?#চোখের_তারায়_তুই?
#পর্ব_৩৪
#ইভা_রহমান
বগুড়ার মেইন শহরের মাঝামাঝি পয়েন্টে দাঁড়িয়ে আছে দুইতলা বিশিষ্ট একটা খুবই চমৎকার বাড়ি। ডিজাইনটা পুরানো হলেও বাড়িটা মজবুত। সাথে বাড়ির উঠোন জুড়ে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন এক বৃহৎ বাগান। দোতালের ব্যালকুনি থেকে দাঁড়িয়ে যেনো সেই বাগানবিলাসে কাটিয়ে দেওয়া যায় পুরোটা প্রহর। সেই বাড়ির মেইন ফটকে এই মুহুর্তে দাঁড়িয়ে আছে শিশির। একটু ইতস্তত হচ্ছে তার। কি বলে ঢুকবে সে ভেতরে,আর কেই বা দরজা খুলবে! যে উদ্দেশ্য হিয়াকে মিথ্যা বলে বগুড়াতে আসা তার,তার সেই উদ্দেশ্য কি সফল হবে আজ। খুঁজে কি পাবে সে তার রোদেলার গন্তব্য! নিজের জড়তা টুকু কাটিয়ে ভেতরে আসলো শিশির। দরজায় কড়া নাড়তে বেড়িয়ে আসলো এক পৌঢ় সুদর্শন দেখতে ভদ্রমহিলা। শিশির সালাম নিবেদন করলে ভদ্র মহিলাটিও যথেষ্ট বিনয়ের সাথেই সালামের উওর দিয়ে কথা বলতে শুরু করলেন।
– জ্বী কাকে চাই? তোমার পরিচয়?
– আ-আমি শিশির। শিশির আহমেদ। বাসা রংপুরে। বিবিএ ফাইনাল ইয়ার দেবো।
– আচ্ছা। তো এখানে কিসের জন্য? আমি কি সাহায্য করতে পারি তোমাকে?
– এটা আরমান রানার বাড়ি তাই না। আমি আসলে ওনার ওয়াইফ রোদেলা শাহরিয়ার তার ব্যাচমেট। আসলে রোদেলার যখন বিয়ে হয় আমি সেসময় টা দেশে ছিলাম না। এসে জানতে পারি যে ও বিয়ে করে। তো ওর কিছু ইম্পর্ট্যান্ট ডকুমেন্টস আমার কাছে আছে আর আমরা ভার্সিটি থেকে একটা প্রজেক্টে কাজ করেছিলাম একসাথে,তো সেই বিষয়ে কথা বলতে।
– আচ্ছা বেশ বুঝলাম। দেখো..কি যেনো নাম বললে?
– জ্বী শিশির, শিশির আহমেদ।
– দেখো শিশির এটা আরমান রানার বাড়ি ছিলো ঠিকই কিন্তু একমাস আগে ওনারা আমার হাসবেন্ডের কাছে এই বাড়ি বিক্রি করে চিটাগাং এ শিফট করেছে। তাই রোদেলাকে এ-ই মুহুর্তে তো তোমার কথা বলতে পারছি না।
একটা বড়সড় ধাক্কা খেলো যেনো শিশির। শত অন্ধকারের মাঝে যেই একটু আশার কিরণের দেখা মিলেছিলো সেটাও কিনা আজ এভাবে!
– আ-চ্ছা।___ আন্টি চিটাগং এ ওদের কোনো আ্যাড্রেস বা ওরা কোথায় আছে কাইন্ডলি যদি একটু ডিটেইলস বলতেন।
– আমি কি ভাবে ডিটেইলস বলবো সোনা।আমার হাসবেন্ড আমাকে শুধু এতটুকুই জানিয়েছে যে তারা চিটাগং এ আছে। এরবেশি তো আমি বলতে পারছি না।
– আচ্ছা ঠিক আছে, কিন্তু কোনো কনটাক্ট নাম্বার যেটা দিয়ে যোগাযোগ করা যাবে রোদ বা আরমান স্যারের সাথে।
– আমার কাছে তো নেই, আমার হাসবেন্ডের কাছে থাকতে পারে। কিন্তু উনিও একটা কাজে মালদ্বীপে আছেন। এক দু সপ্তাহের মধ্যে চলে আসবে তখন না হয় তাকে বলে যদি আমি তোমাকে কিছু সাহায্য করতে পারি।
– একটু দেখবেন আন্টি। এটা এটা আমার কনটাক্ট নাম্বার। আপনার হাসবেন্ড আসলে আমাকে একবার শুধু জানিয়ে দিয়েন আমি নিজে চলে আসবো। আসলে ডকুমেন্টস গুলো জরুরি তো।
– আচ্ছা ঠিক আছে বাবা বলবো। ভেতরে আসো,বসো নাহয় কিছুক্ষণ। চা করি।
– না আন্টি আজ না। অন্য দিন। আপনি শুধু আপনার হাসবেন্ড আসলে তাকে একবার।
– হুম চিন্তা করো না আমার স্মরণে থাকবে বিষয়টা।
– ঠিক আছে আসছি আন্টি।
শিশির ভদ্রমহিলাটিকে সালাম নিবেদন করে বেড়িয়ে আসতে ধরেও থেমে যায়,কি একটা মনে করে পিছন ফিরে আহত কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,
– আচ্ছা আন্টি কিছু যদি মনে না করেন, একটা কথা জিজ্ঞেস করি?
– হ্যা বলো?
– আপনি তো নিশ্চয়ই রোদের সাথে বা ওর হাসবেন্ড সহ ওকে দেখেছেন? রোদেলা কি ওর হাসবেন্ডের সাথে ভালো আছে? না মানে ওদের যেই সম্পর্ক সেটা কি মানে ঠিকঠাক আছে?
– হ্যা। নরমাল হাসবেন্ড ওয়াইফ যে রকম হয় তাদেরকেও তো সেরকমই হাসিখুশি দেখলাম। ইনফেক্ট ওরা তো এবছরের মধ্যে বেবিও নেওয়ার প্ল্যান করেছে বলেছিলো। তাহলে খারাপ কেনো থাকতে যাবে।
এবার যেনো আরো একটা বড় ধাক্কা এসে শিশিরের হৃৎপিণ্ড টাকে টুকরো টুকরো করে ছাড়লো। তাহলে যে হিয়া রোজ বলে তার রোদ আপু নাকি বিয়ে করে স্বামী সংসার নিয়ে সুখে আছে এটা কি ঠিক! গলায় এসে কান্না গুলো দলা পেকে বসলো ছেলেটার। অনেক কষ্টে সেই চিপে রাখা কান্নাটা সংযত রেখে বেড়িয়ে আসলো শিশির। রোদ সুখে আছে এটাই কি যথেষ্ট না তার জন্য! আর কি চাই তার।
শিশির বেড়িয়ে আসতেই ভদ্রমহিলাটি দরজা লাগিয়ে রুমে আসলেন। দরজার আড়ালে লুকিয়ে থাকা কান্নারত মেয়েটিকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
– জীবনটা অতীত বা ভবিষ্যৎ এ না রোদ মা। জীবনটা বর্তমানে। যদি ভবিষ্যতের কথা ভাবতে গিয়ে বর্তমানে আসা ভালোবাসার থেকে এভাবে পালিয়ে বের হও সেটা যেমন তোমার মনকে বিষিয়ে তুলবে তেমনি পিষে ফেলবে সেই ছেলেটার জীবন।
– আমি শিশিরের আশেপাশে থাকা মানেই শিশিরের বিপদ মামনি! ওকে যে বাঁচতে হবে। ওকে যে ভালো থাকতে হবে।
– তাই। তোমার মনে হয় এ-ই ভালো থাকায় ভালোভাবে বাঁচা যাবে! আমি তোমাকে বলে রাখছি রোদ, শিশির আসবে,আবার আসবে সে। তোমার মুখোমুখি না হওয়া অবধি সে থামবে না!
!
!
রিক্সা মামার থেকে খুচরো নেবারো যেনো সময় নেই এখন উজানের। ভাড়া যদিও ২০টাকা হয় তবুও মামার হাতে পঞ্চাশ টাকার নোট টা ধরিয়ে দিয়েই উঠোন পেড়িয়ে বাড়ির দরজায় এসে দাঁড়ালো উজান। আর গ্রীলের দরজা ধাক্কাতে গিয়েই দেখলো গ্রীলে তালা ঝুলে গ্রীল খুলে আছে। বিষ্মিত হলেও গ্রীলে তালা লাগিয়ে ফ্ল্যাটের দরজার এসে দাঁড়াতেই দরজা ধাক্কাতে শুরু করলো উজান। ধাক্কাচ্ছে তো ধাক্কাচ্ছে কিন্তু ভেতর থেকে আর কোনো রেসপন্স আসছে না কারোরই। প্রায় পাঁচ মিনিট যাবৎ দরজা ধাক্কানোর পরো যখন হিয়া দরজা খুললো না চিন্তিত হ’য়ে পড়লো উজান। কি করছে কি মেয়েটা ভেতরে সব খেরিয়াত আছে তো। শেষমেশ বাধ্য হয়ে দরজাটা ভেঙে ফেললো উজান। বাহুতে আঘাত পেলো ভীষণ কিন্তু চিন্তায় ভূলে গেলো সেই অসহ্য ব্যাথা। দূত পায়ে হিয়া হিয়া বলে ডাকতেই হিয়ার রুমে গিয়ে দাঁড়াতেই কেঁপে উঠলো উজান। তার হিয়া এরকম অচেতন হয়ে ফ্লোরে কেনো পড়ে আছে!
হুশ হারিয়ে ফেললো যেনো উজান। মনে হলো কেউ তার হৃৎপিণ্ড টা হাতে নিয়ে চিপে ধরে পিষতে শুরু করলো। হিয়ার দিকে ঝুঁকে আসতেই হিয়াকে নিজের বুকের উপর তুলে নিলো উজান। হিয়ার মুখে গালে হাত থাপড়িয়ে থাপড়িয়ে বলতে থাকলো উঠো হিয়া,কি হয়েছে আমার হিয়ার,হিয়া চোখ খুলো হিয়া” হিয়া চোখ খুললো না। ঘামতে শুরু করলো উজান,কাঁপা হাতে হিয়ার পালস চেক করতে গিয়েই দেখলো হিয়ার কোমড়ের নীচ টা জুড়ে রক্তের বন্যা। আরেক দফা থমকে গিয়ে চুপসে বসলো উজানের সাড়া শরীর। সাথে চুপসে যাওয়া শরীরে দাঁড়িয়ে উঠলো সকল লোমকূপ। কি হচ্ছে এসব। কেনো হচ্ছে?
শুকনো ঢোক গিলতে শুরু করলো উজান। কপালের ঘাম মুছতে গিয়ে খেয়াল করলো মাথার উপরের ফ্যান টাও তো বন্ধ। দরজা জানালা গুলোও বন্ধ থেকে কিরকম ঘরটা বন্ধ হ’য়ে আছে দেখো। হিয়াকে বুক থেকে নামিয়ে ফ্যান টা ছেড়ে দিয়ে আসলো উজান সাথে রুমের দু পাশের দুটো জানালা খুলে দিয়ে পর্দাটা মেলে দিয়ে এক গ্লাস পানি নিয়ে হিয়ার পাশে বসলো। হিয়ার গা থেকে ওড়না সহ খুলে দিলো হিয়ার জামা। হিয়াকে কোলে করে এনে বসিয়ে রাখলো ঠিক ফ্যানের মাঝ বরাবর। হিয়ার ঘর্মাক্ত চোখ মুখ মুছে দিয়ে পানি ছেটালো হিয়ার মুখে। একজন ডক্টর হয়েও উজান বুঝতে পারছিলো না কি করবে এখন সে। হিয়াকে যে অন্য ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবে এই চিন্তাও যেনো বেড়িয়ে যেতে থাকলো মাথা থেকে তার। কি করবে এখন নীরব বা রিমা কে কি একটা ফোন করবে সে!
নীরবকে একটা ফোন করবে করবে ভাবছে সেই মুহুর্তে করুন এক সুর টেনে চোখ মেললো হিয়া। ঝাপসা চাহনি টা পরিষ্কার হতেই মুখের সামনে দেখা মিললো চিরচেনা সেই প্রিয় মুখ! একটু স্বস্তি ফিরে পেলো উজান। হালকা হাসি ঝুলিয়ে বললো” এ-ই তো হিয়া,দেখো আমি এখানে,পিচ্চি টা আমার চোখ খুলো এখন,দেখো আমাকে,হিয়া,এই হিয়া” প্রথমে মুহুর্ত গুলো বুঝতে সমস্যা হলেও পরমুহূর্তে ঠিকই হিয়ার স্মরণে আসলো আজকে সারাদিনের সেই বিভীষিকাময় দিনটার কথা। আলতো সুরে উজানের সাথে হুম হ্যা করলেও সবকিছু মনে পড়তেই উজানের দিকে গিষে এসে উজানের কলার চিপে ধরলো মেয়েটা। রাগান্বিত সাথে অশ্রু মিশ্রিত কন্ঠে জমানো যতো রাগ,অভিমান,অভিযোগ গুলো ঝারতে ঝারতে উজানের বুকে লুটিয়ে গিয়ে অঝোরে এক বিশাল বারিধারা শুরু করলো হিয়া,যেনো সাতটা মহাসমুদ্রের জলরাশিও আজ হিয়ার চোখের পানির কাছে কম পড়ে যাবে এতোটাই কেঁদে ভাসাচ্ছে মেয়েটা। কান্নার এই লাগামহীন সুতোটা টানতে যেনো হিমশিম খাচ্ছে উজান। কেনো কাঁদছে তার পিচ্চি টা এভাবে! সেকি বুঝতে পারছে না তার চোখের এক একটা অশ্রুবিন্দু উজানের জঘম হওয়া হৃৎপিণ্ডে লবন ছিটিয়ে দেবার মতোই কাজ করছে….!!!!
– যখন আমার তোমাকে প্রয়োজন ছিলো তখন তুমি কেনো এলে না উজানন,কেনো ফোন তুললে না আমার,আমি আমি যে কতোবার তোমাকে ডাকলাম কেনো নিচে নামলে না তুমি, কেনো এসে বাঁচালে না আমাদের চিহ্ন টাকে। কেনো উজান? কেনো আসতে এতো দেড়ি করলে তুমি বলো?
অশান্ত-অস্থির-বেশালামহীন হিয়ার মাথাটাকে এক হাতে নিজের বুকের বা পাশে শক্ত করে চিপে ধরে নিলো উজান। আরেকহাতে হিয়ার সমস্ত শরীরে হাত বুলিয়ে বুলিয়ে উজান বললো,
– চুপ না হিয়া। পিচ্চি আমার একটু কান্না থামাও। আমি আমি বুঝতে পারিনি তোমার এতো দরকার ছিলো আমাকে। আমি কাল রাতে নীরবের সাথে মিলে নেশা করেছিলাম তাই বাড়িতে এসে কখন যে ওভাবে। সরি। সরি। আর কখনো এরকম হবে না প্রমিস।
রেগে গিয়ে উজানের বুক থেকে মুখ তুলে হিয়া হেঁচকি তুলতে তুলতে বললো,
– তুমি কেনো নেশা করো। আমি বলেছি না তুমি নেশা করবা না কখনো। কেনো খাও সিগারেট। আমি বলেছি না সিগারেটের গন্ধ আমি নিতে পারিনা। কেনো হ্যা কেনো কেনো আমার বারণ শুনো না তুমি। আজকে দেখলে তো আমার কথা শুনো না বলে কি হ’য়ে গেলো।
হিয়ার পুরো মুখে চুমু আঁকলো উজান,নিজের চোখের পানি টাকে মুছে দিয়ে হিয়ার গাল জোড়া শক্ত করে চিপে ধরে বললো,
– আর ক-ক-খনো নেশা করবো না আমি। একটা সিগারেট অবধি খাবো না৷ তুমি এখন কান্নাটা থামাও। আমি কথা দিচ্ছি তো আমি আর এমন কিচ্ছু করবো না যেটা তুমি চাও না বিশ্বাস করো।
উজানের হাত দুটো মুঠো করে ধরে নিয়ে হিয়া বললো,
– তোমাকেই তো বিশ্বাস করি আমি। তোমাকেই তো ভরসা করি। আমি তো জানি আমি যতো রাগ করি, যতোই অপমান করে তোমাকে তাড়িয়ে দেই তুমি তুমি ঠিক আমাকে আদর করবে ভালোবাসবে,
– হুম সোনা করবো তো। করি না বলো।
– তাহলে আজকে তুমি আসলে না কেনো। সিয়াম ভাইয়া যখন আমাকে ওভাবে ধরে মারলো,আমি কতো ডাকলাম তোমাকে তুমি কেনো আসলা না?
হিয়ার কথায় একটু চমকে উঠলো উজান। সি-য়াম হি-য়াকে মারলো মানে! হাতের বাধন আলগা হয়ে গেলো উজানের। বিষ্ময়ে তাকিয়ে থেকে অবাক চাহনিতে প্রশ্ন করলো হিয়াকে সে,সিয়াম তার সাথে কি? হিয়া বলতে পারলো না শুধু কেঁদে গেলো,শুধু কান্না করে করে নিজের সব আক্ষেপ অভিযোগ সব জাহির করলো,
– আমি আমি খুব ভয় পাইছিলাম জানো,কেউ ছিলো না ঔসময়,সন্ধ্যা নামছিলো। ভাইয়া আমার ওড়নাটা দিয়ে আমার মুখ বেঁধে রাখছিলো,আমি কি ভয় পাইছি তখন জানো তুমি।
– তারপর?
– একটা চাকু ছিলো রুমে ওটা দিয়ে ভাইয়াকে মেরে দিছি। রক্ত বের হচ্ছিলো। তারপর আমি দৌড়ে পালিয়ে আসছি ওখান থেকে।
– সিয়াম কোনো ক্ষতি করেনি তো তোমার?
উজানের প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে আবারো কান্না করে ভাসিয়ে তুললো হিয়া।
– করছে তো খুব মারছে,গাল চিপে ধরছে এরকম করে,চুল টেনে ছিঁড়ছে,আমার পেটে, পেটে লাথি মারছে জোড়ে,বুকে হা হাত দিছে তারপর আমি চাকু দিয়ে..
আর সহ্য করতে পারলো না উজান। হিয়াকে বুকের ভেতর জাপ্টে ধরে নিজের শরীরের ভেতর মুহুর্তে জন্ম হওয়া পাহাড় সমান রাগটাকে শান্ত করতে চাইলো যেনো। একটা দীর্ঘ চুমু খেলো হিয়ার মাথায়। হিয়ার শরীর বুলিয়ে দিয়ে বললো,
– আই এ্যাম সরি,এ্যাই এ্যাম সরি হিয়া। আর কখনো তোমার থেকে আলাদা সরে থাকাবো না আমি। এ-ই ভূল কখনো হবে না আর প্রমিস।
– শুধু যদি আজকে ফোনটা ধরতে একবার তাহলে অনন্ত আমাদের..
হিয়া কিছু বলার আগে উজান হিয়ার মুখ টা তুলে নিয়ে বিষ্ময়ে বললো,
– ফোন ধরতে মানে! কখন ফোন দিয়েছিলে আমাকে? হ্যা আমার ফোন সাইলেন্ট ছিলো কিন্তু তুমি তো কোনো ফোন দেওনি আমাকে হিয়া!
কপট রেগে গিয়ে হিয়া উজানের গাল জড়িয়ে বললো,
– তাহলে আমি মিথ্যে বলছি,চেক করো তোমার ফোন দেখো আমি কলসের পর কলস,টেক্সট করেছি কি না,অনলাইনেও তো কতো চেষ্টা করছি তুমি সাড়া দেওনি।
একটু থমকে বসলো উজান। তাহলে কি কেউ?
– তোমার ফোন টা কোথায় হিয়া?
– ওটাতো জানি না কোথায়,তোমাদের বাড়িতেই মনে হয় আমি ওটাকে ফেলে দিয়ে আসছি যখন সিয়াম ভাইয়া আমাকে ঔ রুমে।
চুপ হয়ে কিছুক্ষণ সব বিষয়টা বুঝতে চেষ্টা করলো উজান। তাহলে কি ফোনটা প্রিয়ন্তির কাছে। আর তার ফোন থেকেই বা কে সব কলস ডিটেইলস ডিলিট করলো, তার মা না প্রিয়ন্তী!
– আচ্ছা ওসব ছাড়ো,এখন আমরা ডক্টরের কাছে যাবো এ এই রক্ত কিসের এতো,পিরিয়ড হয়েছে তোমার। নাকি অন্য কিছু যে এভাবে।
এ-ই রক্তগুলো কিসের আবারো সেই কথা মনে পড়তে কেঁদে ভাসালো হিয়া। উজান কান্নারত হিয়ার চোখ মুখ মুছে দিয়ে বললো,
– চুপ না হিয়াআআ। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে তোমাকে এরকম করে কাঁদতে দেখে। আমি কিন্তু রাগ হচ্ছি এবার। একটু থামো___বলো না বলো এগুলো কীসের রক্ত,কিছু হয়েছে?
– বলবো না আমি এগুলো কীসের রক্ত,কিচ্ছু বলবো না। সব তোমার জন্য সব,তুমি আসোনি কেনো তখন,এমনি সময় সারাক্ষণ বাড়িতে পড়ে থাকো,আমার খোঁজ নেও,আজকে কেনো আসলে না হ্যা কেনো আসলে না আমার খোঁজ নিতে?
– রাগ হচ্ছে খুব না। আচ্ছা আগে ডাক্তারের কাছে যাই আমরা তারপর তুমি রাগ করো আমার সাথে,যত্তো খুশি রাগ করো কেমন।
– আমি ডাক্তারের কাছে যাবো না। তুমি আমাকে খাবার এনে দেও কিছু,আমার খিদা পাইছে খুব। পেটে ব্যাথা হয়। খাবো আমি।
– আচ্ছা আচ্ছা কি খাবে বলো,যা খাবে আমি তাই আনবো। বলো কি চাই ?
কপট রেগে গিয়ে হিয়া বললো “ভাত খাবো দুপুরে খাইনি আমি” উজান হিয়াকে বললো”বেশ আগে একটু গোসল টা করিয়ে দেই তোমাকে আমি তারপর আনছি তোমার জন্য ভাত” হিয়া কিছু বললো না। মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিয়ে বললো চলো গোসল করিয়ে দেও। উজান হিয়াকে কোলে নিয়ে ওয়াশরুমে এসে হিয়াকে সুন্দর মতো গোসল করিয়ে দিলো,As a doctor হিয়া যে এখনো একটা ট্রমার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে তা বেশ বুঝতে পারছে উজান। তাই হিয়াকে আর বেশি কিছু জিজ্ঞেস করে ঘাটতে চাইলো না বিষয়গুলো। হিয়াকে গোসল করিয়ে দিয়ে রুমে নিয়ে আসলো উজান। আলমারি থেকে হিয়ার প্রিয় জামাটা নিয়ে পড়িয়ে দিতে চাইলেও হিয়া রেগে গিয়ে বললো” এ-ই জামা হয়না এখন আমার, অন্য জামা নিয়ে আসো” মৃদু হেঁসে উজান বললো” মোটা হইছো যে,আগের সেই পিচ্চি হিয়া আছো নাকি আমার,ভাইয়ের হোটেলে খাও আর মোটা হও” রেগে গিয়ে মুখ ফুলিয়ে রইলো হিয়া। উজান একটা অন্য জামা নিয়ে হিয়াকে পড়িয়ে দিয়ে কি ভাত তরকারি আছে সব সাজিয়ে নিয়ে এসে হিয়াকে খাইয়ে দিতে শুরু করলো। কখনো হিয়া খাচ্ছে কখনো কাঁদছে কখনো বা সেই জানালার ধারে গিয়ে একা একা কিসব বলছে। উজান হিয়ার মনের অবস্থা বুঝে চুপ হয়ে সব শুনে যাচ্ছিলো,দেখে যাচ্ছিলো। ভাত খাওয়া শেষে হিয়া নিজেই উজানকে জড়িয়ে বললো” আমাকে ঘুম পাড়িয়ে দেও না উজান,আমি একটু ঘুমাতে চাই ” তপ্ত একটা শ্বাস টেনে হিয়াকে খুব যত্নে আগলে ধরে ঘুম পাড়িয়ে দিলো উজান। সাথে শোনালো এক ঘুম পাড়ানি গান। ঘুমের অতলে হারিয়ে যেতেই উজান হিয়াকে পর্যবেক্ষন করতে কেমন একটা বিষয়ে অনুভব হলো ঠিকই কিন্তু সেই সাথে সিয়ামের সেই অত্যাচারের কথা স্মরণ হতেই উঠে দাঁড়ালো উজান। ঘড়িতে তখন এগারোটার কাছাকাছি উপায়ন্ত না পেয়ে রিমাকে ফোন করে বললো আর্জেন্ট একটু বাড়িতে এসে হিয়ার সাথে থাকতে। উজানের ফোন পেয়ে কিছুসময় বাদে রিমা আসলো হিয়াদের বাড়িতে। উজান তার ঘুমন্ত পরীর পাশে রিমাকে বসিয়ে রেখে ছুটে আসলো বাড়িতে। বললো রিমা তুমি থাকো কিছুক্ষণ হিয়ার পাশে আমি আসছি একটু!
!
!
এক পায়ের উপর আরেক পা তুলে তার বিছানার উপর বসে আছে উজান। তারই সামনে রাখা সোফাটার উপর বসে আছে প্রিয়ন্তী। উজান তাকে ডেকে পাঠিয়েছে। ওয়াও। এটার মতো আনন্দের আর কি আছে এ-ই মুমেন্টে। হাসিহাসি মুখে কিছু বলতে যাবে ওমনি ফ্লোর থেকে চোখ উঠিয়ে স্বাভাবিক কন্ঠেই উজান জিজ্ঞেস করলো।
– হিয়ার ফোন কোথায় প্রিয়ম্তী?
অবাক এক দৃষ্টি ছুঁড়ে উজানের দিকে তাকিয়ে থমকে উঠলো প্রিয়ন্তী। নড়াচড়া থেমে গেলো তার। এমন এক ভাব ধরলো মনে হলো যেনো উজানের কথায় আকাশ থেকে পড়লো সে।
– Excuses me!
– হি-য়া-র ফো-ন কোথায়?
– কোন হিয়ার কথা বলছো বলো তো,তোমার ঔ বিয়ে করা__তার ফোন কোথায় আমি কি করে জানবো আশ্চর্য।
– সত্যি জানো না।
– না জানি না।
– আর একবার জিজ্ঞেস করবো? সত্যি জানো না?
– না জানি না।
প্রিয়ন্তীর বলাও শেষ নেই তার আগেই তার উপর ঝাপিয়ে পড়লো উজান। পাশে থাকা কাঁচের ফ্লোয়ার ভাছ টা এক লহমায় ভেঙে দিয়ে সেই ভাঙ্গা অংশ প্রিয়ন্তীর মুখের দিকে তুলে ধরলো সে। একহাতে প্রিয়ন্তীর গাল চিপে আরেক হাতে কাঁচের টুকরো টা মুখের সামনে চেয়ে ধরে বললো,
– জীবনে সব সহ্য করতে পারি আমি কিন্তু হিয়ার চোখের পানি সহ্য হয় না আমার। সেই হিয়াকেই আজ কাঁদিয়েছিস তো তোরা। আমাকে তোদের মতো হতে বাধ্য করিস না প্রিয়ন্তী! ফোন কোথায়?
– ব বল ছি। এ-ই যে ব্যাগে আছে ফোন।
– গুড! কোথায় পাইছিস ফোনটা?
– নি নিচে দারোয়ান মামা দিয়েছিলো।
– আমার ফোনে হাত দিয়েছিলি কোন সাহসে?
– ব ব বড় আম্মুকে দেখলাম রোদের সাথে কথা বলছে তোমার ফোন দিয়ে_তা তা তারপর আমাকে বল-লো তোমার রুমে রেখে আসতে। আমি দেখলাম তোমার ফোনে লক পাসওয়ার্ড নেই সেই সুযোগে আমি
– সেই সুযোগে হিয়ার সব কলস ডিটেইলস ডিলিট করেছিস তো।
– হ হ্যা।
বাঁকা হাসলো উজান। এক লহমায় প্রিয়ন্তীকে ছুঁড়ে ফেললো সোজা ফ্লোরে! প্রিয়ন্তীকে আর কিছু বলতেও যেনো বিবেকে বাঁধলো তার। কি হবে এ-ই নরপশুদের এসব বলে। রুম থেকে বেড়িয়ে সোজা দারোয়ান মামার রুমে আসলো উজান। উজানকে দেখামাত্র দারোয়ান মামা দূত এসে অস্থির কন্ঠে বলে উঠলো,
– আমি আর তোমাদের বাড়িতে কাজ করবো না উজান। দেখো রুমের অবস্থা দেখো। দেখছো কিরকম হ’য়ে আছে বিছানাটা আমার। সাথে এ-ই রক্ত। মনে হচ্ছে এখানে কোনো।
– তুমি বিকেলে কোথায় গিয়েছিলে মামা? যে এসে এইসব।
– আমাকে সিয়াম বাবা কিছু টাকা দিয়ে খরচ আনতে পাঠিয়েছিলো বললো জরুরি দরকার। পরে আমি এসে দেখি আমার রুমে এইসব। পরে আবার শুনলাম সিয়াম স্যারকে নাকি কেউ চাকু দিয়ে। ভালো আছে তো বাচ্চাটা এখন?
তপ্ত এক শ্বাস টানলো উজান। বাঁকা এক হাসি দিয়ে বেড়িয়ে আসতেই রমজান মামা প্রশ্ন করলো,
– তুমি এই রাতে এখন কোথায় যাচ্ছো আবার উজান?
মামার প্রশ্নে চোখটা বন্ধ করে একটা দীর্ঘ শ্বাস
টানলো। পরমুহূর্তেই চোখটা খুলে উজান বললো,
– পাপীকে তার প্রাপ্য শাস্তি টুকু দিতে যাচ্ছি রমজান মামা! দোয়া করিও যেনো কাজটা সঠিকভাবে করতে পারি।
!
!
আজ দুদিন পরঃ
সকাল থেকে বাড়ির পেছনের জায়গাটুকু পরিস্কার করে বাচ্চার দাফনের জায়গাটাতে একটা বাঁশের তৈরি বেষ্টন বানাতে ব্যস্ত আমাদের হিয়া। সাথে সেই মধ্যখানে লাগিয়েছে একটা কামিনিফুলের চাড়া। কাদাঁমাটি কঞ্চি হাতে নাস্তানাবুদ অবস্থা যেনো এখন বেচারির। সাথে এই এলোমেলো মাথার চুল,ইশশ জ্বালিয়ে শেষ করলো একবারে। ঠিক সেই মুহুর্তে পেছনে এসে দমকা হওয়ার মতো দাঁড়িয়ে গেলো উজান। খুকখুক একটা কাশি দিতেই চমকে উঠলো হিয়া। বুকে থু থু দিয়ে পেছন ঘুরে তাকাতে গিয়েই দেখলো তার ঠিক পেছনে দাঁড়িয়ে বিরাট এক হাসি ঝুলিয়ে ফ্যালফ্যাল করে তার দিকে তাকিয়ে আছে তার পাগল সেই প্রেমিকপুরুষ। রাগ উঠলো হিয়ার। একটা ভেংচি কেটে,মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে নিজের কাজে মন দিলো আবার হিয়া। দাঁড়িয়ে আছে দাঁড়িয়ে থাকুক আমার কি!
– এ-ই পেছনে কি করছো তুমি,বাগান বানাচ্ছো?
চোখ বড়সড় করে তাকিয়ে রাগি সুরে হিয়া বললো,
– আপনার কি তাতে?
মৃদু হেঁসে হিয়ার পাশে বসে পড়লো উজান। চাকুটা তুলে মাটিতে দাগ কাটতে কাটতে বললো,
– আমার কিছু না। না মানে মানুষ তো বাড়ির সামনে গার্ডেন বানায় তুুমি হঠাৎ এই বাড়ির পেছনে। বিষয়টা একটু আজব ধরনের তাই না।
– হ্যা খুবই আজব ধরনের,তো?____ আর আপনাকে বলেছি না আপনি এ বাড়িতে আসবেন না। কেনো আসেন তারপরো।
– বললেই হলো,আমি আমার ফ্রেন্ডের বাসায় আসি,তোমার কথা মতো সব হবে নাকি,আশ্চর্য।
– ঠিক আছে আসবেন কিন্তু আমার সাথে একটাও কথা বলবেন না। আমি হেট করি আপনাকে এখন। খুব হেট করি বুঝলেন।
– কতো হেট করো?
– অনেক অনেক অনেক হেট করি। যান তো আপনি এখন কাজ করতে দিন আমাকে।
যাবে কি আরো ভালো করে বসলো উজান। চাকু দিয়ে মাটিতে খুটখুট করতে করতেই হঠাৎই কামিনী ফুলগুলোর দিকে চোখ পড়তেই হাত বাড়িয়ে কামিনী ফুলের চারা টা ধরতে যাবে ওমনি ক্ষেপে উঠে বাধা দিলো হিয়া।
– খবরদার ঔ মাটিতে হাত দিবেন না আপনি। ওটায় হাত দেওয়ার কোনো অধিকার নেই আপনার! হাত সাড়ান সাড়ান বলছি,
– হোয়াট! আর ইউ ক্রেজি হিয়া। এ-ই মাটিতে এমন কি আছে যেটাতে হাত দেবার অধিকার নেই কারো।
– আপনি বুঝবেন না কি আছে! আপনি বুঝলে তো..
আর কিছু বললো না হিয়া। তাচ্ছিল্যের এক হাসি টেনে আবার কাজে মন দিলো মেয়েটা। হিয়াকে লক্ষ্য করতে গিয়ে হালকা হেঁসে হিয়ার মাথার চুল গুলো মুঠো করে ধরলো উজান। সেটাতে সুন্দর মতো বেনি গাঁথতে গাঁথতে বাকা সুর টেনে বললো,
– একটা কঞ্চি দিয়ে বেষ্টন বাঁধবে সেটাই পাচ্ছে না আর বড়বড় কথা। দেখি রাবারটা দেও আমাকে।
হিয়া চোখ পাকিয়ে উজানের হাতে রাবার দিয়ে আবার কাজে মন দিলো। নিজে থেকে যখন করছে বেনী করুক না,খুব বিরক্ত করছে যে এই বিশ্বাসঘাতক চুল গুলো আজ। হঠাৎই বাঁশের চিকন আশ এসে হাতে বিঁধতেই চিলিক দিয়ে রক্ত বের হয়ে আসলো হিয়ার আঙ্গুল থেকে। আ বলে হাতটা ঝারা দিয়ে উঠলো মেয়েটা। চটজলদি হিয়ার হাত টা বুকে নিয়ে রাগ করতে শুরু করলো উজান। গজগজ করতে করতে বললো” বেশি পাকামো করলে যা হয়” কপাল কুঁচকে উজানকে বকতেই হিয়াকে পাশ কাটিয়ে বেষ্টন টা ঠিক মতো করে বেঁধে দিলো উজান। এক টানে হিয়াকে উঠিয়ে হিয়ার গায়ের সব ময়লা ঝারতে ঝারতে বললো” যতোদিন যাচ্ছে বড় তো হচ্ছোই না,বরং রিদিতার চাইতেও ছোট বাচ্চাদের মতো হয়ে যাচ্ছো,যতোসব উদ্ভব কাজ,বাড়ির পেছনে কাউকে বাগান করতে কখনো শুনেছো তুমি” হিয়া রেগে কিছু বলতে যাবে ওমনি শিশির এসে দাঁড়িয়ে বিষ্ময়ের সুর তুলে বলে,
– এ-স-ব কি হচ্ছে এখানে! তোরা এখানে কি করছিস উজান। পেছনের দিকে কি কাজ তোদের?
– আমাকে জিজ্ঞেস না করে নিজের বোনকে জিজ্ঞেস কর সে এখানে কেনো..
রেগে গিয়ে হিয়া বললো,
– এটা আমার বাড়ি আমি যেখানে খুশি যা ইচ্ছে করবো তোদের কি এতে? আর তোকে যে বললাম গার্লসের সামন থেকে আমাকে কয়েকটা গোলাপের চাড়া এনে দিতে আজ, আনিসনি তুই?
– এই রে,একটুও খেয়াল ছিলো না বুড়ি। কালকে এনে দেবো প্রমিস!
– হ্যা আমার জিনিস মনে থাকবে কেনো,থাকবে তো বন্ধুর জিনিস মনে না।
অভিমানে মুখ ফুলিয়ে নিচ থেকে চাকু বটি সহ কাজের যাবতীয় জিনিস গুলো তুলে নিতে শুরু করলো হিয়া। এদিকে শিশির উজানকে উদ্দেশ্য করে বললো,
– আচ্ছা উজান,কি শুনলাম এটা সিয়াম নাকি আর কখনো চলাফেরা করতে পারবে না,তাকে নাকি কে একটা চাকু দিয়ে?
বিষ্ময়ে বুকটা শূন্য হয়ে আসলো যেনো হিয়ার। কি বললো ভাই এটা একটু আগে। সিয়াম ভাইয়া চলাফেরা করতে পারবে না বলতে!
– হুম কেনো কি সমস্যা তোর এতে।
– আমার সমস্যা আবার কি। হঠাৎ করে কি এমন হলো যে ওর হাত পা সব প্যারালাইজড হয়ে ও এভাবে!
– আমি কি জানবো বল,সারাদিন আর থাকি বা কোথায় বাড়িতে এখন। আমিও ঔ একই কথা শুনলাম চাচির কাছে।
– স্ট্র্যাঞ্জ! আচ্ছা যাই হোক। ভেতরে আয় এসে কথা বলি। এদিকে পোকামাকড় থাকতে পারে। বুড়ি,উঠ উঠ আয় জলদি,ভাত দে ক্ষিদা লাগছে খুব!
শিশির চলে আসতেই উজানের দিকে তেড়ে আসলো হিয়া। উজানের কলার চিপে ধরে বললো,
– সত্যি করে বলুন সিয়াম ভাইয়ার এই অবস্থা কে করেছে?
– আমি কি করে জানবো আশ্চর্য। ও ইনজুরড ছিলো ওভাবেই ট্রিটমেন্ট করতে গিয়ে!
মিথ্যা শুনে যেনো আরো রেগে উঠলো হিয়া। রাগান্বিত সুরে বললো,
– তাই! আপনি ভাইয়াকে এভাবে পঙ্গু করে…কি করে পারলেন আপনি। আপনি না একজন ডক্টর। আপনি না মানুষকে সারিয়ে তোলার প্রতিজ্ঞা করেছেন তাহলে কি করে এভাবে,হাত কাঁপেনি না আপনার!
ঘাড় টা দুবার বাকিয়ে ফুটে নিয়ে উজান বললো,
– আমি শুধু পাপিকে তার প্রাপ্য শাস্তি টুকু দিয়েছি হিয়া। যাতে সে তার এ-ই নোংরা হাত দিয়ে আর কারো জীবন না নষ্ট করতে পারে।
আরো জোড়ে কলার চিপে ধরে অগ্নি দৃষ্টি ছুঁড়ে হিয়া বললো,
– এই কাজটা করতে গিয়ে একবারো হাশরের ময়দানের কথা মনে আসেনি আপনার। পাপিকে শাস্তি দেবার আপনি কে? হাশরের দিনে কি করবেন সেদিন? যেদিন আল্লাহ আপনাকে জিজ্ঞেস করবে এই পাপের কথা কি উওর দিবেন তখন তাকে। কি বলবেন যে আপনি তার এক বান্দাকে এভাবে পঙ্গু বানিয়ে দিয়ে তার সাথে..
হিয়ার মুখে আসা ছাঁটা চুল গুলো কানের পাশে গুঁজে দিতে দিতে উজান বললো,
– প্রশ্ন তো আল্লাহ আমাকে এটাও করতে পারে হিয়া,যে তুমি তোমার স্ত্রীর প্রতি হওয়া অন্যায়ের সুযোগ থাকা স্বত্বেও আসামিকে শাস্তি কেনো দেওনি!
– আ- আপনি কি ভেবেছেন এসব এসব করে আপনি আমার সিম্প্যাথি পাবেন। আমি সব ভূলে আপনাকে ক্ষমা করে দেবো। না মিস্টার শাহরিয়ার আপনি ভূল ভাবছেন। আমি এখন শুধু হেট করি আপনাকে। অনেক অনেক হেট করি।
– হুম আমিও হেট করি তোমাকে খুশি।
– আমি আপনার থেকে বেশি ঘেন্না করি আপনাকে?
– হুম আমিও করি তোমাকে।
– আপনাকে না সত্যি কিছু বলার নেই আমার। যা ইচ্ছে করুন কিন্তু ভুলেও আর আমার পিছু নিবেন না। বলে রাখলাম।
রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে সেখান থেকে বেড়িয়ে রুমে আসলো হিয়া। এদিকে মুখে এক বিরাট হাসি ঝুলিয়ে হিয়ার পিছু পিছু রুমে আসলো উজান। শুরু করলো টম এ্যান্ড জেরীর মতো জেরী সেজে হিয়াকে জ্বালানো। শেষে বাধ্য হয়ে রুমের দরজা ধাম করে লাগিয়ে দিলো হিয়া। মুচকি হাসলো উজান। এদিকে উজান হিয়ার এ-ই কাহিনি দেখে মাথা নাড়িয়ে নিজের রুমে গিয়ে শুইয়ে পড়লো শিশির। না এদের দুইজনকে দিয়ে আর কিছু করা মানে অসম্ভব ব্যাপার!
!
ঘড়িতে তখন ভোর পাঁচটে পাড় হচ্ছে। ফজরের আযান দিয়েছে তো অনেকক্ষণ হলো। সূর্য উঠেনি এখনো পুরোপুরি যাগ নামাযের ওয়াক্ত তো কায়েম আছে এখনো। তড়িঘড়ি করে উঠে কোনোমতে ফরজ নামাজ টা পড়ে নিয়ে উঠলো হিয়া। ইশশ কতো দেড়ি হয়েছে আজ দেখো। আর একটু হলে তো পুরো সকালেই নেমে পড়তো,উফফ। রুমের এদিকে জানালাটা খুলে দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো হিয়া। সাথে সাথে পর্দা ভেদ করে ভোরের শীতল বাতাস এসে জুড়িয়ে দিলো হিয়ার সাড়া শরীর। কতো শান্তি না ভোরের এই হিম শীতল বাতাসটার, যেনো আলাদা এক শান্তি! হঠাৎই লাগিয়ে দেওয়া কামিনী ফুলের গাছ টা দেখতে গিয়েই বিষ্ময়ে তাকিয়ে উঠলো হিয়া। আচ্ছা এগুলো কি দেখা যাচ্ছে আশেপাশে তার। আগে তো ফাঁকাই ছিলো হঠাৎ এই এক রাতের মধ্যে কি এমন হলো যে!
গায়ের ওড়না টা জড়িয়ে নিয়ে এক দৌড়ে রুম ছেড়ে পেছনে এসে দাঁড়াতেই থমকে উঠলো হিয়া। এসব কি! এই এতোসব ফুলের গাছ,রঙবেরঙের ফুল এভাবে কে লাগিয়ে দিলো! কাঁপা ঠোঁটে কিছু বলতে নিতেই হিয়ার পেছনে এসে দাঁড়ালো উজান। হিয়াকে জড়িয়ে ধরে থুঁতনি ঠেকালো হিয়ার বাহুতে। হিয়ার কানের লতিতে একটা চুমু এঁকে বললো” সারপ্রাইজ! সুন্দর না? বিষ্ময়ে উজানের দিকে অবাক চাহনিতে তাকিয়ে উঠলো হিয়া। কিছু বলতে গিয়েও ঠোঁট কাঁপতে থাকলো তার। উজান কি কখনো জানতে পারবে তার অজান্তে এ কার চারপাশটাকে এতো ফুল দিয়ে ভরিয়ে তুলছে সে। কখনো কি হিয়ার অভিমান ভাঙ্গবে, কখনো কি অভিমানের পাহাড় কেটে দিয়ে হিয়া উজানকে বলবে তাদের এই নিষ্পাপ বাচ্চা টার কথা! ভাবতে গিয়েই চোখে পানি নামতে শুরু করলো হিয়ার। ঘেন্না নামক ভালোবাসায় আলতো হাতে জড়িয়ে ধরলো সে উজানকে! স্নিগ্ধ ভোরের মতোই পিচ্চি হিয়াকে নিজের প্রশ্বস্থ বুকে আগলে রাখলো উজান। অভিমানের মায়াতে সেই প্রশ্বস্থ বুকের বুকপিঞ্জরে হিয়াও খুঁজে নিলো একরাশ প্রশান্তি!❤️
চলবে….