#ছদ্মবেশ,পর্ব ৭১,৭২
#মেহেদী_হাসান_রিয়াদ
৭১
সারা রাত ঘুম হয়নি নিলয়ের। পুরোনো স্মৃতি গুলো মনের ভেতর নাড়া দিচ্ছে বারংবার। বুঝে উঠার পর থেকে ভালো কাজ খুব কমই করেছে সে। বলতে গেলে জীবনের ৮০ ভাগই সে ব্যায় করেছে খারাপ কাজে।
তাকে নিয়ে তার বাবার হাজারো স্বপ্ন ছিলো। সেটাও সে পুরণ করতে পারেনি। বাবার উপর তীব্র অভিমানে বাড়ি ছেড়েছিলো সে। সেদিনও বুঝতে পারেনি তার বাবা তার ভালোই চেয়েছিলো। কারণ বাবারা কখনো সন্তানের খারাপ চাইতে পারে না।
সেই অভিমানে বাড়ি ছাড়ার সময় কে বা জানতো যে শেষ বারের জন্য আর কখনো বাবার সাথে কথা হবে না। মাকে হারিয়ে বাবার কাছে বড় হয়েছিলো সে।
আর সেই বাবার সাথে অভিমান করে বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার সময় দেখেছিলো শুধু বাবার ছলছলে চোখ। আবার সেই বাড়িতেই ফিরে আসার পর দেখলো বাবার বিধ্বস্ত নিথর দেহ। মনটা সেদিনই পাথর হয়ে গিয়েছিলো তার।
এর পর কত মানুষকে মে’রেছে। একটুও মায়া কাজ করেনি কখনো। সেই মানুষ গুলোর কাঁন্না, আর্তনাৎ, পরিবারের কাছে ফিরে যাওয়ার ছটফট, সব যেন এখন চোখের সামনে ভেষে উঠছে বারংবার।
সবাইকে ছেড়ে নতুন জায়গায় নতুন করে জীবন শুরু করা। এতোদিন যাদের সাথে ছিলো তাদের মাঝে এমন কি আছে যে, তাদের ছেরে যেতেই ইচ্ছে করছে না।
বেলকনিতে দাড়িয়ে বুক ভরা দির্ঘশ্বাস নিয়ে খোলা আকাশের পানে চেয়ে রইলো অনেক্ষন ধরে। কোথা থেকে আজ এসব বিশ্রি অনুভূতি গুলো এসে হানা দিয়েছে তাকে? দেখতে দেখতে রাতও প্রায় শেষ হয়ে আসছে।
এই প্রিয় বাড়িটায়, এই প্রিয় মানুষ গুলোর সাথে আজই শেষ রাত। হয়তো জীবনে আর এমন একসাথে কাটানো সময় গুলো কখনো আসবে না।
হয়তো মানুষ গুলোর কাছে আবার ফিরে এলেও সময়টা তখন এমন থাকবে না। সংসার জীবন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যাবে সবাই। খারাপ লাগছে, তবুও তাদের ছেড়ে যেতে হবে। বন্ধু মহলের সময়টা খুবই রঙিন হয়। তবে এই রঙিন জীবন হারিয়ে যায় এক সময় ব্যস্ততার মাঝে।
রাত প্রায় শেষ হয়ে এলো। রুমে এসে লেপটপ টা হাতে নিয়ে বসলো খুব গম্ভির ভাবে। সব কিছু আগেই রেডি করে রেখেছে সে। এখন শুধু এগুলো মেইল করার পালা।
কিছুক্ষন নিশ্চুপ সময় কাটিয়ে নির্জনের অতিত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের কিছু প্ল্যানিং এর সব তথ্য রাজকে মেইল করে দিয়ে লেপটপ অফ করে শুয়ে পরে এক পাশে।
ঘুম যেন এখনো আসতে চাইছে না। তবুও নিজের উপর জোড় করে চোখ দুটি বন্ধ করে রাখে সে।
,
,
নিলয়ের ব্যাপারে জানা সব কিছু শুধু বন্ধুদের মাঝেই সীমাবদ্ধ থাকলো। ফরিদা আন্টি বা আশে পাশের তেমন কেউ ওর ব্যাপারে সত্যটা জানেনা।
সেদিন নিলয়ের হাতে গু’লি লাগার বিষয়টা একটা এক্সি’ডেন্ট হিসেবে চালিয়ে দিলো তাদের কাছে।
সকালে নাস্তা করতে বসলো সবাই এক সাথে। ফরিদা আন্টি নিলয়ের প্লেটে নাস্তা দিতে দিতে বলে,
– যা শুনেছি তা কি সত্যি? তুমি নাকি চলে যাচ্ছো?
নিলয় স্বাভাবিক ভাবে বলে,
– হ্যা আন্টি। কিছু সময়ের জন্য চলে যেতে হচ্ছে।
ফরিদা আন্টি আবার বলে,
– হটাৎ করে এমন সিদ্ধান্ত কেন?
নিলয় আবারও কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে বলে,
– একটু প্রয়োজন ছিলো আন্টি। পরে যখন ফিরে আসবো তখন বলবো।
নিলয় যেহেতু বলতে চাচ্ছে না তাই ফরিদা আন্টি এই বিষয়ে আর প্রশ্ন না করে বলে,
– তো কখন বের হবে?
নিলয় কিছুটা আবেগ প্রবন হতে গিয়েও নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে বলে,
– সন্ধায়।
দুপুরে নিলয়ের প্রিয় খাবার গুলো রান্না করলো ফরিদা আন্টি। এতোদিন এক সাথে থেকে কার কি প্রিয় সেটা ভালোই বুঝে নিয়েছে সে। সম্পর্কটা এমন ছিলো যে, অপরিচিত কেও আসলে এমনিতেই বলবে যে, মা তার পাঁছ ছেলেকে নিয়ে এক সাথে আছে।
দেখতে দেখতে আজকের দিনটাও পার হয়ে গেলো। পিন্টু গাড়ি নিয়ে বাসার সামনে এসে ফোন দেয় নিলয়কে।
সবার থেকে বিদায় নেওয়ার মুহুর্তে নিলয় ফোনটা বের করে দেখে পিন্টুর ফোন। বুঝতেই পারছে যে, পিন্টু এসে গেছে হয়তো। নীলাও উপস্থিত সেখানে।
নিলয় মুখে কিছুটা হাসির রেখা টেনে ফরিদা আন্টির দিকে চেয়ে বলে,
– দোয়া করবেন আন্টি। মায়ের মতোই পাশে ছিলেন অনেকদিন। ছোট বেলায় মাকে হারিয়ে মায়ের অভাবটা থেকে গিয়েছিলো বুকে। এখানে আসার পর মনে হচ্ছিলো সেই অভাবটা একটু একটু করে দুর হয়ে যাচ্ছে। মনে হয়েছিলো, মাকে পাইনি কি হয়েছে? মায়ের মত একজনকে তো পেয়েছি।
ফরিদা আন্টিও যেন এমন পরিস্থিতিতে কিছু বলার মত অবস্থায় নেই। শুধু ছলছল নয়নে নিলয়ের মুখে দু’হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে,
– ভালো থেকো সব সময়। আর পৌছেই ফোন দিবে কিন্তু।
নিলয় কিছুটা মৃদু হেসে বলে,
– জ্বি অবশ্যই দিবো। দুরে চলে যাচ্ছি দেখে কি হারিয়ে যাচ্ছি? আপনারাই তো আমার আপন জন। আর আপন জনদের থেকে হারিয়ে যাওয়া যায় কি? মনের টান তো একটু হলেও থাকবে।
ফরিদা আন্টি কিছু একটা পড়ে নিলয়ের কপালে ফু দিয়ে বলে,
– ফি আমানিল্লাহ্।
তারপর তুষারের কাছে গিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে,
– দেখিস আবার, নতুন করে কোনো সুমাইয়া ইসলামের পাল্লায় পরিস না। মাথা থেকে মেয়ের চিন্তা দুর করে পড়াশুনায় মন দিবি। ক্যারিয়ার ভালো না হলে রাস্তার পা’গলিরাও তোকে পাত্তা দিবে না।
বলেই হেসে উঠে নিলয়। সেই সাথে তুষারও। বৃষ্টির দিনে এক চিলতে রোদের মত এই হাসি।
নিবিড়ের পাশে নীলাও দাড়িয়ে ছিলো। নিলয় একটু মুচকি হেসে বলে,
– অনেক ঝামেলা পার করেই তো এক সাথে হলি দুজন। এবার যত তারাতারি সম্ভব বিয়েটা করে নিবি। আরেকটা বিষয়ের জন্য কনগ্রেচুলেশন। আঙ্কেল আন্টিকে আমার সালাম দিস।
প্রথমে সবটা স্বাভাবিক হলেও শেষের কথাটায় অবাক হলো নিবিড়। আঙ্কেল আন্টি কার কথা বলছে? নিলয় এসব জানলো কিভাবে?
রাজের সামনে গিয়ে তার কাধে হাত রেখে নিলয় বলে,
– সবাইকে দেখে রাখবে। আর তোমার মেইল চেক করে নিও। A To Z সব পেয়ে যাবে সেখানে। খারাপ কাজ তো অনেকই করলাম এবার একটু তার প্রাশ্চিত্য দিয়ে নিই।
একে একে সবার থেকে বিদায় নিলো নিলয়। শুধু রুশানের দিকে চেয়ে কিছু বলতে পারলো না সে। ওর সাথে তো অনেকই চো’র পু’লিশ খেললো। চাইলে অনেক আগেই শেষ করে দিয়ে সবটা স্বাভাবিক রাখতে পারতো। তবে বন্ধুত্ব প্রতিশোধ নয়, এনে দিয়েছে আলোর পথে।
রুশানের দিকে কিছুক্ষন নিশ্চুপ হয়ে তাকিয়ে থেকে শান্ত ভাবে বলে,
– ভালো থাকিস।
যতই অভিমান থাকুক। বিদায়ের মুহুর্তে সকলেরই মনটা খারাপ হয়ে যায়। তেমন এখানে সবারও। আচমকাই বন্ধুরা নিলয়কে জড়িয়ে ধরে কিছুক্ষণ ওভাবেই রইলো।
নিলয় মুখে হাসির রেখা টেনে বলে,
– বিদায়ের সময় এতো ইমোশন দেখিয়ে তো তোরা আমার কষ্টটা আরো বাড়িয়ে দিবি।
সব শেষে সবার থেকে বিদায় নিয়ে গাড়িতে গিয়ে উঠে নিলয়। পিন্টুর দিকে চেয়ে বলে,
– সব ঠিকঠাক আছে তো?
পিন্টু নিলয়ের দিকে চেয়ে বলে,
– হ্যা ভাই। গতকাল থেকেই সব ঠিকঠাক করে রেখেছি। আজ রাত পার হয়ে ভোরেই রওনা দিতে হবে আমাদের।
নিলয় জানালা দিয়ে সবার দিকে তাকিয়ে হাত না্ড়িয়ে বিদায় জানালো তাদের। এরপর গ্লাস উঠিয়ে গাড়ি টান দিয়েই এতোক্ষন আটকে রাখা চোখের পানি আচমকাই গড়িয়ে পরলো গাল বেয়ে। আজ তার চোখে পানি আসলো? এটা নিজেরই যেন বিশ্বাস হতে চাইছে না। পাথর থেকেও কি কখনো পানি বের হয়?
,
,
রাতে একটা বাড়িতে উঠে নিলয় ও পিন্টু। সেখাকার একটা মসজিদে ঢুকে এশার নামাজ আদায় করে নিলয়। একে একে সবাই চলে গেলেও নিলয় বসে রইলো এক পাশে।
হুজুরকে বলে অনুমতি নেয় আজ রাতটা মসজিতেই কাটাবে বলে।
হুজুর ঘুমু ঘুমু চোখে সকালে ফজরের আজান দিতে উঠলে দেখে সেই ছেলেটা এখনো সেই মসজিদের এক কোনে বসে নিশ্চুপ হয়ে কাঁন্না করছে।
বিষয়টা কিছুটা আন্দাজ করতে পেরে হুজুর ছেলেটার কাছে গিয়ে তার কাঁদে হাত রাখলেই কাঁন্না বন্ধ করে নিশ্চুপ হয়ে যায় সে।
তার পাশে বসে হুজুর বিষয়টা জিজ্ঞেস করলে নিলয় খুব করুণ ভাবে বলে,
– হুজুর আপনার তো অনেক ধর্মিয় জ্ঞান আছে। সেই তুলনায় আমরা কিছুই জানিনা। আমি জীবনে অনেক খারাপ কাজ করেছি। যেই কাজ গুলোর কোনো ক্ষমা হয় না। তবুও জীবনের এই অব্দি এসে মনে হচ্ছে আমার করা সব কাজই ভুল ছিলো। আমার এসব করা কখনোই উচিৎ হয়নি। আমি সব ছেরে ভালো পথে আসতে চাই। পূর্বের এসব কাজের জন্য আল্লাহ্ আমাকে কি ক্ষমা করবে হুজুর?
ছেলেটার চোখে-মুখে অনু সূচনার ছাপ দেখে হুজুর প্রশ্ন করে,
– আপনার নাম কি?
সে বলে,
– জ্বি আমার নাম নিলয়।
হুজুর আবার বলে,
– শয়’তানের ধোকায় পরে আমরা মানুষরা অনেকই ভুল করে থাকি। অনেক বড় বড় গুনাহ করেও যখন আমরা নিজের ভুল বুঝতে পেরে সৃষ্টি কর্তার কাছে ক্ষমা পার্থনা করি। তখন সে খালি হাতে ফিরিয়ে দেন না। সে সব সময় চায় বান্দা কখন নিজের ভুল বুঝতে পেরে অন্ধকার ছেড়ে আলোর পথে ফিরে আসবে। আমি জানিনা আপনার ভেতরের খবর, একমাত্র তিনিই জানেন সব। ক্ষমা করার মত হলে অবশ্যই আপনাকে তিনি ক্ষমা করে দিবেন।
নিলয় আর কিছু না বলে নিশ্চুপ হয়ে রইলো। হুজুর একটু মুচকি হেসে বলে,
– আজানের সময় হয়ে গেছে। আজান দিতে পারেন?
নিলয় কিছুটা নার্ভাস ফিল করলেও বলে,
– হ্যা পারি। তবে কখনো দিই নি।
হুজুর একটু মুচকি হেসে বলে,
– আপনার শরিরে ক্লান্তি মিশে আছে। অজু করে আসুন। আজ আপনিই আজান দিবেন।
নিলয় চুপচাপ তাই করলো। এতো খারাপ একজন মানুষকেও যে কেউ এতোটা আপন করে নিবে তা হয়তো ধারণাতেই ছিলোনা তার।
,
,
ওদিকে ভোরে ভোরেই সব রেডি করে নিলো পিন্টু। নিজেদের প্রয়োজনিয় সব কিছু একটা বোর্ডে তুলে নিলো তারা। নিজেদের পার্সনাল বোর্ড দেখে যা ইচ্ছা তা নিয়েই সমুদ্র পথে রওনা দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে তারা।
বোর্ডে উঠার আগেই নির্জনের ফোন আসে। কিছুটা বিরক্তিকর ভাবে ফোন রিসিভ করে। নির্জন পায়ের উপর পা তুলে বসে ফোন কানে নিয়ে হাসি মুখে বলে,
– তুমি কি যা করতে চাইছো, ও যা বললে তা কি করছো বুঝতে পারছো তো নিলয়? ভালো করেই জানো এই পথে যে একবার পা রাখে তার বের হওয়ার কোনো রাস্তা থাকে না। একটাই রাস্তা থাকে আর তা হলো ‘মৃ’ত্যু’। তুমি এই রাস্তা থেকে সরতে চাইলেও বিষয়টা এমনই দাড়াবে। তুমি তো ম’রবেই, সাথে তোমার বন্ধুদেরও কুকুরের মতো মা’রবো।
নিলয় কাধে একটা ব্যাগ নিয়ে বলে,
– আমি বেচে থাকতে আমার বন্ধুদের গায়ে একটা ফুলের টোকাও পড়তে দিবো না। আপনি চেষ্টা করতেই থাকুন।
ওপাশ থেকে হেসে উঠে নির্জন। হাসতে হাসতে বলে,
– তোমার কাছে কি এটা ছেলে খেলা মনে হচ্ছে? দেখো আমার এসব করতে বেশি সময় লাগবে না। অজথা নিজের সাথে জেদ করো না।
নিলয়ও সোজাসুজি ভাবে বলে,
– যদি আমার বন্ধুদের কোনো ক্ষতি হয়, তাহলে সব ইনফরমেশন আইনের হাতে চলে যাবে। সেই ক্ষেত্রে ধরা আমি না, ধরা আপনি। সব মুখোশ উন্মোচন হয়ে যাবে দেশ বাসির সামনে। সো যা করার ভেবে চিন্তেই করবেন।
নির্জন কিছু বলার আগেই ফোন কেটে দিলো নিলয়। পিন্টুকে সাথে নিয়ে চুপচাপ বোর্ডে গিয়ে উঠলো সে।
সাদা রঙের বোর্ডটার ভেতরটা সব সোনালি রং দিয়ে সাজানো। একটা মানুষের প্রয়োজনিয় সব কিছুই আছে সেখানে। বলতে গেলে ভেতরটা ছোটখাটো একটা VIP রুম। আজ দুই দিন ঘুমাতে না পারায় সকালে কিছুক্ষন বিশ্রাম নিচ্ছে নিলয়।
শোয়া থেকে উঠে দেখে আট টা বেজে গেছে। সূর্যের তেমন একটা তাপ নেই। হালকা মেঘলা আকাশে ঠান্ডা পরিবেশ। বোর্ডের ভেতর থেকে বেড়িয়ে বাইরে এসে দাড়ায় নিলয়। দেখে চার পাশে শুধুই পানি। পিন্টু ভেতর থেকে দুই কাপ কপি এনে এক কাপ নিলয়ের হাতে দিলো।
দুজন হাসি মুখু কপিক কাপে চুমুক দিলো।
পাশ থেকে পিন্টু বলে,
– আপাতত এই সমুদ্রতেই দারুন লাগছে ভাই। ইচ্ছে করছে এখানেই থেকে যাই। ওয়েদারটাও দারুণ।
নিলয় কফির কাপে চুমুক দিয়ে বলে,
– আজ মনটা ভিষয় ভালো আমারও। কেমন জানি নিজেকে খুব হালকা মনে হচ্ছে। অতিতে যাই করেছি, এবার থেকে আমরা দুই ভাই নতুন জায়গায় নতুন করেই জীবন শুরু করবো।
পিন্টুও বলে,
– আমার মাঝে মাঝে মনে হয় আপনি আমার আপন ভাই। মনে হওয়ার কি আছে? আপনি তো আমার আপন ভাইই,,,,,। নতুন জীবনটা শুরু হবে দুই ভাইয়ের হাত ধরে।
নিলয় একটু মৃদু হেসে পুনরায় দুজন কফির কাপে চুমুক দিলো। আচমকাই ফোনটা বেজে উঠলো নিলয়ের।
(ছোট একটা কথা, সমুদ্রে নেটওয়ার্ক থাকে কিনা আমার জানা নেই। তবুও ফোনটা গল্পের সুবিধার্তে।)
হাতে নিয়ে দেখে রুশানের নাম্বার থেকে ফোন। রিসিভ করে হাই-হ্যালোর পর্ব শেষ হলে ওপাশ থেকে রুশান বলে,
– পৌঁছেছিস?
নিলয় বিষণ্ন মনে বলে,
– না, আরো কিছুক্ষন লাগবে। এখনো সমুদ্রে আছি, চার পাশে সুধুই পানি।
রুশান আবার বলে,
– সকালে কিছু খেয়েছিস?
নিলয় বলে,
– হুম,,,
তারপর কিছুক্ষন নিশ্চুপ থেকে করুণ গলায় বলে,
– শুন, স্যরি রে। জানি রাগ করে আছিস আমার উপর। তবুও স্যরি চাইছি। ক্ষমা করে দিস আমায়।
রুশান কিছুক্ষন চুপ থেকে বলে,
– রাগ করে থাকলে কি ফোন দিতাম?
নিলয় আচমকাই খুব করুন ভাবে বলে উঠে,
– বন্ধু,,,,,,,,,,
রুশান কিছুক্ষনের জন্য থেমে গেলো যেন। নিলয়ের এই করুন গলায় বন্ধু শব্দটা যেন কেমন একটা অনুভূতি তৈরি করে নিয়েছে তার ভেতর।
নিলয় কিছু বলার আগেই খেলায় করে তাদের বোর্ডের থেকে অনেকটা দুরে কয়েকটা স্প্রিড বোর্ডও এগিয়ে আসছে।
ফোন কানে থাকা অবস্থায় নিলয় হাতের ইশারায় পিন্টুকে বলে ভেতর থেকে ‘স্নাইপার’ টা নিয়ে আসতে। তারপর আবার স্প্রিড বোর্ড গুলোর দিকে তাকালো।
নিলয়কে এমন চুপ থাকতে দেখে ওপাশ থেকে রুশান বলে,
– আর কিছু বলবি?
নিলয় চুপচাপ পিন্টুকে ডাক দিয়ে পেছন ফিরলেই দেখে পিন্টু ভিলেন হাসির সাথে তার দিকে একটা পি’স্তল তাক করে দাড়িয়ে আছে।
নিলয় কিছু বুঝে উঠার আগেই পিন্টুর করা দু’টো গু’লি এসে আ’ঘাত করে নিলয়ের বুকে। ওপাশ থেকে এতোক্ষন হ্যালো হ্যালো করা রুশান উত্তেজনা বসত আচমকাই জোড়ে বলে উঠে,
– নিলয়,,,,,
পিন্টু হাসতে হাসতে আরো কয়েকটা গু’লি চালালো পর-পর। হাত থেকে ফোনটা পরে গেলো নিলয়ের। নিশ্চুপ হয়ে পিন্টুর দিকে তাকিয়ে আছে নিলয়। এটা কি সেই পিন্টু, যাকে সে নিজের ভাই মনে করেছিলো? দুনিয়াটা কি এতোটাই সার্থপর?
বুক চুইয়ে র’ক্ত পরতে শুরু করলো নিলয়ের। নিচে পরে থাকা ফোনে রুশান বার বার হ্যালো হ্যালো করতে থাকে। এতোই জোড়ে বলছে যে, নিলয়ের কান অব্দি এসে পৌছাচ্ছে শব্দ গুলো। একবার ফোনটার দিকে চেয়ে আবার পিন্টুর দিয়ে তাকালো। একটা কথাই বলতে ইচ্ছে হচ্ছে,
– এটাই কি তোর আর আমার মধ্যকার ভাইয়ের সম্পর্ক?
বাট বলতে পারলো না, তার আগেই পিন্টু এতে নিলয়ের বুকে লাথি দিয়ে সমুদ্র ফেলে দেয় তাকে। এক পা উপরে তুলে তার মাঝে ভর দিয়ে নিলয়ের দিকে চেয়ে আবারও ভিলেন হাসে পিন্টু। স্প্রিড বোর্ড গুলো এবার বড় বোর্ড টার কাছে এসে গেলো। কয়েকজন বোর্ডে উঠে গিয়ে পিন্টুর পেছনে দাড়ায়।
নির্জনের ফোনে পিন্টু কল দিয়ে বলে,
– ভাই, আপনার কথা মত কাজ হয়ে গেছে।
এদিকে ফোনে বারংবার চিৎকার করছে রুশান। আর অন্য দিকে সমুদ্রের পানিতে ধীরে ধীরে তলিয়ে যাচ্ছে নিলয়। মৃত্যুর আগ মুহুর্তে নিবিড়, তুষার, রাজ, রুশান সবার চেহারা গুলো ভেষে উঠছে চোখের সামনে। আর কখনো দেখা হবে না সেই প্রিয় মানুষ গুলোর সাথে।
মানুষ বদলায়, বিশ্বাসঘাতকতায়, মিথ্যায়, জমে থাকা অভিমানে জীবন অনেক কিছুই কেড়ে নিতে পারে। কাউকে সারা জীবন নিজের প্রয়োজনে ব্যাবহার করে, প্রয়োজন শেষে একটি শক্তিশালি তলোয়ারের আঘাত করে ছুড়ে ফেলে দিতেও পারে। মানুষ বদলে যায়, ভালোবাসা থাকে অপরিবর্তিত। হাজার বছর পরেও ভালোবাসা থেকে যায় একই রকম। শব্দটা বদলাবে না। বদলে যাবে মানুষ। বিশ্বাসঘাতকতায় হেরে যাবে ভালোবাসা। তবুও কিছু মানুষকে সব সময় ভালোবাসা যায়। জীবন থেকে বন্ধুত্ব হারিয়ে গেলেও তাদের প্রতি ভালোবাসাটা হারিয়ে যায় না।
সমুদ্রের জলে ধীরে ধীরে তলিয়ে যাচ্ছে নিলয়। নিশ্বাস গুলো বুদবুদ তৈরি করে উপরের দিকে উঠে যাচ্ছে। হয়তো জীবন প্রদিপ নিভতে শুরু করলো একটু একটু করে। জীবনের শেষ সময়টা বন্ধুদের সাথে হলেও তাদের কখনো বলা হয়নি, ভালোবাসি তোদের। খুব বেশিই ভালোবাসি।
To be continue…………
#ছদ্মবেশ (পর্ব ৭২)
#মেহেদী_হাসান_রিয়াদ
নিলয় পানির নিচে ডুবে যাওয়া অব্দি তাকিয়ে ছিলো পিন্টু। মুখে হাসির রেখা এখনো ফুটে আছে। নিলয়কে আর দেখতে না পেয়ে সোজা হয়ে দাড়ালো।
নিলয়ের হাত থেকে পরে যাওয়া ফোনটা পায়ে থাকা শক্ত জু’তার আঘাতে ভেঙে গেলো অনেকটা।
ওপাশ থেকে ফোন কানে ধরে রাখা রুশানের বুঝতে বাকি রইলো না, নিলয়ের সাথে কিছু একটা নিশ্চই হয়েছে।
এতোক্ষন রুশানকে এমন জোড়ে জোড়ে শব্দ শুনে সেখানে একসাথেই এগিয়ে আসে নিবিড় ও তুষার। রাজ বাসায় নেই। গতকাল রাতে নিলয়ের বিদায়ের পর ভাইয়ের ফোন পেয়ে তার বাসায় গিয়েছে সে।
রুশানকে এমন অস্থির দেখে তুষার ও নিবিড় দুজনই একসাথে প্রশ্ন করলে রুশান কিছুক্ষন নিশ্চুপ থেকে বলে,
– নিলয়ের মনে হয় কোনো প্রব্লেম হয়েছে। নিশ্চই খারাপ কিছু হয়েছে ওর সাথে।
পাশ থেকে নিবিড় বলে,
– তুই এতোটা নিশ্চয়তা দিয়ে কিভাবে বলছিস?
রুশান আর কিছু না বলে চুপচাপ বেরিয়ে গেলো সেখান থেকে। নিবিড় ও তুষার দুজনই কিছুটা অবাক হয়ে দাড়িয়ে রইলো। কিছু একটা নিশ্চই হয়েছে ভেবে তারাও ছুটলো রুশানের পেছন পেছন।
,
,
শেষ বিকেলে সমুদ্র পাড়ে একটা লা’শ ভেষে আসে। সেখানকার কয়েকজন স্থানিয় জনগন সমুদ্র পাড়ে ঢেউয়ের সাথে আসা লাশ দেখলে ধীরে ধীরে ভিড় বাড়তে শুরু হয় সেখানে।
স্থানিয় বি’জি’বি সেই খবরটা পেলে ঘটনাস্থলে এসে লা’শটা উদ্ধার করে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করে।
সেখানকার রিপোটারদের থেকে নিউজ ছড়িয়ে পরে চার দিকে। রুশান খবর পেয়ে বাকিদের নিয়ে রওনা দেয় ঘটনাস্থলের দিকে।
তারা চার জন কয়েক ঘন্টার মাঝে পৌছে যায় নিলয়ের লা’শের কাছে। এতোদিন একসাথে থাকা সেই নিলয় আজ লা’শ হয়ে পড়ে আছে তাদের সামনে। রাজ, রুশান, নিবিড়, তুষার সবাই পলকহিন ভাবে আহত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে।
এই সার্থপর দুনিয়ায় কোনো কিছু মানুষের যতই প্রিয় হোক, ব্যাবহার শেষে ঠিকই ছুড়ে ফেলে দিতে দ্বিধা বোধ করে না।
চোখের পানি যেন টলমল করছে সবার। কাছের বন্ধুর লা’শ এভাবে সামনে পরে থাকলে কয়জনই বা তা স্বাভাবিক ভাবে নিতে পারে।
নিলয়কে লাশবাহি গাড়ি করে ঢাকায় নিয়ে আসে রুশান ও বাকিরা। রাজ ও রুশান গম্ভির মুখে বসে থাকলেও নিবিড় ও তুষারের হাত পা যেন রিতিমত অবশ হয়ে আছে। কাছের মানুষ গুলোর মৃত্যুর খবর হুট করে এসে আঘাত করার পর যেমব অনুভূতি তৈরি হয় ঠিন তেমনই।
রাত হয়ে গেছে অনেক। নিলয়কে ম’র্গে রেখে তাদের চারজনকে বের করে দিলো। রাতে এভাবে লা’শের পাশে থাকাটাও অনেকের জন্য বিপজ্জনক।
তবুও রুশান ওসবের সাথে কানেক্টেড থাকায় সে ওখানে থেকে বাকি তিনজনকে পাঠিয়ে দিলো বাসার দিকে।
পরদিন পোস-মার্টাম শেষ হলে দাফন করার জন্য বাড়ি নিয়ে যেতে পারবে নিলয়কে।
এক রাশ গম্ভিরতা ঘিরে ধরে আছে সবাইকে। বিষণ্ন মনে বাসায় ঢুকে দেখে ফরিদা আন্টি কাঁন্না করছে সোফায় বসে। তার পাশে নীলা বসে আছে। হয়তো অনেকক্ষণ আগে থেকেই ফরিদা আন্টির পাশে ছিলো সে।
ফরিদা আন্টির কাঁন্নার কারণ দেখে কিছুটা অবাক হলো রাজ। তখন তো বাসায় কাউকে এসব নিয়ে কিছু বলার জন্য নিষেধ করেছিলো রাজ। বাসায় আসার পর না হয় ধীরে সুস্থে বুঝিয়ে বলবে সকলকে। তাহলে এদের কে বললো?
এই মুহুর্তে কিছু বুঝিয়ে বলার পরিস্থিতিতেও নেই তারা। কেমন একটা ছন্নছাড়া ভাব বিরাজ করছে সবার মাঝে।
লা’শের পাশে বসে আছে রুশান। তার সামনে পরে আছে নিলয়ের নিথর দেহ। নিলয়ের জীবনের শেষ কথাটা রুশানের সাথেই হয়েছিলো।
বেচে থাকা কালিন একজন আরেক জনকে যতই আঘাত করুন, এই মুহুর্তে ওসব স্মৃতি যেন কষ্টের নিচেই চাপা করে গেছে তার।
তার প্রফেশন অপ্রিয় থাকলেও মানুষটা ঠিকই প্রিয় ছিলো। যদি মানুষের ক্ষমতা থাকতো প্রিয় মানুষগুলোকে মৃ’ত্যুর পরেও ফিরিয়ে আনার। তাহলে কেওই তার প্রিয় মানুষ গুলোকে এভাবে চোখের পলকে হারিয়ে যেতে দিতো না।
আসার পর ফ্রেশ হয়ে নিজেদের মতো চুপচাপ বসে আছে সবাই। নীলা, ফরিদা আন্টির সাথেই থেকে গেলো এখানে। নীলার বাবাকে ফোন দিয়ে বলে দিয়েছে নিবিড়, যে নীলা আজ ফরিদা আন্টির সাথেই আছে। পরিস্থিতি বুঝে তিনিও আর কিছু বললো না।
সবাই সবার মতোই আছে। শোকের বাড়ি ছন্নছাড়া হবে এমনটাই স্বাভাবিক। মন মেজাজ খারাপ থাকলেও চোখ দুটু রক্তিম হয়ে আছে রাজের।
হাতে লেপটপ নিয়ে নিলয়ের পাঠানো মেইল গুলো চেক করলে লাগলো একে একে। গতকাল রাতে ভাইয়ের বাসায় চলে যাওয়ায় তা দেখার সময় হয়নি।
কিছুক্ষন ওগুলো ঘাটাঘাটি করে এতো সিরিয়াস বিষয় গুলোতেও মন বসলো না তার। লেপটপ অফ করে এক পাশে রেখে চুপচাপ বসে আছে এক পাশে। শরিরটা শান্ত হয়ে থাকলেও মনটা অস্থিরতার মধ্য দিয়ে কাটাচ্ছে সে।
,
,
সন্ধার আগে দেশে ফিরেছিলো নির্জন। সন্ধার পর কিছুটা বিশ্রাম নিয়ে রাত্রে ডিনার শেষে খোলা আকাশের নিচে,সামনে মদের বোতল নিয়ে টি-শার্ট ও ট্রাউজার পরে বসে আছে। তার গার্ড গুলো এক নিয়মে দাড়িয়ে আছে তার পেছনে।
একটু পর পর ড্রিংক্স করছে সে। এক সাথে চার-পাঁচটা গাড়ি এসে দাড়ালো সেখানে। সামনের গাড়ি থেকে বীরের ন্যায় বেড়িয়ে এলো পিন্টু।
হাসি মুখে নির্জনের দিকে এগিয়ে এসে সালাম দিলো। তারপর সোজা হয়ে দাড়িয়ে রইলো সামনে।
সালামের উত্তর স্বরুপ নির্জন একটু মাথা নাড়িয়ে হাতের ইশারায় পিন্টুকে বসতে বলে। কিছুটা বিব্রতকর অবস্থায় পরে গেলো পিন্টু। কারণ নির্জনের সামনে কখনো নিলয় আর সামির ছারা অন্য কেউ বসার সাহস পায় নি। আজ নির্জন নিজেই পিন্টুকে তার সামনে বসতে বললো, যা দেখে কিছুটা অস্বস্থিকর পরিস্থিতিতে পরলেও মনের ভেতরটা আনন্দে নেচে উঠলো এটা ভেবে যে, নির্জন হয়তো নিলয় ও সামিরের জায়গায় তাকেও বসাতে চাইছে। হয়তো নিলয়ের শুন্যতা ও তার দায়িত্ব পিন্টুকেই দিবে সে।
এতো বছর ধরে তো এটাই চেয়েছিলো পিন্টু। তাই মুখে একটা হাসি ফুটিয়ে মনে কিছুটা নিলয়ের মতো সাহস জোগানোর চেষ্টা করে বসে গেলো নির্জনের সামনে।
হাত পা রিতিমত কাঁপছে পিন্টুর। যা যেখে নির্জন একটা রহস্যজনক হাসি দিয়ে বলে,
– কোনো পরিস্থিতিতে কখনো নিলয়ের আঙুলও কাঁপতে দেখিনি আমি।
কথাটার মানে বুঝে পিন্টু নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করলো। কিছুক্ষন নিরব থেকে নির্জন স্বাভাবিক ভাবে বলে,
– ড্রিংক্স হবে?
পিন্টু আবার কিছুটা অস্বস্থিতে পরে গেলো। তবুও ভয় পেলে চলবে না, এটা ভেবে গ্লাস হাতে তুলে নিলো পিন্টু।
নির্জন শুধু এক পলকে পিন্টুর দিকে চেয়ে আছে। হয়তো কিছু একটা বুঝার চেষ্টা করছল ডে।
ড্রিংক্স করা শেষ হলে পিন্টু কিছুটা স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করে নির্জনের দিলে দৃষ্টি রাখলো।
নির্জন বসা থেকে উঠে বলে,
– তুই তো আমার বুকের উপর থেকে একটা পাথর সরিয়ে দিলি বাবা। যা সামনে আমার পথের কা’টা হয়ে দাড়াতো।
প্রশংসা শুনে ভেতর ভেতর ভেতর খুশি হলো পিন্টু। নির্জন একটা হাসি দিয়ে বলে,
– আজ থেকে তোর স্থান কারে পেছনে নয়। ডিরেক্ট আমার এই বুকে। বুকে আয় বাপ।
বলেই পিন্টুর দিকে দুই হাত বাড়িয়ে দিলো নির্জন। যা দেখে এবার আনন্দে মনটা নেচে উঠলো পিন্টুর। তার মানে অনেক দিনের স্বপ্ন পুরণ হতে যাচ্ছে তার।
আর কিছু না ভেবে পিন্টুও নির্জনের দিকে চলে গেলো। নির্জন পিন্টুকে বুকের সাথে চেপে ধরে একটু আবেগ প্রকাশ করলো। যেমনটা পিন্টুর মাঝেও প্রশান্তি বয়ে আনছে।
এক হাতে জড়িয়ে ধরে থাকা অবস্থায় আচমকাই নির্জন অপর হাতে পাশ থেকে মদের বোতলটা ভে’ঙে পরপর পিন্টুর পে’টে কয়েক বার আ’ঘাত করে দিলো।
এমন একটা কিছু ঘটে যাবে তার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলো না পিন্টু।
নির্জন তাকে বুক থেকে আলাদা করলে, এক হাতে পেট চেপে ধরে অবাক দৃষ্টিতে নির্জনের দিকে চেয়ে থাকে পিন্টু।
নির্জন কিছুটা গম্ভির গলায় বলে,
– আমার সামনে বসে ড্রিংক্স করার সাহসটাও দেখি পেয়ে গেলি। পাখনা বড় হওয়া ভালো, এতো বড় হওয়া ভালো নয়।
বলেই ধাক্কা দিয়ে ঘাসের মাঝে ফেলো দিলো পিন্টুকে। যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে পিন্টু। এমন সময় সামিরও আসলো সেখানে। পিন্টুকে এভাবে কাতরাতে দেখে কিছুটা অবাক হয়ে বলে,
– ছেলেটার এমন অবস্থা করলেন কেন জানতে পারি আঙ্কেল? আপনার কথা মতোই তো সব করেছিলো সে।
পাশ থেকে একজন নির্জনের সামনে পানি নিয়ে আসলে সেটাতে হাত ধুয়ে নির্জন স্বাভাবিক ভাবে বলে,
– নিলয়ের সাথে ছেলেটার সম্পর্ক খুব গভির ছিলো। এতো গভির সম্পর্ক থাকার স্বত্তেও লোভে পরে যেই ছেলেটা নিলয়ের সাথে বেঈমানি করতে পারলো, সেই ছেলেটা কয়দিন পর আমার পেছনে ছু’রি বসাবেনা তার কি নিশ্চয়তা আছে? তাই পথের কাটা ভয়ঙ্কর হওয়ার আগেই পথ থেকে সরিয়ে নিলাম।
বিষয়টা আগে ভেবে দেখেনি সামি। তাই আর কিছু না বলে চুপচাপ দাড়িয়ে রইলো সে। নির্জন হাত মুছতে মুছতে আরো কিছুটা সময় নিস্তব্ধতায় কেটে গেলো। এর মাঝে নিস্তেজ হয়ে গেলো পিন্টুও।
নির্জন কয়েক কদম সামিয়ের দিকে এগিয়ে গিয়ে সামিয়ের কাধে হাত রেখে আরো কয়েক কদম এগিয়ে গেলো। সামিরও যাচ্ছে তার সাথে চুপচাপ।
নিরবতা ভেঙে নির্জন বলে,
– আরোহির সব কিছুই শুনেছি আমি। এখন তোমাকে ডেকেছি এই জন্যই যে, বিয়ের প্রস্তুতি নাও। এক সাপ্তাহের মাঝেই তোমাদের বিয়েটা শেষ করে আরোহিকে নিয়ে দেশের বাইরে চলে যাবে কয়েক মাসের জন্য। এর মাঝে হয়তো আরোহি এসব বিষয়ে কিছুটা ভুলে যাবে। মাইন্ডে নতুন চিন্তার জন্ম হলে পুরোনো চিন্তা গুলো এমনিতেই মাথা থেকে সরে যাবে।
সামির ভেতর ভেতর খুশি হলেও কিছুটা ভালো সাজার জন্য বলে,
– তবে আরোহির এক্সামটা?
নির্জন স্বাভাবিক ভাবে বলে,
– সেখান থেকে ফিরে আসার পর এক্সাম দিবে। বাকি সব এমনিতেই ঠিকঠাক থাকবে। তোমার ওসব ভাবতে হবে না। আপাতত বিয়ের প্রিফারেশন নাও, ইয়াং ম্যান।
বিনিময়ে নিছু বললো না সামির। শুধু একটু মুচকি হাসলো।
,
,
পরদিন পোস-মার্টাম শেষে শেষে দুপুরের দিকে নিলয়ের লা’শ বাড়িতে পাঠানো হয়। লা’শবাহি গাড়িটা এসে দাড়ালো বাড়ির সামনে।
কয়দিন আগেও যেই ছেলেটা স্বাভাবিক ভাবে হাসি খুশিতে এই বাড়িয়ে প্রবেশ করতো সেই ছেলেটা আজ প্রবেশ করলো কা’টা ছেঁ’ড়া লা’শ হয়ে। যেই বাড়ির প্রতিটা মানুষ এক সময় খুব হাসি খুশিতে দিন পার করতো সেই বাড়িয়ে আজ শোকের ছায়া নেমে সকলে নিশ্চুপ। চার বন্ধুর মাঝে সবচেয়ে বেশি হার্ট হয়েছে তুষার।
হাসি খুশির সময় গুলোতে তুষারের সাথেই বেশির ভাগ দুষ্টুমি ফাজলামি করতো সে।
এরপর রুশান, নিজেদের মাঝে গোপনে কত কিছুই ঘটে গেলো। শুধু জানা ছিলো না সব কিছুর মুল যেই জন, তারা একই সাথে বাস করতো।
বিলেকে বাড়ি থেকে নিলয়ের শেষ বিদায় নিয়ে চার বন্ধু চারপাশে ধরে নিলয়কে নিয়ে গেলো কবরস্থানের দিকে। যাকে নিয়ে একই ছাদের নিচে প্রতিদিন একই সাথে কাটিয়েছে তারা, আজ সেই জনকেই তারা চারজন চার পাশে ধরে কবরস্থানের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। নিয়তি কতটা খারাপ হলে এই বয়সে কাছের মানুষদের শেষ বিদায় জানাতে হয়।
জানাযা শেষে নিলয়কে দাফন করে পাড়া প্রতিবেশিরা নিজেদের মত চলে গেলো বাড়ির দিকে। একে একে সবাই চলে গেলো। শুধু নিশ্চুপ হয়ে কবরস্থানের পাশে দাড়িয়ে আছে রুশান, নিবিড়, তুষার তারা তিন জন। রাজ তার পাশে ছোট একটা জায়গায় বসে আছে চুপচাপ।
কাছের বন্ধুটা আজ লা’শ হয়ে কবরে শুয়ে আছে। চাইলেও আর কখনো দেখা হবে না তার সাথে। ভাবতেই নিবিড় ও তুষারের দু’চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে অঝড়ে। পাশে রুশানও দাড়িয়ে আছে আহত চোখে তাকিয়ে।
এই শোক রুশানকেও দুর্বল করে তুললেও তেমন একটা দুর্বল করতে পারেনি রাজকে। রক্তিম চক্ষু জোড়া স্থির হয়ে আছে মাটির দিকে। শুধু এক হাতে ছোট একটা লাঠি দিয়ে বার বার মাটির মাঝে আঘাত করে নিজের রাগকে নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করছে। নিরবতায় ঘন ঘন নিশ্বাসের সাথে যেন এই রক্তিম চোখ ঝলসে দেবে সামনে থাকা সব কিছু।
To be continue………….