চোখের_তারায়_তুই?#পর্ব_২৪

0
678

?#চোখের_তারায়_তুই?
#পর্ব_২৪
#ইভা_রহমান

অস্থির হিয়া সেদিন সারারাত পায়চারি করলো নিজের ঔ ছোট্ট রুমটায়। ফোন করে যে উজানকে একটু বলবে সবটা, সেই ফোনটাও তো কাজের কথা বলে শিশির নিজের দখলে নিয়ে রাখছে দুদিন হলো। না আছে উজানের সাথে কোনো যোগাযোগ না লতাকে দিয়ে উজানের হিয়াকে দেওয়া কিছু বার্তা। সারারাত আর ঘুম হলো না হিয়ার। ভোরের আলো টাও ফুটে গেলো জলদি। শিশির ঘুমিয়ে আছে উঠবে আর কিছুসময় বাদে। হিয়া আর আজ কলেজ গেলো না। সেই ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতে ডাইনিং এ এসে পড়ার ভান করে অপেক্ষা করতে শুরু করলো শিশিরের ঘুম থেকে ওঠার।

সকাল তখন আটটার কিছু পর।ঘুম ভেঙে ফ্রেশ হয়ে তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে ডাইনিং পেড়িয়ে আবারো রুমে আসলো শিশির। মনের সাথে একটা বৃহৎ যুদ্ধ করে, নিজের মন টাকে অটুট করে,হিয়া এসে দাঁড়ালো শিশিরের সামনে। অস্থির হিয়ার অঙ্গভঙ্গি, সাথে বিচলিত কন্ঠে হিয়া প্রশ্ন করলো তাদের এরকম সিদ্ধান্তের ঠিক কি কারণ। কেনো তারা এতো বড় একটা বোঝা চাপিয়ে দিতে চাইছে হিয়ার এতটুকুনি একটা মাথার উপর..??

– ভাইয়া আমি পড়াশোনা করতে চাই। আমিও রোদ আপুর মতো ভার্সিটি যেতে চাই। পাবলিকে পড়তে চাই। তুই এরকম করিস না আমার সাথে।

স্বাভাবিক কন্ঠে শিশির বললো,

– তোকে তো পড়তে কেউ নিষেধ করছে না। না কেউ বাধা দিচ্ছে।

– ভাইয়া নিষেধ করা আর বাধা দেওয়া সেটা প্রশ্ন না। আমি জানি তুই আমাকে পড়াবি। যতোদূর আমি চাই তোতোদূর পড়াবি কিন্তু একটা সম্পর্ক রেখে,একটা কামিটমেন্ট তৈরি করে আমার পক্ষে কি করে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব তুই বল।

– একটা সম্পর্ক করে যখন এতোদূর অবধি এসেছিস বাকিটাও নিশ্চয়ই পাড়বি।

– ভাইয়া সম্পর্ক আর বিয়ে দুটো আলাদা জিনিস। আমি কি করে দুটো মেইনটেইন করে চলবো। আমার পক্ষে সম্ভব হবে না। ভাইয়া একটু বুঝ..দেখ তুই বা চাচি কেউ চাইছিস না তো যে আমি স্যারের সাথে যোগাযোগ রাখি। ঠিক আছে। আমি তোকে কথা দিচ্ছি তুই আর কখনো কোথাও আমাকে আর স্যারকে একসাথে দেখবি না। তুই আমার ফোন রেখে দিয়েছিস তো রাখ তোর কাছে। আমার সেটাও চাই না। কিন্তু এতো বড় অন্যায় আমার সাথে করিস না তোরা..

একটা তাচ্ছিল্যের হাসি টেনে শিশির বললো,

– তোর সাথে আমি অন্যায় করি হিয়া।

হিয়া শিশিরের হাত দুটো মুঠো করে ধরে এগিয়ে এসে বললো,

– আমি তা বলি নি ভাই। তুই অন্য মানে খুঁজবি না। কিন্তু এ-ই বিয়ে আমার সাথে হলে আমি এটা মেনে নিতে পারবো না ভাই প্লিজ একটু দয়া কর।

শিশির কিছু বললো না। হিয়ার মাথায় হাত বুলে দিয়ে তৈরি হয়ে নিলো। হিয়া শিশিরের নিরবতার মানে টা ঠিক বুঝতে পারলো না। শিশির কি রাজি না এখনো কিছু চলছে শিশিরের মনে!

!
!

এদিকে হিয়ার মুখে এসব শুনতেই রাগে পুরো কঠিন এক রুপ ধারন করলো উজান। যোগাযোগ রাখতে দিচ্ছে না। হিয়ার ফোন কেঁড়ে নিয়েছে ওকে ফাইন। কিন্তু বিয়ে। এটা কি কোনো ছেলে খেলা!

একটা মুহুর্ত বিলম্ব না করে শিশিরের দোকানের সামনে এসে হাজির উজান। ক্যাশম্যামো হাতে আজো হিসাব গুনতে মগ্ন তখন শিশির। উজান এসে এক লহমায় টেবিলের উপর যা আছে সব ছুঁড়ে দিয়ে শিশিরের দিকে অগ্নি দৃষ্টি ছুঁড়ে দিয়ে বললো,

– তোর সমস্যা টা কি। কি চাইছিস তুই। হিয়ার ভবিষ্যৎ টা নষ্ট করতে। ও একটা বাচ্চা মেয়ে। তুই কি করে ওকে এখন বিয়ে দেবার কথা ভাবতে পারলি শিশির।

কোলের উপর পড়া ক্যাশম্যমো টা ঠিক করে টেবিলের উপরে রেখে স্বাভাবিক কন্ঠে শিশির বললো,

– বাচ্চা মেয়ে যখন তখন রিলেশনে কেনো জড়িয়ে ছিলি ওকে। হিয়া না তোর স্টুডেন্ট ছিলো।

– রিলেশনে জড়ানো আর এ বয়সে বিয়ে করার মধ্যে আসমান জমিন ফারাক আছে শিশির। মেয়েটাকে তো এ্যাটলিস্ট ইন্টারটা শেষ করতে দে।

– হিয়ার বিয়েও হবে সে ইন্টারো শেষ করবে এ নিয়ে তোর মাথা না ঘামালেও চলবে।

শিশিরকে এতো স্বাভাবিক দেখে আরো রেগে উঠলো উজান। শিশিরের দিকে আঙ্গুল তুলে বললো,

– জাস্ট স্টপ শিশির। অনেক বাড়াবাড়ি শুরু করে দিয়েছিস কিন্তু তুই। হিয়ার জন্য আমি কতোদূর যেতে পারি তার কোনো ধারণাও তোর নেই।

শিশির চেয়ারে হেলে বসে বললো,
– তা গিয়ে দেখা কি করতে পারিস। এখন পর্যন্ত তো নিজের ফ্যামিলিকে মানাতে পারলি না। নিজের চাচিকে দিয়ে একটা ক্ষমা অবধি চাওয়াতে পারলি না আর বড় বড় লেকচার ছাড়িস।

– আমি কিন্তু হিয়াকে তুলে নিয়ে যাবো শিশির।

– এতো বুকের পাটা আছে তোর! তুলে নিয়ে গিয়ে কি করবি। দুদিন পর ফ্যামিলির চাপে পড়ে তো ছেড়েই দিবি। তাহলে এতো নাটকের কি দরকার।

– তুই হয়তো আমার ভালোবাসার গভীরতা টা এখনো উপলব্ধি করতে পারিস নি শিশির। হিয়ার জন্য পরিবার কেনো আমি আমার মা বাপকেও ছাড়তে রাজি।

– কিন্তু আমি রাজি না। যা এখন বাড়ি। পরে কথা বলবো আমার কাস্টমার দাঁড়িয়ে আছে বাহিরে।

টেবিলের উপর একটা ঘুষি দিয়ে উজান বললো,

– ড্যাম ইউর কাস্টমার শিশির। নিজের বোনের জীবন নিয়ে খেলে এখন তুই হিসাবের খাতা গুনছিস। শ্যাম ইউ শিশির। শ্যাম ইউ৷ আমার তো এটা ভেবে অবাক লাগছে এ-ই শিশির কিনা আমার বন্ধু ছিলো। তোর সাথে বন্ধুত্ব রাখতেও এখন ঘেন্না লাগছে আমার।

– তাহলে রাখিস না। আমি বা হিয়া কেউ তো তোর পর্যায়ে পড়িনা।

– স্টপ শিশির। আর কতো। তুই তো নিজে হিয়াকে বলতি পৃথিবীতে প্রত্যেকটা মানুষ ভিন্ন রকমের হয় কেউ ভালো কেউ মন্দ। তাহলে চাচির একটা ব্যবহারে তুই তোর বোনকে কষ্ট দিচ্ছিস,আমাকে দূরে করে দিচ্ছিস আর রোদেলা…মেয়েটা রোজ রাতে তোর জন্য কান্না করে করে মরে আর তুই। এতো পাষাণ তো তুই ছিলি না। মেয়েটার কি দোষ এখানে। ওর ভালোবাসা তো জেনুইন তাই না বল..

– হয়েছে তোর লেকচার দেওয়া। প্লিজ এখানে আর সীনক্রিয়েট করিস না। এটা আমার কাজের জায়গা।

– শিশির (অস্ফুটে)

!
!

দুদিন পর।

কলেজ থেকে ফিরে ব্যাগ টা কোনো মতে চেয়ারে থুইয়ে হাপিত্যেশ করছে হিয়া। উফফ জানুয়ারিতে হাড়কাঁপানো ঠাণ্ডা হবার কথা তা নাহয়ে এতো সূর্যের তেজ কেনো আজ। সুন্দর সুন্দর স্কিন টা হিয়ার ঝলসে গেলো পুরো। ঘামার্ক্ত মুখ টা টিস্যু দিয়ে মুছে হিয়া জগ থেকে পানি ঢালতে ঢালতে বললো,

– কি গো চাচিআম্মু আজ এতো খাবারোর আয়োজন। রোস্ট এর কি সুন্দর ফেলেবার আসছে দেখো।

– হুম যাগ এসেছিস যখন এই সালাত গুলো কেটে দিয়ে সুন্দর করে গোসল টা করে আয় তো।

– গোসল কি করে সুন্দর করে করতে হয় চাচি!

– পাগলি মেয়ে। বললাম যে মাথা টা ভালো করে শ্যাম্পু করে একটু সুন্দর হয়ে থাক। আর শোন সেবার ইদে যে জামা টা বানালি আজ ওটা পড়িস। তোকে ঔ জামা টাতে অনেক সুন্দর মানায়।

– হঠাৎ আজকে আমাকে সুন্দর করে সাজতে বলছো যে বাহিরে যাবো নাকি কোথাও ঘুরতে!

– ধুর বোকা। বাহিরে যাবো কেনো। শিশির বলেনি তোকে কিছু?

কপালে হালকা ভাজ এঁকে হিয়া অবাক দৃষ্টি ছুঁড়ে বললো,

– কি বলবে!

– কেনো আজ যে রিয়াজদের পরিবার বাড়িতে আসছে তোকে দেখতে তুই জানিস না!

হতবম্ভ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো হিয়া। হাত পা সব ছেড়ে দিতে থাকলো নিমিষে। পানির জগটাও বেসামলে কিছু পানি পড়ে গেলো টেবিলে। কাঁপা কন্ঠে হিয়া বললো,

– মানে কি সব কি বলছো তুমি চাচি!

– মানে আবার কি আছে। আমাদের সব কথাবার্তা তো শেষ। ওরা তো তোকে আগেই পছন্দ করেছিলো সেবার আমার সাথে গেলি না বেড়াতে। রিয়াজের মা’র তোকে ভীষণ ভালো লেগেছে ওরাই তো প্রস্তাব দিয়েছিলো প্রথমে। তোর ভাইকে বললাম। ও কথা বললো। তারপর গিয়ে না সব ঠিক হলো।

– আমাকে না জানিয়ে কি করে তোমরা সব ঠিক করতে পারলে। এটা আমার বয়স বিয়ে করার। সবে আঠারো তে পা রাখছি। উচ্চ মাধ্যমিক টাও শেষ করিনি। কি করে পারলো ভাইয়া এটা করতে!

– দেখ হিয়া মা এমনিতে তোর জন্য অনেক অপমান সহ্য করতে হয়েছে তোর ভাইকে সাথে তোর চাচ্চুকেও। এখনো হচ্ছে। আর জীদ করিস না মা৷ অন্তত শিশির তোর জন্য সেই ছোট্ট থেকে যেই ত্যাগ টা করেছে সেই ঋণ টুকু মেটাতে চেষ্টা কর।

– চাচি!

– আর তোকে তো এখন বিদায় দিচ্ছি না আমরা। আমাদের কথা হয়েছে। তোর এ্যাডমিশন বেড়িয়ে গেলেই ওরা তোকে ঘরে তুলবে। তুই ওখান থেকে অনার্সটুকু পড়বি। ওরা কিচ্ছু বলবে না বরং তোকে সাহায্য করবে,উৎসাহ দিবে।

– কিন্তু চাচি!

– আর কোনো কথা না হিয়া। যা বলছি গিয়ে তাড়াতাড়ি কর। ওরা আসছে হয়তো।

রাগে নিজের রুমে গিয়ে দরজা টা ধাম করে ঠেলে দিলো হিয়া। কি করবে এখন। ফোনটাও তো শিশিরের কাছে। এদিক সেদিক কিছুক্ষন চিন্তা করে দূত পায়ে দাদির রুমে এসে পুরোঘর তন্নতন্ন করে খুঁজে দাদির ফোন হাতে পেতে সক্ষম হলো হিয়া। ওড়নার তলে ফোন লুকিয়ে সোজা আসলো নিজের রুমে। কিন্তু এখন চাচির সামনে কথা বলবে কি করে। সাত পাঁচ না ভেবে জামাকাপড় নিয়ে সোজা গোসলে ঢুকে পানির ট্যাপ ছেড়ে দিয়ে উজানকে কন্টিনিউসলি ট্রাই করতে থাকলো হিয়া। কিন্তু লাভ হলো না কিছুই। দশমিনিট পাড় হচ্ছে কিন্তু উজান ফোন তুলছে না। গোসল করতে সময় নিলো হিয়া পাক্কা আধাঘন্টা। ভেজা হাতে কোনোরকমে জামা পাল্টে লাগাতার উজানকে ট্রাই করছে হিয়া। কিন্তু ফলাফল এখনো শূন্য। হিয়ার হাত কাঁপছে। সাথে কাঁপছে পুরো শরীর। গোসল করেও কপালে বিন্দু বিন্দু ঘামের দেখা মিলছে। না আর বেশি দেড়ি করা উচিৎ হবে না। চাচির ডাকে রুমে এসে মাথা মোছার ভান ধরলো হিয়া। কিছুসময় বাদে চাচি ডেকে বললো “হিয়া মা এ-ই চা পানি টা সোফার ঘরে নিয়ে গিয়ে রাখ তো মা” হিয়া কোনোরকমে ফোনটা বালিশের তোলে গুঁজে ট্রে হাতে ডাইনিং এ আসতে থমকে গেলো যেনো। কাজি সাহেব! কাজি সাহেব কি করতে কি আসছে এখানে। কাঁপা হাতে ট্রে টা ডাইনিং এ রাখতে হিয়া চোখের ইশারায় দাদিকে বললো “কাজি সাহেব এখানে কিসের জন্য ” দাদি কিছু বলার আগে কাজি বলে উঠলেন ” এই কি মেয়ে?” দাদি মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিলেন মানে হুম। বুকটা শূন্য থেকে শূন্য হয়ে আসলো হিয়ার। তারমানে রিয়াজদের বাড়ি থেকে শুধু হিয়াকে দেখতে না বিয়ে পড়িয়ে দিতেও আসছে!

এক মুহুর্ত সেখানে না থেকে রুমে আসলো হিয়া। চাচি ডাইনিং এ সব সুন্দর মতো সাজিয়ে হিয়াকে বললো” আমি গোসলে যাচ্ছি হিয়া,শিশির আসছে বললো তোর চাচ্চুর সাথে। তুই একটু দেখিস দাদি বা কাজি সাহেবের কিছু লাগে কিনা”..চাচি গোসলে যেতেই রুমের দরজা লাগিয়ে আবারো উজানকে ট্রাই করতে থাকলো হিয়া। পাঁচ বারের পর ছয় বারে গিয়ে ফোন ধরলো উজান। হিয়ার এ-ই মুহুর্তে এমন অবস্থা যে বাড়ির পরিস্থিতি বর্ণনা করতেও শ্বাস আঁটকে আসছে তার। হিয়াকে রাগ করতে দেখে উজান হেঁসে দিয়ে বললো “একটু ছাঁদে গিয়েছিলাম পাগলি এ-ই জন্য এতো অস্থির হতে হয়” হিয়া খুলে বললো তার এই অস্থিরতা মূল কারণ। বিচলিত কন্ঠে খুলে বললো পুরো ঘটনার আদৌপান্ত। কান্নারত হিয়ার মুখে এ-ই কথা গুলো যেনো ঠিক সহজ ভাবে হজম করতে পারলো না উজান। একটা দীর্ঘ শ্বাস টেনে উজান হিয়াকে অভয় দিয়ে বললো,

– রিলাক্স হিয়া। কাম ডাউন। পাগলি আমার চুপ করো একটু..

– আমি আপনাকে ছাড়া কি করে অন্য কাউকে। এটা সম্ভব আপনি বলুন!

– সম্ভব না-ই তো। তুমি একটু শান্ত হও। তোমার পেশার লো না পাখি। আমি আসছি তোমাকে নিতে। তুমি একটু কান্না টা থামাও।

– আমি পারছি না উজান। আমার খুব ভয় হচ্ছে। আমি আমি কি করে….

এদিকে এই মুহুর্তে শিশিরের ডাক কানে পৌঁছাতে হিয়া আর কিছু বলার সুযোগ পেলো না। ফোন লুকিয়ে বাহিরে এসে দেখলো রিয়াজের পরিবার সহ শিশির আর চাচ্চু বাড়িতে উপস্থিত। মাথা ঘুরে আসলো হিয়ার। এরপর!

শিশির হিয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে বললো এ-ই যে আমার বোন। হিয়া হতবাক। ঠোঁট শুকনো কথা বের হতে চাইছে না যেনো। অনেক কষ্টে মুখে একটা মেকি হাসি দিয়ে হিয়া সালাম নিবেদন করলো রিয়াজের মা,বাবা আর চাচিকে। রিয়াজের মা হিয়ার থুতনি টেনে ধরে বললেন “ভারী মিষ্টি তোমার বোন,সেবার যেরকম দেখেছিলাম তার চাইতেও আজ বেশি সুন্দর লাগছে”। চাচ্চু ওনাদের বসতে দিয়ে ওনাদের হাতে থাকা মিষ্টির প্যাকেট গুলো নিয়ে ডাইনিং এ আসলেন। চাচি তাড়াহুড়ো করে গোসল সেরে মাথা তোয়ালে দিয়ে পেঁচিয়ে ভেজা পায়েই রুমে এসে অভ্যর্থনা জানালেন সবাইকে। হিয়া করুন চাহনি ভরে শিশিরের দিকে তাকিয়ে উঠলো।

অভিযোগ, অভিমান,হতাশা,অসহায়ত্ব সব প্রকাশ পেলো হিয়ার এই চাহনিতে। শিশির বোনের চোখের ভাষা পড়তে পেড়েও কঠোর হয়ে রইলো। চোখের ইশারায় হিয়াকে বললো যা ভেতরে। হিয়া চোখ দিয়ে এক ফোঁটা পানি ফেলে ক্ষোভ ভরা আবেগে রুমে এসে বসে রইলো। এদিকে হিয়ার ফোন কেটে দেওয়ার পর থেকে উজান কন্টিনিউয়াসলি হিয়ার দাদির নাম্বার থেকে শুরু করে,হিয়া,শিশির সবাইকে ট্রাই করে যাচ্ছে কিন্তু কেউ ফোন তুলতে চাইছে না। শার্টের বাধন টা আলগা করে রুমে পায়চারি করে যাচ্ছে উজান। এক হাতে ফোন কানে নিয়ে তো আরেকহাত কপালে দিয়ে টেনশনে ফেটে পড়ছে উজান। শিশিরকে এতোবার বোঝানোর পরো শিশির কি করে এরকম ইরেস্পন্সিবলের মতো একটা কাজ করতে পারলো। একবার তো না বারবার হাজারবার উজান অপমানিত হয়েও শিশিরের কাছে হিয়াকে ভিক্ষে চেয়ে এসেছে কিন্তু শিশির কি করে!…….না এভাবে হবে না। উজানকে এক্ষুনি হিয়ার কাছে পৌঁছাতে হবে। ফোন টা বিছানায় ছুঁড়ে দিয়ে ব্যাকে ঝুলানো ব্যাগ টা নামিয়ে একটার পর একটা জামা ঢুকাতে শুরু করলো উজান। আর মাকে রোদকে ডাকতে শুরু করলো উচ্চ কন্ঠে,ছেলের ডাকে রুমে এসে থমকে গেলেন উজানের মা,বিচলিত কন্ঠে বললেন

– তুই কোথাও বের হচ্ছিস রাজা। হঠাৎ এভাবে?

– মা আমার ফাইনালের জন্য যেই টাকা টা রাখতে দিয়েছিলো বাবা তোমায় ওটা একটু দেও প্লিজ।

– টাকা দিয়ে এখন কি করবে তুমি।

– করলেই দেখতে পারবে। আমি তোমাকে বাবাকে অনেক বুঝিয়েছিলাম হিয়া আর শিশিরের সাথে আগ বাড়িয়ে কোনো ঝামেলা না করতে। তোমরা আমার কথা শোনো নি। এখন আমি আমার টা করবো।

– তোর টা করবো মানে। কি করবি তুই।

– অনেক কিছু। তুমি কি এখন টাকা দিবে না আমি আবার ভাংচুর শুরু করবো।

– কোথায় টাকা টা লাগবে সেটা তো বল!

উজান বুঝে এখন এ-ই মুহুর্তে হিয়ার কাছে যাচ্ছি এই কথা শুনলে তার মা একটা না একটা সমস্যা ক্রিয়েট করবে। তার উপর বাবাও আসছে আজ। এখন কিছু বলা মানে সময় লস। আর সময় যাওয়া মানে হিয়া হাতছাড়া হয়ে যাওয়া।

– আমার স্কেলেটন টা হারিয়ে গেছে মা,তাই জন্য টাকা লাগবে কিছু। সামনে ফাইনাল ওটা কিনতে হবে। প্লিজ এখন একটু জলদি টাকা টা দেও

উজানের মা’র কাছে এই কথাটা ঠিক বিশ্বাস যোগ্য হয়ে উঠলো না তবুও উনি টাকা টা নিয়ে এসে উজানের হাতে ধরিয়ে দিলেন। উজান দিক বিদিক সব ভুলে টাকা নিয়ে সোজা নামতে শুরু করলো সিঁড়ি বেয়ে কিন্তু মাঝপথে বাঁধ সাধলো রোদ! আকুতির সুরে বললো,

– ভাই সত্যি করে বল তুই কোথায় যাচ্ছিস। হিয়া শিশির এরা ঠিক আছে তো?

– কিচ্ছু ঠিক নেই রোদ। শিশিরের সাহস কি করে হয় আমার হিয়াকে আমার থেকে আলাদা করার।

শেষ কথাটা এতোই তেজ দিয়ে উজান বলে যে রোদ তার ভাইয়ের এই আগুন সমান রাগ দেখে ওখানেই থতমত করতে শুরু করে।

– একটা তো খু*ন আজকে হবে হয় শিশির থাকবে নয় আমি।

উজান নামতেই আবার রোদ দৌড়ে এসে সাহস জুটিয়ে উজানের পা দুটো আঁকড়ে ধরে কান্নারত কন্ঠে বললো,

– ভাই তুই আমাকে কথা দে তুই তুই আমার শিশিরের কোনো ক্ষতি করবি না। তোর হিয়াকে চাই তো। তুই হিয়াকে নিয়ে পালিয়ে যা। যা খুশি কর কিন্তু শিশিরকে কিছু করবি না কথা দে। ভাই ভাই..ভাইয়া…ভাই

ভাই ভাই বলে গলা ছেড়ে ডাকতে শুরু করলো রোদ। কিন্তু উজান শুনলো না। আজ তার এই আগুন সমান রাগ টাকে তার বোনের চোখের পানি মেটাতে পারলো না। বাইক স্টার্ট দিয়ে সোজা হিয়ার বাড়ির দিকে রওনা দিলো উজান। আর রোদ! সে তো মাটি কামড়ে সেখানেই বসে কাঁদতে শুরু করলো হাউমাউ করে। উজান তো চললো তার হিয়াকে নিজের করতে কিন্তু রোদের কষ্ট টা। এটা ঠিক কবে লাঘব হবে।

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here