ছায়া_সঙ্গিনী #পর্ব-১২,১৩

0
535

#ছায়া_সঙ্গিনী
#পর্ব-১২,১৩
#Israt_Bintey_Ishaque(লেখিকা)
১২

ঢাকা থেকে নারায়ণগঞ্জের উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছি, আমি আর রাহাত। গাড়িতে চুপচাপ বসে আছি দু’জনেই, কারো সাথে কোন কথা নেই। আচার ওয়ালা বাসে বর‌ই আচার নিয়ে এলো, তখন আমি এক প্যাকেট নিয়ে খাওয়া শুরু করলাম।যা দেখে রাহাত লোকটার পাওনা টাকা মিটিয়ে দেয়। সাইনবোর্ড কাছাকাছি এসে অনেক জ্যাম শুরু একটুখানি পথ পার হতে পারলেই নারায়ণগঞ্জ এর রাস্তায় চলে যেতাম, এখন একটুর জন্য বসে আছি কেমন লাগে?

অতঃপর জ্যাম কমলে নারায়ণগঞ্জ এর রাস্তায় গাড়ি মোর নেয়। তারপর ত্রিশ মিনিটের মধ্যে পৌঁছে যাই বাসায়। আমাকে গেইট অবধি পৌঁছে চলে যায় রাহাত, আমি শুধু তাকিয়েই থাকি। একবার ও পিছনে ফিরে তাকায় না। তারপর চোখের পানি মুছে বাসার ভিতরে যাই। হঠাৎ কোন খবর না দিয়ে আসায় ভাবী নানা রকম প্রশ্ন শুরু করে দেয়।তার প্রশ্ন সম্পূর্ণ এরিয়ে গিয়ে, নিজের রুমে চলে যাই। কোন রকম বোরকা খুলে, ফুল স্পীডে ফ্যান চালু করা দরজা জানালা বন্ধ করে শুয়ে রইলাম।

এক ঘুমে উঠলাম বিকাল সাড়ে চারটার দিকে। খুব খিদে অনুভব হচ্ছে তবুও খাচ্ছি না।আসরের আযান হতে আরো অনেক সময় বাকি তাই গিয়ে, অনেক সময় নিয়ে শাওয়ার নিয়ে আসলাম। ফোন টা হাতে নিয়ে দেখলাম, আরো দুদিন আগে তুলি চার বার কল করেছিল।কল বেগ করতে গিয়ে দেখি ফোনে ব্যালেন্স নাই। তাই আরিয়ানের রুমে গেলাম ওর ফোন দিয়ে কল করার জন্য। দরজা বিড়িয়ে রাখা তবুও নক করলাম কিন্তু কোন সাড়া শব্দ পেলাম না।তাই ঢুকে গেলাম। খাটের মধ্যখানে উল্টো হয়ে শুয়ে আছে যে ব্যক্তি, তাকে দেখার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না আমি!চিকন স্লিপের সাদা গেঞ্জি সাথে আরিয়ানের লুঙ্গি পরিহিত।চরম মাত্রায় অবাক হলাম আমি।
রাহাত কখন এলো বাসায়? আমাকে কেউ ডাকলো না কেন?ও দুপুরে খাবার খেয়েছে? কাছে গিয়ে মাথার কাছে গিয়ে বসলাম আমি। মাথায় হাত বুলিয়ে ধীরে ধীরে বললাম,
– রাহাত তুমি কখন এসেছো? আমাকে ডাকলে না কেন? দুপুরে খাবার খেয়েছো তুমি?এই রাহাত শুনতে পাচ্ছো?
ওর সারা না পেয়ে কিছুটা ঝুঁকে পরে আবারো ঢাকলাম,এই রাহাত?

আচমকা রাহাত আমাকে টেনে নিয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে পুনরায় শুয়ে রইলো!এই প্রথম ওর এতো কাছাকাছি আসায় খুব অস্বস্তি বোধ হচ্ছে।তাই নড়াচড়া শুরু করলাম। তখন ও বললাম,
– সাপের মতো মোড়ামোড়ি করছো কেন,একটু শান্তিতে ঘুমাতে দাও না?চলেই তো যাবো!তখন ইচ্ছে মতো থেকো।

ওর এরকম কথায় স্তব্ধ হয়ে গেলাম আমি।ও এভাবে বলে যেন একেবারে চলে যাচ্ছে হুহ। আমার ভাবনার মাঝে,গলার দিকটায় তার মুখশ্রী রাখে। ফলে প্রতিটি উষ্ণ গরম নিঃশ্বাস আছরে পরছে আমার গলায়। শুধু এখানেই থেমে নেই সে, তার ঘ্রাণেন্দ্রিয় দিয়ে ছুয়ে দিতে শুরু করে! এতে করে শরীরের প্রতিটা শিড়া উপশিড়া শিরশির করতে শুরু করলো। প্রচুর পরিমাণে শুরশুরি লাগছে, কিছু বলতেও পারছি না। বললে আমি নিশ্চিত এখন রেগে যাবে। তাই বলছি না কিছু, তার এরকম রোমান্টিক অত্যাচার চলতে থাকলো টানা দশ থেকে পনেরো মিনিট।এর মধ্যে আযান হতে,নামাযের অজুহাত দিয়ে উঠে গেলাম। সাথে তাঁকে ও বললাম নামায পড়ে নিতে।

তারপর নামায পড়ে ড্রয়িং রুমে এসে দেখি আরিয়ান বসে গেইম খেলছে।ওরে দেখে বললাম,
– তোর ভাইয়া কখন আসছে?

ও গেইম অফ করে বললো,
– তুই আসার দশ মিনিট পর। অনেক বাজার নিয়ে আসছে। তোর পছন্দের পাবদা মাছ ই এনেছে তিন কেজির মতো। আরো অনেক কিছু তো আছেই।

আমি হতবাক হয়ে গেলাম, তখন ও বাজার করতে বাজারে গিয়েছিলো।আর আমি কিনা কিসব ভেবে অস্থির। অবশ্য ও আমাকে বলে যেতে পারতো যে আমি বাজারে যাচ্ছি। তাহলেই তো আমি এভাবে দরজা বন্ধ করে থাকতাম না।

– আমাকে ডাকলি না কেন?

– আমি ভাবী দু’জনেই ডেকেছি তোকে তোর কোন সাড়া শব্দ নেই।তাই ভাইয়া বললো তুই হয়তো ঘুমিয়ে আছিস।ডাকতে নিষেধ করলো।

– দুপুরে খাবার খেয়েছে ও ?

– হুম, আব্বু সহ সবাই একসাথে খেয়েছি।

– কি রান্না হয়েছে?

– ভাবী তাড়াতাড়ি করে ভাইয়ার আনা মাছ ভুনা করে দিয়েছে। তাছাড়া সকালে মুরগির গোশত,ডাল,পটল ভাজি রান্না করা হয়েছিল।

– ওহ্ আচ্ছা।

তাড়াতাড়ি কিচেনে গেলাম সন্ধ্যায় রাহাত কে নাস্তা দেওয়ার জন্য কিছু তৈরি করতে হবে। রান্নার করা পাতিলের ঢাকনা তুলে দেখলাম কিছু গোশত আছে, সেই থেকে শুধু গোশত গুলো তুলে নিয়ে, পানি দিয়ে ধুয়ে নিলাম। তারপর পানি গুলো ঝরে যাওয়ার জন্য রেখে দিয়ে, পেঁয়াজ কুচি করে নিলাম। চুলায় কড়াই দিয়ে তেল গরম করে পেঁয়াজ কুচি ছেড়ে দিলাম। পেঁয়াজ টা বাদামী রঙের হয়ে এলে একটু হলুদ, আদা রসুন ব্লেন্ডার দিয়ে নেড়েচেড়ে গোশত গুলো ভেঙ্গে দিয়ে দিলাম। তারপর একটু গুঁড়ো মরিচ দিয়ে হয়ে এলে নামিয়ে নিলাম। রাহাত ঝাল খেতে পারে না তেমন তাই মরিচ অল্প‌ই দিলাম।
এখন আটা কাই করে নিতে হবে, সমস্যা হচ্ছে আঁটার কন্টিনার অনেক উপরের তাকে কিছুতেই নাগাল পাচ্ছি না। তখন রাহাত পিছন থেকে কোমড় জড়িয়ে ধরে, শূন্যে তুলে নেয় আমাকে। নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরি ওর এরকম কান্ড দেখে। তারপর কন্টিনার হাতে নিতেই নামিয়ে দেয়। আমি ওর দিকে না তাকিয়ে নিজের মতো কাজ করতে থাকি, লজ্জায় মুখ লুকানোর জায়গা পাচ্ছি না আমি।ওর একেকটা কর্ম কান্ড দেখে শিহরিত আমি।সব সময় ওর সাথে থাকলে আমার অবস্থা নাজেহাল করে ছাড়বে যেই লক্ষন দেখা যাচ্ছে।
আটা কাই করে এবার এগুলো মিশিয়ে নেওয়ার পালা,গরম বলে হাত দিতে পারছি না। তখন রাহাত বললো,
– দাও আমি করে দিচ্ছি।

আমার অবাক চাহনিতে তাকানো দেখে বললো,
– আমরা সব কিছু পারি। সমস্ত কাজে অভিজ্ঞতা আছে।

কিন্তু তবুও আমি দিলাম না, কেমন দেখায় এটা শ্বশুর বাড়ি এসে রান্নার কাজ করবে জামাই। বললাম, তুমি আব্বুর সাথে বসে গল্প করো যাও, আমি এগুলো তৈরি করে আসতেছি।
তারপর ও চলে গেল, আমি সব কিছু নিয়ে রুটি তৈরি করবো তখন কাটা ব্যান থেকে খুলে যাওয়া কিছু চুল,উড়ে এসে খুব বিরক্ত লাগছিল।বার বার হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে ঠিক করার ট্রাই করে চলেছি কিন্তু ঠিক করতে পারছিলাম না। তখন রাহাত এসে সব গুলো চুল খুলে নতুন করে কাটা ব্যান দিয়ে আটকে দিল।
তাকে ছোট্ট করে বললাম,
– ধন্যবাদ।

সে যেতে যেতে বললো,
– মুখে না বলেও, অন্য ভাবে প্রকাশ করা যেত।

তার কথার মর্মার্থ কিছুই বুঝতে পারলাম না, ধন্যবাদ আবার অন্য ভাবে কিভাবে দেয়?আর না ভেবে পিঠা তৈরি করতে মনোযোগ দিলাম। রুটি তৈরি করে,এর মধ্যে পরিমাণ মতো গোশত দিয়ে বাজ করে গরম তেলে ভাজা করলাম। এরকম করে সব গুলো করে বাজা করলাম। তারপর সুন্দর একটা নাস্তার প্লেটে সাজিয়ে মাঝ খানে টমেটো দিয়ে গোলাম বানিয়ে, সাথে সস দিয়ে পরিবেশন করলাম।এই প্রথম রাহাত আমার হাতের মেনু টেষ্ট করলো।যার ফলে মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে রইলো অপলক।
আব্বু চলে যাওয়ার পর রাহাত নিজ হাতে খাইয়ে দেয় আমাকে। ভাবী ও ছিল, তবে ভাবী এরকম পরিস্থিতির সাথে পরিচিত। ভাইয়া ও দেখতাম ভাবী কে প্রায় সময় নিজ হাতে খাইয়ে দিত। অনেক সময় ভাবী আলসেমি করে খাবার খাবে বললে, ভাইয়া নিজ হাতে খাইয়ে দিত।

আমার সাথে মাঝে মাঝে খুনসুটি ঝগড়া করলেও মানুষ টা ততোটাও খারাপ না। আজকের যুগে দাঁড়িয়ে ঠিক ই আছে। অন্যান্য ভাই বৌদের তুলনায়। অবশ্য আমার ভাইয়ার ও অবদান আছে এতে,ভাবী আমার বা আমাদের সাথে খারাপ ব্যবহার করেছে শুনলে ভাইয়া ভাবীর সাথে কথা বলাই অফ করে দিবে।তাই টুকটাক যাই ঝগড়া হয় সেসব কিছু ভাইয়া কে বলি না আমি।
________
এশা এর আযান হতে, আরিয়ানের সাথে মসজিদে যায় রাহাত। এদিকে আমি নামায পড়ে, আমার রুমটা সুন্দর করে গুছিয়ে নেই। অনেক থাকা হয় না তাই একটু এলোমেলো হয়ে অগোছালো পরে ছিল। কাজের মহিলা রুম মুছে চলে যায়, ভাবীর সময় নেই আমার রুমে আসার। তাই এই অবস্থা হয়ে আছে। রুমটা গুছিয়ে একটা সুন্দর দেখে বিছানায় চাদর বিছিয়ে, বালিশ গুলো সেট করে কিচেনে গেলাম। ভাবী নন্দার জন্য রান্না বান্না করছেন। জিজ্ঞাসা করলাম নামায পড়েছে কিনা? বললো পড়ে নাই তাই তাকে নামায পড়তে পাঠিয়ে দিয়ে আমি রান্না শুরু করলাম।
একটু পর, রাহাত আবার এসে দেখে আমি রান্না করছি। তখন পাশে দাঁড়িয়ে বললো,
– মা শা আল্লাহ, আমার বউ তো দেখছি বেশ কাজের। আমার কষ্ট কিছুটা লাঘব হবে দেখা যাচ্ছে। তো কি রান্না করছো ব‌উ?

ব‌উ শব্দটা শুনে গাড় ঘুরিয়ে পিছনে তাকালাম, তখন সে ভ্রু নাচিয়ে বললো,
– কি হয়েছে ব‌উ? কোন সমস্যা ব‌উ? আমাকে বলতে পারো ব‌উ। আমি সমাধান করে দেব ব‌উ। নির্দ্বিধায় অকপটে বলতে পারো ব‌উ।

তার কথায় কথায় ব‌উ শুনতে শুনতে শব্দ করে হেসে দিলাম আমি।আর সে অনিমেষ চাহনিতে তাকিয়ে র‌ইলো,যেন এটাই চেয়েছিল এতো সময়।

রাতের খাবার খেয়ে শুয়ে পড়লাম দুজনে। বিকালের মতো নিজের সাথে মিশিয়ে নেয় আমাকে। তবে একটা কথাও বলে না। বুঝলাম না তার এই নিরবতার কারণ! তারপর দুজনেই ঘুমের দেশে পাড়ি দেই।

রাত তিনটা বেজে ছয় মিনিট,
এলার্মের বিকট শব্দে ঘুম ভেঙ্গে যায় দুজনের। ঘুমানোর সময় এলার্ম দিয়ে রেখেছি।যেন উঠে তাহাজ্জুদ নামায পড়তে পারি, আমার সাথে সাথে রাহাত ও পড়বে বলে উঠলো।যা দেখে আনন্দে মনটা প্রশান্তিতে ভরে গেল আমার।
তাহাজ্জুদ নামাজের ফজিলত সব নফল ইবাদত অপেক্ষা অধিক এবং এটি আল্লাহর কাছে অতি প্রিয়। যারা তাহাজ্জুদ নামাজ আদায় করেন এবং অপরকে এ ব্যাপারে উৎসাহিত করেন, তারা আল্লাহর অপার রহমতের মধ্যে বিচরণ করেন।

হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহ ওই ব্যক্তির ওপর রহমত নাজিল করেন, যিনি রাতে নিদ্রা থেকে জেগে তাহাজ্জুদ নামাজ আদায় করেন এবং তার স্ত্রীকে নিদ্রা থেকে জাগিয়ে দেন। অতঃপর তিনি (তার স্ত্রী) তাহাজ্জুদ নামাজ আদায় করেন। এমনকি যদি তিনি (স্ত্রী) ঘুম থেকে জাগ্রত হতে না চান, তাহলে তার মুখে পানি ছিটিয়ে দেন। ’ -আবু দাউদ ও নাসাঈ

হাদিসে তাহাজ্জুদ নামাজ আদায়কারী ব্যক্তি অধিক সম্মানের অধিকারী বলেও ঘোষণা করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘মুসলমানদের মধ্যে আল কোরআনে অভিজ্ঞ ও তাহাজ্জুদ নামাজ আদায়কারী ব্যক্তি সম্মানের অধিকারী হবেন। ’ –বায়হাকি

তাহাজ্জুদ নামাজের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করা যায়। এ জন্য হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) কখনো বিনা ওজরে তাহাজ্জুদ নামাজ পড়া ছাড়তেন না। সাহাবিরাও নিয়মিত তাহাজ্জুদ নামাজ আদায় করতেন।
_________
এভাবেই পাঁচটা দিন আনন্দ কাটালাম রাহাতের সাথে।এর মধ্যে একদিন, মোহরানার জন্য দেড় লক্ষ টাকার চেক আমার হাতে ধরিয়ে দিল রাহাত। আমি নিতে চাইনি তাও জোর করে দিয়ে বললো,
– তোমার সবকিছু যেমন আমার তেমনি আমার সবকিছু ও তোমার। তবে এই টাকার হক শুধু তোমার। আমাকে দিতে হবে তাই দিচ্ছি, কিন্তু তুমি কি করবে এটা তোমার ব্যাপার। অবশ্যই অপচয় করা ছাড়া।

তারপর,
আমাকে বাবার বাসায় রেখে,তার কাজে ফিরে যাওয়ার সময় তার শেষাক্ত কথা,
– খুব করে অপেক্ষায় ছিলাম কখন তুমি ঘড়িটা পরে বাকিটা আমাকে পরিয়ে দিবে! এতো গুলো দিন একসাথে থেকেও তুমি এই কাজটা করলে না আফসোস।যদি মিশন থেকে বেঁচে ফিরে আসি তাহলে দেখা হবে। তারপর,,,,

# চলবে,, ইনশা আল্লাহ।

#ছায়া_সঙ্গিনী
#পর্ব-১৩
#Israt_Bintey_Ishaque(লেখিকা)

তারপর,,,
সেই দিনের মতো করে এক‌ই স্থানে,এক‌ই ভাবে তার অধর দুটি ছুঁয়ে দিল। আমি দুই হাতে আঁকড়ে ধরে বললাম,
– আবার কবে আসবা তুমি? আমি অপেক্ষায় থাকবো।

আমার দুটো বাক্য শুনে, তার কার্যকলাপ থেকে স্থব্দ হয়ে গেল সে। সামনে ফিরে দুই হাত দিয়ে আমার গাল দুটো আঁকড়ে ধরে বললো,
– তুমি বলছো আমাকে ফিরে আসার জন্য? আদৌও কি সত্যি? আমি নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছি না।

তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বললাম,
– আমাকে এত্তো পাষান মনে হয় কেন তোমার? আমি কি তোমায় ভালোবাসি না?

– ভাসো বুঝি?

– আবার জিজ্ঞাসা করে, তুমি আমাকে একটুও ভালোবাসো না। আমি জানি তো,সব সময় আমার সাথে রাগ দেখাও। এতো গুলো দিন একসাথে ছিলে, তুমি চাইলেই আমাকে নিজের করে নিতে পারতে তুমি সেটা করো নাই। আমি বুঝতে পারছি তুমি আমাকে একদম ভালোবাসো না।

রাহাত জোর করে আমার মাথা উঁচু করে,ভ্রু কিঞ্চিৎ উঁচু করে বললো,
– এই কথা গুলো এতো দিন বললে কি হতো? এখন চলে যাচ্ছি বলে বলছো? আমি যে চাইলেও এখন তোমার কাছে থাকতে পারবো না। কেন বললে না এতো দিন? কত্ত অপেক্ষা করে ছিলাম মুখে না বললেও ঘড়িটা আমাকে পরিয়ে দিয়ে তোমার মনের কথা বুঝাবে আমায়। কিন্তু তুমি তাও করলে না।

আমি আবার ঝাপটে ধরে কান্নার বেগ বাড়িয়ে বললাম,
– ঘড়ির কথা বেমালুম ভুলে গিয়েছিলাম আমি। তাছাড়া ওটা,,,,

– তাছাড়া ওটা?

– কিছু না, তুমি আমাকে ছেড়ে যাবে না, আমি যেতে দিব না তোমাকে। তুমি ওখানে গেলে আবার অসুস্থ হয়ে পরবে। তোমার কপালের ক্ষত স্থান এখনো ভালো করে শুকায় নাই। তুমি যাবে না, আমি যেতে দিব না তোমাকে।

এসব বলে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম, আমি জানি ছারলেই ও চলে যাবে। রাহাত কিছুক্ষণ নিরব থেকে বললো,
– আয়রা আমাকে যে যেতেই হবে,এখান থেকে
ক্যান্টনমেন্ট ফিরে, সেনাবাহিনীর টিম কে নিয়ে র‌ওনা হতে হবে। আমি খুব শীঘ্রই ফিরে আসবো তোমার কাছে ইনশা আল্লাহ। এবার আমাকে বিদায় দাও প্লিজ?

– না দেব না।

– তুমি না আমার কিউট ব‌উ।

– না, আমি কিছু শুনতে চাই না।

– আমার পিচ্চি ব‌উ, তুমি তো জানো আমার কর্মক্ষেত্র সম্পর্কে। না গিয়ে উপায় নেই, দেশের কল্যাণের জন্য নিজেকে যে সঁপে দিয়েছি আমি।সেখান থেকে পিছিয়ে আসা যে কাপুরুষ বলে গণ্য হবো। তুমি কি চাও তোমার স্বামী একজন কাপুরুষ হয়ে বেঁচে থাকুক?

মাথা নাড়িয়ে বললাম,
– না কখনোই না।

– তাহলে তো এবার আমাকে বিদায় দিতে হবে। আল্লাহ তা’আলা চায় তো আমি আবার তোমার কাছে ফিরে আসবো। তুমি মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা করো।জ্ঞান অর্জনের একমাত্র পথ পড়াশোনা।আর পড়াশোনা কখনো বিফলে যায় না,তাই মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা শুরু করো। আমি ফিরে আসলে তো পড়তে পারবে না!

আমি মাথা উঁচু করে বললাম,
– কেন পড়তে পারবো না?

সে দুষ্টু হাসি দিয়ে বললো,
– আমি তোমাকে সারাক্ষণ আমার সাথে মিশিয়ে রাখবো, একটুও ছাড়বো না।তাই এখন পড়াশোনা করে রাখ। বুঝাতে পারলাম?

আমি আবার তাকে জড়িয়ে নিয়ে বললাম,
– দুষ্টু লোক কোথাকার।

আমার একটা আবদার রাখবে ব‌উ? শেষ বারের মতো!

আমি আবার ডুকরে কেঁদে দিলাম,কিল ঘুষি মেরে, কেঁদে কেটে হেঁচকি দিতে দিতে বললাম,
– আমাকে আঘাত দিতে তোমার খুব ভালো লাগে তাই না? কেন বার বার বলছো শেষ বারের মতো, এমন অলক্ষুনে কথা দ্বিতীয়টি শুনতে চাই না আমি।

– আচ্ছা বাবা ঠিক আছে।তাহলে নতুন করে বলি শুনো, আমার একটা আবদার রাখবে সব সময়ের জন্য?

– আচ্ছা বলো?

– আমাকে সব সময়ের জন্য আদর করে দাও! না মানে যতদিন তোমার থেকে দূরে থাকি ততোদিন যেন তোমার আদর গুলো আমাকে সাহসের সাথে কাজ করতে সাহায্য করে।নাও এবার শুরু করো?

তারপর আর কি, প্রথমে কপাল তারপর দুটো গাল,নাক, থুতনি, শেষে কিনা….
শেষ মেষ দিলাম কামড় বসিয়ে!সে আউচ শব্দ করে হাসতে হাসতে বের হয়ে যায় রুম থেকে। তারপর সবাই কে বিদায় জানিয়ে র‌ওনা হয়। আমি সাথে সাথে নিচে গেইট অবধি এসে দাড়িয়ে রইলাম।যতক্ষন পর্যন্ত তাকে দেখা যায়, ততোক্ষণ পর্যন্ত দাঁড়িয়ে রইলাম।
_______
কলেজের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছি, আজকে দুদিন হলো রাহাত গিয়েছে। একবার ও কল করে নাই।কাজে গিয়ে ব‌উকে একদম ভুলে গেছে।
হঠাৎ পিছন থেকে বিকট শব্দ শুনে ইয়া আল্লাহ বলে কানে হাত দিলাম। এদিকে ফারহা হাসতে হাসতে মাটিতে গড়াগড়ি খাওয়ার অবস্থা। মেয়েটা সব সময় আমার সাথে এরকম করে। এরকম আচমকা কোন শব্দ শুনলে ভয়ে লাফিয়ে উঠি আমি।আর এটার সুযোগ নেয় ফারহা।
হাসি থামিয়ে ফারহা বললো,
– দোস্ত সেদিন তুলি আমাকে বলেছিল, ইমরান ভাইয়া কে তোর বিয়ের খবর যদি না দেই তাহলে আমাকে চিকেন ফ্রাই আর নান রুটি খাওয়াবে। কিন্তু বজ্জাত তুলি এখনো অবধি খাওয়ালো না।

ফারহা’র কথা শুনে বুঝতে পারলাম সে জন্যই ফারহা এতো দিন চুপ করে আছে।ফারহা কে বললাম,
– ঘুষ দেওয়া আর নেওয়া সমান অপরাধ তুই কি জানিস? তোকে খাওয়াবো অবশ্যই তবে ঘুষ হিসেবে নয়।ট্রিট হিসেবে।তুলি আসলে একসাথে যাবো রেস্তোরাঁয়।

ফারহা আনন্দে জরিয়ে ধরে বললো,
– থ্যাংক ইয়ু দোস্ত। দাঁড়া আমি তুলি কে কল করছি এক্ষুনি আসার জন্য।

তুলি কে কল করলে জানতে পারলাম ও কলেজ গেইটের কাছাকাছি।তাই ফারহা বললো, গেইটের সামনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা কর। আমি আর আয়রা এক্ষুনি আসতেছি।

তারপর আমরা নিচে চলে গেলাম গেইটের কাছে। তিন মিনিটের মধ্যে তুলি এলো,এসেই আমাকে বললো,
– কুত্তা তুই আমার ফোন ধরিস না কেন?

আমি কিঞ্চিৎ রাগ নিয়ে বললাম,
– তোকে না বলেছি, মানুষকে প্রানীর নাম নিয়ে ডাকলে আল্লাহ তা’আলা নারাজ হন।
আমরা হাসির ছলে মানুষকে মন্দ নামে বা বিকৃত নামে ডেকে ফেলি। কারো নাম পদবি বা কার্যকলাপ নিয়ে উপহাস না করলে অনেক সময় সামাজিক আড্ডাই জমে উঠে না। কিন্তু যা আমাদের দৃষ্টিতে হাস্যরসিকতা তা আল্লাহর দৃষ্টিতে জুলুম অর্থাৎ মানুষের মান সম্মান ভূলুণ্ঠিত করার মতো মারাত্মক অপরাধ।

আল্লাহ মানুষকে মন্দ নামে ডাকা বা উপহাস করতে নিষেধ করেছেন।

এ উপলক্ষে কোরআনে আল্লাহ বলেন : ‘হে ঈমানদারগণ। তোমাদের কোন পুরুষ যেন অপর কোন পুরুষকে উপহাস না করে কেননা সে উপহাসকারীদের অপেক্ষা উত্তম হতে পারে এবং কোন নারী যেন অন্য কোন নারীকে উপহাস না করে কেননা তারা উপহাসকারিণীদের অপেক্ষা উত্তম হতে পারে। আর তোমরা একে অন্যকে দোষারোপ করো না এবং একে অন্যকে মন্দ নামে ডেকো না, ঈমান আনার পর মন্দ নামে ডাকা গর্হিত অপরাধ। আর যারা এহেন অপরাধ থেকে তওবা না করে তারাই প্রকৃত জালেম। (সূরা হুজরাত ৪৯:১১)

তাই প্রতিটি মানুষের উচিত কারো চালচলন বা আচরণ নিয়ে কোন ধরনের বিব্রতকর মন্তব্য না করা। কোন অবস্থাতেই কাউকে গালিগালাজ না করা।

তুলি সবটা শুনে বললো,
– আচ্ছা ব‌ইন মাফ কর এবার বল এখানে থাকতে বললি কেন?

ফারহা বললো,
– গেলেই দেখতে পাবি চল এবার।

তারপর ভালো একটা রেস্তোরাঁয় গেলাম। তারপর তিন জনের জন্য খাবার অর্ডার করে বসে গল্প করতে শুরু করলাম।এক পর্যায়ে ফারহা বললো,
– দোস্ত বাসর রাতে কি হলো?

সাথে তুলি ও যোগ হয়ে বললো,
– হুম দোস্ত বল না? আমার অনেক জানার আগ্রহ।

– অন্য টপিক নিয়ে কথা বল, এগুলো বাদ দিয়ে।

তুলি বললো,
– প্লিজ দোস্ত?বল না?

– স্বামী স্ত্রীর মধ্যকার কথোপকথন অন্য কারো সাথে শেয়ার করা উচিৎ নয়।
পবিত্র ধর্ম ইসলামে মানুষকে এমন বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলতে নিষেধ করা হয়েছে। স্বামী-স্ত্রীর একান্ত বিষয় অন্যের কাছে প্রকাশ করা গর্হিত অপরাধ। আবু সাঈদ খুদরি (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘কিয়ামতের দিন আল্লাহর কাছে নিকৃষ্টতম মানুষ হবে ওই ব্যক্তি, যে তার স্ত্রীর সঙ্গে মিলিত হয় এবং স্ত্রীও তার সঙ্গে মিলিত হয়, অতঃপর সে তার স্ত্রীর গোপনীয়তা ফাঁস করে দেয়। (মুসলিম, হাদিস : ৩৪৩৪)

অন্য বর্ণনায় হাদিসটি এভাবে এসেছে, রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন, ‘ওই ব্যক্তি কিয়ামতের দিন আল্লাহর কাছে সর্বাপেক্ষা বড় আমানত খিয়ানতকারী বিবেচিত হবে, যে তার স্ত্রীর সঙ্গে মিলিত হয় এবং স্ত্রীও তার সঙ্গে মিলিত হয়। অতঃপর সে তার স্ত্রীর গোপনীয়তা ফাঁস করে দেয়। (মুসলিম, হাদিস : ৩৪৩৫)

অনুরূপভাবে স্ত্রীর ও গোপনীয়তা রক্ষা করতে হবে।

ওয়েটার খাবার নিয়ে আসলে সবাই খাবার খাওয়াতে মনোযোগ দিল। খাওয়া শেষ করে কলেজে ফিরে যাবো তখন কোথায় থেকে যেন ইমরান ভাইয়া এসে বললো,
– আয়রা তোমাকে কলেজে খুঁজে পেলাম না। তোমাদের ক্লাসের একটা মেয়ে বললো, তুমি কলেজে এসেছ। কিন্তু সারা কলেজ খুঁজেও পেলাম না।তাই বাসায় ফিরে যাচ্ছিলাম, হঠাৎ এখানে নজর পড়তেই তোমাদের দেখলাম।

আমি উত্তরে কেবল বললাম,
– ভাইয়া আমাদের পাঁচ মিনিট পর ক্লাস শুরু হবে।তাই কলেজে যাই।

– না আজকে ক্লাস করতে হবে না, তুমি আমার সাথে যাবে!

– কিসব বলছেন ভাইয়া? আমি কোথাও যাবো না আপনার সাথে। আমাদের কলেজে যেতে দিন?

– প্লিজ আয়রা আজকে ক্লাস না করলে কিছু হবে না। আমার আম্মু কে তোমার কথা বলেছি আমি! আম্মু তোমাকে দেখতে চেয়েছে।তাই তুমি আমার সাথে যাবে।

– আমি যাবো না।
তুলি ফারহা চল।

আমি চলে যেতে নিলে, ইমরান ভাইয়া আমার হাত শক্ত করে ধরে! তারপর টানতে টানতে নিয়ে যায়। তুলি সাথে আসতে চাইলে, তুলিকে নিষেধ করে দেয়! এদিকে আমি রাস্তায় সিনক্রেট করছি না যত‌ই হোক স্যারের ছেলে বলে কথা। লোকজন জড়ো হলে স্যারের সম্মানহানি হবে।
_______
ইমরান ভাইয়ার আম্মুর সামনে বসে আছি আমি,তখন আমার ফোনে কল আসলো। আননোন নাম্বার থেকে, তবুও রিসিভ করে সালাম দিলাম।
ওপাশ থেকে সালামের জবাব দিয়ে বললো,
– আমার মিষ্টি বউ কেমন আছো?

ভয়ে চুপসে গেলাম আমি, এখন যদি রাহাত জিজ্ঞাসা করে আমি কোথায় আছি! তখন কি জবাব দেব আমি? এদিকে ইমরান ভাইয়ার আম্মু উৎসুক হয়ে তাকিয়ে আছেন!

#চলবে,,,, ইনশা আল্লাহ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here