চোখের_তারায়_তুই?#পর্ব_৩১

0
662

?#চোখের_তারায়_তুই?
#পর্ব_৩১
#ইভা_রহমান

ধীর পায়ে হিয়ার মাথার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো উজান,কাঁপতে থাকা হাতটা আলতো করে বাড়িয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো হিয়ার। একটু নড়েচড়ে বসলো হিয়া কিন্তু ঘুম ভাঙ্গলো না তার। পলাশ এসে চুপিচুপি পায়ে উজানের পেছনে দাঁড়িয়ে উজানের হাত টা আলতো করে চেপে নিতেই পেছন ফিরলো উজান। পলাশ হাতের ইশারায় চুপ হতে বলে ফিসফিস করে বললো” বুবু ঘুমাচ্ছে, সারারাত ঘুমোয়নি এখন আর ডেকে তুলো না বুবুকে” উজান চোখের ইশারায় হুম বলে পলাশকে নিয়ে বাহিরে আসলো। চেয়ারে বসিয়ে দিয়ে পলাশকে জিজ্ঞেস করলো এসব সব কি করে হলো ছোট!

আজকের বিকেলের পর থেকে ঘটে যাওয়া সব ঘটনা এক এক করে খুলে বললো পলাশ। সাথে সেদিনের সেই মর্মান্তিক ঘটনাগুলোর কথাও বলতে ভূল হলো না তার। পলাশ জানালো কি করে সেই হায়না গুলো তাদের দোকানের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো,কি করে একটার পর একটা থাইকে গুড়ো করে পুরো কাঁচের বন্যা বইয়ে দিয়েছিলো তারা,কি করে মুহুর্তে এক রণক্ষেএে পরিণত হয়েছিলো দোকানের চারপাশ,কি করে সেই পুলিশ লোক দুটো হাতে হ্যান্ডক্যাফ পড়িয়ে তার ভাইজানকে থানায় পুড়ে তার উপর অমানবিক নির্যাতন চালিয়ে গিয়েছিলো।

পলাশের কথায় নিজের চোখ দিয়ে অজান্তেই টপটপ জল ঝড়ে পড়তে শুরু করলো উজানের। নাকের পানি চোখের পানি,সাথে শরীরের ঘামে ভেজা পানি সব মিশে একবারে যাচ্ছে তাই অবস্থা হতে থাকলো তার। জ্বলে পুড়ে ছিঁড়ে আসলো উজানের বুক পাজর। তাকে আর হিয়াকে ভালো রাখতে গিয়ে শিশিরের এ-ই সুপ্ত যন্ত্রণা যেনো উজানের পাঁজরের সব পর্শুকাগুলোকে ভেঙ্গে টুকরো টুকরো করে ফেলার জন্য যথেষ্ট ছিলো। সাথে আজকের এ-ই অনাকাঙ্ক্ষিত দূর্ঘটনা যেনো সেই ভেঙে যাওয়া হাড়গুলোকে আরো পিষিয়ে দিয়ে অস্তিত্বহীন করে ছাড়লো। পলাশ উজানের চোখ দুটো মুছে দিয়ে বললো,

– ভাইজানের খুব কষ্ট হইছিলো উজান ভাই। আমি তোমাকে কতো খুঁজছি ঔদিন কিন্তু তুমি কই আছিলা? আজকে তোমার আসতে এতো সময় লাগলো কেন,হিয়া বুবু পাগল হইয়া যাইতো জানো আর একটু হইলে। কেন তুমি চলি যাও বারবার! কেন থাকো না আমাদের সাথে সবসময়?

পলাশের হাত দুটো চেপে ধরে হালকা শব্দ করে কেঁদে উঠলো উজান। এরকমটা তো হবার ছিলো না। তাহলে কিসের তাগিদে কিসের ভূলে এরকম হলো! সব দোষ কি তার,না তার ভালোবাসার কোনটা?
!
!

ভোরের আলো ফুটে গেছে কিছুক্ষণ হলো,আকাশে সূর্যের লাল আভা দেখা মিলছে। নাইট শীফটে ডিউটি করা সিস্টার্সরা প্রস্তুতি নিচ্ছে তাদের বাড়ি ফেরার জন্য,বাহিরে কোনো এক রিক্সার কিরিংকিরিং শব্দ শোনা যাচ্ছে। সাথে শোনা যাচ্ছে কোনো এক ঝাড়ুদাড়ের রাস্তা ঝার দেবার শব্দ। জানালা দিয়ে আলো আসলেও তার তীব্রতা যেনো খুবই কম। এদিকে এখনো হিয়া তার শিশির ভাইয়ের পা জড়িয়ে ঘুমিয়ে আছে বিভোর। গত দুদিনের ক্লান্তিতে মেয়েটা যেনো পুরোই বিধ্বস্ত। সেও তো একটা বাচ্চা মানুষ,শরীর কতো আর নিতে পারে তার।

পলাশকে নিয়ে মসজিদ থেকে নামাজ টুকু সেরে আবার ফিরে আসলো উজান। মোনাজাতে শুধু একটাই দোয়া চাইলো শিশিরের সুস্থতা।

পলাশ উজানের হাতে একটা রিসিপট ধরিয়ে বললো” ভাই,এটা হিয়া বুবু উঠলে দিও তো তার হাতে,আমি একটু বাড়ি থাইক্কা আসি,কাল থাকি আছি খুব ঘুম পাইছে আমার,তুমি তো আছোই এখন না,যাইবা না তো না আর কোথাও? উজান মাথা নাড়িয়ে বললো “হুম আছি,তুই যা গিয়ে একটু বিশ্রাম করে আয়” উজান পলাশের হাত থেকে রিসিপট টা নিয়ে ভাবলো হয়তো কোনো মেডিসিনের রিসিপট কিন্তু না এটা তো মনে হয় কোনো স্বর্ণের দোকানের! কিন্তু কেনো? উজান পলাশের কাছে জানতে চাইলো এটা কিসের রিসিপট পলাশ? পলাশ জানালো এটা সেই স্বর্নের দোকানের রিসিপট যেখান থেকে সে তার মা’র সাথে গিয়ে হিয়ার চেইন টা বিক্রি করে আসছে গতকাল!

এতোক্ষণ অবধি যা-ও বা সব সহ্য করে যাচ্ছিলো উজান। কিন্তু পলাশের এই কথাটা কিছুতেই আর তার শরীর নিতে পারলো না। হিয়ার এমন অবস্থা হয়েছিল কিনা তাকে নিজের গা থেকে সোনা বিক্রি করে। রাগ ক্ষোভ ঘেন্না সব এসে ঘিরে ধরলো উজানকে। কিন্তু এ-ই রাগ,এ-ই ঘৃনা কার জন্য হচ্ছে তার, নিজের পরিবারের জন্য, না নিজের উপর তার নিজের, না সমাজের এই ধনী-গরিব ভেদাভেদের রীতিনীতির উপর কোনটা! তপ্ত এক শ্বাস ছুঁড়ে কেবিনে আসলো উজান। ধীর শব্দে শিশিরের ফাইল টা নিয়ে বসে পড়লো পাশের বেডে। সেগুলো মনোযোগ সহকারে পর্যবেক্ষন করার এক মুহুর্তে ঘুমটা ভেঙে আসলো হিয়ার। ঘুমভাঙা চোখে শরীরের ভাড় টা কোনোমতে এক হাতের উপর দিয়ে উঠে বসলো হিয়া। একপাশে বাঁকা হ’য়ে শুইয়ে থাকতে গিয়ে ঘাড় টা লেগে আছে ভীষণ। সেটাতে একটু হাত বুলিয়ে নিয়ে মাথার চুল গুলো খোঁপা করে নিবে সেমুহুর্তেই ফাইল থেকে হিয়ার দিকে চোখ পড়লো উজানের। ফাইলটা দূত বেডে রেখে “হিয়া” বলে অস্ফুটে একটা ডাক দিতেই চমকে উঠে পেছনে তাকালো হিয়া। উজান এখানে! খোঁপা করা চুল গুলো ছেড়ে দিয়ে করুন এক মায়বী চাহনিতে উজানের দিকে এগিয়ে আসলো হিয়া। চোখ ভিজে আসলো নিমিষে। কেনো আসতে এতো দেড়ি করলো উজান,কেনো এলো না তখন যখন হিয়ার তাকে খুব প্রয়োজন ছিলো! অভিমান, অভিযোগ,রাগ,ব্যাকুলতা,একটু ভরসার হাত পাবার আশা সব মিলিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়লো হিয়া,জাপ্টে এসে জড়িয়ে ধরলো উজানকে। মনে হচ্ছে কান্না করেই হিয়া বুঝিয়ে দিতে থাকলো তার অব্যক্ত মনের এ-ই অসহ্য ব্যাথা গুলো। হিয়ার তালে তাল মিলিয়ে কান্না নামক বৃষ্টিতে নিজেকেও ভিজিয়ে ফেললো উজান। হিয়াকে সর্বশক্তি দিয়ে জড়িয়ে ধরে অভয় দিয়ে বললো” আমি আছি তো এখন,আর কিসের ভয় তোমার হিয়া” আরো জোড়ে কাঁদতে শুরু করলো হিয়া। উজানের শার্টের কলার চেপে ধরে রাগ করতে করতে হিয়া বললো,

– ভাইয়ার এখনো জ্ঞান ফিরছে না উজান। ভাইয়া কি উঠবে না। বলো না তুমি। তুমি,তুমি তো একজন উডবি ডাক্তার তুমি একটু দেখে দেও না গো আমার ভাইটাকে। ভাইয়াকে বলো না আমাকে একটু চোখ খুলে দেখতে,বলো না যে আমি কালকে থেকে যে না খেয়ে আছি ভাইয়া আমাকে খাওয়ায় দিবে না বলো না তুমি। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে উজান। মনে হচ্ছে আমি হারিয়ে ফেললাম ভাইয়াকে। নিজেকে আজ খুব অসহায় লাগছে আমার।

উজান অশান্ত হিয়াকে বুকের ভেতর লুকিয়ে নিয়ে হিয়ার মাথায় চুমু দিতে দিতে বললো,

– উঠবে শিশির হিয়া,আমি সব রিপোর্ট দেখলাম তো কিচ্ছু হয়নি শিশিরের। এখন ঘুমোচ্ছে তো ও। ঘুম টা ভেঙে আসলেই উঠে যাবে দেখো।

– কালকে থেকেই তো ভাইয়া ঘুমোচ্ছে উজান। আর কতো ঘুমায় সে। ওদিকে যে দোকান টা একলা পড়ে আছে ভাইয়া যাবে না দোকানে। ভাইয়া না গেলে কে দেখবে সব হিসাব। পলাশ কি আর পারবে বলো ভাইয়া ছাড়া সব করতে।

কান্নায় জর্জরিত হিয়াকে সব দিয়ে আগলে রাখতে চেষ্টা করতে থাকলো উজান। শিশিরের জন্য তারো তো ভয় হচ্ছে, তারো তো চিন্তা হচ্ছে, তারো তো খুব ইচ্ছে হচ্ছে শিশির উঠুক আর সে তার এ-ই বন্ধুকে ইচ্ছে মতো পানিশমেন্ট দিক। কিন্তু এদিকে সে নিজে কাঁদবে না তার অশান্ত হিয়াকে শান্ত করবে। উজানের বুকে সব কষ্ট উজাড় করে দিতেই একটা সময় হিয়ার হুঁশ ফিরলো। এ কাকে জড়িয়ে সে নিজের কষ্ট গুলো জাহির করছে! মনে পড়লো কালকে সারাদিনের সহ্য করা সব মুহুর্ত,সাথে উজানের মায়ের হাত জোড় করা বিনতি আর শিশিরের উপর বয়ে যাওয়া কিছু নির্মম ঘটনা যেগুলো নিমিষে হিয়াকে উজানের বুক থেকে আলাদা করে দিলো! ঘটনার রেশ বুঝতে পারলো না উজান। হঠাৎ কাঁদতে কাঁদতে কি হলো হিয়ার। হিয়া চোখ মুখ মুছে নিজেকে স্বাভাবিক করে কিছু একটা বলতে যাবে সেই মুহুর্তে জ্ঞান ফিরতে শুরু করলো শিশিরের। শিশিরের নড়াচড়া খেয়াল করতেই হিয়াকে পাশ কাটিয়ে শিশিরের দিকে ঝুঁকে আসলো উজান। নিজেকে শান্ত করে হিয়াও এসে দাঁড়ালো উজানের পাশে। আস্তেধীরে চোখ খুলে উজান হিয়ার দিকে দৃষ্টি পড়তেই মুচকি হাসলো শিশির। এদিকে ভাইয়ের মুখের এই হাসিতে হিয়া নিজে হাসবে না কাঁদবে বুঝতে পারলো না। হিয়ার চোখে মুখে খুশির আবরন সাথে অভিমানো স্পষ্ট। কেনো শিশির নিজের ক্ষতি করতে গিয়ে একবারো ভাবলো না এ-ই ছোট বোনটার কথা। সে কি বুঝলো না সে ছাড়া তার আর আপন কেউ নেই এই জগৎ সংসারে। এ-তো রাগ তার এ-ই ছোট্ট বোনটার উপর। এতো রাগ!

– হেই পাগলি কাঁদছিস কেনো তোরা। আমি ঠিক আছি তো। দেখ কথা বলছি কি সুন্দর।

– তুই কি হ্যা শিশির। এতোকিছু ঘটে গেলো একটা বার আমাদের জানানোর প্রয়োজন অবধি মনে আসলো না তোর?

– জানাস নি সেটাও মানলাম কিন্তু নিজের ক্ষতি করার আগে একটা বার এ-ই বোনটার কথা মনে আসলো না তোর। তুই একটা বার এটা ভাবলি না যে তুই না থাকলে আমি হিয়া কোথায় যাবে। কে আগলে রাখবে তখন আমাকে?

– কেনো উজান আছে না। উজান তোকে আগলে রাখবে।

রেগে গিয়ে হিয়া বললো,

– না আমার কেউ নাই। না তুই ছাড়া কখনো আমার কেউ আপন ছিলো না এখন আছে।

হিয়ার কথায় কপাল কুঁচকে হিয়ার দিকে তাকিয়ে উঠলো উজান। কেনো হিয়া এরকম কথা বলছে। উজান কি তার আপন না?

– আরে আশ্চর্য তো,তুই ও কি এখন কান্না করবি নাকি উজান।

উজান চোখ মুছে নিয়ে শিশিরের হাতটা নিয়ে পার্লস চেক করতে শুরু করলো। দেখে যা বুঝলো নরমাল আছে সব। শিশির একটু স্বাভাবিক ভাবে উঠে বসে নিতেই উজান একটা সিস্টার্সকে বলে ইমিডিয়েট শিশিরকে এ্যাপোয়ন্ট করা ডক্টরটাকে ডেকে আনতে বললো। কিছুসময়বাদে ডাক্তার এসে শিশিরকে দেখলো। বললো এখন সবকিছু নরমাল আছে। আর দু চারদিন অবজারভেশনে রাখার পর তারা শিশিরকে ডিসচার্জ করে দেবে। তবে এখনই যেনো কোনো ভারীকাজ বা কিছুর পেশার নিতে না হয় তাকে, পারলে পুরো একমাস বেড রেস্টে থাকতে দিন ওনাকে। উজান ডক্টরের থেকে সব বুঝিয়ে নিয়ে তাকে বিদায় দিয়ে আবার এসে শিশিরের মাথার কাছে বসলো। শিশিরের হাত জোড়া মুঠো করে ধরে নিয়ে বললো,

– আমাকে ক্ষমা করে দিস আমি রোদকে..!

– রোদের সাথে কথা হয়েছে এরমধ্যে তোর আর। আমি জানি রোদ নিজের ইচ্ছেতে বিয়ে টা করে নি। তোর ফ্যামিলি ওকে ফোর্স করে ভয় দেখিয়ে বিয়েটা করতে বাধ্য করেছে!

– তা নয়তো আর কি। ওরা পারে না এরকম কোনো কাজ নেই শিশির। রোদের সাথে এখন অবধি কোনো কথা হয়নি আমার। ওর সব কনটাক্ট নাম্বার বন্ধ। আমি দেখি কি করতে পারি এদিকে।

– একটু দেখ। জানি হয়তো এখন আর কিছু সম্ভব না তবুও আমি তার সাথে একটা বার কথা বলতে চাই। তাকে দেখতে চাই। শুনতে চাই তার কথা কেনো সে..

হঠাৎই দু’জনের কথার মাঝে হিয়া এসে দাড়িয়ে গম্ভীর কন্ঠে বললো,

– তুই এতো কেনো কথা বলছিস ভাই, ডাক্তারতো তোকে রেস্ট করতে বললো তাহলে এখন কিসের এতো কথা তোর।

কপালে ভাঁজ এঁটে শিশির বললো,

– আমি উজানের সাথে কিছু জরুরি বিষয়েই কথা বলছি বুড়ি।

– কি জরুরি বিষয়,বল আমাকে,এটা যে রোদ আপু কোথায় আছে, কতো সুখে সংসার করছে এসব। কেনো এখনো বুঝতে চাইছিস না রোদ আপু আর কখনো তোর হবে না। রোদ আপুদের সাথে আমরা কোনোভাবেই যাইনা। রোদ আপু বিয়ে করে অনেক ভালো আছে তাহলে কি দরকার তাকে নিয়ে ভাবতে গিয়ে নিজের জীবনটা বিষ বানানোর। বোঝা আমাকে?

– তুই এতো রেগে কেনো যাচ্ছিস হিয়া। আমি তোর রোদ আপুর খোঁজ করবো না এটা একটা কোনো কথা বললি তুই।

– হ্যা বললাম। কি হবে তার খোঁজ নিয়ে। সে তো দিব্যি বিয়ে করে স্বামী সংসার নিয়ে সুখে আছে কিন্তু তুই। তোর যে আজ এ-ই অবস্থা সে কোথায় এখন। খুব নাকি ভালোবাসতো তোকে। এ-ই তার ভালোবাসার নমুনা।

হিয়ার কথা গুলো শুনে সবচাইতে অবাক হলো উজান। হিয়া কবে থেকে রোদেলা কে এতো ভূল বুঝতে শুরু করলো আশ্চর্য! উজান উঠে বিষ্ময়ের সুর টেনে বললো,

– এসব তুমি কি বলছো হিয়া,রোদ কেনো?

– প্লিজ উজান। তোমার বোন সম্পর্কে আমি অন্তত এ-ই মুহুর্তে আর একটা কথা শুনতে চাই না। আর তুমি এখানে কি করছো তোমার বাড়ি নেই। সকাল সকাল এখানে কি চাই তোমার। দেখো ডাক্তার তো বলে গেলো না ভাইয়ার এখন রেস্ট দরকার তাহলে একটু তাকে একা ছাড়ো না। অনেক তো সাফার করালে আমার ভাইটাকে এবার একটু দয়া করো।

– এভাবে কিভাবে তুমি আমার সাথে কথা বলছো হিয়া। তোমার আমার উপর রাগ হ’য়েছে,অভিমান জমেছে বলো সেটা আমাকে!

– রাগ কিসের রাগ। তোমার উপর খামোখা কোনো রাগ কেনো করতে যাবো আমি। আমি শুধু বলছি আমার ভাইয়া অসুস্থ এখানে থেকে আর তাকে বিরক্ত করো না তুমি, তাকে একটু স্বাভাবিক ভাবে সুস্থ হতে দেও।

– তাই কি তুমি চাইছো যে আমি এখানে না থাকি। এখান থেকে চলে যা-ই।

– হ্যা চাইছি,যেটায় সবার ভালো হয় আমি সেটাই চাইছি।

এদিকে হিয়ার এরকম ব্যবহারে শিশির রেগে গিয়ে উঠে বসে হিয়াকে একটা ঝারি দিয়ে বসলো,

– এসব কি ধরনের কথা হিয়া। এক্ষুনি সরি বল উজানকে,বল সরি। বেয়াদবির একটা সীমা থাকে। কার সাথে এভাবে কথা বলছিস তুই।

– যার সাথেই বলি তুই এখন আর আমাকে কিছু শেখাতে আসবি না ভাই। আমি এখন আর ছোট নেই যে তুই যেভাবে বলবি আমাকে সেভাবে চলতে হবে। কোথায় কাকে কি বলতে হয় এটুকু বুঝ হয়েছে আমার।

– তুই কিন্তু আমার হাতের এবার মাইর খাবি হিয়া। আমার মুখের উপর তর্ক করছিস তুই। বেয়াদব কোথাকার।

– হ্যা আমি বেয়াদব আমি অভদ্র আমি খারাপ। তাই তোর কথা শুনতে আমি নই বাধ্য। আর তুমি কেনো এখনো এখানে দাড়িয়ে আছো আমি তো বলছি এখানে আমার আর কাউকে লাগবে না। বোঝো না তুমি কথা।

– হিয়া এবার কিন্তু আমি..

শিশির উঠে কিছু বলতে যাবে কিন্তু উজান হাতের ইশারায় শিশিরকে থামিয়ে দিয়ে বললো তুই শুইয়ে থাক আমি বাহিরে আছি। শিশির না বললেও উজান চোখের ইশারায় বুঝালো হিয়াকে শান্ত হতে দে আমি পরে এসে কথা বলবো এখন ওর সাথে। তাই তাই করলো শিশির। উজানের কথা মানতে বাধ্য হ’য়ে চুপ থাকতে হলো তাকে।

?

দু সপ্তাহ পরঃ

পাঁচ দিনের মাথায় ক্লিনিক থেকে শিশিরকে ডিসচার্জ করে বাড়িতে নিয়ে আসা হয়,এখন সে অনেকটা সুস্থ অনেকটাই স্বাভাবিক ভাবে চলাচলের জন্য তৈরি। কিন্তু হিয়া শিশিরকে আগের মতো চলাচলের পারমিশন এখন অবধি দেয়নি। যখন ডাক্তার বলেছে এক মাসের বেড রেস্ট তো তাকে একমাসেরই বেড রেস্টে থাকতে হবে। বোনের কড়া হুকুমের কাছে হার মানতে হলো শিশিরকে। এদিকে বাড়িতে আসছি থেকে ভাইয়ের জন্য যা পারছে তাই করছে হিয়া। খাবার মুখে তুলে দেওয়া থেকে শুরু করে,খাওয়ার পানি টাও অবধি সে খাইয়ে দিচ্ছে তার ভাইকে। পারলে তো বুঝি সে নিজে তার ভাইকে গোসল করে জামাকাপড় পড়িয়ে দেয় এরকম অবস্থা। শিশির যে এতো বলছে সে এখন সুস্থ কিছুতেই সেই কথা কানে তুলতে চাইছে না হিয়া। অপরদিকে সেদিনের পর থেকে উজানকে যেভাবে পারছে সেভাবে তাড়িয়ে বিদায় করছে হিয়া। তার রাগ উজানের উপর না,তার রাগ তো নিজের উপর, নিজের বোকামির উপর,তার রাগ উজানের মায়ের উপর,তার রাগ রোদের উপর,তার রাগ তার এ-ই অনাথ হবার উপর!

– চুপচাপ পুরো জুসটা শেষ করবি নয়তো আমি কিন্তু,

– একটু আগে একগাদা ফল খাইয়ে গেলি এখন আবার কিসের জুস! তুই আমার সামন থেকে যাবি কি হিয়া!

শিশির রাগ করবে তার আগে হিয়া বড়বড় রাগিরাগি চোখে শিশিরের দিকে তাকিয়ে উঠলো। বেচারা শিশির বোনের ভয়ে বাধ্য হলো জুসটা পুরো গিলতে।

– ভাইয়া একটা কথা বলি?

-বল,কিছু লাগবে তোর?

– না। আচ্ছা ভাইয়া নতুন বাড়িটা পুরোপুরি হতে কতোদিন সময় লাগবে আর। এই সপ্তাহের মধ্যে কি নতুন বাড়িতে ওঠা যাবে না?

– হ-ঠা-ৎ এ-ই ক-থা। সব কিছু তৈরি করে হলেও নতুন বাড়িতে উঠতে আরো মাস খানিক সময় লাগবে বুড়ি। দেওয়ালের রং গুলো শুকাতে হবে,মেঝেতে টাইলস গুলো লাগানো বাকি,কারেন্টের কাজ,পানির কাজ অনেক কাজ সোনা, কিন্তু কেনো?

– তুই টাকা লাগিয়ে জলদি জলদি করে নে না সবটা। এক এক করে করার চাইতে সবকাজের মিস্তিরি একবারে লাগিয়ে কর। পুরো ফ্ল্যাটটা না কম্পিলিট করলেও চলবে তোর আর আমার রুম আর একটা বাথরুম করে নিলেই তো ওঠা যায়।

শিশির হিয়ার হাত ধরে হিয়াকে পাশে বসিয়ে বললো,

– কি হয়েছে তোর। এ বাড়িতে থাকতে চাইছিস না কেনো আর?

– সত্যি করে বলবো,

– হুম।

– ইদানীং না চাচির ব্যবহার খুব অদ্ভুত লাগে ভাইয়া। মনে হয় চাচি এ বাড়িতে আমাদের থাকতে ভিক্ষে দিয়েছে__কেনো জানি চাচিকে আর আগের মতো আপন লাগে না। মনে হয় চাচি খুব বিরক্ত আমাদের নিয়ে। তোর এ-ই অসুস্থতা,আমার এখানে এভাবে থাকা উনি হয়তো সোজাসাপ্টা বলে না কিন্তু আমি বুঝি জানিস।

হিয়ার প্রতি উওরে শিশির কিছু বললো না,শুধু এক ভরসার হাত রাখলো হিয়ার মাথায়,সে নিজেও তো এসব অনুভব করছে,সে তো নিজেও জানে চাচি কতোটা বদলে গিয়েছেন। হিয়া তো এখন নাহয় সবটা বুঝছে!

হিয়া আর কিছু বলতে যাবে ওমনি গ্রীলের কাছ থেকে উজানের কন্ঠ শুনতেই চুপ হ’য়ে আবার গল্পে মন দিলো মেয়েটা। উজান যে দরজা খুলে দেবার জন্য হিয়া হিয়া বলে ডাকছে যেনো সেই ডাক কানেই যাচ্ছে না তার।

– কি রে যা দরজাটা খোল।

– খুলতে হবে না। ওমনি চলে যাবে।

– আশ্চর্য তো খুলতে হবে না মানে। এটা কেমন ধরনের কথা হিয়া।

– কি কথা ভাইয়া,আমি যে তোকে বলছি তুই স্যারকে আর বাড়িতে আসতে দিবি না,মানা করে দিবি কেনো তুই তারপরো আমার কথা শুনছিস না একটু বলবি।

– হিয়া আমি অসুস্থ ছিলাম বলে তোকে কিন্তু এতোদিন কিছু বলিনি,কোনো শাসন করিনি কিন্তু এরপর কিন্তু আমি তোকে খুব রাগ করবো হিয়া।

কথাগুলো খুব ঝাঁঝালো আর কাঠকাঠ কন্ঠেই শিশির বললো,ভাইকে এরকম শক্ত হতে দেখে চুপসে গিয়ে মাথা নিচু করে চুপ করে বসে রইলো হিয়া,

-আসছি থেকে ছেলেটার সাথে খারাপ ব্যবহার করছিস তুই। ওর বাড়ির লোকজন আমার সাথে অন্যায় করেছে এতে ওর দোষ কোথায়। ভূলে যাস না উজান কিন্তু তোর শরীয়ত মোতাবেক স্বামী হয় এখন____তোর সব কিছু সহ্য করে যাচ্ছি,সব কথা শুনে চলছি মানে এ-ই না তোর অন্যায় গুলোকেও আমি প্রশ্রয় দেবো। সব কিছুর একটা সীমা থাকে। ছেলেটা তোর এতো অপমান সহ্য করার পরো প্রতিনিয়ত আমার খোঁজ নিচ্ছে, তোকে দেখে যাচ্ছে আর কি চাই তোর।

ভাইয়ের বকুনিতে টপটপ পানি পড়তে শুরু করলো হিয়ার দুচোখ বেয়ে। রাগে অভিমানে কাঁদতে কাঁদতে নিজের রুমে গিয়ে দরজা লাগিয়ে দিলো হিয়া। অভীমানের সুর টেনে বললো” তোর বন্ধু তুই দরজা খোল,আমার কি তাতে”

!
!

গায়ের শার্ট টা ঠিক করে নিয়ে সোফার রুম পেড়িয়ে বারান্দার গ্রীলের কাছে আসতেই চমকে উঠলো শিশির। আরে উজানের সাথে আজ কাকে দেখছি এটা! পারভেজ নাকি? বিষ্ময়ে হাসতে হাসতে দরজার তালা খুলে দিয়ে পারভেজকে বুকে জড়িয়ে ধরলো শিশির। উৎসাহের সুর তুলে বললো,

– কোথায় থেকে এই বিদেশীরে তুলে আনলি উজান?

উজান শিশিরের হাত থেকে তালা আর চাবিটা নিয়ে দরজা লাগাগে লাগাতে বললো,

– কোথায় থেকে আর আনবো ঔ রাস্তায় কুড়ায় পাইলাম। বিদেশে মনে হয় আর ঠাই মিলে নাই এজন্য বৎস আমাদের দেশে চলে আসছে।

হেঁসে দিলো শিশির। দু’জনকে নিয়ে রুমে এসে শুরু করলো এইসেই আড্ডা। পারভেজ ছিলো শিশিরদের ছোটবেলার সহপাঠী। বেশ ভালোই বন্ধুত্ব ছিলো তিনজনের। পড়াশুনার খাতিরে এসএস শেষ করতেই পাড়ি জমায় বিদেশে। তারপর এ-ই কিছুদিন যাবৎ ফাইনাল কোর্সটা শেষ করেই দেশে ফেরা তার।

– তো বন্ধু বল কি খাবি চা না কফি?

– কিসের চা কফি শিশির। আজকে পারভেজ আমাদের বাহিরে ট্রিট দেবে বলেছে। এখন ওসব চা কফি চলবে না।

– আরে সে ট্রিট না-হয় পড়ে নিবো তার আগে নাহয় এক কাপ গরম চা’ই খেলাম। দ্বারা হিয়াকে বলে আনছি।

শিশির হিয়াকে ডাকতেই রুম ছেড়ে শিশিরের রুমে পা রাখলো হিয়া। কি দরকার ভাইয়ের এরকম করে ডাকছে কেন ভাই। রুমে পা রাখতেই হিয়ার চোখে চোখ মিললো পারভেজের। হিয়ার একটু প্রথমে চিন্তে অসুবিধে হলেও পরমুহুর্তে মুখে একফালি হাসি টেনে শিশিরকে উদ্দেশ্য করে হিয়া বললো” পারভেজ ভাইয়া না উনি?” পারভেজ হেঁসে দিয়ে বললো” এটা আমাদের হিয়া পিচ্চি না! আরে কতো বড় হয়ে গেছে,তা এখনো মনে আছে এ-ই পারভেজের কথা দেখছি ” হিয়া হেঁসে দিয়ে বললো “না মনে থাকার কি আছে শুনি,স্মরণশক্তি এতোই দূর্বল নাকি আমার হু” হেসে দিলো শিশির আর পারভেজ। উজান শুধু মুচকি হাসলো। কিছু বললো না।

এদিকে শিশির বাহিরে যাবার জন্য একটা শার্ট আর প্যান্ট বের করে ওয়াশরুম যেতে যেতে বললো” দাঁড়িয়ে না থেকে,পারভেজের জন্য এক কাপ চা তো করে আনতে পারিস বুড়ি” হিয়া হুঁশে ফিরে বললো আনছি চা করে আমি,তুই যা”
শিশির ওয়াশরুমে ঢুকে ফ্রেশ হ’য়ে নিতেই হিয়া চা বসিয়ে দিলো। হঠাৎ পারভেজ হিয়াকে ডেকে নিয়ে ভালোমন্দ কি পড়াশোনা করছো জিজ্ঞেস করতে গিয়েই বললো” ছোটবেলায় তোর মনে আছে হিয়া,আমাকে বিয়ে করতে চাইতি,বলতি বড় হলে না-কি এ-ই মোটা পারভেজকে বিয়ে করে বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে আসবি তুই ” পারভেজের কথার স্রোতে সেই শৈশবে ফিরে গেলো হিয়া,সেসময়কার সেই কথা গুলো মনে পড়তেই হেঁসে দিয়ে বললো” হ্যা না আবার মনে থাকে,ইশশ ভাবলেই কিরকম লজ্জা পায় বলো তো এখন,তবে তুমি কিন্তু এখন আর আগের মতো গুলুমুলু নেই একদম শুকিয়ে গেছো” পারভেজ হেঁসে দিয়ে বললো” শুধু শুকিয়েছি,হ্যান্ডসাম হয়নি একটুও” হিয়া মৃদু হেঁসে বললো” হুম হয়েছো কিছুটা,তবে তোমার গালের এই টোলটা কিন্তু এখনো সুন্দর লাগছে দেখছি” পারভেজ হেঁসে দিয়ে বললো” তাহলে এ-ই টোল লাগা পারভেজকেই বিয়ে করে নে নাহয়,বাড়ি থেকে পাএী খুঁজছে, তুই হ্যা বললে কিন্তু ” হেঁসে ফেললো হিয়া,পারভেজের কথাটা হিয়া ইআরকি হিসাবে গ্রহন করলেও উজানের কিন্তু বুঝতে বাকি রইলো না পারভেজের এ-ই মজার ছলে বলা কথাটার অন্তর্নিহিত মানে টা আসলে কি! তারউপর হিয়ার অজান্তেই হিয়াকে পা থেকে মাথা অবধি পরক্ষ করতে থাকা পারভেজের চাহনিটাও লুকানো গেলো না উজানের থেকে। উজান ঠিক বুঝতে পারলো হিয়াকে নিয়ে এ-ই মুহুর্তে পারভেজের মনে ঠিক কি চলছে!

একদিকে পারভেজের হিয়ার প্রতি অতিরিক্ত খবরদারী তো অন্যদিকে উজানকে দেখেও আজো না দেখার ভান। কোনোটাই আর মেনে নিতে পারলো উজান। কি চাচ্ছে হিয়া। এতোদিন শিশির অসুস্থ বলে একটা কিচ্ছু বলেনি সে কিন্তু এখন সব সহ্যের সীমা পেড়িয়ে আসছে যেনো তার। বিয়ে টা কি হিয়ার কাছে ছেলে খেলা মনে হচ্ছে না-কি। মানছি হিয়ার রাগ করাটা স্বাভাবিক তাই বলে এভাবে দূরে থাকাটাও নিশ্চয়ই সবকিছুর সমাধান না। রাগে উঠে আসলো উজান। পারভেজকে বললো তুই শিশিরের সাথে কথা বল আমি আসছি একটু। বাহিরের যাবার কথা বলে হিয়ার রুমে এসে চেপে দেওয়া দরজাটা একটানে খুলে ভেতরে এসে আবার ধাম করে দরজাটা লাগিয়ে দিলো উজান। হিয়া তখন রুমে তার জামা টা চেঞ্জ করে অন্য একটা জামা পড়ছিলো। হঠাৎই উজানকে আসতে দেখে ভয় পেয়ে উঠলো মেয়েটা। তড়িঘড়ি করে ওড়নাটা গায়ে দিয়েই ভয়ের শ্বাস টানতে গিয়েই খেয়াল করলো অন্য কেউ না বরং উজান তার রুমে এসে এভাবে দরজা লাগাচ্ছে । একটা স্বস্তির শ্বাস টেনে অর্ধেক পড়া জামাটা পুরো পড়ে নিয়ে যেই গায়ে ওড়নাটা জড়াতে যাবে ওমনি উজান এসে তার শরীরের সর্বশক্তি দিয়ে চেপে ধরলো হিয়াকে। চোখে তো আগুনের লাভার চাইতেও রাগের আগুন জ্বলজ্বল করছে তার। সাথে হিয়ার বাহু জোড়া এমন করে চেপে ধরে আছে যেনো এ-ই বুঝি সেখানের হাড্ডিগুলো ভেঙে গুড়ো হ’য়ে ঝুরঝুর করে পড়তে শুরু করে দিয়েছে হিয়ার।

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here