#ছত্রিশ_ঝামেলা
#পর্ব_১২
সুলতানা নড়েচড়ে বসলেন। শরীরের যন্ত্রণা যে পুরোপুরি কাটেনি, মুখ দেখেই বুঝা যাচ্ছে। ভারী শরীরটা এখন তাঁর কাছে আরো ভারী লাগছে।সুলতানার মনে হচ্ছে, ওজন দ্বিগুণ হয়ে গেছে। সেভেন্টি ফোর হয়ে গেছে ওয়ান ফরটি এইট কেজি।
সুলতানা হাত দিয়ে চুল বাঁধার চেষ্টা করলেন। সম্ভব হলো না। হাত তুলতেও তাঁর কষ্ট হচ্ছে।
শাকিব উঠে এসে যত্ন করে মায়ের চুল বেঁধে দিলো। শাড়িটা ঠিক করে গায়ে টেনে দিলো। বেডসাইড টেবিল থেকে চশমা নিয়ে পরিয়ে দিলো।
সুলতানার ইচ্ছে করলো, ছেলের দুই-হাতে দুটো চুমু খান। অজানা জড়তায় সেটা করতে পারলেন না। আহারে! এই পৃথিবীর অনেক ভালোবাসাই বুঝি জড়তার কারণে প্রকাশ পেলো না।
-“লায়লা অফিস থেকে ফিরেছে?”
-“আমি ফোন করেছি। ভাবী একটা মিটিং এ আছে। আধঘন্টার মাঝেই চলে আসবে। তোমার অসুস্থতার কথাটা বলিনি।”
-“বলিসনি কেন? আমি মরে যাবার পর বলবি?”
-“ভাবীর নিজের শরীর ভালো নেই, মা। এই অবস্থায় অন্যের অসুস্থতা বিষয়ক খবর দেয়া ঠিক হবে না। ভাবী নিজের শরীরের…”
শাকিব বাকি কথাটা চেপে গেল। গতরাতেও লায়লার প্রচন্ড জ্বর এসেছিল। জ্বরের ঘোরে সে অনবরত আবোল-তাবোল বকেছে। এই জ্বরের পেছনের কারণটাও শাকিব মাকে বলেনি এখনো। সে ভেবেছে কথাটা বলতে হবে একটা কাংক্ষিত পরিস্থিতি তৈরি করে। পরিস্থিতি এখনো তৈরি হয়নি। লায়লা ভাবী যে কী ভীষণ ট্রমার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, সেটা হয়তো আন্দাজ করার ক্ষমতাটুকুও শাকিবের নেই।
-“লায়লার শরীর ভালো নেই নাকি? কই বউমা তো আমাকে বলেনি?”
-“মা, ভাবী অনেক কিছুই আমাদের বলেন না। লায়লা ভাবী লোড নিয়ে নিজে ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে যাবে, তবু অন্যের উপর কোনো লোড চাপাবে না।”
সুলতানা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন।
-“তুই এরকম আধকথা পেটে রেখে কথা বলছিস কেন? আধকথা বলার কারণ কী?”
-“এখন আধকথা বলার সময়, তাই আধকথা বলছি। যখন পুরো কথা বলার সময় আসবে, তখন তোমাকে পুরো কথা বলবো মা।”
-“সেই সময় কখন আসবে?”
-“জানি না, মা। তবে আসবে এটা নিশ্চিত করে বলতে পারি।”
-“তুই কি আমার সাথে বাঁদরামো করছিস?”
-“মা, তুমি রাগ করবে না প্লিজ। এখন রাগলে আমি আরো অসহায় বোধ করবো। এমনিতেই আমার খুব একা লাগছে মা।”
সুলতানা নিজের রাগ সামলালেন। শাকিবের কোনো বিশেষ কারণে মন খারাপ বুঝাই যাচ্ছে। তবে বিশেষ কারণটা কী, সেটা তিনি জিজ্ঞেস করবেন না। এখন খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে কথা বের করার সময় না। খুঁচিয়ে কথা বের করতে হয় দু’ তিন বছরের বাচ্চার কাছ থেকে। শাকিব দু’বছরের বাচ্চা না। যথেষ্ট বড় হয়েছে। এখনো যদি নিজের সমস্যার কথা নিজে থেকে গুছিয়ে বলতে না পারে, এরচেয়ে দুঃখজনক আর কিছু নেই। ছেলেকে তো নিজে নিজে চলা শিখতে হবে।
-“মোট কত টাকার জিনিস খোয়া গেছে, জানিস তুই?”
-“মা এসব কথা আমরা পরেও বলতে পারি।”
-“পরে বলবো কেন? পরে বলার কারণ কী?”
-“এখন তোমার শরীর খারাপ মা। শরীর খারাপ নিয়ে বাহ্যিক বস্তুগত সমস্যা আলোচনা করা মানে শরীরকে আরো অসুস্থ করে দেওয়া। শরীর খারাপের সময় আনন্দময় বিষয় নিয়ে কথা বলতে হয়।”
সুলতানার মনটা খারাপ হয়ে গেল। শাকিব মেঝেতে তাকিয়ে যন্ত্রের মতো কথা বলে যাচ্ছে। আনন্দময় বিষয় তো অনেক দূর সুলতানার মনে হলো, তাঁর ছেলে কঠিনভাবে বিষাদ গ্রস্ত হয়ে আছে। কোনো বিষয়ে সে খুব চিন্তিত। সুলতানাকে যেটা করতে হবে সেই মন খারাপ করা বিষয় থেকে শাকিবের ফোকাস সরিয়ে দিতে হবে।
-“তোর চাচা কি চলে গেছে?”
-“হুঁ।”
-“টাকা দিয়েছিস?”
-“হুঁ।”
-“টাকা কোথা থেকে দিলি? অফিস থেকে তো দিসনি! তাহলে টাকা পেলি কোথায়?”
শাকিব মায়ের দিকে তাকালো। অনুনয় এবং অনিচ্ছা ভরা গাঢ় দৃষ্টি। এর মানে হলো, মা প্লিজ টাকার কথাটা জানতে চেয়ো না। আমি খুব অস্বস্তি বোধ করছি। তার মানে শাকিব নিজের থেকে টাকাটা দিয়েছে। বলতে চাইছে না। ছেলেটা কি তাহলে ফটোগ্রাফিতে ভালো করছে? সুলতানা কি জিজ্ঞেস করবেন? উঁহু, করা যাবে না। শাকিব লাই পেয়ে যাবে। লাই বড্ড খারাপ জিনিস। এটা ইচ্ছে শক্তিকে দ্বিগুণ করে দেয়।
সুলতানা লাই দেওয়া মানে শাকিবের ফটোগ্রাফি ভুতকে উস্কে দেওয়া। তিনি ছেলের এই ভবিষ্যৎহীন ইচ্ছেকে উস্কে দিতে পারেন না। সুলতানা বেডসাইড টেবিল থেকে পানির গ্লাসটা হাতে নিলেন। চুমুক দিতে গিয়েও নামিয়ে রাখলেন।
-“তোর সিদ্ধান্ত কী, বল? কী করা উচিত?”
শাকিব মাথা নিচু করে ফেললো! মুখের বিষাদ এবার যেন সর্বাঙ্গে ভর করলো তাঁর। সুলতানা দ্রুত ভাবতে লাগলেন। শরীরের এক জায়গায় বিষ ঢুকলে সেটা সারা শরীরে ছড়িয়ে যায়। মন খারাপের বিষয়টাও কি সেরকম? মন থেকে ছড়িয়ে যায় সবখানে?
-“কথা বলছিস না কেন? রাবেয়া যে এত বড় চুরিটা করলো এর জন্য আমাদের কী করা উচিত?”
-“তুমি কি নিশ্চিত যে টাকাটা রাবু খালা নিয়েছেন?”
-“আমি নিশ্চিত। নিশ্চিত হবার পেছনে ব্যাখ্যাটা বলি, তাহলে তুইও নিশ্চিত হবি। আমি ছাড়া আমার ঘরে শুধু রাবেয়াই আসতো। সে পড়াশোনা জানা ধুরন্ধর মেয়ে। লকারের পিন কোড কোনো এক সুযোগে সে দেখে নিয়েছে। ব্যস।”
-“রাবু খালা পড়াশোনা জানেন নাকি?”
-“ইন্টারমিডিয়েট পাশ। ইংরেজিতে লেটার মার্ক পেয়েছিল।”
-“টাকাটা সরিয়েছে সে অনেক আগে। যেহেতু এই টাকা আমার সবসময়ের দরকার না, তাই আমি খেয়াল করিনি। আজ দরকার হলো বলে চোখে পড়লো। রাবেয়া আমাদের বাড়িতে কাজ ছেড়েছে দু-মাস আগে।মে’ ১৭তারিখের পর রাবেয়া আর কাজে আসেনি। এই ছুতো, ওই ছুতো ধরে ছুটি কাটিয়েছে। অন্য কেউ হলে চুরি করেই পালাতো। রাবেয়া করেনি। সে ঠান্ডামাথায় যোগাযোগ রক্ষা করেছে। নিজে এল না। সন্দেহের কোনো অবকাশই নেই। এখন পুলিশ পাঠিয়ে ওকে ধরে আনলেই সবটা প্রমাণ হয়ে যাবে।”
শাকিব কী বলবে বুঝতে পারছে না। তার নিজেকে খুব খেই হারানো লাগছে। বারবার নিশাতের মুখটা চোখের সামনে ভেসে আসছে। লজ্জিত ব্যথাতুর একটা মুখ।চোখে টলটলে পানি। নাক ফুলে ফুলে উঠছে। নাকের ডগা লালচে হয়ে আছে। শরীরটা কেঁপে উঠছে একটু পরপর। শরীর কেঁপে উঠার দরুন মাথা থেকে ওড়না পড়ে যাচ্ছে। সে বারবার মাথায় ওড়না টেনে তুলছে। ওড়না তুলবার সময় সে কৌশলে চোখের টলটলে পানি জামার হাতায় মুছে ফেলছে।
-“তুই কি ভেবেছিস টাকা আর গয়নার জন্য আমি মরিয়া হয়ে গেছি? মরিয়া হইনি। কারণটা অন্য।
রাবেয়াকে আমি অতিরিক্ত বিশ্বাস করেছি। কিরকম বিশ্বাস করেছি, তার একটু নমুনা দিই। রাবেয়া যখনি কাজে আসতো, সবসময় তার কন্যার কথা গল্প করতো।
গল্প শুনেই তাঁর কন্যাকে আমি নিজের মেয়ের মতো স্নেহ করেছি। তাঁর মেয়ে যখন ইউনিভার্সিটিতে চান্স পেলো, আমি তার পড়াশোনার সমস্ত দায়িত্ব নিয়েছি। আমি বারবার করে বলেছি তোমার মেয়েটিকে আমাদের বাড়িতে একদিন নিয়ে এসো। মেয়েটিকে আমি দোয়া করবো। সে আনেনি। একদিন আমি বললাম, চলো তোমার বাসায় গিয়ে মেয়েকে দেখে আসি। রাবেয়া তখন মেয়েকে আমার অফিসে নিয়ে এলো। নিশাতের সাথে কথা বলে আমার মন ভরে গেছে। আমি ওকে বলেছি,
আমার কোনো মেয়ে নেই। তেমন করে অভাব বোধ করিনি কখনো। অথচ তোমাকে দেখার পর মনে হচ্ছে, তুমি আমার মেয়ে হলে ভালো হতো। এই জীবনটা আরো আনন্দময় হতো। তোমার মা হয়তো জীবনে যথেষ্ট পূণ্য করেছেন বলে তোমাকে পেয়েছেন। আমি করিনি বলে তোমার মতো একটি মেয়ের মা হওয়া থেকে আমি বঞ্চিত হয়েছি। মেয়েটি আমার পা ছুঁয়ে সালাম করলো। আমি সেদিন পর্যন্ত বলিনি, মাগো আমার ছেলে তোমার শিক্ষক। আমার বারবার মনে হয়েছে, মেয়েটি যদি জানতে পারে তার মা তার শিক্ষকের মায়ের সাহায্যকারী, তাহলে মেয়েটি ক্লাসে ছোট হয়ে থাকবে। তার হয়তো এখনের মতো মাথা উঁচু করা মনটা একটু হলেও ব্যথিত হবে। এখন বল রাবেয়ার কি শাস্তি পাওয়া উচিত নয়? এই ধরনের অপরাধী যদি শাস্তি না পায়, তাহলে মানুষ তো মানুষকে বিশ্বাস করতে ভয় পাবে।”
-“মা তোমার শরীরটা আগে ঠিক হোক।”
-“আমার শরীর ঠিক হবার তো কিছু নেই শাকিব।পুলিশি ব্যাপার যা করার তুই করবি। তুই ওকে শাস্তি দেবার ব্যবস্থা করবি।”
শাকিব বসা থেকে দাঁড়িয়ে পড়লো। সুলতানা বিস্ময় নিয়ে ছেলের দিকে তাকিয়ে আছেন।
-“উঠে পড়ছিস কেন? বস! পুরো কথাটা শোন্। তুই আধকথা বলে থাকতে পারিস। আমি পারি না। আমি পুরো কথার মানুষ। পুরো কথাই বলবো। পুলিশি ব্যাপার কী করে সামলাবি শোন্।”
শাকিব বসলো। তাঁর শরীর ক্লান্ত লাগছে। ঘাড় ভেঙে আসছে অসহ্য যন্ত্রণায়। সুচালো কিছু একটা চোখে খুব বিঁধছে। বারবার পেটের ভেতর পাঁক দিয়ে উঠছে। মনে হচ্ছে এক্ষুনি বমি পেয়ে যাবে। আবার জিভটাও শুকিয়ে আসছে। শাকিব মায়ের রাখা পানির গ্লাসটা নিতে গিয়েও নিলো না। সুলতানা ছেলের দিকে পানির গ্লাস বাড়িয়ে দিলেন।
শাকিব এক চুমুকে পুরো পানিটা খেয়ে নিলো।
-“ধানমন্ডি থানার ওসি খালেক আমার পরিচিত। তোকে গিয়ে কিছু করতে হবে না। ঘরে বসে ইনস্ট্রাকশন দিবি। সে সব করবে। ইনস্ট্রাকশনের আগে দুটো চকচকে বান্ডেল তাঁর কাছে হাতে হাতে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করবি। আমাদের ম্যানেজার জামিলকে বললে সে পৌঁছে দিয়ে আসবে। সব পেশায় কিছু মানুষ থাকে এক্সট্রা স্কিলড। খালেক সেইরকম। অপরাধী ধরা এবং অপরাধ স্বীকার করানো তাঁর বা-হাতেরও ব্যাপার না, বাঁ-চোখের ইশারার ব্যাপার।”
শাকিবের মনে হলো।এতক্ষণ পেটে পাঁক খাওয়া বমিটা তার গলায় উঠে এসেছে। তার এক্ষুনি বেসিনে ছুটে যাওয়া উচিত।
-“তুই হয়তো ভাবছিস এত অল্প টাকার জন্য আমি এত কেন ভাবছি? তোকে আবারও ক্লিয়ার করি। টাকাটা অল্প। কিন্তু বিশ্বাসঘাতকতার পরিমাণ বেশি। রাবেয়া আমার সাথে পাহাড়সম বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। আর টাকার চেয়ে বিশ্বাস নিশ্চয়ই অনেক দামী।”
শাকিব মায়ের হাতে হাত রাখলো। নরম স্বরে বললো,
-“মা আমি মানছি এটা অনেক বড় একটা বিশ্বাস ঘাতকতা। তবুও আমি এটা করতে পারবো না। এবং দয়া করে তুমিও করবে না।”
সুলতানার মুখ হাঁ হয়ে গেল। তিনি এতক্ষণে ছেলের মন খারাপের ব্যাপারটা আন্দাজ করতে পারলেন। আন্দাজকে নিশ্চিত করার জন্য তিনি কথার খেলা শুরু করলেন।
-“আমিও করবো না?”
শাকিব শান্ত স্বরে বললো,
-“না। এই ব্যাপারটা এখানেই শেষ। রাবু খালা এবং টাকা চুরি দুটো বিষয়েই আর কোনো কথা হবে না।
মা আমি চাই এই ব্যাপারটা নিশাত কোনোদিন না জানুক।”
সুলতানা আরেক গ্লাস পানি খেলেন৷ নিজের ছেলেকে আজ হঠাৎ করেই তাঁর কাছে বড় মনে হচ্ছে। এতে কি তাঁর আনন্দিত হওয়া উচিত? অবশ্যই উচিত। তাঁর উদাসীন বাচ্চা ছেলেটা এই প্রথম নিজের থেকে দায়িত্ব নিয়ে কিছু ভাবছে। শুধু ভাবছে না। ভাবনামত কাজ করতেও শুরু করেছে। মনের প্রবল চাওয়ার ছায়া পড়তে শুরু করেছে বাস্তব কথাবার্তায়। সুলতানা আনন্দের ব্যাপারটা আড়াল করলেন। মুখের স্বাভাবিকতা বদলে চেহারায় মলিনতা নিয়ে এলেন।
-“আমার সমস্ত বিয়ের গয়না চুরি গেল, তারপরও আমি চুপ করে থাকবো? একটা মেয়ের জীবনের সবথেকে স্পর্শকাতর বিষয় বিয়ে। সেই বিয়ের স্মৃতিচিহ্ন খোয়া গেছে। এই কষ্ট তুই অনুভব করতে পারছিস না বলে এরকম বলছিস!”
-“মা, আমি তোমার কষ্ট অনুভব করার চেষ্টা করছি। যথেষ্ট মন দিয়েই করছি। তবু একটা কথা বলি, যাকে বিয়ে করেছিলে সেও তো হারিয়ে গেছে। তাকে ছাড়া যখন থাকতে পারছো। গয়না ছাড়াও থাকতে পারবে।
মানুষের থেকে নিশ্চয়ই গয়না গুরুত্বপূর্ণ নয়।”
-“আমার ক্ষেত্রে ব্যাপারটা ভিন্ন শাকিব। মানুষ যেমন গুরুত্বপূর্ণ, গয়নাও আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ। এই গয়নার সাথে আমার কমবয়েসী সুখী জীবনের অনেক ঘটনা জড়িয়ে আছে। আমার আবেগি মুহূর্ত জড়িয়ে আছে। বিয়ের হারটা তোর বাবার জীবনে প্রথম তৈরি করা সাতনরীর হার। ব্যবসায়িক অতি দুঃসময়ের সময়ও তিনি এটা বিক্রি করেননি। আমায় বলেছিলেন, সুলতু, আমাকে তো তুমি বাক্সবন্দি করে তোমার কাছে রাখতে পারবে না। এই হারটাকে রাখতে পারবে। তোমার কাছে আমি থাকবো না, কিন্তু আমার ভালোবাসা সবসময় বাক্সবন্দি হয়ে থাকবে। তোর বাবার আমাকে দেয়া সেই বাক্সবন্দি ভালোবাসা চুরি হয়ে গেছে। এখন বুঝতে পারছিস তো!”
শাকিবের চোখ ছলছল করে এলো। সে খুব সাবধানে বারকয়েক চোখের পাতা ফেললো। চোখের পানি চোখের ভেতরে শুকিয়ে ফেলার পুরাতন কৌশল।
-“মা, আমি কোনোভাবেই পুলিশি ব্যাপারটা করতে পারবো না। তুমি আমাকে অন্য কিছু করতে বলো, আমি করে দিচ্ছি। কিন্তু আমার ছাত্রী লজ্জিত হবে এমন কোনো কাজ আমি করবো না।”
-“তুই কি তোর সব ছাত্র ছাত্রীর কথাই এমন করে ভাবিস?”
-“মা আমার অন্য ছাত্র ছাত্রীর বেলায় কিন্তু এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়নি!”
-“যদি হয় কখনো, তখন?”
-“মা, তখনেরটা তুমি আমায় তখন বলো। প্লিজ মা।”
সুলতানার ইচ্ছে করলো, তিনি ছেলের মাথায় হাত রাখেন। চুলে হাত বুলিয়ে কিছুক্ষণ আদর করে দেন। ইচ্ছেটা তিনি সামলালেন। তাঁর বড় ছেলে হাসিবকেও তিনি এমন ভালোবেসেছিলেন। লাভ কিছু হয়নি। ছেলে আদরের সুযোগ নিয়ে ভিনদেশী হয়েছে। শাকিবকে তিনি ভিনদেশে হারাতে চান না।
-“তুই কেন এই কাজটা করতে পারবি না, তার কারণটা আমি আন্দাজ করতে পারছি। নিশাতকে কি তুই পছন্দ করিস?”
শাকিব জবাব দিলো না। এতক্ষণ গলায় উঠে থাকা বমিটা যেন হুট করেই মিলিয়ে গেল। চোখের ব্যাথাটা চোখ ছেড়ে পালালো। ঘাড়ের উপরের ভারী বোঝাটাও নেমে গেল বলে মনে হলো শাকিবের ।
সুলতানা বিছানা থেকে নামলেন। তাঁর ভীষণ ভালো লাগছে। ছেলে নিজের আনন্দের দায়িত্ব নিতে শিখছে এর চেয়ে বড় পাওয়া একজন মায়ের কাছে আর কিছু নেই। সন্তান দায়িত্বশীল হওয়া মানে মায়ের লালন-পালনের সমাপ্তি পর্যায় এসে গেছে। এখন সন্তান একটু একটু করে মায়ের দায়িত্ব নিতে শুরু করবে। মায়ের ভাবনা চিন্তা কমে আসার দিন শুরু।
-“তুমি বিছানা থেকে নামলে কেন?
-“শরীরটা ভালো লাগছে এখন। চোখে মুখে পানি দিয়ে একটু ছাদে হাঁটবো৷”
-“আমি সঙ্গে আসি তোমার মা?”
-“খবরদার না!”
-“মা, নিশাত খুব অন্যরকম মেয়ে। একদম আলাদা। আমি হয়তো তোমাকে ব্যাখ্যা করতে পারবো না ওর পুরোটা। এটুকু বলতে পারি…”
সুলতানা ছেলেকে থামিয়ে দিলেন।
-“শাকিব আমার ধারণা রাবেয়া এই ঘটনা এই প্রথম ঘটায়নি। আগেও ঘটিয়েছে। এবং ভবিষ্যতে আরো ঘটাবে। তোর কি উচিত না ব্যাপারটা নিশাতের সাথে সরাসরি আলাপ করা। তাহলে সে তার মায়ের ব্যপারে সাবধান হয়ে গেল।”
শাকিবের চোখে জমে থাকা পানিটা এবার বেশ কথা শুনবো না শুনবো না করছে। দ্রুত নিঃশ্বাস পড়ছে তার।
-“আমি কথা বললে নিশাত খুব লজ্জা পাবে মা। আমি ওকে লজ্জা দিতে পারবো না মা। কোনোভাবেই না।”
সুলতানা শাকিবকে ঘরে রেখেই ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। ছেলেটার এই মুহূর্তে একা থাকা দরকার। কান্নার কারণ যে জানে, তাকে কান্না উপভোগ করতে দিতে হয়। অকারণ কান্না হলে সেই কান্না ভুলিয়ে ভালিয়ে থামাতে হয়। কার্যকারণ আছে এমন কান্না থামানো মোটেও ঠিক নয়। এই কান্না শরীরের জন্য এক ধরনের রিলাকটেন্ট হিসেবে কাজ করে। তাই এই কান্না যত ভালো করে কেঁদে নেওয়া যায়, ততই ভালো। ছেলেটারও এখন একটু কেঁদে হালকা হওয়া দরকার!
সুলতানা ছাদে যাবার আগে ডাকলেন,
-“কলি… কলি… লেবুর শরবত নিয়ে ছাদে আয়।”
ঘর থেকে জবাব এলো না।
সুলতানা ড্রয়িংরুমের দেয়াল থেকে তাঁর স্বামী আকবর সাহেবের একটি ছবি খুলে নিলেন। তিনি এখন দীর্ঘক্ষণ তাঁর স্বামীর সাথে গল্প করবেন। দুটো সময় তিনি এই কাজটি করেন। যখন তাঁর প্রচন্ড মন ভালো থাকে, আর যখন তিনি সন্তানদের কোনো ভালো খবর পান৷। মন খারাপ বা দুঃসময়ে তিনি কখনোই স্বামীর ছবির সাথে কথা বলেন না। মানুষটা বেঁচে থাকতে সবসময় বলতেন, সুলতু, তোমার মুখ কালো দেখলে আমার মাথা ঠিক থাকে না। কাজের দিশা হারিয়ে ফেলি। তুমি কখনো আমার সামনে মন খারাপ করবে না। তোমার হাসিমুখ আমার মনের জোর।
সুলতানার এখন মন ভালো। শাকিব তাঁর জীবনের আটাশ বছরে এসে এই প্রথম নিজের সুখের জন্য কিছু ভেবেছে। নিজ বিবেচনায় একজনকে পছন্দ করেছে। জীবনের অনেক বড় একটা সিদ্ধান্ত একা নিয়েছে, এই সফলতার কথা সুলতানা তো স্বামীকে না শুনিয়ে থাকতে পারবেন না। শাকিবের বাবা বেঁচে থাকলে হয়তো আজই একগাদা গয়না নিয়ে নিশাতকে দোয়া করে ফেলতেন। বলতেন, মাগো আমার ছেলের কানের তলায় খুব সুরসুরি। মাথার নিচে বালিশ রাখলেই আমার ছেলে ঘুমাতে পারে না। সে জন্মের পর থেকেই বালিশ ছাড়া ঘুমোয়। কোনো ভুলত্রুটি হলে তুমি তারে নাক ধরে উঠবস করাবে। কান ধরে নয়।
সুলতানার চোখ ভিজে এলো। মানুষটা এত আনন্দ আহলাদের কিছুই দেখে যেতে পারলো না। বেঁচে থাকার পুরে সময়টা ব্যবসা দাঁড় করানো নিয়ে কেটে গেল। ব্যবসা যখন ভালো করে দাঁড়িয়ে গেল, তখনি সব ছেড়ে চলে গেল। সুলতানার মাঝে মাঝে মনে হয়ে ব্যবসাটা না দাঁড়ালেই ভালো হতো। মানুষটা সঙ্গ ছাড়তো না। যতদিন অভাব সঙ্গে ছিল, মানুষটাও ছিল। অভাব গেল, মানুষটাও চলে গেল।
সুলতানা যেদিন লায়লার মুখ দেখতে যাবেন, তার আগের রাতে মানুষটা সুলতানার স্বপ্নে এসেছিলেন।
চোখ মুখ হাসি হাসি। স্যুট টাই পরে পুরো পরিপাটি। সুলতানাকে বললেন,
-“ছেলের বউকে দোয়া করতে যাবো। তাই রেডি হয়ে বসে আছি।”
সুলতানা স্বামীর হাত ধরে বললেন,
-“মেয়ে তোমার পছন্দ হয়েছে?”
মানুষটা হাসিমুখে বললেন,
-“অতি পছন্দ হয়েছে। ছোট নাক, গন্ধরাজ ফুলের পাতার মতো চোখ। চোখ দেখলেই মনে হয়, এই মেয়ের ভেতরে একটা নরম শিশু বসা। শরীর বড় হয়ে যাওয়ায় সেই শিশু বাইরে এসে খেলতে পারছে না। তবে শিশুর সারল্য নিয়ে তাকিয়ে আছে। মেয়ের যেহেতু চব্বিশ বছর। তাই বউমাকে তুমি চব্বিশ ভরি স্বর্ণ দিয়ে দোয়া করবে।”
সুলতানা স্বপ্নে দেখা স্বামীর কথা মাথায় রেখেই লায়লাকে চব্বিশ ভরি স্বর্ণ দিয়ে দোয়া করেছিলেন।
নিশাতের বয়স কত জানতে হবে! তবে বয়স যাই হোক নিশাতকেও তিনি ২৪ভরি স্বর্ণ দিয়ে মুখ দেখবেন। তাঁর কাছে দুই বউমা’ই সমান। লায়লা অফিস থেকে ফিরলেই এবার শাকিবের ব্যাপারটা নিয়ে কথা বলতে হবে। বউমাটাকে আজকাল পাওয়া যায় না। অফিস নিয়ে কিসের এত ব্যস্ত থাকে, কে জানে? এখন তো মিমিকেও বাপের বাড়িতে পাঠানো হয়েছে। তারপরও বউমা কেন একটু কথা বলার সময় পায় না? কেন? শাকিব বলছে বউমার শরীর ভালো নয়। আজ এলেই কী হয়েছে জিজ্ঞেস করতে হবে?
সুলতানা আবার ডাকলেন, “কলি কলি…”
কোনো সাড়া নেই। দরকারের সময় মেয়েটা যে কোথায় থাকে, কে জানে?
চলবে
#তৃধাআনিকা