?#চোখের_তারায়_তুই?
#পর্ব_১৩
#ইভা_রহমান
না এই কয়েকদিন যাও বা মনটাকে সামলিয়ে বাস্তবে ফিরে আসা গিয়েছিলো কিন্তু আজ তো যেনো ভোর সকাল থেকে মনটা বড্ড খচখচ করছে হিয়ার। কলেজে গিয়েও মন টিকছে না, না মন টিকছে বাড়িতে এসে। মনে হচ্ছে ডুবে যাই হারিয়ে যাই ভেসে যাই কারো মাঝে। কিন্তু কার মাঝে ডুববে হিয়া,উজান স্যার? ধ্যাত কিসব বলছে এই অবাধ্য মনটা আজ। এতো কেনো বিশৃঙ্খলা তৈরি হচ্ছে হিয়ার সারা শরীর জুড়ে। এ-ই যন্ত্রণা যে বড্ড নেশালো,বড্ড নাছোড়বান্দা একবার লাগলো যখন আর ছাড়তেই চাইছে না,আশ্চর্য!
কোচিং-এ এসেও চুপচাপ বসে রইলো হিয়া। তাকে ঘিরে গল্পের হাট জমিয়েছে বাকি সবাই, লতা এখনো আসে নি নাহলে এ-ই হাট আরো হট্টগোলে ভরে উঠতে এতোক্ষণে। সবার গল্পের তালে রনি স্যার এসে রুমে পা রাখতেই যে যার জায়গায় বসে অবস্থান নিলো। রনি স্যারকে দেখে ক্লাসে উপস্থিত সবাই অবাক হলো হালকা। এখন তো রনি স্যারের ক্লাস না তাহলে। রনি স্যার একটু কেশে নিয়ে বললো” তোমাদের নীরব স্যারের ক্লাস তো এখন,ওটা আর আজকে হচ্ছে না,ইনফেক্ট আজকে তোমাদের আর কোনো ক্লাসই হবে না,তোমরা বাড়ি যাও” সবার মন তো ক্লাস না হবার খুশিতে ভরে উঠলো ঠিকই কিন্তু যখন ক্লাস না হবার কারণ জানা গেলো মুহুর্তে মনটা খারাপ হয়ে সবাই হতাশ হয়ে চেয়ে রইলো স্যারের দিকে। রনি স্যার জানালেন তোমাদের নীরব স্যার আর উজান স্যার ব্যাংকের মোড়ে একটা সাংঘাতিক এ্যাক্সিডেন্ট করেছে তা-ই ক্লাস আপাতত আজ ওফ। রনি স্যারের এ-ই কথা টা শুনে উপস্থিত সবার মাঝে সবচাইতে বেশি শকড হলো হিয়া। মনে হচ্ছে রনি স্যারের এ-ই কথাটুকু হিয়ার দমটাকে পিষে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট ছিলো। হিয়া কাঁপা কন্ঠে রনি স্যারকে কিছু জিজ্ঞেস করতে যাবে তার আগে উনি সেখান থেকে দূত পায়ে প্রস্থান নিলেন। হিয়া’র মুখের দিকে এ-ই মুহুর্তে তাকানো যাচ্ছে না,মুখ শুকিয়ে বিবর্ণ হয়ে গেছে,মনে হচ্ছে শরীরে তার কোনো রক্ত নেই,কিছু বলতে গিয়েও কণ্ঠনালি দিয়ে একটা আওয়াজো বের করতে পারছে না সে,মনে হচ্ছে কেও তার গলা চিপে ধরে তাকে বাকরুদ্ধ করে দিয়ে রাখছে। ঠিক এমনই মুহুর্তে লতা দৌড়ে এসে ভয়ার্ত কন্ঠে এমন-ই বাক্য বলতে শুরু করলে যে হিয়ার কপাল দিয়ে বিন্দু বিন্দু লোনাজল জল তো বের হচ্ছে সাথে হাতের আঙ্গুল গুলোও তিরতির করে কাঁপছে ভীষণ!
– তোরা শুনলি উজান স্যারের এ্যাক্সিডেন্টের কথা,আমার তো হাত পা কাঁপছে। স্যারের মাথায় হেলমেট ছিলো না আর গাড়িটা এসে,আমি আমি দেখে আসলাম রাস্তা টা এখনো কিরকম রক্ত দিয়ে পুরো রাস্তা। আমার খুব ভয় করছে মোহিনী উজান স্যার ঠিক হয়ে যাবে তো?
না বলে চিৎকার করে উঠলো হিয়া৷ এগুলো লতা কি বলছে,হেলমেট,রক্ত। না এগুলো সব মিথ্যা,সব সব সব। রনি স্যারের কোথাও ভূল হচ্ছে,হ্যা হ্যা হ্যা ভূল হচ্ছে। লতা বললো কোনো ভূল হচ্ছে না আমি নিজ কানে আর নিজ চোখে দেখে আসছি,পুরো রাস্তা এখনো অবরোধ করে রাখছে রাস্তার সবাই,এরপরো তুই বলবি স্যারের কিছু হয়নি!
চোখ দিয়ে টপটপ করে অবিরত ঝর্নার মতো পানি পড়ছে হিয়ার। এটা কি করে হতে পারে। কালকে রাতেই তো মানুষটাকে ভালো দেখলো সে তাহলে এখন হঠাৎ। লতার এ-ই চাহনি এ-ই ভয়ার্ত কন্ঠ নিঃসৃত প্রত্যেকটা বাক্য হিয়ার পাঁজর গুলোকে ভেঙে চুরমার করে দিলো মুহুর্তে। হিয়া কান্নারত কন্ঠে অস্ফুটে বলতে থাকলো” আমি যাবো,আমি আমি উজান স্যারের কাছে যাবো,কিচ্ছু হতে দেবো না আমি ওনার,উনি ঠিক হয়ে যাবে,কত কত রক্ত লাগবে ওনার,সব সব আমি দেবো,তোরা তোরা বল না আমার উজান স্যার কোথায় আছে বল না তোরা কোথায় গেলে আমি এখন ওনাকে পাবো,কি হলো কি তুই চুপ হয়ে কেনো আছিস লতা বল না উনি কোথায়” লতাকে চুপ থাকতে দেখে আরো চিৎকার শুরু করলো হিয়া,উপস্থিত সবাই দাঁড়িয়ে শুধু হিয়ার এ-ই অভিব্যাক্তি টা-ই দেখছিলো,এরকম করছে কেনো হিয়া? লতা হিয়ার চোখ মুছে দিয়ে বললো শুনলাম কছিরউদ্দীনে নাকি নিয়ে যাওয়া হয়েছে ওনাদের তুই যাবি? হিয়া লতাকে উওর দেবার প্রয়োজন টুকু আর বোধ করলো না,কাঁধের ব্যাগ টা নিয়ে সোজা নিচে নেমে পড়লো,রনি স্যারদের সাথে কথা বলে পরামর্শ নেবার কথাও মনে আসলো না তার। তাকে যে এক্ষুনি তার উজান স্যারের কাছে যেতে হবে এক্ষুনি মানে এক্ষুনি!
– বলছি কি লতা আমার মনে হচ্ছে আমাদেরো একবার স্যারকে দেখে আসা উচিৎ,এতো বড় একটা এ্যাক্সিডেন্ট..
মুখে ডেভিল সূচক হাসি আঁকলো লতা,মোহিনীর গাল দুটো চিপে ধরে বললো,
– কিসের বড় এ্যাক্সিডেন্ট বাবু,,আমি তো জাস্ট হিয়ার মনে ঢংঢং ঘন্টা বাজাতে এসব নাটক করলাম!
লতাকে ঘিরে রাখা সবার চোখ এবার কোটর থেকে বেড়িয়ে পড়ার উপক্রম,এসব কি বলছে লতা,নাটক করছিলো মানে!
– আরে বোকারা,এ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে কিন্তু সাংঘাতিক কিছু না,ঔ উজান স্যারের বাইকে করে স্যাররা ক্লাস নিতে আসছিলো তখন ঔ একটা অটোর সাথে লেগে মনে হয় ব্যালেন্স হারায়,তাতে ঔ নীরব স্যারের পায়ে ছিলে যায় হালকা,আর তাকে নিয়ে উজান স্যার এখন ক্লিনিকে..
– কিন্তু তুই যে বললি উজান স্যারের মাথা ফেটে রক্ত,এসব কি শুধু হিয়াকে বলার জন্য!
– হ্যা ভাই,বেচারির মুখ টা দেখছিস,চোখ দিয়ে তো অঝোরে বৃষ্টি নামাইতে ছিলো আর বলে কি না স্যারকে ভালোবাসে না। এরপর যখন বুঝবে তখন কি করে মনের ঘন্টা কিরিং কিরিং করে না ওঠে তাই দেখবো আমি,
– তোকে কিন্তু হিয়া এরপর আসলে খু*ন করে ফেলবে লতা।
– করলে করবে,ভয় পাই না-কি ওরে হু..বাড়ি যাবি তো এখন,আর তো ক্লাস হবে বলে মনে হচ্ছে না।
– হুম হবে না রনি স্যার এসে বলে গেলেন,চল…তবে যাই বলিস হিয়া বেচারি কিন্তু খুব ভয় পাইছে,
– ওটাই তো চেয়েছিলাম,ইশশ ওদের ঔ মুমেন্ট টা যদি নিজ চোখে দেখতে পারতাম!
!
!
সব কিছুকে তুচ্ছ করে হিয়া এসে পৌঁছায় ক্লিনিকে,হিয়ার কান্নারত মুখশ্রীটাকে এতোক্ষণ যেমন চোখ মেলে রাস্তার মানুষজন চেয়ে দেখছিলো ঠিক তেমনি ক্লিনিকের প্রত্যেকটা স্টাফ নার্স সবাই কান্নারত হিয়ার মুখের দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে। হাত পা কাঁপছে হিয়ার,সাথে কাঁপছে তার ভেজা ভেজা গোলাপি ঠোঁটযুগল,একদম যেনো বাচ্চা একটা। যেনো ভীড়ে হারিয়ে যাওয়া নিজের মা’কে খুঁজতে কান্নারত মরিয়া এক ছোট্ট শিশু।
– তোমার কোথাও ভূল হচ্ছে মা এখানে এরকম কোনো এ্যাক্সিডেন্টের পেশেন্ট আসে নি,তুমি আরেকবার ভালো করে শুনে নেও।
– আমার কোনো ভূল হচ্ছে না,আমি আমি আপনাদের নিচে আমার স্যারের বাইক দেখেছি উনি আপনাদের ক্লিনিকেই এসেছেন,
– তাহলে তুমি তোমার বাড়িতে ফোন দিয়ে বলো কোথায় কোন কেবিনে ওনারা?
– ফোন ফোন তো সাথে করে নিয়ে আসিনি আমি,আপনারা একটু ভালো করে দেখুন উজান নাম ওনার,উজান শাহরিয়ার একটু খুঁজুন না আরেকবার,
হিয়ার চঞ্চলতা দেখে পাশ থেকে এক ভদ্রলোক বললেন তুমি যে-ই এ্যাক্সিডেন্টের কথা বলছো এরকম তো কোনো পেশেন্ট আসেনি,তবে একটা ছেলের পা হালকা ছিলে গেছে সে আপাতত আমাদের এখানে এ্যাডমিট আছে,হিয়া অস্থির চিওে বলছে না হালকা করে পা ছিলে গেছে এরকম না ওনার অনেক বড় একটা এ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে মাথা দিয়ে অনেক রক্ত বেড়িয়েছে আপনারা প্লিজ একটু দেখুন। একটা পর্যায় লোক গুলো বিরক্ত হয়ে হিয়াকে তাড়িয়ে দিতেই হিয়া দিক বিদিক ভূলে রিসিপশনের লোকগুলোর চোখ ফাঁকি দিয়ে উপরে চলে আসলো,আর এসেই খুঁজতে শুরু করলো প্রত্যেকটা কেবিন। তিন তলায় উঠে দুটো কেবিন দেখার পর যে-ই তিন নাম্বার কেবিনের দিকে হিয়া পা বাড়াতে যাবে ওমনি ঔ লাইনের শেষ মাথায় ৭ নাম্বার কেবিনের দিকে চোখ পড়তে থমকে গেলো হিয়া,উজান না ওটা দাঁড়িয়ে! কান্নারত ঝাপসা চোখ গুলোতে দু’বার পলক ফেললো হিয়া,বুঝতে চাইলো সে কি ঠিক দেখছে,হ্যা সে ঠিক দেখছে,এটা এটা তো তার উজান স্যার’ই। ফাইল হাতে কেবিনের ভেতর ঢুকতে আবার মিলিয়ে গেলো উজান। হুঁশ ফিরলো হিয়ার৷ নিজেকে সামলে এক ছুটে সেই কেবিনের দরজায় এসে ধাম করে পড়লো হিয়া। অস্ফুটে মুখ দিয়ে বেড়িয়ে আসলো সেই প্রাণ প্রিয় শব্দ “উজান স্যার” দরজার ধিরিম শব্দের সাথে সেই পরিচিত কন্ঠের মিষ্টি ডাক কানে পৌঁছাতে ফাইল হাতে মুখ ঘুরে পেছনে তাকালো উজান। বিস্ময়ের বিস্ময় এসে মুহুর্তে গ্রাস করলো উজানকে,হিয়া এখানে! ক্ষীণ কন্ঠে ঠোঁট কেঁপে বেড়িয়ে আসলো “হিয়া”…. এক ছুটে দৌড়ে এসে হিয়া ঝাপিয়ে পড়লো উজানের বুকে। দিক বিদিক আকাশ পাতাল আসমান জমিন সব ভুলে বসলো মুহুর্তে। আশেপাশে কি আছে কে আছে কাউকে তোয়াক্কা না করে সামনের মানুষ টার প্রশস্ত বুকে নিজের পুরোটা মেলে দিলো হিয়া। হিয়ার জাপ্টে ধরাতে উজানের আয়রন করা পিঠের শার্ট কুচকে গেলো নিমিষে। হিয়া এখন আর কাঁদছে না৷ ভয় টা এতো পরিমাণে হিয়াকে ঝেঁপে ধরেছিলো যে হিয়া’র চোখের পানি উজানকে দেখা মাএই পাথর হয়ে জমে গিয়েছে। হিয়ার নিশ্বাসের উওাপ,হিয়ার নিশ্বাসের ভয়ার্ত সুর,তিরতির করে কাঁপতে থাকা কন্দনরত ভেজা ঠোঁটের ক্ষীণ আওয়াজ সব কিছু মিলিয়ে উজানের বুঝতে বাকি থাকলো না হিয়া ভয় পেয়েছে খুব খুব ভয় পেয়েছে হিয়াকে। উজান নিজের বুক থেকে হিয়ার মুখ ওঠাতে চাইলো কিন্তু হিয়া আরো জোরে উজানকে আঁকড়ে ধরলো, এদিকে কেবিনের বেডে শুইয়ে থাকা নীরব আর তার বড় ভাই নিলয়ের সামনে খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো উজান।
– হিয়া…হিয়া শোনো…হিয়া
অনেক কষ্টে হিয়ার মুখ টা তুলতে সক্ষম হলো উজান,নিজের হাত জোড়া উঁচু করে ধরলো হিয়ার গালের ভাঁজ,কান্নাটাকে দমিয়ে কাঁপা ঠোঁটে হিয়া বললো,
– আপনি ঠিক আছেন তো উজান স্যার!
উজান হিয়ার বা গালের সরু লাইন করে আসা পানির ফোঁটাটাকে,তার জড়িয়ে রাখা হাতের বুড়ো আঙ্গুলে মুছে বললো,
– আমার আবার কি হবে,এ-ই যে আমি একদম ঠিক আছি,দেখো,
নিজের গালে রাখা উজানের হাত দুটোকে চেপে ধরে হিয়া বললো,
– লতা লতা যে বললো আপনি এ্যাক্সিডেন্ট করেছেন আপনার মাথা দিয়ে অনেক রক্ত বের হচ্ছে,
– ধুর পাগলি,লতা কাকে দেখতে কাকে দেখেছে,কিচ্ছু হয়নি আমার,
– রনি রনি স্যার যে বললো আপনি আর নীরব স্যার নাকি সেটাও কি মিথ্যা..
– না তবে একটা ছোট খাটো এ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে কিন্তু আমার না তোমার নীরব স্যারের,দেখো পায়ে হালকা ব্যান্ডেজ করা ওনার,
হিয়া ঝাপসা চোখ গুলো ভালো করে মুছে এপাশে ফিরে দেখলো বা পায়ে ব্যান্ডেজ নিয়ে শুইয়ে আছে তার নীরব স্যার,সাথে তার ভাই নিলয়। তারা দুজনেই তাদের দিকে তাকিয়ে হা হয়ে আছে কিরকম! উজান হিয়ার থেকে হালকা দূরত্ব বজায় নিলো। হিয়া চোখ মুখ ভালো করে মুছে নিজেকে ঠিক করে নীরব স্যারের উদ্দেশ্যে বললো স্যার আপনি ঠিক আছেন? নীরব স্যার মুচকি হেঁসে বললো আমি ঠিক আছি বোন কিন্তু তোর চোখ মুখের অবস্থা দেখে তো মনে হচ্ছে উজান স্যারের চিন্তায় তুই একবারে..খানিকটা লজ্জা পেলো হিয়া। নিজের এ-ই কান্ডে এ-ই মুহুর্তে লতার চাইতে নিজের মাথার চুল গুলো বেশি টেনে টেনে ছিঁড়তে ইচ্ছে হচ্ছে তার,পাতার বাচ্চা লতা কালকে আয় শুধু কলেজে,যদি ছয় তালার ছাঁদ থেকে তোকে জিন্দা না ফেলছি আমার নামো হিয়া না।
রনি স্যার সহ নীরবের আরো কয়েকজন বন্ধু আসায় উজান তাদের থেকে বিদায় নিয়ে হিয়াকে নিয়ে ক্লিনিক থেকে বেড়িয়ে পড়লো। হিয়া নির্বাক,এ মুহুর্তে হিয়ার মুখ দিয়ে কোনো কথা বের হতে চাইছে না। যেনো ভাবনার এক অতল গভীরে নিজেকে ডুবিয়ে দিতে ব্যস্ত হিয়া,দূরন্ত মনটা আজ তার এ কয়েকদিনের ছটফটানি টাকে থামিয়ে একটা বিষয়ে বুঝতে পারার আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে। অংকের সূএের চাইতেও কঠিন এ-ই ভালোবাসার গাণিতিক সমীকরণ। না এর শুরু আছে না শেষ শুধু উওর মেলানোটাই যথেষ্ট না যার কাছে,অংক টাকে বুঝতে পারার একটা সুপ্ত বাসনা যার থাকা চাই।
হিয়াকে নিয়ে সোজা মহিপুর ঘাটের দিকে পাড়ি জমালো উজান। হিয়া এর আগে শুধু একবার এই ঘাটে এসেছে তাও আবার ইদে চাচিদের সাথে বেড়াতে। তাই এতোদূর পথের এ-ই রাস্তা সম্পর্কে হিয়ার জানা নেই। তবু হিয়ার মনে কোনো প্রশ্ন উঠছে না তারা কোথায় যাচ্ছে এখন। যাচ্ছে হয়তো কোথাও একটা একটা শান্ত গহীন জায়গায়!
পুরো রাস্তা আর বাইকে কেউ কারো সাথে একটা কথা বললো না,উজান কিছু খাবে কি না জিজ্ঞেস করাতে হিয়া শুধু না ব’লেই চুপ হয়ে রইলো। কথা বাড়ালো না উজান। ব্রীজের নিচে নামালো বাইক টা। নিয়ে আসলো এক চড়ের কাছে। যার সামনে সুপ্রশ্বস্ত তিস্তার বয়ে যা-ওয়া এক অবলীল সৌন্দর্য। চারিদিকে শুধু অথৈ পানির কলকল ধব্বি। উজান হিয়াকে নিয়ে পাড়ে নামতেই এক মাঝিকে ডেকে বললো নদী ঘুরবো রিজার্ভ কতো নিবে।
ছোট্ট ছেলে টা বললো ভাই হাজার টাকা দেন ঔ দূরে যে চড় টা দেখছেন নৌকা বাঁধা আপনারে ঘুরায় আনমু নে। আপনি আপার লগে ঔ বাঁধা নৌকায় যতোক্ষণ খুশি সময় কাটাতে পারেন। উজান হাসলো শুধু ,হেঁসে দিয়ে বললো ধুর মিয়া এই টুকুর জন্য হাজার টাকা চাও৷ ছেলে টা হেঁসে দিয়ে বললো চড় টা একদম নিরিবিলি ভাই কেউ আপনাগো বিরক্ত করবে না। উজান বললো আটশো দেবো চলো কিন্তু আমার বাইক। ছেলে টা বললো সমস্যা নাই ভাই ঔ যে দেখছেন আমার ছোট ভাই আছে আসেন। উজান একটু ইতস্তত করলেও উদাসীন হিয়ার দিকে তাকিয়ে বললো আচ্ছা চলো। মাঝি ছেলে টা নৌকা চালিয়ে উজান আর হিয়াকে একটুদূর সেই চড়ে নিয়ে গিয়ে দাঁড় টানলো। বললো ভাই আপনারা ঔই বাঁধা নৌকায় গিয়ে বসেন আমি আরেকটা টিপ দিয়া আসি। উজান বললো যদি আর ফিরে না আসো তখন। ছেলেটা মুচকি হেঁসে বললো এটা আমার ব্যবসা ভাই আপনার টা মারি খাইলে কিছু দিন ভালো থাকবো বাকি জীবন তো আর চালাইতে পারবো না। উজান মাথা নাড়িয়ে বললো আচ্ছা যা-ও। উজান হিয়াকে নিয়ে বেঁধে রাখা নৌকা টায় গিয়ে বসতে ছেলেটা প্রস্থান নিলো। ইঞ্জিন চালিয়ে মুহুর্তে সামনে মিলিয়ে গেলো তার নৌকা।
হিয়া এসে বসলো চড়ে বাঁধা সেই নৌকার মাথায়। উজান আলতো পায়ে হিয়ার পাশে গিয়ে পা মেলে দিয়ে বসলো। হিয়ার দৃষ্টি বহুদূর ঔ নদীর শেষ সীমান্তে আর উজানের দৃষ্টি আবদ্ধ চিন্তারত হিয়ার মুখের ভাঁজে! চারপাশে কোনো মানুষ নেই না আছে কোনো কাক পক্ষী,শুধু কিছুক্ষণ পর পর দেখা মিলছে কিছু উড়ে চলা সাদা বকের। নিরিবিলি পরিবেশ সাথে শান্ত বাতাস চারপাশে থৈ থৈ পানি যার মাঝে বসে দুই প্রেমিক প্রেমিকা। এ এক অদ্ভুত অনুভূতি অদ্ভুত শিহরণ!
পিনপতন নীরবতা ভেঙে উজান সোজাসাপটা হিয়াকে জিজ্ঞেস করলো,
-ভালোবাসো আমাকে?
হিয়া নদীর বুকে দৃষ্টি আবদ্ধ করে স্থির কন্ঠে বললো,
– আজকে আপনার জন্য যে-ই ভয় টা আমি পেয়েছি এটাকে কি ভালোবাসা বলে?
উজান মাথা নাড়িয়ে বলল,
-হুম বলে
উজানের চোখ চোখ রাখলো হিয়া। চারচোখ নিজেদের মধ্যে আবদ্ধ হতেই হিয়া বললো,
– এটাকেই যদি ভালোবাসা বলে, হ্যা তাহলে আমি ভালোবাসি আপনাকে!
সোজাসাপটা উত্তর হিয়ার,অবাক হলো না উজান,জানে হিয়া সোজা কথা সোজা ভাবেই বলতে পছন্দ করে।
– আপনি ভালোবাসেন আমাকে?
হিয়ার প্রশ্নে এক ভূ উপরে তুলে হিয়ার দিকে তাকালো উজান,পরমুহূর্তে উল্টো হয়ে নৌকায় পিঠ মেলে দিয়ে শুইয়ে পড়লো। আকাশের দিকে তাকিয়ে এক হাত আকাশের বুকে তুলে হিয়াকে বললো,
– ঔ আকাশ টা দেখতে পাচ্ছো?
হিয়া উজানের হাতের দিক অনুসরণ করে আকাশের দিকে তাকাতেই চোখ পিটপিট হয়ে আসলো হিয়ার,উফফ রোদ টাকে কি সোজা হিয়ার মুখে এসেই পড়তে হলো,হিয়া কপালে হাত ঠেকিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে বললো,
– হুম দেখতে পাচ্ছি।
– এ-ই আকাশ টা যতোবড় তার চাইতেও বেশি ভালোবাসি আমি তোমাকে,
হিয়া আকাশের দিকে তাকিয়েই প্রশ্ন ছুঁড়লো
– পারবেন আমার মতো বেখায়লীই চঞ্চল অস্থির অশান্ত দূরন্ত একটা মেয়ের সাথে সারাটা জীবন পাড় করতে?
– শুধু পাড় করতে না এ-ই বেখেয়ালী চঞ্চল অস্থির অশান্ত দূরন্ত মেয়েটাকেই আমার চাই,সারাটা জীবন চাই সারাটা মুহুর্ত চাই সারাটা সময় জুড়ে চাই,অনেক চাই,চাওয়ার থেকেও যদি বেশি কিছু থাকে তার উর্ধ্বে গিয়ে হলেও চাই..!!
– আর আপনার পরিবার?
-পরিবার….মানে?
উঠে বসলো উজান,হিয়ার দিকে আরেকটু সরে এসে বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলো,হিয়া আকাশের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে উজানের দিকে তাকিয়ে বললো,
– আপনার পরিবার যদি রাজি না থাকে?
– হঠাৎ এ-ই প্রশ্ন! রাজি না হবার কি আছে হিয়া?
– আমি অনাথ উজান স্যার!
হিয়ার কথায় উজান হিয়াকে অকপটে নিজের বুকে লুকিয়ে নিয়ে আবার নৌকার পিঠে নিজের পিঠ শুইয়ে দিলেন। এভাবে খোলা আকাশের নিচে উজানের বুকে শুইয়ে পড়তে একটু বিব্রত হচ্ছিলো হিয়া,সাথে লজ্জা পেলো হালকা,কিন্তু তার সাথে একটা অন্য রকম শান্তি এসে ছেয়ে গেলো হিয়ার সারা রন্ধ্র জুড়ে।
– তুমি অনাথ না হিয়া,শিশির আছে রোদ আছে আমি আছি তারপরো তুমি বলবে তুমি অনাথ।
– আমার খুব ভয় করে উজান স্যার,
উজান হিয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
-কিসের ভয় হিয়া?
-ভাইয়া যদি রাজি না হয়।
– খু*ন করে ফেলবো তোমার ভাইয়াকে।
– আপনি ভাইয়াকে খু*ন করতে পারবেন না উজান স্যার।
– পারবো।
-পারবেন না।
– বললাম না পারবো।
– না আপনি পারবেন না।
মৃদু হেঁসে দিলো হিয়া,রেগে গেলো উজান,তৎক্ষনাৎ হিয়াকে টেনে এনে নিজের মুখের উপর ফেললো,হিয়া নৌকার পাটিতে কনুই ঠেকিয়ে সে ধাক্কা সামলে নিলো,হিয়ার খুলে রাখা চুল এসে পড়লো উজানের মুখে,লজ্জায় উজানের চোখ থেকে চোখ নামিয়ে সেই পলক এনে হিয়া উজানের গলার কাছে ফেললো,লজ্জারত হিয়া পিচ্চির চোখ নামিয়ে তাকানো টা বড্ড মনে লাগলো উজানের। মৃদু হেসে উজান এক হাত দিয়ে হিয়ার এক পাশের চুল গুলো হিয়ার কানে গুঁজে দিয়ে শান্ত কন্ঠে বললো,
– হ্যা পারবো না শিশির কে খু*ন করতে,কিন্তু তোমাকে,তোমাকে তো খু*ন করতে পারবো।
অবাক চোখে উজানের চোখে চোখ তুলে তাকালো হিয়া,কি বলছে উজান এসব যাকে ভালোবাসে তাকেই কিনা খু*ন করতে চাইছে সে!
– এ-ই আপনি আমাকে ভালোবাসেন!
– হ্যা,তুমি যদি আমার না হও তাহলে এ-ই তোমার উজান স্যার তোমাকে অন্য কারো হতে তো দেবোই না দরকার পড়লে তোমাকে খু*ন করে নিজেও মরে যাবো।
মুচঁকি হেঁসে দিলো হিয়া,গল্পের বইয়ের সেই প্রিয় চরিএের কথা মনে পড়ে গেলো জেনো তার, যে তার প্রেয়সীকে পাবার জন্য মরিয়া,হন্যে,একটু সাইকো,হালকা পাগলাটে কিন্তু বড্ড বিচক্ষণ সাথে সুদর্শনো বটে!
হিয়াকে লজ্জা লজ্জা হাসি দিতে দেখে উজান ভূ তে ভাঁজ এঁটে বললো”কি ব্যাপার এতো হাসি পাচ্ছে কিসের জন্য শুনি”
হিয়া উজানের উপর থেকে মুখ তুলে আবার হাঁটু মুড়ে বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে বললো” কোথায় হাসছি আমি” হিয়ার সাথে উজান উঠে বসলো,হিয়াকে নিজের বুকে এক হাত আগলে ধরে হিয়ার আঙ্গুলের ভাঁজে আঙ্গুল গুঁজে নিয়ে বললো “তাইতো হিয়া আবার হাসতে জানে নাকি”….এবার একটু শব্দ করে হাসলো হিয়া।সাথে লজ্জাও পেলে ভীষণ মনে মনে বললো”এই উজান স্যার টা এরকম কেনো,যেনো মনে হচ্ছে কতো বছর না কতো যুগ যুগ ধরে দু’জনের মধ্যে গড়ে ওঠা আমাদের এই সম্পর্ক। কতো সহজে জড়িয়ে ধরছে, কাছে টানছে,চুলগুলো কানের পাশে গুঁজে দিচ্ছে, আবার হাতের ভাঁজে হাত গুঁজে দিয়ে নিজের প্রশ্বস্ত বুকে লুকিয়ে নিচ্ছে। লোকটার কি একটুও লজ্জা পাচ্ছে না। ধ্যাত এদিকে যে আমি লজ্জায় শেষ হ’য়ে যাচ্ছি উনি কি বুঝতে পারছেন না,সত্যি কি উনি এতো অবুঝ!
কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থেকে উজান হিয়াকে বুক থেকে তুলে বললো,
-একটা ম্যাজিক দেখবা হিয়া!
– ম্যাজিক কিসের ম্যাজিক!
-কান টা বন্ধ করো,
-হ্যাএএ
হিয়ার নাক টেনে উজান বললো হ্যাএএ না হ্যা।লোকে সারপ্রাইজ দিতে বলে চোখ বন্ধ করতে বলে আর এনাকে দেখো কি করতে বলছে। উজানের কথা মতো হিয়া দু’হাতের আঙ্গুল দিয়ে কানের পর্দা চিপে ধরে বললো এবার! উজান সামনে তাকিয়ে একটা জোড়ে চিৎকার করে সাথে সাথে হিয়ার কান থেকে হাত নামিয়ে বললো শুনো,হিয়া কান পেতে শুনতে চেষ্টা করলো সেই উচ্চারিত প্রতিধ্বনি”অনেক ভালোবাসি তোমায় হিয়া অনেক অনেক ভালোবাসি” মায়াবী চোখে উজানের দিকে তাকালো হিয়া,পরমুহূর্তে লজ্জায় চোখ নামিয়ে বললো আমিও একবার এ-ই আকাশটাকে জানাতে চাই আমি আপনাকে ঠিক কতোটা ভালোবাসি” উজান চোখের ইশারায় বললো বলো আমি শুনছি। হিয়া একটা দীর্ঘ শ্বাস টেনে দাঁড়িয়ে উঠে ঔ আকাশ পানে তাকিয়ে যেই বলতে যাবে উজান স্যা…ওমনি উজান পেছন থেকে এসে হিয়ার মুখ চিপে ধরে হিয়াকে পেছন থেকে নিজের বুকে এনে ফেললো,
– এখনো স্যার..উজান বলো..কি হলো বলো?
মুখ চিপে ধরে রাখায় হিয়া শুধু উমমম উমম বললো,ওহ রে মুখে যে হাত দিয়ে রাখছে উজান হুঁশে ফিরতে হাত নামিয়ে বললো,এখন বলো..হিয়া মুখ গোমড়া করে বললো না আমি পারবো না নাম ধরে আপনাকে ডাকতে। রাগান্বিত দৃষ্টিতে উজান হিয়ার দিকে তাকিয়ে বললো..নাম ধরে বলো নাহলে কিন্তু নদীতে এক ধাক্কায় ফেলায় দেবো আমি..রেগে গিয়ে উজানের শার্টের কলার ধরে বললো” আমাকে ফেলায় দিলে আমি আপনাকে নিয়েই পড়বো উজান স্যার” উজান রেগে গিয়ে বললো তুমি বলবে কি না আমি..শেষমেশ বাধ্য হয়ে হিয়াকে হার মানতে হলো। হিয়া পেছন ফিরে আকাশ পানে তাকাতে উজান আলতো করে হিয়াকে জড়িয়ে নিজের থুতনি ঠেকালো হিয়ার কানের লতির কাছে। লজ্জা পেলো হিয়া সাথে কন্ঠটাকে প্রসারিত করে হিয়া ঔ আকাশপানে চিৎকার ছুঁড়ে বললো”আমিও আপনাকে অনেক ভালোবাসি উজান,অনেক অনেক ভালোবাসি”
নদীর ঢেউয়ের গর্জন,সাথে নদীর কলকল ধ্বন্নি,তপ্ত রোদের উষ্ণ আমেজ,একটু দূরে উড়ে চলা সাদা বকটার পাখা ঝাপ্টানি সাথে আকাশ জুড়ে একটাই প্রতিধ্বনির আওয়াজ “ভালোবাসা ভালোবাসা ভালোবাসা আর ভালোবাসার নামের পাশে পরোতে পরোতে মেশা আমাদের #উজানহিয়া ??
চলবে….