চোখের_তারায়_তুই? #পর্ব_৩৮

0
746

?#চোখের_তারায়_তুই?
#পর্ব_৩৮
#ইভা_রহমান

রোদেলা কে নিয়ে সেই সন্ধ্যারাতের ফ্লাইটে রংপুরের জন্য রওনা দিলো শিশির। রোদেলা অনেক বাঁধা দিতে চাইলো,বললো আরমান জানলে তাদের দুজনকেই মাঝরাস্তাতেই খু’ন করে দেবে। কিন্তু কোনো কিছু বলেই শিশিরকে আটকানো গেলো না। কেউ আটকাতে পারলো না।

রাত তখন এগারোটার কিছুপর,রোদকে নিয়ে রোদের বাড়িতে উপস্থিত শিশির। রাগান্বিত শিশিরের চাহনি,পুরো শরীরে রাগের উথালপাতাল বর্ষন,গায়ের সব শিরা উপশিরা গুলো স্পষ্ট জ্বলজ্বল করছে যেনো তার,সারা রাস্তা রোদের সাথে আর একটা কথা অবধি বলেনি ছেলেটা,রোদো সাহস জুটিয়ে কিছু বলার ভাষা পায়নি আর।

শিশিরের পাশে বিষ্ময়ে এক দৃষ্টিতে রোদের দিকে তাকিয়ে আছে উজান। শিশিরের ফোন পেয়ে হিয়াকে রেখেই চটজলদি নিজের বাড়িতে এসে উপস্থিত হতে হয়েছে তাকে। কিন্তু এসেই যে তার প্রাণপ্রিয় বোনকে এই বেশভূষা নিয়ে তাকে দেখতে হবে এটা তার দুঃস্বপ্নেও যেনো কল্পনা করতে পারেনি সে।

উজান কাঁপছে, উজানের সারা শরীর থরথর করছে। শিশিরের থেকে সব শোনার পর থেকেই অনুতাপে-গ্লানিতে-ঘেন্নায়-ক্ষোভে নিজেকে নিজের মধ্যে পিষে ফেলছে যেনো ছেলেটা। এদিকে রোদের বাবা মার মধ্যে এসব শোনার পরো বিন্দুমাত্র অনুতাপের ছোঁয়া দেখা মিলছে না। উপরন্তু নিজেদের মেয়েকে শিশিরের সাথে দেখামাএই রাগে যেনো ফুঁসতে শুরু করছে তারা।

এদিকে রোদেরো এ-ই মুহুর্তে শরীর কেমন করছে একটা। শিশিরের পাশে দাঁড়িয়ে হাত পা চিবাচ্ছে মেয়েটার৷ সারাদিনে কোনো নেশা শরীরে পড়েনি তার। এখন সেই নেশার টান উঠছে রোদের৷ মনে হচ্ছে এখনই কোনো নেশা না গিলতে পারলে ব্যাথায় পুড়ে যাবে তার সমস্ত শরীর। মাথা চিবাচ্ছে,চোখে ঝাপসা লাগছে,মনে হচ্ছে পুরো শরীরে বি*ষ ধরছে।

!
!
চোয়াল শক্ত,সাথে কাঠ কাঠ কন্ঠে রোদের বাবা মা’কে উদ্দেশ্যে করে শিশির বললো,

– সুখের খোঁজে, প্রতিপওির লোভে মেয়েকে পাঠিয়েছিলেন তো বড়লোক ঘরে,দেখলেন তার পরিণতি,নাকি এখনো মুখ বুঁজে চুপ হয়ে থাকবেন…ছোট থেকে একই কলেজে, একই ভার্সিটিতে পড়াশোনা করেছি আমরা,কোনোদিন ওকে, আমি আর উজান ছাড়া অন্য কোনো ছেলের কাছে ঘেঁষতে দেখিনি,আর আজ, আজ সে মদ খায়,নেশা টানে,হাজার হাজার ছেলের সাথে মেলামেশা করে,কার জন্য করে,সব সব কিছুর জন্য আপনারা দায়ী শুধু আপনারা!

রোদের মা নিজের চোখের পানি টা মুছতে মুছতে বললো,

– সে যা হয়েছে আমরা সব বুঝে নেবো। দরকার পড়লে আমরা আবার আমাদের মেয়েকে ভালো কোনো ছেলে দেখে বিয়ে দেবো,তুমি আর এর মাঝে ঢুকতে এসো না দয়া করে।

তাচ্ছিল্যের এক হাসি টেনে শিশির বললো,

– আপনাদের হাতে রেখে যাবো বলছেন,ভাবলেন কি করে। আমি শুধু এখানে এসেছি রোদের জীবনটা কিরকম নর*ক বানিয়েছেন আপনারা সেটা দেখাতে,আর এটা বলতে যে রোদেলা আজকে থেকে,এখন থেকে আমার দায়িত্বে থাকবে। আপনাদের সাথে সব সম্পর্ক শেষ ওর। যদি নিজেদের বদলাতে পারেন তবেই নিজেদের মেয়ের সাথে দেখা করতে আসবেন,নয়তো রোদের জীবনে আপনাদের আর কোনো জায়গা আমি রাখতে দেবো না, সে যা করার আপনারা করে নিন।

রোদের বাবা এগিয়ে এসে বাঁধা দিতে চাইলে আরো ক্ষীপ্ত হয়ে উঠলো শিশির। অনেক তর্কবিতর্ক চললো। পারলে তো বোধহয় রোদকে ছিনিয়ে আনতে তার বাবা তার কাজের রিভলবার টা দিয়ে শিশিরকে শ্যুট করে বসে। কিন্তু সে সুযোগ শিশির দিলো না। রোদকে নিয়ে বের হতে যাবে ওমনি রোদের মা বাঁধ সাধলে এবার ঢাল হয়ে দাঁড়িয়ে গেলো বাসবি। নিজের সব অপারগতাকে আজ তুচ্ছ করে,শাহরিয়ার বাড়ির সবার ভয় কাটিয়ে প্রতিবাদের সুর টেনে বললো,

– তুমি কি একটা মা মেহরিন। নিজের মেয়ের এ-ই অবস্থা দেখেও তোমার অহংকারের সুতো কাটলো না। তুমি কি আদৌও রোদকে গর্ভে ধারণ করেছিলা!

– এসব তুমি কি কথা বলছো ভাবী। হ্যা মানছি একটা ভূল হয়েছে। ভূল ঘরে মেয়েকে বিয়ে দিয়েছি। তাই বলে তো এ-ই ছেলের হাতে আমি আমার মেয়েকে দিতে পারি না। তুমি কি পারতা,বলো?

– পারতাম। কি নেই শিশিরের বলতে পারো, একটা ভালো কোম্পানিতে জব করছে,নিজের একটা বাড়ি বানিয়েছে এরপরো কি চাও। এতো এতো চাইতে গিয়ে তো মেয়েটাকে জাহান্নামে পাঠিয়ে দিলে এরপরো বিবেক কাজ করছে না তোমাদের_____ তোমাদের জন্য,এই তোমাদের ভয়ে আমিও চুপসে ছিলাম এতোদিন কিন্তু আর না। উজানের ভবিষ্যৎ এর কথা ভাবতে গিয়ে আমিও তোমাদের পাপের ভাগীদার হয়েছিলাম কিন্তু আর কতো____হিয়াকেও কাছে টানতে পারিনি।একটা মা বাবা মরা মেয়ে সে তার সাথেও দিনের পর দিন খারাপ ব্যবহার করতে বাধ্য করেছো আমাকে তোমরা। সেদিন অসুস্থ শরীর নিয়ে এসে মেয়েটা আমাকে বললো আন্টি আমি অসুস্থ,উজানকে একটু দিন না,আমি ডাকতে পারেনি আমার ছেলেকে,ভয় পাইছি,তোমাদের ভয়,কিন্তু না অনেক হইছে। আর তো সহ্য করবো না আমি।

বাসবি রোদকে শিশিরের হাতে তুলে দিয়ে বললো,

– যা-ও রোদকে নিয়ে আমিও দেখবো এখানে কে কি বলে,থা*না পু*লিশ শুধু ওরা একাই করতে পারে না আমরাও সব জানি। দেখি কে কিভাবে আঁটকায় তোমাদের। আর আমাকে তুমি কথা দেও আমার রোদ মাকে আবার আগের মতো করে সারিয়ে তুলবে। এইসব নেশা থেকে আমার মেয়েটাকে সুস্থ করে আবার আগের জীবনে ফিরিয়ে আনবে। দেও কথা আমায়।

শিশির মুখে কিছু না বললেও ইশারায় অভয় জানালো। এদিকে নিজের ছেলের কাছে এসে গা থেকে সব গহনা খুলতে খুলতে বাসবি বললো,

– আর তোকে আমি এসব দিচ্ছি,হিয়াকে তো কোনোদিন কিছু দিতে পারিনি। এগুলো হিয়ার প্রাপ্য। আর আমি চাই তুই এই বাড়িতে সেদিনই ফিরবি যে-দিন হিয়ার রাগ,মান ভাঙ্গিয়ে হিয়াকে এই বাড়িতে নিয়ে ফিরতে পারবি। আর যদি না পারিস তাহলে এ-ই শাহরিয়ার বাড়িতে আর কখনো আসার কোনো প্রয়োজন আমি তোর দেখি না।

কান্নারত চোখমুখ মুছে নিয়ে উজান বললো,

– তাহলে তুমিও আমাদের সাথে চলো,আমি জানি এখানে কেউ আর তোমাকে আগের মতো সম্মান শ্রদ্ধা কিছুই করবে না। আর বাবা জানলে হয়তো।

– আমার আরো দুটো ছেলে-মেয়ে আছে উজান,তোর সাথে গেলে তো চলবে না বাবা। তবে কখনো যদি এ-ই বাড়ি সত্যি ছাড়বার মতো পরিস্থিতি আসে আমি নির্দ্বিধায় তোর কাছে ফিরে যাবো৷ আশা রাখি শিশির আমাকে সেদিন তাড়িয়ে দেবে না।

উজান বাসবির থেকে গহনা জোড়া নিয়ে শিশির সহ বেড়িয়ে আসতেই রোদেলা শিশিরের থেকে গাড়ির চাবি নিয়ে এক দৌড়ে নিচে চলে আসলো। রোদের পেছনে দৌড় শুরু করলো এরা দুজন। একসাথে নিচে নামলো ঠিকই কিন্তু রোদ বললো তাড়াতাড়ি গাড়ির দরজা খুলো আমি আর এক মুহুর্তো এ বাড়িতে থাকতে চাই না। দরজা খুলে পেছনের সীটে বসে পড়লো রোদেলা। এদিকে উজান গাড়ির চাবি হাতে নিয়ে একটু ইতস্ত হয়ে বললো “অনেকদিন ড্রাইভ করা হয়না শিশির, যদি কিছু হয়, তোর অফিসের গাড়ি,তুই সামনে এসে না হয় ড্রাইভ টা কর”শিশির না চাইতেও চাবি হাতে বললো” এটুকু পথ তুই ড্রাইভ করলেই হ’য়ে যেতো উজান”

এদিকে এদের কথোপকথন চলাকালীন নিজের এই তড়িঘড়ি করে গাড়িতে আসার কারণ টা হাসিল করে নিলো রোদেলা। তার ব্যাগ যে রেখে গিয়েছিলো সে এই গাড়িতে আর সেখানেই ছিলো একটা সরু সিরিঞ্জ ভর্তি নেশাদ্রব্য। নেশার টান আসতেই সেটা শরীরে পুশ করে নিয়ে চোখ বুঝলো মেয়েটা। যেনো এটাই এখন তার সুখ এটাই তার শান্তি!

এদিকে শিশিরের হাতে চাবি দিয়ে পেছনে এসে গাড়ির দরজা খুলে,রোদের পাশে এসে বসতেই চমকে উঠলো উজান। রোদ এরকম নেতিয়ে পড়লো কেনো! পাশে পড়ে থাকা সিরিঞ্জ টার দিকে তাকাতেই মানে খুঁজতে সক্ষম হলো উজান। এদিকে রোদের দিকে নজর পড়তেই উঠে আসলো শিশির। সিরিঞ্জ টা চোখে পড়তেই ওখানেই কাঁদতে শুরু করলো ছেলেটা। আকুতির সুর টেনে উজানকে বললো” আমার রোদকে সারিয়ে তোল না উজান,তুই না ডাক্তার,আমার রোদকে আবার আগের মতো করে দে না তুই” উজান দিশেহারা,সে না পারছে রোদকে দেখতে না শিশিরকে সামলাতে। কিভাবে সব ঠিক করবে সে এখন!

রোদকে নিয়ে সোজা বাড়িতে এসে উপস্থিত হলো শিশির। এদিকে দরজা খুলে শিশিরের কোলে এভাবে, এতোদিন বাদে রোদকে দেখে পুরোই বিস্মিত হিয়া। হিয়ার কোনো প্রশ্নের উত্তর দেবার প্রয়োজনটুকু বোধ না করে সোজা রোদকে নিজের রুমে নিয়ে এসে শুইয়ে দিলো শিশির। রোদের গা থেকে ঘড়ি,ব্যাচলেট সব খুলে নিতে নিতে বললো,

– তাড়াতাড়ি তোর একটা জামা নিয়ে এসে রোদকে পড়িয়ে দে হিয়া। আমি এ-ই পোশাকে কিছুতেই রোদকে সহ্য করতে পারছি না। কি হলো কি তোর,দাঁড়িয়ে আমার মুখ দেখছিস কি,আমি কি বললাম শুনতে পাসনি।

আমতা আমতা করে দৌড়ে ছুটে গিয়ে একটা জামা নিয়ে আসলো হিয়া। উজান সহ শিশির রুম থেকে বেড়িয়ে আসতেই হিয়া রোদকে মুছে দিয়ে জামা পাল্টে দিলো। হিয়ার হাত কাঁপছে মুখ দিয়ে কোনো আওয়াজ আসছে না। গলা শুকিয়ে কাঠ। এতোদিন বাদে কোথায় পেলো শিশির তার রোদ আপুকে,আর রোদ আপু এরকম অচেতন কেনো হয়ে আছে তার!

!
!
!
রাত তখন তিনটার মাঝামাঝি, নেশা কাটিয়ে জেগে উঠতে সক্ষম রোদেলা। গা টা আড়মোড়া ভেঙে উঠতে গিয়েই দেখলো সে শুইয়ে আছে, কিন্তু কোথায়? মনে পড়লো কাল সন্ধ্যা থেকে হওয়া সেই সব ঘটনা গুলোর প্রতিচ্ছবি। সব স্মৃতিচারণ শেষে বুঝলো এটা শিশিরের বাড়ি,কিন্তু শিশিরের রুমটাতো আগে এরকম ছিলো না তাহলে কোথায় এখন সে! এপাশ ফিরে উঠে নিতেই পাশে বসে থাকা উজানের দিকে চোখ পড়তেই থমকে উঠলো মেয়েটা। একি উজান কাঁদছে। তার ভাই সত্যি সত্যি কান্না করছে!

রোদেলা উঠে বসে উজানের কাঁধে হাত রাখতেই মুখ তুলে রোদের দিকে তাকিয়ে আরো কেঁদে উঠলো উজান। একটা পর্যায় নিজেকে আটকাতে না পেরে রাগে দুঃখে ঠাটিয়ে এক চড় বসিয়ে দিলো রোদের গালে। খেকিয়ে উঠে রোদ বললো,

– আহহ…. কি সমস্যা তোদের, আমার গালটাকে সরকারি গাল মনে হয় নাকি। যখন ইচ্ছে যার ইচ্ছে এসে এসে থাপ্পড় বসিয়ে দিস। কখনো শিশির কখনো তুই, আমার কষ্ট হয় না।

কাঁদতে কাঁদতে উজান আঙ্গুল তুলে ধরে বললো,

– ইউ নো তোকে এর চাইতেও বেশি পানি*শমেন্ট দেওয়া দরকার। যদি আজ তোকে স্নেহ না করতাম না তাহলে শিশিরের থেকে সব শোনামাত্র তোকে খু*ন করে রেখে দিতাম। এতো হ্যা এতো নাটক!

রোদ মুখে আদুরে এক ভাব টেনে ধরে বললো,

– সরি না। দেখো কিরকম কাঁদতে কাঁদতে নাক টা লাল বানিয়ে দিচ্ছে, এ-ই ভাই চুপ না এবার।

– আজকে নিজেকে তোর ভাই বলতে লজ্জা লাগছে আমার,মনে হচ্ছে ভাই হিসাবে আমি ব্যর্থ, একটা কাওয়াড আমি!

রোদ উজানের গাল জোড়া আঁকড়ে ধরে বললো,

– না ভাই,ভাই বলছি এরকম বলতে নেই। ভালো ভাই আমার। তুই তো তোর যথাসাধ্য আমার খোঁজ করতে চেষ্টা করেছিলি বল আমিই সেই সুযোগ দেই নি।

– তোকে যখন দেখতে গেলাম নিজেকে কতো হাসিখুশি পেজেন্ট করলি,দেখে মনে হলো না জানি তোরা কতো পারফেক্ট হাসবেন্ড ওয়াইফ, কতো ভালোবাসা তোদের মাঝে,তুই তুই ঔ লোকটাকে নিয়ে এতো ভালো আছিস যে শিশিরকে তুই.. একটা বার ভরসা করতে পারলি না আমাকে। সেদিন একটা বার ফোন করা যেতো না আমাকে!

– সেদিন এমন এক পরিস্থিতি তৈরি ছিলো যে আমি তোকে ফোন করে বলবো সেই ওয়ে টাও সিয়াম রাখেনি ভাই।

– হ্যা বুঝলাম কিন্তু তারপর তারপর কেনো মিথ্যা অভিনয় করে গেলি, কেনো বললি তুই ঠিক আছিস,কেনো রোদ বল কেনো? এতোই অধম মনে হতো আমাকে তোর৷ শিশির হিয়ার জন্য কি না করে পারলে বোধহয় নিজের জীবনটাও দিয়ে দেয় আর তুই আমাকে,আমাকে তোর ভালো থাকার কথাটাও সত্য করে জানার সুযোগ টাও দিলি না।

– তা নয় ভাই। তোকে মিথ্যা বলেছি কারণ তুই সত্যি জানা মানে শিশির অবধি সব জানা আমি চাইনি আমার ভূলের জন্য শিশিরের জীবনটা না আর কোনোভাবে ন..

আর কিছু বলতে গিয়ে থেমে গেলো রোদেলা। দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে চুপিচুপি কাঁদতে থাকা হিয়াকে দেখে বিষ্ময়ে তাকিয়ে উঠলো। হিয়া কাঁদছে, ফুপিয়ে ফুপিয়ে চোখ দিয়ে অজস্র অশ্রু

ফোঁটা ঝরাচ্ছে। হিয়ার কান্নার রেশ এসে গায়ে লাগলো রোদেরো,সেও কান্নাভেজা চোখে ইশারায় হিয়াকে ডাকতে,এক পা দু পা করে ধীর পায়ে রোদের দিকে এগিয়ে আসলো হিয়া। হিয়ার হাত ধরে হিয়াকে নিজের সামনে বসিয়ে দিয়ে আলতো হাতে হিয়ার গালে হাত রাখতেই কান্নার বেগ বেড়ে উঠলো হিয়ার। বাড়তে বাড়তে এতোই জোড়ালো গতিতে অশ্রু ঝড়তে শুরু করলো যে হিয়ার সাথে তাল মিলিয়ে চিৎকার করে এবার নিজেও কাঁদিয়ে ভাসিয়ে দিলো রোদেলা। অকপটে রোদকে জড়িয়ে ধরলো হিয়া। হিয়ার মাথায় হাত বুলাতে শুরু করলো রোদ। কাঁদতে কাঁদতে অভিযোগের সুর টেনে হিয়া মুখ উঠিয়ে নিয়ে বললো,

– জানো রোদ আপু তুমি চলে যাবার পর থেকেই জীবনটা অনেক বিষাক্ত হয়ে আছে, না আমি ভালো আছি,না উজান,না ভাইয়া। একটা সময় তোমার উপর আমার খুব ঘেন্না জন্মেছিলো,সবকিছুর জন্য তোমাকে দায়ী ভাবতাম,কেনো তুমি আমাদের ছেড়ে চলে গেলে! খুব রাগ উঠতো তোমার উপর। তোমার কথা বললেই আমি কানে হাত দিয়ে রাখতাম..

হিয়া ওর চোখ-নাক মুছে নিয়ে আবার বলতে শুরু করলো,

– জানো আমি ভাইয়া কে কি বলতাম,বলতাম তুই রোদ আপুকে ভূলে যা,রোদ আপু আর কোনোদিন তোর হবে না,তুই একটা সুন্দর মেয়ে দেখে বিয়ে করে নে,কিন্তু ভাইয়া শুনতো না,উল্টে আমার সাথে রাগারাগি করতো। বলতো ভাইয়ার নাকি মন বলে তুমি ভালো নাই, তুমি এখনো ভাইয়াকে ভালোবাসো,জানো, জানো তারপর ভাইয়া আরো কি করতো..

হিয়া তার অস্থির হাতে শিশিরের বেডের পাশের ড্রয়ার থেকে একটা ডায়েরি বের করে সেখান থেকে রোদ আর শিশিরের একটা ছবি বের করে নিয়ে রোদের পাশে গিয়ে বসে কান্নারত সুরে বললো,

– এই দেখো ভাইয়া কি করতো,ভাইয়া রোজ রাতে তোমার এই ছবিটা জড়িয়ে কান্না করতো। আমি কতো বকেছি,একবার তো ছবিটা ছিঁড়েও ফেলতে চেয়েছিলাম, ভাইয়া আমাকে মাইর দিছিলো সেদিন জানো। চোখ গুলো বড় বড় করে বলছে আমি যেনো তার জিনিসে আর কখনো হাত না দেই,সেদিন খুব রাগ হচ্ছিলো আমার। খুব কান্না করছি আমি।

বলতে বলতে আবারো ডুকরে কেঁদে দিলো হিয়া। নিজের অদৃশ্য এক মাতৃত্বের স্বাদে হিয়াকে নিজের বুকে জড়িয়ে ধরলো রোদেলা।

– তুমি কেনো বারবার চলে যা-ও রোদ আপু। আমার সাথে এই একটা বছরে কি কি হয়েছিলো তুমি জানো,কেউ পাশে ছিলো না,লতাও এ্যাডমিশন নিয়ে ব্যস্ত ছিলো,চাচিও পাল্টে গিয়েছিলো, আমি এক একা ছিলাম। আগে তুমি বুঝাইতা, তুমি সব সমস্যা এক হাতে সামলে নিতা কিন্তু তুমি যাবার পর থেকে আমি খুব একলা পড়ে গিয়েছিলাম,কেউ পাশে ছিলো না..

আর বলতে পারলো না হিয়া। রোদের জন্য জমানো যতো কান্না ছিলো সব বের করতে শুরু করলো। রোদেলা নিজের চোখ মুছে নিয়ে অশান্ত হিয়াকে শান্ত করতে করতে বললো,

– তোর ভাইকে বাঁচানোর কোনো আর উপায় যে ছিলো না আমার হাতে বুড়ি,আমি খুব হেল্পলেস ছিলাম সেদিন। বিশ্বাস কর তোদেরকে ছাড়া আমিও ভালো ছিলাম না একটুও না। খুব মনে পড়তো শিশিরকে,তোকে,কিন্তু আমার ফেরার কোনো রাস্তা ছিলো না।

– এখন তো তুমি ফিরেছো,এখন আর কোথাও যাবে না বলো,আমাকে ছুঁয়ে কথা দেও।

মুখে কান্নামাখা এক মায়াবী হাসি টেনে রোদ বললো,

– তোর ভাই যেভাবে আমাকে কোলে করে কিডন্যাপ করে তুলে নিয়ে আসছে তোর মনে হয় সে আমাকে আর কোথাও যেতে দেবে।

হেঁসে দিলো হিয়া। চোখে মুছে হেঁসে ফেললো উজান নিজেও। রোদেলা হিয়ার চোখ মুখ গাল ভালো করে মুছে দিয়ে বললো,

– তা আপনার ভাই টা কোথায় শুনি। কথা বলবে না বুঝি আমার সাথে।

উজান বিছানার বালিশ টা মেলে তাতে শুইয়ে দিয়ে বললো” শুধু কথা,সামনে যা শুধু তোর চেহারা আয়নায় দেখার মতো অবস্থা রাখে কি না সন্দেহ আছে রোদুউউবেবি”

রোদেলা উজানকে হালকা করে সাড়িয়ে দিয়ে উঠতে উঠতে বললো” বেয়াদব,তোর নিজের অবস্থা ঠিক কর,কি বানিয়েছিস চোখ মুখের অবস্থা এগুলা”

হিয়া মুখে এক প্রফুল্লের হাসি টেনে দিয়ে রোদের সাথে নিজেও উঠে এসে বললো” ভাইয়া কেমন হইছে আপু,বলো না বলো কেমন দেখলে ভাইয়াকে,খুব হ্যান্ডসাম হইছে না বলো”রোদ হিয়ার গাল টেনে দিয়ে গায়ের ওড়না টা ঠিক করে নিতে নিতে বললো” হুম খুব হ্যান্ডসাম হয়েছে রে,আমি তো ফাস্ট ওকে খেয়াল করিনি বুঝলি,পরে যখন ফ্লাইটে আসতে আসতে ওর দিকে তাকিয়ে নিখুঁত ভাবে দেখলাম,হায়রে আমার অবস্থা তো পুরো যায় যায় বিশ্বাস কর,আমি তো কোনোদিন ইমাজিন ও করতে পারিনি কলেজের সেই উষ্কখুষ্ক ছেলেটা এতোটাও হ্যান্ডসাম দেখতে লাগবে” হিয়া মুখের হাসি ধরে রেখেই রোদের কানের কাছে এগিয়ে ফিসফিস করে বললো” একদম ঢ্যাসু দেখতে হয়েছে না ভাইয়া টা আমার বলো,উজান স্যারকেও হার মানিয়ে দিছে,স্যারকেই কেমন পানসে পানসে লাগে এখন দেখো” রোদ হেঁসে দিয়ে বললো”আস্তে বল,শুনে নিলে তোরই সর্বনাশ” হিয়া একটা ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে ভেংচি কেটে বললো” শুনুক গিয়ে ভয় পাই নাকি,হু”

রোদ হিয়াকে বললো তোরা থাক আমি তোর ভাইয়ের সাথে কথা বলে আসছি,দেখি ম্যানেজার সাহেব আর কতো রেগে থাকতে পারে তার রোদরানির সাথে ” মুচকি হেঁসে রোদ বেড়িয়ে আসতেই হিয়া হেলেদুলে রুম থেকে বের হতে যাবে ওমনি হিয়ার ওড়না আটকিয়ে ধরলো উজান। ওড়না টাকে প্যাঁচাতে প্যাঁচাতে ওড়না সহ হিয়াকে টেনে এনে বসালো নিজের মাথার কাছে। হিয়া চোখ পাকিয়ে কিছু বলতে যাবে ওমনি হিয়াকে টেনে ফেললো সোজা বিছানায়। সাথে নিজেও হিয়ার উপর ঝুঁকে এসে নে*শাক্ত চাহনি ভরে বললো,

– এ-তো চোখের পানি কোথায় পান আপনি। ভাইয়ের জন্য কান্না করেন,আমার জন্য কান্না করেন, রোদের জন্য কান্না করেন। বঙ্গপ্রসাগরের সব পানি আপনার থেকে সাপ্লাই যায় নাকি ম্যাডাম?

– একদম আমার কান্না করা নিয়ে মজা করবেন না হ্যা,আমার জেনুইন ই কান্না আসে এতো!

– বেশ বুঝলাম, তা রোদের কানে ফিসফিস করে কি জানি বলা হচ্ছিলো ভাইয়া বেশি হ্যান্ডসাম! আর আমি পানসে!

– পানসেই তো,বয়স কতো আপনার। আর আমার বয়স দেখেছেন, আমার আগে বুড়ো হয়ে যাবেন আপনি। সব চুল সাদা হয়ে টাক বেড়িয়ে আসবে।

– হ্যা তো,আমি বুড়ো হলে হবো শুধু এ-ই পরীটা ছোট্ট থাকলেই হবে,আমার ছো-ট্ট পি-চ্চি হিয়া!

রেগে গিয়ে হিয়া বললো,

– আআআআ আমি এখন আর পিচ্চি নেই,বড়ো হইছি আমি। ভার্সিটিতে পড়িইইই।

উজান হিয়ার পুরো মুখে নিজের মুখ ঘষে নিয়ে পকেট থেকে মায়ের দেওয়া গহনা গুলো বের করতে করতে বললো,

– হুমম বড়ো হইছো অনেক। দেখি দেখো তো এদিকে এখন!

– কি দেখবো? আহ,লাগছে তো হাত টা ছাড়োওও নাআআ।

উজান হিয়ার হাতে বালা জোড়া পড়িয়ে দিতে দিতে বললো” জানো হিয়া আজ মা এইসব আমাকে দিয়ে বলেছে তার বউমাকে পড়িয়ে দিতে,আর সে এতোদিন তোমার সাথে যা আচরণ করেছে জেনে হোক বুঝে হোক তার জন্য উনি অনুতপ্ত, আর তিনি তোমার কাছে ক্ষমাপ্রার্থী”

হিয়া বিষ্ময়ে উঠে বসলো,হাতের বালা জোড়া দেখতে দেখতে বললো” এসব কি ধরনের কথা উজান,মা কবে কি আচরণ করেছে আমার সাথে, আর মা ক্ষমাই বা কেনো চাবে,তুমি কিছু বলোনি,তুমি আমাকে অনেক লজ্জায় ফেলে দিলে উজান! অস্থির হিয়াকে শান্ত করে হিয়ার গলায় চেইন টা পড়িয়ে দিতে দিতে উজান বললো” এতে লজ্জার কি আছে, মা পরিস্থিতির স্বীকার ছিলো ঠিকই কিন্তু যেভাবেই হোক কিছু হলেও তো এসবে উনি..” হিয়া গলা থেকে উজানের হাত ছাড়িয়ে দিয়ে বললো

-তাই বলে,মা রা কখনো ভূল হয় না উজান। তুমি কাজ টা ঠিক করো নি”

– আশ্চর্য তো আমি কি করলাম এতে,ছাড়ো ওসব,দেখি।

উজান হিয়াকে জড়িয়ে ধরে শুইয়ে নিতেই ক্ষেপে উঠলো হিয়া,রাগান্বিত সুর টেনে বললো” কি সমস্যা দরজা খোলা আর এটা ভাইয়ের রুম, ছাড়ো আমাকে ” মুখটা গম্ভীর করলেও হিয়াকে ছাড়লো না উজান। দরজা লাগিয়ে হিয়ার দিকে এগিয়ে আসতেই মাথার চুল খামচে ধরলো হিয়া। উজানের এই সময়ে অসময়ে আসা আদরের টানে যেনো মেয়েটা বিরক্ত ত্যাক্ত হেনস্ত। উজান হিয়ার দিকে ধেয়ে আসতে আসতে বললো” রাত চারটা বাজতে যাচ্ছে এখন একটু ঘুমাই আমরা” হিয়া উজানকে এক ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিতে চেয়েও পারলো না। উপায়ন্ত না পেয়ে উজানের বাহু বন্ধনে আঁটকে থাকতে হলো তাকে।

– আমরা এখন ঘুমিয়ে গেলে চলবে। ভাইয়া আর আপু এসে ডাকলে তখন!

– তোমার মনে হয় রোদকে এতো সহজে ছাড়বে তোমার ভাই!

– হ্যা কিন্তু

– চুপপ কোনো কথা না আর। কালকে অনেক কাজ আছে। কাজি আসবে, শিশির আর রোদের বিয়ে হবে,রোদের ট্রিটমেন্ট চলবে আরো অনেক কিছু তাই এখন একদম রেস্ট বুঝছো।

– হ্যা কিন্তু উজান আমরা তো আমাদের রুমে গিয়ে এসব..

আর বলতে পারলো না হিয়া তার আগেই তাকে নিয়ে আদরের দেশে হারিয়ে গেলো উজান। এদিকে সিঁড়ি বেয়ে ধীরস্থ পায়ে ছাঁদের উপর আসতেই বুক ধরফর করতে শুরু করলো রোদেলার। কোথায় শিশির কোথায় শিশির কোথায় তার শিশির! সামনে একটু এগিয়ে আসতেই পা আঁটকে গেলো তার। পেছন ফিরে সিগারেট হাতে দাঁড়িয়ে আছে তার ম্যানেজার সাহেব। সাথে আকাশের দিকে তাকিয়ে ধোঁয়া ছাড়ছে তো কখনো আকাশের তারা গুনছে । রোদের উপস্থিতি ঠিকই ধরতে পারছে কিন্তু এতোই রেগে পাথর হয়ে আছে যে একটা আওয়াজ অবধি করছে না ছেলেটা,এতো খারাপ!

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here