ছত্রিশ_ঝামেলা #পর্ব_৩,০৪

0
464

#ছত্রিশ_ঝামেলা
#পর্ব_৩,০৪

০৩

বাড়ি এসেই নিশাতের মন ভালো হয়ে গেল। বাড়িতে একগাদা বাজার এসেছে। দুটো মুরগী আনা হয়েছে। জ্যান্ত শিং মাছ আনা হয়েছে। সোহেল বসে বসে শিং মাছের লাফালাফি দেখছে।
নিশাতের সাথে সাথে জিভে পানি এসে গেল। আজ ঠিক একমাস আটাশদিন পর বাড়িতে মুরগী আনা হয়েছে। সোহেল নিশাতকে দেখেই উঠে এলো।
-“আপা আজ কিন্তু তুই রান্না করবি।”
-“মা কি সব মশলা এনেছে? আদা ছাড়া মুরগী কিন্তু একদম মজা হবে না। গতবার কী বিচ্ছিরি হয়েছিল খেতে!”
রাবেয়া কড়া গলায় জবাব দিলেন।
-“আদা রসুন সব এনেছি। এই নে।”
-“দাদী কোথায়?”
-“একটু আগেই জ্বর নেমেছে। এখন ঘুমুচ্ছেন।”
রাবেয়া হেসে বললেন,
-“পোলাওর চালও এনেছি। কাজু, কিশমিশ দিয়ে একটু পায়েসও করবি।”
নিশাত মাকে জড়িয়ে ধরলো।
-“আমি এই মুহূর্তে ঘোষণা দিলাম, তুমি এই পৃথিবীর সেরা মা। সোহেল আমার ব্যাগ থেকে কাগজ কলম বের করে এই কথাটা এক্ষুনি লিখে দে তো।”

নিশাত ব্যাগটা বারান্দায় রেখেই মাছ কাটতে বসে গেল।
শিং মাছ দিয়ে সে পাতলা ঝোল করবে। শিং মাছের পাতলা ঝোল দাদীর খুব পছন্দ। মুরগী করবে দু’রকমের। সাদা কোরমা আর ঝাল ভুনা। টক দই সে নিজের টাকায় কিনে আনবে। কক্সবাজার যেহেতু যাওয়াই হচ্ছে না, সেই টাকা খরচ করতে অসুবিধা কোথায়?
-“মা, আজ কি দুটো মুরগীই রান্না করে ফেলবো?”
-“হু।”
নিশাতের ইচ্ছে করলো সে মাকে কোলে নিয়ে ফেলে।
সোহেল মোড়া পেতে নিশাতের পাশেই বসলো।
রাবেয়া ঘরে চলে যেতেই ফিসফিস করে বললো,
-“আপা, মা তোকে একটা ভয়ংকর দুঃসংবাদ দেবে।”
নিশাত মিষ্টি করে হাসলো। মুখটা সোহেলের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো,
-“চুলটা কানের পেছনে গুঁজে দে তো ভালো করে। গালে চুলকাচ্ছে খুব।”
-“দুঃসংবাদটা শুনবি না আপা?”
-“উঁহু, খাওয়া দাওয়ার পর শুনবো। এখন শুনলে যদি খাবার ইচ্ছে নষ্ট হয়ে যায়! সুসংবাদ থাকলে বল্।”
-“সুসংবাদ হলো, মা আগামী পরশু থেকে পাঁচদিন বাড়ি থাকবেন না। মায়ের ম্যাম অফিসের কাজে ঢাকার বাইরে যাচ্ছেন।”
-“এটা তো দুঃসংবাদের কাছাকাছি সুসংবাদ।”
সোহেল দাঁত বের করে হাসলো।
-“আপা তোর কক্সবাজার যাবার কী হলো?”
-“যাবো না। তোকে ছাড়া ওখানে গিয়ে মজা পাবো না।”
সোহেল মন খারাপ করে বললো,
-“টাকায় হয়নি, তাই না আপা?”
নিশাত জবাব দিলো না। আজ অনেকদিন পর ভালো খাবার খাবে সে। শুধু শুধু অন্য কথা ভেবে একদম মন খারাপ করতে চায় না সে।

শিং মাছ কাটবার সময় নিশাতের হাতে কাঁটা ফুটে গেল। রাবেয়া গরম পানি নিয়ে এলেন হাত ভেজাবার জন্য। সোহেল যত্ন করে হাত ধুইয়ে দিতে থাকলো নিশাতের।
-“আপা, শিং মাছেও কিন্তু বিষাক্ত জীবাণু থাকে। বেশি ব্যথা করলে ডাক্তার দেখাতে হবে।”
নিশাত দীর্ঘশ্বাস ফেললো। শিংয়ের কাঁটার ব্যথা তো নিশাতের লাগছেই না। আজ মনের ভেতর এর থেকে অনেক বড় কাঁটার ব্যথা নিয়ে সে বাড়ি ফিরেছে। আজও বাসে তার সাথে একটা কুৎসিত ঘটনা ঘটেছে। একটা লোক ইচ্ছে করে তার সাথে দু-বার ধাক্কা খেয়েছে। লোকটার বয়স ষাটের কাছাকাছি হবে। নিশাত নিশ্চিত, লোকটার ছেলেমেয়ের বয়সও নিশাতের থেকে বেশি হবে। অথচ বাসের পুরোটা সময় নিশাতের দিকে এমন করে তাকিয়েছিল ঘেন্নায় নিশাতের গা গুলিয়ে এসেছে। বারবার গায়ের ওড়নাটা টেনে নিশাত কুঁকড়ে গিয়েছে ভয়ে আর ব্যথায়। উহ!

***
লায়লার শাকিবের সাথে গল্প করতে ইচ্ছে করছে৷ শাকিব এখনো ফেরেনি কেন? এত দেরি করছে কেন?
লায়লার সাথে শাকিবের সম্পর্কটা একটু ব্যাখ্যা করা যাক। শাকিব, লায়লার একমাত্র দেবর। সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের একজন লেকচারার। তবে তাকে কেউ জিজ্ঞেস করলে সে বলে, আমি একজন ফটোগ্রাফার। সে কলেজ লাইফ থেকে ফটোগ্রাফি করছে। তার ছবি তোলার হাত অসাধারণ।এই বিষয়ে বাজারে তার দুটি বই অত্যন্ত জনপ্রিয়। ফটোগ্রাফিতে তার বেশ কয়েকটি পুরষ্কারও আছে। বাসার সবথেকে লম্বা রুমটা শাকিবের স্টুডিও। পরিচিত সবাই যারা যারা শাকিবকে চেনে সবাই তাকে বলে বর্ন ফটোগ্রাফার। একটা কুকুরের লেজকেও নাকি শাকিব তার ফটোগ্রাফিতে অন্যরকম করে ফেলে। লায়লার বেশ কয়েকটা অদ্ভুতরকম ছবি শাকিবের তুলে দেওয়া।
লায়লা শাকিবের ফটোগ্রাফি ব্যাপারটা না বুঝলেও একটা জিনিস মনে মনে বিশ্বাস করে- পৃথিবীতে ফটোগ্রাফারদের একটা বুদ্ধির কনটেস্ট হলে শাকিব হতো পৃথিবীর সবথেকে বুদ্ধিমান ফটোগ্রাফার। বোকা সেজে কী করে সবথেকে বেশি বুদ্ধির খেলা খেলা যায়, সেটা এই পৃথিবীতে একমাত্র শাকিবই জানে।
শাকিবের বড় ভাই হাসিব লায়লার স্বামী। তার ভালো নাম হাসিবুল চৌধুরী। সে ইউনিভার্সিটি অফ সিডনিতে একজন রিসার্চ এনালিস্ট হিসেবে কাজ করছে। তার কাজের সময় প্রায় পাঁচ বছর। সামনের মাসেই হাসিবের জন্মদিন। হাসিবের জন্মদিনে কী উপহার পাঠানো যায়, লায়লার সেটা নিয়েই শাকিবের সাথে কথা বলা দরকার। লায়লা দারোয়ান রফিককে ডেকে বলে রাখলো,
-“শাকিব এলেই আমায় খবর দেবেন। যত রাতেই আসুক।”

বাড়ির গেটে এসে শাকিবের মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। বাড়ির ভেতরে যেতে ইচ্ছে করছে না। ড্রয়িংরুমে লাইট জ্বলছে। নিশ্চয়ই মা অপেক্ষা করছেন। এখন গেলেই শাকিবকে জেঁকে ধরবেন। আরও কিছুক্ষণ বাইক নিয়ে উদ্দেশ্যহীন ঘুরাঘুরি করা যাক তাহলে। শাকিবের ঘুরাঘুরির ইচ্ছেটা তেমন মনে জোর পেলো না। দু-বার হর্ণ বাজালো সে। দারোয়ান রফিক গেট খুলে দিয়ে দাঁত বের করে হাসলো। শাকিবের আসার জন্য একদম তক্কে তক্কে ছিল সে।
-“স্যার বাইক কি তালা দিয়া ফেলবো? না রাইতে আবার বাইর হবেন?”
-“বের হবো না। লক করে ফেলো।”
-“স্যার আপনার নামে পার্সেল আসছে একটা।”
-“খুলে দেখেছো কী এসেছে?”
-“জি না স্যার।”
কথাটা বলেই রফিক মাথা নিচু করে ফেললো। সে পার্সেল খুলে দেখে নিয়েছে। পার্সেলে চমৎকার একটা দেয়াল ঘড়ি। এখন ছোট স্যারের চোখের দিকে তাকালেই তার মিথ্যেটা ধরা পড়ে যাবে। তবে এমনভাবে সে আবার প্যাকেটটা করেছে, এটা যে আগে থেকেই খোলা বুঝার কোনো উপায় নেই।
-“খুলে দেখোনি কেন?”
-“কী বলেন স্যার! আমি দেখবো! আমার এই অভ্যাস নাই স্যার।”
-“অভ্যাস লাগবে না। আজ একটু খুলে দেখো।”
রফিক পার্সেলটা নিয়ে এগিয়ে এলো।
-“আপনের সামনে খুলবো স্যার?”
-“এক কাজ করো রফিক, পার্সেলটা তুমি বরং তোমার মেয়ের সামনেই খুলো।”
-“মেয়ের সামনে মানে? আপনার পার্সেল আমার মেয়ে কেন দেখবে? এত বড় ঘড়ি দেখার তার দরকার কী? হাতঘড়ি আছে। সে হাতঘড়ি দেখবে। বড় ঘড়িতে যেই সময় ছোট ঘড়িতেও একই সময়। বড় ঘড়ির টাইম তো আর আলাদা কিছু না।”
শাকিব হাসলো।
-“ঘড়িটা আমি দুলির জন্যই অর্ডার করেছি রফিক। এটা চোখের সামনে টাঙানো থাকলে বেচারির আর স্কুলে যাবার সময়ে দেরি হবে না।
রফিকের আনন্দে চোখে পানি এসে গেল। মেয়েটার বড্ড ঘড়ির শখ। ঘন্টায় ঘন্টায় ঢং ঢং আওয়াজ দেয় এমন ঘড়ি। এই ঘড়িও নিশ্চয়ই আওয়াজ দেয়!

শাকিব বাড়ির ভেতর ঢুকতেই সুলতানার সামনে পড়লো। মা আজ বেশ প্রস্তুতি নিয়ে বসেছেন।
শাকিব পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে অপরাধীর মতো হাসলো।
-“হ্যালো মা। তুমি ভালো আছো?”
পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলো না। সুলতানার কপাল আরও কুঁচকে গেল।
-“ক’টা বাজে? কোথায় ছিলি তুই? হু?”
-“মা তুমি জানো, আমার কাজ আছে। কনটেস্টের ডেডলাইন দিয়ে দিয়েছে। আমার দম ফেলবার সুযোগ নেই। এখনো সব ছবি বাছাই করা হয়নি।”
সুলতানা ধমকে উঠলেন।
-“কী কাজ? পোকামাকড়ের ছবি তোলার কাজ?”
-“মা প্লিজ! ওয়াইল্ড লাইফ ফটগ্রাফি বলো।”
-“লায়লাকে দেখ, তোর সাবজেক্টেই পড়েছে। কত ভালো চাকরি করছে। আগামী মাসে ব্যাংকক যাচ্ছে অফিস ট্যুরে। অফিস সব খরচ দিচ্ছে। তোর আপন ভাবী, তোর মতোই সাবজেক্ট, অথচ দু’দিন পরপর এব্রোড ট্যুরে যাচ্ছে। আর তুই? ক্যামেরা হাতে রাস্তার টং দোকানের চায়ের কাপের ছবি তুলছিস। মানুষের রাস্তায় বসে বিড়ি খাওয়ার ছবি তুলছিস। ইট ভাঙার ছবি তুলছিস!”
-“মা, ওটা স্ট্রিট ফটোগ্রাফি। ঠিক করে নাম বলবে তো!”
-“প্রিয় পুত্র, আমি তোর কাছে ফটোগ্রাফি শিখতে চাচ্ছি না। আগামী মাসের এক তারিখ থেকে তুই অফিসে বসবি, ব্যস। আমি তোর বাবার ব্যবসার কামলাগিরি আর করতে পারবো না।”
শাকিব দীর্ঘ শ্বাস ফেললো। মা সব বুঝে, শুধু তার প্যাশনটাই বুঝে না। এই যে সে বাংলাদেশ থেকে একমাত্র ব্যক্তি হিসেবে এশিয়ান ফটোগ্রাফি কনটেস্টে যাবার সুযোগ পেয়েছে, এটা কি মায়ের কাছে বিশেষ কিছু নয়?
-“মা বাবাকে বিয়ে করেছো তুমি। সুতরাং বাবার সবকিছু দেখবার দায়িত্বও তোমার। ব্যবসা যদি না-ই দেখতে পারবে তাহলে একটা ব্যবসায়ীকে কেন বিয়ে করছিলে? হুঁ?”
-“আমি কি জানতাম নাকি, তোর বাবা সব আমার ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে হুট করে মরে যাবে।”
-“করেছো যখন এখন ভুগো। আই হ্যাভ মাই অওন ড্রিমস টু ফিল। আর ব্যবসায় সবসময় আমাকে ডাকো কেন? ভাইয়াকে ডাকো। ভাইয়া তো সব ফেলে বিদেশে গিয়ে নিজের পছন্দের চাকরিটাই করছে।”
সুলতানা আরো রেগে গেলেন। তবে এবার তার রাগ ঘুরে গেল তার বড় ছেলে হাসিবের দিকে।
-“তোরা দুই ভাইয়ে মিলে আমার কলিজা ভাজি ভাজি করে ফেল্। একজন বিদেশে গিয়ে সাদা সাদা ন্যাংটাদের পড়াচ্ছে। আরেকজন.. রাস্তায় মানুষের পিসু করার ফটো তুলছে।”
-“ভাইয়া ইউনিভার্সিটির টিচার, মা।”
-“ওই হলো! ইউনিভার্সিটি হোক, আর স্কুল হোক.. করছে তো মাস্টারি। অ তে অজগর খেয়ে এখন এ ফর এপেল পড়াতে গেছে। আরেকজন কী করছে? সেই পথেই হাঁটছে। পড়াশোনা শেষ করে এখন গরুর লেজের ছবি তুলছে। কদিন পর সেও বিদেশে গিয়ে পশুপাখির বিষ্ঠার ছবি তুলবে।”
-“মা প্লিজ! এরকম ভাবে বলবে না। আমি ছবিতে একটা ছোট্ট জিনিসের ডিটেইলিং করি। পৃথিবীতে এইরকম ফটোগ্রাফার হাতে গোনা অল্প কয়েকজন আছে। তোমার ছেলে এই অল্পকয়েকজনের মাঝে একদিন…”
শাকিবের কথা শেষ হবার আগেই সুলতানা চলে গেলেন। শাকিব নিশ্চিত মা এখন ভাইয়াকে ফোন করে বকবেন। বকুক। ভাইয়া যদি তার পছন্দমত প্রফেশনে যেতে পারে শাকিব কেন নয়?

শাকিব ঘরে এসে লম্বা একটা শাওয়ার নিলো। আজ সারারাত সে স্টুডিওতে কাজ করবে। কনটেস্টের জন্য ছবির একটা প্রাইমারি সিলেকশান লিস্ট তৈরি করবে। তারপর আরো ডিপলি বাছাই। উফ!
অনেক কাজ তার! শার্ট খুলতে গিয়ে শাকিবের আবার চোখ পড়লো বুক পকেটে থাকা নিশাতের চিঠিতে।চিঠিটা আরেকবার পড়া যাক। হুহ্!

চলবে

#তৃধাআনিকা

#ছত্রিশ_ঝামেলা
#পর্ব_৪

লায়লা দরজায় নক করছে।
শাকিব দরজা না খুলেই বললো,
—ভাবী। প্লিজ বিরক্ত করবে না।
—মিমি তোমাকে গুডনাইট বলতে এসেছে। একমাত্র ভাতিজিকে একটা গুড নাইট কিস দেবে না বুঝি? আমরা তো তোমার জন্যই এত রাত করে ফিরলাম।
বলো মিমি মা, তুমি চাচার জন্য ফিরোনি?

শাকিব উঠে গিয়ে দরজা খুললো।।
দরজায় উঁকি দিয়ে লায়লা মিষ্টি করে হাসলো।তার পরনে হাসিবের পায়জামা পাঞ্জাবি।যখনি সে হাসিবকে মিস করে তখনি সে হাসিবের কাপড় পরে ঘুরে বেড়ায়।
—ভাইয়াকে মিস করছো আবার?
—তোমার ভাইকে আমি সবসময়ই মিস করি। আজ পরিমাণটা একটু বেশি।
—মিমি কোথায়?
— ঘুমিয়ে পড়েছে।
—এরপর থেকে আমি কিন্তু আর সত্যিই তোমাকে আমার স্টুডিওতে এলাউ করবো না।
—ওহ আমার সুদর্শন চিত্রকর দেবর! আমি কি তোমার এই চিত্র নির্মানের কর্মশালায় একটু বসতে পারি?

শাকিব দরজা থেকে সরে দাঁড়ালো।
লায়লা মোড়া টেনে আরাম করে বসলো।
শাকিবের স্টুডিওতে এলেই তাঁর মন ভালো হয়ে যায়। কী সুন্দর সুন্দর সব ছবি টাঙানো! অদ্ভুত একটা মন স্নিগ্ধ করা আবেশ।

—-পাঁচমিনিটের বেশি কিন্তু আমি তোমায় সময় দিতে পারবো না।
—পাঁচ মিনিটই এনাফ। তোমার দেয়া এই পাঁচমিনিট নিয়ে আমি বেঁচে থাকবো অনন্তকাল।
—একদম টিজ করবে না ভাবী।প্লিজ। আই লাভ মাই ওয়ার্ক!
—এমনিতেও সামনে কয়েকদিন তোমায় জ্বালাবো না। আগামী মাসে আমি ব্যাংকক যাচ্ছি।।

লায়লা কয়েকটা ছবি হাতে নিয়ে ভালো করে মনোযোগ দিয়ে দেখতে লাগলো।
—মায়ের ঝারি খেলে আবার? ব্যবসায় বসতে বলছেন?
—হুঁ।
—তুমি মাকে বলোনি, যেটা মন থেকে আসে না সেটা করতে গেলে মনের মৃত্যু হয়। মন হলো আত্মার ধারক।
—তোমার শাশুড়ী এসব ফিলসফিকে দিনে দশবার খুন করে।
লায়লা হাসলো।
—উফ! শাকিব তোমার ছবি তোলা দেখলে তো আমারই ফটোগ্রাফি শিখতে মন চায়। এত সুন্দর!
এটা কিসের ছবি বলতো?
—এটা একটা চিকন সুতার ছবি। এই যে ঝকঝকে ফোঁটাগুলো দেখছো, ওগুলো সুতার উপরে জমে থাকা পানির ফোঁটা!
—সো প্রিটি.. এত ডিটেইলিং ছবিতে।
তোমার কনটেস্টে যাবে বুঝি?
–হুঁ।
—সবগুলোই যাবে? এত ছবি কেন?
—কনটেস্টে আমি দুটো ক্যাটাগরিতে পার্টিসিপেট করছি। স্ট্রিট ফটোগ্রাফিটা মেইন। একবার সিলেক্ট হয়ে গেলে আমার পুরো এক্সিবিশনটা ওরা স্পন্সর করবে।
—আমি তো নিশ্চিত তোমার ছবিগুলোই সেরা হবে।
এটা কি ধরের ছবি। পোটের্ট?
—উঁহু। ল্যান্ডস্কেপ।কতবার বলেছি পোটের্টে ব্যক্তি অবয়বটা মেইন। ভাবী তোমার কি ছবি নিয়ে প্রশ্ন করা শেষ হয়েছে? তাহলে প্লিজ যাও। আমার কাজ করতে ডিসটার্ব হচ্ছে।
—তুমি বলেছিলে পাঁচমিনিট গল্প করবে।
—পাঁচমিনিট হয়ে গেছে কিন্তু।
—উঁহু এভাবে নয়। একদম কাজ ফেলে আমার দিকে তাকিয়ে গল্প করবে তাহলেই…
শাকিব ল্যাপটপ একপাশে সরিয়ে লায়লার মুখোমুখি হয়ে বসলো। জায়ান্ট স্ক্রিনে একটা দোয়েল পাখির ঠোঁটের খড়কুটো দেখা যাচ্ছে। লায়লা একমনে তাকিয়ে দেখতে লাগলো ছবিটা।
—এই পাখি তুমি পেলে কোথায়? ঢাকা,শহরে তো এসব স্বপ্ন!
— আমি সব স্বপ্নই তো খুঁজে বেড়াই ভাবি। এই যে আরেকটা স্বপ্ন তোমারও দেখলাম।।
লায়লা কৌতূহলী চোখে তাকালো।
—আগামী মাসে তুমি ব্যাংকক যাচ্ছো না ভাবী, আসলে তুমি যাচ্ছো সিডনিতে। ভাইয়ার জন্মদিনে ভাইয়াকে সারপ্রাইজ দিতে তাই না?
লায়লা মন খারাপ করা গলায় বললো,
—তোমার সাথে এইজন্যই কথা বলতে ভালো লাগে না শাকিব। সব আগে থেকে জেনে যাও।
—উপহার কি নিয়ে যাচ্ছো?
—সেটাই তো বুঝতে পারছি না। কি নেওয়া যায় বলোতো?
—এক কাজ করো দুটো বিড়াল ছানা আর এক বাটি দুধ সাথে করে নিয়ে যাও।তোমার বর তো খুব বিড়াল ভালোবাসে।জন্মদিনে বিড়াল ছানার সাথে বাটিতে চুকচুক করে দুধ খাবে। পাশে বসে তুমি গাইবে হ্যাপি বার্থডে টু ইউ….
— একদম রসিকতা করবে না শাকিব। ফ্লাইটে আমি বিড়াল নিয়ে যাবো কি করে? বিড়াল নিতে গেলে আবার এপ্লিকেশন করার ঝামেলা আছে!
—তুমি ক্লোরোফর্ম দিয়ে বেঁহুশ করে নিয়ে যাবে। বেঁহুশ বিড়াল স্যূটকেসে থাকবে। কেউ টেরই পাবে না।
লায়লা চিন্তিত কণ্ঠে বললো,
—এখন বিড়াল ছানা পাবো কোথায়? ধুররর! অন্যকিছু বলো…
—কিনে নিয়ে আসো। বিড়ালছানা দুটো ভাইয়ার কোলে দিয়ে বলবে, আগামী জন্মদিন আসার আগে আমারও এমন দুটো ছানা চাই। মিমি ওর খেলার সঙ্গী চায়।
লায়লা লজ্জা পেয়ে অন্যদিকে তাকালো।
—ভাবী তুমি কি সত্যিই বিড়ালছানা নিয়ে যাবার কথা ভাবছো?
লায়লা হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লো।
শাকিব মুগ্ধ কণ্ঠে বললো,
—ভাইয়ার মত একটা বদমেজাজি বিড়ালটাইপ লোককে তোমার মত শার্প একটা মেয়ে যে কি করে এত ভালেবাসে আমার তো মাথাতেই ঢোকে না।
আচ্ছা ভাবী, ইকোনোমিকস তুমি পড়ে পাশ করেছো তো? না দেখে দেখে লিখে?
—তোমার ভাইয়া আমায় বেশি ভালোবাসে। ও প্রতিদিন ফোন রাখবার আগে এত মন খারাপ করে। গতকাল বললো মায়ের হাতের শুটকি তরকারি খেতে ইচ্ছে করছে। মানুষটা ওখানে খাওয়াদাওয়ায় কোনো স্বাদ পায় না বুঝলে?
শাকিব শব্দ করে হেসে উঠলো।
—কি ব্যাপার হাসছো কেন?
–ভাবী তুমি কি জানো, ভাইয়ার কথা বলতে গেলেই তুমি ষোলো বছরের বোকা আর ন্যাকা কিশোরীর মত হয়ে যাও!
—তো?এই বোকা কিশোরীর ভালোবাসা কি খারাপ?
—অবশ্যই খারাপ। আমায় কেউ এমন করে ভালোবাসলে আমি মেরে তার হাড়গোড় ভেঙে ফেলবো।
—ভালোবাসা ব্যাপারটাই কিন্তু বোকা।
শাকিব চেয়ার ঘুরিয়ে আবার ল্যাপটপ খুলে বসলো।
—বরং উল্টো করে বলো, বোকারাই ভালেবাসে।
লায়লা বসা থেকে উঠে এসে শাকিবের কাছাকাছি দাঁড়ালো।
—আর কখনো তুমি যদি কাউকে ভালেবাসো?
শাকিব লায়লায় প্রশ্নটার জবাব দিলো না। সে মনোযোগ দিয়ে জায়ান্ট স্ক্রিনে ছবির স্লাইড পাল্টাতে থাকলো।
লায়লা কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে বললো,
—বিড়াল ছাড়া অন্য কিছু আর কি নেওয়া যায় বলোতো?
—ভাইয়ার ছোট বেলাকার একটা স্পর্শকাতর ছবি আছে। মা’কে বললেই বের করে দেবে। ওই ছবিটা বড় করে বাঁধাই করে নিয়ে যাও।
—স্পর্শকাতর ছবি বলতে?
তোমার ভাইয়ার প্যান্ট না পরা ছবি?
—সেটা হলেও চলতো। ছবিতে ভাইয়া দাঁড়িয়ে হিসু করছে আর ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কাঁদছে।ছোটমামা তুলেছিল ছবিটা।
—ও মাই গড!বলছো কি?
—হুঁ। পিঁপড়া কামড়ে দিয়েছিল ভাইয়াকে। বেচারা ইনজুরড হয়ে হিসু করতে খুব ভয় পাচ্ছিলো।
—তাহলে আমি বরং ওই ছবিটাই খুঁজে দেখি.. কি বলো?

লায়লা দারুণ খুশি হয়ে বেরিয়ে গেলো। লায়লা বেরিয়ে যেতেই শাকিব তাঁর ল্যাপটপের গোপন ফাইলটা খুললো। এখানে তাঁর জীবনের সব বিশেষ ছবিগুলো রাখা আছে।কিছুদিন আগে তাঁর জীবনের অতি বিশেষ একটি ছবি সেই ফাইলে যোগ হয়েছে। ছবিটা তাঁর ছাত্রী নিশাত তাসনিমের। ছবিতে নিশাত দুটো কোকের ক্যান হাতে ভয়ে ভয়ে তাকিয়ে আছে।
শাকিব ছবির স্লাইডটা ফিক্স করে আরাম করে বসলো। আজ আর কাজ করবে না সে। সারারাত এই ছবি দেখে কাটাবে।
লায়লা আবার এসেছে।
—শাকিব!এই শাকিব! দরজাটা খুলোতো।মা তোমার ভাইয়ার ছবিটা খুঁজে পাচ্ছেন না। কি করি বলোতো?
শাকিব ঠান্ডা স্বরে বললো,
— একদম বিরক্ত করবে না ভাবী। আমি ভীষণ জরুরি একটা কাজ করছি।
লায়লা কথা শুনলো না। একাধারে দরজায় নক করতেই থাকলো।
শাকিব স্ক্রিন অফ করে দরজা খুললো।
—কি চাই?
লায়লা হাসিমুখে ছবি বাড়িয়ে দিলো।
—এটা বড় করে এক্ষুনি প্রিন্ট করে দাও।
শাকিব বিরক্ত হাতে ছবিটা নিলো।
—ভাবী তোমার কি মনে হয় না, ইদানিং তুমি খুব বেশিই মিথ্যে বলছো?
—প্রেমিকা নারী আমি। মিথ্যে বলায় কি দোষ বলোতো?
—যাও.. এক ঘন্টা পর এসে ছবি নিয়ে যেও।
—উঁহু। আমি বসে বসে ছবি প্রিন্ট করা দেখবো। এবং তোমার সাথে গল্প করবো।
শাকিব চট করে জায়ান্ট স্ক্রিনের স্লাইডডা বদলে ফেললো।
—আমি তোমার ভাইয়ার হাত প্রথম কবে ধরেছিলাম জানো? ষোলো সালে।তিনই এপ্রিল। বিকেল চারটা পয়তাল্লিশে। হাত ধরা নিয়ে আমাদের কিন্তু একটা মজার ঘটনা আছে। তখনো আমাদের মধ্যে ভালোবাসাবাসি বলা হয়নি বুঝলে? আমরা শুধু এমনি দেখা করি, চটপটি খাই এই আর কি।ধানমন্ডি লেকের ধারে আমরা একবার দেখা করতে গেছি। হাটতে হাটতে হঠাৎ তোমার ভাইয়ার পা ফসকে গেলো। আমি হাত ধরে বেচারাকে সামলালাম। ব্যস… সেই হাত ধরাই আমাদের কাল হলো। ভালোবাসা ছড়িয়ে গেলো মোর প্রাণে…..
লায়লা গুণগুণিয়ে উঠলো।
“তুমি যে সুরের আগুন লাগিয়ে দিলে মোর প্রাণে… সে আগুন ছড়িয়ে গেলো সবখানে… সবখানে….
শাকিব লায়লার দিকে তাকিয়ে হাসলো৷ ক্যামেরা হাতে নিয়ে বেশ কয়েকটা ছবি তুললো৷
—উফ আমার ছবি তুলছো কেন?
—শতাব্দীর সেরা প্রেমিকার ছবি তুলে রাখছি। ইতিহাসের পাতায় একদিন এসবের দরকার হবে।
লায়লা ফিসফিস করে বললো,
—আমি শুধু এই শতাব্দীর নয় শাকিব, তোমার ভাইয়ার জন্য শতশত শতাব্দীর সেরা প্রেমিকা হতে চাই।
শাকিব ক্যামেরায় চোখ রেখেই বললো,
–ভাবী, ভাইয়া যদি কখনো তোমার কাছে কোনো মহা অপরাধ করে তুমি কি ভাইয়াকে ক্ষমা করে দেবে?

লায়লা শঙ্কিত চোখে তাকালো।
—মানে?
—এত ভয় পাওয়ার কিছু নেই ভাবী। তোমার চোখেমুখে ভয়ের এক্সপ্রেশন দরকার ছিলো। সেটা আনতেই প্রশ্নটা করলাম।

লায়লা ছলছল চোখে বললো,
–তোমার ভাইয়ার কোনো মহা অপরাধ আমি ক্ষমা করবো না শাকিব। কখনোই না। ক্ষমা করার প্রশ্নই উঠে না।
শাকিব হাসলো।
—এই প্রেমিকাটিকে আমার ভালো লাগছে ভাবী।এই প্রেমিকা একদম বোকা আর ন্যাকা কিশোরী নয়। দ্যাটস প্রিটি গুড!

চলবে

#তৃধাআনিকা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here