ছায়া_সঙ্গিনী #পর্ব-১৬,১৭

0
617

#ছায়া_সঙ্গিনী
#পর্ব-১৬,১৭
#Israt_Bintey_Ishaque(লেখিকা)
১৬

কাঠের আলমারি খুলে দুটো ঘড়ি বের করে আনলাম। তারপর রাহাতের হাতে আমার’টা দিয়ে বললাম,
– নাও তুমি নিজ হাতে পড়িয়ে দাও?

সে খুশি মনে পড়িয়ে দেয় আমার হাতে, তারপর আমিও তার হাতে তার’টা পড়িয়ে দিয়ে জরিয়ে ধরে বললাম নাও এখন নিশ্চয়ই আর কোন দ্বিধা নেই? তোমার ব‌উ সম্পুর্ণ রুপে তোমার।এখন সে চাইলেও তাকে আলাদা হতে দিও না কেমন?

রাহাত আমার কপালে তার অধর ছুঁয়ে বললো,
– ইনশা আল্লাহ, সারাজীবন এভাবেই জরিয়ে রাখবো আমার মাঝে। তুমি চাইলেও এই বাঁধন ছিন্ন হতে দিব না। আচ্ছা সব তো হয়েই গেল এবার চলো ফ্যামিলি প্ল্যানিং করি?

– মানে?

– মানে আমাদের কয়টা বেবি হবে সে বিষয়ে পরিকল্পনা আর কি।

– আমার একটা স্লোগান বরাবরের মতো পছন্দ বলবো?

– হুম শুনি কি তোমার সেই স্লোগান?

– “দুটো সন্তানের বেশি নয় একটি হলে ভালো হয়”।এই স্লোগান টাই আমরা ফলো করবো কেমন?

রাহাত মিছে রাগ নিয়ে বললো,
– আমার তো ইচ্ছে ছিল ফুটবল টিম গঠন করার! তুমি তো সবটাই বেস্তে দেওয়ার পরিকল্পনা করে বসে আছো।

ওর এরকম অদ্ভুত কথা শুনে ছোট চোখ গুলো আরো ছোট করে তাকালাম আমি।আর বললাম,
– প্রায় সব ছেলেদের এই স্বপ্ন থাকে,তাই এটা কমন। তোমার যদি এতই ফুটবল টিমের পিতা হতে ইচ্ছে হয় তাহলে অনাথ আশ্রম থেকে নিয়ে আস, তাহলেই সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।

– আচ্ছা একটা কাজ করি, আরো তিনটা বিয়ে করার সুযোগ আছে। সেগুলো করে নিলেই তো সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে তাই না?

– একদম গলা টিপে মে*রে ফেলবো বুঝছো? দ্বিতীয় বার যদি এমন কথা বলতে শুনি। মেয়েরা মৃত্যুর পরও চায় না যে তার স্বামী দ্বিতীয় বিয়ে করুক।আর তুমি আমাকে বলছো এই কথা? তোমাকে ইচ্ছে করছে,,,

– কি বলো?

– জানি না।
একদম কথা বলবা না আমার সাথে।ছারো আমাকে এশার এর আযান হবে এখনি, আমি অযু করে আসি।

সে উল্টো আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে গলায় স্লাইড করতে শুরু করলো। আমার এখন মেজাজ খুব গরম লাগছে ইচ্ছে করছে এখন ওর হাতে কামড় বসিয়ে দেই। কিছুক্ষণ নিরব থেকে তাই করলাম। আকস্মিক আক্রমনে ও আউচ বলে চেঁচিয়ে উঠলো, পরক্ষনেই আবার চুপ হয়ে গেল।যেন তার সাথে কিছুই হচ্ছে না। সবকিছু ঠিকঠাক,যেন কামড়ের বদলে আদর দিচ্ছি। কয়েক মিনিট পর ছেড়ে দিলাম,সে তার হাত একবার পরখ করে নিয়ে বললো,
– তুমি তো আমার থেকেও ভালো লাভ বাইট দিতে পারো! আমাকে একটু শিখিয়ে দাও দেখি? তাহলে তোমাকে ও এতো সুন্দর করে দিতে পারবো হা হা হা,,,

ওর কথা শুনে আমার রাগ কমার থেকে আরো বেরে গেল।তাই দিয়ে দিলাম একটা চিমটি,সেও আমাকে দিল‌। আমি আম্মু করে চেঁচিয়ে উঠলাম, অথচ আমি যতটা গভীরভাবে দিয়েছি সেই তুলনায় ও হালকা ছুঁয়েছে শুধু। তারপর আবার আমি দিলাম, তারপর রাহাত। এরকম করতে করতে দুজনের মধ্যে খুনসুটি ঝগড়া লেগে গেল।
________
দু’জনে নামায পড়ে এসে খাবার খেতে বসলাম,নামাযের সময় কারেন্ট চলে এসেছে।তাই এখন আলোকিত ঘর। রাহাত খেতে খেতে আমার দিকে তাকিয়ে বললো,
– তুমি ঠিক মতো খাবার খাও না? এরকম দিন দিন চিকন হয়ে যাচ্ছ!

আমি বললাম, হুম এখন তো আমি চিকন তারপর বলবে কালো হয়ে গেছ, এখন আর সুন্দরী দেখতে লাগে না। তারপর ধীরে ধীরে বলবে তুমি বুড়ি হয়ে গেছ! আমি জানি সব তোমার দ্বিতীয় বিয়ে করার ধান্দা এগুলো।

রাহাত কিছু বলতে যাবে তখন আমি থামিয়ে দিয়ে বললাম,
– খাবার সময় কথা বলতে নেই, মনোযোগ দিয়ে খাবার খাও। না হয় কাটা বিধবে।

তারপর দু’জনের মাঝে নিরবতা চলে, কেউ কারো সাথে কথা বলি না। খাবার খাওয়া শেষ হলে সব কিছু গুছিয়ে রেখে দেই। তারপর মায়ের রুমে গিয়ে শুয়ে থাকি আমি।ও বিয়ের কথা কেন বললো?তাই ওর সাথে থাকবো না আমি হুহু।

কিছুক্ষণ পর একটা ছায়া দেখতে পেলাম, মুহূর্তেই ছায়াটা আমার কাছাকাছি চলে আসে। তারপর ফিসফিস করে বলে,
– তোমার ছায়া সঙ্গিনী চলে এসেছে ব‌উ।

তারপর আমাকে শুন্যে তুলে নিল ছায়া মানব রাহাত, আমার অর্ধাঙ্গ। যেতে যেতে কারেন্টের লাইট অফ করে সৌর বিদ্যুতের মিনমিন করা লাইট জ্বালিয়ে দিল। আমি ছোটাছুটি করছি আর বলছি,ছারো আমাকে। আমি তোমার সাথে থাকবো না হুহ। তুমি পঁচা একদম ভালো না।
সে বিছানায় আমাকে শুইয়ে দিয়ে বললো,
– সরি ব‌উ আর জীবনেও বিয়ের কথা বলবো না ইনশা আল্লাহ। এবার অন্তত শান্ত হ‌ও প্লিজ?

আমি চুপ করে অন্য দিকে তাকিয়ে রইলাম।সে মন খারাপ করে বললো, আচ্ছা যাও তোমাকে বিরক্ত করবো না তবুও তুমি এখানে ঘুমাও। তারপর চলে যেতে নিলে হাত ধরলাম।ব্যাস আর কিছু বলতে হয়নি তাকে। আমার সম্মতি পেয়ে মুচকি হেসে পুরো আমাকেই তার আয়ত্তে দখল করে নেয়!

স্ত্রীকে ভালোবাসা প্রসঙ্গে হাদিসে হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘তোমাদের মধ্যে তারাই উত্তম যারা তাদের স্ত্রীদের জন্য উত্তম। আর আমি আমার স্ত্রীদের জন্য তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম ব্যক্তি।
_______
গ্রামের বাড়ি তার উপর টিন সেট ঘর, বাথরুম বাহিরে থাকবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু দরজা খুলতেই আমার সারা শরীর শিউরে উঠলো। ঘুম ঘুম চোখে এদিক সেদিক তাকাচ্ছি, মনে হয় যেন এই বুঝি কোন ভুত এসে হামলে পড়লো! দূরে সারি বেঁধে গাছপালা, কিন্তু এখন মনে হচ্ছে এগুলো একেকটা প্রেতাত্মা দাঁড়িয়ে আছে। না বাবা আমি কিছুতেই বাহিরে গিয়ে শাওয়ার নিতে পারবো না।যদিও এসব ভুত প্রেতাত্মা বলে কিছু নেই। তবুও জিন জাতি তো আছে! শুনেছি এদের মধ্যে মানুষের মতো ভালো খারাপ আছে।যদি খারাপ গুলো এসে আমার গাড় মটকে দেয়!ওরে বাবা না না কিছুতেই আমি এখন শাওয়ার নিব না।তাই দরজা লাগিয়ে দিলাম, আবার ভাবছি ফরজ গোসল না করলে তো আমি নামায পড়তে পারবো না, তাহলে? না না নামায কিছুতেই মিস দেওয়া যাবে না।
যাই রাহাত কে নিয়ে আসি। গেলাম রাহাত কে ডাকতে।ওরে ডাকতেই ও ঘুম ঘুম কন্ঠে বললো,
– আবার কি হলো? একটু ঘুমাতে দাও না ব‌উ। এতো সময় যাবত তো ঘুমাতে দিলে না।

ওর এরকম কথায় বরকে যাই আমি, কি বললো ও আমি ওরে ঘুমাতে দেইনি না ও আমাকে ঘুমাতে দেইনি? এখন সব দোষ আমাকে দেওয়া হচ্ছে। ধারাও তোমাকে ঘুমাতে দিচ্ছি আমি,,,
হাত ধরে অনেক টানাটানি করলাম একটুও নাড়াতে পারলাম না। তাই গিয়ে পায়ে শুরশুরি দেওয়া শুরু করলাম। বেচারা পা নাড়াতে নাড়াতে শেষ,ওর পায়ে ভিশন শুরশুরি লাগে।তাই এই সুযোগ হাত ছাড়া করলাম না।ফল স্বরুপ উঠে বসে বললো,
– দুষ্টু ব‌উ কোথাকার। আমাকে তুলেই ছাড়লো।

আমি হাসতে হাসতে বললাম,
– এবার চলো কিছুক্ষণ পর আযান হবে।চলো না,,,,

টিউবওয়েল এর চারপাশে টিন দিয়ে বাথরুম তৈরি করা হয়েছে যাকে এখানে বলে গোসলখানা। রাহাত বড় বালতি তে পানি ভরে দিয়ে ঘরের দরজায় টুলে বসে থাকে, তারপর আমি নিশ্চিন্তে শাওয়ার নিয়ে আসি।এসে দেখি সে টুলে বসে বসে ঘুমাচ্ছে,যা দেখে আমি হাসতে হাসতে শেষ। ওরে ডেকে শাওয়ার নিতে পাঠিয়ে দিলাম। তারপর আমি দরজা বন্ধ করে ঘরে বসে আছি।ফুল স্পীডে ফ্যান চলছে মাথার উপরে, এদিকে শাওয়ার নেওয়াতে খুব শীত অনুভব হচ্ছে। কিন্তু চুল গুলো ভিজে থাকলেও সমস্যা, ঠান্ডা লেগে যাবে।
দিনকে দিন টাক বেল হ‌ওয়ার উপক্রম! এতো পরিমাণে চুল পড়ে। তবে লম্বা বলে মায়া হয় কাটতে। আমাকে রাহাত বলে, পাতলা চুলের কেশবতী হা হা হা,,,
________

সকালের নাস্তা তৈরি করছি আমি আর রাহাত মিলে। পেঁয়াজ মরিচ কুচি করে কেটে নিয়েছি। এগুলো ডিম দিয়ে প্রথমে ভেঙে গুঁড়ো করে বেজে নিব তারপর গতকালের ভাত একসাথে দিয়ে কিছুক্ষণ নেড়েচেড়ে উঠিয়ে নিব।
এটা হচ্ছে ভেজাল বিহীন ঝটপট রেসিপি হা হা হা,,,, তো আমি ভাজা করেছি আর রাহাত পাশে বসে আছে।তো ডিম ভাজি হয়ে এলে রাহাত আঙুলে কালি মাখিয়ে আমার নাকের ডগায় লাগিয়ে দিল! আমিও কি কম নাকি? আমার কলেজের স্যার বললেন যে একটু দেবে তোমরা তাকে আরেকটু বেশি দিবে!তাই স্যারের কথা রাখতে, আমি ডিম ভাজা গুলো নামিয়ে ভাতের পাতিলের নিচ থেকে দুই হাত দিয়ে কালি লাগিয়ে রাহাতের পুরো মুখশ্রী কালি মাখিয়ে দিলাম।এখন খুব শান্তি লাগছে আহা কি শান্তি আর শান্তি।
কিন্তু আমার এই শাস্তি বেশিক্ষণ ধরে রাখতে পারলাম না। পাশের বাড়ির এক জেঠি’শ্বাশুড়ি আসলেন খবর নিতে। গতকালের ঝর ঝাপটার মধ্যে ব‌উ শ্বাশুড়ি ঠিক আছি কিনা?দেখতে এসেছেন আর কি।এখন কথা হচ্ছে গিয়ে,ঐ বৃদ্ধা মহিলা রাহাত কে দেখে চোখ গুলো ছানাবড়া করে বললো,
– অমা ব‌উ!এই বেডা মানুষ কেডা? এমন ক‌ইরা কালি মাইক্ষা রাখছে কা?

আমি ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছি,কি বলে এই মহিলা?বেডা মানুষ মানে কি বুঝাতে চাচ্ছেন উনি? শুধু তাই নয় মহিলা এখন চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করে দিয়েছেন! এদিকে রাহাতের কোন কথাই শুনছেন না তিনি। আমি মাথায় হাত দিয়ে বসে আছি, এই কোন গ্রামে আসলাম আমি? মহিলার চোখে কোন সমস্যা আছে নাকি? না হয় কালি মাখা থাকলেও কি পরিচিত মুখশ্রী চিনতে পারে না? এটা কোন কথা হলো? মহিলা চেঁচামেচি শুনে মানুষজন দৌড়ে আসে। রাহাত আর কিছু না বলে, গিয়ে মুখ ধুয়ে আসে। আমি শুধু নিরব দর্শক হয়ে বসে বসে দেখছি গ্রামের মানুষজন দের কান্ড কারখানা। রাহাতের চাচা তো বোন রোজিনা হাসতে হাসতে শেষ।একজন ভাবী বললেন,
– চাচি আম্মা আন্নে আমাগো রাহাত রেই চিনতে পারলেন না।এ তো আমাগো রাহাত।

তখন মহিলা চোখ পাকায়া বলে,
– তয় কালি মাইক্কা রাখছিল ক্যান?এমনে কালি মাইক্কা রাখলে চিনবার পারুম কেমনে?

তখন একটা ছেলে বললো,
– ভাইয়ে মনে হয় সেনাবাহিনী দেইক্কা মুখে কালি মাইক্কা রাহে।

তাই বলে বাড়িতে কালি মাইক্কা রাহে হা হা হা,,, খুব হাসি পাচ্ছে আমার,,,,

#চলবে,,, ইনশা আল্লাহ।

#ছায়া_সঙ্গিনী
#পর্ব-১৭
#Israt_Bintey_Ishaque(লেখিকা)

চারিদিকে প্রকৃতির মাতাল করা হাওয়া বইছে,এ যেন সৃষ্টিকর্তার আরেকটি নিয়ামতের অংশ বিশেষ। নেই কোন যান্ত্রিক কোলাহল’এর শব্দ দূষণ। চারিদিকে সুনসান নীরবতা। প্রকৃতির এই অপরুপ সুন্দর্যের মাঝে, পুকুর পাড়ের পাকা সিঁড়ি’তে আমি আর রাহাত বসে আছি। শুধু বসে নয় একে অপরের কাঁদে মাথা রেখে বসেছি।মা জানিয়েছেন দু’দিন পর আসবেন।আর আমাদের
বলেছেন বড় আপুর বাসায় মানে রাহাতের আপুর বাসায় যাওয়ার জন্য।আপু কতোবার কল করে বললেন যেতে।

চারিদিকে গাছপালায় ভরা, মাঝে মাঝে পাখির কিচিরমিচির শব্দ শুনতে পাচ্ছি।
একটা কাক খুব করে ডাকছে, তখন আম্মুর কথা খুব মনে পড়লো যখন কোন কাক ডাকতো তখন আম্মু বলতো আল্লাহ’রে ডাক আল্লাহ’রে ডাক।এর কারণ আম্মু মনে করতো কাকে’রা কোন বিপদ সংকেত পেলে এভাবে ডাকে। তখন আমি বলতাম এগুলো সব বানোয়াট কথা আম্মু। ওদের ডাক ই কা কা করা।যা প্রকৃতি প্রদত্ত। কিন্তু আম্মু আমার কথা মানতে নারাজ।সে তার বিশ্বাস ই অটুট থাকতো।

আম্মু কে যখন ই কোন কথা নিয়ে বলতাম আম্মু এটা কোন হাদীসে বর্ণিত নেই তখন আম্মু রেগে যেত আর বলতো এগুলো সবাই মানে সবাই জানে ইত্যাদি ইত্যাদি। আমার কথা বিশ্বাস ই করতো না। খুব সহজ সরল ছিল আম্মু আমার। একদিন আমরা সবাই এই পথে চলে যাবো তবুও একজন আরেকজনের চলে যাওয়া মেনে নিতে পারি না, কষ্ট হয় খুব।
চোখের পানি কিছুতেই বাদ মানছে না।নিরবতার মাঝে হঠাৎ আমার কান্না দেখে বিচলিত হয়ে যায় রাহাত। আমার চোখের পানি মুছে দিয়ে বললো,
– আয়রা কি হয়েছে তোমার? হঠাৎ এভাবে কাঁদছো যে?

আমি কেঁদে কেঁদেই বললাম,
– আম্মুর কথা খুব মনে পড়ছে আমার, আম্মু কেন আমাকে এখন আর নাম ধরে ডাকে না? কেন আদর করে বুকে জড়িয়ে ধরে না? কেন খেতে না চাইলে নিজ হাতে খাইয়ে দেয় না? কেন শাসন করে বলে না,আর কতো মোবাইল টিব্বি? এবার একটু খ্যামা দে। পাশের বাড়িতে কি হয়েছে না হয়েছে কেন আর বলে না? কেন বলে না পরের মায় পিছার বারি দিব এমনে অলসতা করলে! বলতে পারো তুমি?

রাহাত তার সাথে আমায় মিশিয়ে নিয়ে বললো,
– তোমার কষ্টটা আমি বুঝতে পারি আয়রা। কিন্তু তোমাকে তো আল্লাহ তা’আলার পরিকল্পনার প্রতি শ্রদ্ধা থাকতে হবে। আমরা তো জানি আল্লাহ তা’আলা উত্তম পরিকল্পনাকারী।তার কাছে এই নিয়ম উত্তম মনে হয়েছে বলেই তিনি এই পরিকল্পনা করে আমাদের দুনিয়ায় পাঠিয়েছেন। এই দুনিয়া তো শুধু একটা পরীক্ষা কেন্দ্র, সেই পরিক্ষার্থী আমরা সবাই।
দুনিয়াতে মানুষের আগমন ও জীবনের লক্ষ্য হলো আল্লাহ তাআলার বিধি-বিধানের বাস্তবায়ন তথা তাঁর ইবাদত-বন্দেগি করা। আল্লাহ তাআলা কুরআনে মানুষ সৃষ্টির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সুষ্পষ্ট ভাষায় তুলে ধরেছেন-
‘আমি জিন ও মানবজাতিকে শুধুমাত্র আমার ইবাদত ছাড়া অন্য কোনো উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করিনি। অর্থাৎ ইবাদতের জন্যই সৃষ্টি করেছি।’ (সুরা যারিয়াত : আয়াত ৫৬)

– আচ্ছা আমরা দুজনেও তো দু’জন কে ছেড়ে চলে যেতে হবে। যেকোন একজন কিভাবে থাকবো আমরা? কেন এতো নিষ্ঠুর নিয়ম?

– সর্ব মহলের স্বীকৃত বিষয় মানুষের চাহিদা সমূহের মধ্যে বিবাহ হচ্ছে সব চেয় বেশী চাহিদাসম্পন্ন বস্তু,এবং এটা জান্নাতে পুরুষ-মহিলার উভয়ের ক্ষেত্রে বাস্তবায়িত হবে,মহিলাকে আল্লাহ তা’আলা জান্নাতে তার দুনিয়ার স্বামীর সাথে বিবাহ দিবেন(যদি ঐ স্বামী ও জান্নাতি হয়)।

যেমন আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ
হে আমাদের পালনকর্তা, আর তাদেরকে দাখিল করুন চিরকাল বসবাসের জান্নাতে, যার ওয়াদা আপনি তাদেরকে দিয়েছেন এবং তাদের বাপ-দাদা, পতি-পত্নী ও সন্তানদের মধ্যে যারা সৎকর্ম করে তাদেরকে। নিশ্চয় আপনি পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।
(মাজমু’উ ফাতাওয়া ওয়া রাসাঈল ইবনে উসাইমিনঃ২/৫১

আল্লামা আলুসি বাগদাদী রাহ বলেনঃ
জান্নাতি পুরুষদেরকে তার পৃথিবীর স্ত্রী দেওয়া হবে।
তাই আমরা সর্বদা চেষ্টা করবো আল্লাহ তা’আলার ইবাদত পালন করার।যাতে আমরা দুজন একসাথে জান্নাতে থাকতে পারি।একে অপরকে সাহায্য করবো ইবাদত এর কাজে কেমন?

– ইনশা আল্লাহ, আল্লাহ কবুল করুন আমীন।

– সুম্মা আমীন।
_________
সম্পূর্ণ পর্দায় নিজেকে আবৃত করে নিলাম। রাহাত শরবতের মতো হালকা রঙের সার্ট পরেছে ইন করে।মা শা আল্লাহ,সুদর্শন পুরুষদের থেকে কোন অংশে কম নয়। আমি আগে তৈরি হয়ে বসে বসে তার তৈরি হ‌ওয়া দেখছি। একদম পরিপাটি করে নিজেকে সাজাতে ব্যস্ত সে। আর্মি ছেলেরা এভাবে নিজেদের পরিপাটি করে রাখে বলেই তাদের বয়স বেশি একটা বোঝা যায় না। ওদের চলাফেরা খুবই স্ট্রং হয়ে থাকে। রাহাত ও কিন্তু আমার থেকে অনেকটা বড়।হাবিব ভাইয়া যেমন তার বাড়ি গাড়ি টাকা পয়সা সব কিছু রেডি ছিল বলে দ্রুত বিয়ে করে নিয়েছে। সেখানে রাহাতের কিছুই ছিল না, জীবন যুদ্ধে জয়ী হয়ে তারপর তাকে বিয়ের কথা ভাবতে হয়েছে। অবশ্য হাবিব ভাইয়া বিয়েটা তাড়াতাড়ি ই করেছিলেন,ডিগ্রিতে পড়াশোনা শেষ করে বিয়ে করেছেন। তখন ধরা যায় তার অনুমানিক বয়স চব্বিশ। তারপর বিদেশে চলে যায় হাবিব ভাইয়া। বিদেশে যাওয়ার এক বছর পর আপুকে নিয়ে যান।
রাহাত আর হাবিব ভাইয়ার বয়স প্রায় সেইম, হয়তো মাসের বড় ছোট হতে পারে।তো সে অনুযায়ী রাহাতের বয়স এখন সাতাশ বছর।আর আমার বিশ। মানে রাহাত আমার থেকে গুনে গুনে সাত বছরের বড়।সে তুলনায় আমাদের বন্ডিং টা খুবই ভালো আলহামদুলিল্লাহ।কিছুটা বয়স্ক জীবনসঙ্গী থাকা দাম্পত্য জীবনে আরও স্থিতিশীলতা আনতে পারে। তাই স্বামী-স্ত্রীর বয়সের পার্থক্য ৫-৭ বছর হওয়াই আদর্শ বলে বিবেচিত। বয়সের ব্যবধান সত্ত্বেও একটি সফল বিবাহের চাবিকাঠি হলো যোগাযোগ, পারস্পারিক শ্রদ্ধা, ভালবাসা ও স্থিতিশীলতা।

এক ধ্যানে মগ্ন হয়ে বসে আছি বলে রাহাত এসে বসলো আমার পাশে। তারপর বললো,কি ম্যাডাম সেই কখন থেকে লক্ষ্য করছি আপনি কিছু একটা নিয়ে গভীর চিন্তায় মগ্ন।কি এমন ভাবছেন বলেন তো?

আমি রাহাত’কে আবারো ভালো করে পর্যবেক্ষণ করে বললাম, আপনার কথাই ভাবছিলাম।তো আর্মি সাহেব আপনি যেভাবে সাজুগুজু করেছেন, বাহিরে বের হলে তো মেয়েরা পাগল হয়ে যাবে!

– আচ্ছা তো আমার ব‌উ পাগল হয়েছে? আমার বউ পাগল হলেই হবে।

– তাহলে তোমার উচিৎ বাহিরে অগোছালো হয়ে বের হ‌ওয়া আর রুমে আমার সামনে সেজেগুজে বসে থাকা হা হা হা,,,,

– আচ্ছা এবার চলো বের হতে হবে, অলরেডি বারোটা বেজে গেছে।আর তুমি এভাবে যাবে না! তোমাকে অনেক সুন্দরী লাগছে, আমি চাই না আমি ছাড়া অন্য কেউ তোমার সুন্দর্যো দেখুক।

ওর কথা শুনে বিষ্ময়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেলাম আমি। কি বলে এই ছেলে? এভাবে কালো বোরকা ছয় পার্ট হিজাবে নিজেকে আড়াল করার পরেও কিনা বলছে এভাবে যেতে পারবো না! তাহলে কিভাবে যাবো?
সে আমাকে অবাক করে দিয়ে পিছন থেকে ছয় পার্ট এর এক পার্ট এনে চোখের উপর দিয়ে দিল। তারপর বললো,এবার ঠিক আছে।জানো তো কালো বোরকার মধ্যে দিয়ে, তোমার ছোট ছোট কালো চোখের মণি গুলো খুব আকর্ষণীয় দেখাচ্ছে।তাই আমি চাই অন্য কেউ আমার মতো দূর্বল হোক তোমার প্রতি। এবার চলো চলো।

তার কথার উত্তরে আমি আর কিছু বললাম না। একদিন কলেজে ইমরান ভাইয়া বলেছিলেন,আয়রা জানো তুমি নিজেকে কালো পর্দা দিয়ে সম্পূর্ণ আবৃত করতে পারোনি! তোমার ঐ দুটি চোখ ই যথেষ্ট আমাকে গায়েল করার জন্য। সেদিন ইমরান ভাইয়া কে পাগল ছাড়া কিছুই মনে হয়নি আমার। আজকে সেই একই কথা রাহাত ও বললো ‌।
________
দের ঘন্টার পথ পাড়ি দিয়ে পৌঁছালাম আপুর বাসায়।এক তলা বাকা দালান বাড়ী তাদের। বাড়িতে গাছপালা খুব কম,যেগুলো আছে সেগুলো ছোট ছোট। বুঝতে পারলাম নতুন বাড়ি করে এসেছে তারা। রাহাতের দুলাভাই সিংগাপুর থাকেন।তাই তাদের অবস্থা সচ্ছল ই বলা যায়। আপুর দুইটা ছেলে। ছোট টা স্কুল থেকে মাত্র ফিরলো,বড়’টা এখনো ফিরেনি। ছোট জন এসেই আমাকে খুব মিষ্টি করে বললো,
– মামি কেমন আছো?

আমি তাকে কাছে নিয়ে বললাম,
– আলহামদুলিল্লাহ ভালো।তুমি কেমন আছো বাবা?

সেও মিষ্টি করে জবাব দিলো, তারপর কোন ক্লাসে পড় জিজ্ঞাসা করতে বললো, নার্সারি তে পড়ে।মা শা আল্লাহ খুব শান্ত ছেলেটা।এই বয়সের বাচ্চারা খুব দুষ্টু প্রকৃতির হয়ে থাকে। উদাহরণ স্বরূপ আমাদের সাফা আর মার‌ওয়া। দুটো কে খুব মিস করি, মাঝে মাঝে ভিডিও কলে কথা হয়। তখন আমাকে বলে, আমি যেন তাদের বাসায় যাই। অবুঝ মন ওদের, আমি কিছুতেই বোঝাতে পারি না যে আমি চাইলেও তাদের কাছে পৌঁছাতে পারবো না। সেদিন আপু শিখিয়ে দিচ্ছে আর তারা পাকামো করে বলছে,
– বাবু কবে আসবে? আমরা একটা ভাইয়া বাবু চাই। তুমি তাড়াতাড়ি একটা ভাইয়া বাবু নিয়ে আসো, আমরা এসে খেলবো ভাইয়া বাবুর সাথে।

তখন আমি বললাম, ভাইয়া বাবু কোথায় থেকে আনবো আমি? তখন তারা নিজ থেকে বলে, তোমার পেট থেকে আনবে!যেমন করে রোসিয়া’র আম্মুর পেট থেকে রোসিয়ার জন্য ভাইয়া বাবু নিয়ে এসেছে!
ওদের এরকম কথা বার্তায় আমি হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকি,কি বলবো এদের। ডিজিটাল বাচ্চা গুলো আমার থেকেও বেশী জেনে বসে আছে।
খুব মনে পড়ছে ওদের কথা। আপুর ছেলে জিহান বললো,মামি তুমি একটু এই রুমের বাহিরে যাবে? আমি বললাম কেন বাবা?সে বললো,
– আমি স্কুল ড্রেস গুলো চেঞ্জ করবো তাই।

ওর কথা শুনে আরো একবার অবাক হলাম আমি। এইটুকুনি ছেলে সে আমার সামনে চেঞ্জ করতে লজ্জা পাচ্ছে?যাক এটা খুব ভালো।প্রত্যেকটা মানুষের লজ্জা থাকা জরুরি।যে মানুষদের লজ্জা থাকে সে অন্যায় কাজ করতে সংকোচ বোধ করে,ফলে অন্যায় কাজ থেকে বিরত থাকে।
________
রুমের বাহিরে বের হতেই আপুর শ্বাশুড়ি আম্মা আমাকে তার কাছে যেতে বললেন। বৃদ্ধা পান চিবোতে চিবোতে এটা ওটা জিজ্ঞাসা করছেন।এক পর্যায়ে বললেন,
– তো ব‌উ বাচ্চা কাচ্চার খবর কি? শুনছি তোমাগো বিয়া হ‌ইছে মেলা দিন হ‌ইছে। এইবার একটা বাচ্চা নিয়া নাও বুঝঝো?

বুঝলাম না সবাই এভাবে বাচ্চা নিয়ে পরেছে কেন?….

#চলবে,,,, ইনশা আল্লাহ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here