#ছায়া_সঙ্গিনী
#পর্ব-১০,১১
#Israt_Bintey_Ishaque(লেখিকা)
১০
আমার ভিতরে ঠিক কি হচ্ছে আমি বুঝতে পারছি না। পাশে বসে থাকা ভাবীরা জিজ্ঞাসা করলেন কি হয়েছে? আমি বললাম,
– রাহাত এক্সিডেন্ট হয়েছে।
ভাবীরা আরো জিজ্ঞাসা করলেন,
– এখন কেমন আছে? কোথায় আছে?
– খুবই গুরুতরভাবে আহত হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে দূর্গম এলাকায় স*ন্ত্রাস বাহিনী উদ্ধার অভিযানে, অন্যান্য সেনাদের রেসকিউ করতে, নিজের উপর রিস্ক থাকা সত্ত্বেও একচুলও পিছিয়ে আসেনি। ফলে ও সহ আরো তিন জন গুরুতর আহত হয়েছে। প্রাথমিক চিকিৎসার পর,ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট সিএমএইচ হসপিটালে নিয়ে আসা হয়েছে।
আমার কথা শেষ হতেই ভাবীরা দৌড়ে গেলেন মাকে খবর দিতে।আমি যেভাবে বাঁশের বেঞ্চিতে বসেছিলাম, সেভাবেই বসে আছি। আমার কোন রকম প্রতিক্রিয়া নেই।এই মুহূর্তে কি করা উচিৎ সেটা বুঝতে পারছি না।
কিছুক্ষণের মধ্যেই মা পাগলের মত কান্নাকাটি করতে করতে বাড়ি আসলেন।এরই মধ্যে মামা তার বড় আর মেজ ছেলেকে খবর দিয়েছেন।বড় ভাই আর মেজ ভাইয়ের বাজারে বড় মুদির দোকান। তাই তারা বলেছেন কর্মচারী কে সব কাজ বুঝিয়ে এক্ষুনি আসছেন। এদিকে মা কান্না করতে করতে বলছেন, তিনি এক্ষুনি ঢাকা তার ছেলের কাছে যাবেন। তাকে যেন এক্ষুনি নিয়ে যাওয়া হয়।ভাবীরা আমার কাছে এসে বললেন,
– তুমি এভাবে থেক না, চুপচাপ থাকলে ক্ষতি হবে। স্বামীর জন্য কষ্ট হচ্ছে তো কাঁদো। কাঁদলে মন হালকা হবে।
কিন্তু আমার তো জীবনেও কান্না আসবে না। ইচ্ছে করে তো কান্না আসবে না। পাথর মানবের কি আবার চোখের পানি কান্না আছে নাকি। আমার অবস্থা দেখে আশেপাশের কিছু মহিলা কানাঘুষা শুরু করে দিয়েছে,কেউ কেউ বলছেন,
– এই ছেড়ির কি স্বামীর লাইগা মায়া মহাব্বত নাই নাকি। আমাগো বউরা অইলে তো এহন মাডিত গইরায়া কানতো ।এই কেমন মাইয়া মানুষ খোদা জানে!
বড় ভাই আর মেজ ভাই বাড়ীতে আসলে মা সহ তারা তৈরি হয়ে নেয় ঢাকা যাওয়ার জন্য।তারা তৈরি হয়ে বের হবে তখন আমার টনক নড়ে যে আমিও যাবো। রাহাতকে দেখা উচিৎ এখন কেমন আছে, কতটুকু আহত হয়েছে। তাই তাদের বলে আমিও তৈরি হয়ে বের হলাম।স্ট্যাশন এসে টিকিট কেটে ডাইরেক্ট ঢাকার বাসে উঠেছি। মা বাসে বসেও খুব কান্না করছেন। অনেক শান্তনা দিয়েও কান্না থামাতে পারছিনা আমি। কান্না করতে করতে বলছেন, এখনো কেন আইয়ে না আর কতক্ষন লাগবো? আমার ছেলেডা না জানি কতো কষ্ট পাইতাছে। মাবুদ গো আমার ছেলেডারে রক্ষা করো ।
_______
আমাদের ঢাকায় পৌঁছাতে পৌঁছাতে রাত হয়ে গেল।সিএমএইচ হসপিটালের সামনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছি,যে সেনা মায়ের ফোনে কল করে জানিয়েছিল তাকে কল করেছি। আমাদের কে এখান থেকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। তারপর কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতেই লোকটা এসে সালাম দিয়ে বললেন,
– আপনারা রাহাত স্যারের পরিবারের লোক?
ভাইয়ারা সম্মতি দিতেই, আমাদের ভিতরে নিয়ে যাওয়া হলো। তবে এখন কেবিনে ঢুকা নিষেধ, রোগীর জ্ঞান ফিরলে ভিতরে যেতে বলেছে ডাক্তার। তাই রাহাতের কেবিনের বাহিরে বসে অপেক্ষা করতে লাগলাম। কিছুক্ষণ বসে থাকার পর এশা এর আযান হলো।আযানের জবাব দিয়ে দো’আ পড়ে, আল্লাহ তা’আলার কাছে দো’আ করলাম রাহাতের জন্য।
আযান শেষ হলে, আল্লাহ তা’আলার কাছে চাও তোমার দো’আ কবুল করা হবে।
(আবু দাউদ শরীফ, হাদীস-৪৪০)
তারপর একজন কে জিজ্ঞাসা করে, মাকে নিয়ে অযু সেরে নামাযের রুমে গেলাম। জোহর নামায থেকে শুরু করে আজকে এক ওয়াক্ত নামায ও পড়া হয়নি। আল্লাহ মাফ করুন আমিন। এখন সব গুলোর কাজা নামায আদায় করে তারপর এশার নামায পড়বো।
মা এশার নামায পড়ে চলে গেলেন তার ছেলের কাছে। আমি সব গুলো নামায পড়ে তার পর গেলাম। গিয়ে দেখি দরজা কাছে দাঁড়িয়ে গ্লাস দিয়ে তাকিয়ে আছেন মা। তখন ভাইয়েরা ব্রেড আর কলা নিয়ে এসেছেন আমাদের জন্য।মা কিছুতেই খাবেন না বলছেন।এক নাগাড়ে চোখের পানি ফেলেই চলেছেন। সবাই মিলে অনেক বুঝিয়ে এক পিস ব্রেড খাওয়াতে সক্ষম হয়েছি।ভাইয়ারা ও খেয়ে নিল। আমাকে বললো খাওয়ার জন্য, কিন্তু আমার খেতে ইচ্ছে করছে না। তবুও তাদের কথা রাখতে কিছুটা মুখে নিলাম।
রাত সাড়ে তিনটার দিকে জ্ঞান ফিরে রাহাতের, আমি নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে থাকি ওর মাথার পেছনের দিকে। মা বললেন,
– এখন কেমন লাগছে বাবা?
তার ছোট করে উত্তর, ভালো।
কপালে আঘাত পেয়েছে,চারটা সেলাই দিতে হয়েছে।চারটা সেলাই লাগলেও ক্ষতটা গভীর ভাবে হয়েছে। এবং বাম পায়ে ও আঘাত পেয়েছে যার কারণে হাঁটুর কিছুটা নিচ থেকে পুরো পা ব্যান্ডেজ করা হয়েছে।
রাতটা এভাবেই কেটে গেল। সকালে নামায পড়ে এসে,সূরা ফাতেহা, তিন কুল, আয়াতুল কুরসি পাঠ করে ওর বুকে ফুঁ দিয়ে দিলাম। মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেই চোখ খুলে তাকালো রাহাত। আমাকে এখানে দেখে খুব চমকালো।কাল রাতে জ্ঞান ফিরার পর আমি ওর সামনে আসিনি,যখন ঘুমিয়ে ছিল তখন এসেছি।তাই এই মাত্র দেখে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো।ওর সাথে চোখাচোখি হতেই আমি মাথা নিচু করে বসে রইলাম।ও কিছুক্ষণ পর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
– আয়রা তুমি তো, পায়ের নোখ খারাপ দেখতে পছন্দ করো না!তাই না?
ওর হঠাৎ এ কথা শুনে, নির্বুদ্ধিতার মতো তাকিয়ে রইলাম। তারপর আবার উপরের দিকে তাকিয়ে বললো,
– জানো আমার ভাগ্য খুব খারাপ! এমনিতেই আমার বউ আমাকে পছন্দ করে না। এখন তো আরো আগেই পছন্দ করবে না। কখনোই না।
ওর এরকম কথা বার্তার অর্থ কিছুই বুঝতে পারলাম না আমি। কি হয়েছে যে এখন আরো বেশি অপছন্দ করবো? কি নিয়ে এতো দুশ্চিন্তায় ভোগছে? লক্ষ্য করলাম ওর চোখের কোণে চিকন রেখায় পানি গড়িয়ে পড়ছে। তারপর আবার আমার চোখে চোখ রেখে বললো,
– আমার বাম পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুলের নোখ টা থেঁতলে গেছে আয়রা! এখন থেকে তোমাকে পাওয়ার আশা ছেড়ে দিতে হবে!
শেষের কথাটা শুনে আমার ভিতর টা দুমড়ে মুচড়ে উঠলো। না চাইতেই হুরহুর করে কান্না শুরু করে দিলাম।আজ যেন আমার মাঝে নেই কোন দ্বিধা নেই কোন দ্বন্দ্ব।এই মুহূর্তে নিজের কান্না দমন করতে কোন আশ্রয় খুঁজে পাচ্ছি না আমি। খুব করে একটা ভরসার আশ্রয় চাইছি কিন্তু পাচ্ছি না আমি। নিজের দুই হাতে মুখ গুজে কান্না করছি। আমার কান্না গুলো চার দেওয়ালের মাঝেই আবদ্ধ হয়ে আছে। আমার কান্নার মাঝেই নিষ্ঠুর লোকটা আবার বলতে শুরু করলেন,
– হায়রে কি কপাল আমার?আজ তুমি না চাইতেই কান্না করছো। যেখানে আমার ও হাত নেই। হয়তো প্রকৃতির ইচ্ছে তাই কান্না করছো। তবে আমার কি হবে আয়রা? এমন মুহূর্তে তুমি কান্না করলে যখন আমি তোমার অযোগ্য!
এই নিষ্ঠুর লোকটার কথা আর সহিতে পারলাম না আমি। হাউমাউ করে নিষ্ঠুর লোকটার প্রশস্ত বুকেই ঝাঁপিয়ে পরলাম। খামচে ধরলাম তার পিছনে থাকা বালিশে। একজন নার্স এসে বললেন,
– ম্যাম এরকম করবেন না পেশেন্টের অবস্থা ভালো না।
তারপর আরো কিছু বলতে যাবে, তখন রাহাত হাত দিয়ে ইশারা করতেই চলে যায় নার্স। আমি আগের ন্যায় কেঁদেই চলেছি। রাহাত তখন বললো,
– আয়রা কেঁদো না প্লিজ। আমি কখনোই তোমার কান্না চাইনি।যার কারণে এখনো অবধি আমাদের বিচ্ছেদ রয়ে গেছে।
কিন্তু না আমি আজকে কাঁদবো খুব করে কাঁদবো। আমি কান্নার মাঝেই বললাম,
– আমি কাঁদতে চাই রাহাত, আমি কাঁদতে চাই। আমাকে বাধা দিও না প্লিজ। আমি পাথর মানব হয়ে থাকতে চাই না।আর পাঁচটা সাধারণ মানুষের মতো বাঁচতে চাই আমি। আমাকে এভাবেই সারা জীবন তোমার আশ্রয়ে রেখে দাও। আমি এভাবে সারা জীবন কাটিয়ে দিতে চাই। এবার যদি তুমি আমাকে ফিরিয়ে দাও তাহলে আমি আর বাঁচবো না রাহাত, ধুঁকে ধুঁকে শেষ হয়ে যাবো।
দুই হাত দিয়ে ধীরে ধীরে আমার মাথাটা তুলে সোজা করে রাহাত। তারপর বললো,
– এমন কথা মুখেও আনবে না,আনলেই সু*ট করবো! আমি কে জানো তো? আমার কিন্তু রি*ভলবার আছে হু।
আমাকে হাসানোর জন্য তার এই কথা। কিন্তু আজকে তো আমি হাসবো না! এতো কষ্টের মাঝে কেউ হাসে নাকি?অন্য কেউ হাসলেও আমি হাসবো না। আবার তার সাথে মাথা ঠেকিয়ে কান্না শুরু করলাম। এদিকে নার্স খাবার নিয়ে এসে দরজায় কড়াঘাত শুরু করেছে। রাহাতের ভয়ে ভিতরে ঢুকতে সাহস পাচ্ছে না। রাহাত তখন বললো,
– আমার মনে হয় না খেয়েই জীবন পার করতে হবে। কি করবো বউ যদি এভাবে কান্না শুরু করে তাহলে কি আর গলা দিয়ে খাবার নামবে? থাক না খেয়েই জীবন পার করবো আমি।
এবার রাহাত কে ছেড়ে চোখ মুছে, নার্সের থেকে খাবার নিয়ে এসে রাহাতের মুখের কাছে চামচ ধরলাম।সে না খেয়ে বললো,
– উহু খাবো না আমি।
– কেন?
– কাছে এসো।
– পারতাম না।
– স্বামীর অবাধ্য হবে?
আর কিছু না বলে, কাছে এগিয়ে গেলাম। আমার চোখের পানি মুছে দিয়ে, চোখের পাতায় তার ঠোঁট ছুঁয়ে দিল।পরম আবেশে স্তব্ধ হয়ে রইলাম আমি।
তারপর বললো,
– তুমি আর মা তো কিছু খাওনি এখনো। মায়ের সাথে দেখা হয়েছে তোমার?
– আমরা খেয়ে নিব আপনি আগে খেয়ে নিন, আপনাকে মেডিসিন নিতে হবে।তাই আপনার খাওয়া বেশি জরুরি।
রাহাত স্যুপ খেতে খেতে বললো,
– মায়ের সাথে দেখা হয়নি তাই না?
– আমি মাকে সঙ্গে করে নিয়ে তবেই এসেছি। এবার খাবার শেষ করো।
আমার কথা শেষ হতেই রাহাত বিষম খেয়ে, কাশতে শুরু করে,,,,,,
#চলবে,,, ইনশা আল্লাহ।
#ছায়া_সঙ্গিনী
#পর্ব-১১
#Israt_Bintey_Ishaque(লেখিকা)
সকালের স্নিগ্ধ আবহাওয়ায় শরীরে হালকা শীতের আবাস দিচ্ছে।তার উপর দক্ষিণ পাশের জানালা খুলে রাখা।হুরহুর করে স্নিগ্ধ ঠান্ডা বাতাস প্রবেশ করছে চার দেওয়ালের মাঝে। সাধারণ থ্রিপিস পরে আছি আমি, বোরকা খুলে রেখে দিয়েছে। বোরকা পরে তো এতো সময় থাকা যায় না তাই।স্যুপের ট্রে টা পাশে রেখে ওরনা টা পুরো শরীরে জড়িয়ে নিলাম। তারপর রাহাত কে বললাম,
– এখন কোন কথা না বলে খাবার খেয়ে নাও। তাড়াতাড়ি সুস্থ হতে হবে তো নাকি?
রাহাত মলিন মুখে বললো,
– তুমি যদি এভাবে আমার পাশে থাকো তাহলে আমি সারাজীবন এভাবেই অসুস্থ হয়ে থাকতে চাই!
রাহাত কে চোখ রাঙিয়ে বললাম,
– কিসব অলোক্ষুনে কথাবার্তা বলছো? আমাকে একদম রাগাবে না বলে দিচ্ছি।রাগলে কি করবো তুমি নিজেও জানো না কিন্তু।
– কি করবে শুনি?
আমি পুরো রুমটা একবার চেক করে দেখলাম, তেমন কিছুই চোখে পরলো না যেটা দিয়ে আমি আহত হতে পারি! এদিকে রাহাত বাঁকা হাসি দিয়ে ভ্রু নাচিয়ে বললো,
– কি বলো?
চট করে মাথায় বুদ্ধি এলো,তাই ফট করে বললাম,
– ঐ যে থাই গ্লাস দেখতে পাচ্ছো? সেখানে হাতটা ঢুকিয়ে গ্লাস টা বন্ধ করলে কেমন হবে বলো তো?
_________
মুহূর্তেই কারো মুখশ্রী জুরে আঁধার নেমে এলো। শুধু তাই নয় লোকটা এরকম কান্ড করবে আমার ধারণার বাহিরে ছিল।এই প্রথম রাহাতের জন্য নিজেকে খুব অপরাধী মনে হচ্ছে।যে মুখে কথা গুলো বলেছি সে মুখটা ঝলসে দিতে পারলে বেঁচে যাই যেন! কি দরকার ছিল এভাবে বলার? একটু সুন্দর করে বললেই তো ও খাবার টা খেয়ে নিত।
থাই গ্লাস নিয়ে কথাটা বলতেই রাহাত দাঁতে দাঁত চেপে ধরে নিজের কপাল থেকে সাদা ব্যান্ডেজ টা টান দিয়ে খুলে ফেলে!
চোখের পলকে কি থেকে কি হয়ে গেল! আমি ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে গেলাম। তখন মা কেবিনে ঢুকে দেখে সদ্য সেলাই করা স্থান থেকে গড়িয়ে র*ক্তের ধারা বইতে শুরু করেছে। আমার গলা দিয়ে কোন কথা বের হচ্ছিল না তখন, মনে হচ্ছিল কোনো অদৃশ্য শক্তি আটকে রেখেছে!মা হেঁচকা টানে বসা থেকে দাড় করিয়ে আমাকে বলে,
– বউ? তুমি আমার ছেলেরে কি কইছো অয় ক্যান এমন করলো? চুপ কইরা আছো ক্যান? তুমি তারে বাধ্য করছো এই কাম করতে?কতা কওনা ক্যান? আমার ছেলেডার র*ক্ত সব র*ক্ত যাইতাছে গা।অ আল্লাহ আমি কি করুম।
মায়ের আহাজারি শুনে ডাক্তার নার্স রাহাতের কলিগ সবাই দৌড়ে আসে।ডাক্তার সব কিছু রেডি করে আবার নতুন করে ব্যান্ডেজ করার জন্য। কিন্তু রাহাত তখন সবাই কে অবাক করে বলে, আমি ব্যান্ডেজ করবো না!
একজন আর্মি অফিসারের এই ধরনের কাজ তার উপর এই কথা শুনে সবাই হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমি আগের মতই ছলছল চোখে তাকিয়ে আছি, কিছুই বলতে পারছি না। গলাতেই সব দলা পাকিয়ে আছে।মা পাগলের মতো বুঝিয়ে চলেছে,
– বাপ আমার ডাক্তরের কতা হুন, এমন করতাছস ক্যান?
রাহাত তখন শক্ত কন্ঠে বললো,
– মা ওরে বলো এই ধরনের কথা দ্বিতীয় বার বলবে কিনা?ওর এই নিষ্ঠুরতা আমি নিতে পারছি না।এসব বাক্য যেন মুখে ও উচ্চারণ না করে, প্লিজ মা বলো ওরে।
সবাই তখন আমার দিকে আশ্চর্য হয়ে তাকিয়ে আছে,যেন আমি কোন খু*ন করেছি। মা আমার কাছে এসে,কাদ জাঁকিয়ে বললো,
– কি বলেছোস জানি না,এহন ক আর অমন কতা কবি না?
সবাই অধীর আগ্রহে তাকিয়ে আছে আমার দিকে আমি কখন সম্মতি দিব। আমি তখন মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিলাম কিন্তু রাহাত অস্থির হয়ে বললো, এভাবে বললে হবে না মুখে বলতে হবে। তখন ওর দিকে তাকিয়ে খুব কষ্ট করে বললাম,
– আর বলবো না ইনশা আল্লাহ।
তারপর ডাক্তার ব্যান্ডেজ করে দেয়। নার্স নতুন করে স্যুপ নিয়ে আসলে,মা খাইয়ে দেয় রাহাত কে। খাওয়ানোর পর নার্স মেডিসিন দেয়, সাথে ঘুমের ও।চাই রাহাত শান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পরে। ঘুমানোর আগে ঘুম ঘুম চোখে,সৈনিক সোহরাব কে বলে দেয় আমাদের খাবারের ব্যবস্থা করতে।আর তাই এখন খাবারের টেবিলে বসে আছি আমরা। সবাই খাবার খেলেও আমি খাচ্ছি না।গলা দিয়ে খাবার নামছে না যেন, জোর করে খেলে বুমি হবে তাই বসে বসে নাড়াচাড়া করছিলাম তখন মা বললো,
– বউ খাইতাছস না ক্যান?
– খেতে ইচ্ছে করছে না মা,মা আমি হাত ধুয়ে নেই?
তখন রাহাতের মামাতো ভাই দুজন খাবার খেতে খেতে বললো,
– ফুফু আমরা তাইলে চইলা যাই? জানোই তো দোকানে কতো কাম আছে। এদিকে তো তোমরা সবাই আছো রাহাতেরে দেখার জন্য।
মা সম্মতি দিলেন, তারপর তারা খাবার খেয়ে রাহাত কে দেখে ফিরে গেলেন গ্রামে।
_______
রাহাত গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে আছে, এখন চারিদিকের খবরাখবর নিয়ে তার কোন ভাবান্তর নেই। আমি খুব কাছে গিয়ে চেয়ার নিয়ে বসেছি। নিস্তেজ হয়ে পড়ে থাকা ডান হাতটা আমার হাতে তুলে নিলাম।শ্যাম বর্ণের হাতের নখ গুলো লম্বা আর খুব সাদা,বেশ সুন্দর মা শা আল্লাহ। আমার নখ গুলো ও সাদা তবে খুব ছোট ছোট।
হাতটা কিছুক্ষণ বুলিয়ে, খুব ইচ্ছে করছে ঠোঁট ছুঁয়ে দিতে! একবার রাহাতের দিকে তাকালাম, নাহ তার এই মুহূর্তে জেগে যাওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই। তাই ঝুঁকিমুক্ত পরিবেশ দেখে গভীর ভাবে ঠোঁট ছুঁয়ে দিলাম হাতটাতে। কিছুটা লম্বা করে মুখশ্রী টা ফ্যাকাশে হয়ে আছে, গভীর ভাবে পর্যবেক্ষন করে দেখলাম বাম পাশে চোখের একটু দুরত্বে ছোট দাগ মনে হয় পিম্পল হয়েছিল এরকম। তারপর লক্ষ্য করলাম নাকের ডগায় ছোট্ট একটা তিল!যা দেখে মুচকি হাসলাম। শুধু তাই নয় শাহাদাত আঙ্গুল তুলে নেড়ে দিলাম। তারপর কপালের ক্ষত স্থান টা চোখে পরতেই, বুকটা যেন ফেটে চৌচির হয়ে যাচ্ছে। সকালে ব্যান্ডেজ টা খুলে ফেলার পর সেলাই গুলো কিরকম দৃশ্যমান হয়ে উঠে!যা মনে পরলে শরীর শিউরে উঠে।এই প্রথম বার রাহাত এতোটা ভয়াবহ ভাবে আমার সাথে রাগ দেখালো।ওর রাগের সাথে আমি পরিচিত নই,সব সময় ঠান্ডা মেজাজের মানুষ বলে দেখে এসেছি আমি।আর এই মানুষটা এভাবে রেগে যেতে পারে? সম্পূর্ণ ধারণার বাহিরে ছিল আমার।
আমার যখন রাহাতের সাথে বিয়ের কথাবার্তা হচ্ছে তখন আমার স্কুল ফ্রেন্ড মিলি বলেছিল,
– বান্ধবী জীবনেও এই কাজ করিস না, আর্মি পুলিশ এগুলো বিয়ে করলে কথায় রেগে যাবে।এরা প্রচুর রাগী বদমেজাজী হয়ে থাকে। তখন কথায় কথায় শুনতে হবে,আই কিল ইউ! তাছাড়া তোর অনেক রাগ, রাগে রাগে মিলে স্কয়ার হয়ে যাবে। তখন সারাদিন ঝগড়াই লেগে থাকবে সংসারে, ভালোবাসা বাসি আর হবে না।
তখন আমি বলেছিলাম রাহাত একদম শান্ত প্রকৃতির ছেলে,ওর মধ্যে কোন রাগ নেই।যদিও থাকে তাহলে আমি ম্যানেজ করে নিব। আল্লাহ চান তো এমনিতেই ভালোবাসা তৈরি হবে।
জানালায় হাত রেখে দূরের ঐ শুভ্র নীলাভ আকাশের পানে তাকিয়ে আছি। ভাবছি পুরোনো দিনের কথা। ভাইয়ার ছয় জন বন্ধুর মধ্যে একজন যে সবসময় নিরব দর্শকের মতো মাথা নিচু করে বসে থাকে,আর বাকিরা হই হুল্লোড় করে পুরো পিকনিক স্পট মাথায় তুলে নিয়েছে যেন। এতো কথাবার্তা ভালো লাগছে না বলে, সাইটে গিয়ে, সুইমিং পুলের কাছে গিয়ে বেঞ্চে বসে থাকি আমি। বসে বসে আপুর ফোন স্ক্রল করছি। হঠাৎ পায়ের কাছাকাছি একটা কালো সাপ দেখে!দিকপাশ না ভেবে দৌড় দেই যার ফলে সুইমিং পুলে গিয়ে পরি। আকস্মিক ঘটনায় বরকে যাই আমি,যার ফলে অল্প পানিতেই হাবুডুবু খেতে থাকি! মানে পানি থেকে যে উঠে দাঁড়াবো সেই জ্ঞান টুকু লোপ পায় আমার। তাছাড়া বোরকা পরা,হাতে আপুর মোবাইল,কাঁদে সাইট ব্যাগ,সব কিছু মিলিয়ে সুচনীয় অবস্থা আমার। আশেপাশের লোকজনের চেঁচামেচি শুনে আপু ভাইয়া তারা দৌড়ে আসে। তখন সবার প্রথমে রাহাত পানিতে নেমে আমাকে উপরে তুলে নিয়ে আসে।নাকে মুখে অনেক পানি ঢুকে যায়। তারপর নিকটবর্তী হাসপাতালে ভর্তি করে পানি বের করা হয়। পানির কারণে নিউমোনিয়া পর্যন্ত হয়ে যায় আমার। শেষে জানা যায় ভাইয়ার বন্ধু রাকিব প্লাস্টিকের সাপ দেখিয়ে আমাকে ভয় দেখায়,যেটা আমি সত্যি সত্যি সাপ মনে করি।এ নিয়ে রাকিব ভাইয়ার সাথে অনেক ঝামেলা হয় রাহাতের। বেচারা রাকিব ভাইয়া ও বুঝতে পারেনি এতো বড় ঘটনা ঘটে যাবে।
এরকম আরো কিছু ঘটনা ঘটে,এর থেকে আমাদের একে অপরকে পছন্দ করা। আব্বু প্রথমে রাজী ছিল না বিয়েতে। আম্মুর খুব পছন্দ হয় রাহাত কে, সেই প্রথম থেকেই আম্মু চাইতো রাহাতের সাথে যেন আমার বিয়ে হয়। আম্মুর ধারণা ছিল এরকম একটা শান্ত শিষ্ট ভালো ছেলে তার রাগী বদমেজাজী মেয়েটাকে আগলে রাখতে পারবে।
_________
দুপুরে রাহাত কে খাবার খাওয়াতে নিলে, রাহাত বললো সে মায়ের হাতে খাবার খাবে। এতে কিছুটা কষ্ট হলো আমার, কিন্তু মুখে কিছু না বলে মায়ের হাতে খাবার দিয়ে দিলাম। তারপর রাহাত দ্বিরুক্তি না করে খেয়ে নিল।
শুধু তাই নয় প্রত্যেক বেলা এভাবেই মায়ের হাতে খাওয়া শুরু করলো রাহাত। আমার সাথে তেমন প্রয়োজন ছাড়া কথাও বলে না।ওর ক্ষতটা একটু শুকিয়ে আসলে কোয়ার্টারে চলে আসি সবাই। আমি প্রতিদিন নিয়ম করে ক্ষত স্থান গুলো ড্রেসিন করে দেই।সময় মতো মেডিসিন দেই। রাহাত বাসায় বসে থেকেই ল্যাপটবে কাজ করে, ফোনে কথা বলতে শুনে বুঝতে পারলাম ও আবার সেই পার্বত্য চট্টগ্রাম দূর্গম এলাকায় যাবে।
পায়ের ক্ষতটা শুকিয়ে এসেছে, এখন ব্যান্ডেজ করতে নিষেধ করে দিয়েছে ডাক্তার। তাই অফিসে গিয়েই কাজ শুরু করে দিয়েছে।এর মধ্যে একদিন গিয়ে মাকে গ্রামে রেখে এসেছে।
আমাদের মাঝে এখন স্বাভাবিক সম্পর্ক চলছে,খাই দাই ঘুমাই এই আর কি। নির্ঘুম রাত,তাই বেলকনিতে দাঁড়িয়ে দূরের আকাশ দেখছি। তখন রাহাত এসে বসলো,
– ঘুমাবে কখন?
আমি অনিমেষ চাহনিতে বললাম,
– আমার কথা তাহলে মনে পরলো তোমার? সারাক্ষণ তো কাজ নিয়েই থাক।
রাহাতের এতে কোন ভাবাবেশ নেই,সে বললো অনেক রাত হয়েছে ঘুমাবে চলো। আর শোন আগামীকাল তোমাকে তোমার বাসায় রেখে আসবো। তৈরি হয়ে নিও।
এটুকু কথায় বাতাসের বেগে আমার আঁখিপল্লব দুটো জ্বলজ্বল করে উঠলো। তবুও আড়ালে পানি টুকু মুছে নিলাম। আজো কি বাবার বাসাই আমার বাসা?
_______
আমাকে বাবার বাসায় রেখে যাওয়ার সময় তার শেষাক্ত কথা,
– খুব করে অপেক্ষায় ছিলাম কখন তুমি ঘড়িটা পরে বাকিটা আমাকে পরিয়ে দিবে! এতো গুলো দিন একসাথে থেকেও তুমি এই কাজটা করলে না আফসোস।যদি মিশন থেকে বেঁচে ফিরে আসি তাহলে দেখা হবে। তারপর,,,,
#চলবে,,, ইনশা আল্লাহ