ছত্রিশ_ঝামেলা #পর্ব_১০,১১

0
341

#ছত্রিশ_ঝামেলা
#পর্ব_১০,১১

১০

শাকিবের ভীষণ অস্থির লাগছে। শেষবার এমন অস্থির লেগেছিল ইন্টারমিডিয়েটের রেজাল্ট বেরোবার আগে। বারবার তার মনে হয়েছে, সে পরীক্ষায় ফেল করবে! পরীক্ষায় ফেল করা নিয়ে তার নিজের কোনো মন খারাপের ব্যাপার ছিল না। টেনশান হচ্ছিল ভাইয়ার জন্য। ভাইয়া তার রেজাল্টের জন্য সেদিন রোজা রেখেছিলেন! শাকিব সেদিন মনে প্রাণে চেয়েছিল সে কোনোরকমে পাশ করে যাক। পরীক্ষা যে তার খারাপ হয়েছিল তা নয়। দুটো পরীক্ষায় সে রেজিষ্ট্রেশন নাম্বার ভুল ফিলাপ করেছিল। এবং পরে তা আবার ঠিক করেছিল। সেবার সে কোনোভাবে উতরে গিয়েছিল, এবার কী হয় কে জানে?

এই মুহূর্তে শাকিব বসে আছে ড্রিম ওয়ার্ল্ড কফিশপে। এখানে সে মার্লিনার সাথে দেখা করতে এসেছে। মার্লিনা গতকালই দেশে এসেছে। যদিও মার্লিনার লায়লার সাথে কথা বলার কথা ছিল। কিন্তু লায়লা ইচ্ছে করেই শাকিবকে পাঠিয়েছে। শাকিব বারবার জানতে চেয়েছে,
-“মার্লিনার সাথে তুমি কেন দেখা করতে চাইছো না?”
-“আমার কেন জানি খুব ভয় করছে শাকিব। মনে হচ্ছে, মার্লিনার সাথে দেখা করতে গেলেই আমি ভয়াবহ কোনো দুঃসংবাদ পাবো।”
-“তুমি এমন ভাবে বলছো যেন মার্লিনা দুঃসংবাদের দূত!”
-“হতেও পারে।”
লায়লার সন্দেহকে শাকিবও উড়িয়ে দিতে পারছে না। মার্লিনা হাসিবের ব্যাপারে কী বলতে চায়? শাকিব মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছে, খারাপ বা ভালো যে খবরই হোক, সে এটার চাপ লায়লা ভাবীর উপর পড়তে দেবে না। মনে আছে, মিমির জন্মের সময় লায়লা ভাবীর তখন জীবন নিয়ে টানাটানি। ডক্টররা পেটের মধ্যে কোনো বেবীর রেসপন্স পাচ্ছিলেন না। ভাবীর ছিল হাই ব্লাড প্রেশার। ডক্টর বলছিলেন, হয়তো একজনকে বাঁচানো যেতে পারে। অপারেশন থিয়েটারে যাবার সময়ে লায়লা শাকিবের হাত ধরে বলেছিল,
-“শাকিব তোমায় আমায় একটা কথা দিতে হবে।”
-“কী কথা?”
-“কথা দাও, যদি আমি মারা যাই তুমি তোমার ভাইয়াকে আর বিয়ে করতে দেবে না?”
শাকিব হেসেছিল খুব।
-“ভাইয়ার মতো একটা মানুষকে আর কেউ বিয়ে করবে না ভাবী!”
-“তুমি কথা দাও শাকিব, নাহলে আমি অপারেশন থিয়েটারে যাবো না।”
শাকিব কথা দিয়েছিল।
একটা মানুষ আরেকটা মানুষকে কী করে এত ভালোবাসতে পারে? কী করে?

-“হ্যালো, শাকিব!”
সুন্দরী বাংলায় ইংরেজির প্রবল টান। শাকিব ফিরে তাকালো। মার্লিনা চলে এসেছে। ছিপছিপে গড়নের বাদামী চুলের গম্ভীর চেহারার মেয়ে। এধরনের গাম্ভীর্য সাধারণত স্কুলের অঙ্ক শিক্ষকদের চেহারায় দেখা যায়। তারপরও কোথাও যেন সবটা ছাপিয়ে এক টুকরো স্নিগ্ধতা উজ্জ্বল ফুটে আছে।
শাকিব উঠে দাঁড়ালো।
মার্লিনা হাত বাড়িয়ে দিলো।
-“তোমাকে অপেক্ষা করানোর জন্য দুঃখিত। আমি তোমার কাছে ক্ষমা কামনা করছি।”
-“ক্ষমা চাওয়ার কিছু নেই। আমার এখানে বসে থাকতে ভালো লাগছিল।”

শাকিব হাত বাড়ালো। তার ভেতর ভেতর নিঃশ্বাস আটকে আসছে। মার্লিনা কি ভয়াবহ কোনো দুঃসংবাদ নিয়ে এসেছে? মার্লিনা মোবাইল ফোন বের করে কাউকে ফোন করলো।
শাকিবের সামনেই সে একজনকে বাইরে অপেক্ষা করতে বললো। তার মানে মার্লিনা একা আসেনি।
-“তুমি যদি কিছু মনে না করো আমি কি তোমার জন্য কফি অর্ডার করতে পারি?”
-“হিসেবে গেলে কিন্তু তুমি অতিথি। আমি হোস্ট।”
-“আমি কোনো হিসেবে যেতে চাইছি না শাকিব।”
মার্লিনার কণ্ঠস্বরে নিস্তেজ স্বাভাবিকতা।
মার্লিনা ওয়েটার ডেকে দুজনের জন্য কফি অর্ডার করলো।
-“তুমি কি আর কিছু নেবে?”
-“আমার কিন্তু এই কফিটাই শেষ হয়নি।”
শাকিব পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে কথা শুরু করলো। নিজের ভেতরের নার্ভাসনেসটা সে কিছুতেই বুঝাতে চায় না মার্লিনাকে।
-“আপনি কবে এসেছেন?”
-“গতকাল! আসলে আমি গতকালই দেখা করতাম। মিসেস লায়লা সময়টা পেছালেন।”
-“আপনি আমায় চিনলেন কী করে?”
-“তোমার ইউনিভার্সিটিতে আমি যোগাযোগ করেছি। ওরা তোমার সমস্ত ডিটেল আমায় পাঠিয়েছে। মিসেস লায়লা যে শেষমুহুর্তে আমার সাথে দেখা করতে চাইবেন না আমি জানতাম। তাই আমি অনেকটা প্রিপারেশন নিয়েই এসেছি।”
-“আসলে, ভাবীর লাস্ট মোমেন্টে একটা কাজ এসে গেল।”
মার্লিনা হাসলো।
-“হাসিবের চেহারার সাথে তোমার অনেক মিল আছে! তোমাদের কণ্ঠস্বরও কিন্তু একই রকম। তুমি যে এখানে এসেছো, হাসিব জানে?”
-“কেউই জানে না। এমনকি আমার মাও নয়। তুমি বলেছিলে গোপনীয়তা রক্ষা করতে।”
মার্লিনা কফিতে তিনটা সুগার প্যাকেট নিলো।
-“এভাবে চমকে তাকিয়ো না। আমি তোমার সাথে এখন যে আলোচনাটা করবো সেখানে আমার অনেক এনার্জি দরকার। আমি কিন্তু ব্যাগে করে চকলেটও নিয়ে এসেছি।”
মার্লিনা ব্যাগ থেকে অনেকগুলো চকলেট বের করে টেবিলে রাখলো৷
-“তুমি চকলেট নিতে পারো।”
মার্লিনা বেশ দুশ্চিন্তার সাথে কফিতে চুমুক দিলো। তারপর কিছুক্ষণের নীরবতা।
-“তুমি এত কষ্ট করে তোমার কাজের থেকে সময় বের ছুটে এসেছো আমার কথা শোনবার জন্য, এজন্য আমি তোমার কাছে ভীষণ কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি।”
শাকিব হাসলো।
-“আপনার বাংলা কিন্তু বেশ ভালো। কোথায় শিখেছেন?”
মার্লিনা মলিন হাসলো। ভীষণ অনিচ্ছার হাসি।
-“হাসিব আমায় শিখিয়েছে। আমি ওর বাংলার ছাত্রী বলতে পারো। ও কিন্তু টিচার হিসেবে খুব কড়া।”
-“ভাইয়ার সাথে আপনার কতদিনের পরিচয়?”
এবারে মার্লিনা নড়চড়ে বসলো। লম্বা বক্তৃতা শুরুর আগে আমরা যেমন বসি তেমন।
-“দেখো শাকিব, আমি খুব বড় করে ভূমিকা টানবো না৷ বাংলায় আমার শব্দ ভান্ডার খুব অল্প। তাই কথাগুলোও আমি খুব সংক্ষিপ্ত করে তোমায় বলবো।
কথাগুলো যদিও আমি মিসেস লায়লাকেই শুধু বলতে চেয়েছিলাম, কিন্তু আমার মনে হয়েছে তিনি হয়তো এতটা মেন্টাল শক নিতে পারবেন না।”
শাকিব কফিতে চুমুক দিলো। একটু আগেই মিষ্টি লাগা কফিটা তার কাছে বিষের মত ঠেকলো।
-“তোমার ভাইয়ার সাথে আমার পরিচয়, ওর একটা ফটো এক্সিবিশনে। আমি তোমার ভাইয়ার আঁকা একটা ছবি কিনবো বলে ওর পেছনে পড়েছিলাম। রোজ ওকে ফোন করতাম। ও বিরক্ত হতো। কিন্তু আমি এতটাই নাছোরবান্দা হয়েছিলাম যে শেষ পর্যন্ত ছবিটা সে আমায় এমনিই দিয়ে দিয়েছিল। ব্যস, তারপর থেকেই আমাদের বন্ধুত্ব শুরু। আমাদের প্রায় প্রতিটি উইকএন্ডেতেই দেখা হতে শুরু করলো। উইকএন্ডে ও সারাদিন ছবি আঁকে। আমরা দূরে কোথাও বেড়াতে যাই।হাসিব ছবি আঁকে, আমি দেখি। লাস্ট কিছুদিন যাবত আমি খেয়াল করছি হাসিব অসুস্থ। কিছুদিন পরপর ওর বাঁ-হাত ফুলে যাচ্ছে। আমরা ডক্টরের সাথে কনসাল্ট করি। ডক্টর বললেন, লাংসে পানি জমেছে।লাংস্ থেকে পানি ক্লিয়ার করাও হলো। এবং সেই একই ঘটনা পরবর্তীতে আবার ঘটলো।হাসিবকে জিজ্ঞেস করলে ও বললো, এটা খুব সাধারণ অসুখ। কিন্তু আমার খুব সন্দেহ হচ্ছিল ওর অসুস্থতা নিয়ে। ওর ডক্টরের সাথে যোগাযোগ করে আমি ওর মেডিকেল রিপোর্টস যোগাড় করলাম। এবং রিপোর্ট দেখে ভীষণ অবাক হলাম। সে লাংস্ ক্যান্সারে আক্রান্ত। সেকেন্ড স্টেজ। কেমো চলছে, কিন্তু অবস্থা দিনদিন খারাপের দিকে যাচ্ছে। আমি ওকে বললাম, বাড়িতে জানাতে। ও বলেছে, জানালে তোমরা দুশ্চিন্তা করবে। তাই আমি বাধ্য হয়ে কথা বললাম। আমার মনে হয়, হাসিবের এই অবস্থায় তোমাদের পাশে থাকা দরকার। বিশেষ করে মিসেস লায়লার। আফটার অল শি ইজ হিজ লিগ্যাল ওয়াইফ। তুমি কি একবার হাসিবের সাথে কথা বলবে?”
শাকিব অপ্রস্তুত হয়ে উঠে দাঁড়ালো। এবং আবারও বসে পড়লো।
-“তুমি কথাগুলো আগে জানাওনি কেন?”
-“আমি জেনেছি অনলি থ্রি উইকস। এর মাঝেই কিন্তু আমি তোমাদের নক করেছি।”
শাকিব বিভ্রান্তের মতো বললো,
-“আমি তোমার কোনো কথা বিশ্বাস করতে পারছি না মার্লিনা৷”
-“আমি কিন্তু এখন তোমাকে এর থেকেও অবিশ্বাস্য কিছু কথা বলবো শাকিব।হাসিব আর আমি খুব ভালো বন্ধু। ঠিক যতটা ভালো বন্ধুত্ব হলে একজন আরেকজনের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তে প্রভাব ফেলতে পারে ঠিক ততটা ভালো বন্ধু।”
-“আমি বুঝতে পারছি মার্লিনা।”
-“আমার কথা এখনো শেষ হয়নি শাকিব। আমাদের ভালো বন্ধুত্ব রয়েছে এতটুকুর মধ্যে কথাটা শেষ করতে পারলে ভালো ছিল। কিন্তু এখানে আমাকে অত্যন্ত ব্যথার সাথে আরও কিছু কথা যোগ করতে হচ্ছে। আমাদের বন্ধুত্বের সম্পর্কে আমরা খুব তাড়াতাড়ি একে অপরের ভীষণ কাছাকাছি চলে এলাম। একটা নিট এন্ড ক্লিন নির্ভরতার জায়গা তৈরি হলো আমাদের মাঝে।
এতটুকু পর্যন্ত সবটুকু ঠিক ছিল। কিন্তু এর মাঝে একদিন আমাদের মাঝে ভুল হয়। এক উইক এন্ডে হাসিব আর আমি বেড়াতে যাই। উদ্দেশ্য হাসিব ছবি আঁকবে। সেদিন হুট করেই ওয়েদার খুব খারাপ করে গেল। আমরা একটা কটেজ ভাড়া করে সেদিন সেখানে থেকে গেলাম। সেখানে মদ্যপ অবস্থায়, তুমি বলতে পারো একদম অবচেতনভাবে আমরা শারীরিকভাবে ঘনিষ্ঠ হই। ইনফ্যাক্ট যখন আমি আর হাসিব সচেতন হই তখনো সে বিষয়ে আমরা কেউই এতটা নিশ্চিত ছিলাম না। শুধু প্রশ্ন ছিল, আমাদের মাঝে কি কিছু হয়েছে? কিছু কী হয়েছে? আমরা দুজনেই প্রচ্ছন্নভাবে ব্যাপারটা এড়িয়ে গেলাম। আমি আবারও বলছি আমরা এ ব্যাপারে একদমই নিশ্চিত ছিলাম না।
রেয়’কে আমি যখন কনসিভ করি, আমি খুবই আশ্চর্য হই। দেখো, আমি একটা মাত্র পুরুষের বন্ধুত্বে সীমাবদ্ধ নারী নই। সুতরাং তুমি জানো কোনো রিস্ক রেখে আমি আমার আনন্দ খুঁজি না। আমার তখনই মনে হলো, এই অঘটনটা আমার হাসিবের সাথেই ঘটেছে। কারণ শুধু সে রাতের ব্যাপারটাই আমি মনে করতে পারছিলাম না। হাসিব অত্যন্ত ভালো একজন মানুষ। এ পিওর হার্টেড গাই। তাই এবরশানের মতো একটি ব্যাপারে আমি গেলাম না। ভাবলাম, সন্তান এলে একজন ভালো মানুষেরই এলো। এবং রেয়’র জন্মের পর আমি খুব অবাক হলাম। ওর চোখ দুটো দেখতে একদম হাসিবের মতো। কৌতূহল থেকেই আমি ওদের ডি এনএ টেস্ট করি। তখন আমি নিশ্চিতভাবে জানতে পারি হাসিব ইজ মাই চাইল্ডস বায়োলজিকাল ফাদার।”
-“ব্যাপারটা ভাইয়া কখন জানে?”
-“ওকে আমি এখনো বলিনি। এবং বলবোও না। কারণ রেয়’র কাস্টাডি নিয়ে আমি একদম চিন্তা করছি না।আমি জানি আমাদের দেশে ও ভালো লাইফ পাবে। আমি ভালো চাকরি করি। আই আর্ন ভেরি হ্যান্ডসাম এমাউন্ট। আমার চিন্তা হাসিবকে নিয়ে। ওর সারভাইভ করা নিয়ে। রেয় যখন বড় হবে তখন হাসিবকে অন্তত আঙ্কেল হিসেবেও যাতে পায়।”
-“আমি আপনার কথা কেন বিশ্বাস করবো। আমি কী করে বিশ্বাস করতে পারি?”
মার্লিনা ফোন করে তার সাহায্যকারী মেয়েটিকে ডেকে আনলো, যাকে সে একটু আগেই বাইরে অপেক্ষা করতে বলেছিল। মেয়েটি বেবি ক্যারিয়ারে করে রেয়’কে নিয়ে এসেছে। রেয়’র বয়স দু’বছর! রেয় হাত-পা ছুড়ে কাঁদছে। শাকিব কাঁপা কাঁপা স্বরে বললো,
-“ও রেয়?”
-“হ্যাঁ।”
মার্লিনা নির্বিকারভাবে রেয়’কে কোলে নিয়ে আদর করে কান্না থামালো।
শাকিব স্থির দৃষ্টিতে অনেকক্ষণ দেখলো মার্লিনাকে।
কমবয়েসী একটি মেয়ে। চোখের নিচে ক্লান্তির পাহাড় জমে আছে।
-“তোমাদের বন্ধুত্বের শুরুতে তুমি কি জানতে ভাইয়া বিবাহিত?”
মার্লিনা বিষন্ন চোখে তাকালো।
-“আমি জানতাম। ইনফ্যাক্ট মিসেস লায়লা এবং মিমির অনেক ছবিও আমি দেখেছি।”
-“তারপরও তুমি কেন ভাইয়ার কাছাকাছি এলে?”
-“দেখো, আমাদের দেশে এটা একদম ম্যাটার করে না। আমি বলেছি, এটা একটা নিট এন্ড ক্লিন বন্ধুত্ব। উই বিলিভ ইন সেক্সুয়াল লিবার্টি। তারপরও আমি বলছি, ইট ওয়াজ এন অ্যাক্সিডেন্ট। হাসিব এখনো জানে না৷ তাকে আমি গেস করবারও সুযোগ দিইনি। আমি রেয়’র বাবা হিসেবে আমার বর্তমান বিশেষ বন্ধুটিকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছি। হাসিব রেয়’কে মাইজেলের সন্তান হিসেবেই জানে।”
-“তুমি কেন এত নিঃস্বার্থভাবে সব ছেড়ে দিচ্ছো? তুমি ভাইয়াকে বলতে পারতে রেয় ওর সন্তান।”
মার্লিনা হাসলো।
-“আমি এটা বলামাত্রই হাসিব সুইসাইড করবে। হি ইজ এ কমপ্লিট ফ্যামিলি ম্যান। ও ওর বউ ছাড়া কিচ্ছু বুঝে না। ওর ফ্ল্যাটের সমস্ত জুড়ে মিসেস লায়লা এবং মিমির ছবি। আমি ওকে একদম কষ্ট দিতে পারবো না।
হি ইজ এ ভেরি গুড ফ্রেন্ড অফ মাইন।”
মার্লিনা উঠে দাঁড়ালো।
-“আমার কথা শেষ। আমাকে যেতে হবে৷”
-“আমি ভাইয়ার ডক্টরের সাথে কথা বলতে চাই।”
-“শিওর৷ আমি সব ডিটেল তোমাকে মেইল করে দিচ্ছি৷”
শাকিব দু-হাত বাড়ালো।
-“আমি কি রেয়’কে একবার কোলে নিতে পারি?”
মার্লিনা রেয়’কে শাকিবের দিকে এগিয়ে দিলো।
রেয় বিস্ময়ভরা চোখে তাকিয়ে আছে শাকিবের দিকে।
মার্লিনা কাঠ কাঠ স্বরে বললো,
-“তুমি কি রেয়’র সঙ্গে কিছুক্ষণ একা থাকতে চাও।”
শাকিব জবাব দিলো না। মার্লিনা বেরিয়ে গেল। বিকেলের রোদ পড়তে শুরু করেছে। কাচের দেয়াল পেরিয়ে সেই রোদ রেয়’র নরম গালে এসে পড়ছে।
রেয় হাসছে, শাকিব ফিসফিস করে ডাকলো,
-“হেই হিরো। ইউ আর টোটালি লুক লাইক ইওর ফাদার।”

দূরে কোথাও মিষ্টি বেবি মিউজিক বাজছে।
শাকিব রেয়’র গালে গাল ঠেকিয়ে মাথা দোলাতে লাগলো। তার বুক ভেঙ্গে যাচ্ছে এক মিশ্র অনুভূতিতে। একই সঙ্গে গভীর আনন্দ ও গাঢ় ব্যাথায়। বারবার মিমির মুখটা ভাসছে চোখের সামনে। আহারে বেচারি এমন ভাইয়ের কথা কখনোও কি জানবে না?

চলবে

#তৃধাআনিকা

#ছত্রিশ_ঝামেলা
#পর্ব_১১

শাকিব ঠান্ডা মাথায় পুরো ব্যাপারটা সামালানোর চেষ্টা করছে। সামলানোর বদলে বেসামাল হয়ে যাচ্ছে। লায়লা ভাবী পাশে থাকলেও এতটা খারাপ হতো না।একটু আগেই এই বাড়িতে একটা ভয়ংকর ঘটনা ঘটেছে। ঘটনাটা হলো, দুপুরে শাকিবের মা মিসেস সুলতানা লাঞ্চ করতে বাসায় এসে দেখেন, দেশের বাড়ি থেকে শাকিবের রুহুল চাচা এসেছেন। তাঁর হার্টের বাইপাস করা হবে, টাকার জন্য এসেছেন। সুলতানা তখন টাকা বের করতে লকার খুলেন। লকার খুলে তিনি আৎকে উঠেছেন। লকারে দশটা বান্ডেলে পাঁচ লক্ষ টাকা ছিল। টাকাটা নেই। এই টাকাটা তিনি সবসময় ঘরেই রাখেন। কখন হঠাৎ কিসের দরকার হয়? ইমার্জেন্সি ফান্ড! সুলতানা লকারের চারটে তাকেই ভালো করে খুঁজলেন। খুঁজতে গিয়ে আরো দুটো ব্যাপার ধরা পরলো। সুলতানার বড় গয়নার বাক্সটাও ফাঁকা।এই বাক্সে তাঁর বিয়ের সমস্ত গয়না রাখা ছিল। এক পিস গয়নাও নেই। সুলতানা তখন বুকে প্রচন্ড চাপ অনুভব করেন। এক পর্যায়ে তাঁর শরীর ঘামতে থাকে। প্রচন্ড তেষ্টা পায়। তিনি তেষ্টা মিটাতে পানি খেতে যান। পানি বুকে বেঁধে যায়। তিনি সেন্সলেস হয়ে মেঝেতে গড়িয়ে পড়েন। আওয়াজ পেয়ে নতুন কাজের মেয়ে কলি ছুটে আসে। এসে দেখে সুলতানা মেঝেতে চিৎ হয়ে পরে আছেন। সেই শাকিবকে ফোন করে ঘটনাটা জানায়।
শাকিব ডাক্তার নিয়ে এসে দেখে মায়ের জ্ঞান ফিরেছে। তবে বুকের চাপ কমেনি। ডাক্তার চেক-আপ করে বলেছেন। তেমন কিছুই হয়নি। কোনো ঘটনায় হঠাৎ করেই নার্ভে প্রচুর চাপ পড়েছে। নার্ভ চাপ সহ্য করতে পারেনি বলেই এই অবস্থা। চিন্তার কিছু নেই। কিছুক্ষণ রিলাক্স করলেই স্বাভাবিকতা ফিরে আসবে। সেই কিছুক্ষণ এখন প্রায় দু’ঘন্টা হয়ে গেছে। শাকিব চুপ করে মায়ের মাথার পাশে টুল পেতে বসে আছে। সুলতানা চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছেন। তিনি ঘুমে না সজাগ বুঝা যাচ্ছে না বলে শাকিব মাকে ডাকছে না। পাশেই কাজের বুয়া কলি ভোঁতা মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। তার হাতে তজবি। সে বিড়বিড় করো দোয়ায়ে ইউনূস পড়ছে। প্রতিবার পড়ার শেষে সে তজবির গুটাগুলো মুঠো পাকিয়ে বেশ শব্দ করে চুমু খাচ্ছে। এইবারও আরেকবার সে চুমু খেলো। একবার তজবি পড়ার সমাপ্তি। কলি মেয়েটির বয়স চব্বিশ-পঁচিশ। ভাবভঙ্গি এবং আচরণ চল্লিশোর্ধ মানুষের মতো।
কলি বুয়া তজবি রেখে এগিয়ে এলো। চিন্তিত গলায় বললো,
-“এখন একবার ডাক দেন। দেখি নানীজান চোখ মেলে কিনা! অবস্থা কেমন গুরুতর বুঝতে পারতেছি না।”
-“আরেকটু অপেক্ষা করে দেখি।”

কলি নিরাশ হয়ে তজবি জপতে শুরু করলো। শাকিব ঘড়ি দেখলো। সময় কি কোনোভাবে থেমে গেছে? এত বড় শক সে নিজেও নিতে পারছে না। রাবু খালা কেন এমনটা করবেন? এত বিশ্বস্ত মানুষ!
-“ও মামাজান, মামাজান, আপনের কী মনে হয়? নানীজান বাঁচবে? বাঁচলেও বড় দুঃখ নিয়া বাঁচবে। টেকা পয়সার দুঃখ, বড় দুঃখ। দুনিয়ায় দুই দুঃখ মানুষ ভুলে না। স্বামী মৃত্যু আর টেকার মৃত্যু। আহারে নানীজানরে আল্লাহ পাক দুই মৃত্যুই দিলো।”
-“কলি তুমি এখন যাও।”
-“আমি তো এখন যাবো না মামাজান। আমি নানীজানের জবান না শুইন্না কোথাও যাবো না। এই দেখেন হাতে বোরকা নিয়া বসা। নানীজান কথা বলবে, কথা শুনবো, নানীজানের পায়ে হাত দিয়া দোয়া নিবো।তারপর বোরকা পিন্দা এক দৌড়ে বাইর হইয়া যাবো।”
-“বোরকা পরে কোথায় যাবে?”
-“থানায় যাবো। এতগুলা জিনিস চুরি হইছে মামলা করতে হইবো না? মামলা করার ব্যাপারে এই কলির পায়ের নাগালেও এই বাংলাদেশে কেউ নাই। নিজের দেওর, ভাসুর, স্বামী, ননদ সবাইরে জেল খাটাইছি।
দেন নানীজানরে ডাক দেন। আমার একহাজার পূর্ণ হইছে। বিসমিল্লাহ!”
শাকিব মায়ের মাথায় হাত রাখলো। মৃদুস্বরে ডাকলো।
-“মা…মা….মা..”
সুলতানা একটু নড়েচড়ে চোখ মেলে তাকালেন।
তাঁর দৃষ্টি হতাশ ও বিষন্ন! মুখবয়বে অসুস্থতার ছাপ স্পষ্ট!
শাকিব দরদভরা কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো।
-“মা এখন তোমার কেমন লাগছে? একটু ভালো লাগছে?”
সুলতানা উঠে বসবার জন্য শাকিবের দিকে হাত বাড়ালেন। শাকিব পিঠের নিচে বালিশ দিয়ে মাকে ধরে বসালো। কলি সাথে সাথেই বোরকা গায়ে দিয়ে ফেললো। মাথা নিচু করে এসে সুলতানাকে কদমবুসি করলো।
-“সালাম করছো কেন?”
-“দোয়া রাখবেন নানীজান। থানায় যাইতেছি। মামলা মোকদ্দমা আপনারা পারবেন না। আপনেরা দিল গলা মানুষ। মামলা করতে শক্ত দিল হওয়া লাগে। তাই মামলার দায়িত্ব আমার। চোররে জেলের ভাত খাওয়ানের দায়িত্ব আমার।”
সুলতানা গলা ঝারলেন।
-“এই দায়িত্ব তোমায় কে দিলো?”
-“দায়িত্ব তো দিতে হয় না নানীজান। আক্কেলবুদ্ধি ওয়ালা মানষের দায়িত্ব আপনা-আপনি ঘাড়ে ঝুইল্লা যায়। আমার ঘাড়ে এখন থানায় যাওয়ার দায়িত্ব।”
-“কলি, ঘাড়ের দায়িত্ব এখন সরিয়ে রাখো৷ তোমাকে থানায় যেতে হবে না। তুমি এখন গিয়ে আমার জন্য একগ্লাস লেবুর শরবত বানিয়ে নিয়ে এসো। সাথে দুই টুকরো লেবু কুচি করে কেটে কাঁচামরিচ ধনেপাতা দিয়ে মাখিয়ে নিয়ে আসবে। ফ্রিজে দই থাকলে একটা পিরিচে করে অল্প একটু দইও নিয়ে আসবে।”
কলি আরো কিছু বলতে যাচ্ছিলো। সুলতানা চোখ রাঙালেন। কলি বোরকা খুলে মেঝেতে ছুঁড়ে ফেললো।
-“কামের সময় কাম দিলে আমার মাথায় রক্ত উইঠ্যা যায়। থানায় যাবো… কিন্তু না এখন শরবত বানাও।দাসী বান্দী হওয়ার বড় জ্বালা। কাজ কাম করতে হয় অন্যের ইচ্ছায়। চাচাজান, আপনার কিছু লাগলে বলেন একেবারে নিয়া আসি।”
-“আমার কিছু লাগবে না কলি। রফিককে একটু বলে দিও মা এখন ভালো আছেন।”
কলি বেরিয়ে গেল। সুলতানা আবার ডাকলেন,
-“কলি বোরকা নিয়ে যাও।”
কলি বোরকা নিয়ে গেল ঠিকই কিন্তু রান্নাঘরে গিয়ে সেটা জানালা দিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিলো। তার মেজাজ ভীষণ চটে আছে এখন।
রফিক হন্তদন্ত হয়ে রান্নাঘরে প্রবেশ করলো।
-“কলি! বড় ম্যাডামের অবস্থা কী?”
-“অবস্থা বেগতিক। এখনো চোখ মেলে নাই। মুখ দিয়া সমানে লোল পড়তাছে। মনে হয় টিকবে না। আমার হাত ধইরা কইলো, বিদায় দেও কলি। বিদায় দেও।তোমার কাছ থাইকা বিদায় না নিয়া তো যাইতে পারি না। রাইতের ভাত কমাইয়া বসাও। রাতে মনে হয় আর আমি ভাত খাইতে পারবো না।”
-“বলো কী?”
-“যা দেখছি তাই বলি। মামাজান বলতে মানা করছে তাও বলি। আপনেরে না বইল্লা তো থাকতে পারবো না।আপনে আপন মানুষ।”
-“ছোডো স্যার ম্যাডামরে হাসপাতালে নিতেছে না কেন?”
-“মামাজান বলতেছে, যা হবার বাড়িতেই হোক। যেই বিছানায় আমার বাপে মরছে, মা মরলেও সেই বিছানায় মরবে। এই দেখেন লেবুর শরবত বানাইতেছি। মৃত্যুর আগে নানীজানের মুখে শেষ পানি দেওয়ার জন্য!”
রফিক যেমন হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসেছিল তেমনি হন্তদন্ত হয়ে ছুটে গেল। এক্ষুনি তাকে আল্লাহপাকের কাছে সিজদাহে পড়তে হবে। অতিরিক্ত চিন্তায় বায়ু নির্গত হয়ে ওযু ভেঙে গেছে। আগে ওযু করতে হবে। রফিক ছুটতে গিয়ে পা ফসকে দেয়াল ক্যাবিনেটের কাচে পড়ে গেল।
কাচ ভেঙে একাকার। দু-টুকরো কাচ তার থুতনিতে ঢুকে গেছে। গলগল করে রক্ত পড়ছে।
রফিক কঁকিয়ে উঠে ডাকলো,
-“কলি… কলি, একটু আসো বইন! ইন্তিকালের দশায় পড়ছি।”
কলি শরবত বানানো রেখে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলো। বিরক্ত স্বরে বললো,
-“নানীজান মরার আগে আপনি মরার জন্য পাগল হইছেন কেন? আপনার এত তাড়াহুড়া কিসের? এই মাসের বেতনও তো এখনো পান নাই। চলেন, হাসপাতালে চলেন। থুতা তো মনে হয় শেষ।”
রফিক বিড়বিড় করে বললো,
-“ইনশাআল্লাহ দেখবা, বড় ম্যাডামের কিছু হবে না। তাঁর বিপদ কেটে যাবে। আল্লাহপাক তাঁর বিপদ আমার উপরে নিয়া আসছেন। আল্লাহপাকের অশেষ দয়া।”
-“আল্লাহপাক নানীজানের বিপদ আপনারে দেবে কেন? আপনি নানীজানের কে? কামলা! কামলা মানুষের আবার হিসাব কী?”
-“হিসাব আছে। ভালো হিসাব আছে। কারণ আমি পাক কালাম পইড়া আল্লাহপাকেরে বলছি, আল্লাহ গো বড় ম্যাডামের বিপদ আপনে আমারে দেন। আল্লাহপাক দোয়া কবুল করেছেন।”
-“নিজের উপরে এইভাবে কেউ ডাইক্কা বিপদ আনে?”
-“আমি আনি, আমার যারে আপন মনে হয় তাঁর জীবনের সব বিপদ আমার উপরে ডাইক্কা আনি।”
-“বিপদ ডাকাডাকি এখন আপাতত বন্ধ করেন। নেন, আমার ওড়না নেন। থুতায় চাপ দিয়া ধইরা রাখেন। আল্লাহ রক্ত তো সাগর হইয়া গেছে। এক সাগর রক্তের বিপদ। দাঁড়ান, আমি বোরকা নিয়া আসতেছি।”

কলি রফিককে নিয়ে হাসপাতালে রওনা হলো। রফিক কলির কাঁধে মাথা এলিয়ে রিক্সায় বসে আছে। ব্যথায় তার মুখ দিয়ে গোঁ গোঁ শব্দ বেরোচ্ছে। কলি মনে মনে বললো, আল্লাহ গো এখন থাইকা এই মানুষের সমস্ত বিপদ তুমি আমারে দিবা। আমি তাঁর জীবনের বিপদ ভাগিনী হইতে চাই। তাঁর জীবনের বিপদের ভাগ আমার। আর সুখের ভাগ তাঁর।
কলি রফিকের মাথায় হাত রাখলো। ইশ মানুষটার সব চুল পাইক্কা একাকার। হাসপাতাল থেকে ফেরার পথে একটা সেলুনে ঢুইকা চুল কলপ করাইতে হবে। সামনে বিয়াশাদী। এত সাদা চুল নিয়ে তো আর বিয়ের আসরে বসা যাবে না।
কলি ধমকে উঠলো,
-“মাথা তুলেন। মাথা তুলেন। মাথার ওজন এক মুন। মাথার ভারে তো আমি রিক্সা থাইকা পইড়া যাবো।”

রফিক অনেক চেষ্টা করেও মাথা তুলতে পারলো না। তার থুতনিতে প্রচন্ড যন্ত্রণা হচ্ছে।

চলবে

#তৃধাআনিকা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here