চোখের_তারায়_তুই? #পর্ব_৪০

0
811

?#চোখের_তারায়_তুই?
#পর্ব_৪০
#ইভা_রহমান

সারারাত আদর সোহাগ সহ শত-শত প্রতুশ্রুতির পসরা সাজিয়ে একটা স্মৃতিময় সময় উপভোগ করলো রোদেলা আর শিশির। সেই রেশ কাটিয়ে ভোর রাতে ঘুমটা লেগে আসে শিশিরের দুচোখ জুড়ে। রোদকে জড়িয়ে ঘুমিয়ে নিতেই কিছুসময় বাদে নেশার টানে উঠে পড়ে রোদ। আবারো সেই নেশারঝোক পেয়ে বসে তাকে। আগে তো চাইলেই হাতের কাছে সব মজুদ ছিলো কিন্তু এখন। শিশিরকে ডাকবারো তো সাহস পাচ্ছে না সে। কিন্তু শরীর তো এই ব্যাথা নিতে পারছে না আর। উপায়? উঠে এসে বারান্দার দরজা খুলে বারান্দায় কিছুক্ষণ বসে রইলো রোদেলা। ফজর শেষ হয়ে আকাশে সূর্যের আভা দেখা মিলছে। আর একটুসময় বাদে হয়তো পুরোপুরি সকাল নেমে যাবে। ভোরের শীতলতার সাথে পুরো শরীর কেঁপে উঠছে রোদের। অনেক চেষ্টা করছে সে নিজেকে শান্ত রাখার কিন্তু পারছে আর কোথায়। পুরো শরীর চিবাচ্ছে তার। এখন একটু নেশা মিললেই যেনো শান্তি আসতো তার। উঠে এসে রুমের লাইট জ্বালিয়ে দিলো রোদ। সবকিছু উল্টে পাল্টে খুঁজতে শুরু করলো তার ব্যাগ। কিন্তু ব্যাগ কোথায় এখানেই তো রেখেছিলো কাল সকালে তাহলে। নেশার টানে পুরো জামাকাপড় ঘরবাড়ি আউলে ফেললো রোদ। ব্যাগ কোথায় তার ব্যাগ টাকেই তো বড় প্রয়োজন এ-ই মুহুর্তে। তাহলে কি শিশির ওটা নিয়ে লুকিয়ে রেখেছে,কিন্তু কেনো!

রোদ নিজের চিবানো শরীরটাকে শান্ত করতে করতে যেই পেছনে ফিরতে যাবে ওমনি শিশিরের বুকে মাথা ঠেকলো তার। মুখ তুলে উপরে তাকাতেই চোখ ভরে আসলো মেয়েটার। চোখে চোখ পড়তেই শিশিরের দিকে করুন এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে উঠলো রোদেলা বোঝাতে চাইলো তার অপারগতা ঠিক কতোটা।

– আমি তোমাকে ব্যাগ দেবো না রোদ।

– কেনো এরকম করছো,আমার খুব খারাপ লাগছে প্লিজ কষ্ট দিও না আমাকে।

– কষ্ট তো তুমি আমাকে দিচ্ছো। এরকম কেউ করে। আমাদের নতুন সংসার আর সেখানে এভাবে সব তছনছ করে রেখে দিলে তুমি।

– আমার শরীরে খুব ব্যাথা দিচ্ছে শিশির। ওটা ওটা না নিলে আমি শেষ হ’য়ে যাবো। ওটা নিলে না আমার শান্তি লাগে। খুব আরাম পাই আমি। তুমি চাও না আমি একটু সুখ পাই, বলো তুমি চাও না।

– চাই কিন্তু এভাবে না। তুমি নেশা বাদে যা বলবে আমি তাই এনে দেবো কিন্তু নেশা না।

রেগে উঠলো রোদেলা। দু’হাতে শিশিরের গাল আঁকড়ে ধরে রাগান্বিত সুর টেনে বললো,

– আমার ব্যাগ দিবে কি না বলো,নাহলে কিন্তু আমি ছেড়ে চলে যাবো তোমায়।

কথাটা বড্ড আঘাত করলো শিশিরকে। রোদ কিনা নেশার জন্য তাকে ছেড়ে চলে যাবার কথা অবধি বলছে।

– সত্যি চলে যাবে আমায় ছেড়ে।

– হ্যা হ্যা চলে যাবো। তুমি বুঝছো না কষ্ট টা আমার। রানা থাকলে ঠিক এনে দিতো,একটা না একটা ব্যবস্থা করতো কিন্তু তুমি কি করছো। আদর আদর আদর চাই না তোমার আদর। আমাকে নেশা দেও। আমার নেশা চাই।

রোদকে আগলে রাখা বাঁধনটা নিমিষে আলগা হয়ে পড়লো শিশিরের। এসব কি বললো রোদ তাকে। ঘুমানোর আগে অবধি তো সব ঠিকই ছিলো তাহলে এখন। চোখে আসা পানিটাকে মুছে নিয়ে রোদের দিকে এগিয়ে আসলো শিশির। রোদকে আবারো বুকে আগলে নিতে নিজেকে ছাড়ার আপ্রাণ চেষ্টা করতে থাকলো রোদ। কিন্তু শিশির ছাড়লো না। অনেক বোঝানোর চেষ্টা করতে থাকলো শিশির কিন্তু অপমানের বিনিময়ে শিশিরকে কিছুই ফিরিয়ে দিলো না মেয়েটা। তীব্র কষ্ট হলেও শিশির জানে এগুলো তার রোদের মনের কথা না। তার রোদরানি যে পরিস্থিতির স্বীকার।

!
!
উজানের পরামর্শে রোদকে কিছুদিনের জন্য রিহাবে রাখার ব্যবস্থা করলো শিশির। যদিও এতে শিশিরের বিন্দুমাত্র কোনো আগ্রহ ছিলো না। সে তো রিহ্যাব নাম টা শুনেই ক্ষেপে উঠেছিলো প্রথমে। কিছুতেই সে যে তার রোদকে ঔসব জায়গাতে পাঠাতে রাজি নয়। কতো কি করবে তারা রোদের সাথে,তার রোদ পারবে কি সেসব সহ্য করতে। রোদের যদি খুব কষ্ট হয়! উজানের আশ্বাসে শেষমেশ রোদের ভালো কিছুর আশায় শিশির রোদকে রিহাবে পাঠাতে রাজি হয়। এদিকে রিহাবে থাকতে কষ্ট হলেও মেনে নিলো রোদ। রিহ্যাব টা উজানের সুপরিচিত বিধায় উজান এ-ই রিস্ক টা নিতে চেয়েছে,তার কোন বন্ধুর নাকি ছোট ভাই এরকম এ্যাডিক্টেট ছিলো,রিহ্যাবে যা-ওয়ার পর-ই ঠিক হয়ে এখন অনেকটা স্ট্যাবেল আছে। সবকিছু বিবেচনা করেই উজান সিদ্ধান্ত টা নিয়েছিলো। আর এই সিদ্ধান্তে সফলো হয় ছেলেটা। টানা কুড়ি দিনের নিষ্ঠুর এক চিকিৎসার কবলে পড়ে নিজেকে অনেকটা সুস্থ করে বাড়িতে ফিরতে সক্ষম হয়েছে রোদেলা। তবে চোখমুখের অবস্থা পুরো কাহিল। চোখের নিচে কালি,শরীরের ওজন কমে প্রায় শূন্যের কোঠায়।

রোদ বাড়িতে আসার পর থেকে এ-ই যে শুরু হলো শিশির সহ হিয়ার যতো রকমের যত্নআত্তি। হিয়ার এক কথা তার রোদ আপু সুন্দর তো তাকে সবসময় সুন্দর থাকতে হবে। এরকম চোখে কালি,ফিনফিনা শরীর,না এটা কিছুতেই যে হিয়া মেনে নিতে পারছে না। রোদকে আগের মতো সুন্দর সুস্থ ফিট করে তুলতে হিয়ার শুরু হলো যতোরকম পাগলামি। শিশির আর উজান কি করবে রোদের প্রতি হিয়ার যে যত্ন,ভালোবাসা গড়ে উঠেছে এতে কি রোদ আগের মতো সুষ্ঠপুষ্ঠু না হয়ে পারে।

!
!

বিছানায় শুইয়ে রোদের সাথে গল্প দিচ্ছে উজান। কারেন্ট চলে গেছে অনেকক্ষণ হলো। চার্জার ফ্যানটারো গতি কম। টেবিলের সামনে বসে অফিসের ফাইল হাতে হিসাব কষতে ব্যস্ত শিশির। উজানেরো তো এখন যথেষ্ট ভালো ইনকাম হচ্ছে এ-ই মুহুর্তে আইপিএস এর ব্যবস্থা করলে মন্দ হয় না বিষয়টা। সেই নিয়ে কথা চলাকালীন জুস হাতে রুমে ঢুকলো হিয়া। চোখে মুখে প্রফুল্লের হাসি টেনে বললো,

– এ-ই যে রোদ আপু,উঠো তো জলদি,ফটাফট জুস টা খেয়ে নেও তো কুইক__সাড়ো না তুমি উজান,দেখছো আপুর গরম লাগছে তারপরো নিজে ফ্যান দখলে নিয়ে আছো?

বিছানা থেকে উঠে বসে জুসের গ্লাস টা হাতে নিলো রোদ। হিয়াকে পাশে বসিয়ে বললো,

– আমার গরম লাগছে না রে পাগলি,দেখি বস তো একটু,আসছি থেকে একটা কাজ অবধি করতে দিচ্ছিস না আমায়,সারাক্ষণ রান্নাঘরে এটা ওটা রান্না করছিস,এভাবে পড়াশোনার কতো ক্ষতি হচ্ছে বল তো, শিশির তুমি কিন্তু তোমার বোনকে বলে দেও হ্যা কালকে থেকে আমাকে কিছু করতে না দিলে কিন্তু আমি আর এ বাড়িতে থাকবো না হ্যা।

– বালাইষাট তোমাকে যেতে দিলে তো আমি,আর আমার পড়াশুনার কোনো ক্ষতি হচ্ছে না বুঝছো তোমার ভাই যে সারারাত বই নিয়ে বসিয়ে রাখে,,, এখন তুমি ঝটপট জুস টা শেষ করো তো। আমার সব রান্না শেষ এরপর গোসল করে এসে একসাথে খাবো কেমন।

রোদ জুস টা শেষ করে নিতেই শিশির রোদের হাতে ফাইনাল ইয়ারের ফর্মফিলাপের কাগজ ধরিয়ে দিতেই চমকে উঠলো রোদেলা৷ মানে কি,এখন ব্যাগ হাতে পরীক্ষা দিতে যেতে হবে নাকি তাকে!

– এ এসব কি হ্যা,দেখো আমি সারাবছর কিছু পড়িনি হ্যা, কি চাইছো যে আমি ফেইল করে আরো সাড়ে সর্বনাশ করি নিজের।

– আমার ফাস্ট ক্লাস লাগবে না রোদ। তুমি শুধু পাশ করো তাতেই আমি খুশি।

– সেই পাশ টাও আমি করতে পারবো না শিশির। এই এক দু মাসে কি পড়ে আমি।

– আর কোনো কথা না রোদ। যা বলছি তাই শুনো এমনিতে একবছর গ্যাপ গেছে এখনো তোমার না,

– হ্যা কিন্তু আমি,

হিয়া রোদকে অভয় জানিয়ে বললো,

– কোনো কিন্তু না রোদ আপু,আমরা আছি তো। উজান আছে। তুমি একটু কষ্ট করে পড়লেই দেখবে তুমি পাশ করে যাবে।

– আমার হবে না হিয়া।

– আমি তো বলছি তুমি পারবে। একটু ভরসা রাখো।

– বলছিস?

– হুম বলছি।

– ঠিক আছে যখন আমাদের বুড়িটা এতো করে বলছে তখন আমি না করে আর পারি কি করে।

হেঁসে দিলো হিয়া। রোদকে বললো তোমরা গল্প করো আমি রান্না ঘরটা মুছে নিয়ে আসি। হিয়া রান্নাঘরে এসে গ্যাসের চুলাটা মুছতেই ধীর পায়ে উজানো উঠে আসলো। হিয়ার পেছনে দাঁড়িয়ে ডান হাতে হিয়ার কোমড় জড়িয়ে বা হাত প্রসারিত করে হিয়াকে আগলে নিলো। ঘামে ভেজা শরীরে উজানের এই পরশ যেনো শীতলতার ছোঁয়া লাগিয়ে দিলো। মৃদু হেঁসে হিয়া বললো,

– কি করছো উজান,কি চাই?

– তোমাকে চাই।

– আমি তো তোমারই।

– হুম সে তো আমরাই,

– তাহলে?

উজান হিয়ার ঘাড়ে চুমু এঁকে বললো,

– না আমি ভাবছি,আমি জ্বরে পড়লেও তো আপনাকে আমার এতোটা সেবাযত্ন করতে দেখি না কখনো,যতোটা রোদের জন্য অস্থির হয়ে আছেন আপনি।

হিয়া মুখ টা উজানের দিকে আলতো করে ঘুরিয়ে বললো,

– আমি আপনার সেবা করিনা এ কথা বলতে পারলেন আপনি উজান। হ্যা রোদ আপুকে বেশি কেয়ার নিচ্ছে কারণ আপুর অবস্থা তো খুব একটা ভালো ছিলো না। তাই না। আমি চাই আপু আগের মতো ঠিক হয়ে উঠুক আর আমরা চারজন মিলে সুখে শান্তিতে যেনো বাকিটা জীবন কাটাতে পারি।

উজান হিয়ার নাকের সাথে নাক ঘষে নিয়ে বললো,

– হুম,থাকবো একসাথে।

– আর কি বলো তো উজান। আমি তো কখনো মা বা বাবা কাউকে কাছে পাইনি না। আমার শৈশবে,কৈশোরে চাচি আর রোদ আপুই অনেকটা সেই অভাব পূরণ করেছিলো আমার। তাহলে তাদেরকে কীভাবে ভূলে যাই বলো,হ্যা একটা সময় ভূল বুঝেছিলাম আপুকে,আসলে কি বলো তো নিজের মানুষের থেকে এরকম কিছু সহ্য করতে পারিনি। আজকে আপুর জায়গায় তুমি বা ভাইয়া থাকলেও হয়তো আমি এরকমই রাগ করতাম।

উজান হিয়ার কথার তালে হিয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো,কতো বড় হয়ে গেছে না তার হিয়া। কি সুন্দর সব বুঝে এখন। কি সুন্দর সবাইকে আগলে রাখতে জানে।

– আচ্ছা, ছাড়ো এখন,কেউ আসবেএএএ উজানন।

উজান হিয়াকে তার দিকে ঘুরিয়ে হিয়ার সাড়া শরীরে আদর করতে করতে বললো,

-একবার ধরলে ছাড়তেই তো মন চায় না ম্যাডাম কি যে বেহাল অবস্থা বানিয়ে দিচ্ছেন আমার।

হেঁসে ফেললো হিয়া। অনেক কষ্টে উজানকে বুঝিয়ে গোসলে পাঠাতে সক্ষম হলো। সত্যি এই পাগল টা পারেও বটে সারাক্ষণ শুধু আদর আর আদর।

?
এদিকে রোদেলা আর শিশির নিজেদের মধ্যে সব ঝড়ঝাপটা কাটিয়ে যেই জীবনটাকে নতুন করে উপভোগ করতে শুরু করলো তো উল্টোদিকে উজান হিয়ার মাঝে ঝগড়া খুনসুটি যেনো লাগামহীন ভাবে বেড়ে উঠলো। সেগুলো অবশ্য ভালোবাসাময় ঝগড়া সিরিয়াস কিছুই না। এদিকে এদের এই তুতু ম্যা ম্যা নামক ভালোবাসার আদিক্ষ্যেতায় মাঝেমধ্যে বিরক্ত হয়ে উঠে শিশির কিন্তু উজান আর হিয়ার এই টম এ্যান্ড জ্যারি টাইপ ঝগড়া বেশ উপভোগ করতে শুরু করলো রোদেলা। দিনে সারাদিন ঝগড়া ঝগড়া ঝগড়া রাতে আবার কি সুন্দর দেখো একে অপরকে জড়িয়ে শান্তির এক ঘুমে হারিয়ে যায়। এরকম কেউ করে।

আজো সেই রেশ ধরে উজানের সাথে কথা কাটাকাটি চলছে হিয়ার। ঝগড়ার মূল কারণ হিয়ার মনে মনে পাতানো সতিন প্রিয়ন্তী। লতার নানিকে দেখতে লতাসহ হিয়া আজ সকালে বেড়িয়েছিলো মেডিকেলের উদ্দেশ্যে। সেই সূএে লতার বায়নার হিয়াকে যেতে হয় মেডিকেল ক্যান্টিনে। আর সেখানেই এক টেবিলে উজানের সাথে প্রিয়ন্তিকে দেখেই ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে হিয়া। এমনিতে হিয়া উজানের ব্যাপারে যা পজেসিভ কাউকে উজানের আশেপাশে সহ্য হয় না তার। তারউপর কি না একই টেবিলে একই সাথে এরা দুজন। আজ আর হিয়াকে কে পায়। উজানের মাথার চুল একটাও রাখে কি না এ-ই মেয়ে সন্দেহ।

– বের হোন বাড়ি থেকে। বলছি না বের হোন। দেখুন আর রাগ তুলবেন না কিন্তু আমার হ্যা নাহলে কিন্তু, নাহলে কিন্তু আপনাকে আমি।

মৃদু হেঁসে হাতে থাকা আপেল টায় এক কামড় বসিয়ে গেটের দেওয়ালে ঠেস দিয়ে একটা ভাব নিয়ে দাঁড়ালো উজান। আপেল টা চিবিয়ে নিয়ে রোদকে কন্ঠ উঁচু করে বললো,

– কোথায় জানি একটা কিরকম জ্বলে যাওয়া গন্ধ গন্ধ পাচ্ছি বলে মনে হচ্ছে না। রোদ এই রোদ দেখ তো রান্নাঘরে কিছু পুড়ছে কি না?

– আপনি আমার সাথে মজা করছেন। হ্যা জ্বলছি আমি খুব জ্বলেপুড়ে খাক হয়ে যাচ্ছি। শান্তি এখন?

চুল গুলো এক হাতে ব্রাশ করে নিয়ে উজান বললো,

– এতো জেলাসিইইই! ইশশ। তবে যা-ই বলো আজকে কিন্তু প্রিয়ম্তীকে গ্রীন কামিজে মারাত্মক সুন্দর লাগছিলো তাই না।

– হুম এখন তো আমি পুরানো হয়ে যাচ্ছি না এখন তো প্রিয়ন্তী কেনো আমি বাদে সব মেয়েই তো সুন্দর লাগবে চোখে।

– হুম পুরাতন তো একটুআধটু হয়েছো, আগের সেই বাচ্চামি টা মুখের মধ্যে নেই না। কি আর করার বিয়ে যখন করেছি তখন তো আর মাঝরাস্তাতে ফেলে যেতে পারি না না।

ঠোঁটে ঠোঁট চিপে সহ্য করলো হিয়া,হাত দুটো শক্ত করে মুঠো করে বললো,

– আপনি বেরুবেন এ-ই বাড়ি থেকে। আমি সত্যি সত্যি রেগে উঠলে কিন্তু,

– তারমানে এতোক্ষণ তুমি মিথ্যা মিথ্যা রেগে ছিলে হিয়া,

আঙ্গুল তুলে হিয়া বললো,

– আপনি না। কি ভাবেন বলুন তো নিজেকে খুব চালাক না?

– আরে চালাক তো আমি এমনিতেই তোমার মতো মাথা মোটা নাকি। আচ্ছা হিয়া একটা কথা জিজ্ঞেস করি,না ধরো তুমি তো দিনদিন বুড়ি হয়ে যাচ্ছো না,শিশির আর রোদ যেভাবে তোমাকে আদর করে বুড়ি ডাকে,ওমনি ডাকতে ডাকতে তো তুমি সত্যি সত্যি বুড়ি হয়ে গেলে এখন যদি আমি আরেকটা বিয়ে করি,সাপোস প্রিয়ন্তীকেই করলাম তুমি রাগ করবে না তো। না না রাগ তাই করবে তুমি না কতো মিষ্টি হিয়া আমার।

এতোক্ষন যাও বা চোখ মুখ শক্ত করে সবকিছু সহ্য করে যাচ্ছিলো হিয়া। এবার তো টানতে টানতে উজানকে ফ্ল্যাটের বাহিরে এনে গ্রীলের সামনে এনে দাঁড় করিয়ে ঠোঁটে ঠোঁট চিপে বললো,

– আমি আমি বুড়ি,আর প্রিয়ন্তী তো কচি খুকি। আ হা রে আরেকটা বিয়ে করবে। তা যাও না যাও আরেকটা কেনো বুকে সাহস থাকলে না আরো হাজারটা করো,ভাইয়াকে তো চেনো না না ওখানেই গুলি করে রেখে দেবে তোমাকে।

– আচ্ছা! যা আমি তো ভয় পেয়ে গেলাম!

– আপনাকে তো আজ আমি,বের করে দিয়েই ছাড়বো। আমার সাথে মস্করা,আমি রেগে আছি যেনেও আমাকে নিয়ে মজা,দাঁড়ান তবে।

হিয়া দৌড়ে গ্রীলের চাবি এনে গ্রীল খুলে উজানকে টানতে টানতে বললো,

-এই বের হোন তো আপনি, বের হোন। আর যদি এ বাড়িতে আমি আপনাকে দেখেছি না তো।

– আরে শার্ট তো ছাড়ো,নতুন শার্ট আমার, প্রিয়ন্তী বললো কি সুন্দর মানিয়েছে আমায়। আর তুমি শার্ট টাকে টানাটানি করে ছিঁড়তে চাইছো। স্টুপিড গার্ল।

হিয়া নিজের মাথায় মারতে মারতে বললো,

– হ্যা আমি তো স্টুপিড, ইডিয়ট আমি,মাথামোটা গরু গর্ধব,না হলে কি সরল মনে আপনাকে বিশ্বাস করে মেডিকেলে ডিউটি দিতে পাঠাতাম। আমার এ-ই মাছুম মনটা কি আর জানতো আপনি ডিউটির নাম করে ফাস্ট ইয়ারের মেয়েদের সাথে রংতামাশা করে বের হোন।

– মেয়েদের সাথে না বলো ওনলি প্রিয়ন্তীর সাথে।

হিয়া উজানের গলা টিপে ধরে বললো,

– আপনাকে তো আজকে আমি,প্রিয়ন্তীর ভূত যদি না তাড়িয়েছি না আপনার মাথা থেকে তো আমিও হিয়া মুনতাসীর না।

– আরে পাগলি ছাড়,আরে তোর হাতের নখ,হিয়াআ।

উজানকে ছেড়ে দিয়ে হাত টেনে বের করতে নিতেই উপরে ছাঁদ থেকে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামছিলো শিশির। আর নামতেই নিজের বোনের আবার সেই উজানকে বের করে দেওয়া দেখে রীতিমতো রাগের আগুন জ্বলে উঠলো পুরো শরীরে।

– আর কোনোদিন এ বাড়িতে আসবেন না আপনি, আপনাকে আসতে দেখলেই আমি কিন্তু।

– হ্যা ঘরজামাই থাকি না। তাড়িয়ে তো দিবেই। শ্বশুরের সম্পত্তি আমার কি কোনো অধিকার আছে নাকি।

– ঘরজামাই ঘরজামাই এর মতো থাকবেন। এতো,এতো কিসের বাহিরের দিকে নজর দেন শুনি। আপনি না অহেতুক কথা বলে সময় নষ্ট করছেন। বের হোন তো আপনি, হবেন কি?

উজান বের হতে নিবে ঠিক সেই মুহুর্তে নিজেকে আর আটকাতে না পেরে হিয়ার দিকে ধেয়ে আসলো শিশির। হাত তুলতে ধরেও থেমে গেলো। ভয় পেয়ে চোখ বন্ধ করে চুপসে গেলো হিয়া। হিয়ার বাহু চেপে রাগান্বিত দৃষ্টিতে শিশির বললো,

– আবার আবার তোর ছেলেমানুষী। তুই জীবনেও শুধরাবি না। আমার যা বোঝার বোঝা শেষ।

উজান শিশিরের থেকে হিয়াকে ছাড়িয়ে নিয়ে তাকে শান্ত করতে করতে বললো,

– কিছু না জেনে রিয়াক্ট করিস না শিশির। আমি হিয়াকে রাগিয়ে দিচ্ছিলাম যার কারণে হিয়া।

– সে যে-ই কারণেই হোক,বাড়ি থেকে বের করে দিবে এটা কেমন আচরণ। এ-ই তুই চাস না উজান এ বাড়িতে থাকুক। বল চাস না। না চাইলে খোলাখুলি বলে দে আমি আজকেই তোদের ডিভোর্সের ব্যবস্থা করে দেবো,কি দেবো।

কথাটা খুব উঁচু কন্ঠে হিয়াকে ঝারি দিয়েই বললো শিশির। এদিকে শিশিরের গলা পেয়ে দৌড়ে আসলো রোদেলা। কান্নারত হিয়াকে শান্ত করতে তাকে আগলে নিতেই এক ছুটে কাঁদতে কাঁদতে নিজের রুমে গিয়ে দরজা লাগিয়ে দিলো হিয়া। এদিকে কপালে হাত দিয়ে উজান বললো,

– অহেতুক সীনক্রিয়েট টা না করলেই চলতো না তোর। আগে তো শুনবি পুরো ব্যাপারটা।

– না আমি চাই না কিছু শুনতে। গত কয়েকমাস ধরে তোদের এইসব, মানুষ তো একটা দিন অন্তত চুপ থাকে। এভাবে সারাজীবন একসাথে থাকবি কি করে।

– তুই যা ভাবছিস সেরকম কিছুই হয়নি ভাই, তুই আসলি কেনো আমাদের মাঝে, খামোখা মেয়েটাকে কাঁদিয়ে দিলি।

রোদ শিশিরকে রাগ করতে করতে বললো,

– আমি এর আগেও তোমাকে দেখেছি অহেতুক তুমি মেয়েটার সাথে চিল্লাচিল্লি রাগারাগি করো। কেনো করো। শুনো তো আগে দোষ টা কার।

শিশির শুনলো না। রাগ করে রুমে ঢুকে দরজা টা ধাম করে বারি মারলো। রোদ উজানকে আঙ্গুল তুলে বললো,

– সব তোর জন্য হয়েছে। ঘর থেকে সব শুনেছি আমি। কি দরকার ছিলো প্রিয়ন্তীর কথা বলে মেয়েটার রাগ তুলে দেবার। জানিসই তো তোর ভাগ কাউকে দেওয়া পছন্দ না তার। তারপরো।

– আরে আমি কি করলাম, এরকম তো রোজ হয়,আজকে যে শিশির এসে এভাবে।

– রোজ তো আর শিশির বাড়িতে থাকে না না। যা গিয়ে এবার ভাঙা মান হিয়ার। দোয়া করি হিয়ার এ-ই রাগ যেনো আগামী এক সপ্তাহো না কমে আর।

– কি খারাপ বোন তুই রোদ। কোথায় ভাইকে হেল্প করবি উল্টে বদদোয়া দিয়ে বলছিস আগামী এক সপ্তাহ যেনো হিয়ার রাগ না কমে! সিরিয়াসলি!

!
!
দরজা জানালা লাগিয়ে রুমটাকে অন্ধকার বানিয়ে গাল ফুলিয়ে বসে আছে হিয়া। সাথে চলছে লতার সাথে ফেইসবুকে এক বিরাট চ্যাটিং এর পসরা। কি তার অভিযোগ কি তার রাগ। এদিকে সোফার রুমে শুইয়ে সেই কনভারসেশন পুরো দম উপভোগ করছে যেনো উজান। হিয়ার সেই পাসওয়ার্ড তো এখনো উজানের কাছে,এখনো নিজের কম হিয়ার আইডিতেই আনাগোনা যেনো বেশি চলে উজানের। সেই কনভারসেশন পড়তেই মনে মনে যে এতো হেঁসে ফেলছে ছেলেটা তা হিয়া আর লতার টেক্সট দেখলেই বলাই বাহুল্য রাখে। সাথে ভালো লাগছে এ-ই ভেবে যে হিয়া আর যাই করুক উজানের উপর বিশ্বাস টা তো ঠিক বজায় রাখছে।

– তুই স্যারকে সন্দেহ করিস হিয়া?

– তোর মনে হয় উনি সন্দেহ করার মতো মানুষ। যে মানুষটা আমার জন্য তার পরিবার ছেড়েছে,নিজের মা’কে ফেলে আসছে তাকে সন্দেহ করতে বলছিস?

– তাহলে তোর এই মন খারাপের কারণ?

– তুই তো জানিসই আমি ওনাকে অন্য কারো সাথে সহ্য করতে পারি না। উনি আমার তো শুধু আমার। কি দরকার ঔ প্রিয়ন্তীর সাথে কথা বলার। মেয়েটাকে তো প্রথম থেকেই সুবিধের মনে হয় না আমার,দেখলি না কিরকম ফোনটা লুকিয়ে রেখেছিলো আমার একবার।

– তা বুঝলাম,হয়তো দেখ স্যার কোনো জরুরি দরকারে ওর সাথে একসাথে বসে,

– সে আমি জানি। ওনার দায় ছিলো বলেই উনি বসেছিলো কিন্তু আমার জিনিসটা ভালো লাগেনি এটাই হচ্ছে মূল কথা। কেনো বসবে উনি ঔ মেয়েটার সাথে উনি জানে না ঔ মেয়েটা কি নজরে দেখে ওনাকে।

– তা এখন কি করবি,এভাবে রুমে দরজা লাগিয়ে বসে বসে কাঁদবি।

– কাঁদছি কোথায়,আমি তো আমার রাগ দেখাচ্ছি। উনি কি বলে জানিস আমি নাকি বুড়ি প্রিয়ন্তীকে নাকি গ্রীন কামিজে কি সুন্দর মানিয়েছে,হিয়া আমি যদি প্রিয়ম্তীকে বিয়ে করি তুমি কি খুব রাগ করবে। বল কিরকম লাগে তখন!

হেঁসে ফেললো লতা। শত-শত হাহা ইমোজি ভরিয়ে দিয়ে রিপ্লাই করলো,

– ব্যাপারটা কিন্তু বেশ এন্টারটেইনের হবে রে হিয়া। দুই সতীনে মিলে চুলাচুলি করবি ওয়াও না বল।

– পাতার বাচ্চা লতা,এক শুটিয়ে চামড়া লাল করে দেবো তোর। বেয়াদব।

আরো হেঁসে দিয়ে একগাদা হা হা দিতেই রাগে লতাকে ব্লক করে দিলো হিয়া। এদিকে হিয়ার আর লতার এ-ই কনভারসেশন বেশ উপভোগ করলো উজান। হিয়া কি না লতাকে মেরে লাল চামড়া বের করে দেবে সত্যি এ-ই মেয়ে ডেঞ্জারাসো বটে।

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here