?#চোখের_তারায়_তুই?
#পর্ব_১৪
#ইভা_রহমান
সময়ের বহমানতার সাথে চারটে অক্ষত হৃদয় এর সুপ্ত ভালোবাসা ছড়িয়ে পড়তে থাকলো প্রকৃতির কোল জুড়ে,নীরবে,অন্তরালে,সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে,কখনো বা বিশাল আকাশের বুক চিড়ে..শিশিরকে ফাঁকি দিয়ে উজান হিয়া ব্যস্ত হয়ে পড়লো একে অপরের মাঝে নিজেদের প্রেমের উষ্ণতা ছড়িয়ে দিতে,কখনো কোচিং এ ক্লাস নিতে আসা উজানের সাথে আড়ালে আবডালে করা হিয়ার নয়নযুগল এর লজ্জামাখা লুকোচুরি আবার কখনো বা বাড়িতে এসে শিশিরের সামনেই নিষ্পাপ কিছু খুনসুটির ছড়াছড়ি। কখনো কোচিং শেষে বা কোচিং এর ক্লাস ফাঁকি দিয়ে উজানের সাথে মহিপুর ঘাটের নৌকা ভ্রমণ কখনো বা রোদের কাছে পড়তে এসে উজানকে এক পলক চোখে দেখার শান্তি। অপরদিকে রোদের আশকারায় নিজের আবেগটাকে,মনের গভীরে লুকিয়ে রাখা সেই যত্নের ভালোবাসাটাকে খুব সংগোপন’ই শিশির ব্যক্ত করতে মরিয়া হয়ে উঠলো রোদের মাঝে। কিছুমুহুর্তের জন্য ভূলে গেলো ধনী গরিবের সেই চিরায়ত ভেদাভেদ এর প্রথা,ভূলে গেলো তার পরিচয় ভূলে গেলো সে কে আর রোদ কি। ভার্সিটিতে ক্লাসে এসে সেই ফাঁকা ক্লাস রুমের দরজার খিল গুলো যেনো এ-ই কয়েকদিন একটু বেশি করে খোলা হচ্ছিলো,তার সাথে ক্যাম্পাসের বাহিরের টং এর দোকানের সেই গরম চায়ের সাথে ভাজা সিংগাড়া আর হাতে হাত ধরে বসে কিছু গল্পের ঝুড়ি,এ-ই তো ব্যাছ! থাক না পরের টা পরের জন্য। বর্তমান টা থাক না লেখা একান্ত নিজেদের!
!
!
সকাল থেকে কাপড়ের সব দোকান ঘুরে ঘুরে ক্লান্ত শিশির সাহেব। না তার চাচ্চুর কাপড়ের ব্যবসার জন্য না তার রোদ পাগলির দেওয়া একটা ওড়নার সাথে থান কাপড় ম্যাচিং করার জন্য। কিন্তু কপাল ওড়নার রঙ এমনই যে এটা নীল না আকাশি না নেভি ব্লু না পিত রঙ বোঝা মুশকিল। পলাশ কে দিয়ে চাচ্চুর দোকানের সব কাপড় তো নামাইছে নামাইছে সাথে চলছে গোডাউন এ এ-ই রঙের কাপড় আছে কি না তার সন্ধান!
হাতে থাকা কাপড়ের থান টা ছুঁড়ে দিলো পলাশ,রেগে গিয়ে বললো,
– আমি আর পারবো না ভাই,রোদ আপারে কন ঔরকম রঙের কাপড় আমাগো দোকান তো দূর পুরো মার্কেটে নাই।
– ভাই কইছি এ-ই আর একবার শুধু ঔপাশের বস্তা টা দ্যাখ,তোর রোদ আপায় কালকে রাতে সেই পরিমাণ আমার সাথে চিল্লাচিল্লি করছে এখন এটা ম্যাচিং করে না দিতে পারলে খু*ন করে ফেলবে আমাকে,একটু বুঝ ছোট,
নিজের চুল খামচে ধরলো পলাশ,এ-ই যে এতো গুলা কাপড় নামা হইছে এখন এগুলা গুছাবে কে। শিশির হতাশ মুখে দুঃখী দুঃখী ভাবে পলাশের দিকে চেয়ে থাকতেই পলাশ বললো সব কইরা দিমু ভাই কিন্তু একটা শর্ত আছে। শিশির বললো আচ্ছা যা চাবি তাই দেবো বল কি শর্ত। পলাশ ফিঁক করে হেঁসে দিয়ে বললো “তাহলে চাচারে কয়া আমাকে আবার আপনার সাথে কাজে নিবেন কথা দেন” থ বনে গেলো শিশির,তবে রে,শালা পুঁচকো এ-ই ছিলো তোর মনে..শিশির বললো ঠিক আছে নেবো কিন্তু আগে এরকম সেইম টু সেইম কাপড় খুঁজে দিতে হবে তারপর। অনেক কষ্টে পুরো মার্কেট ঘুরে সেই নীল না ছাই কাপড় খুঁজতে সক্ষম হলো শিশির। আহ শান্তি,মনে হচ্ছে আকাশের চাঁদ হাতে নিয়ে ঘুরছে এখন সে এরকম অবস্থা! রোদকে ফোন করবে করবে ভাবছে তখনি ফোন স্ক্রিনে জলজল করে উঠলো রোদেলা নামের তিনটে বর্ণ। হাসি মুখে ফোনটা রিসিভ করেই অপর পাশের ঝাঁঝালো কন্ঠ শুনেই ভয়ে বুকটা আবার শূন্য হয়ে আসলো যেনো বেচারার,
– মানে আমি একটা কাজ দিয়েছি সেটা তো ঠিক সময় হবে না না তোমার,সারাদিন লাগে একটা ম্যাচিং খুঁজতে তোমার,এ-ই নাকি তুমি কাপড়ের ব্যবসা করেছিলে ছোট থেকে। একটা ওড়নার সাথে কাপড় ম্যাচিং করতে এ-ই অবস্থা। হে মাবূদ বিয়ে করে একে নিয়ে যে আমি সংসার করবো কি দিয়ে…এর চেয়ে তাসফি বললো ওর সাথে আজ আসতে। আমি যে কেনো শুনলাম না ভাবলাম বর টা কাপড় ভালো চিনবে কিন্তু একটা কাপড় কিনতে সারাদিন আর তো..
চুপচাপ সব হজম করলেও এবার রেগে উঠলো শিশির,ঝারি দিয়ে বললো,
– একটু থামবা কি তুমি রোদ,ইদানিং একটু বেশি কথা বলো তুমি।
ফোন কাটলো শিশির। ক্ষেপে উঠলো রোদ। পরমুহূর্তে মনে মনে অভিযোগ পুষে নিয়ে বললো আর কখনো কিছু করতে বলবো না তোমাকে,আমার কাজে একটুতে বিরক্ত হও তো তুমি,আর বলবো না শিশির এটা করো,শিশির ওটা করো,মনে থাকবে সব।
আবেগী রোদের চোখ টলটল করছে,আর একটু হলেই হয়তো গড়িয়ে পড়বে কিছু লোনাজলের বিন্দু বিন্দু জল কিন্তু না তার আগেই ফোন আসলো শিশিরের। প্রথমবার না ধরলেও দ্বিতীয়বার ঠিকই মন কে না করতে পারলো না রোদ। অভিমানের সুরে বললো,
– বলো।
শান্ত কন্ঠে শিশির বললো,
– কবে লাগবে?
– কালকে সকালে,
– কতো সকালে?
– ৭টা।
– এতো সকালে দিয়ে কি করবে?
– রিমা আপুর বাস সকালে,আমি আপুকে কাপড় টা দেবো,আপু অনেক সুন্দর পেইন্ট করে কাপড়ে,তোমার একটা পাঞ্জাবির মাপ আর আমার একটা জামার মাপ দিয়ে দুটো জামা বানাবো,আপু বলছে সেইম পেইন্ট করে দিবে। তাই জন্য।
মৃদু শ্বাস ছাড়লো শিশির,ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো রাত সাড়ে দশটা পাড় হচ্ছে,এখন কি করে!
– বের হতে পাড়বা এখন বাড়ি থেকে?
– না,বাবা আছে।
– নিচেও নামতে পারবা না,গেটের কাছে?
– না
– আচ্ছা আমি ফোন দিলে ফ্ল্যাটের দরজা টা তুমি খুলো ঠিক আছে,আসছি আমি,
– আসছি মানে….হ্যালো,হ্যালো,হ্যা..যা কেটে দিলো!
!
!
আধাঘন্টা বাদে ফ্ল্যাটের দরজা খুলতেই থমকে গেলো রোদ। ঘড়িতে তখন এগারোটা দশ। আর শিশির কি না এ-ই এ-তো রাতে তাদের বাড়িতে। হে মাবূদ রক্ষা করো তুমি। কাঁপা কন্ঠে ভর্য়াত সুরে রোদ ফিসফিস করে বললো,
– তুমি এখানে কি করছো,মারবা নাকি আমাকে,আব্বু বাড়িতে আছে..যাও এখন..
দেওয়ালে হাত ঠেকিয়ে রোদের দিকে হালকা ঝুঁকে, মুখে এক ফালি হাসি ঝুলিয়ে শিশির বললো,
– এতো ভয়,ডাকো না শ্বশুর আব্বাকে একটু সালাম দিয়ে দেই।
কপাল কুঁচকে রোদ বললো,
– তুমি মজা করতিছো আমার সাথে,আমার কলিজা কতো কাঁপতিছে তুমি জানো,
শিশির মুখ দিয়ে কিছু বের করবে তার আগে পেছন থেকে উজানের মা ডাইনিং এ এসে জগে পানি ভর্তি করতে করতে বললো “কে আসছে এ-ই রাতে রোদ মা” বড় আম্মুর আওয়াজ পাবার সাথে সাথে কেঁপে উঠলো রোদ,এদিকে শিশির মুখে হাসি চেপে এক হাতে রোদের কোমড় ছুইয়ে আরেক হাতে রোদের কানের পাশের চুল গুঁজে দিয়ে বললো” বলো যে বাড়ির জামাই আসছে”
রোদ রেগে গিয়ে শিশিরের হাতে খামচি দিয়ে মাথা চুলকাতে শুরু করে কি করবে এখন বেচারি। পরে কি একটা মনে করে আমতা আমতা করে বললো ‘ইয়ে বড় আম্মু কেউ কেউ না,ঔ ফুডপান্ডা থেকে ছেলে আসছে,রিমা আপুর খুব আইসক্রিম খেতে ইচ্ছে হচ্ছিলো তো তাই আমি অর্ডার করে” উজানের মা শুধু “আচ্ছা আমি ভাবলাম উজান আসলো,আচ্ছা তা নিয়ে আয়। বলেই ওনার রুমে চলে গেলেন। রোদের যেনো কলিজায় পানি আসলো কিছুটা,শিশিরের দিকে চোখ পাকিয়ে বললো,
– ছাড়বা কি তুমিইইইই…
– হুম,এ-ই যে নেও আর এ-ই চকলেট!
-চকলেট ?…Thank You
-শুধু Thanks
– আর কি!
– কিছু না পাগলি..যা-ও রুমে আসি আমি আজ,
– যাবে!
– হ্যা তা থাকি আর তোমার আব্বু বন্দুক নিয়ে তেড়ে আসুক,সাথে একটা থাকে না বাড়িতে সবসময়।
– যা ফাজিল ওটা তো আব্বুর কাজের জন্য।
– হ্যা একদিন ঔ রাইফেল দিয়ে শ্বশুর আব্বা আমারে মারতে আসবে মিলায় নিও তুমি।
– হে হে,আমি আছি না! কিচ্ছু হতে দেবো নাকি আমি তোমার।
– হুম তুমি আছো দেখেই তো বিপদ!
রোদ চোখ পাকিয়ে বললো কিইইই..শিশির মাথা নাড়িয়ে বললো না কিছু না। রোদ মৃদু হাসলো। শিশির রোদের হাতে ঔ কাপড়ের ব্যাগ আর চকলেট গুলো ধরিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে যাবে ওমনি নিচের ফ্ল্যাটের সিঁড়ি পাড় করতেই রোদ ধরধর করে দৌড়ে এসে গপ করে শিশিরকে জড়িয়ে ধরলো। বিস্ময়ে তাকিয়ে উঠলো শিশির..রোদ আবার! ঘটনার রেশ বুঝে ওঠার আগে রোদ শিশিরের গলা জাপ্টে নিলো,অকপটে শিশিরের গালে বসিয়ে দিলো ইয়া বড় একটা চুমু। অবাকের চাইতে বেশি কিছু থাকলে সেটা হলো শিশির,সাথে তার পাগলির এ-ই কান্ডে হেঁসে ফেললো নিমিষে। আবার এক দৌড়ে উপরে আসতে যাবে ওমনি শিশির রোদকে থামিয়ে দিয়ে সিঁড়ির রেলিং এ চেপে ধরে বললো,
– আমি দেই একটা!
লজ্জায় মাথা নুইয়ে ফেললো রোদ। শিশির রোদের থুতনি ধরে রোদের মুখ টা উপরে তুলে ধরলো,রোদের গোলাপি ঠোঁট যুগলে অকপটে শুধু নিজের ঠোঁট গুলো তিন চার বার উপরে উপরে ছুঁইয়ে দিয়ে বললো” যা পাগলি” লজ্জার শেষ সীমানায় পৌঁছে গেলো রোদ। ইসস এই ছেলে টা এতো বাজে কেনো ধুর। শিশির কে ধাক্কা দিয়ে এক দৌড়ে উপরে চলে আসলো রোদ। এ-তো খুশি হলো যে আজকে সারাদিনের সব রাগ অভিযোগ অভিমান নিমিষে ধুলোয় মিশে গেলো তার…!!
!
!
এদিকে গত এক সপ্তাহ ধরে হিয়াকে এক নজর চোখে দেখার জন্য পাগলপ্রায় উজান এবার সবকিছু ভূলে পাড়ি জমালো হিয়ার নানু বাড়িতে, নাগেশ্বরী,বর্ডার এলাকার কাছাকাছি। পিচ্চি হিয়া তো বিয়ে খাবার কথা বলে দুদিনের জন্য তার মামির সাথে এসেছিলো এখানে কিন্তু মেয়েকে দেখো গোটা এক সপ্তাহ হয়ে যাচ্ছে না তার আছে বাড়ি ফেরার কোনো চিন্তা না ওখানে বসেও উজানের সাথে যোগাযোগ করার কোনো ব্যবস্থা। এদিকে হিয়ার পাগলপ্রেমিক যে কতোটা মরিয়া হয়ে হিয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে আছে তা কি আর হিয়ার বুঝতে!
রাত তখন সাড়ে নয়টার কিছু পর। গ্রামে এই সাড়ে নয়টা মানেই মাঝরাতের সমান৷ সেখানে হিয়াকে নিয়ে এই রাতে বাড়ি ফেরার জেদ টা সত্যি পাগলের বিলাপ ছাড়া অন্য কিছু না। কিন্তু হিয়ার ডেস্পারেট উজান স্যার এ-ই পাগলামি করতেই ছুটে এসেছে শত কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে এ-ই ছোট্ট গ্রামে। হিয়ার নানু বাড়ি খুঁজতেও বিলম্ব পেতে হয় নি তাকে। ঠিক অন্ধকারের সরু রাস্তা বেয়ে বেয়ে চলে এসেছে এতোদূর এতোটা পথ সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে।
এদিকে বিয়ে বাড়ি বোঝাই যাচ্ছে চলছে নানা রকম মানুষের আনাগোনা। কোনোভাবে ধরা পড়লে শেষ। উঠোনে বসে আছে দুজন মধ্য বয়সী নারী। পাখা হাকিয়ে গল্প করছে নিজেদের মধ্যে। যাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে হিয়ার কাছে এ মুহুর্তে যা-ওয়া অসম্ভব। এদিকে বাড়ির পেছনের যেই কলের পাড় যেখানে সচারাচর গোসল করা হয় না৷ শুধু বড় বড় কাজের জন্য যেখানে জমা হয় মামি সহ সবাই,তার পেছন দিক দিয়েই বয়ে গেছে বিস্তৃত ধান ক্ষেএ। যার চারপাশে ধূ ধু অন্ধকার আর অন্ধকার। সেখানের এক কিনারে হেলে যাওয়া সুপারি গাছটার সাথে পিঠ আর এক পা ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে উজান। কি করবে কি উজান এখন। আর এই যে অভাগা তারছেঁড়া নেটওয়ার্ক কোনোভাবেই আর কাজ করতে চাইছে না যেনো। হিয়ার ফোনে অনেক কষ্টে টেক্সট দিতে সক্ষম হলো উজান। কিন্তু লাভ হলো না কিছুই, দশ মিনিট হ’য়ে যাচ্ছে কিন্তু রিপ্লাই তো দূর সীন করার প্রয়োজনটুকু বোধ করছে না এ-ই মেয়ে! মেজাজ টা আরো বিগড়ে আসলো উজানের সাথে তো আছে এই নাছোরবান্দা মশার উৎপাত। অসহ্য। হঠাৎই রান্নাঘর থেকে মামি চেচিয়ে বললো হিয়া যা তো কল থেকে এক জগ পানি নিয়ে আয়,বড় আপা কলের পানি খাবে। শ্বাস টানলো উজান যাগ এদিকেই আসবে তাহলে হিয়া!
মামির হুকুম মানতে জগ হাতে কলের পাড়ে আসতেই ঝড়ের বেগে হিয়াকে নিয়ে এক টানে নিজের বুকের কাছে এনে হিয়াকে নিজের সর্বস্ব দিয়ে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরলো উজান। হাতে থাকা জগ টা মাটিতে পড়ে গেলো নিমিষে,শব্দ হলো কিছুটা বেশি না। এদিকে হিয়া চিৎকার করবার আগেই স্ব জোরে হিয়ার মুখ চিপে ধরে রাগান্বিত সুরে উজান বললো,
– চেঁচাচ্ছ কেনো তুমি? মা’র খাওয়াবে নাকি!
প্রিয় উজান স্যারের সেই পরিচিত কন্ঠের সাথে পরিচিত গায়ের গন্ধ নাকে পৌছাতে থমকে গেলো হিয়া। মানে কি উজান এখানে। ধুর না এটা কোনো স্বপ্ন হয়তো। অন্ধকারে যেটুকু যা বোঝা যায় তারই আলোতে হিয়া চোখ পিটপিট করে দেখতে থাকলো সামনের মানুষ টাকে। আবছা আলোতে উজানের মুখের অবয়ব দেখা মিললো কিছুটা। আবারো চমকে উঠলো হিয়া। সত্যি সত্যি উজান এখানে। ওর নানু বাড়িতে! আশ্চর্য! উমম উমম করে মাথা নাড়িয়ে চোখের ইশারায় মুখ থেকে হাত সরাতে বললো হিয়া। উজান হাত সরালো ঠিকই কিন্তু হিয়াকে আরো ভালো করে জড়িয়ে নিলো তার প্রশ্বস্থ বুকের খাঁজে।
– আপনি এখানে!
– তুমি কি হ্যা,দুদিনের কথা বলে গোটা এক সপ্তাহ ধরে এখানে পড়ে আছো,না কোনো টেক্সট না ফোন কলস। কি চাইছো কি তুমি আমাকে পাগল বানাতে চাইছো,
উজানের পিঠে দু হাত রেখে আরো শক্ত করে উজানের বুকে মুখ লুকিয়ে নিলো হিয়া। শার্টের ফাঁকে মুখ টা আলতো করে ঘষে নিয়ে বললো,
– সরি তো,কি করবো এখানে একদম টেলিটকের নেট পাওয়া যায় না,বর্ডার এলাকা না,এখানে এ্যায়ারটেলের ভালো সার্ভিস তাই তো সকালে মামার সাথে গিয়েছিলাম শহরের দিকে যদি একটু কথা বলা যায়। কিন্তু আপনি ফোন ধরলেন আর কোথায়।
– তা অন্য কারো ফোন থেকে একটা কথা বলা যেতো না,
উজানকে আরো আরাম করে ধরে নিয়ে হিয়া বললো,
– কি বলে ফোনটা চাইতাম বলুন দেখি,আচ্ছা ওসব বাদ দিন,আপনি এখানে কি করে আর কেউ দেখে ফেললে কি হবে বুঝতে পারছেন কিছু,
– আই ডোন্ট কেয়ার
– কেয়ার না করলে কেয়ার করতে শিখুন,ভাইয়া জানলে না ধরে ফাটাবে দু’জনকে।
– তোমার ভাইরে আমি ফাটাবো,দেখি চলো এখন আমার সাথে,
বিষ্ময়ে উজানের বুক থেকে টুক করে মুখ তুলে হিয়া বললো,
– যাবো মানে কোথায় যাবো!
– বাড়ি যাবো চলো,তোমাকে ছাড়া ভালোলাগছে না আমার আর।
-পাগল আপনি উজান স্যার,এ-ই রাতে আমি কি করে আপনার সাথে,
– জানি না,বাইক আছে আমার সাথে,চলো,
– বাইক থাক আর উড়োজাহাজ আমি কি বলে এখন বাড়ি ফিরবো বলুন দেখি,তাও আবার আপনার সাথে।
– তাহলে এখানে সারারাত দাঁড়িয়ে থাকো আমার সাথে।
– হে মাবূদ রক্ষা করো,আপনি সত্যি পাগল হয়ে গেছেন উজান স্যার..প্লিজ আপনি বাড়ি ফিরে যান আমি আমি কাল বিয়ে শেষ হলেই মামাকে বলবো বাসে উঠে দিতে কেমন।
– না আমি আর একটা মুহুর্ত তোমাকে ছাড়া থাকতে পারবো না। একটুতো তুমি বুঝো হিয়া,
– আপনি একটু বুঝুন না স্যার,এরকম অন্যায় আবদার করবেন না,
এদিকে আবার মামির ডাক কানে পৌঁছাতে হিয়া কেঁপে উঠলো,উজানের বুকের ঠিক মাঝে পাঁচ ছয়টা চুমু এঁকে দিয়ে ভয়ার্ত সুরে বললো,
-উমমমমমম….এখন দেখুন ওদিকে মামি আমাকে খুঁজছে,আমাকে যেতে হবে প্লিজ আপনি ফিরে যান,
– না,
-কেনো বায়না করছেন বাচ্চা দের মতো,
– করলে করছি! তুমি এখন আমার সাথে ফিরবে ব্যাছ(কাঠ কাঠ কন্ঠে)
কথাটা কঠোর ভাবেই আদেশের হুমকিতে বললো উজান। একদিন দুদিন করে গোটা একটা সপ্তাহ মগেরমুলুক নাকি। নিরুপায় হিয়া কি করবে এখন। কতো কি প্লানিং করলো কাল বউয়ের সাথে নিজেও একটু লাল টুকটুক বউ সাজবে,কতো মজা করে পোলাও রোস্ট খাবে,আর এই খাটাশ টাকে দেখো কি হুকুম করে বসলো। আর একটা দিন না দেখে থাকলে যেনো জাত চলে যেতো হু। আহ কি মোর প্রেম এর চাইতে একা ছিলাম স্বাধীন ছিলাম ধুর..এতো পাগলামি করলে চলে। কি বলে বাড়ি ফিরবে এখন হিয়া!
উজানের থেকে এক ঘন্টা সময় চেয়ে নিয়ে উঠোন পেরিয়ে রুমে আসতে চেপে ধরলো মামি। পানি আনতে এতোক্ষণ লাগে হিয়ার, যদিও বিয়ে উপলক্ষে বাড়িতে লোকজনের আসা যা-ওয়া লেগেই আছে। আবারো কথা বানিয়ে বলতে হলো হিয়াকে৷ সাথে কান্নারত কন্ঠে বললো তার নাকি শিশির ভাইকে দেখতে খুব ইচ্ছে হচ্ছে বাড়ি ফিরতে চায় এখন। মামি ব্যাপারটা প্রথমে পাওা না দিলেও কিছুসময় বাদে সত্যি সত্যি হিয়াকে নাকের পানি চোখের পানি এক করে কাঁদতে দেখে মামা থেকে শুরু করে বাড়ির সবাই অস্থির হ’য়ে উঠলো। সকাল থেকে বিয়ে খাবো বিয়ে খাবো বলে যেই মেয়ে সবার মাথা খাচ্ছিলো সে কি না এ-ই রাতেই বাড়ি ফিরতে চায়,আশ্চর্য!
– দেখ হিয়া মা,এখন তো অনেক রাত বাস টাস কিচ্ছু পাবি না,আমি না হয় কাল সকালে উঠেই তোকে,
– না মামা আমার আজকেই বাড়ি যা-ওয়া লাগবে কালকে কালকে কলেজে ফর্ম জমা দেওয়ার শেষ ডেইট আমি এখনি জানলাম সেটা,সকালে বাসে উঠলে তো আমি আর পৌঁছাতে পারবো না না,
– একটু আগে বললি শিশিরকে দেখতে ইচ্ছে করছে এখন আবার বলছিস ফর্মের শেষ তারিখ কি সত্যি আসলে..
– কোথায় কি সত্যি,যা সত্যি তাই তো বললাম,দুটোই ঠিক
– তোকে তো এ-ই রাতে আমি একা ছাড়বো না মা,আর আমিও এ-ই অনুষ্ঠান ছেড়ে একা কি করে তোর সাথে,কালকে সকাল ছাড়া,আর যদি তোকে আজকেই যেতে হয় তুই না হয় বরং শিশির কে ডেকে…
– না না তার কোনো দরকার নেই,বাহিরে বাহিরে ভাইয়ার বন্ধু উজান উজান স্যার দাঁড়িয়ে আছে। ওনাকে বললেই আমাকে বাড়ি দিয়ে আসবে…
হিয়ার কথায় বিষ্ময়ে তাকিয়ে উঠলো মামা থেকে বাড়ির প্রত্যেকটা মুরব্বি। শিশিরের বন্ধু দাঁড়িয়ে আছে মানে। তাও আবার তাদের বাড়ির বাহিরে। কেনো? হিয়া বানিয়ে বললো উজান নাকি বর্ডার এলাকায় এখানে কোন এক ফ্রেন্ডের সাথে মিট করতে আসছে। উজানকে দেখতে পেয়ে হিয়া থামিয়ে দিয়ে বাহিরে দাঁড় করিয়ে রাখছে। উনি শহরেই ফিরছে, বললে হিয়াকেও সাথে নিয়ে যাবে। মামার আদেশে উজানকে ভেতরে নিয়ে আসা হলো। বাড়ির সবার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি উজানের উপর। উজানের ঔ লম্বাচওড়া দুধে আলতা গায়ের বরন সাথে সাদা শার্টের সাথে নীল জিংকসের একটা পার্সোনালিটি বেশ মনে ধরলো সবার। মামা শিশিরকে এ বিষয়ে কথা বলতে ফোন দিতেই কেঁপে উঠলো হিয়া। ভাইয়াকে কি বলবে এখন সে। উজান চেখের ভাষায় আস্বস্ত করলো আমি আছি। মামা শিশিরকে ফোন করে জানাতেই থমকে গেলো শিশির। উজান ওর গ্রামের বাড়িতে হঠাৎ কি করতে। মামার থেকে ফোন নিয়ে উজান বললো সে নাকি এখানে ওর কোন ফুফুর বাড়িতে একটা কাজে এসেছে পথে হিয়াকে দেখে থেমে গিয়ে কিছু বলতে যাবে ওমনি হিয়া বায়না ধরে সে বাড়ি ফিরবে তার নাকি কলেজে কি একটা কাজ আছে। শ্বাস টানলো শিশির। হিয়ার উপর বিরক্ত হলো কিছুটা৷ হিয়ার মনের এ-ই দোটানার জন্য মামাকেও সাফার করতে হচ্ছে আরেকদিকে উজানকেও। মামারা সংকোচ বোধ করলেও শিশির তো জানে এ-ই পৃথিবীতে তার পর আর যদি কেউ থাকে হিয়াকে নিরাপত্তা দেবার সে আর কেউ না তার এ-ই বন্ধু উজান। তাই শেষমেষ শিশিরের অনুমতিতে মামা রাজি হলো উজানের হাতে হিয়াকে ছাড়তে।
বাইকের পিঠে চেপে সরু গলি বেয়ে বাইক চলতে চলতে এসে থামলো একটা সরু পথে। যার এক পাশ দিয়ে বয়ে গেছে আবারো সেই ধূ ধূ অন্ধকার বিস্তৃত ধানক্ষেত। আর এক পাশে ছোট খাটো দুটো টিনের দোকান৷ একটা যদিও বন্ধ আরেকটায় দেখা যাচ্ছে মৃদু আলোর চিহ্ন। কারেন্ট নেই হাড়িকেনের খুপরি তে মিটেমিটে জ্বলছে সেই আগুন। বাইক টা সেই দোকানের অপজিটে একটু সাইডে দাড় করিয়ে রাখলো উজান৷ নেমে গিয়ে দোকানে এসে দাঁড়িয়ে একটা সিগারেট কিনলো,সাথে কিনলো হিয়ার জন্য একটা চিপস। লাইটারে সিগারেট ধরিয়ে হিয়ার কাছে এসে চিপস টা দিয়ে বাইকের নিচে আলতো হেলে বসলো সেই পিচঢালা পথে। গত এক সপ্তাহ ধরে না ছিলো খাওয়া না ঘুম এখন এই সিগারেটটাই পারে পেটের ক্ষুধার সাথে শরীরের শান্তি মিটিয়ে মাথা ব্যাথা টা কমাতে। রাগে ফুঁসতে থাকা হিয়াও গটগট করতে করতে উজানের পাশে গিয়ে বসলো। সামনে তাকিয়ে ঔ বহুদূর আকাশের পানে তাকিয়ে রইলো দুজন। মিটমিট তারা জ্বলছে। মেঘের চাদরে চাঁদের সরু চিকন ফালি দেখা যাচ্ছে সাথে বইছে আগমনরত শীতের হিমেল বাতাস! ধানফুলের গন্ধ সাথে সিগারেটের ধোঁয়া মিলিয়ে যেতে থাকলো হিমেল প্রকৃতির কোল জুড়ে! হিয়া চিপসের প্যাকেট টা কোলে রেখেই মাথা রাখলো উজানের বুকে। সাথে সাথে ওড়না দিয়ে চিপে ধরলো নিজের মুখ,ইসস কি বিশ্রী এই সিগারেটের স্মেল!
চলবে….