#ছত্রিশ_ঝামেলা
#পর্ব_১৪,১৫
১৪
রাত সাড়ে আটটা। দরাম দরাম দরজায় কিল পড়ছে। সোহেল দৌড়ে গিয়ে লুকিয়ে পড়লো। বাড়িতে পুলিশ এসেছে। তারা খোঁজ করছে রাবেয়াকে!
নিশাত অত্যন্ত বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
-“আপনারা কী চান?”
-“ম্যাডাম পুলিশের কিছু চাওয়ার নাই। পুলিশ শুধু জনগণের ভালো চায়। আমরা জনগণের দরকারে দুইটা কথা বলতে আসছি। রাবেয়া বেগমরে ডাইকা দেন, কথা বইলা শেষ করি।”
-“মায়ের শরীর ভালো না। প্রেশার অত্যন্ত লো। প্রচন্ড মাথা ঘুরছে। দু-বার বমি করেছেন৷ আপনাদের যা দরকারি কথা আমার সাথে বলুন।”
পুলিশের মাঝে একজন অত্যন্ত অভদ্র ইঙ্গিতে বললেন,
-“ম্যাডাম, আপনার সাথে দরকারি কথা বলতে পারলে আমাদেরও আরাম হইতো। কিন্তু কপাল খারাপ, কপালে আরাম নাই। কপালে আছে ঝামেলা। ছত্রিশ ঝামেলা। ডাকেন, আপনার মায়েরে ডাকেন।”
নিশাত একরাশ বিস্ময় আর দুশ্চিন্তা নিয়ে ডাকলো,
-“মা, একটু এসো তো।”
রাবেয়া ও’ঘর থেকে জবাব দিলেন না। পুলিশের দল নিশাতকে উপেক্ষা করেই হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকে পড়লো।
রাত ন’টার মধ্যে চারজনের পুলিশের সেই দল রাবেয়া বেগমকে ধরে থানায় নিয়ে গেল। সবুরা অবিরত বিলাপ চালিয়ে যেতে থাকলেন। সোহেল নির্বিকার হয়ে দাদীর পাশে বসে রইলো। নিশাত, হালিম চাচার খোঁজে বেরোলো। মোহাম্মদপুরে সেই ঠিকানায় গিয়ে হালিম সাহেবের কোনো খোঁজ পাওয়া গেলো না। এর মধ্যে শুরু হলো বৃষ্টি। নিশাত বৃষ্টিতে কাকভেজা হয়ে একা একাই থানায় উপস্থিত হলো।
থানার অফিসার মহিউদ্দিন সাহেব স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন,
-“থানায় ঘুরাঘুরি করে লাভ নেই। জটিল কেইস। প্রতিমন্ত্রীর বাসায় চুরি। মামলা কোর্টে উঠবে। উকিল ছাড়া আসামীর জামিন হবে না।”
-“মা কোথায়?”
-“আপাতত, আমাদের হেফাজতে। কালকের মাঝে কোর্টে চালান হবে।”
-“আমি মায়ের সাথে একবার দেখা করবো।”
-“দেখা করে লাভ হবে না। উকিল নিয়া আসেন। কথা বলতে হবে আইনের ভাষায়। আমরা আইনের ভাষা ছাড়া কিচ্ছু বুঝি না।”
-“আমি শুধু মা’কে একটু বলে যাবো, উনি যাতে চিন্তা না করেন। প্লিজ!”
ওসি সাহেব দেখা করার সুযোগ দিলেন।
-“দশমিনিটে কথা শেষ করবেন। চুরির মালপত্রের হদিস ভালো কইরা নিয়া নেন। এমন হইতে পারে মালপত্র ফেরত পাইলে পার্টি কেইস উঠাই নিয়া মিমাংসায় যাইতে পারে। প্রতিমন্ত্রীর বড় মেয়ের তেরো লাখ টাকা দামের হীরার নেকলেস। একটু ভালো কইরা জিজ্ঞাস করেন। আমরা জিজ্ঞাস করলে কিন্তু খবর হইয়া যাবে।”
রাবেয়া নিশাতকে দেখে বেশ আনন্দিত হলেন। তার চোখেমুখে দুশ্চিন্তা বা ভয়ের কোনো ছাপ নেই। যেন থানায় আসার ব্যাপারটা তিনি জানতেন।
-“শোন্ মা, একদম চিন্তা করবি না। তুই শুধু তোর হালিম চাচাকে খবরটা দে। দেখবি উনি আসলে সব এক মিনিটে সমাধান।”
-“উনি কিভাবে সমাধান করবেন? অপরাধে ফেঁসে গেছ তুমি।”
রাবেয়া রহস্যময় ভাবে হাসলেন।
-“উকিল, জজ-ব্যরিষ্টার সব উনার পকেটে থাকে। তুই মন খারাপ করিস না, মা। একবার জেল থেকে ছাড়া পাই এর পেছনের সব ঘটনা তোকে খুলে বলবো!”
-“মা, হালিম চাচা যদি আমাদের সাহায্য করতে না আসেন?”
-“অবশ্যই আসবেন। আমার জন্য না আসলেও উনার সন্তানের জন্য আসবেন।”
রাবেয়ার চোখ আনন্দে চকচক করছে। কিশোরীর মতো খুশি খুশি চেহারায় তিনি নিশাতের দিকে তাকিয়ে আছেন।
নিশাত কাঁপা কাঁপা স্বরে বললো,
-“উনার সন্তান কি তোমার গর্ভে, মা?”
রাবেয়া মাথা নাড়লেন।
-“তুই আমাকে অবিশ্বাস করিস না, মা। আমরা কিন্তু শরীয়ত মেনে বিয়ে করেছি। সাক্ষীও আছে। তোর দাদীমা সব জানে।”
-“তুমি কি এই কাজটা উনার পরামর্শেই করেছো?”
-“যা করেছি আমাদের ভবিষ্যতের জন্য করেছি।
তোর ভালো, সোহেলের ভালো সব কথা চিন্তা করেই তো করেছি।”
রাবেয়া আরো কিছুক্ষণ কথা বললেন।
নিশাত মিনিটকয়েক চুপচাপ বসে থেকে উঠে দাঁড়ালো। হালিম চাচা যে নিঁখোজ এই কথাটা তার মাকে বলতে ইচ্ছে করছে না। বাইরে তখনো তুমুল বৃষ্টি হচ্ছে। নিশাত বৃষ্টির মাঝেই বেরোলো। ভিজে গায়েই তো সে। আর গা বাঁচিয়ে লাভ কী?
বাড়ি ফিরে নিশাত বেশ অবাক হলো। সোহেল আর দাদীমা বারান্দায় বসে আছে। দরজায় তালা। নিশাতকে দেখেই সোহেল ছুটে এলো।
-“বাড়িওয়ালা আমাদের বের করে দিয়েছে আপা। বলছে, একটা জিনিসপত্রও দেবে না।”
নিশাত বাড়িওয়ালা রুস্তম আলীর সাথে দেখা করতে গেল। বেশ অনেকক্ষণ অপেক্ষার পর দরজা খুললো। বাড়িওয়ালা রুস্তম আলী অত্যন্ত পরহেজগার মানুষ। হাতে সবসময় তজবি। নিশাতকে দেখে তজবিতে চুমু খেলেন। যেন কিছুই হয়নি এমন হাসিমুখে বললেন,
-“আসো মা, ভেতরে আসো।”
নিশাত দরজায় দাঁড়িয়ে থেকেই বললো,
-“ভেজা গায়ে ঘরে যাবো না চাচা।”
-“ভেজা গায়ে ঘরে আসবা না কেন? মানুষের থাইকা তো আর ঘর বড় না। আগে মানুষের জীবন তারপর অন্য হিসাব।”
নিশাত ক্লান্ত স্বরে বললো,
-“চাচা, আজকের রাতটা আমাদের অন্তত থাকতে দিন। আমি কালকের মধ্যেই কিছু একটা ব্যবস্থা করে ফেলবো।”
-“থাকতে তো আমি মানা করি নাই মা। বিছানা বালিশ দিয়া দিসি। বারান্দায় থাকো। যতদিন খুশি থাকো। কিন্তু ঘর তো মা খোলা যাবে না। চুরির আসামী বইলা কথা। আমার উপরে অভিযোগ আসবে আমিও এই চুরির সাথে জড়িত। তোমাদের প্রতি আমার কোনো অভিযোগ নাই মা। অভিযোগ চুরির প্রতি। যে প্রতিমন্ত্রীর বাসায় চুরি করে, সে যে আমার বাড়িতে করবে না, এর গ্যারান্টি কী?”
নিশাত একবার ভাবলো সে নিচু হয়ে বাড়িওয়ালা চাচার পা ধরে ফেলবে।
-“শোনো মা, তোমাদের জন্য এই বাড়ি ভাড়া করছে হালিম মিয়া। এখন শুনতেছি সে নারিন্দার হালিম ডাকাত। ডাকাতি কইরা তিন চাইরবার জেল খাটছে।তার উপরে খুনের মামলাও আছে ঘাড়ে। মোহাম্মদপুরে তার বরফকলে কিছুদিন আগে দুইটা ডেডবডিও পাওয়া গেছে। আমরা মা সাধাসিধা মানুষ। এইসব ডাকাতির হিসাব নিকাশ তো মা আমরা বুঝি না। তুমিই বলো, আমি হজ্জ্ব কইরা আসছি নয় বছর। এরপর থাইকা এক ওয়াক্ত নামাজ কাজা নাই। আমি কি ডাকাতির হারাম পয়সা খাইতে পারি? তোমার বিবেচনা ভালো, তোমার নিজ বিবেচনায় বলো।”
নিশাত হাতজোড় করে বললো,
-“চাচা, এই মুহূর্তে আমরা ভয়ংকর বিপদে পড়েছি। এই মুহূর্তে আপনার সাহায্য দরকার!”
-“সাহায্য তো মা আমি তোমাদের অবশ্যই করবো৷ নাহলে বলো, অন্য বাড়িওয়ালা হইলে পুলিশ ডাইকা এতক্ষণে অভিযোগ দিতো। অথচ আমারে দেখো, পুলিশ দুইবার ফোন কইরা খবর জিগাইলো, আমি কাটছাঁট কইরা এক কথা বলে দিসি। বলছি, তোমরা এইসব কিছু করো নাই। আমার আবার এক স্বভাব। মানুষের উপকার না কইরা থাকতে পারি না।”
নিশাত মাথা নিচু করে বললো,
-“যাই চাচা।”
-“যাইবা মানে, এক কাপ চা খাইয়া যাও। এত রাতে ভিজা শরীরে আসছো, চা না খাইয়া গেলে তো চলবে না।”
নিশাত ওখানে আর এক মুহূর্ত দাঁড়ালো না।
রুস্তম আলী পেছন থেকে চেঁচিয়ে বললেন,
-“মা শোনো, তোমার বই খাতা আমি প্লাস্টিকের বস্তায় ভইরা যত্ন কইরা দিয়া দিসি। বিদ্যাশিক্ষার সম্মান আমি জানি মা। বিদ্যা শিক্ষা মাথার তুল্য জিনিস। এর অমর্যাদা আমি কোনোদিন করি নাই।”
নিশাত দ্রুত চিন্তা করতে লাগলো। এই মুহূর্তে তাকে থাকবার জন্য একটা জায়গা বের করতে হবে। রাসনা খালার কাছে যাওয়া যায়। বস্তিতে তিনি নিশ্চয়ই ফিরিয়ে দেবেন না। এত রাতে ভ্যান যোগাড় করা অসম্ভব। জিনিসপত্র থাকুক। সকালে এসে নেওয়া যাবে।
নিশাতের মোবাইল ফোন বাজছে। অচেনা কেউ ফোন করেছে। নিশাত ফোনটা কেটে দিলো।
সাথে সাথেই মেসেজ এলো,
‘আমি তোমার নিপু ভাইয়া নিশাত। ফোনটা রিসিভ করো। জরুরি কথা আছে৷’
নিশাত ফোনকল ব্যাক করলো।
-“হ্যালো নিশাত! তোমার সাথে একটা জরুরি দরকার ছিল।”
-“জি বলুন।”
-“বিরাট বিপদে পড়েছি বুঝলে নিশাত? আমার মেজো ফুপির খুব শরীর খারাপ। ফুপি একা মানুষ। বিশাল বাড়িতে থাকেন। উনি বারবার করে বলছেন, আমি যাতে উনার সাথে গিয়ে থাকি। আমি কী করে থাকি বলো? আমি আছি চৌদ্দ রকম ঝামেলায়। এখন এইখানে ডাক পড়ে তো তখন ওইখানে ডাক পড়ে। তুমি যদি আমায় একটু সাহায্য করো!”
নিশাত ঢোঁক গিলে কান্না আটকালো।
-“বড় ভাই হিসেবে তোমায় একটা অনুরোধ নিশাত। তুমি যদি কটা দিন আমার ফুপির পাশে থাকতে! এখনি চলে আসলে ভালো হয়। তুমি কি এই অধম বড় ভাইয়ের অনুরোধটা রাখবে?”
নিশাত ফোনের এপাশে ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো।
-“এক কাজ করো নিশাত, সোহেলকে আর দাদীমাকে সাথে নিয়ে নাও। একা বাড়িতে, কখন কী দরকার হয়?”
রাত দুটা নাগাদ নিপু ভাই সমস্ত মালপত্র সহ নিশাতকে নিয়ে যে বাড়িতে পৌঁছালেন সে বাড়িতে নিপু ভাইয়ের কোনো অসুস্থ খালা নেই। ফাঁকা বাড়ি।
নিশাতদের জন্য তিনি খাবার দাবার থেকে সবকিছুর ব্যবস্থা করে রেখেছেন।
-“তোমরা এত রাতে কখন কী রান্না করবা না করবা।তাই খাবার আনায়া রাখছি।”
নিপু ভাই খুব ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।
নিশাত মেঝেতে হাঁটু গেড়ে বসে পড়লো। কাতর স্বরে বললো,
-“আপনি শুধু আমাদের সাহায্য করবেন বলে এই মিথ্যে গল্পটা ফেঁদেছেন, তাই না?”
নিপু ভাই বেশ বিরক্ত হলেন।
-“তোমাকে পরিষ্কার করে একটা কথা বলি নিশাত, এইসব সাহায্য আমি তোমাকে করছি না।”
-“তাহলে কে করছে?”
-“কে করছে সেটাও আমি তোমাকে বলতে পারবো না। নাও যথেষ্ট ঝামেলা করছো। এখন বাকিটা সামলাও।”
নিশাত মেঝেতে হাঁটু গেড়ে বসে পড়লো। এত ক্লান্তি সে আর নিতে পারছে না।
চলবে
#তৃধাআনিকা
#ছত্রিশ_ঝামেলা
#পর্ব_১৫
সকালে নিশাতের ঘুম ভাঙলো পিয়াসার ফোন পেয়ে।
-“হ্যালো নিশাত! দশমিনিটের মাঝে ঝিগাতলার কাজী অফিসে চলে আয়। আমি আর ঠুল্লা তোর জন্য অপেক্ষা করছি।”
নিশাত চোখ কচলে উঠে বসলো। ক’টা বাজে এখন?
দুপুর হয়ে গেছে। সে এত বেলা অবধি ঘুমিয়েছে।
-“নিশাত আমি ঠিক করেছি বিয়ে করে আজ তোদের বাসায় চলে আসবো। ঠুল্লা থাকে মেসে। তাই বলে আমাদের বাসর রাত তো আমরা ভেস্তে দিতে পারি না। তোর নতুন কোনো বিছানার চাদর থাকলে পেতে ফেল।
কিরে কথা বলছিস না কেন?”
নিশাত কাল রাতের ঘটনা মনে করতো চেষ্টা করলো।
তাকে নিপু ভাই এই বাড়িতে এনে ঠাঁই দিয়েছে।
-“হ্যালো নিশু, শুনতে পাচ্ছিস? হ্যালো।”
–“পিয়া শোন্,আমি এই মুহূর্তে নিজেই বাস্তুহারা হয়ে আছি। সুতরাং তোর বাস্তু সংস্থানে তোকে অন্য ব্যবস্থা করতে হবে।”
-“মানে?”
-“মানে হলো, আমি নিজেই এখন আশ্রয়হীন।”
-“আশ্রহীন মানে? কী হয়েছে? বল!”
-“আমি রাখছি।”
-“রাখছি মানে, বললেই হলো! বিয়ে করে আমি যাবো কোথায়? তোর ভরসায় আমি ঘর ছেড়ে বেরিয়েছি। চিঠি লিখে বেরিয়েছি। বাবা হয়তো এতক্ষণে চিঠি পড়েও ফেলেছেন৷ এখন আমি যাবো কোথায়?”
-“তুই কোথায় যাবি সেটা তুই ঠিক কর। তোর সঙ্গে তোর বর আছে, তোর বরকে বল। বিয়ে করে যদি বউকে নিয়ে থাকার জায়গাই না খুঁজে বের করবে, তাহলে বিয়ে করতে এসেছে কেন?”
-“আমার বিয়ের মতো একটা বিশেষ দিনে তুই আমার সাথে এমন করতে পারছিস নিশু। শুধু তো আজকের রাতটা, আমরা কালই কোনো একটা জায়গা খুঁজে বের করে নেবো।”
–“কাল যে জায়গাটা খুঁজে বের করবি, সেটা আজ কর। খবরদার আমাকে ফোন করবি না।”
নিশাত ফোন রেখে দিলো। এই মুহূর্তে তার সামনে অনেক কাজ। প্রথম কাজ হলো, নিপু ভাইয়ের সাথে সরাসরি কথা বলা। সাহায্যটা তাকে কে করছে জানা দরকার। এই সাহায্যের পেছনে তার উদ্দেশ্য কী? নিশাত নিশ্চয়ই এমন কোনো মহীয়সী নারী নয় যার জন্য মানুষ বাড়ি মাথায় নিয়ে ঘুরছে। দ্বিতীয় কাজ, মায়ের জামিনের ব্যবস্থা করতে হবে। তৃতীয় কাজ, একটা থাকার জায়গা বের করতে হবে। এই সাহায্যকারীর সাহায্য তার পক্ষে বয়ে বেড়ানো সম্ভব নয়।
নিশাত দ্রুত নিপু ভাইকে ফোন করলো। নিপু ভাই ক্যাম্পাসে আছেন।
পিয়াসা বারবার ফোন করছে। নিশাত কঠিন ভাষায় একটা মেসেজ লিখলো।
“তোর সাথে আমার বন্ধুত্ব শেষ। তোর সাথে আমার জন্মের আড়ি। আর কোনদিন তুই আমার সাথে কথা বলতে আসবি না।”
ক্যাম্পাসে গিয়ে নিশাত ভীষণ অবাক হলো। কেউ তার সাথে কথা বলছে না। দেখলেই অদ্ভুত মুখভঙ্গি করছি। রিশাদ দাঁত কেলিয়ে বললো,
-“ঘটনাটা আসলেই দুঃখজনক। আমি তো বিশ্বাসই করিনি প্রথমে। গ্রুপে সবাই বলছিল, তারপরই আমি খবরের কাগজটা দেখি- গৃহকর্মী সেজে অভিনব পন্থায় ডাকাতি। পেছনে রয়েছে সংঘবদ্ধ ডাকাতের দল। কেঁচো খুঁড়তেই বেরিয়ে এলো সাপ। তুমি কি নিউজটা দেখেছো? তোমার মতো ভালো একটা মেয়ের মা এমন করবে ভাবাই যায় না। কিছু মনে করো না নিশাত, উনি কি তোমার আসল মা? না মানে সৎ মাও তো হতে পারে!”
নিশাত দীর্ঘশ্বাস ফেললো। মায়ের খবরটা তাহলে পেপারে চলে এসেছে।
-“আসলে ছবিতে দেখলাম উনার বয়সও যথেষ্ট কম। হতেও তো পারে, উনি তোমার বাবার দ্বিতীয় স্ত্রী।”
নিশাত ঢোঁক গিললো।
-“উনি আমার মা। উনার গর্ভ থেকে আমার জন্ম হয়েছে। তুমি যদি আরও কনফার্ম করতে চাও, তাহলে একটু অপেক্ষা করতে হবে রিশাদ। মা আর আমার ডি এন এ টেস্ট করে রিপোর্ট দিতে পারি।”
-“তোমার মা! মাই গুডনেস। আচ্ছা নিউজে যে বলছে, ডাকাতের যে বিশাল দল ছিল, তাদের সাথে তোমার মাও মাঝে মাঝে বেরিয়ে যেতেন। গ্রেপ্তারের সময় নাকি বিপুল পরিমাণ অর্থ ও কিছু হাতিয়ারও পাওয়া গেছে?”
নিশাত রিশাদের সামনে থেকে সড়ে এলো। এত ঝামেলা নেওয়ার মানে হয় না। ক্লাসের সবার মধ্যে একটা চাপা গুঞ্জন চলছে, চলুক। নিশাতের তো এত শক্তি নেই যে সব গুঞ্জন থামিয়ে দেবে।
নিপু ভাইকে পাওয়া গেল ইউনিভার্সিটির বাইরে চায়ের টংয়ে।
নিশাতকে দেখেই বললেন,
-“নাশতা করো নাই?”
-“জি না।”
-“চা-বিস্কুট খাও।”
নিশাত বসলো। বিরস মুখে চায়ে চুমুক দিলো।
-“ক্যাম্পাসে কারও সাথে কোনো তর্ক বিতর্কে যাওয়ার দরকার নাই। যে যা বলে বলুক। দুইদিন একটু আলোচনা হবে, তারপর দেখবা সব ঠান্ডা। মনে রাখবা, তোমার জীবনের সমস্যা শুধু তোমার। সমস্যা তোমার, সমাধানও তোমারেই করতে হবে। সবার কথায় কান দিলে তো তুমি সমস্যার সমাধান করতে পারবা না। তোমার টার্গেট সমস্যা সমাধান করা। আমি উকিলের সাথে যোগাযোগ করছি। জামিন পাইতে গেলে একটু ঝুট ঝামেলা আছে, সমস্যা নাই। তবে আন্টির জামিন হবে ইং শা আল্লাহ।”
-“মা প্রেগন্যান্ট নিপু ভাই। এই অবস্থায় উনার উপর এত বড় একটা শক…”
নিপু প্রথমে কথাটা বুঝতে পারলো না। যখন বুঝলো, ততক্ষণে তার হাত থেকে চায়ের কাপ ছিটকে গেছে।
নিশাত যেন সেটা দেখলোই না।
-“মা বলছেন, হালিম চাচার সাথে উনার বিয়ে হয়েছে। শরীয়ত মেনে বিয়ে করেছেন। এই অবস্থায় হালিম চাচার স্ত্রী হিসেবে বোধহয় উনার জামিন পাওয়াটা এতটাও সহজ হবে না।”
-“বিয়ের কোনো প্রমাণ আছে? মানে সাক্ষী সাবুদ।”
-“আমার দাদী জানেন। আমি জেনেছি গতকাল।”
নিপু মাথা চুলকাতে লাগলো। তার মাথায় কাজ করছে না। উকিলের সাথে সে একভাবে আলাপ করেছে, এখন ঘটনা দাঁড়িয়েছে অন্য।
-“মা খুব আশা করে বসে আছেন, হালিম চাচা এসে তাকে ছাড়িয়ে নিয়ে যাবেন। অথচ মা জানেনই না, একজন খুনী, যার মানুষ খুন করতে কখনো বাঁধেনি, তার কাছে ভালোবাসা খুন করা কোনো ব্যাপারই নয়।”
নিশাত চোখ মুছলো। কান্না পাচ্ছে না তার। তবু কেন এত চোখের পানি ঝরছে?
-“আচ্ছা আমি দেখতেছি কী করা যায়? নিশাত তোমার সঙ্গে তো টাকা পয়সা নাই। এইখানে কিছু টাকা আছে, সঙ্গে রাখো। কখন কী দরকার হয়? বাজার সদাই যা লাগবে বলবা, আমি কইরা পাঠাই দিবো। কোনো চিন্তা করবা না৷ সব ঠিক হইয়া যাবে ইং শা আল্লাহ।”
নিশাত চুপ করে কিছুক্ষণ বসেই থাকলো।
-“নিপু ভাই, আমাকে যে আপনি এত এত সাহায্য করছেন, কেন? আমি তো আপনার কেউ নই।”
-“তোমারে বললাম না, এই সাহায্য আমি তোমারে করতেছি না। সাহায্য কে করতেছে সেটা জানার তো তোমার দরকার নাই। আগে আন্টির চিন্তা করো।”
নিশাত চায়ের কাপ রেখে উঠে পড়লো। খানিকটা গিয়ে ফিরে এলো।
-“আমার বাবা মারা যাবার পর হালিম চাচা আমাদের জীবনে এলেন। আচমকা এলেন। দু-হাত বাড়িয়ে দিলেন সাহায্যের। আমরা তখন দুঃখ দারিদ্র্যে জর্জরিত। কিচ্ছু জিজ্ঞেস না করে তাকে আমাদের জীবনের সকল অংশে জুড়ে দিলাম। মনে করলাম, এত অনাদরের জীবনে যখন একটু আদর ভালোবাসা এসেছে, তা নিয়ে মাথা ব্যথা না করে বরং সবটুকু মাথা পেতে নিলাম৷ আজ সেই মানুষটার সাহায্য আমাদের গলায় কাঁটা হয়ে গেঁথে গেছে নিপু ভাই। আগে থেকে যদি নিজেদের একটু দুঃখে কষ্টে সামলাতাম হয়তো আজ এই পরিস্থিতিতে এসে পড়তাম না। আপনি আমাদের ভীষণ বিপদে এগিয়ে এসেছেন, সেজন্য আমার হয়তো আপনাকে ধন্যবাদ ছাড়া দেবার জন্য আর কোনো কৃতজ্ঞতা আমার কাছে এই মুহূর্তে নেই। কিন্তু এরপর থেকে আমি চাই, আপনি আর আমাদের পাশে না দাঁড়ান। বাকি যুদ্ধটা আমি একা করতে চাই নিপু ভাই।”
নিপু একদৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো নিশাতের দিকে৷
-“আমি আজই বাড়ি ছেড়ে দিচ্ছি। জিনিসপত্র যা সঙ্গে আছে, তা বিক্রি করে আমি কিছু টাকা যোগাড় করবো। আমার মনে হয়, এই যুদ্ধটা আমার একা চালিয়ে যাওয়া দরকার। কাউকে সঙ্গে নিলে আমি হয়তো আরও দুর্বল হয়ে পড়বো।”
নিপু থামিয়ে দিলো নিশাতকে।
-“তোমাকে এই সাহায্য কে করতেছে, সেইটা জানা কি তোমার খুব দরকার?”
নিশাত জবাব দিলো না।
-“তোমারে একজন সবটা না জানাইয়া সাহায্য করতে চাইতেছে। তুমি সেই সাহায্য নিতে চাও না। তোমার ধারণা সেও একদিন তোমাদের সাথে প্রতারণা করবে, তাই না?”
নিশাত মাথা নিচু করে ফেললো।
-“তাইলে এক কাজ করো, তুমি নিজেই তারে খুঁজে বের করো। যে একা একা নিজের জীবনের এত চ্যালেঞ্জিং পথ হাঁটবে ঠিক করতে পারে, সে নিশ্চয়ই এই সামান্য কাজটাও পারবে। আমি তোমাকে নিজে থেকে কোনোদিন তার নাম বলবো না। সে আমাকে বলেছে, আমার কাজ তোমারে সাহায্য করা, আমি তার কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করবো। ব্যস।”
-“আপনি তার কথা শুনবার জন্য এত বাধ্য কেন? সে আপনার কে হয়?”
-“সে আমার রক্তের সম্পর্কের কেউ হয় না। বন্ধু হয়। খুব সাধারণ বন্ধু। একটু বসো। তার বন্ধুত্বের ছোট একটা নমুনা তোমারে দিই। আমার ছোট একটা বোন আছে। নাজমা নাম। মা-বাবা ছাড়া আমরা বড় হইছি, সমাজ সংসারে কেউ নাই। আমি আর আমার বোনে দুইয়ে মিলে বাস। আমি তখন ইউনিভার্সিটি ফার্স্ট ইয়ারে৷ আমার বোন কলেজে উঠছে। এক সন্ধ্যায় আমি বাড়ি ফিরে দেখি, আমার বোনটার সব শেষ। পাড়ার দুইটা ছেলে মিলে এই কাজ করছে। আমি তখন দিশাহারা। নাজমারে নিয়া হাসপাতালে ছুটলাম। কেউ আমার পাশে নাই। বোনটার এত বড় দুর্ঘটনায় আমি মহাবিপদে পড়লাম। কেইস করবো, লড়াই করবো এইসব চিন্তার বাইরে। বোনের জীবন মরণ দশা। এইসময় আমার সেই বন্ধুটা কি কইরা জানি নাজমার খবর পাইলো। বললো, কেইস সে লড়বে। আমি বললাম, কেইস করলে ঘটনা ঘাটাঘাটি। আমরা বোনটা তো বাঁচতে পারবে না। সে কথা শুনলো না। ছেলে দুইটারে সে খুইজ্জা বাইরে করলো। একা একা পুরা আইনি ব্যাপারটা দেখলো। আমার বোনটার শারীরিক যন্ত্রণা হয়তো সে কমাইতে পারে নাই। কিন্তু মানসিকভাবে আমার বোনটার সব যন্ত্রণা দূর হইয়া গেল। আমার বোনরে সে পড়াশোনা করতে বিদেশ পাঠাইলো। এখন বলো আমার সেই বন্ধুর কথা কি আমি না রাইখা পারি?”
এতটুকু বলে নিপু ভাই থামলেন।
-“তুমি যাও নিশাত। আর কথা বলতে ইচ্ছে করতেছে না।”
নিশাত ওখানেই ঠায় দাঁড়িয়ে থাকলো। নিপু ভাই চলে গেলেন।
পিয়াসা আবার ফোন করছে। নিশাত ফোনের লাইন কেটে দিলো। ভালো লাগছে না তার। মাথা দপদপ করছে।
সারাদিন নিশাত এলোমেলো ছুটাছুটি করলো। একবার থানায় গেল। পুলিশের কাছ থেকে একজন উকিলের নাম্বার নিয়ে যোগাযোগ করলো। সবশেষে সে সুলতানা ম্যাডামের অফিসে গেল। রিসেপশনিস্ট জানালো, সুলতানা ম্যাডাম অসুস্থ। তিনি আজ অফিসে আসেননি।
নিশাতের ধারণা সুলতানা ম্যাডাম হয়তো আর্থিকভাবে তাকে সাহায্য করতে পারে। মা যেহেতু অনেকদিন এ বাড়িতে কাজ করেছেন, তিনি নিশ্চয়ই ফিরিয়ে দেবেন না
–“উনার বাসার ঠিকানা পাওয়া যাবে? আমার উনার সাথে দেখা করা খুব দরকার।”
বাসার ঠিকানা হাতে নিয়ে নিশাত থমকে গেল। এটা শাকিব স্যারের বাসার ঠিকানা।
নিশাত বিড়বিড় করতে লাগলো- পৃথিবী এত ছোট কেন?
সুলতানা ম্যাডামের অফিস থেকে বেরিয়ে নিশাত বাড়ি ফিরে যাবে ঠিক করলো। পা চলছে না একদম তার। আকাশ কালো করে আছে খুব। তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরা দরকার। সোহেল আর দাদীমা কী করছেন, কে জানে?
বাড়ি ফিরেই নিশাত ব্যাগ গুছিয়ে নিলো। সে এখানে থাকবে না। রতন খালার বস্তিতে চলে যাবে।
সোহেল বারবার করে বললো,
-“আপা আজকের রাতটা এইখানে থাকি। কালকে যাবো।”
নিশাত শুনলো না। সম্পূর্ণ অজানা একটা মানুষ থেকে সাহায্য নেওয়া তার পক্ষে অসম্ভব।
রতন খালার বস্তিতে গিয়ে খালাকে পাওয়া গেল না। তিনি দেশের বাড়িতে গিয়েছেন।
-“এখন আমরা কী করবো আপা?”
-“আমরা এখানেই বসে থাকবো।”
-“ওই বাড়িতে থাকলে কী হতো? দেখলে তো আমরা এখন কী বিপদে পড়লাম?”
নিশাত দ্রুত চিন্তা করতে লাগলো। সোহেল আর দাদীমার জন্য থাকার একটু জায়গা ব্যবস্থা করতেই পারলেই হয়। সে নিজে তো যেকোনো জায়গায়ই রাত কাটাতে পারে। পিয়াসাদের বাড়ি গিয়ে কি একবার দেখবে? সন্ধ্যা পর্যন্ত অপেক্ষা করে কি দেখবে। রতন খালা ফিরে কিনা? ঝমঝম করে বৃষ্টি নেমেছে।
নিশাতের মোবাইল ফোন বাজছে। অপরিচিত নাম্বার থেকে ফোন এসেছে।
-“হ্যালো নিশাত।”
নিশাতের বুকের ভেতরে ধক করে লাগলো।
শাকিব স্যার ফোন করেছেন।
-“হ্যালো। শুনতে পাচ্ছো?”
-“জি স্যার, বলুন।”
-“তুমি বাড়ি ছেড়ে চলে এসছো কেন? তোমার কি ধারণা, তুমি এরকম বাড়ি ছেড়ে চলে এলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।”
-“এরকম নয় স্যার”
-“নিশাত শোনো, সামান্য একটা দুর্ঘটনা ঘটে গেছে।দুর্ঘটনা আমাদের সবার জীবনেই ঘটে। এই পৃথিবীতে সবার ক্ষেত্রেই ঘটে। আমাদের উচিত দুর্ঘটনা কাটিয়ে উঠার চেষ্টা করা। সেটাকে বড় পরিসরে নিয়ে যাবার তো কিছু নেই। তুমি কেন সেটাকে বড় করার জন্য এত উঠে পড়ে লেগেছো বলো তো? তুমি জানো, তোমাকে খুঁজে বের করতে আমার কত ঝামেলা হয়েছে। এক্ষুনি তুমি আবার বাড়িতে ফিরে আসবে।”
নিশাত ঠোঁট কামড়ে ধরলো শক্ত করে। দৃঢ় স্বরে বললো,
-“সমস্ত ব্যাপারটার জন্য আমি যে আপনার কাছে কতটা লজ্জিত হয়ে আছি, আপনি জানেন না স্যার। এই মুহূর্তে আপনি প্লিজ আর আমায় লজ্জিত করবেন না।”
শাকিব কাতর স্বরে বললো,
-“আমি তোমার উপর অনেক ভরসা করি নিশাত। নিজের থেকেও বেশি ভরসা। পুরো ব্যাপারটা তুমি কী করে সামলাবে, আমি জানি সেই ছক তোমার মাথায় আছে। তবুও যদি তুমি এমন ভুল সিদ্ধান্ত নাও, তাহলে কী করে হয়, বলো তো?”
নিশাত ফোনের লাইন কেটে দিলো। তার জীবনের এমন এলোমেলো পরিস্থিতিতে সে আর কাউকে জড়াতে চায় না। কাউকে না। রাতটা সে আজ এই বারান্দায় বসেই কাটাবে৷ যা হবার হবে।
বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে শাকিব চলে এসেছে।
নিশাত কিছু বলবার আগেই শাকিব বললো,
-“আমি মোড়ের মাথায় গাড়ি দাঁড় করিয়ে এসেছি নিশাত। সোহেল, তোমাদের দরকারি কী কী নিতে হবে বলো তো?”
সোহেল এগিয়ে গিয়ে কথা বললো,
-“আমরা কোথায় যাবো আপা?”
নিশাত জবাব দিলো না। জবাব দিলো শাকিব।
-“আমরা কোথায় যাবো এটা তোমার আপা জানে না সোহেল। আমি জানি, আমাকে জিজ্ঞেস করো।”
-“আমরা কোথায় যাবো?”
-“আমরা আমাদের বাসায় যাবো সোহেল। আমার মা খুব অসুস্থ। উনাকে দেখার কেউ নেই। ভাবীরও শরীর খারাপ। তোমরা আমার সঙ্গে গেলে আমার খুব উপকার হবে।”
সোহেল অতি উৎসাহে তার বইয়ের ব্যাগটা হাতে নিলো।
-“আপনাকে আমি কী ডাকবো?”
-“নাম ধরেও ডাকতে পারো। আমার নাম শাকিব।”
সোহেল সাথে সাথেই বললো,
-“আপনি আপার ইউনিভার্সিটির স্যার?”
-“তোমার আপার টিচার হলেও তোমার আপা আমার কাছে কিন্তু একদিনও পড়েনি। তোমার আপার বোধহয় টিচার হিসেবে আমাকে তেমন পছন্দ না। আচ্ছা দাদীমা তো এই বৃষ্টিতে হেঁটে যেতে পারবেন না। কোলে করে নিয়ে যাই বরং।”
শাকিব সবুরা বানুকে কোলে তুলে নিলো। সাথে সাথে সবুরার চোখে পানি এসে গেল। এত রাতে এই বিপদ থাইকা উদ্ধারের জন্য আল্লাহপাক নিশ্চয়ই ফেরেশতা পাঠাইছে। এত ভালো ছেলে মানুষ হতেই পারে না।
তিনি ভারী কান্নায় ভেঙে পড়লেন।
বারবার বলতে লাগলেন,
-“আল্লাহগো, এই পোলা আমরারে বিপদের দরিয়া থাইকা উদ্ধার করছে, তারে তুমি সুখের দরিয়ায় ডুবাই রাইখো সারাজীবন।”
শাকিব একে একে সব জিনিসপত্র নিয়ে গাড়িতে তুললো।
নিশাত বারান্দায় ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো। পা চলছে না তার। এত অসহায়, এত ক্ষুদ্র তার নিজেকে এর আগে কখনোই মনে হয়নি। আচ্ছা ভালোবাসলেই বুঝি মানুষ ক্ষুদ্র হয়ে যায়?
শাকিব নিঃশব্দে এসে নিশাতের পাশে দাঁড়ালো।
বৃষ্টির তোড় যেন আরও বেড়েছে। সমস্ত আকাশ যেন আজ রাতেই তার সমস্ত মেঘ গলিয়ে পৃথিবী ধুয়ে পবিত্র করে দেবার জোড় চেষ্টায় নেমেছে।
নিশাত ভাঙা ভাঙা স্বরে বললো,
-“স্যার, আমার মা এই কাজটা নিজে থেকে করেননি। বিশ্বাস করুন। আমার মা এতটাও খারাপ নয়। মা’কে তো আমি চিনি। সম্পূর্ণ ব্যাপারটার পেছনে ছিলেন হালিম চাচা। শুধু মা’ই নয় লোকটা আরও অনেক জনকে ব্যবহার করে এসব করিয়েছে৷ ঢাকা শহরে লোকটার একটা চক্র আছে। আমার মায়ের সরলতাকে লোকটা ব্যবহার করেছে৷ আমার মা চোর নন। আমার মা চোর নন।”
বলতে বলতে নিশাত বারান্দার মেঝেতে বসে পড়লো৷
গলা শুকিয়ে গেছে তার একদম।
শাকিবও পাশাপাশি বসলো নিশাতের। নিশাতের দিকে হাতটা বাড়াতেই নিশাত নিজেকে একদম গুটিয়ে নিলো। শাকিবের ইচ্ছে করলো সে চিৎকার করে বলে,
নিশাত আমার এক্ষুনি এই মুহূর্তে তোমায় চিৎকার করে একটা বিশেষ কথা বলতে ইচ্ছে করছে। কথাটা বলার জন্য আমি হয়তো অন্য রকম একটা মুহুর্ত ভেবে রেখেছিলাম।
-“হালিম চাচাকে আমি আর সোহেল বাবার মতো সম্মান করেছি। ভেবেছি, মা তো বাবাকে হারিয়ে একা। উনি যদি মায়ের পাশে থাকতে চান, আর মাও যদি মন থেকে ব্যাপারটা মেনে নেন আমাদের কোনো আপত্তি নেই। আপনি বিশ্বাস করুন স্যার, আমার মা একদম খারাপ মানুষ নয়। একদম নয়।”
শাকিব এবারে হাত বাড়িয়ে নিশাতের হাতটা ধরলো। গাঢ় আদরে যত্ন করে নিজের মুঠোবন্দি করলো।
ফিসফিস করে বললো,
-“তুমি কি হেঁটে যাবে নিশাত? নাকি তোমাকে দাদীমার মতো কোলে করে নিয়ে যাবো?”
নিশাত ছলছল চোখে শাকিবের দিকে তাকালো।
বৃষ্টিতে ভিজে মানুষটা একদম চুপসে গেছে। নিশাতের খুব ইচ্ছে করলো, সে হাত বাড়িয়ে শাকিবের কপাল মুছিয়ে দেয়। ভিজে চুলটা নিজের হাতে ঝেড়ে দেয়। যে মানুষটাকে এতদিন মনের ভেতরে সে গবর্ভরে ভালোবাসলো, আজ সেই মানুষটার কাছ থেকে এত সামান্য হয়ে দয়া নিতে তার একটুও ভালো লাগছে না।
নিশাত উঠে দাঁড়ালো। শাকিবের হাত ধরে নেমে পড়লো ঝুম বৃষ্টিতে।
আচ্ছা, এই ঝুম বৃষ্টি কি তার সব লজ্জা, মলিনতা, ধুয়ে দিতে পারে না?
চলবে
#তৃধা_আনিকা