#ছদ্মবেশ,পর্ব ৭৯,৮০
#মেহেদী_হাসান_রিয়াদ
৭৯
কেটে গেলো কয়েকদিন। রাতভর ভারি বর্ষণ হওয়ায় বাড়ির পেছনের জমি গুলোর আল ডুবে জমি গুলো বড় বড় পুকুরের মতো মনে হচ্ছে। বাড়ির পানি গড়িয়ে জমিতে চলে গেলেও উঠোন ভিজে আছে অনেকটা।
সকালে নিবিড়ের ঘুম ভাঙলে ব্রাশ হাতে কল-পাড়ের দিকে এগিয়ে গেলো সে। কয়েকদিন থেকে সেও যেন এই বাড়ির একজন সদস্য হয়ে গেলো। এখন আর কাউকে জিজ্ঞেস করে করে কোথাও যেতে হয় না। সবটাই তার চেনা-জানা।
পিছলে পরার ভয়ে সাবধানে কল পাড়ের দিকে এগিয়ে গেলো নিবিড়। যাওয়ার সময় বড় ঘরের পাশে পাকের ঘরটায় চোখ পরলে দেখে ভাড়ি বর্ষণে প্রায়ই ভিজে গেছে ঘরটা। রান্না করার মতো অবস্থায় নেই আর।
ঘরের ভেতরে আলাদা একটা মাটির চুলো আছে। সেটার মাঝে নাস্তা তৈরি করছে আন্টি।
নিবিড় কলপাড়ে গেলে দেখে সেখানে তিশাও ব্রাশ করছে। নিবিড়কে দেখে সরে সাইডে দাড়ালো সে। নিবিড়ও ব্রাশ করা শুরু করলে তিশা পাশ থেকে বলে,
– ভাইয়া উঠেনি? নাকি এখনো নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে?
নিবিড় হেসে বলে বলে,
– নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে এখনো।
এর মাঝে তীশানে তার মা ডেকে হাতে একটা জগ দিয়ে বলে, এটাতে করে পানি নিয়ে যেতে। তিশাও সাবধানতার সাথে গুটি গুটি পা পেলে তা পানি ভরে ঘরে দিয়ে এলো।
ফিরে এলে নিবিড় মুখ ধুয়ে বলে,
– তোমাদের এখানে কি বৃষ্টি হলেই এমন হয়ে যায়?
যদিও জানার কৌতুহল জাগলো, তবুও প্রশ্ন করা শেষে কিছুটা বিভ্রান্তে পরে গেলো সে। এমন প্রশ্ন করা আদৌ ঠিক হয়েছে কি না?
কিন্তু তিশা ছোট মেয়ে এতো কিছু বুঝেনা হায়তো। ফটফট করে বলে দিলো,
– হুম, রান্না ঘরের চাল নষ্ট হয়ে গেছে। তাই ঝড় হলেই এমন ভিজে যায় সব। আমি তো মাঝে মাঝে ভাবি, আমাদের বাড়িটা যদি অনেক সুন্দর আর অনেক বড় হতো। ঐ মিমদের মতো। তাহলে কতো ভালো হতো।
কথা বলার মুহুর্তে তিশার ইশারা অনুযায়ি পাশের বাড়িটির দিকে আচমকাই চোখ চলে যায় নিবিড়ের। দেখে দোতলা বাড়ি, আকাশি কালারের রং করা।
এর মাঝে ব্রাশ নিয়ে সেখানে উপস্থিত হয় তুষার। তিশা আরো উত্তেজনা নিয়ে তুষারের দিকে চেয়ে বলে,
– ভাইয়া আমাদের বাড়িটা মিমদের বাড়ির মতো হলে ভালো হতো। তাই না?
বোনের এমন কথায় মনটা বিষণ্ন হয়ে উঠলো তুষারের। বাবা মারা যাওয়ার পর তার উপর খুব ভালো ভাবেই ভর করেছে সব কিছুর দায়িত্ব।
ঐ দিকটায় সব স্বাভাবিক হলে যোগাযোগ বাড়লো রাজ ও রুশানের সাথে। এতোদিন ব্যস্ততার কারণে কেমন একটা যোগাযোগ হয়নি তাদের মাঝে।
সকালের নাস্তা শেষে নিবিড়কে ভিডিও কল দিলো রাজ। উদ্দেশ্য তুষারের মা ও তার ছোট বোনের সাথে কথা বলা। এর আগে তুষারের মায়ের অপারেশন আরো নানার বিষয়ে তাদের কথা শুনেছিলো তুষারের মুখে। সুজুগ হয়নি দেখে কথা বলা হয়ে উঠেনি।
এখন নিবিড় ও তুষার বাড়িতে থাকায় সুজুগ পেয়ে কল দিলো রাজ।
নিবিড়ের সাথে কথা শেষে তুষার ও তার মায়ের সাথে কথা বলে সে। তিশা মায়ের পাশে দাড়িয়ে তাকে। রাজ অপরিচিত দেখে কথা বলেনি সে। রাজের সাথে রুশানও এসে বসে। তুষারের মা জানার পর সালাম দেয় রুশানও।
তুষার পাশ থেকে মাকে বলে,
– আমার আরো দুইজন বন্ধু। তোমাকে বলেছিলাম না, মোট পাঁচ জন থাকি আমরা।
আগে নিলয় সহ পাঁচ জন থাকতে থাকতে ঐ কথাই মুখ দিয়ে বেড়িয়ে যায় তার। তুষারের মাও ফোনে রাজ ও রুশানের দিকে চেয়ে হেসে বলে,
– আরোকজন কই, তাকেও ডাকো।
মুহুর্তেই হাসি বিলিন হয়ে যায় সকলের। সেই সাথে অন্য টপিক নিয়ে কথা ঘুরিয়ে নেয় রাজ।
তুষারের মায়ের সাথে কথা শেষ হলে পূনরায় নিবিড়ের সাথে কথা বলছে রাজ। কথা বলার ফাকে নিবিড়ের পেছনে থাকা তুষারদের বাড়ির আশপাশটায়ও চোখ রাখল সে।
সেই মুহুর্তে ফরিদা আন্টিও এসে বলে,
– কিরে নিবিড় বাবা, তোরা আসবি কবে? নাকি সেখানে গিয়ে আমাদের কথা ভুলেই গেলি তোরা?
নিবিড় হেসে বলে,
– ভুলিনি গো আন্টি, তবে পরিবেশের মায়ায় পরে গেছি। মুক্ত বাতাসে নিশ্বাস ফেলার জন্য যেন এই গ্রামীন পরিবেশই বেষ্ট।
ফরিদা আন্টি একটু হেসে বলে,
– তাহলে এক কাজ কর, সেখানে দুইটা মেয়ে খুজে দুজন মিলে বিয়ে করে একেবারে ঘর জামাই থেকে যা। নীলাকে না হয় অন্য কোথাও বিয়ে দিয়ে দিবো সবাই মিলে।
কথা বলেই আবারও একসাথে হেসে উঠে তারা।
,
,
ওদিকে আরোহির মা এখন অনেকটাই সুস্থ হয়ে উঠেছে। রাজ বাসা নিয়ে এসেছিলো গত কাল। মায়ের সাথেই এখন সময় কাটাচ্ছে আরোহি। যেই মানুষটাকে নিশ্চিত হারিয়ে ফেলবে ভাবেছিলো সেই মানুষটাকে আবার ফিরে পাওয়ায় আনন্দটা যেন আকাশ ছোয়ার মতোই। এই মুহুর্তে ‘মা’ তার কাছে এক অন্য রকম অনুভূতির নাম।
ভাইয়ের ফোন আসলে বেলকনিতে চলে যায় রাজ। রাজু হেলান দিয়ে বসে স্বাভাবিক ভাবে বলে,
– যা চেয়েছিলি তা তো সফল ভাবেই শেষ হয়েছে। এখন আর কতো দিন ঐ ব্যাচেলর বাসায় পরে থাকবি৷
রাজ কিছুটা আহ্লাদী স্বরে বলে,
– মায়ায় পরে গিয়েছি ভাইয়া। কি করবো বলো?
রাজু এবার অন্য হাতে ফোন নিয়ে বলে,
– বাবা ফোন দিয়েছিলো?
রাজ বলে,
– এই দু’য়েক দিন কথা হয়নি। কেন কি হয়েছে?
– সাপ্তাহ খানেক পর দেশে আসছে বাবা। মাস খানেক থাকবে দেশে। সব কিছু ঠিকঠাক করে অস্ট্রেলিয়ায় সব কিছু বিক্রি করে দেশেই তোর সাথে সব কিছু নতুন করে শুরু করবে। এরপর তোর হাতে সব কিছু বুঝিয়ে নিশ্চিত হয়ে অবসর সময় কাটাবে।
রাজ কিচুটা অবাক হয়ে বলে,
– কিন্তু বাবা তো আমায় কিছুই বলেনি এই ব্যাপারে।
– সব কিছু মিলিয়ে এখনো বছর খানেক লেগে যাবে। তাই হয়তো ভেবেছে তোকে ধীরে সুস্থে জানাবে। যাই হোক, কয়েক দিনের মাঝে ব্যাচেলর বাসা ছেরে নিজ অবস্থানে ব্যাক কর। মায়া বাড়িয়েই বা লাভ কি। বন্ধু মহল তো আমাদেরও ছিলো। এখন সবাই আলাদা হয়ে নিজেদের জীবন নিয়ে ব্যস্ত।
রাজ আর কিছু বললো না। নিশ্চুপ হয়ে রইলো কিছুক্ষন।
,
,
সব শেষে দুদিনের জন্য বাসায় ফিরলো রুশান। দাদি তার কপালে চুমু দিয়ে বলে,
– এতো বছর পর আমার কলিজা ঠান্ডা করলি ভাই। এখন ম’রে গেলেও আমার আর দুঃখ থাকবে না।
রুশান দাদিকে জড়িয়ে ধরে বলে,
– এসব কি বাজে বকছো দাদি। ম’রার কথা মাথায় আসলো কেন? আমরা সেই আগের মতোই হাসি-খুশি থাকবো।
দাদি যেন আজ খুব আবেগি হয়ে উঠেছে। রুশানকে ধরে দাদার ছবিটার দিকে তাকিয়ে বলে,
– দেখছো তুমি, আমাদের নাতি এটা। অন্যায়ের বদলা দুই যুগ পরে হলেও নিয়েছে।
দাদির এমন পাগলামি দেখে একটু মুচকি হেসে দাদিকে শান্ত করার জন্য মাথায় হাত বুলিয়ে চুপচাপ রইলো রুশান।
এর পর আরশির কাছে গিয়ে বলে,
– আরিশা আন্টিরা কি চলে গিয়েছে আবার?
আরশি স্বাভাবিক ভাবেই বলে,
– হ্যা, তারা তো গতকালই চলে গিয়েছে।
রুশান একটু ভ্রু-কুচকে বলে,
– আমি আসবো, এ কথা বলোনি তাদের?
আরশি এবার ছেলের দিকে চেয়ে বলে,
– তুই আসবি শুনার পরই রিমা জেদ ধরেছে আর থাকবে না এখানে। তাই আফাও হার মেনে চলে গেলো তাকে নিয়ে।
রুশান কিছুটা ভেবে বলে,
– রিমার হাব ভাব এমন পাল্টে গেলো কেন? সেটাই তো বুঝতে পারছি না।
আরশি আবার নিজের কাজে মন দিয়ে বলে,
– তোদের মাঝে কি হয়েছে আমি কিভাবে জানি?
রুশান কথার পিঠে কথায় বলে,
– তোমাকে বলেনি কিছু?
আরশি আবার ছেলের দিকে চেয়ে ভ্রু-কুচকে বলে,
– আমি কি তার বান্ধবি নাকি যে, আমাকে সব কিছু বলবে। এমনি এমনি তো আর এমন করছে না। এখন আমার কানের সামনে প্যান প্যান না করে গিয়ে নিজের সংসার সামলা।
রুশান টেবিল থেকে একটা আপেল নিয়ে কামড় দিয়ে বলে,
– সে কিন্তু ঢং করতে গিয়ে মাঝে মাঝে ওভার এ্যাক্টিন করে ফেলে। শুধু তোমার বোনের মেয়ে দেখে কিছু বলি না।
আরশি এবার বিরক্তির মাঝে একটু হাসির আভাস রেখে রুশানের দিকে তাকালে রুশান আপেলে আবার কামড় দিয়ে অন্য দিকে চেয়ে চুপচাপ হাটা ধরে সেখান থেকে। রিমার বিষয়টা সামনা-সামনি দেখতে হবে। এ মেয়ের ভেতর আবার কোন ভু’ত ভর করেছে।
,
,
বাইকের সাথে হেলান দিয়ে বসে আছে সাকিব। আর তুষার ও নিবিড় বসে আছে মাচার উপর। সবাই মিলে গল্প করছিলো নিজেদের মতো।
এর মাঝে একটা সুন্দরি মেয়ে সেখান দিয়ে হেটে যাওয়ার সময় তার দিকে তুষারের চোখ পরলে মেয়েটাও কিছুটা মুচকি হেসে তুষারের দিকে এক পলক তাকিয়ে সামনের দিকে হেটে চলে যায়।
তুষার হা করে অপলক ভাবে চেয়ে আছে মেয়েটার দিকে। পাশ থেকে সাকিব হাত দিয়ে তুষারের হা করা মুখটা বন্ধ করে দিয়ে বলে,
– পরোনো অভ্যাস তোকে এখনো ছারলো না।
তুষার বলে,
– তুই যেমনটা ভাবছিস, বিষয়টা মোটেও তেমন না। আমি ভাবছি অন্য কথা। তার আগে বল, এটা ফিরোজ কাকার মেয়ে না? কয়েক বছর আগে না এতটুকু দেখলাম। আর এখন আমাদের সামনে দিয়ে নাইকার পোস নিয়ে হেটে যাচ্ছে।
পাশ থেকে সাকিব হেসে বলে,
– সেই এতটুকু মেয়েটা এখন পুরা এলাকার ছেলে গুলোরে নাড়তাছে। এই যে এই মাত্র তোর দিকে চেয়ে মিষ্টি হেসে একটা পোস নিলো না? এই হাসি দিয়ে এলাকার পোলাপাইন গুলোরে পাগল করে এখন আঙুলের ইশারাশ নাড়তেছে। কয়দিন আগে বিচার বসছিলো তাকে নিয়ে, মেম্বারের ছেলে হৃদয়ের সাথে প্রেম করে নাকি ওর থেকে ফোন, লেপটপ, টাকা, আরো অনেক কিছু নিয়ে এরপর ব্রেকআপ করে দিলো। এরপর বলে হৃদয়কে নাকি এই মেয়ে চিনেও না। তো এবার চিন্তা কর, একটু খানি মেয়ে কোন লেভেলে চলে গেছে। এখন মামা তুমি এই বারো **** হাসিতে পাগল হলে তোমাকেও তুরুলার মতো নাচাইবো। সো সাবধাম।
তুষার বিষয়টা মাছি তাড়ানোর মতো করে উড়িয়ে দিয়ে বলে,
– আসতাগফিরুল্লাহ্, মাইয়ার অভাব পরছে নাকি দেশে?
পাশ থেকে সাকিব হেসে বলে,
– তা তোমার প্রথমে হা করে তাকিয়ে থাকা দেখেই বুঝছি। তাই আগেই সাবধান করে দিলাম।
,
,
অনেক দিন গ্রামে সময় কাটানো শেষ হলে ঢাকায় ব্যাক করার প্রস্তুতি নিচ্ছে তারা। পরিষ্কার আকাশে হুট করে কালো মেঘে ছেয়ে গেলে যেমনটা দেখায় ঠিক তেমনই মনে হচ্ছে তুষারের মা ও তিশার চেহারা দেখে। বিদায়ের সময়টায় সকলের মনই বিষণ্ন থাকবে এটাই স্বাভাবিক নয় কি?
তিশার বিষণ্ন মন দেথে তুষার তার সামনে বসে গালে আদর করে দিয়ে বলে,
– মন খারাপ করিস না, কয়দিন পর আবার আসবো। এখন শুধু দুষ্টুমি না করে সুন্দরে পড়াশুনা করবি।
তিশা মাথা কাত করে ‘হ্যা’ সূচক সম্মতি জানিয়ে বলে,
– আসার সময় এই ভাইয়াটাকেও নিয়ে আসিও আবার।
পাশ থেকে এবার নিবিড়ও বসে তিশার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
– হ্যা অবশ্যই আসবো। এর পরে আসলে আরো বেশি দিন থাকবো।
যদিও এটা মিথ্যা শান্তনা তবুও তিশার মুখে হাসি ফুটে উঠলো। খুশিতে নিবিড় ও তুষার দুজনের গলাই এক সাথে জড়িয়ে ধরলো সে। কারো সাথে খুব মিশে যাওয়ার পর বিদায়ের মুহুর্তটা সত্যিই অনেক কষ্টের। কারো বা চোখের কোনে জমা হয় পানি। তবুও বিদায় নিতে হয় হাসি মুখে। কারণ দুনিয়াটাই যে চিরস্থায়ী না, ক্ষনস্থায়ী।
To be continue………..
#ছদ্মবেশ (পর্ব ৮০)
#মেহেদী_হাসান_রিয়াদ
– কে আপনি? অনুমতি না নিয়ে আমার রুমে প্রবেশ করেছেন কেন?
কাঁপা স্বরে কথাটা বললো নীলা। সামনে থাকা লোকটা তার দিকে এক পা একপা এগিয়ে এলে ভয়ে গলা শুকিয়ে আসে তার। কয়েক পা পিছিয়ে গেলে পেছনের দেওয়ালের সাথে পিঠ ঠেকে যায় তার। ভয়ে নিশ্বাস উঠা নামা করছে তার।
এই লোকটা রুমে প্রবেশ করার একটু আগেই কারেন্ট চলে গিয়েছিলো। আজিব তো, লোকটা রুমে আসার আগেই কারেন্ট চলে যেতে হলো, নাকি কারেক্ট চলে যাওয়ার পর লোকটার রুমে আসতে হলো?
কাহিনি কি, বাইরের বিল্ডিং গুলো তে তো ঠিকই কারেন্ট আছে। তাহলে এখানে চলে গেলো কেন? এটা কোনো পরিকল্পনা মাফিক করছে না তো কেউ? ভয়ে আবারও শুকনো ঢোক গিললো নীলা।
আবছা আলোয় লোকটার চেহারাও দেখা যাচ্ছে না ভালো করে।
নীলা এবার ভয়ে কাঁন্না করে দিয়ে জোড়ে জোড়ে হেল্প হেল্প করে চিৎকার দিয়ে উঠতেই নিবিড় হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরলো তার। আর ফিসফিসিয়ে বলে যে, আমি অন্য কেও না। এবাবে চিৎকার করে বাকি ভাড়াটিয়াদের হাতে মা’র খাওয়াবে নাকি?
নিবিড়ের গলা শুনে নীলার ভয় কাটলো কিছুটা। বুকের ভেতর ধুকধুক শব্দটা এখনো কমেনি একটুও। নীলাকে চুপ থাকতে দেখে নিবিড় কিছুক্ষনের মাঝে একটা মোমবাতি জ্বালিয়ে তা দুজনের মাঝখানে ধরে একটু হেসে উঠলো সে। নীলা এখনো গম্ভির হয়ে চেয়ে আছে নিবিড়ের দিকে। মনে হচ্ছে যে কোনো মুহুর্তেই আ’ক্রমন করে বসবে সে।
যা দেখে নিবিড় মোমবাতি হাতে নিয়ে হাসতে থাকলে নীলা রেগী দৃষ্টিতে চেয়ে বলে,
– এগুলো কেমন মজা?
নিবিড় হাসি থামিয়ে বলে,
– ভয় পেয়েছো?
নীলা এবার বিষণ্ন গলায় বলে,
– এমন মজা কেউ করে?
নিবিড় আবার হেসে এক হাতে নীলাকে বুকে টেনে নিয়ে বলে,
– আচ্ছা স্যরি। এভাবে ভয় দেখানো আমার উচিৎ হয়নি।
নীলা চুপ করে থাকলে নিবিড় আবার বলে,
– স্যরি বললাম তো।
নীলা এবার শান্ত ভাবে বলে,
– কখন এসেছো? আর আসার আগে আমায় বলোনি কেন?
নিবিড় এবার মোম বাতিটা সাইডে রেখে বলে,
– ভেবেছিলার সারপ্রাইজ দিবো। কিন্তু তার আগেই তো তুমি ভয়ে ফিট। বাদ দাও ওসব, আঙ্কেল আসেনি এখনো?
– না আট টার পর আসবে।
নিবিড় একটা স্বস্থির নিশ্বাস ছেরে বলে,
– আচ্ছা ভালোই হলো, তুমি দাড়াও আমি বিদ্যুতের লাইনটা আবার অন করে দিয়ে আসি।
নীলা চোখ বড় বড় করে বলে,
– তার মানে তুমি লাইন অফ করেছো? অন্য ভাড়াটিয়ারা জানলে কি করবে বুঝতে পারছো?
নিবিড় একটু ভাব নিয়ে সেদিকে হাটতে হাটতে বলে,
– কি আর করবে, একটু বকাঝকা করবে? বেশি হলে বিদ্যুৎ অফ করা আর এভাবে একটা মেয়ের ঘরে প্রবেশ করা, সব মিলিয়ে একটু মা’রবে। এর চেয়ে বেশি কিছু তো হওয়ার চান্স নেই। আর প্রেম করতে গেলে একটু আধটু মা’র খাওয়া লাগে। তাহলে ভালোবাসা আরো মজবুত হয়।
নীলা একটু কৌতূহল নিয়ে বলে,
– কিভাবে মজবুত হয়?
নিবিড় তার দিকে ফিরে বলে,
– তখন তোমারও একটু মায়া হবে যে, ইশ ছেলেটা আমার জন্য কতো মা’র খেয়েছে। এর পর আমার কাছে এসে বলবে, বাবু তুমি ব্যাথা পাও নি তো? এরপর আমি সুন্দর একটা ডায়লগ দিবো যে, তোমার জন্য সব সহ্য করতে পারি। এরপর তুমি আরো খুশি হয়ে আমার শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলবে, আই লাভ ইউ বাবু।
নিবিড়ের এমন কথায় হাসি পাচ্ছে নীলার। তবুও হাসি দমিয়ে রেখে বলে,
– এখন পিঠে মা’র পরার আগে, তাড়াতাড়ি গিয়ে কারেন্টের লাইন দিয়ে আসো।
,
,
এদিকে আরিশা আন্টিদের বাসায় গেলো রুশান। রিমার রুমের সামনে গেলে দেখে এয়ার ফোন দিয়ে গান শুনছে নাকি মুভি দেখছে সেটা সে জানে। চুপচাপ রিমার পাশে গিয়ে বসে রুশান।
রুশানকে দেখে কান থেকে এয়ারফোন টা খুলে এক পাশে রেখে অভিমানি গলায় বলে,
– কেন এসেছেন এখানে?
রুশান দুই পা মেঝেতে রেখে বাকি শরির নিয়ে চিৎ হয়ে রিমার পাশে শুয়ে বলে,
– নানান বিষয়ে পড়াশুনা করতে করতে একটা বিষয়ে সেদিন খুব ভালো করে পড়লাম। সেটা হলো বিভিন্ন ধরণের পা’গলদের বৈশিষ্ট্য। যেমন ধর পা’গল তো অনেক প্রকার হয়। এর মাঝে কিছু পা’গল আছে যারা মানসিক ভারসাম্য ঠিক থাকলেও মাঝে মাঝে একটু বেঠিক হয়ে যায়।
কথা বলতে ইচ্ছুক না হলেও রুশানের বলার মাঝে রিমা ভ্রু-কুচকে বলে,
– ওয়েট, আমাকে কি ইন-ডিরেক্টলি কিছু বলছেন?
রুশান এবার থেমে গিয়ে বলে,
– তোকে ইন-ডিরেক্ট লি বলার কি আছে? তুই পা’গল হলে তোকে ডিরেক্টলিই বলতাম।
রিমা আর কিছু না বলে চুপচাপ রইলো। রুশান আবার বলে,
– এর মাঝে ছোট একটা বৈশিষ্ট্য পেলাম যে, কিছু পা’গল অজথাই রাগ করে বসে। যেই রাগের কারণ তারা নিজেও জানেনা। এই মানসিক প্রব্লেমটা অল্প অল্প করে শুরু হয়। তাই এখন তোর জন্য কিছুটা টেনশন হচ্ছে আমার। যত যাই হোক, আমার একটা মাত্র বৌ। সে যদি পা’গল হয়ে যায়, তাহলে কি আমার মান সম্মান থাকবে বল?
রুশান সুন্দরে সব বললেও রিমা ঠিকই বুঝতে পারছে যে, রুশান তাকেই পা’গলের সাথে খোচা মে’রে কথা বলছে। তাই চোখ ছোট ছোট করে এক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে রুশানের দিকে।
রুশান এবার ওসব কথা থামিয়ে বলে,
– এখন বল তুই কেন রাগ করেছিস? রাগের কারণ টা নিজে জানিস তো?
রিমা বিপাকে পরে বলে,
– আমি কি বলেছি, যে আমি রাগ করেছি?
রুশান এবার উঠে বসে বলে,
– তাহলে কি আমি এতোক্ষণ অজথাই বকবক করলাম? আমি আরো ভাবলাম তুহ রাগ করে আছিস কিছু গিফ্ট দিয়ে, সুন্দর সুন্দর কথা বলে তোর রাগ ভাঙাতে হবে। যাই হোক রাগ যেহেতু করিস নি তাহলে এসব করার কোনো প্রয়োজনও নেই।
রিমা চট করে আবার বলে,
– আমি তো এটাও বলিনি যে, আমি রাগ করিনি। এতো কিছু হয়ে গেলো, বাট এতো কাছের মানুষ হয়েও আমি কিছু জানতাম না। সেদিন জানলাম তুমি পুলিশে জব করো। এর এখন দেখি এতো কিছু। একে তো আমাকে কিছুই বলোনি, এর মাঝে যোগাযোগও বন্ধ রেখেছিলে। দিনে একবারও ফোন দাও নি। তো আমার কেমন লাগার কথা, তুমিই বলো। সেই হিসেবে আমি অবশ্যই রাগ করেছি। আর সেই রাগ ভাঙানোটা তোমার কর্তব্য।
রুশান কিছুটা ভাবের মাঝে থেকে বলে,
– রাগ তো অলরেডি ভেঙেই গেলো। তো নতুন করে আবার এতো ন্যাকামি করার কি দরকার?
রিমা অবাক হয়ে বলে,
– কিভাবে? আমার রাগ ভাঙলো আর আমিই জানিনা?
রুশান এবার মুচকি হেসে রিমার গাল টেনে দিয়ে বলে,
– রাগ ভেঙেছে বলেই তো আপনি থেকে তুমিতে সম্বোধন করলি। এখন আর ন্যাকামো না করে রেডি হয়ে নে, আজ বাইরে ডিনার করবো। তারপর রাতের শহর টা ঘুরে দেখাবো তোকে।
রিমা মুহুর্তেব সব রাগ ভুলে হকচকিয়ে বলে উঠে,
– সত্যিই?
রুশান এবার দাড়িয়ে বলে,
– হুম তাড়াতাড়ি কর। আর পাশেই তোর যেন কোন বান্ধবি আছে, প্রীতি না কি নাম? তাকেও ডেকে নিস। সে আবার খুব সুন্দর সুন্দর কথা বলে। মিষ্টি মিষ্টি কথা গুলো শুনতেও ভালো লাগে।
রিমার হাস্যজ্জল মুখ আবারও গোমড়া করে বলে,
– যাবোনা আমি।
রুশান বুঝেও না ভুঝার ভান করে বলে,
– ওমা কেন?
রিমা আবার রাগি চোখে চেয়ে বলে,
– সব সময় আমার একটা আনন্দের মাঝে পানি ঢেলে দেওয়াটা আপনার জন্মগত অভ্যাস।
রুশান আবার বলে,
– আমি আবার কি করলাম?
রিমা রাগি ভাবেই বলে,
– কিছুই করেন নি। কোথাও যাবো না আমি।
রুশান চুপচাপ বাইরের দিকে পা বাড়িয়ে বলে,
– কেউ যেতে না চাইলে আর কি করার? জোর করে নিয়ে যাওয়াটাও অন্যায়। আমি বরং চলেই যাই।
মুহুর্তেই পেছন থেকে রিমা আবার ডেকে বলে,
– আমি রেডি হচ্ছি।
,
,
রাজের বাবা আরোহিকে দেখে গম্ভির ভাবে রাজের দিকে চেয়ে বলে,
– মেয়েটা কে?
রাজ যদিও আরোহির বিষয়ে কখনো বাবাকে বলেনি তাই কিভাবে বলবে তা ভেবে চুপ করে আছে। এর মাঝে পাশ থেকে রাজের ভাই রাজু বলে,
– ওর নাম ‘আরোহি’ বাবা। যার কথা তোমায় বলেছিলাম।
আরোহি দাড়িয়ে আছে চুপচাপ রাজের পাশে। রাজের বাবা পুনরায় রাজের দিয়ে চেয়ে বলে,
– আজ এতো এতো নার্ভাস মনে হচ্ছে তোমাকে? আর দাড়িয়ে আছো কেন? বসো দুজন।
বাবাকে না জানিয়ে নিজের জন্য মেয়ে খুজে রাখায় বাবার সামনে কিছুটা নার্ভাস ছিলো রাজ। শেষে বাবার পজেটিভ রি-একশান দেখে কিছুটা স্বস্থি নিয়ে বাবার পাশে বসে সে। বাবা গম্ভির হলেও মা এতোটা গম্ভির না তার। হাসি মুখে আরোহিকে ডেকে তার পাশে নিয়ে বসালো সে। রাজু আগেই তাদের ব্যাপারে সবটা বলে রেখেছিলো বাবা-মা কে। আরোহির দিকে চেয়ে মিষ্টি করে হেসে বলে,
– প্রথমে ভেবেছিলাম, না জানি আমার ছেলে কেমন মেয়ে পছন্দ করেছে। তবে এখন কিছুটা নিশ্চিত হলাম। তোমার বিষয়ে সবই শুনেছি আমি। তো তোমার মা কেমন আছে এখন?
এতো কোলাহলের মাঝে আরোহি এভাবে খুব কমই কথা বলেছে। তাই কিছুটা নার্ভাস হয়ে বলে,
– জ্বি আন্টি, ভালো আছে এখন।
রাজের মা আরোহির এমন অবস্থা দেখে একটু হেসে বলে,
– সব না হয় ঠিকই আছে, বাট তুমি এভাবে কাঁপছো কেন?
পাশ থেকে রাজ বলে,
– ও এসবে অভ্যস্ত নয় মা, সব কিছু মানিয়ে নিতে একটু সময় লাগবে।
এদিকে নিবিড় ও তুষার রাজের দেওয়া ঠিকানা অনুযায়ি পৌছে গেলো। রুশান বললো তার ফিরতে হয়তো পরদিন হয়ে যাবে। তাই আপাতত নিবিড় ও তুষারকে আসতে বললো রাজ। বাবার সাথে তাদের পরিচয় করে দিবে। এর পর ফরিদা আন্টি ও বাকি সবাইকে ইনভাইট করে নিয়ে আসবে এখানে।
বড় বাড়িটার সামনে নেমে নিবিড় ও তুষার চার পাশে চোখ বুলিয়ে দেখে গার্ডদের সাথে নতুন করে কিছু পুলিশও যোগ হয়েছে আজ। নিবিড় কিছুটা নার্ভাস হয়ে বলে,
– ভাই এতো পুলিশ এভাবে ঘুরঘুর করছে কেন? কোনো ঝামেলা হয়েছে নাকি?
তুষার কথাটা উড়িয়ে দিয়ে বলে,
– আরো না, পুলিশ এসেছে রাজের ভাইয়ের সাথে। রাজনৈতিক লোক হওয়ায়, কোথাও গেলে পুলিশ গার্ড দেয় তাকে।
নিবিড় এবার একটা স্বস্থির নিশ্বাস ফেলে বলে,
– আমি ভাবলাম আরো কি না কি? আমাদের এভাবে যাওয়া কি ঠি হবে? ভেতরে দেখছি সব উচু শ্রেনীর লোকজন। আমার ভয় হচ্ছে আমারা এভাবে গেলে না জানি আবার আমাদের বের করে দেয়।
তুষার একটু মুক কুচকে বলে,
– ধ্যাৎ, বাজে বকিস কেন? রাজ আসতে বলেছে না আমাদের। দাড়া রাজকে একটা কল দিই। তাহলে দেখবি সব ঠিকঠাক।
এর মাঝে একজন গার্ড প্রশ্ন করে,
– আপনারা কি ভেতরে যাবেন?
নিবিড় একটু জোর করে হাসির রেখা টানার চেষ্টা করে বলে,
– না আমরা এখানেই ঠিক আছি।
কিছুক্ষন পর বাইরে আসে রাজ। দুজনকে এভাবে দাড়িয়ে থাকতে দেখে বলে,
– কিরে ভেতরে না গিয়ে এখানে আহাম্মকের মতো দাড়িয়ে আছিস কেন দুজন?
তুষার কিছু বলতে গেলেও তার আগে নিবিড় আগ বাড়িয়ে বলে,
– একটু নার্ভাস ফিল হচ্ছিলো তাই যাওয়ার সাহস পাহনি। আর এতো বড় বড় মানুষদের মাঝে অজথা আমাদের নিয়ে আসার কি প্রয়োজন ছিলো বল।
রাজ কিছুটা অবাক হয়ে বলে,
– মানে কি?
নিবিড় আবার বলে,
– তুই বিষয়টা একটু ভেবে দেখ, এই মানুষ গুলোর সামনে বা আঙ্কেলের সামনে আমাদের বন্ধু বলে পরিচয় করিয়ে দিলে তারা কি ভাববে? হয়তো তারা মুখে কিছু বলবে না, তবে নিশ্চই তারা বিষয়টা ভালো চোখে নিবে না। বিষয়টা তোর জন্যও লজ্জার।
পাশ থেকে তুষারও তাল মিলালো নিবিড়ের কথার সাথে। সত্যিই তো, রাজে স্ট্যাটাস অনুযায়ি তার বন্ধু হওয়ার কথা, তার মত বড় বড় বিজনেসম্যান রা। এমন সাধারণ ছেলে রাজের বন্ধু বিষয়টা তো সত্যিই সবার কাছে হাস্যকর হয়ে উঠবে।
পাশ থেকে রাজ এক দৃষ্টিতে তাদের দিকে চেয়ে বলে,
– এতো দিনে এই চিনলি আমায়? যাই হোক এসব দেখে যেহেতু বন্ধুর পরিচয় দিতে লজ্জা হচ্ছে তোদের। তাহলে চলে যা দুজন। আমি বাধা দিবো না। তবে আর কখনো আমার সামনে আসতে পারবি না। পারবি শর্ত মানতে? পারলে চলে যা।
To be continue………