চোখের_তারায়_তুই? #পর্ব_২১

0
837

?#চোখের_তারায়_তুই?
#পর্ব_২১
#ইভা_রহমান

চোয়াল শক্ত,চোখে আগুনের লাভা,সেই রক্তবর্ণ চোখের দিকে এ-ই মুহুর্তে তাকাতে শিউরে উঠছে হিয়া। আবারো ফাসির আসামির মতো ভাইয়ের সামনে কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হলো হিয়াকে। মনে হচ্ছে পায়ের নিচে মাটি নেই মাথার উপর ছাদ নেই। শ্বাস নিচ্ছে কি নিচ্ছে না সেই হিসাব টাও করতে ব্যর্থ হচ্ছে হিয়া। শিশিরের গলা ভারী,কন্ঠ কঠিন,চোখে দাবানলের লেলিহান শিখা!

-এটা কতোটুকু সত্যি হিয়া?..আমি কিছু জিজ্ঞেস করছি তোকে..চুপ করে থাকবি না হিয়া..হিয়া আমার রাগ তুলবি না কিন্তু। তুই জানিস আমি রাগলে আমার কোনো হুঁশ থাকে না..এটা কতোটুকু সত্যি হিয়া?

কাঁপা কন্ঠে হিয়া বললো,
-সব টুকু!

হিয়ার মুখ দিয়ে কথাটা বের হতে নেই ওমনি হিয়ার গালে সপাটে এক চড় বসিয়ে দেয় শিশির। এতোক্ষণ অবধি যাও বা সব সহ্য করে নিয়েছিলো এ-ই রাগে জ্বলন্ত বুকের খাঁচা টা,একটু আগে অবধি যে মনকে শিশির সান্ত্বনা দিয়েছিলো না এসব সব মিথ্যা,কিন্তু না হিয়ার এই”সব টুকু” কথাটা যেনো সেই জ্বলন্ত লেলিহান শিখায় ঘি নামক বস্তু টা ঢালতে যথেষ্ট ছিলো। আজ অবধি শিশির হিয়ার প্রতি যতোটুকু কঠোর হয়েছে যতোটুকু শাসন করেছে যতোটুকু মেরে হোক,বকে হোক হিয়াকে আয়ওে রাখতে চেষ্টা করেছে আজ তার চাইতেও এ-ই জ্বলন্ত শিখার উওাপে ফুঁসছে শিশির!

হিয়া নিশ্চুপ। চোখ দিয়ে শুধু ঝরে পড়ছে টপটপ লোনাজল। নাকের পানির সাথে চোখের পানি এক হয়ে লেপ্টে যাচ্ছে। কখনো হাত উঠিয়ে সেটা মোছার বৃথা চেষ্টা করছে হিয়া। একটু নাক টেনে যে শব্দ করে কাঁদবে এ-ই সাহস টুকু যোটাতে পারছে না মেয়েটা…..হিয়াকে শিশির বকবে মারবে ধমকাবে কিন্তু অন্য কেউ তার বোনের গায়ে হাত তুলবে এটা কখনোই ভাই হয়ে মেনে নেওয়া শিশিরের মতো ছেলের পক্ষে অসম্ভব। যেখানে শিশিরের ভয়ে চাচা চাচিও কোনোদিন হিয়াকে রাগ করে দুটো কথা বলতে পারে নি সেখানে রোদের মায়ে’র এই স্পর্ধা দেখে নিজেকে সংযত রাখতে বড্ড বেগ পেতে হচ্ছে তাকে,বড্ড বেগ পেতে!

– কিসে কমতি রাখছিলাম তোর। আমার মান সম্মান এভাবে ডোবাতে একটা বার ভাই টার কথা মনে পড়লো না তোর হিয়া!

হিয়া নির্বাক। সে যে কখনো চাইনি তার জন্য তার ভাইকে এরকম হেনস্তা হতে হোক,অসম্মানে পুড়তে হোক।

– পৃথিবীতে আর কোনো ছেলে ছিলো না। শেষমেশ কিনা..

শিশির ওর বা দিকের বুকে আঙুল দিয়ে বলে,

-আমার এই কলিজাটা দেখতিছিস,তোর পর তোর রোদ আপুকে আমি এখানে জায়গা দিছি,ভালোবাসছি তাকে কিন্তু আমি জানি রোদ আমার জন্য না,আমি রোদের সাথে যাই না..নিজেকে পাথর বানাইছি। তোর রোদ আপুকে আমি ফিরায় দিছি বারবার,দিনের পর দিন তার সাথে দুরব্যবহার করছি..কারন জানি এটা কখনো সম্ভব না…কিন্তু তুই আমার বোন হয়ে কি করে পারলি এ-ই এতো অবিবেচকের মতো এই কাজটা করতে!

-ভাইয়া আমি!

– কি হিয়া?…আজকে আমার বোনের গায়ে তারা হাত তুলে আর আমাকে কি না সেটা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে হচ্ছে। যেখানে রক্তের দাম তারা টাকায় চুকায় দিতে চায় সেখানে তুই কি করে ভাবলি সেই মানুষ গুলো তোর আমার মতো এ-ই এতিমকে মেনে নিবে…

সাহস জুটিয়ে হিয়া বললো,
– ভাইয়া,উজান স্যার আমাকে সত্যি অনেক ভালোবাসে। উনি ওরকম না বিশ্বাস কর..

হিয়ার কথার শেষ নেই আবারো হিয়ার গালে সপাটে এক চড় বসিয়ে হিয়ার বা হাতের এক বাহু চিপে ধরে শিশির। চোখে জ্বলছে সেই লেলিহান শিখার আগুনের রক্তবর্ণ। জমে গেলো হিয়া৷ কথাটা বলা কি তার ভুল হয়ে গেলো। সত্যি ই তো উজান আর বাকি সবার মতো না। তাহলে!

– উজান কিরকম সেটা তোকে আমাকে শেখাতে হবে না। তুই কতো জানিস এ-ই দুনিয়া সম্পর্কে। কতো বড়ো হইছিস। এখনো কলেজও পাস করলি না। এটা তোর বয়স প্রেম করার।

কথাগুলো হিয়ার কানের কাছে খুব ঝাঁঝালো কন্ঠেই বললো শিশির। ভয়ে কুঁকড়ে উঠলো হিয়া। চোখ দিয়ে অবিরত লোনাজল বেড়িয়ে ভিজিয়ে দিচ্ছে হিয়ার কাঁধ গলা। দম টা আঁটকে আসছে। বাহুতে শিশিরের শক্ত বাঁধন থাকায় হিয়া হাতে ব্যাথা পাচ্ছে। দরজার ঠিক সামনে দাঁড়িয়ে আছে দাদি আর চাচি। শিশিরকে এ-ই রকম কঠোর হয়ে রাগতে কোনোদিন দেখে নি তারা। এর আগেও শিশির হিয়াকে এক দুবার মেরেছে কিন্তু কখনো গায়ে হাত তুলে এভাবে। এটা ভাবতেই অবাক যেনো তারা…!!

শিশির আজ এতোটাই ক্ষেপে আছে যে বোনের উপর নিজের গায়ের সর্বশক্তি প্রয়োগ করে শাসন করতে লিপ্ত হচ্ছে সে। রাগের বসে হিয়ার দু গাল চিপে ধরলো শিশির। চোখ ফেটে কান্না বের হতে থাকলো হিয়ার। সাথে দম ফেটে শ্বাস টানতে কষ্ট হচ্ছে ভীষণ। তবুও বোনের প্রতি একটুও মন গলছে না শিশিরের একটুও করুনা হচ্ছে না তার। হিয়ার মনটা শুধু এ-ই মুহুর্তে একটাই মুখ খুঁজছে কোথায় আপনি উজান স্যার,কোথায় আপনি?

– বল কতোদিন থেকে আমার সাথে এ-ই নোংরা খেলা খেলছিস তুই আর উজান মিলে। আমার পিঠের পেছনে এতো এতো ঘটনা ঘটালি আর আমি সরল মনে সব..তারমানে সেদিন ঔ নানু বাড়িতে উজানের যাওয়া,পিকনিকে একসাথে থাকা,রোদের কাছে বায়না করে রাত বিরাতে পড়তে যাওয়া সব সব মিথ্যা সব নাটক….

হিয়ার গাল ছেড়ে দিয়ে বিছানায় বসে পড়লো শিশির। যেনো শরীরে আর শক্তি পাচ্ছে না। ভাবতেই যেনো অবাক লাগছে তার কোলে করে বড় করা বাচ্চা টা তাকে এ-তো দিন চোখে পট্টি পড়িয়ে,মিথ্যার জাল বুনিয়ে এ-ই সব নোংরামো করেছে!

শান্ত কন্ঠে শিশির বললো,
-ছিঃ…এতো মিথ্যা হিয়া,এতো,আমার সাথে মিথ্যা! শিশির ভাইয়ের সাথে মিথ্যা। আর আমি এতো বোকা যে..

ভাইয়ের এই অবস্থা মেনে নিতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছিলো হিয়ার। হিয়া দৌড়ে গিয়ে নিচে বসে শিশিরের পা জড়িয়ে ধরে বলে,

– কিছু মিথ্যা না ভাইয়া,আমি আমি কিছু মিথ্যা বলি নি তোকে। সেদিন সত্যি আমি জানতাম না উজান স্যার নানু বাড়িতে ওভাবে আসবে,পিকনিকে পিকনিকে সত্যি আমি লতাদের জন্য যাই বিশ্বাস কর তারপর তো…

– এখনো মিথ্যা হিয়া! আমি বোকা না হিয়া,রোদ ও তোদের দু’জনের কথা জানতো তাই না?

হিয়া ডুকরে কেঁদে উঠলো,শিশির আবার এসবের জন্য রোদকে কেনো ভূল বুঝছে!

-রোদ আপুর কোনো দোষ নেই ভাইয়া। আপু জানতো ঠিকই কিন্তু স্যার আপুকে..তুই আপুকে ভুল বুঝিস না প্লিজ।

-ভুল ঠিকই তো ভুল আমার,নাহলে আমার বোন আমাকে কিছু না জানিয়ে তার রোদ আপু,উজান স্যার সবার সাথে সব শেয়ার করে আর আমি,আমি এদিকে সারাদিন দোকানে খেটে মরি আর ভাবি আর কি করলে এ-ই বোনটা ভালো থাকবে!

কান্নায় ভেঙে পড়লো হিয়া। শিশির নিজেকে কেনো এরকম অসহায় ভাবছে। কেনো ভাবছে হিয়া তাকে পর করে দিছে। হঠাৎই হিয়ার গলার কাছে চোখ পড়তেই আবারো সেই লেলিহান শিখায় বুকটা কেঁপে উঠলো শিশিরের। এ-ই চেইন আর লকেট টা নিয়েই তো তারা তার বোনকে কথা শোনাচ্ছিলো। জলজল করে ওঠা লকেটের মতো জ্বলে উঠলো একটু আগের সেই আগুনের তাপ। মুহুর্তে চোয়াল শক্ত করে হিয়ার চুল মুঠো করে ধরে বসা থেকে হিয়াকে উঠিয়ে হিয়ার গাল আবার চিপে ধরলো শিশির! এতো লোভ হিয়ার!

– এতো লোভ কবে থেকে হলো হিয়া তোর। এটা চাই তোর কতো দাম বলতি আমাকে। নিজেকে বিক্রি করে হলেও এনে দিতাম। কিন্তু তুই কি করলি। সবার সামনে তোর ভাইকে ছোট করলি..আরে একবার বলে দেখতি ভাই আমার এ-ই চেইন টা চাই,দেখতি কি করতাম আমি

কাঁদতে কাঁদতে হিয়া ফুপিয়ে বললো,

– আমার মাথায় খুব লাগছে ভাইয়া,আমার চুল ছাড় না….বিশ্বাস কর ভাইয়া আমি লোভী না..আমি তো এটা চাই নি স্যারের থেকে। আমি, আমি এটা কেনো কিছুই কখনো চাই নি স্যারের থেকে। স্যার নিজে থেকে এটা আমাকে দিয়েছে..

আরো জোড়ে হিয়ার মুখ চিপে ধরলো শিশির,গায়ের সর্বশক্তি প্রয়োগ করলে হিয়ার উপর,এক টানে হিয়ার গলা থেকে ছিড়ে ফেললো সেই চেইন। গলার সাইড ছিলে গিয়ে রক্ত বের হলো কিছুটা। কিন্তু শিশির থামলো না।বরং চিৎকারের সইত বললো,

– তুই নিয়েছিস কিসের জন্য। তোকে দিলেই তুই নিবি। এতো লাগে তোর। আমি ইদ আসলে এগুলা কিনে দেই না তোকে…ছোট থেকে বড় হইছি চাচ্চু ছাড়া কোনোদিন কারো কাছে একটা পয়সার জন্য হাত পাতিনি। আজকে তোর জন্য মানুষ আমাকে..

বলতে বলতে গলা ধরে আসলো শিশিরের। গলার কাছ টা মনে হলো শক্ত কিছু দিয়ে বেঁধে দেওয়া হলো তার,কান্নাভেজা চোখে বললো,

– নিজে ছেঁড়া শার্ট পড়ে ঘুরছি কিন্তু আমার সার্মথ্য যা কুলায় তা দিয়ে বাজারের সব চাইতে ভালো ফোড়ক টা তোকে কিনে পড়াইছি..ভার্সিটিতে উঠে একটা নিজের বই কিনতে মন চায় না নিজের, লাইব্রেরি থেকে বই আনি আনি পড়ি,বন্ধুদের কাছে ধার নেই আবার দিয়ে আসি আর তোর জন্য..যখন যা লাগবে গাইড থেকে শুরু করে এই রাইটার ঔ রাইটার সব রাইটারের বই এনে দেই,কলেজের বেতন
,ফি সব দিয়ে রাখি যাতে আমার মতো তোকে কোনোদিন ক্লাসে লজ্জায় পড়তে না হয় আর তুই..

শিশির চোখের পানি টা সামলে নিলেও হিয়ার মন অনুতাপের আগুনে পিষে ছাই হয়ে যাচ্ছে। আজ অবধি কোনোদিন শিশির এ-ই কথা গুলো তুলে নি। হিয়াকে বুঝতে দেয়নি তার ভাইয়ের কষ্ট টা আর আজ যেনো সবটা জোড়ে হ’য়ে একসঙ্গে বুকে তীর ঘুতাচ্ছে হিয়ার।

হিয়ার টেবিলে নজর দিতেই দেখলো পরশু কিনে আনা সাজেশন এর পাতলা পাতলা বই গুলো,যেগুলো এখনো পেপারে মুড়ে রাখা,না হিয়া ধরেছে না একবার চোখ বুলিয়ে দেখার প্রয়োজনটুকু মনে করেছে। সেই রাগ গিয়ে পড়লো সামনের টেবিলে সাজিয়ে রাখা ফিসের বোলটার উপর। উজান এনে দিয়েছিলো না এই বোল এই মাছ.বোল টাকে আছড়ে ভাঙ্গলো শিশির। মেঝের একপাশ পানিতে ভরে গেলো। বোলে রাখা মাছ গুলো মেঝেতে কিছুক্ষণ ঝাপিয়ে থেমে গেলো।

– রোদের মা’র এতো বড় স্পর্ধা কি করে হয় চাচি উনি আমার বোনের গায়ে হাত তুলে। এতো সাহস ওনার।

সাথে সাথে আবার পাশে থাকা চেয়ার টা তুলে আছাড় মারলো শিশির। উঁচু কন্ঠে বললো,

– যেখানে আমি তোমাদেরকে কখনো হিয়াকে একটা বকতে দেই নি সেখানে বাহিরের এক মহিলা..

টেবিলে রাখা কাঠের স্কেল টা হাতে তুলে হিয়ার দিকে তেড়ে এসে হিয়াকে মারতে শুরু করলো শিশির। হাতে পায়ে যেখানে যা পারছে মেরে মেরে লাল করে দিচ্ছে শিশির। হিয়া বাঁচার জন্য আকুতি জানাচ্ছে কিন্তু লাভ হচ্ছে না। চাচি আর দাদিকে ভেতরে ঢুকতে অবধি দিচ্ছে না শিশির। হিয়ার কান্নার আওয়াজ ভারী থেকে ভারী হয়ে আসছে। মন থেকে একটা বাক্যেই উচ্চারিত হচ্ছে উজান স্যার আপনি কোথায়?

– এ-ই দাম দিলি ভাইয়ের কষ্টের। এ-ই মূল্য দিলি নিজের ভাইয়ের। তুই লেখাপড়া করবি বড় হবি। আমার কতো শখ তোকেও উজানের মতো ডাক্তার বানাবো আমি আর তুই এসব প্রেম ভালোবাসা করে আমার স্বপ্ন টাকে…ছিঃ

ব্যাথায় আ হু বলে হিয়া চিৎকার করলেও মন গলাতে ব্যর্থ হতে হলো হিয়াকে। শিশির তাকে মারছে৷ যেখানে পারছে ওখানে মারছে। চাচি সাহস করে এসে হিয়াকে ধরলেও হিয়াকে বাঁচাতে বারবার হেরে গেলেন উনিও। একটা পর্যায় স্কেলটা দু টুকরো হবার পর শিশির থামলো। চাচির থেকে হিয়াকে চুল ধরে টেনে নিজের কাছে এনে কাঠ কাঠ কন্ঠে বললো,

– আর যদি উজানের আশেপাশে আমি তোকে দেখছি,হয় ঔদিন তুই বাঁচবি না হলে আমি।

হিয়ার বুকটা চুপসে গেলেও হিয়া বললো,

– আমি স্যারকে সত্যি অনেক ভালোবাসি ভাইয়া। আমি আমি তোর সব স্বপ্ন পূরণ করবো তোর সব কথা শুনবো৷ সারাদিন পড়াশোনা করবো কিন্তু তুই স্যারকে ভুলে যেতে বলবি না প্লিজ

– কেনো বলবো না,এ-ই জন্য যে ওরা তোকে আবার অপমান করবে আবার তোর গায়ে হাত তুলবে এ-ই জন্য

– স্যার তো জানে না এসব বল। আমি স্যারকে বললে..

– কি বললে হ্যা কি বললে,আমি বলছি তুই উজানের সাথে মিশবি না তারপরো তুই আমার মুখের উপর কথা বলছিস যে..

আবারো হিয়ার গালে দু তিনটা থাপ্পড় দিতে চাচি এবার রেগে উঠে শিশিরকে আটকালো,ঝাঁঝালো কন্ঠে বললো

– এখন বোনের উপর জোরাজোরি কেনো করছিস,যখন ওরা আমাদের মেয়ের গায়ে হাত তুললো তখন কি করছিলি তুই?

– উনি শুধু রোদের মা ছিলো বলে আমি চুপ করে গিয়েছিলাম চাচি।

– হ্যা অনেক ভালো করছিস এখন ছাড় হিয়াকে..এখন না মেরে ছোট থেকে শাসন করলে এ-ই দিন দেখতে হতো না। রোদকে বলে দিবি আর যেনো সে এ বাড়িতে না আসে।মেয়েটা ভালো কিন্তু ওর বাবা মায়ের যা আচরণ শুনলাম। আর উজানকেও বলবি ঘনঘন এ বাড়িতে আসার আর তার দরকার নেই,কি আছে তোর সাথে সব বাহিরে।

এটুকু বলে চাচি রুম থেকে বেড়িয়ে যাবার আগে কাঠ কাঠ কন্ঠে জানালো,

-আমি কিন্তু আমার সংসারে কোনো অশান্তি চাই না শিশির।

শিশির শ্বাস টেনে বললো,

– আজ অবধি আমার আর হিয়ার জন্য বাড়িতে কোনো অশান্তি হয়েছিল কি চাচি। হয়নি। আর সামনেও হবে না। অশান্তির সব পথ বন্ধ করে দেবো আমি আজকেই..

বলেই হিয়াকে রুমে বন্দি করে সবাইকে বের করে দিলো শিশির। হিয়াকে তালা বন্দি করতে করতে বললো,

– এতো লোভ তোর,আজকে সব বের করবো আমি। এরপর থেকে আমার অনুমতি ছাড়া বাহির তো দূর উঠোনেও তোর যাওয়া বন্ধ। আমার সাথে কলেজ যাবি আমার সাথে আসবি। কোচিং প্রাইভেট সব বন্ধ। আমি পড়াবো তোকে..

!
!
মাটিতে লুটিয়ে অঝোরে কেঁদে ভাসাচ্ছে হিয়া। মনে হচ্ছে এ-ই পৃথিবীতে ভালোবাসার মতো অপরাধ কিছু নেই আর কিচ্ছু না। আর সবচাইতে বড় অপরাধী সে নিজে। কেনো এতো ভালো বাসতে গেলো সে উজানকে। কেনো এতো ঘনিষ্ঠ হলো সে আর উজান। কেনো? আজ যা তার জন্য তার শিশির ভাইকে কষ্ট পেতে হচ্ছে এর জন্য আসলে দায়ী কে?

– আমি লোভী না ভাইয়া। আমি সত্যি জানতাম না এই লকেট টার এতো মূল্য ছিলো যার কারণে তোকে এতো মূল্য দিতে হবে…উজান স্যারকে আমি অনেক ভালোবাসি ভাইয়া..আপনি কোথায় উজান স্যার..ভাইয়া আমাকে ভূল বুঝছে। আপনি তাড়াতাড়ি আসুন না। আমার সাড়া শরীরে খুব ব্যাথা হচ্ছে গায়ে জ্বালা করছে কোথায় আপনি….

কথা গুলো বলতে বলতে ডুকরে উঠলো হিয়া। লুটিয়ে পড়ে শুইয়ে পড়লো সেই পানি ভেজা মেঝেতে। সারা শরীর ব্যাথায় কাঁপুনি দিতে থাকলো হিয়ার। মাথা ঝিমঝিম করতে থাকলো। একটা গোল্ডফিস লাফিয়ে হিয়ার কাছে এসে পড়লো। কান্নারত চোখে তার দিকে তাকিয়ে রইলো হিয়া। মাছ টাও বোধহয় হিয়ার এ-ই ব্যাথায় ব্যাথিও হচ্ছে অনেকটা। ফোলা ফোলা চোখ দুটোও অন্ধকারের মতো ঝাপসা হয়ে গেলো। চোখ বুজলো হিয়া। বন্ধ চোখ বেয়েই গড়িয়ে পড়তে থাকলো চোখের পানি। ক্লান্তিতে একসময় ঘুমিয়ে গেলো মেয়েটা। গলার কাছে চিলিক দিয়ে বের হওয়া রক্ত টা একটু শান্ত হলো..

এদিকে বোনকে আজ এভাবে আহত করে নিজেও নিজেকে শাস্তি দিতে থাকলো শিশির। যেই হাতে হিয়াকে মেরেছে সেই হাতে ভাঙ্গা কাঁচের টুকরো বিধিয়ে নিজের অশান্ত মনকে শান্ত করার আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে সে। হাত দিয়ে চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে রক্তের বারিধারা। নিজের সন্তান তুল্য বোনকে এতোটা আঘাত করবে জীবনেও কল্পনা করে নি সে,ভুলেও না!

– আমি হিয়াকে মারলাম মা,আমি আমাদের বাচ্চা টাকে এরকম করে মারলাম আজ। হিয়ার কি খুব কষ্ট হচ্ছে মা। আমি হিয়াকে মারলাম বলে বাবা আমার সাথে কথা বলতে চাইছে না তাই না। আমি একটা খারাপ ভাই খুব খুব জঘন্য আমি। খুব বাজে!

!
!
!

একদিন পর;

উজান আজ তার কাজ টুকু সেরে শহরে পা রাখতে না রাখতে সোজা বাস থেকে নেমে রওনা হয় হিয়ার বাড়ির পথে। এই দুই দিন তার হিয়া পিচ্চি যে বড্ড ভাবিয়েছে তাকে। হিয়ার ফোন তো বন্ধ বন্ধ, তার উপর শিশির অবধি তার ফোন টা রিসিভ করে দায় সাড়া ভাবে কথা বলছে। বাসের সীটে চোখ বন্ধ করে হিয়াকে নিয়ে ভাবতে গিয়ে উজান বুঝেছে হিয়া ছাড়া তার জীবনটা ধূ ধূ মরুভূমির মতো৷ যার অস্তিত্ব আছে ঠিকই কিন্তু সেখানে হিয়া ছাড়া বেঁচে থাকা অসম্ভব অকল্পনীয়। হিয়া তো তার জীবনের সেই মরুভূমির এক পশলা বৃষ্টি! দীর্ঘ শ্বাস ফেললো উজান। যাকে দুদিন দেখতে না পেয়ে আমি ঘুমোতে পাচ্ছি না সেই মেয়েটাকে দেখো কিরকম দিব্যি আমাকে ভূলে গিয়ে ভালো আছে! মানুষ তো একটা ফোন করে নাকি। চিন্তা হয় না আমার। যা-ই শুধু এগুলো যতসব যা কিনেছি ওর জন্য একটা কিছু ওকে দেবো না। হু.

কিন্তু উজান তো আর জানে না তার হিয়া ভালো নেই। কালকে সারাদিন নিজের ঔ বদ্ধ ছোট্ট রুমটায় আহাজারি করেছে সে। একটু শব্দতেই মনে হচ্ছে এ-ই তো বুঝি উজান স্যার আসলো তাঁকে বাঁচাতে,বন্দি খাঁচা থেকে মুক্ত করে তার খোলা আকাশে উড়িয়ে নিয়ে যেতে। কিন্তু উজান আসে নি। না সেদিন না কালকে। তার উপর শরীরের ব্যাথা গুলো তীব্র থেকে তীব্র বেগে বাড়ছে তার। চাচি খাবার দিয়ে গেলেও এক লোকমা খেয়ে বমি করে ভাসিয়ে দিয়েছে মেয়েটা। তবু শিশিরের পাথর মন গলাতে পারে নি হিয়া। পারেনি নিজের ভাইয়ের অভিমানের পাহাড় কাটতে। ভোরের দিক থেকে তীব্র জ্বরে ককিয়ে উঠে হিয়া। কিন্তু ভাইকে ডাকার সাহসটুকু আনতে পারে নি মনে। সকালে চাচি নাস্তা দিতে রুমে আসতেই হিয়ার শরীরে হাত রাখতেই কেঁপে উঠে। একি, মেয়ের গা তো আগুনের মতো গরম!

কাজ ফেলে জলদি বাড়িতে আসলো শিশির। ঘড়িতে তখন এগারোটা ছুঁই ছুঁই। মুর্ছে যাওয়া বোনকে নিজের বুকে আগলে নিয়ে থার্মোমিটারে জ্বর মাপলো শিশির। যা বুঝলো হিয়ার অবস্থা ভালো না। দূত ডাক্তার দেখাতে হবে। চাচিকে দিয়ে সদরদরজার বাহিরে রিক্সা দাঁড় করালো শিশির। হিয়াকে কোলে নিয়ে আসলো উঠোন পেড়িয়ে মাঝরাস্তায়। ইতিমধ্যে উজানো এসে উপস্থিত সেই পথে। আজ কদিন বাদে পিচ্চি টাকে দেখবে সে। শত মাইলের ক্লান্তি থাকলেও হিয়া পিচ্চিকে দেখার আনন্দে শরীর ভুলে গেলো তার সেই ক্লান্তি। মুখে এক আবেগী হাসি টেনে আসছিলো উজান। কিন্তু না মুমূর্ষু হিয়ার দিকে চোখ পড়তেই দমটা ওখানেই আঁটকে গেলো তার! হিয়া অসুস্থ!

হিয়া ঝাপসা চোখে উজানকে দেখতে পেলেও শরীর নাড়িয়ে কিছু বলার শক্তিটুকু যোটাতে পারলো না৷ মনে শান্তি পেলো অনেকটা। কিন্তু লাভ হলো না কিছুই! উজান হকচকিয়ে হিয়াকে ধরতে আসতেই বাঁধ সাধলো শিশির। খানিকটা থমকে গিয়েও হিয়ার দিকে তাকাতে বুকটা ছিঁড়ে আসলো উজানের। শিশিরকে পাওা না দিয়ে হিয়াকে ধরতে যাবে ওমনি এবার বাঁধ সাধলো চাচি। চোখের ইশারায় শিশিরকে বললো আমি হিয়াকে নিয়ে যাচ্ছি তুই আয়। ব্যাপারটায় এবার অনেকটা অবাক হলো উজান। চাচি হিয়াকে নিয়ে হসপিটালের দিকে রওনা দিতেই শিশির উজানকে নিয়ে হেঁটে আসলো একটু সামনে। শিশির চুপচাপ। কিন্তু উজান না। তার মুখে অনবরত একটাই বাক্য বের হচ্ছে “হিয়ার কি হয়েছে শিশির। হিয়া এরকম করছে কেনো?”

নিশ্চুপ শিশির তার পকেট থেকে সেই চেইন আর লকেট টা উজানের হাতে ধরিয়ে দিয়ে শান্ত গলায় বললো,

– তুই আমার অনেক কাছের একটা মানুষ উজান। আমি চাই না কোনোকিছুর জন্য তোর আর আমার সম্পর্ক টা নষ্ট হোক। বাকিটা তুই অনেক বুঝদার I hope তোকে আর এ বিষয়ে কিছু বলতে হবে না!

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here