নির্বাণ। কখন অনুষ্ঠান শেষ হয়েছে, কেমন গেল সব, কোন সমস্যা হয়েছিল নাকি না, স্পর্শী খেয়েছে কি-না এসেস্ট্রা এসেস্ট্রা। সব প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে স্পর্শীও স্বাভাবিক হতে শুরু করল। কথা চলল তাদের দীর্ঘ রজনীর শেষ ভাগ পর্যন্ত। ঘড়ির কাঁটা চারের ঘরে পৌঁছাতে নির্বাণ স্পর্শীকে ঘুমাতে যাওয়ার জন্য তাড়া দিল। স্পর্শী দ্বিরুক্তি না করে সম্মতি জানায়। ফোন কেটে যাওয়ার পর সে আনমনে হাতের দিকে তাকায়। মিহি কারুকাজে আবৃতি। প্রগাঢ়তা না পেলেও ধীরে ধীরে রঙ ফুটছে। ডান হাতের তালুর একটু নিচেই খুব সূক্ষ্মভাবে নির্বাণের নামটি লেখা। বাংলায় নয়, ইংরেজিতে। তবে এমনভাবে লেখা হয়েছে যে নামটি খুঁজে বের করা দুষ্কর। ডিজাইনের সাথে মিশে আছে একদম। স্পর্শীর ঠোঁটের কোণে সরু রেখা ফুটে। কারণে-অকারণেই। মিনমিনে কন্ঠে বলে, “দেখা যাক আপনি পারেন কি-না নিজের নামটি খুঁজে নিতে৷”
__________________
সাঁঝ নেমেছে পশ্চিমাকাশে। কমলাটে নীরদদেশে ছেঁয়ে পড়েছে কালচে আঁধার। বাতাবরণ নিরুত্তাপ, নিরুপম। শুক্লপক্ষের পঞ্চমী আজ, নিদারুণ চন্দ্রমার আবির্ভাব মধ্যভাগে। বাতাসে ভাসছে মিষ্টতা। কয়েক ঘটিকা পূর্বেই আনুষঙ্গিক সকল কার্যবিধির সমাপ্তি ঘটিয়ে স্পর্শীকে নিজের ঘরে তুলেছে নির্বাণ। এখানে আসামাত্র তাকে বরণ করে নিল নানাজান, মামা-মামীসহ ছোট-বড় সকলে। হৈ-হুল্লোড়ে মাতানো পরিবেশ যেন। অতঃপর বাকি সময়টুকু কাটল তাদের সাথেই। হাসি-ঠাট্টার মাঝে৷ রাত বেশি হতে দেখে ফ্রেশ হওয়ার জন্য নিলুফা স্পর্শীকে নির্বাণের রুমে বসিয়ে দিয়ে গেলেন। রুমটা হরেকরকম ফুল দিয়ে সজ্জিত। কিছু কিছু জায়গায় মোমবাতি জ্বলছে টিমটিম করে। রুমের সাজসজ্জা দেখে স্পর্শী লজ্জা পেল বেশ। লাজুক দৃষ্টি পর্যবেক্ষণ করলো সব। ক্ষণকাল পর নাহিদ আর মৃদুল লাগেজগুলো দিয়ে যাওয়ামাত্র নির্বাণ এলো রুমে। স্পর্শীকে দেখে সে বলে উঠে, “এখনো ফ্রেশ হওনি কেন?”
“এইতো যাচ্ছি। গহনা,ওড়না খুলেনি আগে।”
“তাহলে আমি আগে ওয়াশরুমটা ইউস করছি।”
“আচ্ছা। এমনেও আমার একটু সময় লাগবে।”
নির্বাণ কথা বাড়ায় না। শেরওয়ানি খুলে চলে যায় ফ্রেশ হতে। মিনিট ত্রিশের পর নির্বাণ বেরিয়ে আসে ওয়াশরুম থেকে। ভেজা চুল মুছতে মুছতে তাকায় স্পর্শীর পানে। মেয়েটা তখন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুলের ক্লিপগুলো খুলতে ব্যস্ত। এক খোপা বাঁধতে, পার্লার থেকে হাজার খানেক বার্বিপিন চুলে গেঁধে দিয়েছে যেন। বেশিরভাগ পিন খুঁজে পাচ্ছে না সে। মাথার ওড়নাটাই খুলেছে খুব কষ্টে। স্পর্শীকে এভাবে ভোগান্তির মধ্যে দেখে হাতের তোয়ালেটা চেয়ারে উপর রেখে স্পর্শীর সন্নিকটে এগিয়ে আসে নির্বাণ। স্পর্শীর হাত সরিয়ে দিয়ে বলে, “দাও আমি সাহায্য করছি।”
আয়নার মধ্য দিয়েই স্পর্শী তন্ময় নয়নে তাকালো নির্বাণের দিকে। মৃদু হেসে মাথা নাড়ে সে। নির্বাণ আলগোছে চুল থেকে সব ক্লিপ বের করে দিয়ে গহনা-গাটি খুলতে সাহায্য করে। নির্বাণ এত সাবধানের সাথে সবটা করলো যে স্পর্শী সামান্যটুকু ব্যথাও অনুভব করতে পারলো না। কাজ শেষে স্পর্শী লাগেজ থেকে এক সেট জামা নিয়ে চলে যায় ফ্রেশ হতে। ফ্রেশ হয়ে আসার পর স্পর্শী যেন হাফ ছেড়ে বাঁচে৷ এতক্ষণ বেশ অস্বস্তিবোধ করছিল সে। বেরিয়ে এসে নির্বাণকে কোথাও না পেয়ে স্পর্শী ভ্রু কুঁচকে তাকালো৷ কিছুক্ষণ তার খোঁজ করে ভেজা চুল মুছে নিল সে। অতঃপর স্থির হয়ে বসলো বিছানায়। ঘড়ির দিকে তাকালো একবার, রাত একটার বেশি বাজে। এই সময় কোথায় গেল মানুষটা? মনে প্রশ্ন জাগ্রত হলো তার। তবে অপেক্ষার প্রহর দীর্ঘতর হলো না, মিনিট দুই-এক যেতেই দুই কাপ কফি নিয়ে ফেরত আসলো নির্বাণ। স্পর্শী বিস্ময়কর নয়নে তাকিয়ে বলে, “এত রাতে কফি?”
নির্বাণ মন্থর কন্ঠে বলে, “হুম! সারাদিন অনেক দখল গিয়েছে, কফি খেলে ফ্রেশ লাগবে একটু। ক্লান্তি ভাবটাও কেটে যাবে।”
“তা ঠিক।” কথাটা বলে কফির কাপটা হাতে নিল স্পর্শী। নির্বাণ বলে, “বারান্দায় যাবে? আকাশটা সুন্দর আজ।”
“চলেন!”
হাতে কাপটা চেপে ধরে দুইজনই বারান্দার দিকে অগ্রসর হয়। বারান্দার এক কোণে রাখা বেতের মোড়ায় এসে বসে দুইজনে। চৈত্রের হিম বাতাস বইছে। কুহেলির আশপাশ চন্দ্রপ্রভায় উজ্জ্বল দেখাচ্ছে। মেঘহীন আকাশে নিখুঁত আকৃতির চন্দ্রমা দ্যুতি বিলাতে করছে না কোন কৃপণতা৷ ক্ষুদ্র নক্ষত্র সঙ্গ দিতে আছে পাশে। রজনীগন্ধার ঘ্রাণে মাতোয়ারা হয়ে দুললছে পাতা। পূর্ণিমার রাত আজ, মোহনীয় না হয়ে যাবে কোথায়? স্পর্শী মোহগ্রস্ত নয়নে তাকিয়ে থাকে আকাশের পানে। পরিবেশে স্বাদ উপভোগ করার ফাঁকে ফাঁকে আলতো করে ঠোঁট ছোঁয়ায় কাপে। মনে পড়ে তার অতীতের কিছু কথা। বছর এক আগে এমনই একরাতে নির্বাণের সাথে তার অনাকাঙ্ক্ষিত এক সম্পর্কের বাঁধনে আবদ্ধ হয়ে পড়ে তারা। অতঃপর সেখান থেকেই তাদের পথচলা। সম্পর্কের শুরুটা ছিল প্রচন্ড আগোছালো,ছণ্ণছাড়া। যেখানে এই বদরাগী মানুষটাকে একটুও সহ্য হতো না তার, নামটাও যেন বিষ সমতুল্য ছিল তার নিকট সেখানে এই সম্পর্ক টিকবে না বলেই ধরে নিয়েছিল সে। স্পর্শী যদি হয় উত্তর মেরু, নির্বাণ ছিল দক্ষিণ মেরু। সম্পর্ক কিভাবে গড়ে উঠতো শুনি? তার উপর দুইজনের আগেরকার একটা সম্পর্ক বিদ্যমান ছিল। শিক্ষক,ছাত্রীর সম্পর্ক। সে-টা কিভাবে অদেখা করতো তারা? সব মিলিয়ে যেন হ-য-ব-র-ল অবস্থা ছিল৷ তাই আশা রাখেনি সে কোন। কিন্তু পরে, সময় যত গড়ালো সব বদলাতে শুরু করলো। ভার্সিটিতে শিক্ষক হিসেবে যে নির্বাণকে স্পর্শী চিনতো তার একদম উল্টো এক সত্তাকে আবিষ্কার করলো তার পাশে। কঠোর ব্যক্তিত্বের পরিবর্তে খুঁজে পায় কোমলতা। ধীরে ধীরে সেই সত্তার মায়ায় জড়িয়ে গেল সে। নিজের অজান্তে, তাকে অভ্যাসে পরিনত করে ফেললো। কখনো লজ্জা না পাওয়া মেয়েটি তার সান্নিধ্যে লজ্জায় বেষ্টিত হলো। সবসময় কন্ঠস্বর উঁচু থাকতো যার, কন্ঠ নমনীয় হলো একজনের ছোঁয়ায়। কখনো কথাই বেরোয় না যেন। ভার্সিটির সবচেয়ে রূঢ়ভাষিণী মেয়েটা এই এক মানুষটির কাছে এসে ভেজাবিড়াল হয়েই রয়ে গেল। যার সঙ্গ পছন্দ ছিল না এক মুহূর্তের জন্য, আজ তার সঙ্গ পেতেই তার কত আকুলতা, ব্যকুলতা। সেই মানুষটির পাশেই আজীবন থাকতে চায় সে, মৃত্যুর আগপর্যন্ত। কি অদ্ভুত এই বেড়াজাল তাই না?
স্পর্শী মৃদুহাসে৷ অন্দর জুড়ে মগ্নতা, স্নিগ্ধতার প্রকাশ। নির্বাণ হাসিটা খেয়াল করে বলে, “হাসছ যে?”
স্পর্শী নির্বাণের দিকে তাকিয়ে বলে, “কিছু না। এভাবেই!”
অতঃপর কি যেন ভেবে নিজের ডান হাতটা নির্বাণের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে, “আপনার নাম আছে এখানে, পারলে খুঁজে দেখান। যদিও আপনি পারবেন না জানি।”
নির্বাণ কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে, “পারব না বলছ?”
স্পর্শী আত্মবিশ্বাসের সহিত বলে, “একদম।”
“দেখা যাক।”
কথাটা বলে নির্বাণ বারান্দার নীলাভ বাতিটি জ্বালিয়ে দেয়। খুব মনোযোগের সাথে দেখতে শুরু করে স্পর্শীর হাতটি। মিনিট না গড়াতেই নির্বাণ নিজের নামের অক্ষরটি খুঁজে বের করে ফেলে। তালুর একটু নিচে তর্জনী দেখিয়ে বলে, “তুমি না বলছিলে পাব না? এই দেখো পেয়ে গিয়েছে।”
এত দ্রুত নিজের নাম খুঁজে বের করে ফেলায় অবাক না হয়ে পারে না স্পর্শী। আঁখিপল্লব বড় বড় করে তাকিয়ে বাচ্চামো সুরে বলে, “এত তাড়াতাড়ি আপনি খুঁজে পেলেন কিভাবে?”
নির্বাণ স্পর্শীর নাক টেনে বলে, “যে নাকি কলমে-অক্ষরে পুরোটাই আমার, তার হাতে নিজের নাম খোঁজা তুচ্ছ বৈ কিছুই না।”
স্পর্শী লাজুক হেসে সন্তর্পণে নির্বাণের বুকের পাশে মাথা রাখে। নির্বাণ স্পর্শীর পিছন দিয়ে হাত গলিয়ে দিয়ে আলতোভাবে কোমর জড়িয়ে ধরে। আস্তে করে কপালে অঁধর ছুঁয়ে দিয়ে প্রণয়কাব্যর সূচনা রজনিতে বিভোর হয় শ্যামমানবটির মন।
_______________
পরিশিষ্টঃ
তখন দ্বিপ্রহর। স্বচ্ছ কাঁচের ন্যায় রোদ গড়িয়ে পড়ছে অন্দরে। নীরদবরণে চোখ ঝলসানো রোদ্দুর খেলা করছে আপন মনে। চড়ুইপাখির কলরব, শালিকের জুটি গুঞ্জন তুলছে এদিক-সেদিক। স্পর্শী বিছানায় হেলান দিয়ে মন দিয়ে হুমায়ুনের লেখা- ‘রূপা’ উপন্যাসটি পড়ছে। মগ্নতা এতই যে সময় এদিকে ফুরিয়ে যাচ্ছে তার কোন হিসাব নেই। পাশেই পার্শিয়া গা গুটিয়ে শুয়ে আছে। নড়াচড়া নেই বিন্দুমাত্র। নিলুফা দ্বিতীয়বারের মত খাবারের জন্য ডাকতে এসে বিষয়টা লক্ষ্য করলেন। তাই সে আর না ডেকে চুপচাপ বেরিয়ে গেলেন রুম থেকে, কেন না তিনি যানেন এখন খাওয়ার কথা বললে স্পর্শীর কি হবে। ক্ষণকাল পর প্লেটে খাবার সাজিয়ে রুমে আসলেন নিলুফা। স্পর্শীর সামনে এসে বসে বললেন, “খেয়ে নাও, দুপুর পার হয়ে যাচ্ছে তো।”
স্পর্শীর ধ্যাণ ভাঙ্গে। সে বইয়ের পাতা থেকে দৃষ্টি সরিয়ে সামনের দিকে তাকায়। নিস্পন্দ কন্ঠে বলে, “খেতে ইচ্ছে করছে না মা।”
“খাবার নিয়ে এসময় হেলাফেলা করলে চলে নাকি? ছয়মাস চলছে তোমার, এখন বেশি বেশি করে খাওয়া-দাওয়া না করলে শরীর শক্তি পাবে কোথা থেকে?”
অবসন্ন কন্ঠে উত্তর দেয় স্পর্শী, “লাভ কি? সেই তো বমিই হয়ে যায়।”
“যতটুকু পারো খাও নাহলে নির্বাণ শুনলে কিন্তু খুব রাগ করবে। জানোই তো খাওয়া নিয়ে হেলাফেলা করা তার একটুও পছন্দ না।”
স্পর্শী বিরবির করে বলে, “যাচ্ছে তো সব আমার উপর দিয়ে, সে বুঝে কি? পারে তো শুধু ঝাড়তে। আসলেই হিটলার একটা।”
নিফুলা কথাটা শুনলেন ঠিকই কিন্তু কোন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখালেন না। মিটমিটিয়ে হাসলেন শুধু। তারপর ভাতের দোলা মেখে বলেন, ” আমি খায়িয়ে দিচ্ছি হা কর।”
নিলুফার স্নেহে আবৃত কন্ঠ উপেক্ষা করতে পারলো না স্পর্শী। বই বন্ধ করে পাশে রাখে। খাওয়ার কোনরকম ইচ্ছে না থাকা সত্ত্বেও নিলুফার হাতে খেল সে। তবে খাওয়ার পর আর খারাপ লাগলো না তার। নিলুফা ভাতে লেবু চিপড়িয়ে এনেছে, যাতে স্পর্শীর খেতে সমস্যা না হয়। এরই মাঝে পার্শিয়া ঘুম থেকে উঠে পড়ে। স্পর্শী আর নিলুফাকে পাশাপাশি দেখে কতক্ষণ চেয়ে থাকে সেই পানে৷ অতঃপর মৃদু শব্দ করে মাথা হেলিয়ে দেয় স্পর্শীর দিকে। স্পর্শী হাত এগিয়ে গায়ে আদর করে দিল তাকে। পার্শিয়া কিয়ৎকাল এভাবে থেকে বিছানা থেকে নেমে পড়ে। চলে যায় বাহিরে৷ হঠাৎ নিলুফা বলে, “কবুতরের মাংস আছে, খাবে? আনব একটু?”
স্পর্শী নাক মুখ কুঁচকে বলে, “না মা খেতে ইচ্ছে করছে। আর একটা কথা, উনাকে কবুতরের মাংস আনতে মানা করবেন তো। একবার কি কবুতর খেতে চেয়েছি এখন রোজ রোজ খাওয়াচ্ছে আমাকে সে-টা।”
নিলুফা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলে, “সে-টা নাহয় তুমিই বল। আমি বললেও শুনে না এখন। সেদিন বললাম ফ্রিজে মাংস আছে আনার দরকার নেই, তবুও কাল রাতে আসার সময় আবার এক হালি কবুতর নিয়ে এসেছে। আর কি বলব ওকে আমি বল? তুমি তখন ঘুমিয়ে ছিলে বলে টেড় পাওনি।”
স্পর্শী মুখ ছোট করে বলে, “আমার সারাজীবনের কবুতর খাওয়ার খায়েশ শেষ। এমন পাগলামো কেউ করে বলুন?”
নিলুফা বলেন, “ছেলে আমার তোমার প্রতি একটু বেশি যত্নশীল। তাই পাগলামোও তার বেশি।”
স্পর্শী নাজুক দৃষ্টিতে তাকায়, বলে না কিছু৷ কেন না সত্যি যে তাই। তিন বছর পেরিয়ে চারে পা রাখতে চলল তাদের সম্পর্ক। সাথে, ছোট এক আগন্তুকের আগমন নিয়ে। কিন্তু তবুও বদলায়নি কিছু। না মনোভাব, না আচরণ। সব যেন সেই শুরুর মতই আছে। ফিকে হয়ে যায়নি সম্পর্কটা, উল্টো দিনকার দিন প্রগাঢ়তা পাচ্ছে যেন। দায়িত্ববান পুরুষটি পূর্বের ন্যায় একটু বেশি দায়িত্ববান হয়েছে৷ স্পর্শীর সবকিছুতেই তার নজর প্রখর খুব।
স্পর্শীকে চুপ করে যেয়ে নিলুফাও কথা বাড়ায় না। মুচকি হেসে চুপচাপ খায়িয়ে দিতে থাকে।
প্রথম একবছর স্পর্শী নিলুফার সাথেই ছিল সাভারে। ফাইনাল ইয়ারের পরীক্ষা দিয়ে সে আর নিলুফা ঢাকায় নির্বাণের এখানে শিফট হয়ে যায়। পার্শিয়াকে স্পর্শী ফেলে আসতে না পারায় ওকেও সাথে নিয়ে আসে সে। নিলুফার সমস্যা ছিল না কোন। তবে প্রথম প্রথম নির্বাণ একটু অস্বস্তিবোধ করে কিন্তু পরবর্তীতে সেও মানিয়ে নেয়। তবে তাদের মধ্যকার দ্বন্দ্ব তখন পর্যন্ত বিধ্যমান। কোন এক অদৃশ্য কারণেই দুইজন দুইজনের পাশে ঘেঁষে না, মুখোমুখি হলেও হয় পার্শিয়া মুখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে চলে যায় নাইলে নির্বাণ। এমনকি নির্বাণ পাশে থাকলে পার্শিয়া স্পর্শীর কাছে পর্যন্ত আসে না। চুপচাপ গিয়ে নিলুফার রুমে, তার কোলে উঠে বসে থাকে। দুইজনের এমন আচরণের কারণ স্পর্শীর যেন কখনো খুঁজে বের করতে পারবে না।
অন্যদিকে পড়ালেখা শেষে দেশের বাহিরে একটা কোম্পানিতে চাকরি হয়ে যায় নাহিদের৷ যার দরুন সেখানেই বসতিস্থাপন করে সে। নিজের অবস্থান পাকাপোক্ত করে একটা সুযোগ বুঝে, স্পৃহার প্রতি নাহিদের ভালোলাগার ব্যাপারটা পরিবারের সকলকে জানায়। তাকে বিয়ে করতে চায় বলে প্রস্তাব রাখে। প্রথমদিকে এ নিয়ে একটু দমনদোষা দেখা দিলেও পরবর্তীতে দুই পরিবার মেনে নেয়। নাহিদ মাঝে ছুটিতে দেশে আসতেই স্পৃহা এবং তার আকদ করিয়ে রাখা হয়। শেষ কথা এটা হয় যে, স্পৃহার পড়ালেখা শেষ হলে উঠিয়ে দেওয়া হবে তাকে এবং নাহিদও নিজের সঙ্গ করে স্পৃহাকে নিয়ে যাবে।
___________________
সায়াহ্নের মেহেদীরাঙ্গা অম্বর নীমিলিত হলো আঁধারে। নক্ষত্রবিহীন আকাশে অজস্র মেঘের মাঝে বৃত্তকার চাঁদটির মায়াবী খেলা। নিষুপ্ত রজনিতে কারো হিংস্র ডাক প্রতিধ্বনিত হচ্ছে ক্ষণে ক্ষণে। ঠিক সেই প্রহরে স্পর্শী আলগোছে এসে নির্বাণের পাশে দাঁড়ালো। খুব আদুরে ভঙ্গিতে ডাকলো তাকে, “এই যে শুনছেন?”
ল্যাপটপের স্ক্রিনে হতে নেত্র দুইটি সরিয়ে নিয়ে মুখ তুলে তাকালো নির্বাণ। সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকিয়ে স্পষ্ট কন্ঠে জিজ্ঞেস করে সে, “কি বল?”
জিহ্বা দিয়ে ওষ্ঠ্যদ্বয় ভিজিয়ে নিয়ে স্পর্শী বলে ওঠে, “আমার না আইসক্রিম খেতে ইচ্ছে করছে বাহিরে গিয়ে। নিয়ে যাবেন?”
কথাটি শুনে নির্বাণের অভিব্যক্তি বদলায়। রূঢ়ভাব আসে কন্ঠে, “এখন ঠান্ডা খাওয়া তোমার আর বেবির স্বাস্থ্যের জন্য একটুও ভালো না। ইফেক্ট করবে দুইজনকে। তার উপর সময় দেখছে?”
স্পর্শী মুখভার করে, “এতকিছু জানি না। আমি আইসক্রিম খাব ব্যস।”
“না, বলেছি না আমি?”
“আমি আইসক্রিম খাব মানে খাব। আপনি নিয়ে না গেলে কিন্তু একাই চলে যাব আমি।”
নির্বাণ একপলক স্পর্শীর দিকে তাকিয়ে কোল থেকে ল্যাপটপ নামিয়ে রাখে পাশে। স্পর্শীরভেক হাত ধরে টেনে নিজের কোলে বসিয়ে দিয়ে তার কোমরের পাশে হাত গলিয়ে দেয় নির্বাণ। চোখে চোখ রেখে বলে, “বললেই হলো নাকি? খালি একবার রুমের বাহিরে পা রেখে দেখাও না।”
ঘটনাক্রমে স্পর্শী ভড়কে যায়। দৃষ্টি বড় বড় তাকায় সে। আড়ষ্ট কন্ঠে বলে, “কি করছেন কি? ছাড়ুন আমায়।”
নির্বাণ আরও শক্ত করে স্পর্শীকে জড়িয়ে ধরে বলে, “না ছাড়লে কি করবে?”
স্পর্শী রাগান্বিত দৃষ্টিতে তাকায় কিন্তু কিছু বলে না। রাগে ফোঁস ফোঁস করতে করতে নিচে নামার জন্য মোচড়ামুচড়ি শুরু করে সে। নির্বাণ এবার হাতের বাঁধন শক্ত করে নেয়। মন্থর কন্ঠে বলে, “আমি না ছাড়লে তুমি কখনোই আমার সাথে পেরে উঠবে না। উল্টা ব্যথা-ট্যাথা পাবে। তাই বলছি বলছি শান্ত হয়ে বসো।”
স্পর্শী কথা শুনে না, অশান্ত ভঙ্গিতে নড়াচড়া করতেই থাকে। নির্বাণ এবার মুখ এগিয়ে নিয়ে স্পর্শীর গালে আলতো করে নিজের অধর ছোঁয়ায়৷ সঙ্গে সঙ্গে স্পর্শী স্থির হয়ে যায়। বার কয়েক চোখ ফেলে তাকায় নির্বাণের পানে। নির্বাণ সেটা দেখে মৃদুহেসে বলে, “তোমাকে জব্দ করার প্রক্রিয়া জানা আছে আমার৷ তাই আমার সাথে চালাকি করে লাভ নেই।”
স্পর্শী লজ্জা পেয়েছে বটে তবে সেটা প্রকাশ্যে আসতে না দিয়ে গাল ফুলিয়ে বলে, “আপনি প্রচন্ড খারাপ। কথা নেই আপনার সাথে।”
নির্বাণ নিষ্পলক তাকিয়ে থাকে তার পাণে। প্রেগন্যান্সির শুরু থেকেই হুটহাট মেয়েটার মন বদল হয়। একেকটার জিনিসের জন্য বাচ্চাদের মত বায়না ধরে। কখনো এটা, কখনো এটা৷ না দিলে এই এক মুখ ফুলিয়ে বসে পড়ে। আর ঠিক এখানটায় এসে হার মানতে হয় তাকে। রূঢ় হৃদয় গলে মোম হয়ে যায়। অপ্রিয় আবদারও তার তখন পূরণ করতে উঠে পড়ে লাগে মানবটা। নির্বাণ দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে মাথা ঝাঁকিয়ে বলে, “আচ্ছা যাও আমি খারাপ। এবার গিয়ে রেডি হয়ে নাও, আইসক্রিম খাওয়াতে নিয়ে যাচ্ছি তোমায়।”
স্পর্শী যেন এই কথাটিই শুনতে চাইছিল। খুশি দেখায় তাকে। নির্বাণ হেসে হাতের বাঁধণ আলগা করতেই উঠে পড়ে স্পর্শী। চলে যায় জামা বদলে নিতে।
__________________
নিষুপ্ত অন্তরিক্ষে রুপালি চাঁদের মোলায়েম আলো ছলকে পড়ছে পিচঢালা রাস্তার উপর। নামবিহীন এক ফুলের ঘ্রাণ আসছে কোথ থেকে ভেসে। খোলা,নির্জন রাস্তার ধারে নির্বাণ দাঁড় করিয়ে রেখেছে গাড়িটি৷ গাড়ির ফ্রন্টের উপর পা বাতাসে ভাসিয়ে বসে আছে স্পর্শী, একহাতে কোণ আইসক্রিমটি নিয়ে মজা করে খাচ্ছে সে। তার পাশেই নির্বাণ পা ভাঁজ করে দাঁড়িয়ে আছে। জ্যােৎস্নার নৈসর্গিক আলোয় শোভা পাচ্ছে শ্যামবর্ণ মুখে। ঠোঁটে কার্ণিশে অদৃশ্য রেখা। স্পর্শী আইসক্রিম খেতে খেতে জিজ্ঞেস করে, “আজ কি পূর্ণিমা?”
নির্বাণ ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়, “ঠিক জানি না। কেন?”
“না এভাবেই। পূর্ণিমার আকাশ দেখতে ভালো লাগে অনেক।”
নির্বাণ নিরুত্তর থাকে একটু ঝুঁকে এসে খুব সন্তর্পণে স্পর্শীর আশপাশে লেগে থাকা আইসক্রিমটুকু মুছে দিয়ে বলে, “আমার আঁধারিয়া অম্বরের আনাগোনায় আমাবস্যা নামা বারণ ,চৈতালি পূর্ণিমা যে তার কারণ।”
স্পর্শী দ্বিধাগ্রস্ত নয়নে তাকায়, “চৈতালি পূর্ণিমা কি?”
“চৈত্র মাসের পূর্ণিমা। যেখান থেকে কি-না আমাদের গল্পটা শুরু। আমার জীবনের সবচেয়ে উজ্জ্বলতম পূর্ণিমা পাওয়া সেখান থেকেই তো।”
স্পর্শী বিস্তৃত হাসে। একেক করে মনে পড়ে তার অতীতের সকল পাতা। যা কি-না সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না,রাগ-অভিমান ও বিশ্বাসে পরিপূর্ণ। আঁখিপল্লবে ভাসে সব। অকস্মাৎ পেটে সূক্ষ্ম ব্যথা অনুভব হয়। হাত থেকে লুটিয়ে পড়ে আইসক্রিমটি। পেট ধরে সাথে সাথে স্পর্শী চেঁচিয়ে উঠে, “আহ নির্বাণ!”
নির্বাণ আতঙ্কিত নয়নে তাকায়। উৎকন্ঠিত হয়ে বলে, “কি হয়েছে স্পর্শী? তুমি ঠিক আছো? কোথাও সমস্যা হচ্ছে? ডাক্তারের কাছে যেতে হবে? বল কি হয়েছে?”
স্পর্শী কথা বলে না। চটজলদি নির্বাণের একহাত টেনে নিজের পেটের উপর রাখে। প্রথম প্রথম নির্বাণ বিষয়টা ধরতে পারে না। জিজ্ঞাসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সে। অতঃপর কিছুটা একটা অনুভব করতে পেরে থম মেরে দাঁড়িয়ে পড়ে সে। অভিব্যক্তি কি দিবে বুঝতে তো পারেই না, সাথে মুখের খেই ও হারিয়ে ফেলে। এ যেন অন্যরকম অনুভূতি, অন্যরকম ভালোলাগা। কিয়ৎক্ষণ পর সে বলে উঠে, “এটা কি ছিল?”
স্পর্শী হেসে বলে, “বেবির ফাস্ট মুভমেন্ট।”
নির্বাণের চোখ উজ্জ্বল দেখায়। বলায় প্রকাশ না করলেও স্পর্শী আন্দাজ করতে পারছে নির্বাণের অনুভূতির গভীরতা। নির্বাণ জড়ানো কন্ঠে বলে, “আমার প্রিন্সেস তাই না ও?”
স্পর্শী বলে, “প্রিন্স নাকি প্রিন্সেস তা তো জানি না। প্রিন্সও হতে পারে।”
“আমার প্রিন্সেস ও আমি জানি। তাই না বল আমার প্রিন্সেস?”
মাথা নিচু করে কথাটি বলে নির্বাণ। অতঃপর টুপ করে চুমু খায় স্পর্শীর পেটে। তা দেখে স্পর্শী হাসে। প্রশান্তির হাসি সেটা। নির্বাণও হাসে তাল মিলিয়ে। কপোত-কপোতীর এমন মিষ্ট মুহূর্ত দেখে যেন চাঁদও হাসে। প্রকৃতি যেন বলে ওঠে, এমন মুহূর্তর সাক্ষী যেন হাজারটা পূর্ণিমা হোক। অমর হয়ে থাকুক স্মৃতিগুলো প্রণয়রজনির এই প্রহরে। স্নিগ্ধতা, শুদ্ধতা,পবিত্রতা ছড়িয়ে যাক এভাবেই। যুগ থেকে যুগান্তর।
~~~~~সমাপ্ত~~~~~~
অবশেষে ইতি টানতে পারলাম। প্রথমেই পাঠকদের নিকট ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। এতটা সময় ধরে আপনাদের অপেক্ষায় রেখেছি। কথা ভেঙেছি বারংবার। উপন্যাসের ছন্দ কেটেছে, গুছিয়ে লেখা হয়নি কখনো কিন্তু তবুও যারা ধৈর্য ধরে এই শেষ পর্যন্ত পাশে ছিলেন তাদের নিকট আমি কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি৷ সাথে, শেষবারের মত পাঠকদের ভালোবাসা কুড়িয়ে নিতে চাইচ্ছি। সকলের মন্তব্যের আশায় আমি। ভালোমন্দ যাই হোক আজ বলে যাবেন।
ভালোবাসা সকলের প্রতি❤️