#ছদ্মবেশ,পর্ব ৭৫,৭৬
#মেহেদী_হাসান_রিয়াদ
৭৫
গায়ে সাদা টি-শার্ট এর সাথে মাথায় একটা সাদা কেপ পরে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করলো রেজোয়ান। তার বাকি লোলরাও একই কালারের জামা পরে কাজ করছে। সব কিছুতে নিজেদের সবটা সৌন্দর্য দিয়ে সাজাতে ব্যস্ত তারা। নির্জনের একমাত্র মেয়ের বিয়ে বলে কথা।
পুরো বাড়িটা সাজাতে রেজোয়ান সহ ২৫ জন ছেলে কাজ করলো সারা দিন। এখনো অনেক কিছুই বাকি আছে। আগামি কাল সন্ধায় বিয়ে। এর মাঝেই এত বড় বাড়ির সবটা কাজ শেষ করতে হবে। যদিও এসব কাজে প্রফেশনাল নয় রেজোয়ান ও তার লোকজন। তাই সময় নিয়ে সবটা নিখুত ভাবে করছে, যেন কোনো ত্রুটি না থাকে।
নির্জনের লোকেরা সারা বাড়ি হেটে হেটে পর্যবেক্ষন করছে। সবটা ঠিকঠাক মত হচ্ছে কিনা খুব ভালো ভাবেই নজরদারিতে রাখছে সব।
সবাইকে কাজ দেখিয়ে দিতে দেখে নির্জনের এক লোক রেজোয়ানের কাঁধে হাত দিয়ে দুটো টোকা দিয়ে রেজোয়ানের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলে,
– খেয়াল রাখবি কোনো কাজের যেন কোনো ক্রুটি না থাকে। কোনো কাজের বিন্দু মাত্র বদনাম হলেও তোদের নিজেদের জী’বন নিয়ে পরে টানাটানি করতে হবে। বুঝতেই তো পারছিস কার বিয়ের প্রোগ্রাম এর কাজ তোদের দেওয়া হয়েছে।
রেজোয়ান ছেলেটা একটু রগচটা স্বভাবের হলেও এই মুহুর্তে মুখে একটা হাসি ফুটিয়ে বলে,
– চিন্তা করবেন না স্যার, আমরা আমাদের সবটা দিয়ে করছি।
লোকটা একটু মাথা নেড়ে বলে,
– ভেরি গুড। তবে যার সাথে প্রোগ্রাম নিয়ে কথা হয়েছিলো তাকে কোথায় দেখতে পাচ্ছিনা কেন?
রেজোয়ান স্বাভাবিক ভাবেই ফট করে বলে দেয়,
– স্যার, সে হচ্ছে আমাদের ম্যানেজার। সে এসব প্রোগ্রাম নিয়ে তারপর কাজে আমাদেরকে পাঠায়।
লোকটা আর কিছু না বলে রেজোয়ানের দিকে চেয়ে সামনের দিকে পা বাড়ায়। কিছুটা সামনে গিয়ে ডান পাশে চেয়ে থমকে গিয়ে বলে,
– এদিকটায় এখনো হাত লাগানো হয়নি কেন?
রেজোয়ান আবারও জোরপূর্বক একটা হাসির রেখা টেনে বলে,
– সময়ের আগে সব হয়ে যাবে স্যার। চিন্তা করবেন না।
,
,
এদিকে রাজ আর রুশান বসলো একটা ছক নিয়ে। দেশে কোন জায়গায় নির্জনের কোন টিম কাজ করছে, আর অ’শ্র সহ বিভিন্ন অবৈধ মাল গুলো কোন কোন জায়গায় রাখা আছে সব ডিটেইল্স নিলয় মা’রা যাওয়ার আগে দিয়ে গিয়েছিলো রাজকে। আর সেই অনুযায়ি ছক তৈরি করে নিলো রাজ। শুধু অপেক্ষায় আছে সময়ের। সব জায়গায় এক সাথে এ্যাটাক করার একটা উত্তম সময়ের প্রয়োজন। ক্ষমতার শক্তি দিয়েই সব হয় না। মানুষের মেধাশক্তিটাই সবচেয়ে বড় শক্তি।
ছকের সব খুটিনাটি গুলো রুশানকে বুঝিয়ে দিতে লাগলো রাজ। কোন যায়গায় কিভাবে যেতে হবে। কোন জায়গায় কি আছে, আর কোথায় কতগুলো লোক গেলে সবটা হ্যান্ডেল করতে পারবে।
সব ডিটেইলস মনোযোগ সহকারে নিজের মাঝে আলোচনা করে নিলো তারা।
সবটা শেষ হলে ছকটা ভাজ করে রুশানের হাতে দেয় রাজ। আর শান্ত গলায় বলে,
– নিলয় ছিলো নির্জনের মেইন হা’তিয়ার। এরপর ছিলো নিলয়ের সাথে থাকা সেই ছেলেটা। কি যেন নাম? ওহ্ হ্যা পিন্টু। পিন্টুকে দিয়ে খোজ নিয়ে নিলয় সবটা সামলে নিতো। যার কারণে নির্জনকে তেমন একটা চাপ নিতে হতো না। এখন তারা দুজনের মাঝে কেউই নেই। কিছুটা হলেও ছন্নছাড়া হয়ে আছে নির্জনের টিম ম্যানেজমেন্ট। এখন আছে সামির। সে নিজের বিয়ে নিয়ে চিন্তিত।
রুশান চুপচাপ ছক টা নিয়ে ব্যাগের ভেতর রাখলো। ব্যাগটা কাধে নিয়ে রাজের দিকে চেয়ে বলে,
– সব নাহয় বুঝলাম, বাট যাওয়ার আগে একটা ছোট্ট বিষয়ে জানার আগ্রহ জাগলো মনে।
হুট করে রুশানের এমন প্রশ্নে রাজ কিছুটা কৌতুহলি দৃষ্টিতে তাকায় রুশানের দিকে।
রুশান স্বাভাবিক ভাবে বলে,
– আরোহিকে কি সত্যিই ভালোবেসে ফেললি? নাকি শুধু ওসব লোকদের থেকে তাকে বাচাতে তুই আগামি কাল ওখানে যাবি? মানে এটা কি করুনা, নাকি ভালোবাসা?
রাজ কিছুটা নিশ্চুপ থেকে স্বাভাবিক ভাবে বলে,
– অন্যায় দেখলে এমনিতেই সহ্য হয় না। তো সেখানে নিজের মানুষের সাথে হলে কিভাবে সহ্য করবো বল?
উত্তর পেয়ে কিছুটা মুচকি হাসলো রুশান। যা দেখে কিছুটা হলেও লজ্জাজনক পরিস্তিতিতে পরতে হলো রাজকে। তবুও তা প্রকাশ না করে কথা ঘুরাতে রুশানে ঠেলে সেখান থেকে পাঠিয়ে দিয়ে বলে,
– সময় খুবই কম। এই কম সময়েই তোকে সবটা ম্যানেজ করে নিতে হবে। তাই সময় নষ্ট না করে এখনি বেড়িয়ে পর।
রুশান সেখান থেকে যেতে যেতে পেছন ফিরে রাজের দিকে চেয়ে আবারও হেসে বলে,
– তাকে কখনো হারাতে দিস না, যে তোকে সত্যিই ভালোবাসে। ক্ষমতায় সব পেলেও কখনো একজন সত্যিকারের ভালোবাসার মানুষ খুজে পাবিনা। ভালোবাসা হওয়া উচিৎ নিঃস্বার্থ। তেমনই আরোহিও স্বার্থ খোজেনি৷ তোকে নিঃস্বার্থ ভাবেই ভালোবেসেছে। আর যারা অবস্থান দেখে ভালোবাসতে আসবে তাদের মাঝে অবশ্যই স্বার্থ লুকিয়ে থাকবে।
বলেই চলে গেলো রুশান। নিজের মত করে বলকনিতে এসে দাড়ালো রাজ। হুট করেই আরোহিকে নিয়ে খুব ভাবতে ইচ্ছে হচ্ছে তার। আরোহিকে অনেক ভাবে পরিক্ষা করে সে ভালোই বুঝতে পেরেছে যে, আরোহির অনুভূতি গুলোকে ভালোবাসা না বললে হয়তো ভালোবাসা নামক শব্দটাই মিথ্যে হয়ে দাড়াবে। তবে এটা কথা তাকে ভাবাচ্ছে খুব। যে মেয়েটার মাঝে এখনো বাচ্চামো বিদ্যমান, কোনো সম্পর্ক ছারাই এতো রাগ, অভিমান, আবেগ প্রকাশ করে ফেলতো। তার সাথে কোনো সম্পর্কে জড়িয়ে গেলে কি করবে? সুজুগ পেলেই জ্বালিয়ে মা’রবে এটা নিশ্চিত। এটা ভাবতেই মাঝে মাঝে হাসে উঠে রাজ। যেমনটা কোনো কিছু ভাবতে ভাবতে একজন গম্ভির মানুষও হুট করে হেসে উঠে, ঠিক তেমনই।
,
,
রাতের মাঝে নিবিড়ের সাথে ভালো একটা ভাব হয়েছে তীসার। প্রথম প্রথম কিছুটা লজ্জা পেলেও পরিচয় হওয়ার পর সব লজ্জা কেটে গেলো তার।
সকাল থেকেই নিবিড়ের ফোন নিয়ে কার্টুন দেখায় ব্যস্ত সে। নাস্তা শেষে নিবিড় ও তুষারের সাথে বের হলো নিবিড়কে সারা গ্রাম ঘুরিয়ে দেখাবে বলে। বৃষ্টির মৌসুমে মানুষ আউশধান কেটে নতুন করে আবার রোপন করছে। দুই পাশের সারি সারি গাছের মাঝ দিয়ে রাস্তায় হেটে দুই পাশের সৌন্দর্য উপভোগ করছে তারা। গ্রামের নাম করা বড় বড় দীঘি গুলো ও সুন্দর সুন্দর জায়গা গুলোতে ঘুরলো তারা।
দুপুরের আগে বাড়ি ফিরে আসে আবার। দেখে তুষারের মা পাশের বাসার রুজিনা চাচিকে ডেকে এনে রান্না বান্না করছে দুজন মিলে।
তুষার ও নিবিড় দুজন ফ্যানের নিচে বসলো। তীসা নিবিড়ের পাশে তার ফোনটা নিয়ে বসলো। আবার ফোন রেখে নিবিড়ের দিয়ে চেয়ে বলে,
– ভাইয়া জাম্বুরা খাবে? আমি খুব সুন্দর করে বানাতে পারি।
পাশ থেকে তুষার বলে,
– এটা জিজ্ঞেস করার কি আছে? যা বানিয়ে নিয়ে আয়।
তীসা দৌড়ে বাইরে চলে গিয়ে জাম্বুরা গাছটার নিচে দাড়ালো। জাম্বুরা পারার জন্য একটা ছোট বাশ রাখা আছে সেখানে। তীসা সেখান থেকে দুইটা জাম্বুরা পেরে রান্না ঘরে চলে গেলো তা কে’টে লবন মরিচ মিশিয়ে বালো করে তৈরি করে আনতে। নিবিড় ও তুষার কথা বলছে নিজেদের মত।
কিছুক্ষনের মাঝে একটা পাত্রে সব রেডি করে এনে তাবে চামচ দিয়ে দুজনের সামনে রাখলো তীসা। তুষার চুপচাপ বসে আছে দেখে তীসা বলে,
– কি হলো তুমি খাবে না?
তুষার রাগ করেছে এমন ভাব নিয়ে বলে,
– তুই তো তোর নতুন ভাইয়ের জন্যই বানিয়ে আনলি। তাকেই সব বলছিস। আমাকে কি এর আগে একবার জিজ্ঞেস করেছিস খাবো কিনা?
তীসা এবার দুই হাত কোমরে রেখে বড় বড় চোখে তাকায় তুষারের দিকে। তুষারকে অন্য দিকে ফিরে থাকার ভাব নিয়ে বসে থাকতে দেখে তীসা এবার কোমরে হাত রাখা অবস্থায় হেসে বলে,
– আচ্ছা রাগ করে থাকতে হবে না, আমিই খাইয়ে দিচ্ছি।
বলেই চামচ হাতে তুষারকে খাইয়ে দিতে লাগলো সে। পাশ থাকে নিবিড় হেসে বলে,
– তাহলে এই ভাইয়ে কি দোষ করলো?
তীসা দুজনকে দুই চামচ করে খাইয়ে দিয়ে বলে,
– হয়েছে? এবার আর ঢং না করে নিজেরা খেতে শুরু করো।
বিকেলে ফুটবল খেলতে মাঠে গেলো তুষার। সাথে নিয়ে গেলো নিবিড়কে। অনেক দিন এভাবে মাঠে খেলা হয় না। আগের মত এখন টিমে সবাই নেই। কেউ কেউ চাকরিতে জড়িয়ে গেছে। কেউ চলে গেছে বিদেশ। এখন যেই কয়জন আছে, সিনিয়র জুনিয়র মিলে খেলার মাঠে খেলতে নামে। ছোট বেলায় প্রতিদিন বাবা মায়ের চোখ ফাকি দিয়ে মাঠে খেলতে চলে যেত সবাই। সেই সোনালি দিন গুলো যেন জীবন থেকে হারিয়ে গেলো বড় হওয়ার সাথে।
সবার সাথে নিবিড়ও নামলো খেলতে। বৃষ্টি হওয়ায় মাঠ ভিজে আছে। খেলার মাঝে ঢুকে নিবিড় কয়টা আ’ছাড় খেয়েছে তার হিসেব নেই। বল টানার সময় এর পর গোল দিতে গিয়ে কয়েকটা লা’ থি খেয়ে যেন পা অবশ হয়ে গেলো তার। কোনো মতো পা ধরে মাঠের এক পাশে গিয়ে বসে উ আ করতে লাগলো নিবিড়। নতুন খেলতে নামলে যেমনটা হয়।
তুষার তার কাছে ছুটে এসে এসে সবটা শুনে বলে,
– সা’লা পল্টি মো’রগের মত শুধু শরিরটাই বানাইলি। এছারা শরিরে আর কিচ্ছু নাই। জীবনে মাঠে নামসনাই খেলতে?
নিবিড় আবার ব্যাথায় আ করে উঠে বলে,
– তোদের গ্রামের ছেলে গুলোর পা এতে শক্ত কেন?
তুষার এবার নিবিড়কে ধরে উঠিয়ে বাসার দিকে হাটতে হাটতে বলে,
– আগে অভ্যেস না থাকলে খেলতে নামলি কেন?
বিকেল টা কে’টে গেলো কোনো মত। ফার্মেসি থেকে ব্যাথার ঔষধ নিয়ে আসলো তুষার। আর তীসা একটা বোতলে তেল এনে বলে,
– এগুলো আমাদের বাড়ির পাশের এক দাদির থেকে আনা পড়া তেল। এগুলো মালিশ করে দিলে ব্যাথা চলে যাবে তাড়াতাড়ি।
নিবিড়ের এখন ভালো-মন্দ দেখার সময় নেই। তাড়াতাড়ি ব্যাথা গেলেই হলো। নিবিড়কে শুয়ে থাকতে বলে তীসা একটু একটু করে মালিশ করে দিতে লাগলো খুব যত্ন সহকারে। মেয়েটা খুবই মিশুক। অল্পতেই কাউকে আপন করে নেওয়ার ক্ষমতা রাখে।
,
,
সোফায় বসে সিগারেটের ধোয়া ছারছে নির্জন। আরোহির মা আজ ভয়ার্ত ভাবটা বদলে কিছুটা সাহসি ভাব নিয়ে তার সামনে গিয়ে দাড়ায়। এতে নির্জনের তেমন একটা রেসপন্স না পেয়ে তার পাশের সোফায় বসে বলে,
– আপনার কি মেয়েটার জন্য একটুও মায়া হচ্ছে না? তার জী’বনটাও কি আমার মতো নষ্ট করতে চাইছেন? কেমন বাবা আপনি?
নির্জন এক মনে ধোয়া উড়িয়ে তার স্ত্রীর দিকে তাকালো। কিছুটা গম্ভির ভাবে বলে উঠে,
– আমি কি করবো না করবো তা কি তোমার থেকে কৈফিয়ত নিয়ে করতে হবে?
আরোহির মা কিছুটা ছিটকে ফেলে দেওয়ার মত করে বলে,
– আমার কথার গুরুত্ব কেন দিতে যাবেন? আমার বা পরিবারের প্রতি কেনো টান আছে আপনার? অবশ্য থাকবেই বা কি করে? নিজের মেয়ের বয়সি মেয়েদেরকে ব্যবহার করে নিজের প্রয়োজন মিটিয়ে নিচ্ছেন। ফ্যামিলির প্রতি টান কখনো চিলো না আছে? অন্তত নিজের মেয়ের বিষয়টা একটু ভাবুন। তাকে কেন এসব বাজে বিজনেসের সাথে জড়িয়ে নিচ্ছেন? সারা জীবন নিজে যেমন চেয়েছেন তেমন ভাবেই চালিয়েছেন মেয়েকে। অন্তত ভালো কারো সাথে বিয়ে দিয়ে বিবাহিত জীবনে সুখি হতে দিন। মেয়েটার সারাটা জীবন কেন নিজ হাতে দোজখ বানিয়ে তুলছেন?
নির্জন আবার সিগারেটে টান দিয়ে বলে,
– ও এসবের কিছুই জানবে না। রানীর মত থাকবে সে।
আরোহির মা একটু তাচ্ছিল্য ভাব নিয়ে হেসে উঠে বলে,
– যেমনটা আমি আছি তেমনই তো সুখে থাকবে তাই না?
নির্জন এবার বিরক্ত হয়ে কঠোর দৃষ্টিতে তাকালে কিছুটা চুপসে যায় সে। অনুরুধের ভঙ্গিতে বলে,
– মেয়েটা এখনো বাচ্ছা, তাকে এসবের সাথে জড়াবেন না দয়া করে।
নির্জন এবার রাগি দৃষ্টিতে তার দিকে চেয়ে বলে,
– তোমার কথায় প্রচুর বিরক্তিবোধ করছি আমি। উল্টাপাল্টা কিছু করে ফেলার আগে আমার চোখের সামনে থেকে বিদায় হও।
,
,
সব কিছু ঠিকঠাকই থাকবে। তোর ইচ্ছে মতোই হবে সব। মায়ের বলা এই কথাটাকে একটু ভরসা হিসেবে নিয়ে বার বার চোখ মুছে বিষণ্ন মনে বিয়েজ সাজে সাজলো আরোহি। তাছারা রাজের কোনো ক্ষতি হোক, এটা সে কখনোই চায় না।
সারা বাড়িটায় ঝাক ঝমক পূর্ণ ভাবে সাজ। বরপক্ষ ও কনেপক্ষ মিলে সারা বাড়ি কোলাহল পূর্ণ পরিবেশ তৈরি হয়েছে। নিজেদের মত আনন্দ করছে সবাই। আরোহিকে রুম থেকে স্টেইজে নিয়ে যাওয়ার মুহুর্তে বিষণ্ন গলায় মায়ের দিকে চেয়ে করুণ ভাবে বলে,
– ম’রে গিয়ে তোমাদের সবাইকে মুক্তি দিয়ে দিবো। যেই জীবনে আমার ইচ্ছের কোনো মুল্য নেই সেই জী’বন নিয়ে বেশি দুর আগাবো না আমি। আমাকে বিয়ে দিচ্ছো না, মে’রে ফেলছো তোমরা।
আরোহির মায়ের কষ্ট হলেও চুপ করে রইলো সে। কারণ রাজ বলেছিলো সময় হলে সব হবে। এদিকে নির্জনের লোক এসে ডেকে গেলে আর সময় নষ্ট না করে আরোহিকে নিয়ে সামিরের পাশে বসানো হয়।
আরোহির মা বারবার আড় চোখে এদিক ওদিন তাকাচ্ছে। রাজের কথায় পুরোপুরি ভরসা না পেলেও এটা ছারা আর কিছুর উপরই ভরসা নেই আপাতত। তার এক মুহুর্তের জন্য হলেও মনে হচ্ছে নির্জনের এতো সিকিউরিটির মাঝে কিভাবে সে এটার সমাধান করবে? সম্ভব না জেনেও রাজের উপর ভরসা করে আছে সে।
সব কিছু ঠিকঠাক ভাবেই চলছে। সেখানে গেস্টদের মাঝে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা রাজের লোক গুলোর সবার ফোনে একটা মেসেজ আসলো এক সাথে। এই মেসেজের জন্যই তারা অপেক্ষা করছিলো এতোক্ষণ। মেসেজ পেয়ে তৎক্ষনাৎ সবাই ফোন পকেটে ঢুকিয়ে প্রস্তুতি নিয়ে স্বাভাবিক ভাবেই গ্যাস্টদের সাছে হাটাচলা করতে লাগলো তারা। কেউ বসে আছে জায়গা বুঝে। সবাই সবার জায়গা থেকে রেডি হয়ে আছে। অপেক্ষা করছে শুধু রাজের ভেতরে আসার।
কিছুক্ষন পর,
মুহুর্তেই এমন একটা ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ায় আতঙ্কে জড়সর হয়ে দাড়িয়ে আছে সবাই। সব হ’ত্যা’কান্ডের মাঝে ভিডিউ ফুটেজে দেখা সেই এক কালারের হুডি পরা ছেলেটাকে সেই অবস্থাতেই দেখে হাত পা রিতি মতো কাঁপতে শুরু করলো সেখানে থাকা নির্জনের কয়েকটা লোকের।
এমন পরিস্থিতি তৈরি হওয়ায় সবাইকে সরে যেতে দেখে আরোহিও ভয়ে সেখান থেকে উঠে পেছনে দেওয়াল ঘেসে দাড়িয়ে রইলো। থমথমে পরিবেশে রাজ গম্ভির ভাবে কিছুটা এগিয়ে গিয়ে আরোহির দুইপাশ দিয়ে দুই হাত পেছনের দেওয়ালে রেখে কিছুক্ষন চেয়ে রইলো আরোহির ভয়ার্ত চেহারাটার দিকে। চোখ দুটু লাল বর্ণ ধারণ করে আছে। খুব রেগে গেলেই এমনটা হয় রাজের।
লোক ভর্তি বিয়ে বাড়িতে আরোহিকে দেওয়ালের সাথে চে’পে ধরে রক্তিম চ’ক্ষু নিক্ষেপ করে আছে রাজ। ভয়ে কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমতে লাগলো আরোহির। নিশ্বাস বার বার উঠা নামা করছে। আসে পাশের মানুষ গুলো দাড়িয়ে চক্ষু জুগল বড় বড় করে নিক্ষেপ করে আছে তাদের দিকে। সামির সহ বাকি সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো।
রাজ দুই আঙুলে আরোহির গতকাল লাগানো হলুদ মাখা হলদে গালটা ছুয়ে দিয়ে বলে,
– বাহ্ সুন্দরই তো লাগছে খুব। বিয়ে করবে, তাই না? অথচ আমাকে দাওয়াত দিতেই ভুলে গেলে? কত কষ্ট করে কত মাস তোমাকে পড়ালাম বলোতো। আর এখন আমাকে না জানিয়েই বিয়ে করে নিচ্ছো?
মাথায় হুডি পরা মুখে মাস্ক লাগানোয় কেউ রাজকে না চিনলেও আরোহির চিনতে একটুও ভুল হলো না। টল মলে চোখের পানি নিয়ে রাজের বুকে ঝা’পিয়ে পরে চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে হচ্ছে,
‘আমি করতে চাইনি এই বিয়ে। বিশ্বাস করুন আমাকে জোড় করে বাধ্য করা হয়েছে। নাহলে তারা আপনাকে মে’রে ফেলতো।’
কিন্তু তা আর বলা হলো না। এর আগেই রাজ আরোহির এক হাত চেপে ধরে চার দিকে চেয়ে হু’ঙ্কার দিয়ে বলে উঠে,
– এই কে? আমার সামনে দাড়িয়ে আরোহিকে বিয়ে করবি, কোন ছেলের এমন বুকের পাটা? এক বা’পের জ’ন্ম হলে সামনে এসে কথা বল।
পিন পতন নিরবতাময় বিশাল ক্লাবের ন্যয় বাড়িটি কেঁপে উঠলো রাজের হু’ঙ্কারে।
পি’স্তল হাতে ভেতর থেকে বেড়িয়ে রাজের সামনে এসে দাড়ালো আদ্রিয়ান মাহমুদ নির্জন।
পি’স্তল হাতে এগিয়ে এসে রাজকে দেখেই থমকে দাড়িয়ে গেলো সে। সব জায়গায় ফুটেজে দেখা সেই রুপটা সামনে দেখে আশে পাশে যারা এতোক্ষন রাজের দিকে ব’ন্দুক তাক করে ছিলো, তাদেরকেও ইশারায় ব’ন্দুক সরিয়ে নিতে বললো সে।
আজ রাজ ও নির্জন দুজনই মুখোমুখি দাড়িয়ে। রাজ হাতের তুড়ি বাজাতেই গ্যাস্টদের মাঝে ছদ্মবেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা তার ছেলে গুলো পি’স্তল হাতে দাড়িয়ে সকলকে জব্দ করে নিলো।
নির্জন চার দিকে একবার চোখ বুলিয়ে রাজের দিকে তাকিয়ে বলে,
– ক্রা’ইমের জগতে তোর সাথে সাথে আমার কিসের শ’ত্রুতা তা আমি জানিনা। অজান্তেই এতো কিছু করেছিস আমার। কেন করেছিস, কি চাস তা জানতে চাইছিনা আপাতত। তবে এতে আমার মেয়ের বিয়েতে এসে কি সব বকছিস? আরোহিকে কিভাবে চিনিস তুই?
রাজের অক্টো হাসির শব্দ সারা জায়গা জুড়ে বেজে উঠে। এর পর মাথা থেকে হুডি সরিয়ে, মুখের মাস্ক খুলে নির্জনের দিকে তাকাতেই নির্জন দুই পা পিছিয়ে গিয়ে বলে।
– রাজ তুমি?
আরোহির হাত ধরে রাখা অবস্থায় রাজ বলে,
– অবাক হচ্ছেন? আমি নিজেও মাঝে মাঝে দেখে অবাক হই। আপাতত তারচেয়ে বেশি অবাক হচ্ছি আপনাকে দেখে। কেমন বাবা, যে নিজের মেয়ে সুখটাই কে’ড়ে নিতে চাইছেন? কেন নিজের মেয়েকে বিজনেস এর সাথে জড়াতে চাইছেন? আপনার মেয়ে বলে তাকে দিয়ে তো আপনি যা ইচ্ছা তা করতে পারেন না, তাইনা? অন্তত আমি বেচে থাকতে।
নির্জন রাগান্বিত দৃষ্টিতে রাজের দিকে চেয়ে বলে,
– আমার এতো ক্ষতি করে এখন আবার বাড়িতে এসে আমার মেয়ের হাত ধরে আমার সামনে দাড়াতে তোর একটুও বুক কাঁপলো না?
রাজও স্বাভাবিক ভাবে বলে,
– যেটা ভালো মনে হয় করি, যেটা ভালো মনে হয়না তা কক্ষনো করিনা। এটাই আমার আদর্শ। বুক কাঁ’পতে জন্ম হয়নি আমার, জন্ম হয়েছে কাঁ’পুনি সৃষ্টি করতে। বা’চা ম’রার পরোয়া তো আমি এমনিতেই করিনা।
নির্জন আবার বলে,
– তো আমার সম্পর্কে সব জেনে এখন ম’রতে এলি কেন? এখানে ছড়িয়ে থাকা সামান্য লোক গুলো নিয়ে সবটা হ্যা’ন্ডেল করে নিতে পারবি। এতোই ইজি মনে হচ্ছে সবকিছু? কতটুকু ধুরণা আছে আমার সম্পর্কে।
রাজ এবার কিছুটা হেসে হবে। আবার স্বাভাবিক হয়ে বলে,
– একেবারে গভির পর্যন্ত। তাছারা এখন এসব গভিরতার খবর খুজতে গিয়ে কোনো লাভ নেই। কারণ আপনার সব লোক, সব অবৈধ জিনিস পত্র এতোক্ষনে পু’লিশ ও রে’ব এর হাতে পৌছে গেছে। সো শুন্য মাঠে গর্জে উঠা নিতান্তই বোকামি।
রাজের কথায় যেন হতভম্ব হয়ে আছে নির্জন। রাজ আরোহির হাত ছেরে দিয়ে তার দিকে চেয়ে বলে,
– খুবতো বলতে ভালোবাসি। নিজের বাবাকেও ভয় পেতে। এখন নিজের বাবার সামনে দাড়িয়ে নিজেকে সাহসি ভেবে ভালোবেসে হাতটা ধরতে পারলেই তোমার সব চাওয়া পূরণ হবে আজ। আর ভিতু সেজে চুপ করে থাকলে একেবারে হারাতে হবে আমায়। চাইলেও আর কখনো খুজে পাবে না।
বলেই আরোহির দিকে এক হাত বাড়িয়ে দেয় রাজ। আরোহি একবার রাজের দিকে তাকাচ্ছে আরেকবার বাবার দিকে তাকাচ্ছে। রাজের প্রতি ভালোবাসা তীব্র হলেও বাবার দিকে তাকাতেই সিদ্ধান্তহীনতায় পরে যাচ্ছে বার বার।
To be continue……….
#ছদ্মবেশ (পর্ব ৭৬)
#মেহেদী_হাসান_রিয়াদ
দোটানায় পরে গিয়ে চুপচাপ হয়ে দাড়িয়ে আছে আরোহি। একবার রাজের দিকে তাকাচ্ছে আরেক বার বাবার দিকে। চার পাশে ভয়াবহ নিরবতা বিরাজ করছে। পাশ থেকে সামির কিছু একটা বলে রাজের দিকে এগিয়ে আসতে চাইলে পাশ থেকে রেজোয়ান আ’ক্রমণাত্বক ভাব নিয়ে এগিয়ে একহাতে কলার চেপে ধরে অন্য হাতে মাথার পি’স্তল ঠেকিয়ে রাগী দৃষ্টি নিক্ষেপ করে তার উপর।
রেজোানের এমন আ’ক্রমনাত্বক রুপ দেখে নিশ্চুপ হয়ে থেমে গেলো সামির। ঐ অবস্থায় রেজোয়ান রাগী কন্ঠে বলে উঠে,
– বেশি উড়ার চেষ্টা করবি তো, একধম এখানেই পু’তে দিবো। এমনিতেও কয়েকবার ভাইকে রাস্তায় ধরে ফাপর নিয়েছিলি। শুধু ভাই নিষেধ করছে দেখে কিছু বলিনাই তোরে। নিজের ভালো চাইলে এখন যেভাবে আছিস, এভাবেই চুপচাপ দাড়িয়ে থাক।
সামির চুপচাপ চেয়ে আছে রেজোয়ানের দিকে। এই মুহুর্তে মুখের উপর কিছু বলার সাহস পাচ্ছে না। শুধু ঘন ঘন নিশ্বাস নিচ্ছে সে।
রাজের ইশারায় রেজোয়ান এবার তাকে ছেরে শান্ত হয়ে রাজের পাশে এসে দাড়ালো।
রাজ পুনরায় আরোহির দিকে তাকালো আরোহির সিদ্ধান্তের অপেক্ষায়। এতোদিন ভালোবাসাকে পাওয়ার তীব্র আকাঙ্খা থাকলেও এই মুহুর্তে দুই অপশন থেকে একটা বেছে নেওয়া আরোহির জন্য পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন কাজ।
মানুষটা যতই খারাপ হোক, বাবা নামক একটা শব্দের টানে হলেও আটকে আছে সে।
আরোহিকে এমন দোটানা পরিস্থতে পরতে দেখে পাশ থেকে তার মা আজ সাহসি ভাব নিয়ে এগিয়ে এসে তার সামনে দাড়িয়ে বলে,
– সময় বুঝে সিদ্ধান্ত নিতে না পারলে এতোদিন কেন এমন পাগলামি করেছিলি? সারা জীবন কি এই মানুষত্বহীন পশুদের সাথে অন্ধকারে কাটাতে চাস? সারা জীবন যার সাথে থাকার জন্য এতোদিন এমন পাগলামি করেছিলি, তার সামনে আজ কেন চুপ করে আছিস? বাবা নামক এই মানুষটার জন্য তাই তো? যেই মানুষটা তোর সুখের কথা না ভেবে তোকে তার ব্যবসার অংশ বানাতে চেয়েছিলো, তার জন্য এখনো তোর মনে কোনো টান রয়েছে? যদি রাজকে মন থেকে ভালো নাই বেসে থাকিস তাহলে এখনি বলে দে। আর কখনো এর চেয়ে বেশি পাগলামি করলেও তাকে খুজে পাবি না।
মায়ের কথায় কিছুটা নিজের আবেগের ঘোর কাটলো আরোহির। সত্যিই তো, ছোট বেলা থেকে যেই মানুষটা তাদের এতো কষ্ট দিয়ে এসেছে, এখন নিজের মেয়েকে তার ব্যবসার অংশ বানিয়েছে। অম্তত একজন বাবার থেকে কোনো মেয়ে এমনটা আশা করে না। তবুও তার জন্য এতো মায়া হচ্ছে কেন? আর রাজকেও তো সে সত্যিই ভালোবেসেছিলো। রাজকে ফিরিয়ে দিলেও বাকি জীবনটা এই সামির নামক খারাপ মানুষটার সাথে কাটাতে হবে। যেখানে রাজের জায়গায় অন্য কারো কথা ভাবতেও পারেনা সে।
আবেগ থেকে বেড়িয়ে নিজের মাঝে কিছুটা সাহস জুগিয়ে ভয়ার্ত চেহারায় ভালোবাসার মানুষটার পেছনে গিয়ে দাড়িতে তার এক হাত চেপে ধরে দাড়ালো আরোহি। বাবার প্রতি তার মায়া কাজ করছে নাকি ভয়, এটা সে নিজেও বুঝে উঠতে সক্ষম হচ্ছে না।
আরোহির সম্মতি পেয়ে রাজ কিছুটা মুচকি হেসে আরোহির এক হাত শক্ত করে মুঠো করে ধরে নির্জনের সামনে দিয়ে তাকে নিয়ে হেটে বের হয়ে গেলো। চুপচাপ দাড়িয়ে আছে নির্জন। পাশে সামিরও দাড়িয়ে রইলো চুপচাপ। নির্জন একবার সামিয়ের দিলে তাকালো। হয়তো এই সামিরের জায়গায় আর নিলয়ের মত কেউ থাকলে পরিস্থিতি ভিন্ন হতো। হয়তো খুব ভয়াবহ একটা পরিস্থিতি তৈরি হয়ে যেত মুহুর্তেই।
রাজ এখানে প্রবেশ করার পর সেখানে থাকা সকল ক্যামেরা নিয়ে নিয়েছিল তার লোকেরা। সিসিটিভি ক্যামেরাও রেজোয়ান কৌশলে আগেই অফ করে রেখেছে। সব কিছুর উদ্দেশ্য একটাই, যেন সময়ের আগে রাজের চেহারা বাইরের কেউ না দেখতে পায়।
রাজের পেছন পেছন তার সব লোক বেড়িয়ে যায় সেখান থেকে। এখনো যেন অবাকের ভঙ্গি নিয়ে কাটাচ্ছে নির্জন।
আচমকাই নিজের ঘোর থেকে বেড়িয়ে উত্তেজিত ভাবে সেখানে থাকা নিজের লোকদের বলে,
– সব জয়গা থেকে দ্রুত সবাইকে সরে যেতে বলো ইমিডিয়েটলি। ছেলেটা মোটেও সুবিধার না। একবারে প্রস্তুতি নিয়েই নেমেছে সে।
সেখানে থাকা নির্জনের লোক গুলো চারদিকে ফোন করতে ব্যস্ত হয়ে পরলো। কিন্তু দুর্ভাগ্য বসত কেউই ফোন তুলছেনা আজ। অস্থিরতা আরো বেড়ে গেলো নির্জনের মাঝে।
সেই মুহুর্তে গেটের সামনে গাড়ি থামিয়ে একজন ছুটে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে বলে,
– বস, সব শেষ হয়ে গেছে আমাদের। কোনো সতর্ক ছারাই হুট করে শহর ও আসেপাশের এলাকা গুলোতে পু’লিশ ও রে’ব এর অভিজানে আমাদের সব লোক ও অবৈধ জিনিস পত্র সব আ’টক হয়ে গেছে। যারা এদিক সেদিক করেছিলো, সবাইকে ক্রস ফা’য়ার করে ফেলে দিয়েছে। শুনেছি খুলনা ও চট্টগ্রাম বর্ডার সীমান্ত গুলোতে নাকি এখনো বিজিবি অভিজান চালাচ্ছে। সবাই একসাতে দল বেধে মুহুর্তেই সব এলোমেলো করে ফেলেছে। এবার মনে হয় না সত্যটা আর লুকিয়ে রাখা যাবে।
নির্জন অস্থিরতা নিয়ে চোখ মুখ বন্ধ করে কিচ্ছুক্ষন নিশ্চুপ রইলো নিজের রাগকে নিয়ন্ত্রণ করতে। চোখ খুলে র’ক্তিম চোখে আরোহির মায়ের দিকে চেয়ে বলে,
– তুমি আগে থেকেই সব জানতে?
,
,
একটা বাড়িতে এসে গাড়ি থামলো রাজের। বাড়ির প্রাচির গুলোর চার পাশে গার্ড দিয়ে ঘেরা।
আরোহিকে নিয়ে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করে রাজ। একটা বেডরুমে নিয়ে গিয়ে কয়েকটা জামা সামনে রেখে বলে পরিহিত সব চেন্জ করে নিতে। আরোহি এখনো খাটের উপর বসে আছে চুপচাপ। হাত পা কাঁপছে তার। হয়তো অনেকটা ভয়ে আছে এখনো।
আরোহির এমন অবস্থা দেখে রাজ তার পাশে বসে গালে হাত রেখে বলে,
– ভয় পাওয়ার কিচ্ছু নেই। এখানে কেউ তোমার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। তাছারা আজ থেকে সব সময় আমি তো আছি তোমার সাথে।
রাজের কথায় আরোহি শান্ত হওয়ার বিপরিতে রাজের দিকে চেয়ে মাথা নিচু করে কাঁদতে শুরু করলো। গম্ভিরতার মাঝে আচমকাই আরোহিকে এভাবে কাঁদতে দেখে রাজ মায়া ভরা দৃষ্টিতে আরোহির দুই গালে হাত রেখে শান্তনা দিয়ে তাকে শান্ত করার চেষ্টা করছে। এর মাঝে আরোহি কাঁদতে কাঁদতে বলে,
– মাকে মে’রে ফেলবে বাবা। এর আগে আমার সামনেও অনেকবার মে’রেছিলো। ফ্যামিলির সম্মানের দিকে চেয়ে লজ্জায় এসব বিষয়ে কখনো আপনাকে কিছু বলিনি। কিন্তু বাবা খুব খারাপ, আজ মাকে মে’রেই ফেলবে সে।
বলেই আবার কাঁদতে শুরু করলো আরোহি। এতো অস্থিরতার মাঝে মুহুর্তেই থমকে গেলো রাজ। তবুও আরোহিকে শান্ত করতে সে বলে,
– কিছু হবে না তার। তাকেও এখানে নিয়ে আসছে অন্যরা। তোমার বাবা চাইলেও তার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না।
আরোহির বুকের উপর পাথরটা যেন কিছুটা হাল্কা অনুভব করলো মুহুর্তেই। কাঁন্না কিছুটা থামিয়ে করুণ ভাবে বলে,
– সত্যি?
রাজ মাথা নাড়িয়ে ‘হ্যা’ সূচক উত্তর দিলো। তারপর আলতো করে আরোহির চোখের পানি মুছে দিয়ে বলে,
– এখন চুপচাপ ফ্রেশ হয়ে মায়ের জন্য অপেক্ষা করো। আমি একটু বাইরে থেকে দেখে আসি, পরিস্থিতি কেমন।
বলেই আর এক মুহুর্ত দেড়ি না করে চলে গেলো রেজোয়ানের কাছে। এখন এক মুহুর্ত সময়ও অপচয় করা বোকামি। এক সময় সবই স্বাভাবিক হয়ে যাবে। শুধু এখন কিছু হারালে তখন আফসোস টা রয়ে যাবে।
,
,
ফ্রেশ হয়ে রুমে বসে ছিলো আরোহি। দুইটা মেয়ে টেবিলে খাবার সাজিয়ে আরোহির সামনে এসে কয়েকবার ডাকলেও কোনো রেসপন্স নেই তার। নিজের মত এক ধ্যানে বসে সময় পার করছে সে। হতাশ হয়ে রুমের বাইরে হাটাহাটি করছে একটা মেয়ে। আরেক জন গিয়ে টেবিলে খাবার গুলোতে ঢাকনা দিয়ে বসে আছে এক পাশে।
কিছুক্ষন পর আবার ফিরে এলো রাজ। টেবিলে খাবার ঢাকনা দিয়ে রাখা অবস্থায় দেখে কারণটা নিজেই বুঝে নিলো। চুপচাপ রুমে গিয়ে দেখে আরোহি বসে আছে বিষণ্ন মনে। রাজকে দেখেই উঠে তার দিকে এগিয়ে এসে বলে,
– আম্মু কোথায়? নিয়ে এসেছেন তাকে?
রাজ কিছুটা শান্ত ভাবে বলে,
– এতো ঝড় ঝামেলার মাঝে তার একটা প্রেশারে প্রব্লেম হয়েছিলো। তাই রেজোয়ান এখন হসপিটালে নিয়ে গেছে তাকে। চিন্তা করো না, সব ঠিকঠাক হলেই এখানে নিয়ে আসবে তাকে।
আরোহির অস্থিরতা বেড়ে গেলো আরো। অস্থির হয়ে বলে উঠে,
– কিন্তু আমার আম্মুর তো কোনো প্রেশারে প্রব্লেম ছিলো না। বলুন না কি হয়েছে?
রাজ কিছুটা চুপ থেকে পূনরায় বলে,
– বলেছিনা শান্ত থাকো। সব ঠিকঠাক থাকলে নিয়ে আসবে এখানে।
আরোহি এবার কিছুটা কাঁদু স্বরে বলে,
– বলুন না কি হয়েছে? বাবা কিছু করেছে তাই না? আমি জানতাম এমন কিছুই করবে। বলুন না আমার আম্মু বেচে আছে তো? তার খারাপ কিছু হয়নি তো?
আরোহির চোখে মুখে অস্থিরতার ছাপ। এই মুহুর্তে সত্যটা জানালে হয়তো আরো ভেঙে পরবে সে। তাই যতটা সম্ভব কথা ঘুরিয়ে রাখতে হবে তাকে।
রাজ নিজের মাঝে একটু হাসিখুশি ভাব আনার চেষ্টা করে আরোহির আরো কাছে এগিয়ে যায়। রাজ সামনে এসে দাড়ালে অস্থিরতা ভাব কিছুটা বিলিন হয়ে মাথা তুলে রাজের মুখের দিকে তাকায় সে।
রাজ একটু মুচকি হেসে আরোহির মুখের এক পাশে এলোমেলো চুল গুলো আলতো করে কানের পেছনে গুজে দিয়ে বলে,
– কিচ্ছু হয়নি। সব ঠিকঠাকই আছে। আর আমি যাওয়ার পর থেকে তুমি কি এখানেই বসে ছিলে শুধু? সন্ধা থেকে তো কিছুই খাওনি। মায়ের সাথে কথা বলতে হলেও তো তোমাকে সুস্থ থাকতে হয়ে তাই না। আর না খেয়ে যদি শুধু টেনশন করো তাহলে সেই সুস্থতা কোথা থেকে আসবে বলো?
আরোহি রাজের দিকে চেয়ে শান্ত গলায় বলে,
– এই মুহুর্তে আমার খেতে ইচ্ছে করছে না।
এভাবে মুখের দিকে চেয়ে আরোহির কথাটা যেন একধম বাচ্চাদের মতো মনে হলো রাজের। আচমকাই একটা মৃদু হাসি বেড়িয়ে আসে মুখ দিয়ে। মুখের দিকে চেয়ে রাজকে এভাবে হেসে উঠতে দেখে ভেতর ভেতর কিছুটা লজ্জা জাগ্রত হয় তার। আর কিছু বলতে না পেরে নিচের দিকে চোখ সরিয়ে নিলো।
রাজ আবার কিছুটা স্বাভাবিক ভাব এনে বলে,
– সুস্থ থাকতে হলে তো খাওয়া আর ঘুমটা ঠিক রাখতে হবে তাই না? চলো এখন খেয়ে তারপর চুপচাপ বিশ্রাম নিবে। সকালে উঠে মায়ের সাথে কথা বলবে। আর চিন্তা করো না, ওনি এখন একদম ভালো আছে।
আর কিছু বললো না আরোহি। চুপচাপ রাজের সাথে খাবার টেবিলের উদ্দেশ্য বের হয়ে গেলো রুম থেকে। রাজ মেয়ে একটাকে ডেকে বললো, আরোহির রুমটা রেডি করে রাখতে। আর অন্যজন খাবার টেবিলের সামনে আছে খাবার সার্ভ করে দিবে বলে।
খাওয়া শেষে রেজোয়ানকে ফোন দিয়ে আরোহির মায়ের সম্পর্কে জানতে চাইলো রাজ। সব সিকিউরিটি ঠিকঠাক রেখে কিছুটা সাইডে এসে রেজোয়ান বলে,
– এখন আই’সি’ইউ তে নিয়ে যাওয়া হয়েছে তাকে। অবস্থা তেমন একটা ভালো না। একটা মানুষ কোনো মানুষকে এতো পিটায়না। হয়তো এর চেয়ে কম মা’রে নয়তো মে’রে ফেলে। ডাক্তাররাও শিউর হয়ে কোনো নিশ্চয়তা দিতে পারছে না। এখন দেখা যাক ভাগ্য কোন দিকে যায়।
রাজ কিছুটা শান্ত থেকে বলে,
– আচ্ছা ঠিক আছে, চারপাশ টা দেখে রেখো।
তখন রেজোয়ান ঐ বাসায় যাওয়ার পর দেখে সেখানে কেউ নেই। নির্জন ও তার লোকটা হয়তো বেড়িয়ে গেছে সেখান থেকে। আরোহির মা তখন র’ক্তাক্ত হয়ে মেঝেতে পরেছিলো শুধু। নির্জন নিজের সবটা শক্তি দিয়ে মে’রে শেষে কোনো সাড়া-শব্দ না পেয়ে ম’রে গেছে ভেবে সেভাবেই রেখে দিয়ে দলবল নিয়ে চলে গেলো সেখান থেকে।
আরোহির মাকে এভাবে দেখে তারা প্রথমে ভেবেছিলো ম’রে গেছে। পরে পালস চলছে দেখে হসপিটালে নিয়ে গেলো তাকে।
দেখতে দেখতে রাত তখন ১১ টা। আরোহিকে রুমে নিয়ে গিয়ে বিশ্রাম নিতে বলে রাজ। এখনো কিছুটা অস্থিরতা রয়ে গেছে আরোহির মনে। রাজ তাকে শুইয়ে দিয়ে বিছানার পাশে হাটু-গড়ে বসে বলে,
– মাত্র রেজোয়ানের সাথে কথা হয়েছে। তোমার মা একধম সুস্থ আছে। এখন রাত হয়ে গেছে দেখে হসপিটালে এতো ঝামেলা করে এখানে নিয়ে আসতে বলিনি। কাল সকালে নিয়ে আসবে। এখন চিন্তা না করে চুপচাপ ঘুমিয়ে পরো। আর ভয় পাবেনা একদম। আমি পাশের রুমেই আছি।
To be continue…………