চোখের_তারায়_তুই?#পর্ব_২৭

0
708

?#চোখের_তারায়_তুই?
#পর্ব_২৭
#ইভা_রহমান

দুপুরের জন্য সবজি রান্না করতে চাকু হাতে একটা কুমড়ো কাটছে হিয়া। সাথে রাগ মিশিয়ে গজগজ করতে করতে বলছে” এ-ই গত চার পাঁচ দিন থেকে কুমড়ো খেতে খেতে নিজেকেই একটা আস্ত কুমড়ো মনে হচ্ছে আমার। এতো সবজি থাকতে এ-ই কুমড়োটাই ওনার প্রিয় হতে হলো,কুমড়োপটাশ একটা,এতো কুমড়ো খায় তবুও তো চোখের সমস্যা। লাভ কি হয় খেয়ে। অসহ্য”

রাগে কুমড়োটাকে কাটা বাদ দিয়ে ভাতের সাথে সিদ্ধ বসিয়ে দিলো হিয়া। পারবো না আর আজ ভাজিভুজি করতে সিদ্ধ বসিয়ে একটু ঝাল ঝাল ভর্তা করে দেবো ওতেই চলে যাবে। একটু তো মুখের ফেলেবারটা চেঞ্জ হবে। কুমড়ো গুলোকে সিদ্ধ দিয়ে সকালের বাসন দুটো মাজতে যাবে ওমনি কলিংবেলের লাগাতার শব্দে আসছি আসছি বলে দৌড়ে ছুটে আসলো হিয়া। হ’য়ে গেলো এতো তাড়াতাড়ি বাজার উজানের! ওড়না দিয়ে ঘামে ভেজা চোখমুখ মুছতে মুছতে রুমের দরজা খুলতেই থমকে গেলো হিয়া! এ কে এসেছে তাকে দেখতে!

শিশির ভাইয়া! কিছু বলবে কি তার আগেই শিশিরকে দেখামাত্র কান্নায় ভেঙে পড়লো হিয়া। অবিরত চোখের নোনাজল খুব সুন্দর করেই বেয়ে যেতে থাকলো হিয়ার চোখ জোড়া দিয়ে। সেই কান্নার রেশ গিয়ে লাগলো শিশিরের শরীরেও। বোনকে কাঁদতে দেখে নিজেও অনেকটা আবেগে ভাসলো সে। ভেজা চোখে হিয়ার দিকে এগিয়ে এসে হিয়ার মাথায় স্নেহের হাত রাখতেই দু’হাতে শিশিরকে জাপ্টে ধরলো হিয়া। বাধ ভাঙ্গলো তার কান্নার। কাঁদতে কাঁদতেই হিয়া ক্ষমা চেয়ে নিতে থাকলো তার ভাইয়ের কাছে।

– I am sorry ভাইয়া৷ খুব খুব সরি। বিশ্বাস কর আমি এরকমটা করতে চাইনি। কিন্তু হ’য়ে গেছে। ভয় পাইছিলাম সেদিন খুব। কাজি আঙ্কেল টাকে দেখে ভেবেছিলাম তুই সত্যি সত্যি আমার বিয়ে পড়িয়ে দিবি। আমি উজান স্যারকে হারাতে চাইনি ভাইয়া। আমি পারতাম না স্যারকে রেখে অন্য কাউকে। তুই আমাকে ক্ষমা করে দিয়েছিস তো বল?

কান্নারত বোনের চোখ মুছে দিয়ে শিশির বললো,

– পাগলি,তোর উপর রাগ করলে না তোকে মাফ করবো। হ্যা একটু অভিমান জমেছিলো। এখন আর নেই। তুই উজানের সাথে ভালো আছিস এটাই কি যথেষ্ট না আমার জন্য।

হিয়া শিশিরের হাত মুঠো করে ধরে বললো,

– তুই সত্যি বলছিস তো। তুই তুই আমাকে ছুঁয়ে বল তুই আর রেগে নেই আমার সাথে। তুই এখন আগের মতো কথা বলবি আমার সাথে বল আমাকে।

শিশির হিয়াকে অভয় দিয়ে বললো হুম বলবো। এদিকে এদের ভাই বোনের এই গদগদ আবেগী মুহুর্তের মাঝে এক ফালি হাসি দিয়ে রুমে এসে চিৎকার শুরু করলো রোদেলা। এটা কি হচ্ছে আমাকে রেখে এরা নিজেরা নিজেদেরকে আদরযত্ন করছে দেখো। দিস ইস ভেরি ব্যাড। রোদেলাকে এক বুকে আগলে নিয়ে শিশির বললো “শান্তি মিটেছে এবার ম্যাডামের,উজান আর হিয়ার নতুন সংসার দেখবো বলে বলে মাথা একবারে চিবিয়ে খাচ্ছিলো,পাগলি একটা। রোদ আহ্লাদের সুরে বললো হয়েছে শান্তি। আর আজকে আমরা দুপুরে হিয়ার বাড়িতে খেয়ে তারপরই বিদায় নেবো,কেমন!

হিয়া শিশির আর রোদকে ভেতরে বসতে দিয়ে চটজলদি চা পানি করে আনতে গেলো রান্নাঘরে। যেমনই হোক যেভাবে হোক এটা তো এখন তার একটা সংসার। আর তার বাড়িতে প্রথম তার ভাইয়া আর রোদ আপু আসছে যতোটুকু পাড়া যায় মেহমানি তো করতেই হবে তাকে তো নাকি।

উজান শিশিরকে আর রোদকে নিজেদের রুমে নিয়ে এসে বসিয়ে দিয়ে গল্প দিতেই কিছুক্ষণ বাদে ট্রে তে চা আর পাউরুটি নিয়ে হিয়া হাজির। এদিকে পিচ্চি হিয়াকে এভাবে কাজ করতে দেখে মুচকি হাসছে বাকি সবাই। রোদ ট্রে থেকে চা নিয়ে খেতে খেতে বললো,

– বাহ বা আমার ননদীনি দেখছি খুব কাজ করতে শিখে গেছে। ভাইয়ের ইফেক্ট পড়েছি দেখছি।

– একদমই না আপু। বিশ্বাস করো এটা যে আমার সংসার,আমি যে এখানে একটু নিজে থেকে কাজ করবো তারো সাধ্য নেই আমার। আসছি থেকে পড়াশুনার বাহিরে ঘরের একটা কাজে হাত দিতে দেন না উনি। আজ তো তোমরা আসবে দেখে বললো রান্নাটা করে নিতে, নয়তো সারাক্ষণ বইয়ের ভেতরে মুখ ডুবে থাকতে হয় আমার। এগুলো কি ঠিক বলো তো তুমি।

হিয়ার কথায় মুচকি হাসলো উজান। এদিকে বিছানার একপাশ জুড়ে গাদা গাদা বইয়ের পাহাড় দেখে হাসি আর থামাতে পারলো না রোদ। হাসতে হাসতে চোখে পানি চলে আসলো কিন্তু এ-ই সব দেখে নিজেকে আর নিজের বাধভাঙ্গা হাসিটাকে আঁটকে রাখাতে পারলো না যেনো সে।

– সত্যি ভাই,এটা তোর দ্বারাই সম্ভব। লাইক সিরিয়াসলি তুই বিয়ে করে কোথায় হানিমুনে যাবার চিন্তা করবি তা না তুই হিয়াকে।

– এসব হানিমুন,ঘুরে বের হবার জন্য অনেক সময় আছে রোদ। আজকে জানুয়ারির আট তারিখ, মার্চ এপ্রিলের দিকে ওর ফাইনাল। সে খেয়াল আছে ওর।

– হ্যা তাই বলে এভাবে___প্লিজ এটা বলিস না যে তোরা কক্সবাজারে স্ট্রে করার পড়েও সমুদ্র ঠিকমতো ঘুড়ে দেখিস নি।

হিয়া কান্না কান্না কন্ঠে বললো,

– সত্যি দেখিনি আপু। জানো আমি কতো কি কল্পনা করেছিলাম এ-ই প্রথম কক্সবাজার যাচ্ছি কত্তে মজা করবো,সারাদিন পানিতে খেলবো,সানসেট দেখবো কিন্তু তোমার ভাই। সে কি করেছে জানো একদিন,শুধু একদিন আমাকে বীছে নিয়ে গিয়ে একটু শুধু সমুদ্র টা দেখিয়ে আবার এনে পড়তে বসিয়েছে। এগুলো ভালো লাগে বলো।

– সত্যি তো। দীস ইজ রিয়েলি ভেরি ব্যাড উজান। পড়াশোনা করাচ্ছিস করা তাই বলে তুই মেয়েটাকে একটু আদর করবি না। এটা কিন্তু টোটালি আনফেয়ার।

– হ্যা আপু একটু বকা দিয়ে বুঝিয়ে দেও তো এরপর থেকে যেনো আমাকে অনেক অনেক আদর করে। সে তো আমাকে আদরই করতে চায় না। এরকম নিরামিষ কেউ হয় বলো তো তুমি।

কথাটা বলতে বলতেই হুঁশ ফিরে আসলো হিয়ার। কাদের সামনে কিসব বলছে সে এগুলো। নিজের ভাইয়ের সামনে কিনা উজানকে বলছে তাকে আদর করে দিতে। ইশ ইশ ইশ লজ্জায় বোধহয় মাটিতে লুটে যায় মেয়েটা। সবাইকে নিজের দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকতে দেখে এক দৌড়ে রান্নাঘরে এসে পালালো হিয়া। কি হলো এটা। ভাইয়ার সামনে কিনা! ধ্যাত।

এদিকে হিয়াকে লজ্জাপেতে দেখে উঠে আসলো রোদ। বুঝছে মেয়েটা ভারী লজ্জা পেয়েছে। রোদ উঠে আসতেই রুমের দরজা লাগিয়ে দিলো উজান। চোখের ইশারায় শিশিরকে বললো পকেটে সিগারেট আছে কিনা। শিশির সিগারেট বের করলো ঠিকই কিন্তু লাইটার। সেটাতো রান্নাঘরে। বাধ্য হ’য়ে সিগারেট টা নিয়ে বিছানার এক কানিতে লুকিয়ে রাখলো উজান। নাহলে হিয়ার যা চোখ। দেখলেই বাড়ি থেকে বের করে দিয়ে দরজায় তালা দিয়ে রাখবে। উজান শিশিরের দিকে এগিয়ে এসে গা টা বালিশে হেলান দিয়ে বসে বললো,

– তুই যখন রাজি ছিলি তাহলে এতো তাড়াতাড়ি বিয়েটা কেনো করালি আমাকে দিয়ে শিশির?

– আমি হিয়ার বিয়ে না দিলেও চাচির চাপে হয়তো রাজি হতে হতো আমাকে উজান। হিয়া না বুঝলেও আমি তো বুঝি চাচি আর চাইছিলো না আমি বা হিয়া কেউ তার সংসারে থাকি আফটারওল সামনে ওনার মেয়ের বিয়ে বাড়িতে আত্নীয়স্বজন আসবে,রুম লাগবে,আরো তো….

– তাই তুই হিয়ার বিয়ে দেওয়ার কথা ভাববি।

– ভাবতে তো চাইনি বাধ্য হয়েছি। যাই হোক আমি ভেবেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। জানতাম চাচি শোনার মানুষ হবে না।

– তাহলে যখন আমার সাথে হিয়ার বিয়েই দিবি তখন আমাকে আর হিয়াকে এতোদিন এতো সাফার করালি কিসের জন্য। কম আঘাত দিসনি কিন্তু তুই।

– হ্যা তো। আমার বোনকে আমি যার হাতে তুলে দেবো তাকে একটু পরখ করতে হবে না আমার। সে আমার বোনের জন্য কতো দূর কি করতে পারে,সে আসলে কতোটা ভরসাযোগ্য সেটা আমাকে দেখতে হতো না।

শিশিরের গায়ে একটা কুশন চটকে দিয়ে উজান বললো,

– তুই একটা হা”রা”মি শিশির। তোর আমার উপর বিশ্বাস ছিলো না।

– বিশ্বাসের প্রশ্ন না উজান। প্রশ্ন তোর বাড়ির লোকদের নিয়ে।

– আমি তো মা’কে জানিয়েছি আমি হিয়াকে বিয়ে করেছি। এখন তারা মানলে মানবে না মানলে আমি আমার আর হিয়ার জন্য যতটুকু যা করতে হয় সব এ্যারেন্জ করতে পারবো আইহোপ।

– জানি না কি করবি এটা এখন তোর দায়িত্ব। তবে হিয়াকে নিয়ে এখনি রংপুরে ফিরিস না। চাচি এখনো আমার সাথে কথা বলছে না। এ মাসের ২৫তারিখে নীলির বিয়ে । উনি এক বাক্য জানিয়ে দিয়েছেন এ-ই বিশ পঁচিশটা দিন যেনো হিয়াকে নিয়ে বাড়িতে আর কোনো ঝামেলা না হয়। তাই আমি চাই তোরা কিছুদিন একটু আড়ালে থাক।

– ঠিক আছে। আমারো একটু স্পেস দরকার। তবে তুই প্রথম থেকে এরকম না করলে কিন্তু সবটা ঠিক ভাবে হতো। এ-ই বিয়েটা এতো জলদির কিছু ছিলো না।

– ভূল তো হিয়া বুঝেছিলো। কাজিকে দেখে ভাবছে ওর বিয়ে দেবো আসলে কাজি তো এসেছিলো চাচ্চুর খোঁজে। হিয়া বুঝতে ভূল করেছে, ভেবেছে ওকে সত্যি সত্যি বিয়ে দিয়ে দেবো আমি।

– আচ্ছা যা-ই হোক যা হবার তা তো হয়েছে। এখন তুই গিয়ে আগে হিয়ার সব নোটস,কোচিংএর শীট আর খাতা গুলো কুরিয়ার করে পাঠিয়ে দিবি। আমি চাইনা এসবে জড়িয়ে ওর ভবিষৎ টা খাপছাড়া হ’য়ে উঠুক।

শিশির উজানের হাতটা মুঠো করে ধরে নিয়ে বললো,

– আজ থেকে আমি আমার কলিজটা তোর হাতে অর্পন করলাম উজান। এটাকে দেখে রাখিস। কোনো কমতি বা আঘাত আসতে দিস না।

উজান শিশিরের হাতের উপর হাত রেখে বললো,

– কথা দিচ্ছি তোকে, হিয়া আমার কাছে তোর কাছে থাকার মতোই ভালো থাকবে। কোনো কমতি আসতে দেবো না আমি হিয়ার। খুব ভালো রাখবো তোর বোনকে!

!
!

সেদিন টা হিয়ার হাতের কুমড়ো ভর্তার সাথে রোদের রান্না করে নিয়ে আসা মুরগীর কষা মাংসের সাথে খুব জমিয়ে খাওয়া শেষে একটা লম্বা আড্ডা দিলো চারজন। দেখতে দেখতে সময় ফুরিয়ে কখন সন্ধ্যা নামলো সে হিসাব মেলাতে ব্যর্থ হলো হিয়া। এদিকে তো শিশিরকে যেতেও দিতে ইচ্ছে হচ্ছে না তার ইশ যদি আমরা চারজন এভাবেই এক ছাঁদের নিচে একসাথে হাসি মজা আনন্দে কাটিয়ে দিতে পারতাম রোজ।

– আমাকে ফোন করবি কিন্তু ভাই। নাহলে আমি কিন্তু ভেবে নেবো তুই এখনো আমার উপর রাগ করে আছিস।

শিশির হিয়ার মাথায় হাত বুলে দিয়ে বললো,

– বেশ করবো কিন্তু পরিস্থিতি যতোদিন না স্বাভাবিক হচ্ছে তোরা কেউ আমাকে আগে ফোন করবি না আমি নিজে ফোন দিয়ে খোঁজ খবর রাখবো।

– ঠিক আছে। আচ্ছা ভাইয়া চাচ্চু কি খুব রেগে আছে আমার উপর। চাচি,চাচি আম্মু কি তোকে খুব কথা শুনিয়েছে আমাকে নিয়ে।

– না বুড়ি চাচ্চু রেগে নেই। হালকা অভিমান করেছে। তবে চাচি রেগে আছে অনেক, হাজারহোক নিজের আত্নীয়কে না করতে হয়েছিল তাকে!

শিশির আর হিয়ার বিদায় পর্বের মাঝে রোদ এসে উজানের হাতে একটা প্যাকেট গুঁজে দিয়ে ফিসফিস করে বলে উঠে,

– এটা তোর জন্য। আমি তো জানি শিশিরের পারমিশন অবধি তুই হিয়াকে এখনো গ্রহন করিস নি। কিন্তু আজ তো শিশিরো পারমিশন দিয়ে দিলো এখন এটা তোর জন্য জরুরি বুঝলি।

চোখ দুটো বড়সড় করে রোদের মাথায় গাট্টা মেরে দিয়ে উজান বললো,

– ফাজিল মেয়ে। ভাইয়ের সাথে মজা করিস। অতিরিক্ত পেকে গিয়েছিস কিন্তু তুই রোদ।

রোদেলা উজানের গাল দুটো টেনে দিয়ে কাঁদো কাঁদো মুখ করে বললো,

– পেকে একদম গুলগুলা হয়ে গেছি ভাই কিন্তু তোর বেরসিক বন্ধু টা-ই বুঝলো না রোদের মনের এই দুঃখ জ্বালা যন্ত্রণা!

হেঁসে দিলো উজান। সাথে হাসির বাঁধ ভাঙ্গলো রোদেলার।

– তাহলে আজকে আসছি। আমাকে আবার ওদিকে বাস ধরতে হবে।

– তুই আবার আজকেই রংপুরে ব্যাক করবি ভাইয়া । কিন্তু রোদ আপু?

– আমি কিছুদিন ঢাকাতেই স্ট্রে করবো হিয়া। তবে এখানে হয়তো আসতে পারবো না। কাল বাড়ির সবাই আসছে।

মনটা ছোট করে হলেও হাসিমুখে শিশির আর রোদকে বিদায় দিলো হিয়া আর উজান। আজকে সত্যি দিনটা অনেক পরিপূর্ণ ছিলো। এই কয়েকদিন অনুতাপের আগুন যেভাবে হিয়াকে পিষে মারছিলো আজ যেনো সব কষ্ট দুঃখ অভিযোগ জীবনের পাতা থেকে মুছে গেলো নিমিষে। দরজা লাগিয়ে রুমে এসে বিছানার উপর বসতেই হাসি হাসি মুখে বালিশ টা কোমড়ে গুঁজে দিয়ে, আজকে সারাদিনের কথা ভাবতে গিয়েই আবেগে জর্জরিত হ’য়ে পড়লো হিয়া। সত্যি উজান কথা রেখেছে। বলেছিলো আজকে সব ঠিক করে দিবে আর তাই করেছে। আজকে নিজেকে অনেক সুখবতী মনে হচ্ছে হিয়ার। যেনো এ-ই পৃথিবীতে তার মতো সুখি আর দু’জন নেই।
!
এদিকে হিয়ার ভাবনার মাঝে হঠাৎই নিজের গায়ে দেওয়া শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে হিয়ার দিকে ঝুঁকে আসলো উজান। কপালে ভাঁজ এঁটে উজানের দিকে তাকাতেই আঁতকে উঠলো হিয়া। কি করতে কি চাইছে এ-ই লোকটা। খেয়ে ফেলার ফন্দি আঁটছে নাকি!

– এ এসব কি করছেন। জামা-কাপড় কে কেনো খুলছেন আপনি?

হিয়াকে বিছানায় ফেলে দিয়ে উজান বললো।

– আদর করিনা আমি। একটুও করি না।

– আমি, আমি তো রোদ আপুকে ওটা কথার কথা বলেছি না। আপনি তো আমাকে..

– চুপ। আজ এ-তো আদর দেবো যে সেটার হিসাব গুনতেই তুমি কাহিল হ’য়ে পড়বে মিস মুনতাসীর উপস মিসেস শাহরিয়ার!

!
!

এ-ই তো চললো জীবন। সাথে চললো উজান হিয়ার একটা ছোট্ট সংসারের যাবতীয় কারবার। উজানের সাথে থাকতে থাকতে সময় গুলো কিভাবে ফুরিয়ে আসলো জানা নেই হিয়ার। উজানের সাথে ঔ ছোট্ট রুমে খুনসুটিতে ভরা রঙীন রঙীন দিন পাড় করতে থাকলো হিয়া। কখনো উজানের জন্য স্পেশাল চা রান্না করা,কখনো রাত বিরাতে উজানের সাথে ছাঁদে বসে জোৎস্নাবিলাশে নিজেদের মাতিয়ে তোলা। কখনো ছুটির দিনে মুখ লুকিয়ে কোনো জায়গা থেকে ঘুরে আসা। সাথে কখনো পড়াশোনা করতে করতে উজানের বুকে ঘুমে লুটিয়ে পড়া,ঘুমন্ত হিয়াকে ঠিক মতো শুইয়ে দিয়ে নিজেও হিয়াকে আগলে ঘুমে যাওয়া। কখনো ঘুম থেকে না উঠতে উজানের হাজারটা বায়না। আবার কখনো পড়ার থেকে বাঁচতে মিছে মিছে হিয়ার ঘুমের ভান করা সব মিলিয়ে একটা বেশ স্মৃতিময় মুহুর্তে ভরে উঠলো হিয়া আর উজানের জীবনের এই রঙীন অধ্যায়ের পঙক্তিগুলো।

ওদিকে হিয়ার খোঁজ করা বাদ দিয়েছে চাচি আর চাচ্চু তারা আপাতত তাদের মেয়ের বিয়ে নিয়েই ব্যস্ত ছিলো এতোগুলো দিন। ওদিকে উজানের মা, উজান আর হিয়ার বিয়ের খবর জানলেও সেটা বাড়িতে সবার থেকে লুকিয়ে যায়। উজানের এ-ই এতোদিন বাড়ি থেকে নিরুদ্দেশ থাকার ঘটনাটাকে তিনি ফ্রেন্ডদের সাথে একটা লং ট্রীপের কথা বলিয়ে চালিয়ে যেতে থাকেন। তার সাহস কুলায় না শাহরিয়ার বাড়ির নরপশু গুলোর সামনে সত্যিটা উন্মোচন করার। কিছুদিন বাদে যখন উজানের বাবা ফরেন থেকে দেশে ব্যাক করবেন তখন তিনি তার হাসবেন্ডকে কি জবাব দিবেন সেটা ভাবতেই যেনো ওনার ভয়ে দম আঁটকে যাবার মতো অবস্থা।

!
!
?
আকাশ জুড়ে কালো মেঘের থোকা থোকা ঘন স্তুপ। সকালে সূর্যের সরু কিরনের দেখা মিললেও হঠাৎ জানুয়ারি মাসের আকাশ জুড়ে এরকম ঝড়ের আগমনী বার্তা যেনো প্রকৃতিকে বিচারকের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। প্রশ্ন তুলছে তার এই ছন্দপতনের কারন কি? এখন তো হওয়া উচিৎ হাড়কাঁপানো ঠাণ্ডার আমেজ সাথে শৈত্য প্রবাহের ভয়ে গরমের খোঁজ। কিন্তু তা না হয়ে শীতের ভেতরে বর্ষাকে টেনে এনে কাকে ভেজাতে চাইছে এই বর্ণিল প্রকৃতি!

ছাঁদের উপর মেলে দেওয়া কাপড় গুলো নিয়ে আসতেই বেসামাল হয়ে যাচ্ছে হিয়া। উজানের বায়নাতে শাড়ি পড়তে গিয়েই আরো নাস্তানাবুদ অবস্থায় পড়তে হচ্ছে যেনো হিয়াকে। এতো বাতাস। শাড়ির আঁচল কোমড়ে গুঁজে উড়ন্ত চুলের সাথে উড়ন্ত কাপড় গুলো তুলতেই ঝমঝম বৃষ্টিতে মুখরিত হয়ে উঠলো চারপাশ। এ যা এটা কি হলো!

মুহুর্তে হিয়াকে ভিজিয়ে দিলো অসময়ে এ-ই বৃষ্টি। এমনিতেও হিয়া ছোট থেকে বৃষ্টি প্রিয় একটা মানুষ। তার উপর প্রকৃতির এই অসময়ের ছন্দপতন। নিজেকে আর আঁটকে রাখতে পারলো না হিয়া। ভিজেই যখন গিয়েছি আর বাকিটা না-হয় ভিজিয়েই কাটিয়ে দেই। বৃষ্টির গোলগোল টপটপ ফোটার তালে নিজেকে হারিয়ে ফেললো হিয়া। এদিকে এ-ই বৃষ্টিতে হিয়ার আসতে দেড়ি দেখে এক ছুটে উপরে আসলো উজান। আর এসেই তার পিচ্চি ময়ূরীর নাচ দেখেই চোখ আঁটকে রইলো যেনো তার। সাথে রাগো হলো কিছুটা এভাবে যদি সে না এসে অন্য কেউ দেখে নিতো। কেমনটা লাগতো তখন!

এক পা দুপা করে হিয়ার দিকে এগিয়ে আসতেই উজানকে দেখামাএ উজানের বুকে লাফিয়ে পড়লো হিয়া। এক ফালি হাসি টেনে দিয়ে কাঁপতে কাঁপতে বললো,

– এ-ই অসময় কি সুন্দর বৃষ্টি পড়ছে দেখুন। ওহহ কি ঠান্ডা। জমে যাচ্ছি।

উজান হিয়ার মুখ থেকে ভেজা চুল গুলো সরিয়ে দিয়ে বললো,

– তাহলে ভিজছো কেনো। কেউ যদি এভাবে এসে দেখতো তখন!

জিহ্ব কাটলো হিয়া। সত্যি তো কেউ এসে দেখে নিলে কি হতো। একবার বৃষ্টিতে ভিজতে গিয়ে কি বকুনিটাই না দিয়েছিলো উজান। একদম সোজা বাথরুমে নিয়ে গিয়ে ঢুকিয়ে দিয়েছিল।হিয়ার করুন মুখ টা দুহাতে তুলে ধরে হিয়ার কপালে একটা স্নেহের পরশ আঁকলো উজান। ইশশ বৃষ্টির এতো তেজ যে চোখ খুলে সামনের মানুষটার দিকে তাকাতেও পারছে না যেনো হিয়া। হিয়াকে নিয়ে একটা দীর্ঘ বৃষ্টিস্নান শেষে নিজেদের রুমের দিকে রওনা হলো উজান। না এভাবে এই শীতে বৃষ্টিতে থাকা একদম আর উচিৎ হবে না। সাথে বজ্রের গর্জনো তো শোনা যাচ্ছে এ মুহুর্তে নিচে যাওয়াটাই যেনো শ্রেয়!

বৃষ্টি ভেজা শরীরে ছাঁদ থেকে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে সিঁড়ির মাথায় হিয়াকে টুক করে কোলে তুলে নিলো উজান। কি হলো এটা! দু’জনের শরীর গড়িয়ে টপটপ পানি পড়ছে। এদিকে হিয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকায় উজানের চুলের পানি এসে চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে হিয়ার মুখে। চোখ পিটপিট করে উজানকে রাগ করে হিয়া বললো,

– কি করছেন৷ মানুষের সিঁড়ি ভিজিয়ে দিবেন নাকি!

– চুপ! অনেক বেশি কথা বলো তুমি ইদানীং!

– আশ্চর্য তো। নামান আমাকে কেউ এসে এভাবে দেখলে তখন। উজান ঘরে চলুন নাআআ। বাহিরে এসব কিচ্ছু না প্লিজজ…

নেশাভরা কন্ঠে উজান বললো,

– যাবোই তো ঘরে। এতো অস্থির হচ্ছো কেনো তুমি?

– আপ আপনি এরকম করে তাকিয়ে কি দেখছেন! দেখুন। এখন এসব একদম না হ্যা। এমনিতে শুকনো জামাকাপড় গুলো ভিজে চিপচিপে হ’য়ে আছে, ওগুলো আবার চিপে নেড়ে দিতে হবে,এখন একদম কিচ্ছু না হ্যা।

মৃদু হাসলো উজান। একরাশ নেশা ছড়িয়ে দিয়ে এক পা দু পা করে সিঁড়ি বেয়ে নেমে নিজেদের ফ্ল্যাটে এসে থামলো। হঠাৎই মেঘের গুরুমগুরুম কানে বাজতেই কেঁপে গিয়ে উজানের ঘাড় চিপে ধরলো হিয়া। উফফ আকাশটাও এতো লজ্জা দিতে জানে যে কি বলবো। হিয়াকে নিয়ে রুমে এসে থামতেই একটা বিকট বাজ পড়ার শব্দে কেঁপে উঠলো হিয়া উজান দুজনই সাথে কাঁপলো জানালার থাই অবধি। সাথে সাথে কারেন্ট টাও ফুশ হয়ে নিভে গেলো সব বাতি। এখন!

অন্ধকার রুমে হিয়াকে নামিয়ে দিয়ে টর্চ খুঁজতে থাকলো উজান। হিয়া হেঁসে দিয়ে বললো আপনি টর্চ কিনে আনেননি মাস্টারমশাই। থাকুন এখন এই ঘুটঘুটে অন্ধকারে। উজান হিয়ার গাল দুটো টেনে দিয়ে বললো টর্চ নেই তো কি হয়েছে মোমবাতি তো আছে!

দরজাটা ভালো করে লাগিয়ে দিয়ে দুটো মোমবাতি জ্বালিয়ে নিয়ে রুমে আসলো উজান। একটা রাখলো ডাইনিং এর এক কোণে আরেকটা রাখলো তাদের রুমে বিছানার পাশের ছোট্টো টুল টায়। অন্ধকারের মাঝে মোমের আলোর এক আলাদা আভা ছড়িয়ে পড়লো নিমিষে। থাই দিয়ে শিরশির করে আসতে থাকা বাতাসে পর্দা উড়তে থাকলো। এ-ই বুঝি উড়ন্ত পর্দার সাথে এই বাতাসে নিভে যায় মোমবাতির রক্তিম আলো। কিন্তু নিভলো না তার আগে বারান্দার থাই সহ জানালার থাইটা আলতো করে লাগিয়ে দিলো উজান। হিয়া র্যাক থেকে নিজের একটা কুর্তি উঠিয়ে নিয়ে ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়াতেই হিয়ার হাত ধরে হিয়াকে নিজের বুকে এনে ফেললো উজান। চোখ পাকিয়ে হিয়া বললো,

– এটা কি হচ্ছে। দেখুন আমার ভীষন শীত করছে আমি এখন চেঞ্জ করবো।

কে শোনে কার কথা। হিয়াকে ছাড়লে তো উজান। ভেজা শাড়ীর ভেজা আঁচল টা একটানে মুঠো করে পেঁচিয়ে ধরে হিয়াকে জড়িয়ে ধরলো উজান। চোখ জোড়া বন্ধ করে তপ্ত শ্বাস ছাড়তে শুরু করলো হিয়া। হিয়ার কোমড় থেকে হাত সরিয়ে হিয়ার ঠোঁট জোড়া নিজের দখলে আগলে নিলো উজান। হার মানতে হলো হিয়াকে। হার মানতে হলো তার অবাধ্য প্রেমিকের অসময়ের প্রেমবিলাশের কাছে! হিয়াকে নিয়ে নিজেদের ভালোবাসার রাজ্য মগ্ন হয়ে পড়লো উজান। বাহিরে বৃষ্টির ঠান্ডা আমেজ কিন্তু ভেতর ঘরে বিরাজ করতে শুরু করলো প্রেমের উওাপ!❤️

!
!

দুদিন পরঃ

জানুয়ারীর শেষের দিকে শৈত্য প্রবাহের প্রকাপটা ঢাকাতে বিরাজ না করলেও ভোরের দিকে শরীরে কিছু না জড়িয়ে ঘুমোনো টা বড্ড কষ্টের। আর এ-ই শীতেও হিয়াকে সকাল সকাল বই নিয়ে কম্বলের ভেতর মুড়ে রাখছে উজান। যদিও ব্যাপারটায় প্রচন্ড চটে আছে হিয়া!

– আর চারটা জাস্ট এ-ই চারটা ম্যাথ করে দেও আই প্রমিস সারাদিনে আর একটা বারো আমি বই নিয়ে বসতে বলবো না।

– দেখো উজান। কাল রাতে কিন্তু দুটো পর্যন্ত পড়িয়েছো হ্যা এখন যদি আরো অংক করিয়ে দিতে হয় তাহলে আমি কিন্তু ভাইয়াকে ফোন দিয়ে এক্ষুনি বলবো আমাকে বাড়ি নিয়ে যেতে। কি বলবো?

– আচ্ছা যাও চারটে করতে হবে না দুটো তো করো।

– আরে এগুলো তো আমি পারি করতে আর কতো করবো।

– হ্যা বেশি বেশি করলে বেশি বেশি প্রাকটিস হবে।

– উজান তুমি কি সত্যি চাইছো আমি তোমাকে রেখে ভাইয়ার কাছে চলে যাই। কি যাবো। বলো যাই।

রাগান্বিত হিয়াকে বুকের ভেতর মুড়ে নিয়ে রাগ করতে করতে উজান বললো” ঠিক আছে এখন ছুটি দিলাম বাট রাতে কিন্তু অংক করে নিয়েই ছাড়বো আমি,ক্লিয়ার” রাগে উজানের পিঠে খামচি বসিয়ে দিলো হিয়া। এ-তো বাজে এ-ই লোকটা। ধুর। আর এক সপ্তাহ পর যাবো না রংপুর দেখবো তখন এ-তো কি করে শাসিয়ে রাখে। কুমড়োপটাশের বাচ্চা একটা। এমনি এমনি আর হিটলার ডাকতে মন চায় না। অসহ্য একবারে!

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here