চোখের_তারায়_তুই?#অন্তিম_পর্ব

0
1395

?#চোখের_তারায়_তুই?
#অন্তিম_পর্ব
#ইভা_রহমান

আজ ছয় বছর পরঃ

এ-ই ছয় বছরে জীবনের চাকার গতি যেমন অনেক পাল্টাচ্ছে। তেমনি পাল্টেছে সাংসারিক অনেক নিয়মনীতি। বয়সের ভারে চাপা পড়লেও মনের কচি ভাব টা এখনো বজায় রেখেছে এ-ই পবিএ ভালোবাসার হৃদয়ের মানুষ চারজন। উজান আজ সফল একজন ডাক্তার,শিশির এক সফল বিজনেস আইকন। হিয়ার ডেন্টিস হবার খ্যাতিও যথেষ্ট। রোদেলা অবশ্য চাকরিবাকরির দিকে মনোনিবেশ করে নি। তার তো ছোট্ট থেকেই ছিলো একটা সজানো সংসারের বড্ড ইচ্ছে। যেটা আজ কানায় কানায় পরিপূর্ণ। যেটাতেই নিজের ধ্যান জ্ঞান দিতে সে সবসময় প্রস্তুত। দোতলার ইউনিট পুরোপুরি পূরণ করে শিশিররা সেখানে শীফট করেছে। আর নিচ তলায় গড়েছে হিয়ার নিজস্ব চেম্বার।

বর্ষা সামনের মাসে নয় বছরের কোঠায় পা রাখবে। এখনো সে সেই আগের মতোই চঞ্চল আর দুষ্ট আছে। বলা চলে যতো দিন যাচ্ছে তার মাথায় যেনো নিত্যনতুন দুষ্টুমির ভূত মাথায় চাড়া দিচ্ছে।

আর এদিকে আমাদের উজান হিয়ার কোল আলো করে আসা তাদের প্রিয় সন্তান তাদের ছেলে হিয়ান। যেমন বলেছিলাম ঠিক সেরকম,একদম বাবা-র হাত পেয়েছে। ধীর শান্ত স্থির। সে যে হিয়ার ছেলে বোঝা মুশকিল। বাসবি তো নিজেও বলে “হিয়ান যতোটা ধীর,শান্ত আর এ বয়সে যতো যা গোছালো উজানো হয়তো তার শৈশবে এরকম গোছালো শান্ত,ভদ্র ছিলো না। হিয়ান যেরকম বিচক্ষণ তার ছোট ছোট কিছু কাজ দেখলেই সেটা উপলব্ধি করা যায়। মায়ের কখন কি লাগে,মা কখন কি খাবে সব দিকে নজর থাকে তার। হিয়া যে এখনো অগোছালো আর বেখেয়ালী ভাগ্যিস তার হিয়ানের মতো ছেলে জন্মেছে নয়তো এ-ই মেয়ে যা।

আজো চেম্বার বা মেডিকেল থেকে উপরে আসলে নিজের এ্যাপরোন সহ যাবতীয় জিনিস বিছানায় ছুঁড়ে দেয় এই মেয়ে। আর সেগুলো তুলে ড্রয়ারের উপর গুছিয়ে রাখে হিয়ান। আজো বেরুতে যাবার আগে সব মেকআপ কিট থেকে জামা কাপড় স্তুপ করে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখার অভ্যােস রয়ে গেছে হিয়ার। কিন্তু আমাদের হিয়ান সে হয়তো কাপড় গুছাতে পারে না কিন্তু হিয়ার মেক আপ কিট সব সুন্দর মতোই যেখানে রাখার জায়গা ওখানেই রেখে দেয় ছেলেটা। এ তো বললাম তার মায়ের কথা। বাবা চেম্বার থেকে ফিরলে তো রাতে আবার চলে বাবা ছেলেতে মিলে এক বিরাট গল্প। তবে সেটা হিয়া আর বর্ষার মতো গল্প কাহিনি না,তাদের গল্পের বিষয়বস্তু তো হতে হয় কোনো গবেষণা বিষয়ক বা কিছু শিক্ষনীয় বইয়ের নীতি বাক্য। যেগুলোতে কান পাততে একদমই ইচ্ছুক না হিয়া। উপরন্তু বর্ষা যেমন এখনো হিয়াকে নিজের দ্বিতীয় মা জানতে অভ্যস্ত তেমনি হিয়ানো উল্টোদিকে রোদেলাকে অন্য রকম এক চোখে দেখে। হিয়া আর বর্ষা যেমন ওখানেই চুলাচুলি করবে ওখানেই মারামারি করবে কিন্তু টান অন্য রকম তেমনি রোদেলা আর হিয়ানের সম্পর্কটাও একই সূত্রে গাঁথা।

তবে এখানে আরেকটা মজার বিষয় আছে কি বলুন তো। হিয়ান আর বর্ষাই শুধু এ বাড়ির ছোট সদস্য না এ বাড়ির আরো এক ছোট সদস্য আছে। সে হলো রোদেলা আর শিশিরের দ্বিতীয় সন্তান তাদের আরেকটা ছোট্ট পরী নাম মেঘলা। দেড় বছর হয়েছে সে রোদের কোল আলো করে এ-ই পরিবারে এসেছে সে। দেখতে ভারী মিষ্টি,সাথে বর্ষার মতো অস্থির। তবে বর্ষার মতো ওতোটাও চঞ্চল না,একটু বোকাসোকা সাথে হিয়ানের আবার অনেক ফেবারিট!
!
!
!

ডাইনিং এ বসে রোদের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে মনোযোগ সহকারে তাকিয়ে আছে হিয়ান। খুব সর্তকভঙ্গিতে খেয়াল করছে তার ফুফুমনির প্রত্যেকটা কাজের ভঙ্গি। চায়ের কেটলি থেকে শিশিরের জন্য কাপে চা ঢালছে রোদেলা। রোদেলাকে শিশিরের চায়ে চিনি দিতে দেখে হিয়ান চোখ সরু করলো,কি একটা ভেবে নিয়ে রোদকে প্রশ্ন করে বললো,

– ফুফুমনি একটা কথা বলি?

– হ্যা মনি বল?

– তুমি তো মামুর চায়ে সবসময় দু চামচ চিনি দেও তাহলে আজ এক চামচ কেনো দিলে?

– বাহ বা! আমি তোর মামুর চায়ে কয় চামচ চিনি দেই সেটাও খেয়াল রাখিস তুই। ইশশ আমার বর্ষাটারো যদি একটু তোর মতো বুদ্ধিসুদ্ধি থাকতো।

– তোমার বড় মেয়ের কখনো বুদিসুদদি(বুদ্ধিসুদ্ধি) হবে না ফুফুমনি। ওর মাথায় শুধু আম্মুর মতো গল্প করার চিন্তা থাকে। কিন্তু তোমার ছোট মেয়ে অনেক ইন্টিলিজেন্ট হবে তুমি দেখো।

– তোর তো দেখছি আমার ছোট মেয়ের জন্য খুব ভালোবাসা। তা বিয়ে করবি আমার ছোট মেয়েকে। বানাবি আমাকে তোর শ্বাশুড়ি?

– মানে তুমি বোঝাতে চাইছো mother in law হতে চাও তুমি আমার?

– উমমমমমম হুমম। তোর মাদার ইন ল হতে চাই। কেনো বানাবি না? পছন্দ না আমাকে তোর?

– না পছন্দ, তুমি তো এই ওয়াল্ডের বেস্ট ফুফুমনি। কিন্তু তোমার ছোট মেয়ে যদি আমাকে বিয়ে না করে রিজেক্ট করে দেয় তকন(তখন)?

– কেনো রিজেক্ট করবে। আমার হিয়ান বাবার মতো বেষ্ট জামাই আমি পাবো নাকি তার জন্যে?

– আচ্ছা আমরা বড় হলে আমি তোমার মেয়েকে জিজ্ঞেস করবো সে আমাকে বিয়ে করবে কি না। যদি করে তাহলে তুমি আমার ফুফুমনি থেকে মাদার ইন ল হতে পারবে। নাহলে its our bad luck!

– হুম,আচ্ছা আমার মেয়েটা আগে বড় হোক। কলেজে উঠুক তারপর জিজ্ঞেস করবো না হয় কেমন।

– হুম। বাই দা ওয়ে তুমি কিন্তু এখনো বললে না মামুর চায়ে কেনো আজ এক চামচ চিনি দিলে?

– দিলাম কারণ তোর প্রিয় মামুজানের সুগার বেড়ে গেছে তাই সোনা!

– ইউ মিন ডায়াবেটিস?

– ইয়েশ মেরি জান ডায়াবেটিস।

– ওকে। ফাইন। আমি বাবার থেকে শুনেছিলাম ডায়াবেটিস নাকি সব অসুখের মূল,এতে নাকি সর্বপ্রথম পেশেন্টের চোখে ইফেক্ট করে,তারপর তাদের শরীরের কোনো ঘা সহজে শুকাতে চায় না। কোনো কোনো পেশেন্টকে নাকি ইনসুলিন অবধি নিতে হয়। সো ইটস ভেরি ডেঞ্জারাস। ইউ সুড বি ভেরি কেয়ারফুল এ্যাবাউট মামু।

হিয়ানের কথায় চোখ ঠিকরে বেড়িয়ে আসার উপক্রম রোদেলার। এটা তো দেখছি আরেক উজান!

– তোর বাবা বললো আর ওমনি তুই এতো কিছু মনে রেখে দিয়েছিস!

– হ্যা এটা এতো কঠিন কি যে মনে থাকতে নেই।

– না সেই তো কঠিন কি।

– ওকে তুমি মামুজানকে চা টা দিয়ে আসো। আমি পড়তে বসি। ইউ নো ইটস মাই স্ট্যাডি টাইম!

!
!

আয়নার সামনে টুলে বসে মাথায় চিরুনি করছে হিয়া। আর হিয়ার গলা জড়িয়ে আছে আমাদের সেই ছোট বর্ষা। যদিও এখন সে যথেষ্ট এ্যাডাল্ট।

– ফুফু মনিই চল না কালকে আমরা চিকলি ওয়াটার পার্ক থেকে ঘুরে আসি। কাল তো সবার ছুটি। আর তুই জানিস চিকলি পার্কটা এখন যা সুন্দর হয়েছে না। আমি তো আমার ফ্রেন্ডদের ফোনে ভিডিও দেখেই অস্থির।

– যাবি। ঠিক আছে। ভাইয়ার তো শুনলাম আবার নাকি প্রমোশন হয়েছে এই ফাঁকে ট্রিটো নেওয়া হ’য়ে যাবে বল,

– উফ এটা তো মাথা থেকেই বেড়িয়ে গিয়েছিলো আমার। কালকে বাবার পুরো পকেট ফুটো করে দিয়ে আসবো কেমন।

– হ্যা রোদ আপুতো ওতো খরচ করতে দিবে না এখন তোকে।

– আরে ওটা ব্যাপার না,আব্বুকে দিতে দিবে না তো কি হইছে মামু আছে না…আর কেউ না গেলে নাই তুমি আর আমি আছি কি করতে বলো বলো।

– পাগলি যা!

-তাহলে কাল আমরা ম্যাচিং করে ড্রেস পড়ি চলো,সবাই এক কালার।

– পড়বি বলছিস,বেশ তুই দেখ কোন কালারটা সবার আছে তারপর না-হয় ওভাবে তৈরি হবো।

– আচ্ছা যদি শাড়ি পড়ি তাহলে স্কুল দিয়ে আসার সময় ফুল নিয়ে আসবো কেমন,মাথায় দিয়ে ইন্সটাতে রিলস বানাবো,সেই হবে বলো।

মুখে খুশির হাসি টেনে হিয়া কিছু উওর করতে যাবে ওমনি হিয়ান এসে সোজা দাঁড়িয়ে পড়লো দু’জনের সামনে। বর্ষাকে চোখ পাকিয়ে বললো,

– তুই সবসময় আমার আম্মুর সাথে কানেকানে এতো কি কথা বলিস বুবু?

– এ-ই যে আসছে আরেক আম্মু। আমার কি মনে হয় জানিস ফুফু,আমি তোর মেয়ে হলে আর এ-ই হিয়ান আম্মুর ছেলে হলে খুব ভালো হতো। একদম খাপে খাপ মিলে যেতো বল।

হিয়া বর্ষার গালে হাত বুলিয়ে দিতেই হিয়ার গালে একটা বাবুনি এঁকে দিলো বর্ষা। এদিকে বিরক্ত হয়ে হিয়ান বললো,

– বর্ষা বুবু শোন। সবসময় সবাইকে এরকম বাবুনি দিবি না এতে অনেক হাইজিনের ব্যাপার থাকে। তুই তো মুখও দু বেলা ভালো করে ক্লিন করিস না। কতো জার্মস থাকে তোর মুখে তুই জানিস।

– আসছে আরেক পন্ডিত। শোন হিয়ান আমি তোর মতো না। আমার দাঁত না তোর মতো পোকা খেয়ে ভোতা হয়ে যায় নি৷ আর এটা তোর হাতে কি,কিসের বোতল এটা,দেখি?

– তোকে দেখতে হবে না। এটা আমার আম্মুর জন্য, মা?

– হ্যা বাবা কিসের বোতল এটা? আমি কি তোর কাছে কোনো বোতল চেয়েছিলাম আজ?

– না চাও নি,তবে কাল তোমাকে বলতে শুনলাম তোমার পানির পট টা নাকি মেডিকেলে হারিয়ে ফেলেছো। তাই এটা আজ দাদির সাথে গিয়ে নিয়ে আসছি। তোমার প্রিয় হ্যালো কিটি,see.

বোতল টা হাতে নিয়ে আবেগে জড়িয়ে পড়লো হিয়া। হিয়ানকে জড়িয়ে হিয়ানের কপালে চুমু খেলো। সাথে হিয়ানের পুরো মুখে হাত বুলিয়ে দোয়া দিতে দিতে বললো,

– আমার সোনাবাচ্চা টা মায়ের কি লাগবে না লাগবে সব খেয়াল রাখে। আবার এটাও জানে মায়ের হ্যালোকিটি পছন্দ!

– মা,তুমি আর বর্ষা কেনো এক জিনিস বুঝো না। একটু আগে বললাম না বাবুনি দিতে নেই যখনতখন এতে মুখে অনেক জার্মস থাকে সেগুলো লেগে যায়।

– উপসসস sorry sorry!

ব’লেই আবার হিয়ানকে জড়িয়ে আরো কয়েকটা বাবুনি দিয়ে বসলো হিয়া। এতে বেশ মজা পেলো বর্ষা। এদিকে এদের গল্প চলাকালীন ফ্লোরে হাঙ্গুর দিয়ে দিয়ে রুমে আসলো মেঘলা। মুখ দেখে মনে হচ্ছে কেবলই ঘুম থেকে উঠলো বাচ্চাটা। রোদ বোধ হয় রান্নাঘরে তাই ফাঁকতালে সোজা হিয়ার রুমে এসে হাজির সে। ছোট্ট মেঘলা পরীটাকে কোলে তুলে নিলো হিয়া। ঘুমন্ত মেঘলা কিছুক্ষণ হিয়ার বুকের উষ্ণুমে নড়াচড়া করলো,মেঘলার ধার ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা হিয়ান আর বর্ষা তাকে পেয়ে যেনো পুরো অস্থির হয়ে খেলতে শুরু করলো। এদিকে ছোট্ট মেঘলাও হিয়ান আর বর্ষার তালে এমন-ই হাসি দিয়ে উঠলো যে পুরো বাড়ি সকাল হতে না হতেই আনন্দে খুশিতে মুখরিত হয়ে উঠলো!

!
!
???
বাহিরের প্রকৃতিতে আজ দেখা মিলছে ঝড়ের পূর্বাভাস। আকাশে কালো কালো থোকা মেঘের ভারী স্তুপ। একটা ঝিরিঝিরি ঠান্ডা বাতাস। সাথে কখনো এক দমকা বাতাসের তান্ডব। বাতাসের এই গতিবিধি দেখে বোঝা মুশকিল বৃষ্টি টা আসলেই কখন গিয়ে নামবে। আর এই ঝড়ো প্রকৃতিতে বাসবির সাথে মিলাদের বাড়িতে যাবার জন্য পিছ নিয়েছে তার তিন নাতিনাতনি। বর্ষা তো আগেই দরজার চৌকাঠে গিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সাথে আজ তবারক নিতে বাসবির সাথে যেতে ইচ্ছে পোষণ করেছে স্বয়ং হিয়ান নিজেও। আর মেঘলা রানি,তার তো কথাই নেই বোনকে লিপিস্টিক দিয়ে নতুন জামাকাপড় পড়ে সাজুগুজু করতে দেখেই সেও শুরু করেছে বাহিরে যাবার বাহানা! কি করি এখন।

– বড় আম্মু আমি বলছি কি,তুমি কিন্তু তিনজনকে নিয়ে একা হাতে পারবে না। মেঘলা থাক তুমি বরং হিয়ান আর বর্ষাকেই নিয়ে যাও তোমার সাথে।

– ধুর বোকা মেয়ে তা হয়। বাচ্চা টা কান্না করছে না। আমার কোনো সমস্যা নেই শুধু তোর বড় মেয়ে না ওখানে গিয়ে কোনো দুষ্টুমি করে বসে।

বর্ষা কোমড়ে হাত ঝুলিয়ে বললো,

– আমি এখন আর কোনো দুষ্টুমি করি বড় আম্মু। আমি এখন অনেক স্থির হয়ে থাকি ইউ নো না?

রোদেলা তবুও আপওি করে বললো,

– না বড় আম্মু,তুমি আত্মীয়ের বাড়িতে যাচ্ছো,ওখানে সবার সাথে গল্প গুজব করবে। এখন এদেরকে নিয়ে গেলে এরা পুরো পাগল বানিয়ে দেবে তোমায় বিশ্বাস করো। তারচেয়ে বর্ষা থাক। তুমি বরং মেঘলা আর হিয়ানকে নিয়ে যাও।

– নো ওয়ে আম্মু। আমি তো দাদিমনির সাথে যাচ্ছি। বোনকে তুমি আগলে রাখো হু?

হিয়ান তার চোখের সানগ্লাস টা নামিয়ে গম্ভীর এক ভঙ্গিতে রোদেলাকে আশ্বাস দিয়ে বললো,

– ফুফুমনি ডোন্ট ওয়ারি। আমি আছি মেঘলাকে টেক কেয়ার করার জন্য। তুমি একদম নিশচিতে(নিশ্চিন্তে) থাকো।

হিয়ানের গলা জড়িয়ে একটা চুমু আঁকলো রোদেলা। আবেগে জড়িয়ে গিয়ে বললো” এ-ই তুই টা-ই তো আমার একমাত্র ভরসা মেরি জান। আর একজন তো?কোথায় ছোট বোনকে আগলে আগলে রাখবে উল্টে নিজের যাওয়া নিয়ে ব্যস্ত হয়ে আছে,কাকে আর কি বলি”

!
!
হেঁসে দিয়ে তিনজনকে নিয়েই বেড়িয়ে পড়লো বাসবি। দরজার খিল আটকিয়ে রুমে আসতেই উজানের দিকে দৃষ্টি পড়লো রোদেলার। উজানকে মুচকি দিয়ে হাসতে দেখে ভূ কূঁচকে রোদ প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়ে বললো,

– কি ব্যাপার হ্যা এরকম মিচকে মিচকে হেঁসে যাচ্ছিস কেনো শুনি….আশ্চর্য!

উজান জগ থেকে পানি ঢেলে খেতে খেতে বললো,

– হিয়াকে না একটু আগে রাগিয়ে দিয়েছি বুঝলি,বলেছি প্রিয়ন্তিকে দেখছি অনেক ডেডিকেশন নিয়ে কাজ করে তা আমি ভাবছি ওকে যদি আমার এ্যাসিসট্যান্ট রাখা যায়। আর তাতেই মহারানি রাগে ফুঁসতেছে। মুখ ফুলিয়ে দাঁত মুখ খিঁচে বসে আছে, একটা আওয়াজ অবধি করছে না।

– তুই না আসলে খুব খারাপ আছিস ভাই। জানিসই তো মেয়েটা প্রিয়ন্তীর কথা শুনলেই তেলে বেগুনে জ্বলে ওঠে। তাও কেনো বলিস…আমি হলে না শিশির এরকম করলে ঘর থেকে তো দূর বাড়ি থেকেই তাড়িয়ে দিতাম। হু।

– তুই যে ডাকনি রে ভাই। শিশির ওসব সাহস পাবে না। বউভীতু একটা!

বলেই রোদের মাথায় একটা গাট্টা মারলো উজান। ব্যাথায় খ্যাক করে উঠলো রোদেলা। উজানকে পাশ কাটিয়ে নিজের রুমে যেতে যেতে বললো,

– যা তো,ঢং শুরু করছে। পানির জগে ঢাকনাটা তো দে অন্তত।
!
!
নিজের রুমে এসে দরজায় খিল আটকিয়ে দিলো রোদেলা। আয়নায় একবার নিজেকে দেখে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা শিশিরের সামনে এসে দাঁড়িয়ে গেলো। শিশিরের হাতে থাকা ফোনটা কেঁড়ে নিয়ে ছুঁড়ে দিলো বিছানায়। শিশিরের কাঁধে দু হাত ঝুলিয়ে দুলতে থাকলো। সাথে শিশিরের হাত জোড়া নিয়ে এসে ঠেকালো নিজের কোমড়ে। এক হাতে শিশিরের ঠোঁট জোড়া স্লাইড করে দিতেই রোদকে একদম হ্যাচকা টেনে নিজের উপর এনে ফেললো শিশির। আবেগ জুড়িয়ে বললো,

– বাহ বা ম্যাডামের যে দেখছি আজ নিজে থেকে আদর নিতে ইচ্ছে মনে জাগছে।

– তা নয়তো কি,কেউ কি এখন আর আগের মতো আদর করে। পুরাতন হয়ে গিয়েছি না। অফিসে কতো সুন্দর সুন্দর মেয়ে এ্যামপ্লই সারাক্ষণ চোখের সামনে ঘুরঘুর করে সেগুলো দেখে এসে কি বউ কে আদর করতে ইচ্ছে জাগে নাকি কারো।

মৃদু হেঁসে দিয়ে শিশির বললো,

– জেলাসি! তা আপনার কি সত্যি সত্যি মনে হয় আপনার হাসবেন্ড আপনাকে রেখে অন্য মেয়েদের দিকে সারাক্ষণ তাকিয়ে থাকে?

– সত্যি বলবো?

– হুম!

– সত্যি বলতে যে মানুষ নিজের বাড়িটাকে অফিস বানিয়ে রাখে সে যে অফিসে কি করে তার সব হিসাব বোঝা শেষ আমার। আমার তো মনে হয় অফিসের সুন্দর সুন্দর মেয়েরা তাদের এই হ্যান্ডসাম বসের একটু সুমিষ্ট কথা শুনতেই মরিয়া হ’য়ে থাকে। বস তাদের পাওা দেয়া না কিনা!

– তাই তো….আর তুমি যে সবসময় বলো আমি বাড়িকে অফিস বানিয়ে রাখি,সারাক্ষণ ল্যাপটপে চোখ দিয়ে রাখি। এগুলা কার জন্য করি,তোমার জন্য করি,তোমাকে আমাদের বাচ্চাদেরকে একটা সুন্দর ভবিষ্যত দেবার জন্যেই তো করি। তুমি বুঝো না।

– সে নাহয় বুঝলাম। কিন্তু তাই বলে এতো কাজ। একটু তো আদর যত্ন করাই যায় না মাঝেমধ্যে।

রোদেলার নাকের সাথে নাক ঘষে দিয়ে শিশির বললো,

– আদর আদর করে করেই তো দুটো বাচ্চার মা-ই বানিয়ে দিলাম,তবুও হয় না।

– তোমার এ-ই আদর,এই যত্ন এই ভালোবাসাটুকুই তো আমার সবকিছু বর্ষার আব্বু।

– আর আমার সবকিছু যে তুমি সেটা বুঝো।

রোদেলা হাসি দিয়ে মাথার সাথে মাথা ঠুকিয়ে হুম বলতেই রোদেলাকে নিজের পায়ের উপর তুলে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সাইরির সুর টেনে শিশির বললো,

– আমার #চোখের_তারায়_তুই যে আছিস শুধু। যে চোখে নিবদ্ধ আছে শুধু তোর অস্তিত্ব। প্রিয় বস্তুুর মতো এক সুন্দর ভালোবাসা তুই যে আমার পাগলি। আর কবে বুঝবি বল। আর কবে বুঝবি।

শিশিরের বোকা বোকা সাইরি শুনে হেঁসে ফেললো রোদেলা। রোদেলার হাসির ঝংকার গিয়ে দোলা লাগলো শিশিরের মনে। ঝড়ো বাতাস বেড়ে উঠলো। ব্যালকুনির দরজাটা দেওয়ালে এক বারি খেলো। পর্দা উড়তে থাকলো তার রঙীন পাল তুলে। রোদেলা এগিয়ে এসে ব্যালকুনির দরজা লাগিয়ে দিতেই রোদকে থামিয়ে দিলো শিশির। ঘরের সব আলো নিভিয়ে রোদকে নিয়ে হারিয়ে গেলো তাদের নিজস্ব ভালোবাসার জগৎে। যে জগৎ শুধুই তাদের শুধুই দুজনার!

!
!
???
এদিকে ছাঁদ থেকে তুলে আনা কাপড় গুলো বিছানায় ছুঁড়ে ফেললো হিয়া। বেড কভার টা হাতে তুলে রাগে গজগজ করতে করতে সেটা গোছাতে শুরু করলো। কিন্তু রাগের তালে চাদর ভাজ তো দূর উল্টে বারবার বেভাজ হ’য়ে যাচ্ছে। হিয়ার এ-ই বেহাল কান্ডে বেশ মজা নিচ্ছে উজান। ইশশ রাগে দেখো পুরো লাল লঙ্কা হ’য়ে আছে মুখটা। না আর রাগিয়ে দেওয়া যাবে না। এবার একটু না মানালেই এই মুমেন্ট টা নষ্ট। এতো সুন্দর ওয়েদার এটাকে কি ওয়েস্ট করলে চলে!

দরজার খিল আটকিয়ে হিয়াকে এসে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো উজান। মুখ ডুবালো হিয়ার নরম কাঁধে। হিয়ার কানের লতিতে এক দীর্ঘ চুমু এঁকে দিয়ে বললো,

– হিয়ানের মা কি আজ খুব ক্ষেপে আছে নাকি।

– না,হিয়ানের মাকে কি কেউ কিছু বলছে যে হিয়ানের মা ক্ষেপে থাকবে…হিয়ানের মা তো ডাক্তার হতে পারে নি না। ডেন্টিসকে কি আর কেউ এ্যাসিসটেন্ট বানাতে চায় নাকি।

উজান হিয়াকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিয়ে বললো,

– তোমার কি সত্যি মনে হয়,যে আমার হিয়া যাকে পছন্দ করে না আমি তাকে আমার সহযোগী হিসাবে রাখবো।

– না..কিন্তু তুমি ঔ পেত্নীর নাম টাও বা মুখে আনবে কেনো। ওর নাম মুখে আনাও তোমার জন্য দোষ বুঝছো তুমি।

উজান হিয়ার মাথার সাথে মাথা ঠুকে দিয়ে বললো,

– আরে আমার হিয়ানের মা,কেনো তুমি বুঝো না আমার #চোখের_তারায়_তুমি যে আছো শুধু। যেই চোখের সবটা জুড়ে তার হিয়ার বসবাস। যেই চোখ শুধু তার হিয়াতেই নিবদ্ধ থাকতে জানে। অন্য কেউ তো তাকে ছুঁতেও পারে না।

হিয়া অভিমানের সুর টেনে বললো,

– বিশ্বাস করো হিয়ানের আব্বু তোমার মুখে না এসব রোমান্টিক কথা সত্যি বেমানান লাগে। তুমি ঔ তোমার ছেলের মতো বেরসিক আর গম্ভীরই সুন্দর।

হিয়াকে হ্যাচকা টেনে নিজের আরো কোল জুড়ে লেপ্টে নিয়ে উজান বললো,

– তাই, তা এই বেরসিক হাসবেন্ডকে কি এখন একটু আদরযত্ন করা যায়। দেখো ওয়েদার টা,তার উপর হিয়ানো নেই এ-ই মুহুর্তে যদি…

– কি বলতে কি চাও তুমি হিয়ানের বাবা। আমাদের ছেলে আমাদের মাঝে থাকলে কি আমাদের মধ্যে কোনো মুমেন্ট বিল্ডআপ হয় না নাকি…শোনো আমার ছেলে না এই ওয়াল্ডের বেস্ট ছেলে। কতো খেয়াল রাখে আমার তুমি জানো? তুমি তো সারাদিন ঔ মেডিকেল চেম্বার নিয়ে থাকো,একবারো কি ফোন দিয়ে খোঁজ নেও আমি কি খেলাম,কি পড়লাম! কিন্তু তোমার ছেলে কি করে জানো?

– কি করে?

– সে আধা ঘণ্টা পরপর নিচে গিয়ে দেখে আসে মা তোমার কি পানি লাগবে,মা তুমি কি কিছু খাবে। মা তুমি মাস্ক দেও নি কেনো মুখে। মা হাতে গ্লাভস পড়ে পেশেন্টের মুখে হাত দেও..মা এটা মা ওটা। আমার যে পানির পট দরকার সেটাও কিনে আনছে,তাও আবার আমার প্রিয় হ্যালো কিটি! তুমি দেখছো সে তার মায়ের সব পছন্দ অপছন্দ এ বয়সেই কীরকম বুঝে।

– হুমম বুঝলাম। দেখতে হবে না রক্ত টা কার।

– থাক আর তোমার রক্ত। তোমার ফ্যামিলির রক্ত পেলে না আমার ছেলে অহংকারের কমতি হতো না। ভাগ্যিস সে তো তার মায়ের মতো হয়েছে যার মনটা বিশাল এই আকাশটার সমান।

– হয়েছে মেরি জান। এবার নিজের ছেলের কথা বাদ দিয়ে আমরা একটু আমাদের কথা বলি। এতো সুন্দর একটা ওয়েদার। এখন একটু,

– একদম না হ্যা,আমার এখন অনেক কাজ আছে। নীচে কামিনী ফুলের গাছের ডাল টা হেলে গেছে এখন ওটাকে ঠিক করে না দিলেই যা বাতাস উঠেছে,সেই বাতাসের চোটে না ভেঙে যাগ।

– আরে সে পড়ে হবে। এখন একটু..আর বিশ্বাস করো হিয়া,মেঘলাকে দেখলে এখন বড্ড লোভ হয় আমার। আমি চাই আমাদেরো বর্ষার বা মেঘলার মতো একটা ছোট্ট ফুটফুটে মেয়ে আসুক।

– তুমি কি পাগল উজান,বাড়িতে এমনিতেই তিনটে বাচ্চার জ্বালায় থাকা যায় না। এখন আরো একটা। মা এবার পাগল হয়ে যাবে বিশ্বাস করো তুমি।

– হবে না মা পাগল,আর মা’কেই কেনো সবসময় দেখতে হবে। তুমি দেখবে। এখন তো চেম্বারো তোমার বাসায়।

– তা হয় না উজান৷ আচ্ছা মেঘলা আর একটু বড় হোক,হাটা শিখুক তারপর।

– এখন মানে এখনই ব্যাছ!

রাগে হিয়াকে নিজের সাথে আরো লেপ্টে নিতে হেঁসে দিলো হিয়া। উজানকে এক ধাক্কা দিয়ে এক দৌড়ে নিচে নেমে আসলো হিয়া। হিয়ার পিছে পিছে উজানো ছুটলো। দু’জনে এসে উপস্থিত হলো সেই কামিনী গাছ টার নিচে। সাথে এবার আকাশ কাপিয়ে শুরু হলো ঝুম বৃষ্টি। বৃষ্টিকে উপেক্ষা করেই হিয়া উজানের সহযোগিতায় কামিনী ফুলের ডাল টাকে শক্ত রশি দিয়ে বেধে সোজা করে দিলো। যাগ এখন আর যতোই ঝড় ঝাপটা আসুক আর কোনো ভয় নেই। হিয়ান হবার পর থেকে হিয়া তার প্রথম বাচ্চা টা হারিয়ে ফেলার শোক টা অনেকাংশে কাটিয়ে উঠতে পেরেছে। সবার অগোচরে চোখ ভিজলেও মন খারাপ টাকে আর বেশি প্রধান্য দেয় না হিয়া..গাছ টাকে ঠিক করে দিয়ে আর উপরে ফিরতে চাইলো না হিয়া,বায়না ধরলো তার প্রিয় বৃষ্টিতে ভেজার স্বাদ নেবার। উজানো না করলো না,আজকের বৃষ্টি টা যেনো একটু বেশি সুন্দর। বৃষ্টির সাথে হিয়াকেও নিজের বুকে আলিঙ্গন করে নিলো উজান। হিম শীতল বাতাসে কেঁপে উঠলো দু’জনের সমস্ত শরীর। বাতাসে বইতে থাকলো এক অদ্ভুত শিহরণ আর এদিকে ভেতর ঘরে চলতে থাকলো শিশির রোদেলার এক প্রেমের উওাপ।

সমাপ্ত❤️?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here