ছত্রিশ_ঝামেলা #পর্ব_৬,০৭

0
449

#ছত্রিশ_ঝামেলা
#পর্ব_৬,০৭

০৬

নিশাত ক্লিনিকে পৌঁছে বেশ অবাক হলো। পিয়াসার মাথা ঠুল্লা বান্দর দেখতে অমায়িক শান্ত-ভদ্র চেহারার।লম্বা গড়নের উজ্জ্বল শ্যামলা মানুষ। নাকটা বেশ ধারালো। তার মাথার দুই তৃতীয়াংশ চুল অমসৃণভাবে কামানো। তবুও তাকে দেখতে ভালো লাগছে। গায়ের ধূসর বর্ণের শার্টটা তাকে অদ্ভুতরকম মানিয়েছে৷ ডান কানের গোড়ায় ব্যান্ডেজ নিয়ে তিনি আহত চেহারায় প্যাসেজে দাঁড়িয়ে আছেন। একটু দূরেই পিয়াসা বসে কাঁদছে।

ভদ্রলোক নিশাতকে দেখেই ছুটে এলেন। অসহায় স্বরে বললেন,
-“আপনার বান্ধবী তো ভয়াবহ কান্ড ঘটিয়ে বসে আছে।”
-“ভয়াবহ কান্ড পরে শুনবো। আগে আপনি রিক্সা ভাড়া মিটিয়ে দিন।”
-“কতটাকা ভাড়া?”
-“ভাড়া ঠিক করে উঠিনি। ভাড়া ঠিক করতে আমার বিরক্ত লাগে। আপনি জিজ্ঞেস করে দিয়ে আসুন।”
ভদ্রলোক ভাড়া মিটিয়ে এসে আহত চেহারায় দাঁড়ালেন।
নিশাত মিথ্যেমিথ্যি ঘাড়টা এদিক ওদিক কাত করে ক্লান্তির ভাব করলো।
-“এবার বলুন বান্ধবী কী করেছে?”
-“আমার কান কেটে গেল বলে, সে তার হাত কেটে ফেলেছে। বলছে স্টিচ নেবে না। বলছে এই হাত দিয়ে আমি তোমাকে কেটেছি এই হাত আমি চাই না।”
-“একজন না চাইলে তাকে জোর করা তো ঠিক নয়।”
-“আমি আপনার কাছে হাত জোড় করছি। বেচারিকে আপনি একটু বুঝান। অনেকক্ষণ ধরে রক্ত ঝরছে।”
-“ঝরতে দিন। অতিরিক্ত রক্ত ঝরে গেলে রক্তের তেজও কমে যাবে।”
ঠুল্লা ভদ্রলোক নিশাতের সামনে হাতজোড় করে মাথা নিচু করে ফেললেন।
নিশাত ছুটে গেল। পিয়াসা কাটা হাত ওড়নায় মুড়িয়ে শান্ত চেহারায় বসে আছে। তার চোখে-মুখে একদম কিছু হয়নি ভাব। রক্ত ওড়না ভিজে টপটপ করে মেঝেতে পড়ছে।
নিশাতকে দেখেই পিয়াসা নির্বিকার গলায় বললো,
-“ঠুল্লাটাকে একটা সেলুনে নিয়ে যা তো নিশু। মাথাটা ঠিকঠাক কামিয়ে দে। ঠুল্লার কাল থেকে অফিস আছে। এই আধছিলা মাথা নিয়ে তো অফিস যেতে পারবে না। মানুষ ক্যাশ তুলতে এসে দেখবে ক্যাশিয়ারের মাথার কেশ হন্তদন্ত!”
নিশাত পিয়াসার হাত চেপে ধরলো।
-“আগে চল তোর হাতটা সিলাই দিয়ে আনি।”
-“আমি হাত সেলাই করবো না।”
-“কেন করবি না?”
-“আমার এই হাত অপরাধী। অপরাধীর শাস্তি পাওয়া উচিত।”
-“তুই হাত সেলাই না করলেই তোর অপরাধ কমে যাবে না পিয়া। তুই যদি ভেবে থাকিস এই করে তুই তোর ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করছিস তাহলে তুই ভুল লজিকে আছিস।”
-“আমি ভুল লজিকে আছি?”
-“অবশ্যই ভুল লজিকে আছিস।”
-“তোর শুদ্ধ লজিক কী বলে? আমার করণীয় কী?”
-“তোর এখন যেটা করতে হবে, নিজে ডাক্তার দেখাতে হবে। তারপর ঠুল্লাটার কাছে আন্তরিকভাবে ক্ষমা চেয়ে ঠুল্লাটাকে সঙ্গে করে নিয়ে বাসায় পৌঁছে দিতে হবে। তার আগে এই আধছিলা মাথা ঢাকবার জন্য সুন্দর কয়েকটা ক্যাপ কিনে দেওয়া উচিত। যাতে ক্যাপ পরে সে অফিস যেতে পারে। তারপর তোর হাত যখন ভালো হবে, তখন তার পুরো মাথাটা তুই যত্ন করে কামিয়ে দিবি।”
-“আমি ওর মাথা কামাবো?”
-“অবশ্যই কামাবি। যে মন্দ কাজের শুরু তোর হাতে হয়েছে, সে কাজের সমাপ্তিও তুই টানবি। ভালো কাজের দায়িত্ব মাঝপথে অন্যকে দেওয়া যায়, মন্দ কাজের দায়িত্ব আরেকজনকে দেওয়া যায় না। চল… ডাক্তারের কাছে চল।”

পিয়াসা কাঁদতে কাঁদতে ডাক্তারের চেম্বারে ঢুকলো। তার হাতের তালু কেটেছে। স্টিচ লাগলো পাঁচটা। নিশাত রসিকতার সুরে বললো,
-“প্রায়শ্চিত্ত তো একদম মাপে মাপে করেছিস। একটু বেশিও কাটিসনি। খাপে খাপ, প্রায়শ্চিত্র আর পাপ।
আমি তো রক্ত দেখে ভেবেছিলাম কয়েকমাইল কেটেছিস!”
পিয়াসা এত ভয়ংকর রাগী চোখে তাকালো যে, নিশাত রসিকতা আর বাড়ালো না।
স্টিচ নিয়ে ক্লিনিক থেকে বেরোবার সময় পিয়াসা মৃদুস্বরে বললো,
-“ক্ষমা কিভাবে চাইবো বুঝতে পারছি না।”
-“ব্যান্ডেজ করা হাত দিয়ে পা ধরে বসে পড়্।”
-“পা ধরবো? এত প্রেম তো হয়নি!”
-“যা ধরার মতো প্রেম হয়েছে তা ধর।”
পিয়াসা ঠুল্লা সাহেবের হাত ধরে কাঁদতে থাকলো।
ভদ্রলোক নিশাতের সামনে অপ্রস্তুত হয়ে পড়লেন।
লজ্জিত গলায় কাচুমাচু হয়ে বললেন,
-“ইশ ইশ! এখানে স্যরি বলার কী আছে? ভুল তো ভুলই। আমি হাঁচি না দিলে তো এই অঘটন ঘটতো না।”
নিশাত ভদ্রলোককে আরো অপ্রস্তুত করে দিলো।
-“শুনুন ঠুল্লাভাই, এর পর যখন আপনি পিয়াসার কাছে মাথা কামাতে বসবেন, হাঁচি দেবার আগে তার কাছে অনুমতি চাইবেন। বিনা অনুমতিতে হাঁচি দেওয়া ঠিক না। এবার কেটেছেন এক কান। তখন কাটবেন আরেকটা। লোকে কী বলবে? দু-কান কাটা!”

পিয়াসা নিশাতকে চোখ রাঙালো। নিশাত চোখ রাঙানোর তোয়াক্কা করলো না। সে হাই তুললো।
পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে ঠুল্লা সাহেব নিশাতদের রেস্টুরেন্টে খেতে যেতে বললেন।
নিশাত মানা করলো।
-“আমার কাজ আছে। আমি আপনাদের সাথে যেতে পারবো না। এখানে এসে এমনিতেই আমার অনেক সময় নষ্ট হয়েছে। ভাড়া দে পিয়া চলে যাই।”
পিয়াসা হতাশ চোখে তাকালো।
-“তুই না গেলে আমি খাবো কী করে? হাতে তো ব্যান্ডেজ।”
-“রেস্টুরেন্টে গেলেই খেতে হবে না কি? না খেয়ে বসে থাকবি৷ তারপরও বেশি খেতে ইচ্ছে করলে, উনাকে বলবি খাইয়ে দেবে। কি আপনি খাওয়াতে পারবেন না?”
ঠুল্লা ভদ্রলোক আরো কাচুমাচু হয়ে পড়লেন। কাচুমাচু ভঙ্গি লুকোতে এদিক ওদিক পিটপিট করে তাকাতে লাগলেন। পিয়াসার মুখ দেখে মনে হলো সে এই মুহূর্তে নিশাতের মাথা ফাটিয়ে দিতে পারলে বেঁচে যেত। নিজের রাগকে চাপা দিতে না পেরে পিয়াসা মুখ ফসকে বললো,
-“জাহিদ আমাকে খাওয়াবে কেন? আমি চামচ দিয়ে খাবো। রেস্টুরেন্টে একগাদা লোকের সামনে আমি ওর হাতে কেন খাবো? আমার কি কোনো সেন্স নেই?”
-“কেন জাহিদের হাতে তোর খেতে সমস্যা কী? নাকি জাহিদ সাহেবের মানচিত্রেও স্থলভাগ বেশি। কি জাহিদ সাহেব, আপনার জলভাগের খবর কী?”
জাহিদ প্রশ্নাতুর চোখে তাকালো। বেচারার দৃষ্টি ঝুলে গেছে। তিনি বিভ্রান্তের মতো তাকিয়ে আছেন।
-“ইয়ে মানে কিসের মানচিত্র?”
-“আশ্চর্য! আপনি পিয়াসার কাছে মাথা কামাতে বসে গেলেন, অথচ ওর মানচিত্র থিওরিই জানেন না?”
-“মানচিত্র থিওরিটা কী?”
-“মানচিত্র থিওরি হলো এমন একটা থিওরি যাতে আপনার মনের সব চিপাচাপা অলিগলির জল এবং স্থল পরীক্ষা করা হবে। জল বেশি হলে আপনি পাশ! স্থল হলে ফেইল। একবার যদি মানচিত্র থিওরিতে আপনি ফেইল করেন, তাহলে মাথা কামিয়েও লাভ হবে না। পিয়াসা যে কোনো সময় আপনাকে ক্রস কেটে চলে যাবে। আপনি তাড়াতাড়ি আপনার মানচিত্র ঠিক করুন।”
জাহিদ সাহেব হতভম্ব হয়ে পিয়াসার দিকে তাকিয়ে আছেন। তার দৃষ্টি বলছে তিনি ভীষণ ঘাবড়ে গেছেন।
নিশাত ব্যাগ থেকে বিরিয়ানির প্যাকেট বের করে জাহিদ সাহেবের দিকে বাড়িয়ে ধরলো।
-“আপনি এক কাজ করুন এই বিরিয়ানির প্যাকেট দুটো নিয়ে পিয়াসাকে সাথে করে কোনো চিপায় ঢুকে যান। তাকে মুখে তুলে খাওয়াতে খাওয়াতে মানচিত্র থিওরিটা বুঝে নিন।”
পিয়াসা বিরিয়ানির প্যাকেট নিতে ইশারায় মানা করলো। ঠুল্লা সাহেব ইশারার মানা শুনলেন না।বিরিয়ানির প্যাকেট দুটো আগ্রহ করে নিলেন।
এগিয়ে এসে নিশাতকে রিকশা ঠিক করে দিলেন।
নিশাত দুজনকে ক্লিনিকের গেটে দাঁড় করিয়ে রেখেই চলে এলো। হাতকাটা, কানকাটা দুটো এবার যেদিকে খুশি যাক। তাদের মানচিত্রের জলে ভাসুক।
মা বারবার ফোন করছেন। এত ফোন করার পেছনে কী কাহিনি কে জানে? এই মোবাইল ফোনের তো ভীষণ যন্ত্রণা! যখন তখন যেখানে সেখানে ডাক পড়ছে।মোবাইল ফোন কি তবে নিশাতের ইচ্ছেমতো চলাফেরার স্বাধীনতাকে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নিচ্ছে?
নিশাত ফোনকল ব্যাক করলো।
-“হ্যালো মা, এতবার ফোন করছো কেন? ফোন বাজতে শুনলেই আমার কেমন মাথা দপদপ করে।”
-“মাথা দপদপের অভ্যাস কর। এখন থেকে প্র তিমুহূর্তে মাথা দপদপ নিয়ে তোকে বাঁচতে হবে। শোন্, তুই তাড়াতাড়ি চলে আয়। আমরা আজই বাসা চেঞ্জ করবো।”
-“আজই?”
-“এডভান্স করে এসেছি। বিকালেই মালপত্র নিয়ে গোয়িং। তুই এলেই গোছগাছ শুরু হবে। হালিম ভাই বাসার চাবি নিয়ে অপেক্ষা করছেন।”
-“মা নতুন বাসায় কটা ঘর?”
-“তিনটা। তোর আর সোহেলের আলাদা আলাদা ঘর। আমি আর তোর দাদী একঘরে। বুড়ো মানুষ! একা তো ছেড়ে দিতে পারি না। সারাক্ষণ কাশছেন। কখন কেশে টেশে বুকে বান লাগিয়ে কী ঘটান! তুই তাড়াতাড়ি আয় তো! ইশ্ এখনো তো সোহেলটাও এলো না।”
রাবেয়া ব্যস্ত ভঙ্গিতে ফোন কেটে দিলেন।
আনন্দে নিশাতের চোখে পানি এসে গেল। নতুন বাসাতে উঠলেই সে গশাকে চা খেতে ডাকবে।
বলবে, আপনার যেদিন খুশি সেদিন বিকেলে চলে আসবেন। এক বয়াম চা-পাতা চিনি দুধ সব সে আলাদা করে লুকিয়ে রেখে দেবে। মায়ের বিশ্বাস নেই। সবসময় চা-পাতা চিনি শেষ করে বয়াম খালি করে রেখে দেন। দেখা গেল গশা চা খেতে এসেছেন অথচ চা-পাতা নেই। এক টিন নোনটা টোস্টও এনে রাখতে হবে। টোস্ট ছাড়া চা খেলে চা তাড়াতাড়ি ফুরিয়ে যায়।গশা আস্তে ধীরে চায়ে বিস্কিট ভিজিয়ে খাবেন নিশাত বসে বসে মুগ্ধ হয়ে দেখবে।
নিশাত কল্পনায় দেখতে লাগলো, এক ঝিরিঝির বৃষ্টির সন্ধ্যায় শাকিব কালো শার্ট পরে নিশাতদের বাসায় এসেছে। বৃষ্টিতে তার শার্ট ভিজে গেছে। একটু একটু শীত করছে উনার। নিশাত নিজের গা মোছার গামছাটা বাড়িয়ে দিয়ে বলবে,
-“নিন মাথা মুছুন। বৃষ্টির পানি মাথায় বসে গেলে জ্বর আসে।”
শাকিব তোয়ালেতে মাথা মুছতে মুছতে বলবে,
-“এক ফ্লাস্ক আগুন গরম চা দাও তো নিশাত। সাথে একটা মগ নিয়ে আসবে। আমি এখন এক ফ্লাস্ক চা খাবো।”
নিশাত তখন বিরক্ত হবার ভান করবে।
-“এ কী শাকিব ভাই? যখন তখন চা খেতে চলে আসেন? আমাদের বাড়ি তো চায়ের স্টল না? আমার এখন চা বানাতে ইচ্ছে করছে না। আমি এখন বসে বসে বৃষ্টি দেখবো।”
শাকিব তখন রাগ আর ধমক মেশানো দৃষ্টিতে তাকাবে। কিন্তু তার কণ্ঠে থাকবে স্বাভাবিকতা। শীতল স্বরে বলবে,
-“চা বানাতে ইচ্ছে না করলেও বানাতে হবে। তোমার হাতের চা না খেয়ে আমি উঠছি না নিশাত। এর জন্য যদি আমায় অনন্তকাল অপেক্ষা করতে হয় করবো।”
নিশাত তখন আরো বিরক্ত হবার ভান করবে৷ আঁচল ঝারতে ঝারতে বলবে,
-“আপনি তো ভালো যন্ত্রণা করেন শাকিব ভাই। সবসময় তো আমি এত চায়ের মেকিং নিয়ে বসে থাকবো না। চলেন আমার সাথে রান্নাঘরে চলেন।
আপনাকে চা বানানো শিখিয়ে দিই। এরপর থেকে চা খেতে ইচ্ছে করলে নিজে বানিয়ে খাবেন!”
নিশাত শাকিবকে নিয়ে রান্নাঘরে যাবে ঠিকই। কিন্তু চা বানানো শেখাবে না। ভুল রেসিপি বলবে। এক কাপ চায়ে এক চামচ হলুদ দিন, আর দু-চামচ মরিচ।
শাকিব তখন খুব রেগে যাবেন।
-“চায়ে হলুদ মরিচ দেবো কেন? চা কি তরকারি?”
নিশাত তখন এর চেয়েও বেশি রেগে বলবে,
-“চা বানাবেন তরকারী
আপনি আমার দরকারি।
চায়ের ভেতর হলুদ-মরিচ
আপনি আমি কাপ-পিরিচ।”
নিশাতের এই ভুলভাল কবিতায় শাকিব স্যারের তখন হাসি পাবে। কিন্তু তিনি তার গাম্ভীর্যের জন্য হাসবেন না। মুখে আরো কাঠিন্য চলে আসবে।
কাঠিন্য লুকাতে তিনি মনোযোগ দিয়ে চায়ে চুমুক দেবেন। ইশ্ মানুষটার চা খাওয়া এত সুন্দর কেন?

রিকশাওয়ালা পেছন ফিরে তাকিয়েছে। তার চোখে উৎকন্ঠা! সে রিকশা থামিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে।
-“আম্মাগো আপনে কানতাছেন কেন? কোনো দুইশ্যংবাদ?”
নিশাত চোখ মুছতে মুছতে বললো,
-“কোনো দুঃসংবাদ নেই। সুসংবাদ চাচা। সুসংবাদ পেয়ে কাঁদছি। আপনি রিকশাটা একটু সাইড করুন।এই সুসংবাদ উদযাপন উপলক্ষে আপনাকে এখন বিরিয়ানি খেতে হবে।”
নিশাত ব্যাগ থেকে বিরিয়ানির প্যাকেট বের করলো।
-“নিন। ঝটপট খেয়ে ফেলুন।”
রিকশাওয়ালা বিরিয়ানির প্যাকেট হাতে নিয়ে দোটানায় পড়ে গেলেন।
-“এখনি খামু?”
-“হু, এখনি। প্যাকেটের ভেতরে চামচ দেয়া আছে। হাত ধুতে হবে না। আপনি চামচ দিয়ে খান। আমি অপেক্ষা করি।”
রিকশাওয়ালা বিরিয়ানির প্যাকেট নিয়ে রাস্তার এক পাশে বসলেন। নিশাত রিকশা থেকে নেমে পাড়লো।
-“আপনি সিটে বসে খান। আমি বরং এই সুযোগে আপনার জন্য এক বোতল পানি কিনে নিয়ে আসি।
আপনি ভাববেন না আমি ভাড়া না দিয়ে চলে যাবো। এই যে আপনার রিক্সায় আমার ব্যাগ রেখে যাচ্ছি।”
নিশাত রিক্সার হ্যান্ডেলে ব্যাগ ঝুলিয়ে রেখে টাকা নিয়ে চলে গেল।
রিকশাওয়ালা জমির বিরিয়ানির প্যাকেট খুলে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছেন। তার দীর্ঘ দরিদ্রময় দুঃখভর্তি জীবনে এই প্রথম তিনি এমন অপ্রত্যাশিত আনন্দময় ঘটনার সম্মুখীন হয়েছেন। সেই আনন্দ সামলাতে তার সময় লাগছে। তিনি বারবার বিরিয়ানি মুখে তুলতে যাচ্ছেন হাত কেঁপে উঠে তা এলোমেলো ভাবে পড়ে যাচ্ছে।
নিশাত পানি নিয়ে এসে জমিরের পাশে বসলো।
-“চাচা, আপনি তো ঠিক করে খেতে পারছেন না। বাচ্চাদের মতো ফেলে দিচ্ছেন। এভাবে চামচ ধরলে তো হবে না। ঠিক করে ধরুন। দিন আমার হাতে দিন, আমি দেখিয়ে দিচ্ছি।”

জমির ঠিক করে খাবার চেষ্টা করতে লাগলো। চামচ দিয়ে খাওয়া তো বড় যন্ত্রণার! তার চোখে বারবার পানি চলে আসছে। নিশাত ফিসফিস করে বললো, বাবা তুমি কি দেখতে পাচ্ছো, আমরা ভালো থাকতে শুরু করেছি।

চলবে

#তৃধাআনিকা

#ছত্রিশ_ঝামেলা
#পর্ব_৭

লায়লা পরপর দু-গ্লাস পানি খেলো। একটু পানি হাতে নিয়ে মাথার তালুতে দিলো। তার ভীষণ শরীর খারাপ লাগছে। একটু আগেই লায়লা একটা বিশেষ ফোনকল পেয়েছে। ফোনকলটি এসেছে সিডনি থেকে। ফোনকলটি আসবার পর থেকেই লায়লার হাত-পা থরথর করে কাঁপছে। দুশ্চিন্তা এবং সুচিন্তায় এই দুইয়ে মিলে। ফোন করেছে মার্লিনা মেট্রিন নামের এক রিনরিনে কণ্ঠস্বরের নারী। লায়লা তখন যাস্ট একটা মিটিং শেষ করে নিজের কেবিনে এসে বসেছে। প্রচন্ড ক্লান্তিতে যখনি সে কফিতে চুমুক দিয়েছে, ঠিক তখনি ফোনকলটা আসে। লায়লা ফোন ধরতেই মার্লিনা নামের মেয়েটি স্পষ্ট বাংলায় বলেছে,
-“হ্যালো। আপনি কি লায়লা?”
-“ইয়েস।”
-“আমি সিডনি থেকে মার্লিনা মেট্রিন বলছি। আপনার সাথে আমারা জরুরি কিছু কথা আছে। কথাগুলো আমি আপনার সাথে সরাসরি বলতে চাই।”
-“সরাসরি বলতে?”
-“নেক্সট মান্থে আমি বাংলাদেশে আসবো। আপনার সাথে আমার কথা বলা বিশেষভাবে জরুরি।”
লায়লা নিজের উদ্বেগ চাপা দিয়ে বলল,
-“আপনি কি দয়া করে আমায় একটু হিন্ট দেবেন, ঠিক কোন ধরনের জরুরি কথা আপনি আমার সাথে বলতে চান?”
-“কথাটা হাসিব বিষয়ক এবং স্পর্শকাতর।”
এতটুকু শোনবার পরপরই লায়লায় গলা শুকিয়ে গিয়েছে। মার্লিনা কী বলতে চায়?
-“হাসিব কি ভালো আছে?”
-“আমি খুবই দুঃখিত ম্যাম। এর থেকে বেশি হিন্ট আমি এই মুহূর্তে আপনাকে দিতে পারবো না।”
লায়লার বুকটা তখন ধক করে উঠেছে। হাসিব লায়লার স্বামী। তার ভালো নাম হাসিবুল চৌধুরী। সে ইউনিভার্সিটি অফ সিডনিতে একজন রিসার্চ এনালিস্ট হিসেবে কাজ করছে। তার কাজের সময় প্রায় পাঁচবছর। পাঁচবছরে এই প্রথম কেউ হাসিবের কথা বলবে বলে ফোন করেছে। লায়লার মনটা কু গেয়ে উঠলো।
-“খুব বেশি কিছু নয়, আপনি শুধু বলুন হাসিব কোনো বিপদে পড়েছে কি না?”
-“আমি খুবই দুঃখিত ম্যাডাম। আমি কোনো হিন্টই দিতে পারবো না।”
লায়লা কাতর স্বরে জিজ্ঞেস করলো,
-“হাসিবকে আপনি কী করে চিনেন?”
-“আমি একটা রেস্টুরেন্টে কাজ করি। হাসিব সেই রেস্টুরেন্টের একজন নিয়মিত ক্লায়েন্ট। সেই আসা যাওয়ার সূত্র ধরেই পরিচয়।”
-“কেমন পরিচয়?”
-“ভালো পরিচয়। হাসিব আমার খুব ভালো বন্ধু। আগামী সপ্তাহেই আমি আপনার সাথে দেখা করতে আসবো। ভালো থাকবেন।”

লায়লা ফোন রেখেই হাসিবকে ফোন করেছে। হাসিব বেশ স্বাভাবিকভাবেই ফোন রিসিভ করে কথা বলেছে। আগামী তিন তারিখে মায়ের জন্মদিন উপলক্ষে বিশেষ কী উপহার দিতে পারে, সেই নিয়ে কথা বলেছে। মিমির পড়ে যাওয়া নতুন দাঁতটা কতটুকু উঠেছে, লায়লা এখনো কেন দাঁতের ছবি তুলে পাঠাচ্ছে না, সেটা নিয়েও ঘ্যানঘ্যান করলো। লায়লা এক ফাঁকে জিজ্ঞেস করলো,
-“ওখানে কি তোমার মার্লিনা নামের কারো সাথে পরিচয় আছে?”
হাসিব অনেকক্ষণ চিন্তা করে জানিয়েছে, তার পরিচিত কোনো মার্লিনা নামের বান্ধবী নেই।
তাহলে মার্লিনা নামক মেয়েটি কী বলতে চায়? এমন কী কথা যেটা বাংলাদেশে এসেই লায়লাকে বলতে হবে?
হাত-পায়ের কাঁপাকাঁপির সাথে লায়লার মাথার ভেতরটাও এখন দপদপ করছে। এই ব্যাপারটা নিয়ে একজনের সাথে কথা বলা দরকার। কাকে বলা যায়?
লায়লা দ্রুত চিন্তা করতে লাগলো। আলাপ করার মতো লায়লার কাছে তিনটি অপশন আছে। প্রথমে, তার শাশুড়ি সুলতানা চৌধুরী। তিনি স্বভাবে প্রচন্ড ভীতু মানুষ। পারিবারিক যে কোনো ব্যাপারে অল্পতেই বিচলিত হয়ে পড়েন। লায়লার শ্বশুর জনাব আসহাব চৌধুরী মারা যাবার পর থেকে তার রেখে যাওয়া জুয়েলারি বিজনেসটা তিনি একা হাতে সামলাচ্ছেন। ব্যবসায়িক ব্যাপারে তিনি অত্যন্ত সাহসী, স্থির এবং ঠান্ডা মাথা। কিন্তু সন্তানের ব্যাপারে অসহায়, স্নেহকাতুরে, ঝরঝর করে ভেঙ্গে পড়া মা। দ্বিতীয়জন, লায়লার বড় ননদ সুরভি। সুরভীর বিয়ে হয়ে গেছে। সে বর্তমানে কানাডাতে থাকে। সে তার দুই ভাইয়ের প্রতি স্নেহে অন্ধ। ভাইদের যে কোনো ব্যাপার তার কাছে বলা মানে উল্টো তোপের মুখে পড়া। এছাড়াও তার আরেকটা বিশেষ স্বভাব হলো সিম্পল কন্টেন্টকে এগজেজারেট করে করে ফেলা। সুরভীকে বলা মাত্র সুরভী কথাটা অতি রঞ্জিত করে আত্মীয়স্বজনকে জানিয়ে দেবে। তৃতীয় এবং লাস্ট অপশন হলো, শাকিব।
লায়লার ভাবনায় ছেদ পড়লো। দরজায় নক হচ্ছে। নক করছে শাকিব।
-“আসবো ভাবী?”
লায়লা হাসলো।
-“শাকিব… এসো! তোমায় কতবার বলেছি, এমন করে আসবো জিজ্ঞেস করবে না। বলবে, এসে পড়েছি ভাবী।”
-“ভাবী চট করে লাঞ্চের অর্ডার দাও তো। ক্ষিধায় চোখে ঝাপসা দেখছি। নাড়িভুড়িগুলোর অর্ধেক হজম শেষ। বাকি অর্ধেক হজমের পথে।”
টেবিলের উপর ব্যাগ রেখে শাকিব অতি দ্রুত বাথরুমে ঢুকে পড়লো। লায়লা মনে মনে একটু আশ্বস্ত অনুভব করতে লাগলো। যাক, ব্যাপারটা এখন শাকিবকে বলা যাবে। শাকিব বেরিয়ে এলো হাত-মুখ চুপচুপা ভিজিয়ে।
শার্টের হাতায় কপাল গাল মুছতে মুছতে বললো,
-“কী ব্যাপার ভাবী? খাবার কই?”
-“বলা আছে। আব্বাস নিয়ে আসছে। আজকেও পাতলা খিচুড়ি। খেতে পারবে তো?”
-“শুধু পাতলা খিচুড়ি না, এখন তুমি আমাকে পাতলা ইয়ে দিলেও আমি ফুউউৎ করে টান দিয়ে গিলে ফেলবো। সকালে বেরিয়েছি। ইউনিভার্সিটিতে গিয়ে শুনি ওরা আমাকে পি এইচ ডি’র জন্য স্কলারশিপ দিয়েছে। পি এইচ ডি দিয়ে আমি করবোটা কী? এই ঝামেলা শেষ করতে করতে জীবন শেষ।”
-“পি এইচ ডি করবে না?”
-“উঁহু। তখন জোশ ছিল, তাই এপ্লিকেশন করেছিলাম, এখন মনে হচ্ছে ব্রেনটাকে আর পড়াশোনার প্রেশার দেওয়ার কোনো মানেই হয় না। ঠিক করেছি কিছুদিনের মাঝে আমি ইউনিভার্সিটিও ছেড়ে দেবো।”
-“বলছো কী? ইউনিভার্সিটি ছেড়ে দেবে?”
-“ইয়েস। ব্রুকস ইনস্টিটিউট আমায় ডাক দিয়েছে। ওখানে স্কুল অফ ফটোগ্রাফিতে আমি পড়তে যাচ্ছি।সবকিছু ফাইনাল হয়ে গেছে। এখন শুধু, বাধো পেটা, আর ধরো হাটা।”
-“মা জানে?”
-“জানে না। ওখানে গিয়ে তবে জানাবো।”
-“জানবার পর মা হার্টঅ্যাটাক করলে?”
-“ভাবী, হার্টঅ্যাটাক করলে হার্টের চিকিৎসাও আছে। আমি তবু যাবো। এবারে কেউ মোরে বাঁধিতে পারবে না।”

ধোঁয়া উঠা গরম খিচুড়ি চলে এসেছে। সাথে ডিমভাজি। খিঁচুড়ি নিয়ে এসেছে লায়লার ব্যক্তিগত সাহায্যকারী আব্বাস। ব্যক্তিগত সাহায্যকারীরা সাধারণত অফিশিয়াল কাজে সহায়তা করে। আব্বাস করে না। সে শুধু লায়লার খাবার দাবারের ব্যাপারটা দেখে। কফি বানায়, নাশতা বানায় এবং যত্ন করে নিজের হাতে এই খিচুড়ি রান্না করে। খেতে অত্যন্ত অমৃত। শাকিবের ধারণা আব্বাস জন্মেছেই এই পাতলা খিচুড়ি রান্নার জন্য।
আব্বাস বেটে এবং শুকনা শরীরের মুখভর্তি লম্বা দাঁড়িওয়ালা মধ্যবয়সী হাসিখুশি লোক। এক ঝোঁপ দাঁড়ির ফাঁকে এইটুকু মুখটা একটু করে দেখা যায়। আব্বাস মিয়া কঠিন নামাজি। নামাজ পড়তে পড়তে কপালের তিন জায়গায় দাগ পড়ে গেছে। নামাজ ছাড়া আব্বাসের জীবনে দ্বিতীয় প্রধান বিষয় তার একমাত্র মেয়ে। কিছুদিন আগেই মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। মেয়ের জামাই দুবাইয়ে থাকে।
শাকিবকে দেখলেই কৃতজ্ঞতায় আব্বাসের চোখ ভিজে আসে। আব্বাসের মেয়ের বিয়েতে শাকিব একটা অদ্ভুত কান্ড করেছিল। সেই কান্ডের কথা মনে হলেই আব্বাস মনে মনে বড় খতমের দোয়া পড়ে শাকিবের জন্য দোয়া করে।
শাকিব খিচুড়ি প্লেটে নিতে নিতে বললো,
-“আব্বাস ভাই, কী খবর বলুনতো আপনার?”
-“আর খবর! মেয়েটার সন্তান হবে। বড়ই দুশ্চিন্তায় আছি।”
-“দুশ্চিন্তায় আমরা সবাই-ই আছি। আপনি মেয়ের জন্য, আমি ফটোগ্রাফি পড়তে যাবার জন্য, লায়লা ভাবী ভাইয়ার জন্য। এবার বলো ভাবী, ভাইয়ার জন্য দুশ্চিন্তা কেমন চলছে তোমার?”
লায়লা ভীষণ চমকে উঠলো। শাড়ির আঁচলটা ঠিকঠাক করার অযুহাতে নিজের উদ্বেগ চাপা দেওয়ার চেষ্টা করলো। তাতে কাজ হলো না। কনুইয়ে লেগে টেবিল থেকে কয়েকটা ফাইল পড়ে গেল। শাকিব সেটা দেখলো না অবশ্য!
-“আব্বাস ভাই চট করে আমার ব্যাগটা খুলুন তো। ওখানে একটা নীল প্যাকেট আছে। এখানে খুলবেন না। নিয়ে চলে যান। প্যাকেট বিষয়ে আপনার সাথে পরে কথা বলবো।”
আব্বাস ব্যাগ খুলে প্যাকেট নিয়ে বেরিয়ে গেল।
-“ভাবী তোমার ঘরের সিসি ক্যামেরাটা একটু অফ করো তো। আমি এখন একটা বিশেষ পদ্ধতিতে খিচুড়ি খাবো৷ নল পদ্ধতি। এই যে এই পাইপটা প্লেটে রেখে জোরে দিয়ে টান দেবো। গড়গড় করে খিঁচুড়ি গলায়।”
লায়লা বিস্মিত হয়ে তাকালো। শাকিবের হাতে আট ন’ইঞ্চি লম্বা প্লাস্টিকের পাইপ।
-“এটা পেলে কোথায়?”
-“কিনেছি। ইলেকট্রিক যন্ত্রপাতির দোকান থেকে৷ তোমার অফিসে এলেই এই ঝোল ঝোল খিঁচুড়ি খেতে হয় তাই। গতবার এই খিচুড়ি পড়ে আমার হোয়াইট পিজিওন শার্টটা নষ্ট হলো। আমি দরিদ্র মানুষ৷ কাপড়চোপড় তো বারবার কিনতে পারবো না।”
শাকিব সত্যিসত্যিই নল দিয়ে গরগর শব্দ করে খিচুড়ি খেতে লাগলো। লায়লা বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে আছে।
-“ভাবী তুমিও ট্রাই করবে না কি? আই হ্যাভ এনাদার পাইপ ইন মাই ব্যাগ।”
লায়লা শাকিবের ব্যাগ থেকে পাইপ বের করে নিলো। অনিশ্চিত ভাবে খিচুড়িতে ছোঁয়ালো। আশ্চর্য! পাইপ দিয়ে খিচুড়ি খেতে তার ভালো লাগছে।
-“দেখেছো ভাবী, হাতে লাগার চান্সই নেই। আমি ঠিক করেছি। এখন থেকে ডালভাতও এরকম করে খাবো।”
-“সবই ঠিক আছে। আওয়াজটা কেমন যেন হুক্কা টানবার মতো শোনাচ্ছে।”
-“শোনাক। আওয়াজে ফোকাস করা বাদ দাও। ফোকাস ইন খাওয়া। এখন বলো তুমি কী নিয়ে এত চিন্তিত?”
-“আমি চিন্তিত নই। আমার কিসের চিন্তা?”
-“ভাইয়ার জন্য চিন্তা ছেড়ে দিয়েছো? ভাবী আমার ধারণা তোমার চিন্তা করার লিমিট শেষ হয়ে গেছে। তাই এখন আর চিন্তা করতে পারছো না। নাহলে ভাইয়ার এইসময়েও তোমার কোনো দুশ্চিন্তা নেই।”
লায়লার হাত থেকে পাইপ পড়ে গেল। শাকিব কী তাহলে মার্লিনা বিষয়ক কোনো খবর পেয়ে গেছে অলরেডি? লায়লা বলতেই যাচ্ছিলো, শাকিব আগে কথা বলে ফেললো।
-“ভাইয়ার জন্মদিনে বিড়াল উপহাট দেবে, বিড়ালই তো এখনো যোগাড় হয়নি। অথচ তুমি বলছো, তোমার চিন্তা কিসের?”
-“ওহহো….!”
-“ওহহো মানে? শুধু একটা ছবি দিলেই হবে, বিড়াল দেবে না?”
-“আমি ঠিক করেছি শাকিব বাংলাদেশ থেকে বিড়াল নিয়ে যাবো না। ওখানে গিয়ে বিড়াল কিনে ফেলবো।”
-“ও দেশে গিয়ে বিড়াল কিনবে মানে? ওরা তোমাকে ভুলভাল ব্রিড দিয়ে দিলে? আমাদের দেশের বিড়াল খাঁটি বিড়াল ভাবী৷”
-“তুমি যে কীসব বলো না শাকিব। বিড়ালের আবার খাঁটি ভেজাল কী? বিড়াল তো বিড়ালই। চুপ করে খাও তো। বিড়াল বিড়াল করে আমার খাওয়াটাই শেষ করে দিচ্ছো তুমি।”
লায়লা নিচু হয়ে পাইপটা তুললো। বেসিনে গিয়ে ধুয়ে নিয়ে এলো।
শাকিব আরো দু-বার প্লেটে খিচুড়ি নিলো। খাওয়ার পর আয়েশী স্বরে বললো,
-“কাঁচা সুপারি দিয়ে পান খেতে ইচ্ছে করছে ভাবী। তোমার আব্বাসকে ডাকো।”
লায়লা আব্বাসকে ডেকে পানের ব্যবস্থা করলো।
শাকিব পান মুখে দিয়ে চেয়ারে মাথা হেলিয়ে দিলো। চোখ বন্ধ করে রইলো বেশ অনেকক্ষণ।
-“এখন বলো তো ভাবী, তুমি কী নিয়ে এত ভেবে মরছো?”
লায়লা পুরোপুরি হকচকিয়ে গেল। সে ভেবেছিল শাকিব ঘুমিয়ে পড়েছে। অথচ কথা বলছে স্পষ্ট আর ঝরঝরে গলায়।
-“আমি কিছুই ভাবছি না। তোমার কথা বলো, অফিসে এলে যে হঠাৎ করে?”
-“তোমার জন্যই তো এলাম। হুট করে মনে হলো, তোমার আমাকে দরকার। তাই চলে এলাম।”
লায়লা নিজের সামনে ল্যাপটপ খুলে মনোযোগী হলো। কোনোকিছু নিশ্চিত না জেনে শাকিবকে এক্ষুনি কিছু বলা যাবে না। নিজের একমাত্র বড়ভাই সম্পর্কিত সন্দেহজনক অপ্রিয় কথা কারোরই শুনতে ভালো লাগে না। শাকিব ব্যাগ খুলে ক্যামেরা বের করলো। বেশ কয়েকটা ছবি তুললো লায়লার। ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে বললো,
-“খাওয়া, বিশ্রাম সবশেষ আমার। এখন আল্লাহ হাফেজ।”
-“চলে যাচ্ছো না কি?”
-“হুঁ।”
লায়লা ল্যাপটপ বন্ধ করে উঠে দাঁড়ালো। শাড়ির আঁচলটা পেছনে হাত মুড়িয়ে গলায় বুলালো। শাড়ির রঙের মতোই পুরো মুখটাতে অপূর্ব কোমল আভা। ঠোঁটের নিচের কালো তিলটা যেন এক রাজ্য সৌন্দর্য নিয়ে ভাসছে।
-“তোমাকে গোলাপি জাদুর মতো দেখতে লাগছে ভাবী। এই জাদুময়ী মুখটাতে চিন্তার ছাপটা মানাচ্ছে না ভাবী।এখনো সময় আছে, কী নিয়ে চিন্তিত, বলে ফেলো। আগামী দু’দিন আমায় পাবে না।”
লায়লা ক্লান্ত স্বরে বললো,
-“আমি কোনো বিষয় নিয়ে চিন্তিত নই, শাকিব। চলো তোমাকে এগিয়ে দিই।”
লিফটে ঢুকেই শাকিব বললো,
-“তোমার উপহার দেওয়া শার্ট পরে তোমায় দেখাতে এলাম অথচ খেয়ালই করলে না। তোমায় হিন্ট দিতে খিচুড়ির অযুহাতে শার্টের কথাও টানলাম, তাও তুমি বুঝলে না। আমি খুব কষ্ট পেয়েছি ভাবী।”
লায়লা ভ্রু কুঁচকে তাকালো।
-“ওহ! এটা আমার দেওয়া না কি? ওপস! আসলে এত কাজের চাপে ছিলাম। বাই দ্য ওয়ে তোমাকে সুন্দর লাগছে।”
বাইকে উঠে শাকিব হ্যালমেট পরবার আগে তাকালো।
-“ভাবী আগামী কয়েকদিন আমায় বাড়িতে পাবে না। এক বন্ধুর বিয়েতে যাচ্ছি। ঢাকার বাইরে। ফোনেও পাবে না। মা’কে ম্যানেজ করো প্লিজ।”
-“ঢাকার বাইরে? এই সময়ে? কেন? ফোনেও পাবো না?”
-“তোমার কোনো দরকার আছে? সেরকম ইমার্জেন্সি কিছু হলে বলো। আমি প্রোগ্রাম ক্যানসেল করবো।”
লায়লা একমুহূর্ত ভাবলো। শাকিব নিশ্চয়ই ফটোগ্রাফির কোনো প্রজেক্টে কাজ করতে ঢাকার বাইরে যাচ্ছে। এই মুহূর্তে তাকে দুশ্চিন্তায় ফেলার মানে হয় না।
-“না না একদম না।”
-“ভালো করে ভেবে দেখো ভাবী।”
-“উঁহু।”
লায়লা বিষন্ন তাকিয়ে হাত নাড়লো। তার দৃষ্টিতে ভয় এবং দুশ্চিন্তা। সে কি শাকিবকে বলবে মার্লিনা মেট্রিন নামে তোমার ভাইয়ের একটি পরিচিত মেয়ে আমায় ফোন করেছে। বলেছে, হাসিব বিষয়ক স্পর্শকাতর কথা বলবে। লায়লার ভাবনার মাঝেই শাকিব বাইক নিয়ে হুশ করে বেরিয়ে গেল।
লায়লা আর অফিসে ফেরত গেল না। নিচে দাঁড়িয়েই আব্বাসকে ব্যাগ নিয়ে আসতে বললো। আজ আর অফিস করবে না সে। বাড়ি গিয়ে বরং মিমির দাঁতের ছবি তুলে হাসিবকে পাঠানো যাক। মেয়ের দাঁত দেখবার জন্য বেচারা কত আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছে। আহারে!

লায়লা গাড়িতে উঠে বসতেই শাকিবের মেসেজ এলো লায়লার ফোনে,
“ভাবী তোমাকে আজ দুটো মিথ্যে কথা বলেছি। এক. আমার গায়ের শার্টটা তোমার দেওয়া নয়। তুমি ঠিক কতটা এবসেন্ট মাইন্ডেড সেটা জানতে বললাম। দুই. এই মিথ্যেটা তোমায় জানাতে ইচ্ছে করছে না।”

লায়লা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। হাসিবকে নিয়ে এত ভয় কেন করছে তার? কেন?

চলবে

#তৃধাআনিকা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here