চোখের_তারায়_তুই? #পর্ব_২২

0
676

?#চোখের_তারায়_তুই?
#পর্ব_২২
#ইভা_রহমান

কুয়াশাচ্ছন নির্মল প্রকৃতি। চারিদিকে বিরাজ করছে পিনপতন নীরবতা। শুধু কিছু পাখির গুনগুন কানে ভাসছে। কানে ভাসছে হাওয়াতে উড়তে থাকা দূরের কোনো এক গাছের ডালের মড়মড় ধ্বনি। আকাশে সূর্য্যিমামার অস্তিত্ব চোখে পড়লেও তার তেজ এতোই কম যে যেনো দেখে মনে হচ্ছে সূর্য্যি মামা এ-ই ধরনীতে তার হাজিরাটুকুই দিতে এসেছে। এমনকি কিরন বিলিয়ে উওাপ ছড়ানোর যে প্রয়াস তা আজ তার মাঝে নেই। সবুজ ঘাস গুলো দেখে মনে হচ্ছে শিশির ভেজা সকাল তাদের গোসল করিয়ে দিয়ে এখনো গা টা মুছে দেয়নি ভালো করে। বাড়ি থেকে খানিকটা দূরে সেই ধান ক্ষেএের মাঝে এক মাচা তে ঋতুকে নিয়ে বসে আছে হিয়া। আজ প্রায় তিনদিনের কাছাকাছি শিশির হিয়াকে আবার তাদের গ্রামের বাড়িতে তার মামার কাছে রেখে গিয়েছে। আর বলেছে এখন থেকে নাকি হিয়া এখানেই থাকবে। হিয়ার শহরের সমস্ত পার্ট চুকু ফেলবে তার এই পাথর সমান ভাই। যদিও শিশির এরকম কিছুই করবে না শুধু বোনকে একটু শাসাতে আর উজানের থেকে দূরে রেখে হিয়ার মনটাকে নরম করতে হিয়াকে এই শত মাইল দূরে তার রেখে যাওয়া। কিন্তু ভালোবাসার মানুষ ছাড়া মন কি এ-তো সহজে নরম হতে পারে! শিশির বুঝতে ব্যর্থ হয়েছে। ভেবেছিলো দূরত্ব বাড়িয়ে দিলে ভালোবাসা মলিন হয়ে মিশে যাবে একটা সময়। কিন্তু দূরত্ব যে ভালোবাসাকে ভুলিয়ে না বরং তার মাঝে গভীর দাগ তৈরি করে, সেটা কি তার পাথর মন কখনো বুঝবে।

পা দুলিয়ে হিয়ার সাথে গল্প করতে ব্যস্ত ঋতু। এ-ই দুদিনে হিয়ার সব কাহিনি,তার শুনে নিয়ে বুঝে গিয়ে হজম করা শেষ। এখন তার একটাই উদ্দেশ্য বিচলিত হিয়াকে শান্ত করা। কিন্তু এ-ই মেয়ে তো শান্ত হবার বদলে সময়ে সময়ে উজান স্যার উজান স্যার করে হেতিয়ে মরছে,দেখো তো কি জ্বালা!

– দেখ হিয়া তুই যদি এখনো তোর ঔ ঠকবাজ স্যারের জন্য নাকের পানি চোখের পানি এক করিস তাহলে কিন্তু আমি এ-ই,আমি এ-ই হু আমি এই ফাঁকা ক্ষেত্রে তোকে একা রেখে বাড়ি চলে যাবো।

– তোর যেতে ইচ্ছে হলে তুই যা কিন্তু খবরদার আমার স্যারকে ঠকবাজ বলবি না ঋতু।

– এএ পিরীতি দেখলে তো গা জ্বলে যায়। এতো যখন স্যার তোকে ভালোবাসে তাহলে আসলো না কেনো তোকে নিতে…শোন..ওসব বড়লোকের ছেলেদের বিশ্বাস নাই দেখলি না হৃদয় তন্নির সাথে কি করলো। সব মজা লুটে নিয়ে বিয়ে করলো কাকে নিজেদের লেভেলের একজনকে..এরপরো তুই বলবি যে তোর স্যার ভালো মানুষ।

– আমি কি তোকে এসব বলতে এখানে নিয়ে আসলাম ঋতু! যা তুই।লাগবে না আমার কাউকে। সব ছেলে হৃদয় হয় না। আমার উজান স্যার সবার থেকে আলাদা।

– হ্যা ঔ কর। এরপর শিশির ভাই আসুক আমি দেখ কি বলি। এখনো ভীমরতিতে ভুগছে তোমার বোন। এতো মাইর খাবার পরো উজান কুজান ফুজান করে যাচ্ছে দিনরাত হু।

– আহ ঋতু বড্ড বেশি কথা বলিস তুই। বলছি আমার ভালো লাগছে না। যা তো তুই, আর সারাদিন আমার ধারেকাছে আসবি না..বেয়াদব।

হিয়াকে ভেংচি দিয়ে ঋতু হনহন করে বাড়ির রাস্তার দিকে হাটা ধরলো। দিনে একশোবার হিয়ার সাথে লাগে তার কিন্তু ঘুরেফিরে আবার ভাব হয়ে যায় দু’জনের। ঋতু চলে যেতেই চারপাশ টা আরো নীরবতা ধারণ করলো। হিমেল বাতাসে হিয়ার গা শিউরে উঠলো। গায়ের চাদর টা আঁকড়ে হিয়া একটা শ্বাস ফেললো। ঘন কুয়াশার তাতে একটু ধোঁয়া উড়লো।

আনমনে আপন খেয়ালে মগ্ন হিয়া। আজ তো তিনদিন হবে তাহলে কি ঋতুর কথাই ঠিক। উজান স্যারকি সত্যি তাহলে আসবে না হিয়াকে নিতে! আর ভাবতে পারলো না হিয়া। ভাবনার অতলে যাবার আগেই চোখ ভিজে আসলো তার। মাচা থেকে নেমে পায়ের জুতো টা পড়ে যেই সামনে হাঁটতে যাবে ওমনি চোখ পড়লো তার থেকে চার পাঁচ হাত দূরে দাঁড়িয়ে থাকা তার উজান স্যারের উপর! থমকে গেলো হিয়া। সাথে থমকে উঠলো শীতলতায় ছোঁয়া চারিপাশ। দমটাকে সামলে নিয়ে হিয়া চোখ পিটপিট করে দেখতে থাকলো এটা কে?

মাটির সাথে পা আঁটকে গেলো হিয়ার। উজানকে দেখে যেনো নড়ার শক্তি হারিয়ে ফেললো মুহুর্তে। হাত পা কাঁপছে, ঠোঁট নড়ছে কিছু বলতে চাচ্ছে হিয়া কিন্তু বলতে পারছে না। চোখ দিয়ে টপটপ শিশির ফোঁটার মতো পানি ঝরছে। মুখের মধ্যে অভিমান আর অভিযোগের প্রতিচ্ছবি দেখা মিলছে স্পষ্ট। এতো কেনো আসতে দেড়ি হলো আপনার উজান স্যার। এতো কেনো?

হিয়া এগিয়ে উজানকে আঁকড়ে ধরার শক্তি আনতে পারলো না। উজান নিজেই পায়ে হেঁটে হিয়ার মুখোমুখি দাঁড়ালো। চোখের ভাষায় হিয়া তার অভিযোগ এর গভীরতা বুঝতে চাইলো উজানকে। হিয়ার এ-ই করুন চাহনি বুকে কাঁটার মতো বিধলো উজানের। হ্যাঁচকা টেনে হিয়াকে নিজের বুকে এনে ফেললো উজান। বাঁধ ভাঙ্গলো হিয়ার। হাউমাউ করে কেঁদে ভাসিয়ে দিলো উজানের বুক। জড়িয়ে রাখা বাধান টা শক্ত হতে থাকলো ক্ষনে ক্ষনে।

কিছুসময় বাদে অভিমানী হিয়া কাঁদতে কাঁদতেই বললো,

-ঋতু বললো আপনি নাকি আর আসবেন না। আপনিও হৃদয় এর মতো ফাঁকি দিয়ে আমাকে ভুলে যাবেন। আমি। আমি তখন বললাম, না, আমার উজান স্যার বাকি সবার থেকে আলাদা। উনি কখনো তার হিয়াকে ঠকাতে পারে না। উনি আসবে। আমার আমার মন বলেছিলো আপনি আসবেন। আপনি আমাকে ভুলে যেতেই পারেন না। ঋতু ভূল বলেছে তাই না বলুন।

হিয়ার মাথায় বুলে রাখা হাত গুলো আরো গভীরভাবে বুলে দিয়ে উজান বললো,

– হুম ঋতু ভুল বলেছে..চুপ এখন আর কান্না চাই না আমি তোমার চোখে। আমাকে চাচি সব বলেছে।

আদুরে হিয়া উজানের আশকারা পেয়ে যেনো আরো আদুরে হয়ে উঠলো। উজানকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে নিয়ে বললো,

– চাচি চাচি কথা বলেছে আপনার সাথে? চাচি বলেছে আপনাকে,ভাইয়া আমাকে এখানে রেখে গেছে,বলেছে আমি যদি আর কখনো উজান স্যার উজান স্যার করি তাহলে আমার সব পড়াশোনা নাকি বন্ধ করে দিবে।

উজান দীর্ঘ এক শ্বাস টেনে বললো,

– হুম চাচি সব বলেছে আমাকে। তোমাকে শিশির কিরকম করে কতোটা মেরেছে,কি কি অপমান তোমাকে আমার বাড়িতে ফেইস করতে হয়েছে সব বলেছে।

– আমার খুব কষ্ট হচ্ছিলো সেসব সহ্য করতে আমি না আপনাকে বলে বোঝাতে পারবো না।

– জানি।

উজান হিয়ার কান্না রত মুখ টা তুলে তার দু’হাতের তালুতে ধরলো। বুড়ো আঙ্গুল প্রসারিত করে হিয়ার দু চোখ মুছে দিলো তার নরম হাতে। একটু শান্ত হলো হিয়া। কান্না থামিয়ে বললো,

– ভাইয়া কখনো রাজি হবে না উজান স্যার।

ভারী আর গম্ভীর কন্ঠে উজান বললো,

– তোমার ভাইয়া না তোমার চৌদ্দগুষ্টি নাচতে নাচতে রাজি হবে আমাকে তো চিনে না এখনো।

– আর আপনার পরিবার। কেউ রাজি হবে না উজান স্যার ইভেন আপনার মা’ও না। ভাইয়া ঠিকই বলে আমি আপনার জন্য না।

হিয়া’র ঠোঁট আঁটকে ধরলো উজান,

– চুপ…ফার্দার আর এ-ই কথা টা আমি তোমার মুখে যেনো না শুনি হিয়া।

– আপনি পারবেন আমার জন্য আপনার পরিবারকে ছাড়তে?

– সময় আসলে দেখবা সেটা তুমি।

– আর শিশির ভাইয়া?

– তোমার ভাইয়াকে তো আমি পরে দেখে নিচ্ছি। শিশিরের সাহস হয় কি করে তোমাকে এভাবে আঘাত করার। তোমার ভাইয়ের কপাল ভালো যে আমি তার হাত দুটো এখনো দু টুকরো করিনি।

ভূ কুঁচকে তাকালো হিয়া। তার ভাইয়ের হাত ভাঙ্গতে চাইছে কিরকম দেখো।

– হোয়াট। এভাবে তাকানোর কি আছে ভাইকে নিয়ে বললাম বলে খুব রাগ লাগলো।

হিয়া উজানের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে চোখ নাক মুছে মাচা টায় বসতে বসতে বললো,

– ভুলে যাবেন না সে আপনারো বেস্ট ফ্রেন্ড হয়।

উজান হিয়ার পাশে বসে সেই মাচা টায় শুইয়ে পড়লো। আকাশপানে তাকিয়ে হিয়ার এক হাত নিজের বুকের কাছে টেনে রেখে বললো,

– না যা-ই নি ভুলে না তোমাকে না শিশির কে।

– হুম৷ তা এরপর কি করবেন ভাবলেন?

– কিছু না। যেভাবে প্রেম করেছি এতোদিন সেভাবে প্রেম করবো।

– কি করে এখনো,এতোকিছুর পরো এসব কথা বলছেন বলুন তো আপনি। ভয় করে না আপনার?

উঠে বসে হিয়ার নাক টেনে ধরে উজান বললো,

– না। কাকে ভয় করবে তোমার ভাইকে। সে বাঘ না ভাল্লুক যে আমি তাকে ভয় পাবো?

– বাঘও না ভাল্লুক ও না ভাইয়া যে কি না সেদিন একটার পর একটা চড় থাপ্পড় খাবার পর বুঝেছি আমি….আচ্ছা উজান স্যার সত্যি যদি ভাইয়া বা আপনার পরিবার কেউ রাজি না হয় তখন কি করবো আমরা?

– পালিয়ে যাবো!

চোখ বড় বড় করে উজানের দিকে তাকালো হিয়া। কি বলে এ-ই লোকটা। মাথা টাথা গেছে নাকি পুরো!

– হুম যেখানে দুচোখ যাবে তোমাকে নিয়ে পালিয়ে যাবো। হারিয়ে যাবো।গুম হয়ে যাবো।

– আহা ইআরকি না। আমি সিরিয়াসলি জানতে চাচ্ছি। বলুন নাআআআ..

উজান হিয়াকে নিজের বুকে আগলে ধরে বললো,

– তুমি উচ্চ মাধ্যমিক টা শেষ করে এডমিশন দেও। এর মধ্যে আমি ইন্টার্নি টাও শুরু করি দেন আমি তোমার ভাইয়ের কাছে বলবো তোমাকে আমার হাতে তুলে দিতে। আর বাই এনি চান্স যদি কেউ রাজি না থাকে দেন আমরা বিয়ে করে নিয়ে আলাদা থাকবো। ঠিক আছে।

– কিন্তু এতো জলদি বিয়ে?

– হুম। তোমার ভাই আর চাচিদের যা কথা শুনে বুঝলাম ওরা তোমাকে বেশিদিন বাড়িতে রাখবে না অর্নাস পড়তে পড়তে তোমার একটা ব্যবস্থা করবে এর চাইতে আমরা বিয়ে করে নিলে ভালো হয় না বলো..

– কিন্তু এ-ই এক বছর কি করে ভাইয়াকে? ভাইয়া তো আমার সব বন্ধ করে দিচ্ছে।

– কিচ্ছু বন্ধ করবে না শিশির তোমার। হ্যা এখন একটু রাগে আছে অভিমান করেছে শিশির৷ রাগ টা কমলে নিজে তোমাকে নিতে আসবে দেখো তুমি।

– আমার ফোন টাও তো কেঁড়ে নিছে।

– আচ্ছা নিক। রাগ কমলে দিয়ে যাবে। এখন আমাদের একটু কিছুদিন শান্ত থাকতে হবে। শিশির পুরোপুরি শান্ত হলে আমি কথা বলবো ওর সাথে। তুমি এসব নিয়ে একদম ভাববে না।

– আমার খুব ভয় করে আপনি বুঝবেন না। ভাইয়া এবার অন্যরকম রেগে আছে!

– আমি আছি না। কেনো ভয় তোমার তারপরো। আমি তো বলছি এদিকে কি হয় হবে সব সামলে নেবো আমি। তুমি জাস্ট তোমার পড়াশোনা তে ফোকাস করবে হিয়া। নাহলে কিন্তু আমি এবার খুব রাগ করবো।

হিয়া মুখে একফালি হাসি টেনে বললো,
– হু হু করবো তো পড়াশোনা। এতোদিন আপনাকে এক নজর দেখবো বলে কিছু পড়তে পারছিলাম না জানেন। এ-ই যে আজ আপনি আসলেন আমি মনে জোড় পেলাম এখন দেখুন আমার পড়াশোনা কেমন মেট্রোরেলের মতো আগাতে থাকে।

– পাগলি,দেখি,চোখ মুছো ভালো করে।

– হুম ছাড়ুন এখন। গ্রামে কেউ দেখলে না। হয়ে যাবে..

উজান হিয়াকে ছাড়িয়ে দাঁড়িয়ে গেলো। কুয়াশার চাদর জড়িয়ে হিয়া তার গ্রাম ঘুরিয়ে দেখাতে থাকলো উজানকে। ভুলে গেলো এই দুদিনের শরীরের সব ক্লান্তি,মনের শত আহাজারি।

– কোথায় নিয়ে যাচ্ছো হিয়া আমাকে।

– আরে আসুন না..খেজুরের রস খাবো আসুন৷ খেয়েছেন কখনো ইসস কি মজা। শীতের সকালের এই খেজুরের রস উফ!

– আরে থামো,যাচ্ছি তো। ওদিকে বাড়িতে কেউ খুঁজলে তখন?

– আরে ঋতু আছে না সব সামলে নেবো। আসুন তো..

– হুম,তুমি খেজুরের রস খাবে আর আমি তোমার এ-ই ঠোঁটের!

উজানের হাতে একটা জোড়ে করে কিল বসালো হিয়া। আহ বলে হাত টা ঝারি দিতে থাকলো উজান। দৌড়ে এসে বাহুতে হাত বুলে দিয়ে আবারো উজানের বাহু ধরে হিয়া বললো,

– অসভ্য একটা! সবসময় বাজে কথা।

!
!

ভার্সিটি ক্যাম্পাসের পেছনের দিকে রোদকে নিয়ে এক বিস্তর সবুজ ঘাসের উপর বসে আছে শিশির। রোদের চোখে মুখে অনুতাপের ছাপ,ঝর্ণা ধারার মতো প্রবাহিত হচ্ছে সেই অশ্রু। গাল বেয়ে চুইয়ে চুইয়ে পড়া সেই পানি দেখেও চোখ ফিরিয়ে নিচ্ছে শিশির। গত আধাঘন্টা যাবৎ এই কাহিনি চলছে। রোদ কাঁদতিছে আর শিশির গ্রাসে গ্রাসে সিগারেট টানছে।

রোদ গা ঘেসে আছে শিশিরের। ফুসছে আর ফুসছে। শিশির শান্ত কিন্তু কঠিন!

হাতে থাকা সিগারেটটা’র শেষ অংশটুকু পুড়ে নিয়ে শিশির তাদের নীরবতার অবসান ঘটিয়ে বললো,

– রোদ,কি দিয়ে কি কথা শুরু করা উচিৎ আমার জানা নেই। তুমি নিজে সেদিন সব দেখলে। এরপরো তুমি চাইবে আমার সাথে জড়াতে?

– শিশির সেদিন যা হয়েছিল আমি নিজেও হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলাম। আম্মু হুট করে হিয়াকে ওভাবে..

– আমি ওসব কথা আর মনে করতে চাই না রোদ। তুমি তো জানো আমি হিয়ার ব্যাপারে কতোটা পজেসিভ। উনি শুধু তোমার মা ছিলেন বলে কিন্তু আমি একটা আওয়াজ অবধি করিনি সেদিন। কিন্তু এটা সবসময়ের জন্য না। এরপর আমি যে কি করবো সেই ধারণাও তোমার নেই রোদ।

– আর কখনো আম্মু এরকম করবে না বিশ্বাস করো। উজান আছে তো সব সামলে নিবে।

– সামলে আমিও নিতে পারবো রোদেলা। কিন্তু নিজের বোনকে এভাবে কারো পুতুল বানিয়ে না। তুমি হয়তো আমার জীবনে হিয়ার গুরুত্ব কি, এখনো সেটা উপলব্ধি করতে পারোনি রোদ!

– তা নয় শিশির। আমি তো জানি হিয়া তোমার কাছে সন্তানতুল্যা। তুমি নিজ হাতে হিয়াকে কোলেপিঠে মানুষ করে বড় করেছো। আমি বুঝি তোমার কষ্ট টা।

– এতো যখন সব বুঝো তাহলে কেনো এতো জীদ করো তুমি রোদ। এ-ই যে আসছি থেকে তুমি কান্না করতিছো। কিসের জন্য। আমার খারাপ লাগে না। চুপ করো একটু..

শিশির রোদকে চুপ করতে বললেও রোদ থামলো না। রাগ অভিমান অভিযোগ ক্ষোভ সব এক হয়ে জমা হলো রোদের মাঝে।

-রোদ তুমি আমাকে সময় দেও। আমরা দুজনে অনার্স টা শেষ করি। আমি বিসিএস টা ট্রাই করি। আর বাবার অফিসে তো আমার একটা জবের কথাও আছে। এখন তুমি ভাবো আমার একটা ব্যাংকে জব বা সরকারি চাকরি হলে তোমার পরিবারো নিশ্চয় একটু আমাদের বিষয় টা বিবেচনা করবে তাই না।

কান্নারত মুখে বিনীতর সুরে রোদ বললো,

– তোমার যতো সময় লাগে তুমি নেও। কিন্তু সব শেষ করতে বলো না প্লিজ..

– সব শেষ হবার প্রশ্ন না রোদ। প্রশ্ন ভালো থাকার। যেটা আমি তোমাকে কখনো প্রভাইড করতে পারবো না রোদ।

– আমি সব ছেড়ে চলে আসবো শিশির।

– প্রশ্ন সেটাও না রোদ। ঠিক আছে আমি ধরে নিলাম তুমি সব সম্পর্ক ছিন্ন করে আমার কাছে আসলে, আমি তোমাকে স্ত্রীর মর্যাদা দিয়ে ঘরে তুললাম। তারপর। তোমার বাবা আর্মি তে রোদ,কতো বড় বড় মানুষদের সাথে ওঠাবসা ওনার। আমার ক্যারিয়ার নষ্ট করতে ওনার দুমিনিটো সময় লাগবে না।

– তুমি এখন তোমার ক্যারিয়ার নিয়ে ভাবছো শিশির!

তাচ্ছিল্যের এক হাসি দিয়ে শিশির বললো,

– যদি তাই ভাবতাম তাহলে পরিণতি ঠিক কতোটা ভয়ানক হবে সেটা জানা সাপেক্ষেও তোমার সাথে জড়াতাম না রোদ।

রেগে গেলো রোদ। রাগান্বিত সুরে বললো,

– তাহলে কিসে বাধছে তোমার একটু বলবা দয়া করে। নাকি ধরে নিবো এতোদিন আমাদের মাঝে যতো যা হয়েছে,যতো যা ইনটেমছি তৈরি হয়েছে সব মিথ্যা ছিলো,শিশির শুধু রোদের শরীর ছুঁয়েছে আর কিছু ছিলো না এরমধ্যে। এটাই তো বলো।

সপাটে এক চড় পড়লো রোদের গালে। তব্দা খেয়ে রোবটের মতো থ হয়ে আহাম্মক বনে বসলো রোদ। কান এখনো ভনভন করছে তার। মনে হয় পর্দায় দু তিনটা ফুটো হয়ে গেছে ইতিমধ্যে……!!!!

অঝোরে ধারা প্রবাহিত করে কাঁদতে শুরু করলো রোদ। এদিকে রক্তবর্ণ চোখে রোদের চুল মুঠো করে ধরে নিজের কাছে এনে ঠেকালো শিশির। চোখে চোখ চেয়ে বললো,

– তোকে আমি কতো কি ভালোবাসি এটা তোর না জানলেও চলবে। তোর যদি মনে হয় আমি তোর শরীর টাই খাইছি তুই তাই নিয়ে থাক। এ-ই শিশিরের দিকে ভুলেও হাত বাড়াবি না আর।

কান্নারত কাঁপা কন্ঠে রোদ বললো,

– তাই তো চাইতিছো তুমি। আমি আর তোমার দিকে হাত না বাড়াই।

– হ্যা চাইতিছি কেনো চাইতিছি সেটাও তুই জানিস। আর এরকম কাঁদতিছিস কেন তুই। আমি তোকে মারছি?তোকে আঘাত করছি? তাহলে কানতিছিস কেন…রোদ চুপ কর কিন্তু…চুপ করবি না তুই?

রোদ চুপ করে না। চোখ দিয়ে চুইয়ে চুইয়ে পানি পড়তে থাকে তার। এতো কান্নার পানি যে একটা মেয়ে মানুষের চোখে কেমন করে যে সৃষ্টিকর্তা জমা করে রাখে উনিই ভালো জানেন। রোদের এই ননস্টপ চোখের পানি সহ্য করতে পারছিলো না শিশির। এ-ই মেয়ে কি বোঝে না সে কাঁদলে কতোটা আঘাত লাগে আমার মনে। রাগে রোদের চুলের মুঠ আরো শক্ত করে পেঁচিয়ে ধরে রোদের গাল চিপে ধরলো শিশির। আজকে নির্ঘাত খু*ন হবে এ-ই মেয়ে শিশিরের হাতে।

– বললাম কাঁদবি না,তাও কাঁদিস৷ তোর পরিবার কি কান্না ছাড়া তোকে আর ভালো কিছু শিখাইতে পাই নি। যখনই কিছু বলি তখনই কান্দিস। তুই কি বাচ্চা ছেলে রোদ..

– কেনো কাঁদি,আঘাত করো দেখি তো কান্না করি।

দীর্ঘ শ্বাস ফেলে শান্ত ভঙ্গিতে এক হাতে রোদের কোমড় জড়িয়ে আরেক হাতে রোদের গালের শক্ত বাধন হালকা করে শিশির বললো,

– আমি কি আঘাত করছি তোমাকে রোদ? সেদিন রিফাতের বাড়িতে আমাকে কে নিয়ে গিয়েছিলো রিফাতের বোনের রুমে! বলো? আমি তো তোমাকে বলেছিলাম রোদ আমি তোমাকে হালাল ভাবে গ্রহন করতে চাই তারপরো তুমি শোনোনি আমার কথা।

– তো কি হয়েছে। কি এমন করেছি সেদিন। একটু জড়িয়ে ধরেছি। তোমাকে কিস করেছি। তুমি আমাকে স্পর্শ করেছো। এ-ই তো এতটুকু। তাতেই তো সবাই চলে আসলো কিছু হয়েছে কি এরপর?

– সেটুকুই বা কেনো হতে যাবে। আমি বারন করিনি তোমাকে।

আরো রেগে উঠে নাক ভর্তি পানি টেনেটুনে রোদ বললো,

– এখন সব আমার দোষ। তুমি কেনো আটকাও নি নিজেকে তখন।

– কতো আটকাবো আর। আমি একটা ছেলেমানুষ রোদ! সব সময় নিজেকে সংযত রাখতে পারিনা তোমার সামনে।

– ও তাই,বুঝলাম। সেদিন কার কথা না হয় বাদ দিলাম। তার আগে যা সব হতো আমাদের মাঝে। ঔ ফাঁকা ক্লাস রুমে কে নিয়ে যেতো আমাকে। আমাকে আদর কে করতো,কে জড়িয়ে রাখতো,কে আমার ঠোঁট খেতো!

– ঠোঁট খাবার জিনিস না রোদ।

– তাহলে কি করতে আমার ঠোঁট নিয়ে চড়ুইভাতি খেলতে।

দাঁতে দাঁত চিপে নিজের রাগ টাকে কন্ট্রোল করলো শিশির। মাঝেমধ্যে রোদের কথা শুনলে তার এমনি মেজাজ বিগড়ে যায় যে না এই কথার মানে সে নিজে বুঝে ঠিকমতো না রোদকে এরপর কিছু বলে বোঝাতে পারে..

– stupid!

রাগে শিশিরের শার্টের কলার আরো জোরে চিপে ধরলো রোদ। এতো বড় সাহস আমাকে স্টুপিড বললো।

– আমি স্টুপিড হলে তুমি কি!

– মাঝেমধ্যে তুমি হিয়ার চাইতেও বাচ্চামি করো রোদ। তুমি ছোট না যে কিছু বুঝো না। তোমার কপালে বা ঠোঁটে কিস করা আর সেদিন যা হয়েছে দুটো এক জিনিস না।

– আচ্ছা মানলাম দুটো এক জিনিস না। তা প্রেম টা যে করো ওটা হারাম না৷ ওটা করো কেনো তাহলে। তখন হালাল হারাম মনে থাকে না।

রাগে রোদকে এক ঝাটকায় ছাড়িয়ে হাত জোর করে ধরে শিশির বললো,

-মাফ কর বোইন। তোর সাথে কথায় পাবো না আমি।

শিশিরের মাথার চুল খামচে ধরে রোদ বললো,

– আআআআআ আমি কোন দুঃখে বোন হতে যাবো তোমার,বেয়াদব।

রোদের এইসব কান্ডে শিশির হতবাক। না এ-ই মেয়ে কে কিছু বলেও বোঝা অসম্ভব। রোদকে শান্ত করে বসিয়ে রোদের দুহাত নিজের কোলে রেখে শান্ত কন্ঠে শিশির বললো।

– তুমি আমাকে একটু সময় দেও রোদ। হিয়ার একটা ব্যবস্থা করে আমি তারপর আমাদের বিষয় টা ভাববো।

অবাক চোখে তাকিয়ে রোদ বিস্ময়ে বললো,

– হিয়ার কি ব্যবস্থা করবে তুমি শিশির,বুঝলাম না।

– আর তো ছয়টা মাস। উচ্চ মাধ্যমিক টা শেষ হলে ওকে একটা ভালো ছেলের হাতে তুলে দেবো। চাচি অবশ্য বললো সেদিন ওনার এক কিরকম ভাইয়ের কথা দেখি,

ক্ষেপে উঠে রোদ বললো,

– তুমি কি পাগল শিশির। এটা জানার পরো যে উজান হিয়া দুজনে দু’জনের সাথে কামিটমেন্টে আছে। তারপরো কি করে তুমি।

– হিয়া বা উজান চাইলেই তো সব হবে না রোদ। এ্যাস আ গার্ডিয়ান হিয়ার ব্যাপারে যা সিদ্ধান্ত নেবার আমি নেবো।

– হ্যা নিবে কিন্তু তাই বলে..তুমি নিজেকে একবার প্রশ্ম করো তো শিশির,উজানের চাইতে ভালো ছেলে তুমি পাবে হিয়ার জন্য। তুমি কিচ্ছু বুঝো না শিশির। আমি জানি উজান হিয়াকে কতোটা ভালোবাসে।

– আচ্ছা মানলাম। এখন তুমি আমাকে একটা কথা বলো তো রোদ তোমার মনে হয় হিয়া তোমাদের পরিবারে ভালো থাকবে? ওনেস্টলি বলবা?

– হ্যা তাতে কি হয়েছে বিয়ের পর উজান হিয়া আলাদা বাড়িতে থাকবে। পরিবারে কি আসে যায় তাতে,কি সমস্যা?

– আমি হিয়াকে পরিবার গড়তে শিখিয়েছি রোদ ভাঙ্গতে না।

– তুমি উজানকে এখনো চেনো নি শিশির। উজান হিয়ার জন্য কতোটা desperate তুমি জানো না।

– জানতেও চাই না।

– শিশির! উজান না তোমার বেস্টফ্রেন্ড হয়।

– এজন্যেই আমি বেশি করে এ-ই সম্পর্ক টা চাই না। যাই হোক তুমি বাসা যাও এখন দেড়ি হচ্ছে তোমার।

– না তুমি আগে আমাকে প্রমিস করো তুমি উজান আর হিয়ার মাঝে দেওয়াল হয়ে দাঁড়াবে না। তুমি এরকম করলে কিন্তু উজান হিয়াকে নিয়ে পালিয়ে যাবে এই বলে রাখলাম।

– হিয়া রাজি হবে তাতে?

– না হওয়ার কি আছে। সবাই কি তোমার মতো নাকি। ভালোবাসতে গেলে মরতে জানতে হয় যেটা তুমি জানো না।

– উজান আর হিয়াকে বলে দিও যদি তাই হয় তাহলে যেনো আমার সাথে সব সম্পর্ক শেষ করে ওরা ওদের পথটা খুঁজে নেয়। নয়তো হিয়াকে ত্যাজো করতে আমি একটা মুহুর্ত ভাববো না। যখন ভালোবেসে নিজের সব দিয়ে আগলে রেখেছি এতোদিন, সেই প্রশ্নে দাগ উঠলে ছুঁড়ে ফেলতেও দ্বিধাবোধ করবে না এই শিশির..!!!!

রাগে উঠে দাঁড়িয়ে রোদ বললো,
– তুমি এতো কঠিন কেনো শিশির!

– তোমার মতো নরম গালিচায় ঘুমিয়ে বড় হই নি তাই।

– কথা শোনাচ্ছ আমাকে!

– আমার অপারগতা টুকু বলছি এ-ই যা।

– তুমি অনেক নিষ্ঠুর শিশির!

– আর?

– একটা পাষাণ তুমি!

– আর?

– একটা শক্ত পাথর তুমি!

– আর?

– একটা খুবই জঘন্য মানুষ!

– আর?

শিশিরের জন্য আর কোনো শব্দ আর কোনো বাক্য খুঁজে পায় না রোদ। রাগে ক্ষোভে বুক ফেটে আসে তার। যদি খু*ন করতে পারা যেতো এ-ই মানুষ টাকে। রাগে ফুঁসতে থাকা রোদের এক হাত ধরে ক্যাম্পাসের বাহিরে আসলো শিশির। একটা রিক্সা দাঁড়িয়ে রোদকে বললো উঠতে। রোদ উঠলো। শিশির রিক্সা মামার হাতে ভাড়া টুকু ধরিয়ে রোদের দিকে ঝুকে এসে রোদের মাথার কাপড় টা ঠিক করে তুলে দিতে দিতে বললো,

– আমাকে কিছু সময় দেও রোদ। দেখি হিয়াকে আজ নিয়ে আসতে যাবো। অনেকদিন হলো রেখে আসছি। পড়াশোনা টাও ক্ষতি হয়ে গেলো অনেকটা।

– তুমি হিয়াকে আর আমার কাছে পড়তে পাঠাবে না শিশির!

– কেনো আবার অপমানিত হবার জন্য পাঠাতে বলছো?

– শিশির!

– না রোদ,হিয়া আর তোমার কাছে যাবে না পড়তে। আর না উজানের কাছে!

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here