#ছত্রিশ_ঝামেলা
#পর্ব_১
মেয়েটির নাম নিশাত তাসনিম। সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। তার পড়াশোনার বিষয় অর্থনীতি। পড়াশোনায় তার বিশেষ আগ্রহ নেই। শুধু পড়াশোনা নয়, আরো অন্যান্য বিষয়, যা তার প্রতিদিন করতে হয়, তার কিছুতেই তার আগ্রহ নেই। প্রতিদিন সকাল বেলা নিশাত ঘুম ভেঙেই বলে, “ইয়াক থু। আজকের দিনের সকল কাজকর্মের প্রতি আমার ইয়াক থু। নিশাতের সারাদিনের সকল কাজকর্ম চলে ইয়াক থুয়ের উপর দিয়ে। রাতে ঘুমোবার সময় সে প্রতিদিন ভাবে আরেকটি ইয়াক থু’ময় দিন তার জীবনে না আসুক।
ভাবনা পূর্ণ হয় না। ইয়াক থু’ময় দিন প্রতিদিনই তার জীবনে ফিরে আসে।
নিশাতের জীবনের প্রতি এই অনাগ্রহ তৈরি হয় তার বাবা মারা যাবার পর থেকে। নিশাতের বাবা এনায়েত উল্লাহ ছিলেন ঝিগাতলার একটি কিন্ডারগার্টেনের ইংরেজির শিক্ষক। বছর চারেক আগে এক সকালে তিনি বললেন,
-“নিশাত মা, চল আজ তোকে আমি কলেজে পৌঁছে দিই।”
মেয়েকে সঙ্গে করে কলেজ যাবার পথে তিনি হঠাৎ করেই জিজ্ঞেস করলেন,
-“তোর কি কোনো কালো শাড়ি আছে নিশাত?”
নিশাত মন খারাপ করে বললো,
-“শুধু কালো কেন, আমার কোনো শাড়িই নেই, বাবা!”
-“বলিস কী? তুই বাংলাদেশি অষ্টাদশী তরুণী। অথচ তোর কি না কোনো শাড়ি নেই? এটা যে একটা অপরাধের পর্যায়ে পড়ে, জানিস? চল, তোকে এক্ষুনি একটা শাড়ি কিনে দিই।”
নিশাতকে তিনি শাড়ি কিনে দিলেন। কালো রঙের তাঁতের শাড়ি। ম্যাচিং ব্লাউজ কিনলেন, পেটিকোট কিনলেন, একগাছি কালো কাচের চুরি কিনে দিলেন।
নিশাত অবাক হয়ে বললো,
-“সব কালো কিনেছো কেন বাবা? আমি কি শোক দিবস পালন করবো না কি?”
এনায়েত সাহেব নিশাতের মাথায় হাত বুলিয়ে
বললেন।
-“প্রথমবার তোকে শাড়ি কিনে দিলাম৷ মিলিয়ে সব কিনে দেবো না? কলেজ শেষে বাড়ি গিয়ে শাড়ি পরে তৈরি হয়ে থাকবি। তোকে নিয়ে একটি বিশেষ জায়গায় বেড়াতে যাবো। সেই বিশেষ জায়গায় একজন বিশেষ মানুষের সাথে তোর দেখা হবে। তখন বুঝবি কালোর বিশেষত্ব কী!”
নিশাত কলেজ শেষে বাড়ি এসে শাড়ি পরে তৈরি হলো। আগ্রহ নিয়ে বাবার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো। বিকেল গড়ালো, সন্ধ্যা হলো। এনায়েত সাহেব স্কুল থেকে ফিরলেন না। নিশাত অপেক্ষা করতেই থাকলো। রাত হলো। নিশাত শাড়ি পরেই ঘুমোতে গেলো। সকাল হলো। এনায়েত সাহেবের খোঁজ নেই। আত্মীয়স্বজন, পরিচিত সবখানে খোঁজ করা হলো। থানায় ডায়েরি করা হলো। পত্রিকায় ‘সন্ধান চাই’ বিজ্ঞাপন দেওয়া হলো। এনায়েত সাহেব কোথাও নেই। নেই তো নেই-ই। সপ্তাহ পেরোলো, মাস গেল, এনায়েত সাহেব ফিরলেন না। দিন কাটতে লাগলো ভয়াবহ দুঃশ্চিন্তা আর কঠিন অভাবের মধ্যে। তারপর একদিন খবর এলো, এনায়েত সাহেবের ডেডবডি পাওয়া গেছে নারায়ণগঞ্জের কাছে এক নর্দমায়। ডেডবডি গলে পঁচে একাকার। চেনার উপায় নেই।
এনায়েত সাহেবের এই মৃত্যুতে নিশাত, নিশাতের মা রাবেয়া বেগম, তার একমাত্র ছোটভাই সোহেল, নিশাতের দাদী সবুরা বানু এই চারটি মানুষের পরিবারটি ভয়াবহ সমস্যায় পড়লো। আর্থিক সংকটে এক সময়ে এসে প্রায় পথে বসবার যোগাড় হলো। নিশাতদের পরিবারের এই ভয়াবহ কঠিন সময়ে পাশে এসে দাঁড়ালেন হালিম মিয়া। এক প্রবল ঝড়বৃষ্টির রাতে ছাতা মাথায় মানুষটা এসে নিশাতদের ঘরের কড়া নাড়লেন। বললেন,
-“আমি হালিম মিয়া। জীবিত থাকতে এনায়েত ভাই আমাকে অনেক সাহায্য সহযোগিতা করেছেন। তার সেই সাহায্য আমি ফিরিয়ে দিতে এসেছি।”
পরিবারের কেউ তাকে এ ব্যাপারে দ্বিতীয় কোনো প্রশ্ন করলো না। অস্বচ্ছলতা আর টানাটানিতে সবাই এত ক্লান্ত তখন, হালিম মিয়ার আগমন যেন এক টুকরো স্বচ্ছলতার আভাস হয়ে ধরা দিলো পরিবারে। বাবার বয়েসী একজন লোকের এমন হঠাৎ শুভাকাঙ্ক্ষী হয়ে আসা নিশাত আর সোহেলের জীবনে বেশ হ্যাঁ-বোধক ভালো ঘটনা হিসেবেই গ্রহণীয় হলো। ব্যস! সেই থেকে তিনি নিশাতদের পরিবারের একজন হয়ে গেলেন।
হালিম সাহেব থাকেন মোহাম্মদপুরে। একটা আইসক্রিম ফ্যাক্টরিতে কাজ করেন। প্রতি মাসে দু-বার নিশাতদের বাড়ি আসেন। সাথে ভালো বাজার করে নিয়ে আসেন। বড় মাছ, গরুর গোশত, মুরগী, ডিম। সেদিন সারাদিন নিশাতদের বাড়ি থাকেন। নিশাতদের সাথে খাওয়া-দাওয়া করেন। সন্ধ্যায় যাবার সময় নিশাতের দাদী সবুরা বেগমের হাতে কিছু টাকা দিয়ে বলেন,
-“মা গো, আমি হতদরিদ্র মানুষ। সামর্থ্যে যতটুকু পারি তাই নিয়ে এসেছি।”
সবুরা বানু সেই টাকা লজ্জায় হাতে নিতে পারেন না। সম্পূর্ণ অচেনা, অজানা একজন মানুষ তাঁর সংসারে সাহায্য করছে, এই অপমানে তিনি বারবার কাঁদেন। আবার সেই টাকা না নিলেও চলে না। হালিম মিয়া টাকাটা সবুরার পায়ের কাছে রেখে, কদমবুসি করে চলে যান। হালিম মিয়ার সেই টাকায় নিশাত আর সোহেলের পড়াশোনার খরচ বড় টানাটানিতে চলে। পরিবারের সেই টানাটানি দূর করতে এরপর হাল ধরেন নিশাতের মা, রাবেয়া বেগম। কাজ করতে শুরু করলেন লোকের বাড়িতে। তিনি ভালোই লেখাপড়া জানেন এবং বুদ্ধিমতী। ভালোই কাজ জুটিয়ে নিলেন। সাধারণ বুয়ার কাজ নয়। বড়লোক কর্মজীবি মহিলাদের বাড়িতে ব্যক্তিগত সাহায্যকারী। যেমন, তাদের পোশাক পরিচ্ছদের খেয়াল রাখা, ফাইলপত্র গুছিয়ে দেওয়া, কফি বানিয়ে দেয়া, অফিস যাবার সমস্ত প্রস্তুতিতে সাহায্য করা, অফিস থেকে ফিরলে যত্ন করা… ইত্যাদি। বেতনও বেশ ভালো।
নিশাতদের ভেসে যাওয়া সংসার সেইসময়ে একটুখানি স্থির হলো। তবে বাবার মৃত্যু নিশাতের জীবনে একটা জিনিস পারমানেন্ট করে দিয়ে গেল। সেটা হলো কালো রং। নিশাত এখনো সবসময় কালো শাড়ি পরে। মনে মনে সে খুব অপেক্ষা করে। একদিন তার বাবা হঠাৎ ফিরে আসবেন। নিশাতকে ডেকে বলবেন, “নিশু মা, দেখি চলতো। তোকে না বলেছিলাম একটা বিশেষ জায়গায় তোকে নিয়ে যাবো৷ এক্ষুনি চল”।
কালো শাড়ি পরা নিয়ে নিশাতকে অনেক বিড়ম্বনায় পরতে হয়েছে।
কালো শাড়ির জন্য ইউনিভার্সিটিতে তাকে সবাই আড়ালে ডাকে কালোজিরা। ব্যাপারটা ওপেন সিক্রেট। সবাই তার সামনে কালোজিরা নিয়ে কথা বলে। নিশাত একদিন ক্লাস আড্ডায় জিজ্ঞেস করেছিল,
-“কালোজিরেটা কে?”
সবাই এদিক ওদিক তাকিয়ে অন্য কথায় চলে গেছে।
প্রথম প্রথম সবাই ভাবতো নিশাতের মাথা খারাপ। মাথা খারাপ ব্যাপারটা নিশাত কাটিয়ে উঠেছে পড়াশোনার শক্তি দিয়ে। ইউনিভার্সিটিতে ফার্স্ট সেমিস্টার রেজাল্টের পর সবার সেই ধারণায় গুড়েবালি হয়েছে। কালোজিরা মেয়েটি যে পড়াশোনায় ইস্পাতের মত ধারালো; এই নিয়ে কারো মধ্যে কোনো কনফিউশান নেই। মেধাবী মানুষ সাধারণদের পছন্দের হয় না। নিশাতও সবার কাছে অপছন্দের। সবাই তার সাথে ভাসা সম্পর্ক রেখে চলে। ডুবা বন্ধুত্বে কেউই তার ধারে ভিড়ে না। সবাই আছি, আবার সবাই নাই।
ইউনিভার্সিটিতে নিশাতের একমাত্র ভালোবান্ধবী পিয়াসা। একমাত্র পিয়াসাই নিশাতকে কালোজিরা ডাকে না। নিশাতের পড়াশোনা ব্যাপারেও তার কোনো আগ্রহ-অনাগ্রহ নেই।
নিশাত একদিন পিয়াসাকে নিজে থেকে বলেছে,
-“তুই আমাকে একবার কালোজিরা ডাক তো! তোর মুখ থেকে কালোজিরা শুনতে ইচ্ছে করছে।”
পিয়াসা ভীষণ বিরক্ত হয়ে তাকিয়েছে।
-“তোর মতো মিষ্টি একটা মেয়েকে আমি কালোজিরা ডাকবো কেন?”
-“সবাই তো ডাকছে। তোর সমস্যা কী?”
-“আমি সবাই না। তোকে আমি অন্য একটা নামে ডাকি।”
-“কী ডাকিস? শুনিনি তো কখনো!”
-“মনে মনে ডাকি। শুনবি?”
পিয়াসা কানে কানে নিশাতকে সেই নাম বলেছে।
পিয়াসার মুখে সেই নাম শুনে নিশাত ভীষণ আৎকে উঠেছিল। নামটা সে মনে মনেই রেখে দিয়েছে। নামটা এখন আপাতত উহ্য থাক। পরে একসময়ে বলা যাবে।
চলবে
#তৃধাআনিকা