#ছত্রিশ_ঝামেলা
#পর্ব_২
আজ সোমবার। এইদিন নিশাত ইউনিভার্সিটিতে প্রথম ক্লাস করে না। এইদিন প্রথম ক্লাস করান শাকিব চৌধুরী। তিনি নিশাতদের নতুন টিচার। পাশ করার পরপরই তিনি ডিপার্টমেন্টে জয়েন করেন। পড়াশোনায় থাকাকালীন তিনি চেয়ারম্যান স্যারের অত্যন্ত পছন্দের ছাত্র ছিলেন। কানাঘুষা আছে, চেয়ারম্যান স্যার তাকে তার একমাত্র কন্যার জামাতা করতে আগ্রহী। চেয়ারম্যান স্যারের কন্যা বিদেশে পড়াশোনা করছে। পড়াশোনা শেষ করে ফিরে এলেই ঘটনা ঘটবে। এছাড়াও সপ্তাহে আরো দু’দিন শাকিব স্যারের ক্লাস থাকে। সেই ক্লাসগুলোও নিশাত করে না।
ক্লাস না করার পেছনে ঘটনা আছে। শাকিব স্যারকে দেখলে নিশাতের বুকের কাছে দম আটকে যায়। মাথা ঝিমঝিম করে। মুখ হা হয়ে থাকে। মানুষটাকে প্রথমবার যেদিন দেখলো, সেদিনই তার মনে হয়েছিল, মানুষটাকে সে জন্মের আগে থেকে চিনতো। জন্মের আগের পৃথিবীতে এই মানুষটার সাথে তার ভাব ছিল। এই পৃথিবীতে এসে তা হারিয়ে গেছে। এই হা করে তাকিয়ে থাকার অপরাধে শাকিব স্যার তাকে দু-বার ক্লাস থেকে বেরও করে দিয়েছিলেন।
একবার নিশাত শাকিব স্যারকে বেনামী চিঠিও পাঠিয়েছিল। চিঠিটা ছিলো এরকম।
শাকিব স্যার,
এই পৃথিবীতে সবথেকে সস্তা ধরনের প্রেম হচ্ছে, কারো দৈহিক সৌন্দর্য্য দেখে প্রেমে পড়া। তারপরও পৃথিবীর নব্বই শতাংশ মানুষের প্রেমের পেছনে কারণই হলো, দৈহিক সৌন্দর্য্য। অথচ প্রেমের মতো গুরুত্বপূর্ণ একটা ব্যাপারে সবথেকে জরুরি হবার দরকার ছিল হৃদয়।একটা মানুষ আরেকটা মানুষের হৃদয়ের সৌন্দর্য্য দেখে প্রেমে পড়বে। তাই না? কিন্তু দুঃখের ব্যাপার হলো, আমরা হৃদয়ের সৌন্দর্য্য দেখার কোনো সুযোগই পাই না।
প্রেম বিষয়ক এত ত্যানা প্যাঁচানোর কারণ হলো,
আমি আপনার প্রেমে পড়ে গেছি, স্যার। সস্তা প্রেম। আপনার দৈহিক সৌন্দর্য্য আমায় আকৃষ্ট করেছে। আপনাকে প্রথম দেখবার দিন থেকে আমি আপনার দায়িত্বশীল প্রেমিকা হয়ে গেছি। মনে হয়েছে, আপনি আমার চেনা। আপনার মনের ভেতরটাও আমার জানা। আপনাকে আমি নির্ধিদ্বায় ভালোবাসতে পারি।বিয়ে করতে পারি। আপনার সন্তানের মা হতে পারি। আমার প্রেম কোন পর্যায়ে চলে গেছে দেখেছেন তো স্যার?
স্যার, আমার ভালোবাসাটা আপনাকে চিঠি লিখে জানানোর পেছনে কারণ হলো, আমার ধারণা আপনাকে আমি সামনে থেকে কখনোই ভালোবাসি বলতে পারবো না, তাই।
ভালো থাকবেন স্যার।
চিঠিতে নিশাত নাম সাইন করেনি। চিঠি পেয়ে শাকিব স্যার একটা অদ্ভুত কান্ড করেছিলেন। নিশাতকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। চিঠিটা হাতে দিয়ে বলেছিলেন,
-“এই চিঠিটা আমায় পড়ে শোনাও তো, নিশাত।”
চিঠি হাতে নিয়ে নিশাত আঁৎকে উঠেছে। চিঠির সবই ঠিক আছে। শুধু একটা লাইন এক্সট্রা যোগ হয়েছে।
চিঠির শেষে লিখা, আমি কে সেটা আপনি খুঁজে বের করুন তো স্যার।
আশ্চর্য! এই লাইনটা তো নিশাত লিখেনি। এই লাইনটা এলো কোথা থেকে? নিশাত চিঠি পড়ে মুখ ফসকে বলে ফেললো,
-“শেষের এই লাইনটা আমি লিখিনি, স্যার!”
ব্যস, শাকিব স্যার পৃথিবীর সবথেকে নিঃশব্দ হাসিটা হাসলেন।
-“তার মানে চিঠিটা তুমি লিখেছো?”
নিশাত জবাব দেয়নি। মাথা নিচু করে কান ধরে স্যরি বলেছিল।
-“আমি চিঠিটা ক্লাসের সবাইকে পড়তে দিয়েছি ভেবো না নিশাত। তোমাকে খুঁজে বের করতে আমার তেমন কষ্ট করতে হয়নি। আমি শুধু একটা ছোট্ট ব্যাপার দেখেই বুঝে গিয়েছি, চিঠিটা তুমি লিখেছো। তোমার আরও সাবধান হওয়া উচিত ছিল। এরপর থেকে কাউকে বেনামী চিঠি লিখলে কেয়ারফুল থাকবে। ওকে?”
যার কাছে চিঠি নিয়ে সে এত অপমানিত হয়েছে তার কাছে অন্তত ক্লাস তো করা যায় না।
নিশাত ঘড়ি দেখলো। ন’টা একুশ। এর মানে শাকিব স্যারের ক্লাস চলছে। আরো পঁচিশ মিনিট সময় পাওয়া যাবে। নিশাত ব্যাগ খুলে টাকাটা আবার গুণলো। ষোলোশো আশি টাকা আছে। সতেরশো টাকা ছিল, বিশ টাকায় সে নাশতা করেছে। তার দরকার আরো তেত্রিশশো বিশ টাকা। এই টাকাকে তেত্রিশশো বিশ টাকা সে এক্ষুনি বানিয়ে ফেলবে।
নিশাত দোকানের গ্লাস টেনে উঁকি দিলো। মিহি স্বরে বললো,
-“এখানে টাকা ফটোস্ট্যাট করা যাবে? একহাজার টাকা হবে দুই কপি। পাঁচশত টাকা দুই কপি। রঙিন।”
দোকানের নীল পাঞ্জাবি পরা বয়স্ক ভদ্রলোক নিশাতের দিকে সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকালেন। নিশাত মিষ্টি করে হাসলো। নিশাত ভালো করেই জানে, সে যখন মিষ্টি করে হাসে তখন তার দিকে দ্বিতীয়বার না তাকিয়ে কেউ থাকতে পারে না। কলেজে থাকতে রাফাত নামে একটা ছেলে নিশাতকে চিঠি লিখেছিল।
“নিশাত, এই পৃথিবীর সবচেয়ে স্নিগ্ধ সুন্দর ব্যাপার হলো তোমার হাসি।
মাধুরির হাসি যদি হয় মুক্তো ঝরানো। তাহলে তোমার হাসি হলো হীরে ঝরানো। মুক্তা আশপাশ আলো করতে পারে না। হীরার বিচ্ছুরন পারে। তুমি যখন হাসো তখন তোমার আশপাশটা আলোয় ঝলমল করে।”
হাসি ছাড়াও নিশাতের আরো কয়েকটা ব্যাপারে মানুষ কাবু হয়, সেটা পরে বলা যাবে। আপাতত টাকা ফটোস্ট্যাটের ব্যাপারটা বলা যাক।
তবে এখানে নিশাতের হাসি কাজে দিলো না। কারণ বয়স্ক ভদ্রলোকের সন্দেহ আরো ঘন হয়েছে। তিনি কড়া স্বরে জিজ্ঞেস করলেন,
-“কি ফটোস্ট্যাট করাবে?”
-“জি, টাকা। একহাজার টাকার নোট, আর পাঁচশো টাকার নোট।”
-“ফটোস্ট্যাট করাবে তো বাইরে দাঁড়িয়ে কথা বলছো কেন? আমি কি ফটোস্ট্যাট মেশিন নিয়ে বাইরে গিয়ে ফটোস্ট্যাট করাবো?”
-“জুতো খুলে আসবো না জুতো নিয়ে?”
ভদ্রলোকের সন্দেহের দৃষ্টি উবে গেল। দৃষ্টিতে নমনীয়তা এলো। নিশাত প্রায়ই দেখেছে কারো জিনিসকে যত্ন দেখিয়ে কথা বলা মানেই মন গলিয়ে ফেলা।
-“জুতা নিয়েই আসো। সকালে এসে দোকান মুছি, লাভ হয় না। সবাই জুতাই নিয়েই আসে। গতকাল এক বলদ আসছে গোবর নিয়ে। সারা দোকান গোবরে মাখামাখি।”
নিশাত কাচ সরিয়ে ভেতরে ঢুকলো। বয়স্ক ভদ্রলোকের পূর্ণ রূপ এবার দৃষ্টি গোচর হলো। পাঞ্জাবি লুঙ্গি পরনে এক পায়ের পরিপাটি ভদ্রলোক। চোখে সুরমা, মাথায় মেহেদি দেওয়া রোগা স্বাস্থ্য। ওহ! এক পায়ের ভদ্রলোক বলার কারণ চেয়ারে বসা অবস্থায় তার একটা মাত্র পা’ই ঝুলে আছে। লোকটির অন্য পা নেই কেন? অ্যাক্সিডেন্টে কাটা পড়েছে? বাস অ্যাকসিডেন্ট না ট্রেন?
-“তুমি কি সত্যিই টাকা ফটোস্ট্যাট করাবে?”
নিশাত সামনে দাঁড়িয়ে ব্যাগ থেকে টাকা বের করলো। নোট দুটো ভদ্রলোকের টেবিলে বাড়িয়ে ধরলো।
-“জি চাচা। সত্যিই ফটোস্ট্যাট করবো। এখানে রঙিন ফটোকপি হয় তো?”
-“হয়। টাকা ফটোস্ট্যাট করবে কী জন্যে?”
-“টাকার স্মৃতিচারণের জন্য। টাকাটা খরচ হয়ে যাবার পরও যাতে এর একটা কপি আমার কাছে থাকে, সেজন্য। সার্টিফিকেটের মূল কপি জমা দিলেও ফটোকপি থেকে যায়, ঠিক তেমন। মূল টাকা খরচ হয়ে গেলেও ফটোকপিটা আমার কাছে থেকে যাবে।”
বয়স্ক ভদ্রলোক টাকাটা হাতে নিলেন। চমৎকারভাবে দুই পায়ে উঠে দাঁড়ালেন এবং ফটোস্ট্যাট মেশিনের কাছে হেঁটে গেলেন। লুঙ্গির ভেতর থেকে তার আরেকটি পা বেরিয়ে এসেছে৷ লুঙ্গির ভেতরে এত সুন্দর করে পা লুকিয়ে রাখা যায়, এই লোককে না দেখলে তো জানাই হতো না। বাড়িতে একদিন লুঙ্গি পরে পা লুকিয়ে দেখতে হবে তো!
নিশাত অবাক হয়ে বললো,
-“আপনার দুটো পা না কি? ও মাই গড! ও মাই গড!”
-“আমার দুটো পা হওয়ায় তোমার কি সমস্যা হয়েছে?”
-“জি না।”
-“তোমার পরিচয়?”
-“আমি নিশাত তাসনিম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইকোনোমিক্সে পড়ছি। অর্থনীতিতে পড়ে পড়ে অর্থের সাথে একটা আলাদা বন্ডিং তৈরি হয়ে গেছে।”
-“তুমি কি এর আগেও এমন টাকা ফটোস্ট্যাট করেছো?”
-“জি না, চাচা। এই প্রথম! আজই শুরু। দোয়া করবেন চাচা।”
নিশাত টাকা ফটোস্ট্যাট করিয়ে বেরিয়ে এলো।
আসলে সে টাকাটা এক বিশেষ দরকারে ফটোকপি করিয়েছে। সেই বিশেষ দরকারটা এখন বলা যাক।
ইউনিভার্সিটি এসকারশনের ফিস হিসেবে তাকে পাঁচ হাজার টাকা জমা দিতে হবে। টাকা জমা দেবার আজ লাস্ট ডেট। নিশাত মা’কে বারবার করে বলেছিল টাকাটা ম্যানেজ করতে, মা শেষ পর্যন্ত যোগাড় করতে পারেননি। আজ ইউনিভার্সিটি বেরোবার সময় নিশাতের হাতে পনেরোশো টাকা গুঁজে দিয়েছেন। নিশাত ভালো করেই জানে মা এটা গতমাসের ঘরভাড়ার টাকা থেকে দিয়েছেন। নিশাত টাকা ফটোস্ট্যাট করে পাঁচ হাজার টাকা বানিয়েছে। উপরে নিচে আসল নোট দিয়ে সে স্টেপল করে টাকা জমা দেবে। জাল টাকা পাওয়া গেলে ভালো ছিল। জাল টাকা কোথায় পাওয়া যায়, কে জানে? নিশাত টাকাটা ব্যাগে রেখে আনন্দের নিঃশ্বাস ফেললো। এই এসকারশনটা নিয়ে অনেক স্বপ্ন তার। এসকারশনের ডেট হবার পর থেকে প্রতি রাতে নিশাত কক্সবাজারের কথা ভেবে ভেবে ঘুমোতে গিয়েছে৷ কক্সবাজারে গিয়ে কী কী করবে তার একটা লিস্টও সে করে রেখেছে। নিশাতের ছোটভাই সোহেল বলেছে,
-“আপা কক্সবাজার থেকে আমার জন্য দুই লিটার সমুদ্রের পানি নিয়ে আসবি। আমি ঢকঢক করে খেয়ে ফেলবো। সমুদ্রের পানি খেলে নাকি শরীর হালকা হয়ে যায়।”
নিশাত তখন সোহেলকে আরো আশান্বিত করে বলেছে,
-“শুধু পানি কেন বলছিস? এক বালতি বালিও আনবো। বালি বিছিয়ে তার উপর বসে পানিটা খাবি। মনে হবে কক্সবাজারের পানিটা তুই কক্সবাজারের বীচে বসেই খেয়েছিস!”
-“কাঁকড়া আনতে পারবি, আপা?”
-“দেখি!
সোহেল মন খারাপ করে বলেছে,
-“কাঁকড়া তো তুই ধরতে পারবি না। আমি গেলে পারতাম। কাঁকড়া ধরতে হয় নেট দিয়ে।”
-“নেট কিনে নিয়ে যাবো। কাঁকড়া ধরে জারে করে নিয়ে আসবো।”
-“আপা আমারও যেতে ইচ্ছে করছে।”
-“আমার যখন বিশাল একটা চাকরি হবে, তখন তোকে নিয়ে আবার যাবো। বক্স ভর্তি করে কাঁকড়া ধরে নিয়ে আসবো। এবার গেলে আমি খুব বেশি সমুদ্র দেখবো না। অল্প করে দেখবো। শুধু জায়গাগুলো চিনে আসবো। তোদের সাথে যখন যাবো তখন ভালো করে দেখবো।”
-“যদি তোর চাকরি না হয় তাহলে?”
-“তাহলে তোর চাকরি হলে যাবো।”
সোহেল তখন হতাশ চোখে তাকিয়েছে। তার চাকরি হবার কোনো সম্ভাবনা নেই। ক্লাস সিক্স থেকে সেভেনে উঠতে সে ফেল করছে তিনবার। শেষেরবারে সাদেক স্যার বিরক্ত হয়ে বলছেন,
-“নিশাত শুধু তুমি আমার অতি প্রিয় ছাত্রী ছিলে বলে কনসিডার করলাম। তোমার ভাই না হলে একে আমি মাথা ন্যাড়া করে ক্লাস সিক্সে রেখে দিতাম। আমি আমার জীবনে এত গাধা ছাত্র দেখেছি, কিন্তু তোমার ছোটভাইয়ের মতো কাদাকাদি গাধা দেখিনি। এ তো প্যাঁকে-পানিতে গাধা। আমার ধারনা, এর মাথা ফাটালে হড়হড় করে কাদা বেরোবে। ঘিলু বলে কিছু নেই মাথায়।”
নিশাত সাদেক স্যারকে প্রমিস করেছে, ক্লাস সেভেনে সোহেল এক চান্সে পাশ করবে৷ সোহেলের মাথায় যে কাদার ভেতরে লুকিয়ে একটা ব্রেনও আছে সেটা সে প্রমাণ করে দেবে।
ইউনিভার্সিটিতে এসে নিশাতের আনন্দ দ্বিগুণ হয়ে গেল। আজ ক্লাস অফ। চৌদ্দ ব্যাচের ভাইয়ারা ক্লাস অফ ডেকেছেন। ডিপার্টমেন্টের স্যারদের সাথে তাদের কোনো এক বিষয়ে ঝামেলা চলছে। ঝামেলা সেলিম স্যারকে নিয়ে। ফুসুরফাসুর টাইপ ঝামেলা।ফুসুরফাসুরের ভুক্তভোগী ঝুমুর নামের এক বড় আপু।
ক্লাসে সবাই যে যার মতো আড্ডা দিচ্ছে। নিশাতকে ক্লাসে ঢুকতে দেখেই রিশাদ চেঁচিয়ে ডাকলো,
-“আর কে কে বাকি আছো তোমরা? দুটোর মধ্যে কিন্তু পেমেন্ট ক্লিয়ার করতে হবে। এক সেকেন্ড পরে হলেও কিন্তু আমি টাকা নেবো না। কথা বুঝা গেছে?”
রিশাদ নিশাতদের ক্লাসের এসকারশনের চাঁদা তুলবার দায়িত্বে আছে। চাঁদা তোলার ব্যাপারে সে বিশাল আগ্রহ নিয়ে কাজ করছে। নিশাতের মনে মনে সন্দেহ হয়, সবার চাঁদা তোলার দায়িত্ব নিয়ে রিশাদটা না ফ্রি অফ কস্টে ট্যুরে চলে যায়!
রিশাদ নিশাতের দিকে তাকিয়ে দাঁত বের করে হাসলো। যেন সে খুনের আসামী ধরে ফেলেছে।
নিশাত হাসিটা না দেখার ভান করলো।
-“নিপু ভাইয়া বলেছেন, যারা যারা এসকারশনে যাবে না, তারা যাতে উনার সাথে যোগাযোগ করে। আর যাদের টাকা নিয়ে ইমার্জেন্সি কথা বলার আছে তারা যাতে মেনন স্যারের সাথে যোগাযোগ করে। অনলি হি ক্যান কনসিডার।”
রিশাদ এগিয়ে এলো নিশাতের বেঞ্চের কাছে।
-“তুমিও তো এখনো টাকা দাওনি নিশাত। কোনো ঝামেলা থাকলে নিপু ভাইয়াকে বলো গিয়ে। ভাইয়া কিন্তু তিনটে পর্যন্ত ক্যাম্পাসে আছেন। এসকারশনের ব্যাপারেই তো এসেছেন। আর্থিক ব্যাপারটা সম্পূর্ণ স্যার দেখছেন। একবার কথা বলে দেখোই না।”
নিশাত ব্যাগ থেকে টাকাটা বের করেও রেখে দিলো।
ফটোকপি করা টাকা দিতে ইচ্ছে করছে না। এই টাকাটা তোলা থাক।
-“কী ব্যাপার, সাথে টাকা অথচ চাঁদা দিচ্ছো না!”
-“এটা আমার অন্য পারপাসের টাকা।”
-“অন্য পারপাসটা কী? বিশেষ কিছু?”
রিশাদ বিশ্রীভাবে ভ্রু নাচালো।
নিশাত কথাটা না শুনবার ভান করে ব্যাগ নিয়ে উঠে দাঁড়ালো। এখানে আর দু’সেকেণ্ড দাঁড়ালেই সে কেঁদে ফেলবে। টাকাটা নিশাত কারোর থেকে ধার করেও নিতে পারে। কিন্তু চাঁদা দিয়ে কক্সবাজার যাওয়াই বড় কথা নয়, ওখানে গিয়েও খরচাপাতি আছে। যাবার জন্য ভালো একসেট জামাও নেই তার। এই সেমিস্টারের সব বইও তার কেনা হয়নি। এই টাকাগুলো বরং বইয়ের জন্যই তোলা থাক। শুধু শুধু বালি আর নোনা পানির জন্য টাকা খরচ করার মানে হয় না।
ক্লাস থেকে বেরিয়ে নিশাত অন্য ঝামেলায় ফেঁসে গেল। চৌদ্দ ব্যাচের এক ভাইয়া তাকে ডেকে পাঠিয়েছেন।
নিশাত কাঁচুমাচু ভঙ্গিতে সামনে গিয়ে দাঁড়ালো।
-“নিশাত তাসনিম, ফার্স্ট গার্ল!”
-“জি ভাইয়া।”
-“এখানে একটা সাইন করো। সেলিম স্যারের বিরুদ্ধে আমরা আইনি লড়াইয়ে যাচ্ছি। সবার মতামত দরকার। নেক্সট মিটিংয়ের দিন টাইমলি উপস্থিত থাকবে।”
-“জি ভাইয়া।”
-“এখন যাও শাকিব স্যারের সাথে দেখা করে আসো।”
নিশাতের গলা শুকিয়ে এলো। শাকিব স্যার তাকে কেন ডেকেছেন? কী জন্যে?
নিশাত শাকিব স্যারের কেবিনের দরজায় গিয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো। ভেতরে যেতে ইচ্ছে করছে না। আচ্ছা এমন কেন হয়? কিছু মানুষ মনের ভেতরে এত কাঙ্ক্ষিত কিন্তু বাইরে থেকে মুখোমুখি হতে একদম ইচ্ছে করে না।নিজের সাথে অনেক যুদ্ধ করে নিশাত ভেতরে গেল। সে কিছুতেই শাকিব স্যারের দিকে তাকাবে না। নিশাত মেঝের দিকে তাকিয়ে যন্ত্রের মতো স্বরে বললো,
-“স্যার, আমাকে আসতে বলেছিলেন?”
-“হু। বসুন।”
নিশাতের পায়ের তলা শিরশির করতে লাগলো। স্যার তাকে আপনি করে কেন বলছেন?
শাকিব নিশাতের দিকে তাকালোও না।
ফাইল খুলে একটা কাগজ নিশাতের দিকে বাড়িয়ে দিলো৷ নিশাতের শাকিবের দিকে নজর গেল তখনি। আচ্ছা মানুষটা গোলাপি শার্ট কেন পরেছে?
এরকম শার্ট পরলে যে স্বর্গের ইন্দ্রপুরী পৃথিবীতে নেমে আসে, তিনি কি তা জানেন না?
-“নিশাত তাসনিম!”
-“জি স্যার?”
-“আপনার কাছ থেকে আমার একটা সাহায্য দরকার। এটা একটু পড়ে দেখুন তো।”
নিশাত চিঠি হাতে নিয়ে আঁৎকে উঠলো। এটা তো তার লিখাই চিঠি। তবে এটাতে হাতের লিখা তো অন্যরকম। ও মাই গড! তবে কি শাকিব স্যার এবারেও বুঝে গেছেন চিঠিটা তার লিখা!”
-“চিঠি পড়া শেষ হয়েছে?”
-“জি স্যার।”
-“চিঠির ভাষা আপনার কাছে কী মনে হয়?”
-“আমি বুঝতে পারছি না, স্যার।”
শাকিব চিঠিটা নিয়ে আবার ফাইলে রাখলো।
নিশাতের গলা শুকিয়ে আসছে। স্যার কেনই বা আবার তাকে চিঠি পড়তে দিলো? তবে এবার সে কোনো ভুল করবে না। কোনো রিয়েক্ট করবে না।
শাকিব কথা বললো সম্পূর্ণ অন্য প্রসঙ্গে।
-আমার ক্লাসে আপনি নাইন্টি সেভেন পারসেন্ট অনুপস্থিত। কারণ কী?”
-“আসলে স্যার, আমি অসুস্থ ছিলাম।”
-“আমার ধারণা, আপনি ইচ্ছে করে আমার ক্লাস করেন না। ইভেন আজও ক্লাস চলাকালীন আপনাকে ফটোকপির দোকানে দেখা গেছে।”
-“আমি কিছু জরুরি নোটস ফটোকপি করাচ্ছিলাম, স্যার।”
-“সেই জরুরী নোটসগুলো কি আপনার সঙ্গে আছে?”
নিশাত জবাব দিলো না।
-“আমার ক্লাস নিয়ে কোনো অভিযোগ থাকলে সেটা অফিশিয়ালি লিখে জানাবেন প্লিজ।”
-“জি আচ্ছা স্যার।”
-“আমি কিছুদিনের জন্য দেশের বাইরে যাচ্ছি। এই সময়টা অনলাইনে ক্লাস করাবো। বাকি তথ্য আপনি চয়নিকার কাছে থেকে জেনে নেবেন।”
-“জি আচ্ছা স্যার।”
-“এখন আসুন।”
নিশাত দরজা পর্যন্ত যাওয়া অবধি শাকিব স্যার তাকে পিছু ডাকলেন।
-“নিশাত…”
-“জি স্যার।”
-“আপনি ভালো ছাত্রী। আপনার ক্লাস রেসপন্স ভালো। আর একজন ভালো স্টুডেন্টকে নিজের ক্লাসে পাওয়া একজন শিক্ষকের জন্য অনেক আনন্দের। আমি আশা করবো, এরপর থেকে আপনি আমার ক্লাসগুলোতে উপস্থিত থাকবেন।”
-“জি আচ্ছা স্যার।”
শাকিব স্যারের কেবিন থেকে বেরিয়ে নিশাত প্রায় ছুটতে শুরু করলো। এত গরম লাগছে কেন তার? শাকিব স্যার কি কোনেভাবে টের পেয়ে গেছেন চিঠিটা সে লিখেছে? উফ! কোন কুক্ষণে যে সে আবার চিঠি লিখতে গিয়েছিল। একবার ধরা খেয়ে শিক্ষা হয়নি তার।
-“চলে যাচ্ছিস না কি?”
পিয়াসা পিছু ডাকছে৷ নিশাত পেছনে না তাকিয়েই জবাব দিলো,
-“হুঁ।”
-“আর কিছুক্ষণ থাক না প্লিজ! ক্যাম্পাসে একজন নামকরা ডান্স কোরিওগ্রাফার এসেছেন। কক্সবাজারে গিয়ে আমরা যে নাচ করবো, সেটার কোরিওগ্রাফি হবে।”
-“ওসব নাচ-ফাচ দেখার সময় আমার নেই।”
-“চাঁদা দিয়েছিস?”
-“না।”
পিয়াসা দাঁড়িয়ে পড়লো। সরু দৃষ্টিতে তাকালো।
-“তুই কি সত্যিই ট্যুরে যাবি না?”
-“না।”
-“পরে কিন্তু পস্তাবি।”
-“পস্তাবো কেন? বরং পাঁচদিন বসে বসে নোনাপানি দেখলে পস্তাবো। বালির ধারে পানি ঢেউ খেলছে। একটা ঢেউ মিশে গেলেই আরেকটা ঢেউ। এতে দেখার কী আছে?”
পিয়াসা হাত টেনে ধরলো নিশাতের। নিশাত কান্না আটকাতে ঢোঁক গিললো।
-“সত্যি কর বল্ যাবি না কেন? এই ট্যুরটা নিয়ে শুরু থেকে এত লাফালাফি করলি। গতকালও তো বললি, ওখানে গিয়ে আমরা হাফপ্যান্ট পরে পানিতে নামবো। আমি তো দুটো হাফপ্যান্টও যোগাড় করে রেখেছি। আমরা একসাথে হাফপ্যান্ট পরবো।”
নিশাতের চোখে এবার পানি এসে গেলো। বারণ করা কান্না বাঁধ ভাঙবার জোর চেষ্টায় নামলো।
-“মায়ের শরীরটা তেমন ভালো না। কাজে যেতে পারছেন না। আমি চলে গেলে রান্নাবান্না কে করবে? সোহেলকে কে দেখবে? দাদীর দুদিন ধরে জ্বর নামছেই না।”
-“তোর রুনু খালাকে বল্, দুদিন একটু সামলাতে। সোহেল তো দুধের বাচ্চা না যে কোলে নিয়ে বসে থাকতে হবে। ক্লাস সেভেনে পড়ছে। ডিমভাজি করে নিশ্চয়ই খেতে পারবে? দাদীর জ্বর নিশ্চয়ই কক্সবাজার যাওয়ার দিন পর্যন্ত থাকবে না।”
নিশাত হাত ছাড়িয়ে নিয়ে দ্রুত হাঁটতে লাগলো।পিয়াসাও পিছু পিছু এলো।
-“দ্যাখ, ইউনিভার্সিটিতে আমরাই প্রথম ব্যাচ যারা এমন সুযোগ পাচ্ছি। সেকেন্ড সেমিস্টারে ভালো করে এক মাসও আমরা ক্লাস করিনি। এর মাঝেই এসকারশন যাবার সুযোগ। ভাগ্যিস চৌদ্দ ব্যাচের ভাইয়ারা আমাদের এই বিশেষ সুযোগটা দিলো বলে!”
নিশাত ওড়নার কার্নিশে চোখ মুছলো। তার পিয়াসার গলা জড়িয়ে চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে।
পিয়াসা নিশাতের সামনে এসে দু-হাত মেলে দাঁড়ালো।
-“সত্যি করে বল্, কেন যাবি না? বল্ বলছি!”
নিশাত অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে নিলো।
-“আমি তো বলেছি তোকে, আমার থেকে দু-সেট জামা দেবো। জুতো জামা সব আমরা দুজনে মিলে পরবো। দ্যাখ তুই না গেলে আমার কাজটা হবে না নিশু।”
-“যেতে ইচ্ছে করছে না। মনটা কেমন না না করছে।”
পিয়াসা মন খারাপ করে বললো,
-“টাকা যোগাড় করতে পারিসনি, তাই না? তোকে আমি আগেই বলেছিলাম, ম্যানেজ করে রাখ।”
-“মা কাজের ওখান থেকে দু-মাসের এডভান্স নিয়ে রেখেছেন। এখন কী করে আবার চাইবেন বলতো?”
-“আমি এক হাজার ম্যানেজ করে দিতে পারবো। হবে?”
নিশাত মাথা নাড়লো।
-“আমি যাবো না।”
-“এত কথা বলিস না তো। তোর কাছে কত আছ দেখি?”
পিয়াসা নিজেই ব্যাগ থেকে টাকাটা বের করে নিলো।
-“ওহ! কিছু টাকা তো আছেই। এই নে আরো একহাজার। চল্…”
-“কোথায়?”
-“নিপু ভাইয়ার কাছে যাবো। রাম-শাম, যদু-মধু বলে ঠিক ম্যানেজ করে ফেলবো।”
-“আমি পারবো না। যদি ধমক দেয়!”
-“দিলে দেবে। সিনিয়রদের ধমকে কিচ্ছু মনে করতে নেই। সিনিয়রদের ধমক আমাদের শিক্ষাজীবনের আশীর্বাদ! ধমক যত বেশি খাবি জীবনে তত সফলতা পাবি।”
নিশাত কাঁদো কাঁদো মুখে পিয়াসার সাথে রওনা হলো। শুধু কক্সবাজার যাবার জন্য সে পৃথিবীর যে কোনো বিপজ্জনক লোকের কাছে যেতে পারে।
ক্লাসরুমের সামনে যাওয়া পর্যন্ত নিশাত টের পেলো তার হাঁটু কাঁপছে। বার কয়েক সে শুকনো হাতের উল্টোপিঠে কপাল-গাল মুছলো। পিঠের উপর চুলের বেণীটা এদিক-ওদিক নাড়লো। কাঁধের ব্যাগটা এপাশ ওপাশ বদলালো।
-“গিয়ে কি সালাম দেবো?”
-“অবশ্যই সালাম দিবি। সালাম হচ্ছে গেইট পাস।
নামী দামী পার্টিতে ঢুকতে গেলে যেমন পাস লাগে। সিনিয়রদের সাথে কথা বলতেও সালাম লাগে।”
নিপু ভাইকে পাওয়া গেল না। তিনি চলে গেছেন।
নিশাত একরাশ মনখারাপ নিয়ে বাড়ি ফিরে এলো।
চলবে
#তৃধাআনিকা