ছায়া_সঙ্গিনী #পর্ব-২০,২১

0
1111

#ছায়া_সঙ্গিনী
#পর্ব-২০,২১
#Israt_Bintey_Ishaque(লেখিকা)
২০

সন্ধ্যায় রেস্তোরাঁয় যাওয়ার উদ্দেশ্যে রওনা হলাম আমরা ছয় জন।ঢাকায় কোয়ার্টারে আসার পর রাহাতের কলিগ এবং তাদের ব‌উ’রা ট্রিট এর জন্য ধরে রাহাত কে। বিয়ে করেছে এতো মাস হয়ে গেছে অথচ তাদের মিষ্টি পর্যন্ত খাওয়ায়’নি রাহাত,সে নিয়ে তাদের অনেক অভিযোগ।তাই আজকে বের হ‌ওয়া।
অতঃপর,
ক্যান্টনমেন্ট এর কাছাকাছি একটা রেস্তোরাঁয় আসলাম।ওয়েটার মেনু কার্ড নিয়ে এলে, রাহাত তার কলিগ, হাসান আর সৈকত ভাই এবং তাদের স্ত্রী নাইমা আর মহুয়া ভাবীদের দিলেন তারা কি খাবেন অর্ডার করার জন্য। আমাকে কি খাবো জিজ্ঞাসা করলে আমি বললাম,
– ডিমের স্যান্ড‌উইচ আর ফ্রুট কাষ্টার্ড। রাহাত বললো আমি যা খাবো সেও তাই খাবে।

তারপর তারা খাবার অর্ডার করলো,

হাসান ভাইয়া,
– লাজানিয়া,ক্রয়স্যান্ট।

সৈকত ভাইয়া,
– ওনিয়ন রিং,প্যানকেক।

নাঈমা ভাবী,
– স্প্রিং রোল,মিটবল।

মহুয়া ভাবী,
– পিজা,ফ্রেঞ্চ ফ্রাই।

খাবার আনতে আনতে আমরা সবাই গল্প শুরু করি।কার ব‌উদের সাথে কিভাবে পরিচয় হলো তারপর বিয়ে হলো এগুলো নিয়ে।এর মধ্যে সৈকত ভাইয়া আর মহুয়া ভাবীর বিয়েটা ছিল ইন্টারেস্টিং। সৈকত ভাইয়া যেমনটা বললেন,
– সৈকত ভাইয়া যখন ট্রেনিং এ কোন এক গ্রামে যায় এবং সেখানে তাঁবু বানিয়ে থাকে তখন ঐ গ্রামের সুন্দরী বালিকা মহুয়া কে দেখে পছন্দ হয় তার। কিন্তু সেনাবাহিনীর নিয়ম অনুযায়ী তাদের চাকরিতে জয়েন করার ছয় বছর পর বিয়ে করার অনুমতি দেওয়া হয়। সেই কারণে চাইলেও বিয়ে করতে পারে না মহুয়া কে। তবে গোয়েন্দা লাগিয়ে ঠিকই মহুয়ার খবর রাখে।এর চার বছর পর বিয়ে ঠিক হয়ে মহুয়ার। সেই খবর শুনে সৈকত ভাই বিয়ের প্রস্তাব পাঠায় মহুয়া দের বাড়ি! মহুয়ার বাবা কিছুই রাজি নন। মহুয়ার বাবা তার পাটনার এক কাপড়ের ব্যবসায়ির সাথে বিয়ে ঠিক করে তিনি। পাত্রের বয়স ত্রিশের উর্দ্ধে! অথচ মহুয়ার বয়স পনেরো! মহুয়া প্রথম থেকেই এই বিয়েতে রাজি নয়।তাই বিয়ের প্রস্তাব পেয়ে এবং সৈকত কে দেখে পালিয়ে আসে সৈকতের সাথে! সৈকত বিয়ে করে নেয় মহুয়া কে! তবে সৈকতের পরিবার ছাড়া বিয়ের কথা কাউকে জানানো হয়নি।যখন সৈকতের অফিস থেকে বিয়ের অনুমতি দেওয়া হয়, তখন আবার নতুন করে বিয়ে করে তারা। বিয়ে করে অফিসে পেপার্স জমা দেয়।

এখন শুনেছি মহুয়া ভাবীর বাপের বাড়ির সবাই মেনে নিয়েছে বিয়েটা। আলহামদুলিল্লাহ।
______
ওয়েটার খাবার নিয়ে আসে, সবাই খাবার খেতে শুরু করলাম।প্রত্যেক স্বামী ব‌উরা একে অপরকে খাইয়ে দিচ্ছে। পরিবেশটা খুবই আনন্দময় হয়ে উঠেছে। স্বামী স্ত্রীর সম্পর্কটার মতো সুখ আর হয়না। একে অপরের প্রতি,মায়া, ভালোবাসা, বিশ্বাস,কেয়ার, শেয়ার সবকিছু থাকে তখন সুখের কমতি হয় না।
খাবার খাওয়া শেষে বসে বসে বিভিন্ন ধরনের মশলা চিবোচ্ছি তখন মহুয়া ভাবী বললেন,
– ওই লোকটা যে আর আসছে না?

নাঈমা ভাবী বললেন, কোন লোক?
– আরে ঐ যে খাবার দিয়ে যায়।
– একটু পর আসবে হয়তো।

তারা ফিসফিস করে কথা গুলো বলছিল তখন আমি শুনতে পেলাম।যাই হোক ওয়েটার আসে দশ মিনিট পর। তারপর রাহাত বিল দিতে গেলে মহুয়া ভাবী বলে উঠলো,
– ভাই এই লোক তো আমার বাকি খাবার দিল‌ই না!আপনি এখনি টাকা দিয়ে দিচ্ছেন? এখন দিবেন না, দিলে আমার বাকি খাবার দিব না।

ওয়েটার সহ আমরা সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি, তখন ওয়েটার বললো,
– ম্যাম আমি তো আপনাদের অর্ডার করা সমস্ত খাবার সার্ভ করেছি।আপনারা তো মোট দশ আইটেম খাবার অর্ডার করেছেন,সব গুলোই তো দেওয়া হয়েছে।

মহুয়া ভাবী রেগে মেগে বললেন,
– কি বলছেন আপনি? আপনি তো আমার ফ্রেঞ্চ ফ্রাই ই দিলেন না! আবার বলছেন সব দিয়েছেন?

এদিকে মহুয়া ভাবীর কথা শুনে আমরা বিষ্ময়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ়। রাহাত ব্যাপারটা বুঝতে পেরে বিল মিটিয়ে ওয়েটার কে বিদায় করলো। তারপর সৈকত ভাইয়া বললেন,
– মহুয়া তোমার পিজা আর ফ্রেঞ্চ ফ্রাই তো দেওয়া হয়েছে। তাহলে তুমি এসব কি বলছো? লোকটা এখন কি ধারণা করবে বলোতো?

– আমি এতো কিছু জানি না, তুমি দেখনি? আমাকে শুধু আলু ভাজি আর পিজা দিলো! ফ্রেঞ্চ ফ্রাই কখন কোথায় দিল?

মহুয়া ভাবীর এরকম কথার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না আমরা।তাই ফল স্বরুপ জর্জর করে হেসে দিলাম সবাই।আর সৈকত ভাইয়া মাথায় হাত দিয়ে বসে রইলেন। নাঈমা ভাবী হাসতে হাসতে বললেন,
– ভাবী ঐ আলু ভাজি ই হচ্ছে গিয়ে আপনার ফ্রেঞ্চ ফ্রাই!

তখন মহুয়া ভাবীর মুখশ্রী বেলুনের মতো ফাঁকা হয়ে গেল। সৈকত ভাইয়া বললেন,
– যেই কারণে আমি এতো দিন তোমাকে ফ্রেঞ্চ ফ্রাই খাওয়াইনি। আমি জানতাম তুমি এগুলো কে আলু ভাজি বলবে আর আমাকে বলবে রেস্তোরাঁয় তোমাকে আলু ভাজি খাওয়ানোর জন্য নিয়ে আসি। এখন দেখছি আমার ই ভুল তোমাকে একবার খাইয়ে দেখানোর উচিৎ ছিল আমার।

বুঝলাম ভাইয়া রেগে গিয়েছেন, তাই বললাম থাক ভাইয়া বাদ দিন। আমার একজন স্যার বলতেন, মানুষ ভুল না করলে কি গরু ছাগল ভুল করবে?তাই মানুষ মাত্রই ভুল। তাছাড়া পৃথিবীতে আল্লাহ সুবহানাল্লাহ তা’আলা এতো নেয়ামত সৃষ্টি করেছেন যা এখনো আমাদের ধরা ছোঁয়ার বাইরে। এবং আমরা কখনো চোখেও দেখেনি।তাই এরকম হ‌ওয়া স্বাভাবিক,বিষয়টা অস্বাভাবিক ভাবে না নিলেই হয়।
আমার সাথে সবাই একমত পোষণ করলেন। তারপর বাসায় ফিরে এলাম সবাই।
_______

এক সপ্তাহ পর,
মাকে সঙ্গে করে ঢাকায় ফিরে এসেছি আমরা।এখন থেকে আমি রাহাত মা এখানেই কোয়ার্টারে থাকবো। রাহাত অফিসে চলে গেছে,আর আমি পেট ব্যথায় কঁকিয়ে উঠছি খনে খনে। তবে আজকে পেটের ব্যাথা থেকে মনের ব্যাথাটা বেশি!যার কারণে চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে আমার।
রাহাত অফিসে যাওয়ার ঘন্টা খানেক পর পিরিয়ড শুরু হয় আমার।পেট ব্যথা সবসময় ই হয় নতুন কিছু নয়। কিন্তু আমি যে কতো আশা করে ছিলাম,”আসবে আমার ঘরে একটা ছোট্ট সোনা, ভরিয়ে দিবে খুশির আলোয় তার জোছনা”।(দুটো বাক্য গান থেকে নেওয়া) সেই আশা মুহূর্তেই ভেঙে চুরমার হয়ে গেল আমার।
আমার একটা বান্ধবী বলেছিল, আর্মিদের কঠোর ট্রেনিং এর কারণে তাদের শারীরিক সমস্যা হয় যার ফলে অনেকের বেবি হয় না!
এসব কথা আজ খুব মনে পড়ছে আমার,তাই আরো বেশি কষ্ট হচ্ছে। আমি যে মাতৃত্বের স্বাদ নিতে চাই আল্লাহ।ইয়া আল্লাহ আমাকে তুমি দয়া করো, আমি ছাড়া তো তোমার অনেক বান্দা আছে কিন্তু তুমি ছাড়া তো আমার কোন মাবুদ নেই। তোমার এই পাপি বান্দা কে রহম করো আল্লাহ।

বালিশে পেটে চেপে ধরে কাঁদছি, শ্বাশুড়ি মা এসে বললেন,
– ব‌উ তোমার মোবাইল বাজতাছে,ধরো না ক্যান?এই নাও।

আমি দ্রুত চোখের পানি মুছে, ফোন হাতে নিয়ে দেখি আপু কল করেছে বিদেশ থেকে। আমি কল বেগ করলাম।আপু কল রিসিভ করে বললো,
– কিরে কি করছিস তুই? কতোবার কল করলাম। রিসিভ ই করছিস না।

– আসসালামু আলাইকুম।
কেমন আছো আপু?

– ওয়ালাইকুমুস সালাম।
আলহামদুলিল্লাহ ভালো। তুই কি অসুস্থ আয়রা? কথা কেমন যেন শুনাচ্ছে!

– ঐ সব সময়ের মতো পেট ব্যথা করছে। সাফা আর মার‌ওয়া কেমন আছে? কোথায় ওরা?

– আয়রা তুই কি প্রেগন্যান্ট নিয়ন্ত্রণের জন্য,,,

– না আপু সেরকম কিছু নয়, এমনিতেই পিরিয়ড শুরু হয়েছে।আপু আমার কি কখনো বেবি হবে না?

– হোপ!কিসব অলোক্ষুনে কথাবার্তা বলছিস তুই? ধৈর্য ধরে অপেক্ষা কর, আল্লাহ তা’আলা এর ফল দিবেন ইনশা আল্লাহ।
এসব নিয়ে একদম দুশ্চিন্তা করিস না। সাফা আর মার‌ওয়া ওদের বাবার সাথে বাহিরে বের হয়েছে। শোন ঠিক মতো খাওয়া দাওয়া করবি,এসব নিয়ে দুশ্চিন্তা করিস না। প্রথম প্রথম এরকম হয়, কয়েক মাস পর ঠিক হয়ে যাবে ইনশা আল্লাহ।

– আচ্ছা আপু দো’আ ক‌ইরো তোমার কথা যেন সত্যি হয়।পরে কথা বলবো ভালো থেকো।
আল্লাহ হাফেজ।

– আচ্ছা তুই ও ভালো থাকিস, আল্লাহ হাফেজ।
_____
আমাকে অসুস্থ দেখে মা সব রান্না বান্না করেন। দুপুরে রাহাত আসে, আমাকে শুয়ে থাকতে দেখে পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,
– কি হয়েছে আয়রা? শরীর খারাপ? তুমি কি কান্না করেছো?

আমি শুধু বললাম,পেট ব্যথা করছে সকাল বেলা থেকে।ও বললো ঔষধ খেয়েছি কিনা? আমি বললাম, এই সময় পেইনকিলার না খাওয়াই ভালো।ও ওঠে কোথায় যেন গেল, আমি আগের মতই শুয়ে রইলাম।এর কিছুক্ষণ পর গরম দুধ গ্লাসে করে নিয়ে এলো।এই সময় গরম খাবার খাওয়া উচিৎ। বিশেষ করে গরম পানি,দুধ, চা,কফি। এগুলো খেলে অনেক উপকার পাওয়া যায়, বিশেষ করে পেট ব্যথার জন্য।
আমাকে ধীরে ধীরে বসিয়ে দিয়ে, বললো নাও সবটা দুধ খেয়ে নাও ভালো লাগবে। আমি বললাম, তুমি খেয়ে আমাকে দাও কিন্তু সে মানলো না। তা-ও আমি কিছুটা খেয়ে বললাম নাও এবার খাও‌।ও একটু খেয়ে আবার আমাকে সবটা খাইয়ে দিল।

তারপর বললো, শাওয়ার নিয়েছো?
আমি মাথা নাড়িয়ে না বোঝালাম। সে বললো চলো শাওয়ার নিবে। আমি বললাম শাওয়ার না নিলে হয় না? ভালো লাগছে না উঠে গিয়ে শাওয়ার নিতে,,,,,

#চলবে,,, ইনশা আল্লাহ।

#ছায়া_সঙ্গিনী
#পর্ব-২১
#Israt_Bintey_Ishaque(লেখিকা)

কেটে যাচ্ছে দিন,মাস,বছর। রাহাতের ভালোবাসার কোন কমতি নেই
“আলহামদুলিল্লাহ”। তবে আমার সুখের একটাই অভাব”বেবি”। বিয়ের দুই বছর হতে চললো!সময় গুলো আনন্দেই কাটছে রাহাতের সাথে। ছুটি পেলেই দেশের ঐতিহাসিক স্থান গুলোতে ঘুরতে নিয়ে যায় সে। আমার খুব ইচ্ছে ছিল আমার দেশ কে ঘুরে দেখার, সেই ইচ্ছেটা আল্লাহ তা’আলা ধীরে ধীরে পুরন করছেন। আমি বিশ্বাস করি, এরকম ভাবে আমার সুখের অভাব টাও একদিন পুরুন হবে “ইনশা আল্লাহ”।
বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় হসপিটাল গুলোতে অনেক পরিক্ষা নিরিক্ষা করা হয়েছে আমাদের উভয়ের। কিন্তু কোন খারাপ কিছু ধরা পরেনি “আলহামদুলিল্লাহ”।
হয়তো এই মুহূর্তে আমার জন্য সন্তান কল্যাণকর হবে না তাই আল্লাহ তা’আলা আমার দো’আ কবুল করছেন না। কেননা আল্লাহ তা’আলা উত্তম পরিকল্পনাকারী।তাই আমি বিশ্বাস করি আমার জন্য যখন কল্যাণকর হবে তখন নেক সন্তান দান করবেন আল্লাহ তা’আলা। আমি রাহাত দু’জনেই চেয়েছিলাম অনাথ আশ্রম থেকে বেবি দত্তক নিতে কিন্তু আমার শ্বাশুড়ি মা এতে মত দেন নাই। এতো দিন আমি আর রাহাত মিলে মায়ের পিছনে পড়ে ছিলাম রাজি করানোর জন্য। শেষমেষ সফল হতে পেরেছি।আর তাই আজকেই আমি আর রাহাত এসেছি একটা অনাথ আশ্রমে। রাহাত আশ্রমের লোকজনের সাথে কথা বলছে আর আমি পাশে বসে আছি।
কথাবার্তা পাকা হলে একজন ভদ্র মহিলার হাত ধরে ছোট ছোট পায়ে হেঁটে এলো ছোট্ট মেয়েটি বয়স চার। নাম ঝুমুর। আমি চেয়ার ছেড়ে উঠে গিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে ওর হাত দুটো আমার হাতের বাজে নিয়ে বললাম,
– মামনি কেমন আছো?

ঝুমুর পাশে থাকা ভদ্রমহিলা কে পিছন থেকে জরিয়ে ধরলো। আমার মনটা খারাপ হয়ে গেল এতে। পরক্ষনেই মনে হলো ও তো ছোট্ট একটা মেয়ে তার উপর আমাকে চিনে না।তাই ওর এরকম আচরণ স্বাভাবিক। ঝুমুর কে নিয়ে আসার সময় ও খুব কান্নাকাটি করে, আমি রাহাত ওর মন ভালো করতে প্রথমে শপিং মলে তারপর রেস্তোরাঁয় খাওয়া দাওয়া করে বাসায় ফিরে আসি।মা ঝুমুর কে দেখলেন কিন্তু কোন কথা বললেন না। হয়তো মন থেকে মেনে নিতে পারছেন না তাই।
বসায় আসার পর আপু,ভাই, আব্বু, আরিয়ান,ভাবী সবাই মিলে গ্রুপ কলে ঝুমুর কে দেখে। আমি সবাই কে বলি ঝুমুরের জন্য একটা সুন্দর নাম সিলেক্ট করার জন্য। একেক জন একেক নাম বলছে, আমি আর রাহাত কোনটা রেখে কোনটা রাখবো ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলাম না। শেষে ভাবী বললেন রাহাতের সাথে মিলিয়ে “রাফা” । নামটা রাহাতের খুব পছন্দ হলো তাই আমাকে বললো,
– তুমি কি বলো?রাফা রাখবো?

আমি বললাম তোমার পছন্দ‌ই আমার পছন্দ। তারপর রাহাত সবাই কে জানিয়ে দিল আগামীকাল নারায়ণগঞ্জ আসছি আমরা। ওখানেই আকিকা করে রাফা নাম রাখা হবে।

ঝুমুর এতোক্ষণ আমাদের কথা গুলো বসে বসে শুনছিলো।কল কাটতেই বললো,
– মামনি! কোথায় যাব আমরা?

আমি যেন আকাশ থেকে পড়লাম। সেই দুপুর বেলা থেকে বলেছি আমাকে মামুনি বলে ডাকার জন্য কিন্তু ঝুমুর একবার ও ডাকেনি। মাথা নিচু করে বসে ছিল। রাহাত ও কতোবার বলেছে ওকে বাবাই বলে ডাকার জন্য কিন্তু তা-ও ডাকে নাই। হঠাৎ ওর মুখে মামনি শুনে হুরহুর করে কান্নায় ভেঙে পড়লাম আমি। শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললাম,
– কি বললে? আবার বলো না প্লিজ?

ও আমার কান্না দেখে বিচলিত হয়ে যায়। সাথে খানিক ভয় পায়।তাই আর মামনি বলে ডাকতে পারে না। রাহাত আমাকে ঝুমুরের থেকে ছাড়িয়ে বললো,আয়রা মেয়েটা ভয় পাচ্ছে তো। এভাবে কাঁদছো কেন?দেখ ও কিভাবে ভয়ে চুপসে আছে। আমি ঝুমুরের ছোট ছোট গাল দুটো ধরে বললাম,ভয় পেয়েছো মামনি?
ওর উপর নিচ মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিল। তারপর আমি আবার বললাম, মামনি খুব পঁচা তাই না?ও বামে ডানে মাথা নাড়িয়ে না বুঝালো। আমি খুশি হয়ে ওরে আদরে আদরে ভরিয়ে দিলাম। তখন রাহাত বললো, শুধু মামনি ডাকবে?বাবাই ডাকবে না?
ঝুমুর তখন মাথা নিচু করে র‌ইলো। রাহাত দীর্ঘশ্বাস ফেলে চলে যেতে নিলে ঝুমুর দৌড়ে গিয়ে বললো,বাবাই!
রাহাত থমকে দাঁড়ায়, তারপর হাঁটু গেড়ে বসে ঝুমুরের কপালে ভালোবাসার পরশ এঁকে দেয়। একদম বাবা মেয়ের থেকে কম মনে হচ্ছে না দু’জনকে। আমার চোখ থেকে আনন্দের পানি গড়িয়ে পড়ছে।

খাবার টেবিলে আমি রাহাত দু’জনেই ঝুমুর কে খাইয়ে দিচ্ছি। ঝুমুর তৃপ্তি ভরে খাচ্ছে, মনে হচ্ছে কতো বছর তাকে এভাবে আদর করে কেউ খাইয়ে দেয় নি। শুনেছি শিশুরা পবিত্র হয়, এবং তাদের সাথে ফেরেস্তা থাকে। তাইতো এতো কোমল মনের অধিকারী হয়। তাদের একটু আদর করলেই নিজের সবটুকু উজাড় করে দিয়ে দেয়। তাদের ধমক দিয়ে যেখানে একটা কাজ করানো যায় সেখানে আদর করে বললে, দশটা কারতে ও মানা করে না।এই হচ্ছে শিশু সুলভ মন।
ঝুমুর কে নিয়ে আসার সময়, ঝুমুরের খেয়াল রাখা ভদ্রমহিলা চোখের পানি ফেলে বলেছিলেন,
– আপা এই ছোট্ট মেয়েটি কে আপনার হাতে তুলে দিলাম খেয়াল রাখবেন ওর।আড়াই বছর বয়সে মাকে হারিয়েছি মেয়েটা। তারপর বাপ বিয়ে করে আনছে,সৎ মা অনেক অত্যাচার করে বলে বাপ অনাথ আশ্রমে দিয়ে যায়।

কথা গুলো শুনে তখনি কষ্টে বুকটা কেঁপে উঠে আমার। নিজের সাথে নিজে ওয়াদা করি, মেয়েটা কে সারাজীবন নিজের সবটুকু দিয়ে আগলে রাখবো আমি।
_______
দু’দিন পর,
রাহাত আর আরিয়ান মিলে ছাগলের গোসত গুলো কেটে ঠিক করছে।আর আব্বু বসে বসে দেখিয়ে দিচ্ছে কিভাবে কতটুকু সাইজ করে কাটবে।
কিছুক্ষণ আগে আকিকার জন্য, কসাই দিয়ে একটা ছাগল জবাই করা হয়েছে। সেটাই শালা দুলাভাই মিলে ঠিক করছে। এদিকে আমি আর ভাবী মিলে অন্যান্য রান্না বান্নার প্রস্তুতি নিচ্ছি। কিছু মানুষ নিমন্ত্রণ করা হয়েছে। রাহাতের বোন’রা ও আসতেছে। আমার কলেজ ফ্রন্ডদের ও বলেছি।
অতঃপর,
মেহমান আসতে শুরু করে দিয়েছে। রান্না বান্না শেষ করে মাত্র‌ই শাওয়ার নিয়ে বেড়িয়েছি আমি। রুমে এসে শাড়ি পড়েছিলাম তখন পিছন থেকে দরজা লক করার শব্দে পিছনে ফিরে তাকিয়ে দেখি রাহাত।তাই আবার শাড়ি পরাতে মনোযোগ দিলাম।
রাহাত এগিয়ে এসে বললো কি করছো?
আমি মাথা তুলে তাকাতেই কোমর জড়িয়ে ধরলো! হঠাৎ তার এরকম কান্ড দেখে ভ্রু কুঁচকে বললাম, হচ্ছে টা কি? মেহমান চলে এসেছে কিন্তু।ছাড়ো তৈরি হতে হবে আমাকে।সে আমার কথা পাত্তা না দিয়ে উল্টো শাড়ির আঁচল ফেলে দিল! আমি বললাম,
– এই যে আর্মি সাহেব বুড়ো বয়সে কি বিমরতি ধরলো নাকি?

রাহাত অবাক হ‌ওয়ার ভান ধরে বললো,
– আমি বুড়ো! তুমি জানো এখনো অবধি মেয়েরা লাইন ধরে আমার পিছনে?

– হয়েছে হয়েছে।মেয়ের বাপ হয়েছো সেই খেয়াল আছে তোমার? কিছুদিন পর তো শ্বশুর হয়ে যাবে। হা হা হা,,,

– তাই না??

ব্যাস আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে,সে তার কাজে মনোনিবেশ করে। ধীরে ধীরে তার ছোঁয়া গুলো গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছে। আমি দুই হাতে খামচে ধরি তার পাঞ্জাবি। মিনিট খানেক পর তার পাগলামো শেষ হয়, তখন পরম আবেশে তার মাঝে আগলে রাখে আমায়।
তারপর শাড়ি পড়তে সাহায্য করে আমায়। কালো রঙের মাঝে রানী গোলাপী রঙের নকশা করা জামদানি শাড়ি পড়েছি আমি। সাথে মেচিং করে হিজাব। ঠোঁটে হালকা রঙের লিপস্টিক ব্যাস এতেই পারফেক্ট। তৈরি হ‌ওয়া শেষে রাহাত কয়েকটা ছবি ক্যামেরা বন্দি করে রাখে। তারপর নিজের সাথে সেলফি তুললো।
আমি তাড়া দিয়ে বললাম, হয়েছে এবার আমি যাই সবাই কি মনে করবে এভাবে রুমে বসে থাকলে।
রাহাত বললো,
– আর দশ মিনিট, তুমি এখানে বসো আমি যাবো আর আসবো।

তারপর দরজা খুলে কোথায় যেন চলে গেল। আমি বসে বসে ফোন স্ক্রল করছি। হঠাৎ মিষ্টি কন্ঠস্বর ভেসে এলো। ছোট ছোট পায়ে দৌড়ে এসে আমার মেয়ে মামনি বলে জড়িয়ে ধরে।
খুশিতে আত্মহারা হয়ে যাই আমি। রাহাত তৃপ্তি ভরে দেখে আমাদের আর হাসে।

আমি রান্নার কাজ শেষ করে প্রথমে ঝুমুর কে তৈরি করে দেই। রাহাত ওর জন্য খুব সুন্দর পার্টি ড্রেস নিয়ে এসেছে। আমার শাড়ীর সাথে ম্যাচিং করা রানী গোলাপী রঙের ড্রেসটা, আমার সুন্দর মেয়েকে আরো সুন্দরী করে তুলেছে। রাহাত বলে, ঝুমুর কে আমার মেয়ে হিসেবেই সৃষ্টি করেছেন আল্লাহ তা’আলা।তাই তো আমাদের ফেইসের নাকি অনেক মিল।

আমাদের দুজনের একসাথে অনেক ছবি তুললো রাহাত। তারপর তিনজনে মিলে সেলফি তুললাম।
আজকের এই দিনটি দেওয়ার জন্য আল্লাহ তা’আলার কাছে শুকরিয়া আদায় করেও শেষ করতে পারবো না আমরা।
_____
সব আত্মীয় স্বজন প্রায় চলে এসেছে। আমার কলেজ ফ্রেন্ড ফারহা,আদিবা,স্বর্ণা,সাথী,মোনা সহ সবাই এসেছে কিন্তু আমার বেস্টুর এখনো অবধি দেখা নেই। সেই যে সেকেন্ড ইয়ার ফাইনাল পরীক্ষার সময় একবার দেখা হয়েছিল তুলির সাথে আর দেখা হয়নি। জানিনা কেন সেদিন বেশি কথা বলেনি আমার সাথে তুলি!তারপর থেকে যোগাযোগ ও হয়নি!এই যে আজকে আসছে সেটা আরিয়ানের দৌলতে, আরিয়ান কে ওদের বাসায় পাঠিয়ে ফোন নাম্বার কালেক্ট করেছি।তুলি ফোন নাম্বার চেঞ্জ করেছে,তাই অনেক বার কল করেও পাইনি আমি।

কিছুক্ষণ আগে আবার কল করে জিজ্ঞাসা করলাম কোথায় আছে?ও বললো বাসার কাছাকাছি তাই বার বার দরজার দিকে তাকাচ্ছি, কখন ও আসবে।যে মেয়েটা আমায় ছাড়া কিছুই বুঝতো না, সেই মেয়েটা হঠাৎ করে কিভাবে এতো পরিবর্তন হয়ে গেল বুঝতে পারলাম না।যাই হোক ও আজকে আসছে এতেই খুশি আমি।

তুলির কথা ভাবতে ভাবতে আব্বু কে খাবার বেড়ে দিচ্ছি তখন ঝুমুর একটা বেলুন এনে বললো,
– মামনি এটা ফুলিয়ে দাও।

তারপর বেলুন কিছুটা ফুলাতেই দরজায় কলিং বেল বেজে উঠল। আমি দ্রুত পায়ে দরজা খুলে দিলাম। দরজা খুলে যাকে দেখবো তার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না আমি!হাতে থাকা বেলুন টা ছেড়ে দিলাম,যার ফলে বেলুন টা উড়ে গিয়ে তৎক্ষণাৎ হাওয়া বেড়িয়ে নিচে পরে গেল। সামনে থাকা ব্যক্তি নিষ্পলক তাকিয়ে রইল আমার দিকে! ঝুমুর এসে বললো,মামুনি আমায় বেলুন দাও। তখন সামনে থাকা ব্যক্তিটার দৃষ্টি ঝুমুরের দিকে নিবদ্ধ হলো,,,,

#চলবে,,, ইনশা আল্লাহ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here