চোখের_তারায়_তুই? #পর্ব_৪১

0
678

?#চোখের_তারায়_তুই?
#পর্ব_৪১
#ইভা_রহমান

নিজেকে সামলে ব্যালকুনি বরাবর হিয়ার জানালার কাছে এসে দাঁড়ালো উজান। থাই খুলে ভেতরে উঁকি দিতেই ধপ করে উঠে এসে উজানের দিকে তেড়ে আসলো হিয়া। চোখ গুলো ইয়া বড় বড় করে বললো,

– আপনার জন্য ভাইয়া আমাকে মারতে ধরছিলো হ্যা,আপনার সাথে আমার আর কোনো কথা নেই। ছাড়ুন আমার জানালা,ছাড়ুন বলছি। আআআআ আমি ডাকবো কিন্তু ভাইয়াকে।

– হ্যা ডাকো,নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারতে মন চাইলে ডাকো।

– আআআ আপনাকে না আমিইই,

পর্দা সরিয়ে হিয়া পিছিয়ে আসতেই হিয়ার জামা টেনে ধরলো উজান। ব্যাথা পেয়ে আবারো জানালার গ্রীলে লেপ্টে গেলো হিয়া।

– আমার জামা ছিড়লোওও উজান,,,,এ-ই যে লোকক কি করছেন কি! এ্যা হ্যাএএ আমার লাগে তো।

উজান হিয়ার জামা ছেড়ে হিয়ার গাল জড়িয়ে বললো,

– দেও না গেট টা খুলে,দেখো রাত বারোটা বাজছে এরকম করে নিজের স্বামীকে বাহিরে দাঁড় করিয়ে রাখা টা কি ঠিক বলো,

– কে বলেছে দাঁড়িয়ে থাকতে,যান গিয়ে কোথাও শুইয়ে পড়ুন,বাড়িতে তো রুমের অভাব নেই না।

– না,তুমি যখন বলবে তবেই আমি ফ্ল্যাটের ভেতর পা রাখবো নয় তো ,

– নয় তো কি,এখানে সারাজীবন এভাবে দাঁড়িয়ে থাকবেন?

– উমম,হুম থাকবো।

– বেশ তাহলে তাই থাকুন। আজকে আপনি আমাকে খুব হার্ট করেছেন হ্যা এতো সহজে আপনাকে আমি ক্ষমা করবো না। আপনার ইচ্ছে হলে অন্য রুমে গিয়ে থাকুন নয়তো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমাকে পাহাড়া দিন। কিন্তু আমার রুমের দরজা তো আমি এ জীবনেও আর খুলবো না। উমহুম।

ব’লেই ফাঁক তালে জানালার থাই ভেতর থেকে লক করে দিলো হিয়া। এদিকে ব্যর্থ প্রেমিকের মতো নিজের উপর নিজেই রাগ ঝেড়ে দাঁড়িয়ে পড়লো উজান। কি করবে এখন,হিয়াকে তো বললো যে হিয়া না বললে ফ্ল্যাটে পা রাখবে না এখন কি করি। এদিকে ক্ষিদাও তো পেয়েছে প্রচুর। কিন্তু রুমে গিয়ে কোথাও ঘুমিয়ে পড়লেও তো হিয়া এসে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে যাবে। ধুর কি জ্বালা।

সেদিন আর গেইট তো খুললেই না হিয়া। উপরন্ত ছাঁদ থেকে একটা ফেলে রাখা লম্বা চৌকি এনে হিয়ার জানালার কাছে বিছিয়ে দিয়ে তাতে শুইয়ে পড়লো উজান। দেখি তো মহারানীর রাগ আদৌও কখন ভাঙ্গে।

সেদিন আর হিয়ার মান ভাঙ্গেনি। উজানো সারারাত মশার কামড়ে ঔ বাহিরেই পড়ে ছিলো। রোদেলা এসে বালিশ আর খাবার দিয়ে গিয়ে মজা নিতে নিতে ভাইয়ের ল্যাগপুল করলেও শিশির বড্ড ক্ষেপে উঠলো বিষয়টায়। উজানকে চোখ রাঙিয়ে বললো ভেতরে এসে ঘুমাতে কিন্তু উজানো উল্টে রাগ ঝেড়ে বললো সব তোর জন্য হইছে,তুই এরকম না করলে কিছুই হতো না। এদিকে সেদিন তো ওভাবে পাড় হলো হলো পরের দুদিনো ডিউটি সেরে উজান আসতেই দরজা লাগিয়ে ফেললো হিয়া। রোদ এসে পরপর বাহিরের চৌকিটার উপর ভাতের প্লেট রেখে দাঁত কেলাতে কেলাতে ভাইয়ের এই করুন অবস্থা পুরো দমে উপভোগ করলো। এবার আর থাকতে পারলো না উজান। হিয়ার জানালার লক টা কিসব কায়দাবি ভঙ্গিতে খুলে ফেললো আজ। থাই সরিয়ে হিয়াকে ডেকে নিতেই ভ*য়ে অন্তরাত্মা কেঁপে উঠলো হিয়ার। কি আশ্চর্য থাই তো দুদিন থেকেই লক করা তাহলে এভাবে সেটা খুলে দাঁড়ালো টা কে শুনি। কাঁপা পায়ে এদিকে ফিরতেই দেখলো স্ক্রু হাতে কীরকম চোখে রাগের আগুন জ্বালিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে উজান। একটা ডোন্ট কেয়ার এ্যাটিটিউট নিয়ে থাই লাগাতে গিয়েই দেখলো কি আশ্চর্য আবারো সেটাকে কি করে খুলে ফেলছে উজান। আবারো লাগাতে গিয়ে থাইটা শক্ত করে চেপে ধরলো উজান। রাগান্বিত সুর টেনে বললো,

– এবার কিন্তু বাড়াবাড়ি হচ্ছে হিয়া। তুমি দরজা খুলবা না আমি দরজা ভাঙ্গবো কোনটা?

– যা ইচ্ছে করুন গিয়ে,গত দুদিনে কতোবার আমার মান ভাঙ্গাতে চেষ্টা করেছেন আপনি শুনি। কতোবার ফোন দিয়েছেন আমাকে।

– ওহ আমি কিচ্ছু করিনি না। এই যে সারারাত মশার কামড়ে এখানে পড়ে থাকি যাতে তোমার সান্নিধ্যে থাকতে পারি। আর তুমি বলছো আমি কিছু করিনি।

– হ্যা এ্যা ইয়ে তো কি হয়েছে কেউ বলেছে নাকি মশার কামড়ে পড়ে থাকতে। আসুন ভেতরে কতো রুম আছে। দরকার পড়লে ভাইয়ার রুমে গিয়ে থাকুন,এতো পেয়্যারের বন্ধু আপনারা।

– হিয়া আমি কিন্তু,

হিয়া মুখে ভেংচি এঁটে পর্দা টেনে দিয়ে মেলে দিলো। বিছানায় শুইয়ে নিতে উজান আবার পর্দা সরিয়ে দিলো। এই চললো ঘন্টাখানেক। রোদ এসে উজানের গায়ে কাথা ছুঁড়ে দিয়ে দুঃখী দুঃখী মুখ করে বললো,

– ইশশ,এখনো রাগ ভাঙ্গেনি না না পিচ্চিটার?

– তোর খুব মজা লাগছে না এইসব। একবার হিয়াকে দরজা খুলতে দে,তারপর হিয়ার সাথে তোকেও ঠাটিয়ে দুটো চড় মারবো।

রোদ জানালার দিকে এগিয়ে এসে হিয়াকে ডেকে নিয়ে বললো,

– একদম ঠিক কাজ করছিস বুড়ি,এদেরকে না এরকম করেই পানি*শমেন্ট দেওয়া উচিৎ বুঝলি।

– আমি একদম ঠিক করছি না রোদ আপু বলো? তোমার ভাই বলে কিনা আমার সতীন আনবে,সাহস কতো বড়।

– একদম ঠিক করছিস,আমি হলে তো..

রোদকে কিছু বলতে না দিয়ে রেগেমেগে তাকে টানতে টানতে ভেতরে পাঠিয়ে দিলো উজান। সব নষ্টের মূল এই রোদ,বেশি আদর দিয়ে দিয়ে হিয়াকে বাঁদর বানিয়ে দিচ্ছে আজকাল যেনো। কপালে হাত দিয়ে অনেকক্ষণ বারান্দায় পায়চারি করলো উজান। না এভাবে হবে না। মান ভাঙ্গাতে কিছু তো করতেই হবে এবার। কি করা যায়!

!
!

রাত তখন দুটোর মাঝামাঝি, হিয়ার জানালার থাই দিয়ে একগাদা চকলেট ঢিল ছুড়লো উজান। হিয়া তখন রাত জেগে ফিজিক্সের থিউরি মুখস্থ করতে ব্যস্ত। আচমকা এতো গুলো চকলেটর পসরা দেখে চকিতে লাফিয়ে উঠলো হিয়া। আরে এতো গুলো চকলেট! চকলেট হাতে জানালার পর্দা সরিয়ে উঁকি দিতেই দেখলো একগাদা গোলাপ হাতে দাঁড়িয়ে আছে উজান। মনে মনে তো অনেক খুশি হলো হিয়া। কিন্তু না এতো সহজে রাগের বরফ গললে কি চলবে। হিয়া পর্দা টেনে দিতেই সেটাকে আঁটকে ধরে আদুরে কন্ঠে উজান বললো,

– Sorry!

কি একটা ভেবে নিয়ে ভেংচি কেটে সব চকলেট জানালা দিয়ে উজানের চৌকিতে ছুঁড়ে দিয়ে নিজের পড়াতে আবার মন দিলো হিয়া। কি করে উজান এখন। কিছুসময় বাদে আবারো নক করলো উজান। হিয়া সাড়া দিলো না। জানালা দিয়ে দুটো গল্পের বই ঢিল দিতেই লাফিয়ে উঠলো হিয়া। আরে এগুলো তো সেই বই যেগুলো তার রোদ আপুকে আনতে বলবো বলবো বলে ভাবছিলো সে। ইশশ মনে মনে তো হাজারটা লাড্ডু ফুটে গেলো হিয়ার। মনে তো হচ্ছে বই গুলো পড়ে রাতের মধ্যেই শেষ করে দিক সে,কিন্তু বই গুলো নিলেও তো হার মানতে হবে না। কষ্ট হলেও চকলেটের মতো আবারো সেগুলো ফেরত পাঠালো হিয়া। রাগ উঠলো উজানের। এতো অভিমান হিয়ার হ্যা যে এতোকিছু করেও মান ভাঙ্গছে না। শেষে আর একবার ট্রাই করতে দুপ্লেটের মতো ফুচকা এনে টক সহ পলিথিনের প্যাকেট টা ভেতরে ছুঁড়ে দিলো উজান। ফুচকার গন্ধ নাকে পৌঁছাতে জিহ্বে তো যেনো নিমিষে পানি চলে আসলো হিয়ার। মুখে এক বিরাট হাসি ঝুলিয়ে ফুচকার প্যাকেট নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে ভাবলো ফেরত দেবো কি দেবো না। দেবো কি দেবো না। ইশশ চকলেট আর বই তো পরেও নেওয়া যাবে কিন্তু এখন এ-ই ফুচকা গুলো দিয়ে দিলে তো তারই লস না। শেষে মুখে এক কাঠিন্যতা এনে জানালায় এসে দাঁড়িয়ে পড়লো হিয়া। হাতের সাথে হাত গুঁজে দিয়ে রাশভারি মুখ করে বললো,

– পানি*শমেন্ট এখানেই শেষ করে দিতে পারি কিন্তু কথা দিন আর কখনো প্রিয়ন্তীর আশেপাশে আপনি ঘুরঘুর করবেন না।

– তুমি যদি দরজা এবার না খুলো আশেপাশে না সাথে সাথে নিয়েই এবার ঘোরাঘুরি করবো,খুশি।

– কি বললেন আপনি!

– কিছু বলিনি রে,আপনি এবার দরজা টা খুলবেন কি?

– খুলছি,খুলছি,এটাই কিন্তু লাস্ট হ্যা। ক্ষমা করে দিচ্ছে বলে ভাববেন না আমার রাগ পড়ে গেছে আমি এখনো কিন্তু খুব রেগে আছি,নেহাৎ খাবার জিনিস নষ্ট করবো না বলে খেতে হচ্ছে, আর আপনি তো জানেন আমি খাবার নষ্ট করা পছন্দ করিনা। তাই জন্য ফুচকার বদলে গেট খুলে দিচ্ছি,ক্লিয়ার।

– ফুচকা লোভী,হু

ভেংচি কাটলো উজান,পেছন ফিরে ফিঁক করে হেঁসে দিলো হিয়া। দরজা খুলে দিতেই দৌড়ে এসে রুমে ঢুকলো উজান। দরজা লাগিয়ে এমন জোড়ে হিয়াকে চিপে ধরে বিছানায় ফেললো যে হিয়ার সব হাড় হাড্ডি বোধহয় স্টিমরোলারে পিষে ঝুরঝুরা হয়ে যাচ্ছে এরকম।

– আরেএএএ,আমি ফুচকা খাবো তো আগে। ছাড়ো নাআআআ।

– ফুচকা না,খাওয়াচ্ছি ফুচকা। আগে তো আমি তোমাকে খাবো তারপর বাকিসব।

– কেমন করে খাবা,আমি কি খাওয়ার জিনিস।

– গপগপ করে খাবো,যেমন করে তুমি ফুচকা খাও ওরকম করে খাবো।

হেঁসে ফেললো হিয়া। হিয়ার খিলখিল হাসির ধ্বনিতে ঝংকার উঠলো উজানের মনে। হিয়া ফুচকা গিলছে আর এদিকে উজান তার পিচ্চি হিয়াকে আদরে ভরিয়ে দুদিনের সব আদর পুষিয়ে নিচ্ছে।

!
!

এক বছর পরঃ

জীবনের সব চড়াই উৎরাই পেরিয়ে আজ চারটে জীবনে সুখের ছোঁয়া ভরপুর। আজ ক্ষত হৃদয়ে ভরে ওঠা চারটে মানুষের জীবন কানায় কানায় সুখ দিয়ে পরিপূর্ণ। শিশিরের কথা রাখতে নিজের ফাইনাল টা শেষ করে রোদেলা। শিশিরের প্রমোশন হয়,উজানো এমবিবিএস টা শেষ করে বাকি কোর্সগুলো করার প্রিপারেশন নেয়। হিয়ার সেকেন্ড টাইম মেডিকেলে চান্স টা অল্পের জন্য মিস হ’য়ে যায় কিন্তু ডেন্টালে ঠিক চান্স হয় তার। এতেই খুশি হিয়া। কারো সাথে প্রতিযোগীতায় আর তার মন বসে নি। হিয়ার বিশ্বাস সৃষ্টিকর্তা যেখানে তার ভালো চেয়েছেন সেখানেই হিয়াকে চান্স দিয়েছেন। এতেই সে মহাখুশি। রোদের বাবা মা এক দুবার নিজের মেয়েকে ফিরিয়ে নিতে এসেছিলেন কিন্তু শিশিরের কাছে হার মানতে বাধ্য হতে হয় তাদের। ওদিকে রানাও শিশিরকে নানা রকম হু*মকি ধা*মকি দিয়েও খুব একটা সুবিধে করতে পারেনি। রানার সব অ*বৈধ কাজের তথ্য রোদের কাছে ছিলো,রানা পাল্টা কিছু করতে চাইলেই সে নিজেই বিপদে পড়তো,তাই শিশিরের সাথে তর্কবিতর্ক চললেও জিততে পারেনি সে। একটা পর্যায় সে-ও নিজের রাস্তার দিকে চলে যায়। তারপর থেকেই আর কোনো বিপদ এ-ই চারজনকে ছুঁতে পারে নি। বেশ ভালোই আছে চারজন। উজান তো ঠিক করেছে এবার ব্যাংক থেকে লোন তুলে উপর তালার কাজ ধরবে সে,শিশির আর সে মিলে না-হয় সেটা শোধ করবে।

এতো শতো আনন্দের মাঝে গত তিনদিন আগে আরো একঝাঁক আনন্দের বন্যা নিয়ে আসছে রোদের কোলজুড়ে আসা তার আর শিশিরের ছোট্ট প্রিন্সেস । বাবা মা হবার অনুভবে শিশির রোদেলা তো খুশি তার চাইতে বেশি খুশি তো যেনো আজ হিয়া। তার শিশির ভাইয়া আর রোদ আপুর বাবু হয়েছে ভাবতেই তো শুধু নাচতে মন চাইছে তার। তারো যে শখ আবারো তার কোল আলো করে এরকম একটা বাবু আসবে কিন্তু তার সাদা বিলাই যে কাঠকাঠ কন্ঠে জানিয়ে দিয়েছে অন্তত চারটে বছর না গেলে তো বাবু নেওয়ার প্রশ্নেই মুখে আনা যাবে না আর। আগে পড়াশোনা তারপর বাদ বাকি সব। হিয়া হ্যা করলেও একবার যখন মাতৃত্বের স্বাদ পাওয়া যায় সে খানিকক্ষণেরই হোক না কেনো তাই কি আর মন মানতে চায়। তবুও উজান যখন বলেছে ভালো কিছু ভেবেই বলেছে হয়তো। তাই আর বায়না করেনি হিয়া। ভাইয়ের বাবু হয়েছে এটাই যেনো এখন তার শান্তি আর সুখ।

রোদেলাকে ডিসচার্জ করে নিয়ে আসা হয়েছে আজ। সারাদিন চাচি আর দাদি এসে যে কতোবার দেখে গিয়েছে সে হিসাব নেই। উজানের মা ক্লিনিক থাকাকালীন এসেছিলো দুবার,বাড়িতে আনার পর আজ আর আসা হয়নি ওনার। বিছানার উপর ঘুমন্ত বাচ্চাটকে শুইয়ে দিয়ে তার একপাশে বালিশে হেলান দিয়ে শুইয়ে আছে রোদ। শিশির দরজায় দাঁড়িয়ে বাকি তিনজনের কাহিনী দেখছে। উজান যাও বা কিছু মুহুর্তের জন্য মুখটা বন্ধ রাখছে কিন্তু হিয়া তো ননস্টপ বাচ্চাটার সাথে বকবক করেই যাচ্ছে তো যাচ্ছে। ভাগ্যিস বাচ্চাটা একটু ঘুমালো এখন বলে।

– আমার তো এ-ই বুড়ি টাকেই নিয়ে সারাক্ষণ খেলতে মন চাইছে রোদ আপু। আমি যে এতো খুশি হয়েছি না বিশ্বাস করো তুমি।

– থাম,পাগলি,মনে তো হচ্ছে আমার না তোর নিজের বাচ্চা হয়েছে।

– হবে হবে আপু,আমিও তোমার দেখাদেখি বাবু নেবো দেখো তু…

হিয়া আর আগাবার আগেই উজানের চোখে চোখ পড়লো তার,শুকনো ঢোক গিলে নিয়ে আমতা আমতা করতে বললো,

– ইয়ে মানে এখন বলছি না,আমি ফোর্থ ইয়ারে উঠলে তখন নেবো,,,ততোদিনে আমাদের এই বাবুটা বড় হ’য়ে উঠুক।

রোদ হিয়ার কপালে স্নেহের পরশ বুলে দিতেই উজান এসে রোদের পাশে বসে রোদের মাথায় হাত রাখলো। মুচকি হেঁসে বললো,

– তাহলে খালা বানানোর আগে মামা বানিয়ে দিলি তো আমায়।

মৃদু হাসলো রোদ। মিষ্টির প্যাকেট হতে একটার পর একটা মিষ্টি তুলে খেতে খেতে হিয়া বললো,

– আরে মামা না মামা না,আমি ফুফু হলে তো আপনি ফুফা হচ্ছেন না বলুন।

কপালে ভাঁজ এঁটে উজান বললো,

– নো ওয়ে,আমার বোনের বাচ্চা সো আমি মামা হবো আর তুমি মামি,ক্লিয়ার।

হাতে থাকা মিষ্টি টা পুরো মুখে ঢুকে নিয়ে হিয়া বললো,

– না না না,ওসব মামা টামা বাদ,আমি যখন বলছি আপনি ফুফা হবেন তো ফুফা হবেন,ওনলি ফু–ফা।

– জ্বী না,মামা ইস মামা। আমি মামা হবো তুমি মামি। ইস দ্যাট ক্লিয়ার।

হিয়া শুনলো না। শুরু হলো মামা হবে না ফুফা এ-ই নিয়ে দুই জনের সেই কি এক বৃহৎ ঝগড়া। রোদ তার চোখজোড়া পিটপিট করে একবার হিয়ার দিকে দেখছে তো একবার উজানের দিকে। কি একটা অবস্থা এরা তো দেখছি কেউ থামারই নাম নিচ্ছে না৷ শেষে অসহায় চোখে দরজার মুখে দাঁড়িয়ে থাকা শিশিরের দিকে করুন চাহনিতে তাকিয়ে উঠলো রোদ। চোখের ইশারায় বোঝালো এ দুটোকে এবার থামাও না গো একটু। নিজের রোদরানির মাছুম মুখটার দিকে তাকাতে মৃদু হেঁসে উঠলো শিশির। ভাঁজ করা হাত জোড়া নিচে নামিয়ে টানতে টানতে ঝগড়ারত উজান আর হিয়াকে রুম থেকে বের করে দিলো সে। এদিকে তাদের তাড়িয়ে দিয়ে দরজা লাগাতেই চোখ বড়সড় করে তাকিয়ে উঠলো হিয়া। আরে এটা কি হলো ভাইয়া দরজা লাগিয়ে দিলো।

– ভাইয়া,রোদ আপু,আর ঝগড়া করবো না আমরা,সত্যি বলছি,দরজাটা খুলো না প্লিজ,আমার তো বাবুর সাথে এখনো খেলা খেলা বাকি,ওহ আপু।

হিয়াকে থামিয়ে দিয়ে জড়িয়ে ধরলো উজান, টানতে টানতে হিয়াকে নিজেদের রুমে নিয়ে আসতে বললো,

– এ-ই সব তোমার জন্য হয়েছে,কি দরকার ছিলো আমার সাথে তর্ক করার,ইডিয়ট

– আহ,আমার লাগছে তো,ছাড়ো নাআআ।

– এখন চুপচাপ পড়তে বসবা তুমি,আর এসব কি হ্যা কয়টা মিষ্টি খেলে তখন থেকে,সুগার বাড়ানোর ইচ্ছে আছে নাকি।

– তোমার সুগারের চিন্তা তুমি করো আমারটা নিয়ে ভাবতে হবে না,আআআ আ আমার কালো জাম।

– চলো তো হিয়া। অনেক বাঁদরামি করছো সারাদিন এখন চুপচাপ পড়তে বসবে কুইক।

হিয়াকে টেনে হিছড়ে রুমে নিয়ে এসে দরজা লাগিয়ে দিলো উজান। হাত থেকে মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে সোজা বই ধরিয়ে বসিয়ে দিলো বিছানায়। হিয়া রেগে গিয়ে কিছু বলতেই চোখ বড়বড় করে তাকালো উজান। ভয়ে মুখে ভেংচি দিয়ে পড়ায় মন দিলো হিয়া। এদিকে দরজা লাগিয়ে একটা তপ্ত শ্বাস ছাড়লো শিশির। যাগ সারাদিনে এই একটু সময় ফাঁকা হলো রুম টা। তোয়ালে হাতে একটা ফ্রেশ গোসল দিয়ে আসলো শিশির, নয়তো রোদের কড়া নিষেধাজ্ঞা ছিলো অফিস ফিরে যেনো কিছুতেই নোংরা হাতে তার মেয়েকে না স্পর্শ করা হয়। তাই একদম নিজেকে ফ্রেশ করে সব কিছু গুছিয়ে রোদের পাশে এসে বালিশে হেলান দিলো শিশির। রোদ সেসময় কাত হয়ে বাবুকে খাওয়াচ্ছিলো। শিশির কাত ফিরিয়ে রোদকে জড়িয়ে ধরলো। মুখ রাখলো রোদের মুখের উপর। হাত বাড়িয়ে বাবুকে ধরে নিতেই খেতে খেতে গা টা বিরাট এক নাড়া দিলো তাদের প্রিন্সেস।

– Thank you রোদেলা! পৃথিবীর সবচাইতে সুন্দর উপহার টা আমাকে দেবার জন্য।

মৃদু হেঁসে শিশিরের হাতে হাত গুঁজে নিজেদের মেয়ের গায়ে স্নেহের পরশ বুলে দিয়ে রোদ বললো,

– তোমাকেও ধন্যবাদ। তুমি না থাকলে আমি হয়তো..আচ্ছা ওসব পুরাতন কথা বাদ,আমি চাই সব পুরাতন ভুলে আমরা আমাদের মেয়েকে নিয়ে একটা নতুন জীবন শুরু করি,যেখানে শুধু ভালোবাসা থাকবে,ভালোবাসার কমতি যেখানে কখনো হবে না।

– হুম খুব ভালো রাখবো তোমাকে আর আমাদের বাচ্চা টাকে দেখো তুমি।

– হুম,আচ্ছা শোনো না বাবুর নাম কি রাখবো তুমি যে ঠিক করতে চাইলে তখন,করেছো কিছু? আমি তো এই একটা বছর ভেবেই গেলাম শুধু রাখতে আর পারলাম কোথায়!

শিশির রোদের গালের সাথে নিজের গাল টা ঘষে নিয়ে বললো,

– হুম ঠিক তো করেছি,তবে একটা না,আমাদের এরপর আরো যতোগুলো বাবু হবে সবার টা ঠিক করেছি,

-কি! পাগল তুমি?

– শুনো তো আগে,আমাদের এ-ই প্রিন্সের নাম হবে বর্ষা,তুমি রোদ আমি শিশির আর আমাদের বাবু হবে বর্ষা।

একটু হেলে নিয়ে শিশিরের দিকে মুখ তুলে তাকালো রোদেলা। খুশি হয়ে বললো,

– বাহ সুন্দর তো রোদ শিশিরের বর্ষা!

– পছন্দ হয়েছে?

– খুববব হয়েছে। হিয়া শুনলে না খুব খুশি হবে দেখো ও ও না এরকম একটা নাম সিলেক্ট করেছিলো বৃষ্টি না কি জানি, উজান রাজি হয়নি। কিন্তু বর্ষা দু’জনেরই পছন্দ হবে দেখো তুমি।

রোদ মুখে হাসি ঝুলিয়ে আরো কিছু বলতেই রোদের পুরো মুখে চুমু আকলো শিশির। শুরু হলো বর্ষাকে নিয়ে রোদ আর শিশিরের নতুন পথ চলার সূচনা। পথটা যেনো হয় রঙিন, অনেক সুখকর!

!

জানালার ধারে দাঁড়িয়ে কামিনী ফুলের গাছটার দিকে আনমনে তাকিয়ে আছে হিয়া। চোখ দিয়ে টুপটাপ ঝড়ে ফেলছে কিছু লোনাজল। এদিকে ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে এসে বই রেখে হিয়াকে আবার উঠে যেতে দেখে রেগে গেলো উজান। গলা উঁচু করে কিছু বলতেই হুঁশ ফিরলো হিয়ার। চোখের পানি টা উজানের অগোচরে মুছে নিয়ে বিছানায় এসে আবার বই হাতে লিখতে বসে গেলো মেয়েটা। উজান জানালা দুটো ঠিক মতো লাগিয়ে হিয়ার পাশে এসে বসে দুটো বকতেই খেয়াল করলো হিয়ার চোখ ভেজা।

– একটু ওয়াশরুমে গেলাম ওমনি পড়া ছেড়ে উঠে গেলে তো,এভাবে জীবনেও ডেন্টিস তো দূর তুমি….হিয়া তুমি কাঁদছো? হিয়া?

– হু হুম বলো?

– তুমি কান্না করছিলে এতোক্ষণ হিয়া?

– ধুরো না,কান্না কেনো করবো,কান্না করছি না।

উজান হিয়ার সামন থেকে সব বই খাতা তুলে নিয়ে পাশের টেবিলে রাখলো। হিয়াকে কোলে বসিয়ে হিয়ার চোখের দিকে ভালো করে তাকিয়ে হিয়ার গালে হাত রেখে বললো,

– ছোট থেকে এই চোখ জোড়া চিনি আমি,সে কখন কাঁদে কখন হাসে,কখন লজ্জা পায়,কখন ভয় পায় সব বুঝি। বলো তো কেনো কান্না করছিলে?

– আরে কান্না না,তুমি তুমি কয়েল ধরিয়ে দিলে না,চোখ আঁচ লাগছিলো তাই এরকম মনে হচ্ছে।

– হিয়া বলছি না বলতে।

মুখ টা নিচু করে একটু একটু করে আবারো কাঁদতে শুরু করলো হিয়া। হিয়ার মাথা টা নিজের বুকে লেপ্টে ধরে উজান বললো,

– কেনো কাঁদো হিয়া। বলছি না তুমি কাঁদলে কষ্ট পাই আমি৷ চুপ না পাখি আমার।

– আজকে না আমার,আমাদের বাবুটার কথা খুব মনে পড়ছে উজান। সে বেঁচে থাকলে বড় হতো আমার পেটে। সে আসতো। আমিও ওকে খাওয়াতাম, বুকে জড়িয়ে ঘুম দিতাম।

– এই জন্য তুমি কান্না করছো?

উজানের বুকে মাথা নাড়ালো হিয়া। হুম সে এজন্য কান্না করছে। উজান হিয়ার চোখ মুছে দিয়ে বললো,

– এটুকুর জন্য কান্না করতে হয়,রোদের বাবু হয়েছে তুমি খুশি না হয়ে কান্না করছো,শিশির দেখলে কি ভাবতো।

হিয়া মুখ তুলে চোখ মুছতে মুছতে বললো,

– না আমি তো খুশি,খুব খুশি। শুধু একটু ঔ। আচ্ছা বাদ দেও আর এক বছর পর আমরা বাবু নেবো তো,কথা দেও?

– এক বছর না আরো চার বছর,এমন সময় নেবো তুমি ফাইনালো দিবে আর আমাদের হিয়ানো আসবে। নাহলে পড়াশোনার পাশাপাশি তোমার অনেক চাপ হয়ে যাবে হিয়া।

– নাআআ চার না দুই দুই।

– না চার।

– বলছি না দুই। আচ্ছা যাও আড়াই। আচ্ছা তিন,সাড়ে তিন,পোনে চার

– পাগলি যা তো,ঘুমা।

– আর পড়াটা কে পড়বে।

– আজকে ছুটি যা-ও।

-ছুটি?,,তাহলে একটা হরোর মুভি দেখি কেমন।

– না একদম না। পরে ভয়ে আর ওয়াশরুমো একা যেতে চাও না তুমি। আরো দেখবো ওসব মুভি।

– প্লিজ প্লিজ একটা এটাই লাস্ট।

– জীদ করো না তো হিয়া৷ কালকে আমার ডিউটি আছে সকালে।

– আরে একটাই তো। এক ঘন্টার মুভি।

– না বলছি না। এবার কিন্তু পড়তে বসাবো আমি। কি বসাবো।

– আআআ,তুমি খুব বাজে। কয়েল নিভিয়ে মশারী ফেলবা আজকে তুমি,আমার সাথে মুভি না দেখার শাস্তি। হু।

বলেই মশারীর কুশন টা উজানের গায়ে ছুঁড়ে দিলো হিয়া। মশারী লাগিয়ে সেটাকে গুঁজে দিয়ে হিয়াকে নিয়ে আবার সেই মামা না ফুফা কথা উঠতে ঝগড়া বাঁধলো দু’জনের। এই চললো সারারাত। কোথায় গেলো ঘুম কোথায় আর ডিউটি!

চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here