চোখের_তারায়_তুই?#পর্ব_২৬

0
662

?#চোখের_তারায়_তুই?
#পর্ব_২৬
#ইভা_রহমান

ভোর না হতেই হিয়াকে নিয়ে কক্সবাজারের উদ্দেশ্য রওনা দিলো উজান। আপাতত কিছুদিন হিয়াকে নিয়ে দূরে থাকারই সিদ্ধান্ত নিলো সে। বাকিটা না-হয় পরিস্থিতি টা স্বাভাবিক হয়ে আসলেই ভাবা যাবে। এখন তো তার চাই শুধু হিয়াকে নিয়ে থাকার একটা নিরাপদ আশ্রয়….বেলা গড়িয়ে বিকেল তখন সন্ধ্যা ছুঁইছুঁই। আকাশে বাতাসে শীতের আগমনি বার্তা। সাথে উওাল সাগরের গর্জন,আর ঢেউের মনমাতানো ধ্বনি। কক্সবাজারের একটা সুন্দর মোটেলে রুম ভাড়া করে হিয়াকে নিয়ে উঠলো উজান। রুমটা ছোট খাটো কিন্তু ডেকোরেশন অতি চমৎকার। আর বেশি চমৎকার রুমের সাথে লাগানো ব্যালকুনিটা।

গায়ের শার্ট টা খুলে নিয়েই একটা বিরাট গা চাড়া দিয়ে উঠলো উজান। এতোদূরের জার্নি করতে হবে জানলে তো ফ্লাইটেই আসতে পারতো সে। এ-ই এতো ধকল নেওয়া যায়। বিছানায় বসে মাথার চুল গুলো খামচে ধরতেই হিয়া এসে বসলো উজানের পাশে। কেবলই হাত আর মুখ টা ভালো করে ক্লিন করে বের হয়ে আসলো সে। কিন্তু একটা গোসল দিয়ে যে জামা পড়বে সেই জামা কাপড় কিছুই তো সাথে করে নিয়ে আসেনি সে। অস্ফুটে উজানকে ডেকে হিয়া বললো,

– উজান!

– বলো?

– আপনার কি খুব মাথা ব্যাথা করছে?

– হ্যা এমনি চোখের দিকে ব্যাথা হচ্ছে হালকা।

– টিপে দেবো আমি। দেই?

-দিবে। দেও।

উজান আলতো করে হিয়ার কোলে মাথা রেখে হিয়ার পেটে মুখ গুঁজে নিলো। হিয়াও নিজের নরম হাত দুটো দিয়ে উজানের মাথার চুল গুলো মুঠো করে করে টিপে দিতে থাকলো উজানের মাথা। তার সাথে কখনো টিপলো উজানের চোখের পাতা তো কখনো ভুরুর চারপাশ। তো কখনো পেছন ঘাড়।

– তুমি একবারে গোসল টা করে নিয়ে বের হতে পারতে হিয়া। পরে রাত হলে ঠান্ডা লাগে যদি।

– সেটা তো বুঝলাম। কিন্তু গোসল করে এসে পড়বো টা কি। আমি তো এক কাপড়ে বেড়িয়ে আসলাম বাড়ি থেকে আপনার সাথে। এখন!

উজান উঠে হিয়ার মুখে হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো,

– সরি,খেয়াল ছিলো না। আচ্ছা তুমি গোসল টা করে আমার জামাকাপড় থেকে কিছু একটা পড়ে নেও। তারপর রাতের দিকে আমরা এখন নিচে যাবো। এখানে অনেক দোকান আছে। সেখান থেকে তোমার জন্য কয়েকটা জামা কিনে নেবো,কেমন?

– ঠিক আছে। আপনি তাহলে একটু রেস্ট করুন আমি গোসল টা করে আসছি।

হিয়া গোসল করে নিতে এক বেলা ঘুম হ’য়ে যায় উজানের। এদিকে গোসল করে উজানের জামাকাপড় থেকে জামাকাপড় খুঁজে পড়তেই বোকা বোনে যায় হিয়া। এগুলো তো একটাও তার সাইজের না তারউপর এরকম মলিন মলিন কালার। তার জামাকাপড় তো হওয়া চাই বাটারফ্লাই আর রঙবেরঙের ফুলের সমাহারে ভরপুর। তবেই না শরীরের সাথে সাথে মনটা উড়তে থাকে। কিন্তু এই খাটাস টাকে দেখো ম্যাক্সিমাম জিনিসই সাদা। আর জিংকস সেটার কথা তো বাদই দেই। বেল্ট পড়লেও আঁটকে থাকবে কিনা হুউস নো। হু।

সেখান থেকে বেছে কুচে একটা হালকা রঙের নেভিব্লু শার্ট পড়ে বেড়িয়ে আসলো হিয়া। সাথে পড়লো একটা হাফ কোয়াটার প্যান্ট। যদিও অনেক লুস। ধরে না রাখলে যখনতখন খুলে যাবার সম্ভবনাই বেশি। এদিকে এই ঢিলে শার্ট তারউপর প্যান্টের খুলে যা-ওয়ার ভয় সব মিলিয়ে হিয়াকে এ-ই মুহুর্তে একটা ছোট্ট বাচ্চার চাইতেও বেশি কিউট লাগছে যেনো! যেনো একটা তুলতুলে পুতুল।

ঘুমন্ত চোখ জোড়া খুলে হিয়ার দিকে চোখ মেলতেই উঠে বসলো উজান। আরে কে এটা! তার হিয়া পিচ্চি নাকি। মুচকি হেঁসে দিয়ে হিয়াকে দুচোখের সব দিয়ে দেখতে থাকলো উজান। এক্ষুনি সংযম টাকে হারিয়ে দিবে না-কি এ-ই পাগলি টা। আদুরে সুর টেনে হিয়া উজানের দিকে এগিয়ে এসে গদগদ কন্ঠে বললো,

– ওহ উজান,দেখুন না শার্ট টা কিরকম ঢিলে হয়ে আছে। মনে হচ্ছে এতে আরো দুটো হিয়া ঢুকে যাবে। আচ্ছা আপনি কি এতো মোটা আমার চাইতে। দেখি উঠুন তো। মেপে দেখি একটু।

হিয়ার কথায় হেঁসে দিলো উজান। হাসি টেনে বললো,

– হুম অনেক মোটা আমি। তোমার চাইতেও দশ ডবল।

– যাহ ফাজলামো করবেন না। হয়েছে না রেস্ট নেওয়া আপনার,এবার আপনি গিয়ে গোসলটা করে আসুন তো। আমি নিচে যাবো। এ-ইসব পড়ে থাকা অসম্ভব। আমি বরং ধুইয়ে দেওয়া জামা গুলো মেলে দেই। কি পড়ে যাবো আবার নিচে। বলুন দেখি।

একনাগাড়ে কথা গুলো বলতে গিয়ে যে-ই পেছনে পা বাড়াতে যাবে হিয়া ওমনি বেঁধে রাখা প্যান্ট টা সপাটে খুলে পড়ে গেলো নিচে। চোখ বড় করে তাকিয়ে উঠলো হিয়া। কি হলো কেস টা..!!

ইশশ লজ্জায় বোধহয় এ-ই মুহুর্তে লুটিয়ে পড়ে হিয়া। ইশ ইশ ইশ এটা কোনো একটা কথা হলো। ধ্যাত।

কপালে চার পাঁচ টা থাপ্পড় দিতে দিতে প্যান্টটা টুক করে উপরে তুলে মুঠো করে ধরলো হিয়া। এদিকে হিয়ার এই নাস্তানাবুদ অবস্থা দেখে মনেমনে হেঁসে লুটোপুটি খাচ্ছে যেনো উজান। এদিকে উজানকে উঠে দাঁড়াতে দেখে পিছিয়ে গিয়ে দেওয়ালের সাথে মিশে গিয়ে তপ্ত শ্বাস ছুঁড়তে থাকলো হিয়া। মুখে ডেভিল সূচক হাসি টানতে টানতে নিজের প্যান্ট থেকে বেল্টটা খুলে হিয়ার দিকে এগিয়ে আসলো উজান। ভয়ে প্যান্ট আর শার্ট দুটোই খিঁচে ধরলো মেয়েটা। কি করতে কি চাইছে এই লোকটা। এক্ষুনি খেয়ে ফেলার মতলব আঁটছে নাকি!

ভয়ে চোখ বন্ধ করে নিলো হিয়া। উজান নিজের বেল্ট টা হাতে নিয়ে হিয়ার একদম গা ঘেঁসে দাঁড়িয়ে হিয়ার মাথার সাথে মাথা ঠুকে দিতেই লজ্জায় পুরো রক্তিমবর্ণতে নিজেকে রাঙিয়ে নিলো হিয়া। দু’জনের নিশ্বাসের তপ্ত শ্বাস এক হয়ে মিশতে শুরু করলো। এতে আরো কেঁপে উঠলো হিয়া। মুচকি হাসলো উজান। হিয়ার কোমড়ের দিকে হাত রাখতেই নিজের হাতের বাঁধন আলগা করলো হিয়া। হিয়ার প্যান্টের ভাঁজে ভাঁজে বেল্টটা গুঁজে দিয়ে সেটাকে শক্ত করে বেঁধে দিলো উজান। এদিকে উজানের আঙ্গুলের ছোঁয়া,আধো ছোঁয়া স্পর্শ কোমড়ে এসে লাগতেই চুপসে গিয়ে উজানের বাহু খিঁচে ধরে আছে হিয়া। কি করছে কি এ-ই লোকটা। ইশশ হার্টঅ্যাটাক করিয়েই ছাড়বে বোধহয় মানুষটা।

– কি করছে এই মানুষটা। পুরো শরীরের লোমকূপ দাঁড়িয়ে যাচ্ছে তো আমার। আজ এনার জন্য সত্যি বুঝি এই হিয়ার থেকে হিয়া টা বেড়িয়ে ফুস হ’য়ে যায়। এবার তো থামুন। ইশশ এরকম কেউ করে।

উজান হিয়ার কোমড়ে বেল্টটা লাগিয়ে দিয়ে একটানে হিয়ার দু কোমড় খিঁচে হিয়াকে নিজের কাছে এনে ফেললো। চোখ মেলে উজানের দিকে তাকালো হিয়া। উজান কোমড়ের বাঁধন টা আরো শক্ত করে পেঁচিয়ে ধরে বললো” এখন লাগিয়ে দিলাম,সময় আসলে সবটাই খুলে নেবো হিয়া পিচ্চি”

উজানের বুকে একটা কিল বসিয়ে দৌড়ে লজ্জাতে ব্যালকুনিতে পালালো হিয়া। দু’হাতে মুখ ঢেকে মাথা নাড়াতে নাড়াতে বললো” এ-ই স্যারটা এতো অসভ্য আর অশ্লীল কেনো ধ্যাত”

!
!

হিয়ার জন্য কেনাকাটা করে রাতের ডিনারটুকু শেষ করে নিলো দু’জন। মন তো চাইছিলো একটু সমুদ্রের এই উওাল ঢেউয়ের ভাঁজে ভাঁজে নিজেদের একটু ভাসিয়ে দিক তারা কিন্তু শরীর সায় দিলো না। উজান তো যা-ও একটু বিশ্রাম করেছিলো কিন্তু বেল্ট লাগানোর কাহিনীর পর থেকে তো হিয়া পিচ্চি ভয়ে একটা জায়গায় স্থির থাকতে পারলো আর কোথায়।

সেদিনটা উজানের বুকে ঘুমে নিয়ে পাড় করলো হিয়া। তবে এতোকিছুর মাঝে অস্থিরতার কমতি হলো না শিশিরের জন্য। কি করে সামাল দিচ্ছে শিশির ওদিকে সব। হিয়াকে বুকে আগলে যতোটা অভয় দেওয়া যায় তার সবটুকু দিয়ে অশান্ত হিয়াকে শান্ত করে সেই রাতে ঘুম পাড়িয়ে দিলো উজান। কিন্তু নিজে ঘুমালো না। শিশিরের সাথে এ-ই মুহুর্তে যোগাযোগ করা খুবই জরুরি তার। রোদো তো ফোন তুলছে না। ঠিক আছে তো ওদিকে সব। চিন্তায় মধ্যরাত অবধি ছটফট করলো উজান। কিন্তু হিয়াকে রেখে আর উঠলো না। একটা পর্যায় ঘুমটা চোখে আসলো তার। পিচ্চিটাকে আগলে কখন যে ঘুমের রাজ্যে হারিয়ে গেলো তার জানা নেই।

সকাল তখন আটটার কিছু আগে। রাতের দিকে খুলে রাখা জানালা টা বন্ধ করা হয়ে ওঠেনি আর। সেই জানালার পর্দাভেদ করেই আলো এসে ঢুকছে রুমে। শীতের আগমনী গান বাজলেও সূর্যের তেজো কিন্তু কম নয়। চারিদিকে কর্মব্যস্ত মানুষের আওয়াজ কানে পৌঁছালো। সাথে সমুদ্রের পানির টুপটাপ শব্দ কানে বাজলো। ঘুম ভাঙ্গলো হিয়ার। গা টা আড়মোড়া দিয়ে চোখ খুলতেই নিজেকে আবিষ্কার করলো উজানের বাহুবন্ধনে। কতো যত্নের সাথে উজান তাকে আগলে ধরে আছে দেখো। চোখ গুলো পিটপিট করে কচলে নিলো হিয়া। একটু উপরে উঠে উজানের মুখের দিকে তাকিয়ে এক হাতে হাত বুলাতে শুরু করলো উজানের সারা মুখ।

– আচ্ছা আমি কি দেখে লোকটাকে এ-তো ভালোবাসলাম! সবাই যে এনাকে এ-তো সুন্দর সুন্দর বলে,বলে খুব নাকি হ্যান্ডসাম। এএএএ। কচু হ্যান্ডসাম। আমার শিশির ভাইয়া কত্তো ভালো এনার চাইতে। এনার নাক টা দেখো এতো টিকালো কেনো হু৷ ঠোঁট গুলোও তো পিংক পিংক। লিপিস্টিক দেয় বুঝি। দেখি তো একটু…

হিয়া উজানের ঠোঁট গুলো ঘষতে ঘষতে বললো,

– কোথায় ন্যাচারাল’ই তো লাগছে। কিন্তু এ-তো যে সিগারেট খায় তাহলে কালো কেনো হয় না। আশ্চর্য তো। কপাল টাও তো এতো চওড়া। চুলো আগের মতো নেই। আগে কতো ঘন আর মজবুত ছিলো এখন তো মনে হচ্ছে দুদিন পর টাক বেড়িয়ে যাবে। আর দেখেও তো ছি যে ডক্টরদের মাথার চুল থাকতে নেই সব না-কি পড়াশোনা করতে গিয়ে। ইশশ টাক হয়ে গেলে কিরকম দেখতে লাগবে ব্যাপারটা। লতা তো আমাকে ক্ষ্যাপাতে ক্ষ্যাপাতে শেষ করে দিবে।ধুর। আর এই এই চোখ গুলো। একদম চিকার মতো। এএএ এর চাইতে আমার ভাইয়ের চোখ গুলো কি সুন্দর। টানা টানা। হুঁশ। মেয়েগুলো এমনি এমনি এনার প্রেমে হাবুডুবু খায় দেখতে একটুও ভালো না। হু।

হঠাৎই উজানকে পরক্ষ করতে গিয়ে হিয়ার নজরে যায় উজানের বাম কানের দিকে। যেখানে কানের লতিতে ছোট্ট একটা তিলের দেখা মিলে স্পষ্ট। চোখ বড়সড় করে উজানের বাম দিকে ঝুঁকে এসে ঔ তিলটায় হাত বুলাতে শিউরে উঠে হিয়া। মুখটা রঙীন করে বলে উঠে”” এ যা কি সুন্দর একটা তিললল। ইসস কি কিউট! আগে কেনো দেখিনি এটা আমি। আজ তো এটাকে গিলেই ফেলবো পুরো। হুঁশ।

বলেই উজানের কানের লতিতে একটা বাইট বসিয়ে দিলো হিয়া। ব্যাথায় ঘুম ভেঙে আসলো উজানের। হিয়াকে নিজের কানের সাথে গোল্লাছুট নামক কামড়াকামড়ি খেলতে দেখেই মুচকি হেঁসে হিয়াকে বালিশে শুইয়ে দিয়ে হিয়ার উপর শুইয়ে পড়লো উজান। কপালে স্নেহের এক পরশ বুলে দিয়ে বললো,

– সব থাকতে এ-ই কান টাকেই মনে ধরলো ম্যাডামের!

হেঁসে দিলো হিয়া। সেই হাসির ঝঙ্কার গিয়ে কানে বাজলো উজানের। হিয়ার মুখের হাসিতে আরো একবার মুগ্ধ হয়ে গেলো যেনো সে। নিজের হাসিটাকে দমিয়ে হিয়া বললো,

– কান না মাস্টারমশাই আপনার এ-ই তিল টা মনে ধরেছে খুব। একদম একটা কাপ কেকের মতো। কি সুন্দর!

– তাই…মনে তো আমারো একটা তিল ধরেছে। আমি যদি সেটাতে বাইট বসিয়ে দেই। চলবে!

চোখ বড় করে তাকালো হিয়া। তিল মনে ধরেছে মানে৷ কোন তিল। হিয়ার তো পুরো শরীর জুড়ে মোটে তিনটে তিল। একটা পায়ের গোড়ালির কাছে লাল তিল,একটা কোমড় বরাবর ছোট্ট তিল,আর একটা তো বুকের উপরে গলা বরাবর। দমটা ছোট হ’য়ে আসলো হিয়ার। কোথায় বাইট বসাবে এখন এই অসভ্য লোকটা। ধুর। নেশাক্ত চোখে হিয়ার বুকের উপরের তিলে নিজের ঠোঁট ছোঁয়ালো উজান। লজ্জায় উজানের মাথার চুল খামচে ধরলো হিয়া। এই তিল টার কথা স্যার কি করে জানলো আমি তো সবসময় ওড়না দিয়ে ওনার সামনে আসি৷ তাহলে! উজানকে ধাক্কা দিয়ে উঠে আসতে যাবে ওমনি হিয়াকে পেছন থেকে জড়িয়ে আঁটকে দিয়ে হিয়াকে নিজের সর্বস্ব এক করে জড়িয়ে ধরলো উজান। নিজের চওড়া চওড়া লম্বা পা জোড়ার বাম পা টা তুলে দিলো হিয়ার শরীরের উপর। পেছন থেকে শক্তপোক্ত ভাবে হিয়াকে আগলে মুখ ডুবালো হিয়ার ঘাড়ের ভাঁজে পিঠের উপর।

– চুপচাপ শুইয়ে থাকো এখন। কালকে সারারাত ঘুমোতে দেওনি কিন্তু।

মাথা নাড়ালো হিয়া। হিয়াকে আগলে রাখা উজানের হাত দুটো শক্ত করে ধরে সে নিজেও চোখ বন্ধ করে নিলো তবে ঘুমের জন্য না উজানের দেওয়া লজ্জা থেকে বাঁচার জন্য!!

!
!

দুদিন কক্সবাজারে স্ট্রে করে তিনদিনের মাথায় ঢাকাতে এসে পৌঁছালো উজান আর হিয়া৷ কথা অনুযায়ী উজানের বন্ধু রাহাতের ফ্ল্যাটে থাকবে তারা এখন। সেই অনুযায়ী সব গুছিয়ে নিয়ে হিয়াকে নিয়ে নতুন ফ্ল্যাটে এসে পাড়ি জমালো উজান। রাহাত হচ্ছে রিমা ম্যাডামের হাসবেন্ড। ঘরোয়া ভাবে বিয়ে টা হলেও পারিবারিক কিছু কারণে এখনো সবার মাঝে জানাজানি হয়নি বিষয়টা। আর বন্ধুর ওয়াইফ হিসাবে রিমার সাথে একটা আলাদা আত্মীয়তার সম্পর্ক উজানের যেটাকে অন্য কিছু ভেবে গুলিয়ে ফেলেছিলো হিয়া এতোদিন। এই ফ্ল্যাটটা রাহাতের অফিস থেকে পাওয়া। এখনো তারা এসে থাকা শুরু করেনি। এসে থাকতে সময় লাগবে আরো। তাই পড়ে আছে অনেকদিন যাবৎ। রাহাতদের টাকার কমতি নেই তাই ফ্ল্যাটটা রেন্টে দিতেও তাদের তেমন কোনো আগ্রহ ছিলো না। এদিকে হিয়াকে নিয়ে আসবে বিধায় একটা ছোট্ট খাট,আর একটা ছোট্ট আরএফএলের র্যাক সহ একটা ছোট্ট সংসার সাজাতে প্রয়োজনীয় যা দরকার সব এনে সাজিয়ে দিয়েছে উজান। এ-ই তো ব্যাছ এখন শুধু একটা শুভমুহুর্ত দেখে হিয়াকে বাড়িতে পরিচয় করিয়ে দেওয়াটাই বাকি। এ-ই তো যা।

!
!

গোসল সেরে রুমে আসতেই পা আঁটকে গেলো হিয়ার। এসব কি উজানের হাতে৷ সাথে পুরো বিছানা জুড়ে। ভালো করে তাকিয়ে দেখতেই হিয়া বুঝলো এগুলো তো বইপএ। কিন্তু কিসের? আরেকটু এগিয়ে এসে বই গুলো মনোযোগ সহকারে দেখতে গিয়ে হিয়া আবিষ্কার করলো এগুলো তো উচ্চমাধ্যমিকের যাবতীয় টেস্টপেপার থেকে শুরু করে এটুজেড সব বই। কিন্তু এগুলো দিয়ে এ-ই নতুন ফ্ল্যাটে কি করবে হিয়া। রাগে পুরো শরীর রি রি করে উঠলো হিয়ার। মানে কি এ-ই নতুন সংসার করতে এসে এখন এ-ই বইপত্র নিয়ে বসতে হবে তাকে। আশ্চর্য।

– এ এ এই এসব কি হ্যা। এগুলো এগুলো বই,টেস্টপেপার,এগুলো দিয়ে কি হবে এখন। আপ আপ আপনি এক্ষুনি এগুলো বাহিরে বের করুন। বের করুন বলছি।

– এক্সকিউজ মি মিসেস শাহরিয়ার এগুলো বাহিরে বের করে ফেলে দেওয়ার জন্য আমি নিয়ে আসিনি। অনেক পড়া মিস গিয়েছে এ কয়েকদিনে আপনার। এখন দিনরাত পড়ে সেগুলো পুষিয়ে নিতে হবে কুইক।

রাগের উপর আরো পাহাড় সমান রাগ এসে জড়ো হলো হিয়ার সারা অঙ্গ জুড়ে। এ কেমন লোক। একদম বেরসিক।

– দেখুন উজান স্যার। আমি এখানে আপনার সাথে সংসার করতে এসেছি। আমি তো বলছি না যে আমি পড়াশোনা করবো না। করবো সব। কিন্তু তাই বলে আসতে না আসতে আপনি আমাকে বই নিয়ে বসিয়ে দিবেন। এটা কি ঠিক?

– লিসেন হিয়া। এমনিতে শিশিরের জন্য এ-ই অসময় তোমাকে আমি বিয়েটা করেছি। তারমানে এ-ই নয় যে তুমি তার সুযোগ নিয়ে পড়াশোনাতে ফাঁকিবাজি করবে। সো যা বলছি সেগুলো মন দিয়ে শোনো।

হিয়া শুনবে কি। এমনিতে বিয়ে করে আসছি থেকে একটু ঠিকঠাক মতো আদর করছে না তারউপর এ-ই পড়াশোনা। আজকে তো এ-ই লোককে আমি। মাথার তোয়ালে টা একটানে মাথা থেকে খুলে বিছানার উপর চটকে দিয়ে রাগে গজগজ করতে করতে হিয়া বললো,

– আপনি জানেন আপনার ডাক্তারি নলেজ টা ঠিক যতোটা ভালো ততোটাই খারাপ এই সাংসারিক নলেজ।

হিয়াকে রাগতে দেখে উজানো রেগে গর্জে উঠে বললো,

– তোয়ালে টা বিছানায় কেনো ফেললে হিয়া। লিসেন হিয়া আমি কিন্তু এসব ব্যাপারে খুব পার্টিকুলার হ্যা। যেখানকার জিনিস সেখানে না রাখলে আমি কিন্তু।

– হ্যা সে তো আমি দেখতেই পাচ্ছি আপনি কতো পার্টিকুলার। কতোওও দায়িত্ব আপনার।

– ইউ নো হোয়াট। শিশির তোমাকে একটু বেশি আদর দিয়ে,পেম্পার করে করে মানুষ করেছে। যার জন্য তোমার মাঝে কোনো।

– হুম। এখন তো আপনি আছেন শিখিয়ে দেওয়ার জন্য তাই না। আমাকে কথা না শুনিয়ে নিজে গিয়ে তো তোয়ালে টা বারান্দায় মেলে দিয়ে আসলেই পারতেন।

– আমি আমি মেলবো!

– কেনো আপনি তো আমার টিচার আমার হাসবেন্ড। আপনি আমার কথা ভেবে এতোকিছু বইপত্র নিয়ে এলেন আর এটুকু করতে পারবেন না।

– ডিজগাস্টিং হিয়া। ইউ আর টু মাচ।

রাগে তোয়ালে টা বিছানা থেকে তুলে দড়িতে মেলে দিয়ে আসলো উজান। এদিকে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের চুল গুলো ঝারতে ঝারতে হিয়া বললো,

– লোকে বিয়ে করে বউ এনে ফুল দিয়ে ঘর সাজায় আর এনাকে দেখো। লতা ঠিকই বলে একটা একটা নিরামিষ আপনি। পুরাই নিরামিষ।

পিচ্চি হিয়াকে রাগে গজগজ করতে করতে চুল আছড়ানো দেখতে গিয়ে মুগ্ধ হয়ে পড়লো উজান। সব রাগ ধুলোয় গিয়ে মিশে গেলো মুহুর্তে। আলতো পায়ে হিয়াকে এসে পেছন দিয়ে জড়িয়ে ধরে হিয়ার কাঁধে মুখ ডুবালো উজান। রাগান্বিত হিয়া রাগিরাগি চোখে তাকিয়ে থেকে বললো,

– আপনাকে আমি আগে বলিনি,কিন্তু এইটুকু একটা খাটে কি করে দু’জন থাকবো আমরা।

উজান একটা মুচকি হেঁসে দিয়ে বললো,

– আপনি থাকলে এইটুকু খাট কেনো ম্যাডাম আমার তো ফ্লোর হলেও চলবে!

চোখ পাকিয়ে হাতে থাকা চিরুনি টা দিয়ে উজানের হাতে একটা মাইর বসিয়ে দিলো হিয়া। লজ্জা সূচক হাসি টেনে বললো”অসভ্য একটা!

!
!

গত দুদিন ধরে টেস্ট পেপারের ২০টা মডেল টেস্ট তো নেওয়া কম্পিলিট সাথে কম্পিলিট বায়োলজি বইটাকে তিনবার রিভাইস দেওয়া। আজকেও দুপুরের ভাত ঘুম থেকে ওঠার পরপরই দুটো মডেল টেস্ট করতে বসিয়ে দিয়েছে উজান। হিয়ার তো এখন এমন অবস্থা যে সব হজম করবে না না সাথে থাকা মানুষটাকে খু*ন করবে কিছুই মাথায় ঢুকছে না এমন৷ হিয়ার জন্য গরম দুধ আর পাউরুটি নিয়ে হিয়ার পাশে এসে বসলো উজান। হিয়া উজানের দিকে তাকিয়েও আবার পড়াতে মনোযোগ দিলো। এদিকে হিয়ার খোলা চুল গুলোর দিকে তাকিয়ে একটা বিরক্ত সূচক ভঙ্গি এঁটে উজান বললো” কি অবস্থা করে রাখছো চুল গুলোর, দেখি” হাতে চিরুনি নিয়ে হিয়ার পেছনে গিয়ে সেটাকে সুন্দর মতো আছড়ে একটা বেনুনি গাঁথতে শুরু করলো উজান। বিনুনি গাঁথতে গাঁথতে বললো,

– মন কি খুব খারাপ করছে শিশিরের জন্য?

হিয়া কলম থামিয়ে উজানের দিকে চেপে এসে বসে বললো,

– খুব খারাপ করছে। আপনি তো বলছেন ভাইয়া ভালো আছে। আপনার সাথে নাকি ফোনেও কথা বলেছিলো তাহলে আপনি কেনো আমার সাথে ভাইয়ার কথা বলে দিচ্ছেন না উজান। আমার যে খুব কষ্ট হচ্ছে।

– আর একটা দিন ধর্য্য ধরো। আমি সব ঠিক করে দেবো হিয়া। প্রমিস।

– সত্যি তো আর একটা দিনই তো।

– হুম কি যেনো বলো একটা তুমি হু পাক্কা প্রমিস।

হিয়া মৃদু হাসলো। বিনুনি গাঁথা শেষ হতেই হিয়া বিনুনিটাকে হাতে নিয়ে উজানের বুকে নিজের পিঠ ঠেকিয়ে হেলান দিয়ে বসে বললো,

– এ-তো সুন্দর বিনুনি গাঁথা কার কাছে থেকে শিখেছেন?

– রোদ শিখিয়েছে। আগে মা’কে মাথায় করে দিতো তখন শিখেছিলাম ওর কাছে।

– আপনি রোদ আপুকে খুব স্নেহ করেন তাই না।

– হুম অনেক। আমাদের ভাইবোনদের মাঝে রোদের সাথেই আমি কথা বলি ইউ নো যতো আবদার,ঝগড়া,খুনসুটি সব ওর সাথেই হয় আমার। আমাদের আলাদা একটা টান আছে। যতোই সম্পর্ক থাক আত্মার যে একটা কানেকশন থাকে না সেটা একদম আলাদা থাকে।

– হুম। আমারো খুব প্রিয় রোদ আপু। এ-তো সুন্দর আপু!

– ওর মনটাও অনেক সুন্দর হিয়া। আমি বিশ্বাস করি শিশির ভাগ্যগুনে রোদের মতো একটা মেয়েকে পেয়েছে।

হিয়া এবার কপালে ভাঁজ এঁটে মুখ টা উপরে তুলে বললো,

– ওহ তা আপনি বুঝি আমাকে ভাগ্যগুনে পাননি!

উজান হিয়ার মুখের উপর মুখ ঠেকিয়ে দিয়ে বললো,

– না রে পাগলি তোকে তো আমার ভালো কোনো কাজের পুরষ্কার হিসাবে সৃষ্টিকর্তা আমাকে দিয়েছে। আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ পাওয়া এক রহমত তো তুই!

চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here