#ছদ্মবেশ (পর্ব ৮১)
#মেহেদী_হাসান_রিয়াদ
দহনের দিন শেষ হতেই যেন মাঝখানের কিছু সময় খুব তাড়াতাড়িই কেটে গেলো। সুন্দর সময় গুলো মনিতেই কেটে যায় চোখের পলকে। শুধু দুখের সময়টাই যেন থমকে থাকে।
নীলার মুখের সামনে উড়তে থাকা চিকন চুল গুলো নিবিড় আলতো করে কানের পেছনে গুজে দিয়ে বলে,
– আমার বাবা-মায়ের সাথে তোমায় পরিচয় করিয়ে দিবো আজ।
নিবিড়ের কথায় কিছুটা ভ্রু কুচকে তাকালো নীলা। একটু অবাক হয়ে বলে,
– তুমি না বললে তোমার বাবা-মা নেই!
নিবিড় মুখে কিছুটা গম্ভিরতা এনে বলে,
– এমন ভাবে বলছো যেন আমার বাবা মায়ের কথা শুনে তুমি খুশি হওনি?
নীলা এবার আরো অবাক হয়ে বলে,
– আজব তো, আমি সে কথা আবার কখন বললাম? আমি যাস্ট এটা জানতে চেয়েছি যে, তুমি বললে তোমার কেউ নেই। এখন বলছো বাবা-মায়ের কথা। এটাই জানতে চেয়েছি যে কেউ না থাকলে বাবা-মা এলো কোথায় থেকে? তুমি এটাকে অন্য ভাবে নিচ্ছো কেন? বাবা-মা তারাও একটা রহমত। তাদের কথা শুনে আমি খুশি হবো না কেন? সংসারে বাবা-মা নামক দুটো সাপোর্টার থাকলে তো আমাদের জন্যই তা আনন্দের, তাইনা?
নিবিড় এবার শান্ত ভাবে বলে,
– তোমার সাথে কি কখনো আমার আমার জীবনের গল্পটা শেয়ার করেছিলাম?
নীলা মাথা নাড়িয়ে জবাব দেয়,
– হুম,,,,
নিবিড় আবার বলে,
– তাদেরকেই অনেক কষ্টে খুজে পেয়েছি আমি। আমার ভাবনাটাই ভুল ছিলো। ভেবেছিলাম আমার বাবা মা হয়তো ছোট বেলায় আমার রাস্তায় ফেলে গিয়েছিলো। কিন্তু হয়েছে ঠিক তার উল্টো টা। একটা এক্সিডেন্টে আলাদা হয়ে গিয়ছিলাম আমরা। ছেলে হারানোর শোক তারাও বয়ে বেড়িয়েছিলো এতো বছর।
নীলা আবার বলে,
– তাহলে চিনলে কিভাবে যে ওরা তোমার বাবা-মা?
নিবিড় এবার একটা নিশ্বাস ছেড়ে বলে,
– অনেক কষ্টের পর সব কিছু শিউর হয়েই খুজে পেয়েছি। আর সেই অবদান টা হলো আমার ছোট বোন ফারিহা। তার সূত্র ধরেই বাবা-মা অব্দি পৌছাতে পেরেছি আমি।
নীলা একটু কৌতূহল নিয়ে বলে,
– এই ফারিহাটা আবার কে?
নিবিড় হেসে বলে,
– তোমার হবু ননদ। সেখানে গেলেই দেখবে।
নীলা আবার বলে,
– কবে যাচ্ছি আমরা?
– আগামি কাল। আমরা সবাই যাচ্ছি কালকে। এরপর বাবা মায়ের সাথে তোমার পরিচয় করিয়ে দিবো যে, এই দেখুন আপনাদের ছেলে একটা এঞ্জেলকে ধরে এনেছে। তাকে এখন থেকে খুব যত্ন সহকারে বন্ধি করে রাখবেন, নাহলে হুট করে আবার ডানা মেলে উড়ে চলে যেতে পারে।
মুহুর্তেই নিবিড়কে ধরে হাসিতে মেতে উঠলো নীলা। নিবিড়ও হেসে বলে,
– কেন আমি কি মিথ্যা বলেছি নাকি? যদিও মাঝে মাঝে এমনই মুখ ফসকে মিথ্যা কথা বেড়িয়ে যায়। তবে মিথ্যা বললেও কিন্তু আমি মিথ্যুক নই।
নীলা কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে বলে,
– আচ্ছা বুঝলাম, তবে আমার তো আরেকটা টেনশন ঢুকে গেলো মাথায়।
নিবিড় বলে,
– কি সেট?
নিবা কিছুটা চিন্তিত হয়ে বলে,
– বিয়ে পর তো আমরা তোমার বাবা-মায়ের সাথেই সেখানে থাকবো তাই না?
নিবিড় স্বাভাবিক ভাবে বলে,
– অবশ্যই তাদের সাথে থাকবো। এতো বছর পর তাদের খুজে পেয়েছি। বাকি জীবনটা আর এক মুহুর্তরজন্য তাদের থেকে আড়াল হবো না।
নীলা আবার বলে,
– তাহলে আমার বাবা? সে তো একা হয়ে যাবে। তার কি হবে?
নিবিড় এবার একটু মুচকি হেসে বলে,
– তার জন্য আমার মাথায় দারুণ একটা বুদ্ধি এসেছে। অনেক আগে থেকেই এই ব্যাপারে ভাবছি আমি।
নীলা ভ্রু নাচিয়ে বলে,
– কি সেটা?
নিবিড় চট করে বলে,
– তোমার বাবাকে আরেকটা বিয়ে করাবো।
নীলা এবার রেগে গিয়ে বলে,
– এসব বিষয়ে ফাজলামি আমি একধম পছন্দ করি না।
নিবিড় স্বাভাবিক ভাবেই বলে,
– তোমার কি মনে হচ্ছে আমি ফান করছি?
নীলা আবার বলে,
– তাই বলে কি আমি এই বয়সে আরেক মহিলাকে মা ডাকবো?
নিবিড় এবার মুখে একটা ‘চ’ সূচক শব্দ করে বলে,
– আরে আমার পুরো প্ল্যানিংটা শুনো আগে।
– আচ্ছা বলো, কি প্ল্যান?
নিবিড় বলে,
– ফরিদা আন্টিকে তোমার কেমন লাগে।
নীলা স্বাভাবিক ভাবেই বলে,
– কেমন লাগবে, মায়ের মতোই লাগে। মুরুব্বি না আমাদের?
নিবিড় এবার যুক্তিতে এসে বলে,
– রাজ আর রুশান তো প্রায় এখন ফ্যামিলির সাথেই সময় কাটাচ্ছে। এখানে আছি শুধু আমি আর তুষার। পড়াশুনা শেষে আমরাও নিজেদের মতো চলে যাবো। এরপর ফরিদা আন্টিও একেবারে একা হয়ে যাবে। তারপর তোমার বিয়ে পর তোমার বাবাও একা হয়ে যাবে। তো এই ফাকে যদি আমরা তাদের বুঝিয়ে দুজনকে এক করে দিতে পারি, তাহলে তো আর তারা একা হবে না তাই না। তখন সম্পর্কে ফরিদা আন্টির মেয়ের জামাইও হবো আমি। শশুর বাড়ির সাথে সবার মাঝে যোগাযোগ থাকলো। তারাও শেষ বয়সের সঙ্গি পাবে আর আমরাও নিশ্চিন্ত হবো। বাইরের থেকে বৌ খুজতে হলো না। নিজেদের মাঝেই সবকিছু ঠিকঠাক থাকলো। বুঝোনি বিষয়টা?
নীলা এবার কিছুটা ভেবে বলে,
– খারাপ বলোনি বিষয়টা। তবে ফরিদা আন্টি অথবা বাবা তারা কি রাজি হয়ে এই বিষয়ে?
নিবিড় বলে,
– তুমি তোমার বাবাকে বিষয়টা বুঝিয়ে বলবে, আর আমরা সবাই মিলে ফরিদা আন্টিকে বুঝিয়ে বলবো। চেষ্টা করতে দোষ কথায় বলো। আর আমরা তো তাদের ভালোর জন্যই করছি তাই না। এমন তো না যে এতে তাদের কোনো ক্ষতি হয়ে যাবে। এতে বরং শেষ বয়সের সঙ্গি পাবে তারা।
,
,
পরদিন রাজ-রুশান সহ নিবিড়দের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিচ্ছে সবাই। নিবিড়ের পরিবারের কথা শুনতেই তারাও দেখার আগ্রহ নিয়ে ব্যাস্ততার মাঝে সময় বের করে নিয়েছে যাওয়ার জন্য।
প্রথমে নিবিড় বাবা-মায়ের কথা বললে নীলার মতো বাকি সবার চোখই কপালে উঠে গেলো। শুধু তুষার ছারা। কারণ সে আগেই সব জানতো। নিবিড় নিষেধ করেছে বলে কাউকে বলেনি সে।
নিবিড়ের ফোনটা বেজে উঠলে তুষার তা হাতে নিয়ে দেখে ফারিহা নামে সেভ করা। নিবিড় তখনও ওয়াশ রুমে। দরজায় টোকা দিয়ে তুষার ‘ফোন এসেছে’ কথাটা নিবিড়কে বললে নিবিড় ভেতর থেকে বলে,
– কার ফোন।
তুষার বলে,
– তোর বোন ফোন দিয়েছে।
নিবিড় আবার বলে,
– রিসিভ করে বল, আমরা বের হয়েছি।
এর মাঝে তুষার রিসিভ করার আগে কেটে গেলো ফোন টা। পুনরায় কল আসতেই তুষার তা রিসিভ করে। ওপাশ থেকে ফারিয়া বলে,
– কতটুকু এসেছো ভাইয়া?
এপাশ থেকে তুষার বলে,
– আপনার ভাইয়া তো ওয়াশ রুমে।
ফারিহা অবাক হয়ে বলে,
– একটু আগেই তো আমাকে বললো বের হচ্ছে, এখন বলছেন ওয়াশরুমে? বাই দ্যা ওয়ে, আপনি কে?
তুষার একটু হাসি মুখে বলে,
– আমি তুষার, ঐ যে নিবিড়ের সাথে একবার গিয়েছিলাম?
ফারিয়া চিনতে পেরে বলে,
– ওহ্ আচ্ছা, তাড়াতাড়ি রওয়া দিতে বলুন। আর ভাইয়া বের হলে বলবেন আমায় কল দিতে।
বলেই কেটে দিলো ফারিয়া। কিছুক্ষন পর ভেতর থেকে বেড়িয়ে আসে নিবিড়। মাথা মুছতে মুছতে বলে,
– কি বলেছিস?
তুষার বলে,
– বলেছি তুই ওয়াশরুমে।
নিবিড় একটু রাগি ভাব নিয়ে বলে,
– তোকে না বললাম, আমরা বের হয়েছি এটা বলতে।
তুষার নিবিড়ের দিকে চেয়ে বলে,
– আমার কি দোষ বল, মেয়ে মানুষের কন্ঠ শুনে সত্য-মিথ্যা গুলিয়ে ফেলছি।
দুপুরের আগে সবাই পৌছে গেলো নিবিড়দের বাড়ি। বাড়িটা এতো বড় না হলেও সুন্দর ভাবেই সাজানো। দেখতেও মনোমুগ্ধকর।
বাসায় প্রবেশ করার পর বাবা মায়ের সাথে সকলের পরিচয় করিয়ে দিলো নিবিড়। এরপর আতিথিয়েতা শেষে সবাই কথা বলছে নিজেদের মতো।
বিশেষ করে নীলা। যাকে নিবিড়ের বাবা-মা, ফারিহা সকলেরই পছন্দ হয়েছে আজ। মূল কথা, নিবিড় যার সাথে হ্যাপি থাকবে তাকেই তারা ঘরের বৌ করে তুলবে। একমাত্র ছেলেকে এতো বছর পর ফিরে পাওয়ায় তার সব কিছুই যেন খুবই গুরুত্বপূর্ণ তাদের কাছে।
দুপুরের খাওয়া দাওয়া শেষে বিকেলের দিকে। বন্ধুরা মিলে বাড়ির চার পাশ টা ঘুরে দেখতে লাগলো। তুষার চার পাশে চোখ বুলাতে গিয়ে দেখে দরজার সামনে থেকে ফারিহা তাকে কিছু একটা বলছে। তবে আস্তে বলছে দেখে স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে না সে।
তাই সে কিছুটা সামনে এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলে ফারিহা রাগি লুক নিয়ে বলে,
– কানে কম শুনেন নাকি? বলছি ওদের সবাইকে নিয়ে ভেতরে আসুন চা বানিয়ে রেখেছি দেড়ি করলে ঠন্ডা হয়ে যাবে।
তুষার ও কিছুটা রেগে যাওয়ার ভাব নিয়ে বলে,
– যেহেতু বলেছেনই কানে কম শুনি, তাহলে আপনিই গিয়ে বলে আসুন। আমি কিছু শুনতে পাই নি।
ফারিহা একটু বিরক্তি প্রকাশ করে বলে,
– আরে কেন বুঝতে পারছেন না, ঐ নতুন ভাইয়া গুলোকে কি আমি চিনি? ভাইয়ার সাথে ওদেরকে ওখানে গিয়ে ডাকতে কেমন যেন লাগছে। তাই তো আপনাকে বলছি ডেকে দিতে।
তুষার এবার কৌতূহল হল নিয়ে বলে,
– তাহলে আমাকে কেন বলছেন? আমিও তো তাদের মতো পরপুরুষ। তো আমার সাথে কথা বলতে কেমন কেমন টা লাগছে না?
ফারিহা আবার বলে,
– আপনাকে তো আগে থেকেই চিনি। ধুর আপনার সাথে কথা বলাটাই সময় অপচয় হচ্ছে। ভাইয়াকে ফোন দিয়ে বললেই তো হয়। সহজ বুদ্ধি গুলো কেন যে আগে মাথায় আসে না, আজব।
তুষার বলে,
– লাভ নেই, নিবিড় ফোন ঘরে ফেলে গেছে।
ফারিহা আবারও হতাশ হয়ে বলে,
– আচ্ছা এখন এতো কথা না পেচিয়ে যায় তো, তাদের ডেকে আনুন।
তুষার একটু ভাব নিয়ে বলে,
– ডাকবো যদি আপনি আপনার প্রথমের ব্যাবহারের জন্য অনুতপ্ত হয়ে স্যরি চান।
ফারিয়া এবার একটা হতাশার নিশ্বাস ছেরে বলে,
– আচ্ছা ভাই স্যরি। আমার বিরাট বড় অন্যয় হয়েছে আপনাকে বয়রা বলায়। এখন দয়া করে যাবেন প্লিজ।
তুষার হেসে বলে,
– এমন মিষ্টি করে বললে আরো আগেই যেতাম।
,
,
সন্ধায় রুমে বসে বন্ধু মিলে নানান টপিকে আড্ডা দিচ্ছে কিছুক্ষন যাবৎ। এর মাঝে নতুন একটা টপিক যোগ হলো ফরিদা আন্টি ও নীলার বাবার বিয়ের বিষয়ে। চার বন্ধুর মাঝে কথা উঠলে নিবিড় সবটা খুলে বলে তাদের যে, এক সময় তারা থাকবে না। নিজেদের জীবন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যাবে সবাই। নীলাও শশুর বাড়িতে চলে আসবে। মাঝখানে ফরিদা আন্টি ও নীলার বাবা দুজনই একা হয়ে যাবে। শেষ বয়সে সময় কাটানোর জন্য হলেও তাদের সঙ্গি প্রয়োজন। এতোদিন বাড়িটা পরিপূর্ণ ছিলো তাই হয়তো এসব শুন্যতা অনুভব করেনি তারা। সবাই নিজেদের মতো চলে গেলে ঠিকই সেই শুন্যতাটা অনুভব করবে তারা। সেই সাথে আমাদের যোগাযোগটাও আরো গভির হলো তাদের সাথে।
নিবিড়ের রুশানও একমত জানান। সত্যিই তো একা একা কি কখনো কারো সময় কাটে? কাটলেও কতেক্ষন কাটে? একদিন, দুই দিন, এক মাস, এক বছর। কিছু সময় কাটলেও কারো কারো না কারো শুন্যতা থেকে যায়। কথা বলার মতো মানুষ না থাকলে সময় কাটবেই বা কিভাবে?
এর মাঝে রাজ আবার প্রশ্ন করে,
– আমরা নাহয় তাদের বিষয়ে এটা ভাবলাম, বাট তারা কি রাজি হবে?
নিবিড় বলে,
– ফরিদা আন্টিকে আমরা বুঝাবো। আর নীলার বাবাকে নীলা বুঝাবে। আশা করি আমরা সবাই বুঝালে তারা নিশ্চই বুঝবে। তবে ভয়টা নীলার বাবাকে নিয়ে, সে রাজি হয় কি না।
তুষার এতোক্ষন চুপ থাকলেও এবার মুখ খুলে বলে,
– বিয়ের কথা শুনে না করে কে বল? তাছারা ভেবে দেখে নীলার বাবা কতদিন সঙ্গি ছারা একা একা কাটিয়ে দিয়েছে। হয়তো ভেতরটা একেবারে মরুভূমি হয়ে গেছে তার। এখন যদি আমরা পানি হিসেবে তার মনে এই বিয়ের চিন্তাটা ঢুকিয়ে দিয়ে অনুর্বর ভূমিকে উর্বর করে তুলতে পারি, তখন তার উর্বর ভূমিতে নতুন করে বিয়ের ফুল ফুটবে একেবারে কনফার্ম।
এতোক্ষন চুপ থেকে হুট করে এমন কথা বলায় রাজ রুশান দুজনই তাকিয়ে আছে তুষারের দিকে। নিবিড় আঙুল দিয়ে তুষারের দিকে ইশারা করে বলে,
– এই পোলাটা, এই পোলাটা পুরাই ফাউল। একটা সুন্দর কথার মাঝেও নেগেটিভ সাইড টেনে নিয়ে আসলো।
সবাইকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে তুষার চুপচাপ সবার দিকে একবার চোখ বুলিয়ে একটা ঢোক গিলে বলে,
– আমি কি করলাম? আমি তো প্রেমের ফুলের কথা বলেছি।
To be continue……………