চোখের_তারায়_তুই? #পর্ব_০৯

0
890

?#চোখের_তারায়_তুই?
#পর্ব_০৯
#ইভা_রহমান

আজ এক সপ্তাহ ধরে হিয়ার উপর উজানের মেজাজ খুব খারাপ ভাবেই বিগড়ে আছে। না হিয়া ঠিক মতো কোচিং এ পড়া দিচ্ছে না রোদের কাছে ঠিক সময় পড়তে আসছে। উপরন্তু কলেজে মানথলি পরীক্ষার রেজাল্ট এ কেমিস্ট্রিতে ফেইল সাথে ম্যাথে টেনে টুনে ২০ এ ৮ তুলে যে-ই রেজাল্ট হিয়া অর্জন করেছে সেটা কোনো ভাবেই উজান হিয়ার থেকে আশা করে নি। এমন না যে একার হিয়া’ই রেজাল্ট এরকম খারাপ হয়েছে পরীক্ষাতে কমবেশি কেমিস্ট্রি আর ম্যাথে সবার রেজাল্ট’ই এরকম এক অবস্থা। কিন্তু উজান তো আর বাকি সবাই কে কি করলো তা দেখতে চাইবে না তার কথা হিয়া কেনো এরকম করবে!!

কোচিং এ ক্লাস শেষে ক্লাসরুমের সামনে দাঁড়িয়ে গল্প দিচ্ছে লতা,হিয়া,অর্পা সহ আরো অনেকজন। আজ মোহিনীর জন্মদিন উপলক্ষে তারা ঠিক করেছে তারা এ-ই ক্লাস শেষে তাদের ঠিক করা রেস্টুরেন্টে গিয়ে মোহিনীর জন্মদিন টা সেলিব্রেট করবে। তাই নিয়ে চলছিল তাদের কথোপকথন।

– ধুর এটা একটা রেজাল্ট করলাম,কলেজে উঠে প্রথম পরীক্ষাতেই ফেইল।

লতাকে চোখ রাঙিয়ে হিয়া বললো,

– পাতার বাচ্চা লতা আবার কেনো মনে করিয়ে দিলি রেজাল্ট এর কথা,একটু ভূলে ছিলাম,তোর জন্য যদি আবার টেনশনে আমার পেশার লো করতে শুরু করে না তাহলে দেখিস কিন্তু ..

– কি করবো,তোরা তো আছিস বার্থডে সেলিব্রেশন নিয়ে ওদিকে যদি মজনু স্যার গার্ডিয়ান কল করে বাড়িতে সব বলে দেয় তখন কি হবে একবার ভেবেছিস সে কথা?

– তুই কি চুপ করবি লতা। তোর আর কি একটু খাবি না হয় বকুনি। আর আমি, প্রথমে ধরবে ভাইয়া তারপর রোদ আপু আর শেষে…শেষে তো উজান স্যার আমাকে পানা পুকুরে চুবিয়ে রেখে দিয়ে আসবে এবার। ইইইই আমি আস্ত থাকবো তো লতা।

অর্পা এদের দু’জনকে থামিয়ে দিয়ে বললো,

– বাদ দে তো,যা হবে পরে দেখা যাবে,এখন শোন আমি আর লতা মোহিনীকে নিয়ে এদিক দিয়ে যাবো,আর তোরা আগে গিয়ে দেখবি সব ঠিক আছে কি না,কেমন।

– ঠিক আছে,আর ফারহান কে বলবি ঠিক টাইমে, ঠিক ভাবে যেনো কেক নিয়ে আসে নাহলে ঔ ব্যাটার একটা চুলো কিন্তু এই হিয়া আস্ত রাখবে না,

অর্পা হিয়াকে কিছু বলতে যাবে তার আগে উজান এসে পেছন থেকে হিয়াকে ডাক দিতেই ভয়ে হিয়ার বুক টা নিমিষে শুকিয়ে আসলো। পেছন ফিরে অনেক কষ্টে মুখে একটা হাসি এঁকে হিয়া বললো “জ্বী স্যার”

– উপরে সেকেন্ড ইয়ারের পরীক্ষা হচ্ছে গিয়ে একটা সীটে বসো,কুইক

– কেনো স্যার,সেকেন্ড ইয়ারে গিয়ে আমি কি করবো,আমি আমি তো কেবল ফাস্ট ইয়ার, তাহলে?

– আগের সপ্তাহে কতোদিন এ্যাবসেন্ট ছিলে তুমি? কয়টা পরীক্ষা মিস গেছে তোমার।

ভয়ে বুকটা আরো শুকিয়ে খরা হয়ে যাবে বুঝি এবার হিয়ার।

– ইয়ে মানে তিনদিন আসিনি,আর দুটো পরীক্ষা দেওয়া হয় নি আর কি

– শিশির জানে সেটা?

– না মানে ভাইয়া তো দোকানে থাকে তাই আর কি জানানো হয় নি।

– মানথলিতে কেমিস্ট্রিতে ফেইল করছো সেটা নিশ্চয়ই জানে।

চুপ করে মাথা নামিয়ে রইলো হিয়া। বুঝতে পারলো এখন আর কোনো কিছু ব’লেই সামনের মানুষ টার চোখের আগুন টাকে নেভানো সম্ভব না। তাই বাধ্য মেয়ের মতো সোজা সিঁড়ি দিয়ে উপরে চলে আসলো হিয়া। ক্লাস রুমে ঢুকতেই পা আঁটকে গেলো তার। এটা তো ছেলেদের ব্যাচ। পুরো ক্লাসে ছেলে দিয়ে ভর্তি এখানে কি করে সে একা। হিয়ার পেছনে পরীক্ষার খাতা আর প্রশ্ন হাতে উজান এসে দাঁড়াতেই হিয়া পিছন ফিরবে ওমনি দু’জনের দুম করে ধাক্কা লেগে উজানের হাত থেকে সব বই খাতা কাগজ কলম মেঝেতে ছড়িয়ে পড়লো নিমিষে। উজান চোখ পাকালো শুধু কিছু বললো না। নিচে হেলে খাতা গুলো তুলতে যাবে ওমনি হিয়াও কাঁপা হাতে খাতা গুলো তুলতে নিচে হেলতেই মাথার সাথে মাথা বারি লাগলো দু’জনের। আহ বলে খেঁকিয়ে উঠলো হিয়া। কিন্তু পরমুহূর্তে নিজেকে সামলে চুপ হয়ে গেলো সে। উজান কপালে হাত দিয়ে ব্যাথা লাগা জায়গাটা একটু হাত বুলিয়ে নিলো,

– এদিকে আবার কোথায় যাচ্ছিলে তুমি হিয়া,ভেতরে বসতে বলিনি আমি।

– হ্যা মানে না আসলে এটাতো ছেলেদের ব্যাচ স্যার। আমি এখানে কি করে?

এটা যে ছেলেদের ব্যাচ সেটা কিছু মুহুর্তের জন্য খেয়াল ছিলো না উজানের। খাতা গুলো সব হাতে তুলে উজান উঠে বাহির থেকে রুম টা একবার চোখ বুলিয়ে নিলো। ছেলেদেরই তো ব্যাচ,এখন। তবুও উজান ঠিক করলো হিয়াকে আজকে পরীক্ষা নিয়ে তারপর’ই সে ছাড়বে।

– সমস্যা নেই আমি আছি।

হিয়া মাথা নাড়ালো শুধু,উজান এক পা বাড়াতেই হিয়া উজানকে থামিয়ে দিয়ে উজানের সামনে এসে দাঁড়ালো,

– একটু এদিকে শুনুন তো। এদিকে এদিকে। আমার দিকে ঝুঁকে আসুন তো একটু।

– হোয়াট!

– আ হা যা বলছি করুন না,হেলুন একটু,আরে হেলুন না..

উজান শ্বাস ফেলে হিয়ার দিকে হালকা ঝুঁকে আসতেই হিয়া ওর পা দুটো উঁচু করে উজানের কপালের সাথে নিজের কপাল টা আরেকবার ঠুকে দিতে বিস্ময়ে তাকিয়ে উঠে উজান। হালকা পিছে এসে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ছুড়ে হিয়ার দিকে।

– এটা কি ছিলো হিয়া?

হিয়া মাথায় দু আঙ্গুল তুলে দেখাতে থাকে।

– শিং শিং,একবার ঠোকা লাগলে আরেকবার ঠোকা দিতে হয় নাহলে শিং গুঁজে যায়

– হোয়াট রাবিস….এখনো ছোট্ট বাচ্চা তুমি যে এগুলো বিলিভ করো

– আরে আমি তো শুধু

– ইডিয়ট!

ব’লেই রুমে ঢুকলো উজান। হিয়া মনে মনে খুশি হলো কিছুটা যাগ একটু হলেও তো জব্দ করা গেলো সাদাবিলাইটাকে…

ভেতরে এসে পেছনের সীট থেকে দুজনকে তুলে সামনে এনে বসিয়ে পিছন টা পুরো ফাঁকা করে দিলো উজান। আর হিয়াকে দেখিয়ে বললো সেখানে গিয়ে বসতে। উজান ছেলেদের কে সেকেন্ড ইয়ার এর প্রশ্ন দিয়ে হিয়াকে লাস্ট পরীক্ষার প্রশ্ন দুটো ধরিয়ে বললো এক ঘন্টার মধ্যে দুটো পরীক্ষা’ই শেষ করতে হবে তাকে। হিয়ার তো এই মুহুর্তে মন চাইছিলো উজানের মাথায় পেট্রোল ঢেলে দিয়ে আগুন জ্বালিয়ে দিক সে কোথায় এখন গিয়ে বার্থডেতে কেক ফেক কেটে মজা করার কথা হিয়ার আর উজানকে দেখো কেমন পরীক্ষার প্রশ্ন হাতে ধরিয়ে দিলো।

– মন তো চাইছে আপনার সব চুল টেনে ছিঁড়ে আগুন জ্বালিয়ে দেই আমি। কোথায় ভাবলাম ফারহানের আনা চকলেট কেক টা খাবো আর আপনার জন্য এখন আমাকে কি না। জীবনেও আপনার কপালে ভালো বউ জুটবে না উজান স্যার। আর জুটলে এমোনি বউ জুটবে যে জিন্দেগীতেও সে আপনাকে কেক খাইতে দিবে না সেই মেয়ে এ-ই বলে রাখলাম আমি হু।

অভিশাপের শেষ টা শেষ করেই দাঁতে দাঁত চিপে পরীক্ষা দিতে শুরু করলো হিয়া। ভাগ্যিস ম্যাথের এ-ই চ্যাপ্টার টা রোদ আজকে তাকে করিয়েছিলো সকালে নাহলে তো কলম কামড়ে দিয়েই বসে থাকতে হতো এতোক্ষণ হুম।

পরীক্ষা চলাকালীন সবার দৃষ্টির মাঝে কড়া দৃষ্টিতে হিয়ার দিকে তাকিয়ে ছিলো উজান। একটা মিনিটের জন্য রুম থেকে এদিক সেদিক বেড়োইনি সে। এমনকি কোনো ছেলে পরীক্ষা রেখে যাতে হিয়ার দিকে তাকাতে না পারে তাই সে একদম শেষ বেঞ্চে হিয়াকে বসিয়েছে একবারে। যেখানে হিয়ার আশেপাশে ডানে বামে সামনে কেউ নি। পরীক্ষা দিতে দিতে উজানের দিকে মাঝে মাঝে তাকিয়ে রইলো হিয়া। উজান চোখের ইশারায় বললো ” আমার দিকে না তাকিয়ে মনোযোগ দিয়ে পরীক্ষা দেও” হিয়া ভেংচি কেটে আবার লিখতে শুরু করলো।

কিন্তু এদিকে এতো নিরপওা দেবার পরো হিয়াকে নিরাপদ রাখতে ব্যর্থ হলো উজান। পরীক্ষা শেষে ছেলেরা যখন উঠে টেবিলে খাতা রাখছিলো সেই মুহুর্তে হিয়াও তাদের সাথে লাইন করে খাতা দিতে এসেই বাধলো বিপওি। কারেন্ট চলে গেলো আর তাতে হঠাৎই রুম টা কিছুক্ষণের জন্য অন্ধকার হওয়াতে পাশ থেকে এক ছেলে পেছনে এসে হিয়ার বুকের নিচে পেটের মাঝ বরাবর হাত রাখতেই কেঁপে উঠলো হিয়া। কিছু বলতে পেছনে ফিরবে দেখে কেউ নাই তার পেছনে। জেনারেটর আসলো সেই মুহুর্তে। আশেপাশে তাকাতে দেখলো ছেলেরা আগের মতো যে যার জায়গাতে আছে। কিছু বুঝে উঠতে পারছিলো না যেনো হিয়া। জীবনে কখনো এরকম সিচুয়েশনের মুখোমুখি হয় নি সে। আজ প্রথম এরকম কিছু তা-ও আবার এরকম একটা প্লেসে এটা ছিলো হিয়ার জন্য পুরো অনাকাঙ্খিত একটা বিষয়। মুহুর্তে ঘাবড়ে গেলো হিয়া। মুখ দিয়ে যেনো কিছু বলতে গিয়েও কথা বের হচ্ছিলো না তার। কোনোমতে হাতে থাকা খাতা টা টেবিলে রেখে এক দৌড়ে রুম থেকে বেড়িয়ে সোজা নিচে নেমে আসলো হিয়া। বাহিরে লতা, অর্পা আর মোহিনী সহ নিচে অফিস রুমের এক কোণে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিলো হিয়ার পরীক্ষা শেষ হবার। হিয়াকে দেখেই তারা দৌড়ে আসলো হিয়ার কাছে। যাগ তাহলে যাওয়া যাবে এখন।

– উফফ পরীক্ষা দিতে এতোক্ষণ লাগলো তোর। আধা ঘণ্টা লিখে খাতা টা জমা দিয়ে আসলেই তো পারতি তুই। আর উজান স্যার টাকেও কি বলি সবসময় এরকম করলে ভালো লাগে বল তো। কোনো ফ্রিডম নেই কিচ্ছু নেই অসহ্য।

এক মনে কথা গুলো বলছিলো অর্পা। হিয়ার মুখের দিকে চোখ পড়তে থমকে গিয়ে অর্পা বিস্ময়ে প্রশ্ন তুললো,

– তুই কি কাঁদছিস হিয়া!___তুই কাঁদছিস কেনো হিয়া? উজান স্যারকি উপরে কিছু বলেছে তোকে… হিয়া?

একটু আড়াল হ’য়ে অর্পাকে জড়িয়ে কেঁদে ফেললো হিয়া,সবাই তো অবাক আর যা-ই হোক যতো কষ্টে থাকুক না কেনো হিয়া তো সবার সামনে কান্না করার মতো মেয়ে না তাহলে..হিয়া কাঁদতে কাঁদতে অনেক কষ্টে উপরের ঘটনাটা তিনজনকে খুলে বলতেই রাগে ফেটে পড়লো লতা,হিয়ার চোখ মুছে দিয়ে বললো তুই এক্ষুনি আমার সাথে উজান স্যারের কাছে যাবি। আমরা সব জানাবো তাকে। হিয়া যেতে চাইলো না। বড্ড অভিমানের সাথে অভিযোগ ঘিরে ধরলো তাকে৷ চোখ মুছতে মুছতে এক ছুটে কোচিং থেকে বেড়িয়ে আসলো হিয়া। এদিকে হিয়া গেট দিয়ে বেরুতেই উজান এক প্রকার হিয়ার খোঁজে নিচে নামতে মোহিনী আর লতা দের দেখে থেমে গেলো। এরা যা-ই নি বাড়ি এখনো?

– তোমরা এখানে? ক্লাস তো শেষ হয়েছে অনেকক্ষণ হলো বাড়ি যা-ও নি কেনো এখনো?… বাই দা ওয়ে হিয়া কোথায়? এক্ষুনি নামলো না ও?

লতা নিজের রাগ টাকে কন্ট্রোল করতে পারলো না। তেড়ে আসলো উজানের দিকে। মনের রাগ টাকে নিগড়ে ফেলতে শুরু করলো তার কথার আঘাতে। সে যে তার স্যারের সাথে কথা বলছে এটাও যেনো হুঁশ ছিলো না তার।

– আপনি যখন দেখলেন ওটা ছেলেদের ব্যাচ কি দরকার ছিলো আর পরীক্ষা টা নেবার। সেই ছেলেটা হিয়ার বুকের নিচে হাত দিয়েছে এর মানে বোঝেন আপনি!

মোহিনী লতাকে চুপ করতে বলেও লতাকে চুপ করাতে পারলো না।

– কোথায়,আমরাও তো অনেক সময় ক্লাস মিস করি পরীক্ষা মিস করি আমাদের তো কখনো এভাবে ডেকে আলাদা করে পরীক্ষা নেন না আপনি, তাহলে হিয়ার ক্ষেত্রে কিসের এতো অধিকার আপনার,হিয়া কি আপনার শএু না আপনি হিয়াকে ভালোবাসেন কোনটা স্যার..!!

– আহ লতা চুপ কর,স্যারের সাথে কি কথা বলছিস এগুলো তুই?

– তোরা চুপ কর। আজ যদি জেনারেটর না আসতো। ছেলেটা যদি আরো বেশি কিছু করে দিতো তখন ভালো লাগতো তোদের….হিয়াকে আমি ছোট থেকে চিনি স্যার,হাজার কষ্ট থাকলেও আমি হিয়াকে এতোটা অসহায় কখনো দেখিনি। হিয়া আপনার উপর বড্ড অভিমান করেছে উজান স্যার। এবার আপনি ভাবুন আপনি কিভাবে এসব ঠিক করবেন।

একটা দীর্ঘ শ্বাস ছাড়লো উজান। মুখ দিয়ে শুধু এটুকু জানতে চাইলো হিয়া কোথায়। মোহিনী বললো তারা জানে না, হিয়া কিছু না ব’লেই বেড়িয়ে গেলো আপনি আসার আগে। উজান কিছু বললো না। মুখ শক্ত করে বাইকের চাবি হাতে বেড়িয়ে পড়লো হিয়ার গন্তব্যে…..

!
!

ভার্সিটিতে আজ ফাংশন থাকায় তাসফিয়া সহ রোদ এসেছে তাদের ক্যাম্পাসে। শিশিরো আছে বাকি সবার সাথে। কিন্তু রোদ আর শিশিরের মাঝে নেই কোনো কথা না কোনো চাহনি৷ সেদিনের পর থেকে আজ এক সপ্তাহ শিশির রোদকে এ্যাভোয়ড করে যাচ্ছে৷ রোদের টেক্সট ফোন সব কিছু থেকে পালিয়ে বেড়াতে রোদের যতো নাম্বার আছে আইডি আছে সব কিছুকে ব্লক করে রেখেছে সে। ফাংশনে এসেও শিশিরের এই তাচ্ছিল্য মেনে নিতে অনেকটা কষ্ট হচ্ছিলো রোদের। আজ এ-ই অনুষ্ঠানে রোদ যে শাড়ি টা পড়ে এসেছে সেটা শিশিরের দোকান থেকেই কেনা। শিশির যখন কাপড়ের দোকানে ছিলো তখন নিজের হাতে রোদের জন্য শাড়ি টা গুছিয়ে ব্যাগে ভরে ছিলো শিশির। আজ শাড়িটাতে চেনা গন্ধ মিশে থাকলেও শিশির রোদের দিকে এক নজর তাকানোর প্রয়োজন অবধি মনে করছে না যেনো।

– আচ্ছা তাসফিয়া আমাকে কি আজকে খুব বাজে দেখতে লাগছে। শাড়ি টা আমাকে একদম মানায়নি তাই না রে। একদম জোকার জোকার লাগছে না আমাকে।

– এভাবে কেনো কথা বলছিস তুই রোদ?

– শিশির এখন অবধি আমার দিকে একটা বারের জন্য তাকাই নি তাসফিয়া। ও সবার সাথে কথা বলছে। মেহুর সাথে অবধি বসে কফি খেলো কিন্তু আমাকে,আমাকে তো সে… মেহু আমার চাইতে অনেক ফ্রেন্ডলি আর সুন্দর দেখতে তাই না তাসফিয়া,

– তুই এরকম বাচ্চা দের মতো কথা কেনো বলছিস রোদ। গ্রো আপ। তোর ক্লাসের সাথে যায় মেহু। আমার মনে হয় তুই একটু বেশি পাওা দিয়ে ফেলছিস ইদানীং শিশিরকে। কি লাভ হচ্ছে এতে। শিশির কি আদৌও বুঝতে পারছে তুই কি চাস…. তোর মতো সুন্দর মেয়ে এ-ই ভার্সিটিতে আর দুটো নেই সেখানে শিশির যে আর কি চায় উপর মাবূদ ই ভালো জানেন।

চোখে আসা পানি টা কোনো মতে সামলে সেখান থেকে একটু সামনে এসে একটা গাছের নিচে দাঁড়িয়ে পড়লো রোদ। গাছ টার সামনে একটা ছোট্ট পুকুর। পানি নেই শুকিয়ে গেছে। পাশে বেড়ে ওঠা শিমুল গাছের কিছু ফুল সেই কাঁদা ভেজা পুকুরে জমেছে। রোদের মতোই এই শিমুল ফুল গুলোরো মনে হচ্ছে মনটা আজ ভীষণ খারাপ। তারাও যেনো কারো অবহেলার স্বীকার হয়ে এরকম নিশ্চুপ পড়ে আছে! এদিকে চোখের আড়ালে একটু করে হলেও রোদকে দেখছে শিশির কিন্তু বুঝতে দিচ্ছে না। কমলা রঙের জর্জেটের এ-ই শাড়ি টা যেনো রোদের জন্যেই বানানো হয়েছিলো। মেয়েটা এতো সুন্দর না হলেও ক্ষতি ছিলো না যেনো। কিন্তু না রোদের মতো এতো সুন্দর আর দামি কিছু যে তার জন্য তৈরি না,কিছুতেই না!

হঠাৎই গাছের এদিকে একটা বেঞ্চে এসে বসে পড়লো কিছু বখাটে ছেলে। রোদ নিজের মধ্যে থাকায় প্রথমে তাদের অস্তিত্ব টের পেলো না। কিন্তু কিছু সময় বাদে তাদের কিছু বাজে কথা কানে পৌঁছাতে আঁতকে উঠলো রোদ। এগুলো তো সেই ছেলে যারা ভার্সিটতে ঢোকার সময় তার শাড়ির আঁচল টা হালকা টান দিয়েছিলো..

– আরে মামা তোমার পাখি তো দেখি গাছের নিচে দাঁড়ায় আছে আর তুমি কি না তারে গাছের ডালে খুঁজছিলা এতোক্ষণ।

চোখের চশমাটা খুলে পাশে থাকা আরেকটা ছেলে রোদকে উদ্দেশ্য করে বললো,

– মামা তোমাদের ভাবি তো দেখছি পুরাই একটা.. বাটারের মতো শরীর ধরতে গেলেই তো গলে পড়বে দোস্ত

নিজের সম্পর্কে এতো বাজে শব্দ কানে পৌঁছাতে রাগে ঘেন্নায় ক্ষেপে উঠলো রোদ। অন্য দিন হলে হয়তো কিছু একটা বলে প্রতিবাদ করতো সে কারণ এরকম বাজে টোন কৈশোর জীবন থেকেই শুনে আসছে সে।এগুলো নতুন কিছু না তার জন্য। সৌন্দর্য যেমন বর স্বরুপ তেমনি সেটা মাএারিক্ত হলেই অভিশাপ হতেও বিন্দু মাএ দেড়ি করে না। মনটা আজ খারাপ থাকায় রোদ নিজের রাগ টাকে দমিয়ে আবার নিজের জায়গাতে ব্যাক করতেই ছেলে গুলো রোদের পিছে পিছে এসেই আরো বাজে আচরনে রোদকে জ্বালিয়ে শেষ করতে থাকলো,

– ও কমলা আপু আপনার নাম্বার টা দেন না আপু,আপু আপনার শাড়ি টা তো জোস কোথায় থাকি কিনছেন। আরে আপু যাচ্ছেন কোথায়? আপু শাড়ির থেকে ব্লাউজ টা কিন্তু আরো সুন্দর একদম আপনার মতো,আপু ও আ……

ছেলেটা আর কিছু বলার আগে রোদের এক বাহু ধরে রোদকে নিজের বুকের বা পাশে এনে দাঁড় করিয়ে দিলো শিশির। হাতে থাকা সিগারেটটায় এক টান দিয়ে ধোঁয়া ছাড়লো একটা। ছেলেগুলোর দিকে বাঁকা হাসি দিয়ে বললো,

– ব্যাটা তোরা চেনোছ মেয়েটারে,জানোস সে কার কলিজা লাগে?

শিশিরের কথায় ছেলে গুলো হেঁসে দিলো একটা। যে-ই ছেলের নজরে পড়েছিলো রোদ সেই ছেলেটা সামনে এসে বললো,

– মামা আমি তো তোমারই চিনলাম না,তা তোমার কলিজারে কেমনে চিনবো বলো,

হেঁসে দিলো বাকি সবাই,শিশির রোদকে বা হাতে তার বুকের একদম গা ঘেঁষে আগলেই ডান হাতের বুড়ো আঙ্গুলে তার নাক টা দু’বার ঘষে নিলো,রনিকে উদ্দেশ্য করে বললো,

– রনি,ছেলে তো দেখছি আমারে’ই চিনে না। তা একটু চিনায় দে দেখি..

ভয়ে রনি তারেক সহ সামনে এসে দাঁড়াতেই ছেলে গুলোকে সাবধান করে দিলো শিশিরের সাথে না লাগতে। ছেলে গুলোর যেনো ইগোতে লাগলো ব্যাপারটা। তারা আরো ক্ষেপে উঠে শিশিরের দিকে তেড়ে আসলো। এতোক্ষণে শিশিরের হাতে থাকা সিগারেট টা শেষ করা শেষ। এদিকে শিশিরের বুকে চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে আছে রোদ। এ-ই বুক টাকেই তো সে গত কিছু দিন ধরে খুঁজে মরছিলো।

– কে ভাই তুই,যে তুই বললে আমাকে ক্যাম্পাস ছাড়তে হবে। তুই চিনোস আমারে। আমার বড় ভাইরে চিনোস। এক কোপায় তোদের শরীর থেকে মাথা আলাদা করে দিবে সে..

– ডাক তোর ভাই রে। ফোন করে বল শিশির ডাকে,যা

– তোর ইআরকি মনে হচ্ছে না,থাম তাহলে তোর শরীর থাইকা আজ যদি রক্ত না বের করছি আমি আমার নামো হিমেল না।

ব’লেই ছেলেটা তার ভাইকে ফোন করে সব ঘটনা খুলে বললো,শিশির নাম টা শুনেই আঁতকে উঠলো ছেলেটার ভাই। কোন ডিপার্টমেন্ট কোন ইয়ার সিউর হতে নিতেই ছেলেটাকে অপর পাশ থেকেই এ-ই মুহুর্তে ক্ষমা চেয়ে নিতে বলে সে। ছেলেটা তার ভাইয়ের এমন বিহেভের কারণ খুঁজে পায় না। উপরন্ত শিশিরের বিবরণ শুনে নিজেও কিছুটা ঘাবড়ে যায় সেই স্থানে। ফোন রেখে শুকনো মুখে শিশিরের কাছে ক্ষমা চাইতেই শিশির রোদকে তাসফিয়ার পাশে দাঁড় করিয়ে বা হাতে ছেলেটার শার্টের কলার ধরে ডান হাতে ছেলেটার মুখে ইচ্ছে মতো গায়ের সর্বশক্তি দিয়ে তিন চারটে ঘুষি বসিয়ে দিলো,ছেলেটা হাত জোড় করলেও শিশির শান্ত হতে পারলো না,

– জানোয়া.. বাচ্চা সাহস কি করে হয় তোদের, আমার রোদের দিকে চোখ তুলে দেখিস। ক্ষমা চা..এক্ষুনি ক্ষমা চা..

ব’লেই ছেলেটাকে রোদের সামনে টেনে হিচড়ে এনে দাঁড় করিয়ে দিতে ছেলেটা অকপটে ক্ষমা চেয়ে নেয় রোদের কাছে। সাথে তার সাথে বাকি সবাই। এদিকে শিশিরকে শান্ত করে রনি আর তারেক ছেলে গুলোকে বের করে দিয়ে শিশিরের সামনে আসতেই রোদ শিশিরের শার্টের কলার চিপে ধরে অঝোরে কাঁদতে শুরু করে। কান্নামাখা চোখে অভিমান আর অভিযোগের আভাস স্পষ্ট! শিশির কিছু বলতে যাবে তার আগে শিশিরকে একটা ধাক্কা দিয়ে রোদ দৌড়ে সেখান থেকে সামনে কোথায় একটা হারিয়ে যায়,এদিকে শিশির রোদের পেছনে এক পা বাড়াতেই তাসফিয়া রাগে শিশিরকে থামিয়ে দিলো,

– শান্তি মিটছে তোর এখন। এটাই তো চেয়েছিলি তুই৷ ভালো লাগছে রোদের চোখে পানি দেখে তোর। কলিজায় শান্তি আসছে না খুব এখন

– তাসফিয়া তুই!

– কি চায় মেয়ে টা তোর কাছে একটু ভালোবাসা একটু যত্ন একটু আদর একটু তোর এ্যাটেনশন,এ-ই তো। এটারো দেবার মুরাদ হয় না তোর।

পাশ থেকে রনি রেগে উঠে তাসফিয়া কে থামাতে চাইলো কিন্তু পারলো না,

– আহ তাসফি এখন এসব বলার পরিস্থিতি এটা?

– একদম আমাকে কিছু বলতে আসবি না রনি। পরিস্থিতির কথা বলছিস,আজকে শিশির শিশিরের জায়গায় ঠিক থাকলে এরকম পরিস্থিতিতে পড়তেই হতো না ওর…মেয়েটা নিজের অস্তিত্ব ভুলে তোর মতো করে নিজেকে মানিয়ে নিতে শিখছে আর তুই!

শিশির মাথা নিচু করে তাসফিয়ার সব অভিযোগ শুনছিলো এতোক্ষণ। তাসফি থামতেই শিশির কাউকে কিছু না বলে রোদের খোঁজে হাঁটতে শুরু করলো পুরো ক্যাম্পাস।

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here