জঠর
পর্বঃ১০,১১
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি
পর্বঃ১০
‘বই’ শব্দটা ছোটো হলেও এর মাহাত্ম্য অনেক। একটা বই হতে পারে আপনার সুখের সারথি, পরক্ষণে দুঃখেরও হতে পারে। একটা বই হতে পারে আপনার আত্নার খোরাক আবার মস্তিষ্কের সঠিক বিকাশও। একাকিত্ব ঘুচানোর জন্য বই উত্তম। আপনার নিঃসঙ্গ রাতের সঙ্গি বই, ক্লান্ত দিনের সাথী বই, অবসরের বন্ধু বই। বই, বই, বই।
বই পড়ার প্রতি দারুণ ঝোঁক অর্হিতার। তাই তার ঘরে অ্যাকাডেমিক বই পাশাপাশি বাংলা আর ইংরেজি সাহিত্যের নানা জনরার বইয়ের বিচরণ। বাড়ি থেকে আসার সময় সাথে করে বই নিয়ে আসতে ভুলেনি অর্হিতা। এলোমেলো করে রাখা বইগুলো টেবিলে সারিবদ্ধ করে রাখছে। এই বাড়িতে তার তেমন কাজ নেই। রোজ ঘুম থেকে উঠে সকালের নাশতা করে নিজের কক্ষে এসে বই নিয়ে বসে সে। দুপুর নাগাদ দুই, একটা বই তো পড়া হয়েই যায়। এরপর গোসল, খাওয়া আর ঘুম। এভাবে চলছে। পিউলী মাঝে মাঝে এসে টুকটুক করে কথা বলে যায়। মেয়েটার প্রতি মায়া জন্মেছে অর্হিতার। তবে নায়েলের প্রতি রাগ কমেনি।
কিঞ্চিৎ ফাঁক করা দরজা হালকা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করে হৃতি। তার আঁখিযুগলে ব্যস্ত হয়ে অবলোকন করছে অর্হিতাকে। মেয়েটা সারাদিন ঘরে কী করে!
হৃতিকে দেখে তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া করল না অর্হিতা। নরম স্বরে বলল—
“বসো।”
হৃতি চমকে বলল—
“এত বই?”
অর্হিতা মুচকি হেসে বলল—
“যার কেউ নেই তার বই আছে। একা একা থাকি তো তাই সঙ্গি বানিয়ে নিলাম। সব নিজের টাকায় কিনিনি। কিছু গিফ্টেরও আছে।”
হৃতি স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে রইল। অর্হিতা বইগুলো নির্দিষ্ট জায়গায় রেখে ধপাস করে বিছানায় এসে বসে। গা চিপচিপে লাগছে! তপ্ত বায়ুতে তাপিত দেহ। অর্হিতা অক্ষিকোটর ঘুরিয়ে বলল—
“দাঁড়িয়ে আছ কেন? বসো।”
হৃতি নরম পায়ে এসে বিছানার অপর পাশে বসে। অর্হিতার দিকে প্রশস্ত চোখে তাকায়। মেয়েটা কী চঞ্চল! হৃতি স্নিগ্ধ কণ্ঠে প্রশ্ন করে—
“তুমি কী এখনো নায়েলের ওপর রেগে আছ?”
তাচ্ছিল্যপূর্ণ হাসল অর্হিতা। শ্লেষাত্মক গলায় বলল—
“এ বাবা! আমি রাগ করব কেন? আমার কী রাগ করার অধিকার আছে? আর রাগ সবার ওপর করা যায় না। রাগ ও অভিমান দুটো কাছাকাছি শব্দ হলেও অভিন্ন। দুটো শব্দেই ভরপুর অনুভূতি। রাগ তাদের মানায় যাদের রাগ ভাঙানোর মানুষ আছে। প্রিয় মানুষ আছে।আর আমার তো কেউ নেই। আমি যদি তিনদিন না খেয়েও থাকি আমার মামা, মামি কখনো বলত না,” এই অর্হি খেয়ে নে। আসলে কী বলোতো আমাদের মতো মেয়েদের রাগ থাকতে নেই। আমাদের শোভা দেয় না এসব। আমাদের পেছনে তো আর আমাদের মা দুধের গ্লাস হাতে ছুটে বেড়ায় না।”
অর্হিতা চমৎকার করে হাসে। মেয়েটা কী স্বাভাবিক ! যেন কোনো কষ্ট নেই। হৃতির মুক্ত চাহনি। স্নেহার্দ্র গলায় বলল—
“নায়েল আসলে পিউলীকে অনেক ভালোবাসে।”
“তা তো জানি। তাই তো মেয়ের জন্য মা নিয়ে এসেছে।”
“পিউলীকে তোমার পছন্দ নয়?”
অর্হিতা শুষ্ক চোখে চাইল। কেমন বেখাপ্পা গলায় বলল—
“তুমি যদি জিজ্ঞেস করতে আমার নায়েলকে পছন্দ কি না, তাহলে হয়তো তার একটা ভালো জবাব অামি তোমাকে দিতে পারতাম। নায়েল দেখতে সুদর্শন হলেও কিছু একটা ঘাপলা আছে। ভাবো তো তিন মাসেই কেমন অদ্ভুত ফন্দি এঁটে আমাকে এই বাড়িতে নিয়ে এলো! কিন্তু পিউলী সম্পর্কে নো কমেন্ট। আসলে আমি বুঝতে পারছি না, আমার আসলে কী করা উচিত। এসব স্বামী, সংসার তার উপর বাচ্চা-কাচ্চা! আমার ঠিক হজম হয় না। হবে কী করে বলোতো! আমার কী পরিবার ছিল না কি? সারাদিন ভরে বাড়ির কাজ, রাত হলে পড়া, ঘুম। উজালা হতেই আবার সব একই। এসব প্রেম, ভালোবাসা, ইনিয়ে-বিনিয়ে প্রেম পিরিতি ঠিক জমে না আমার ক্ষেত্রে। কিন্তু নায়েলকে দেখো, অদ্ভুত বোকা লোক! সেই আমাকেই নিয়ে এলো নিজের মেয়ের জন্য? ব্যাটার না আমও যায় ছালাও যায়।”
হৃতি স্পষ্ট দৃষ্টি দিয়ে তাকিয়ে থাকে। তার চোখের চাহনিতে উজ্জ্বলতা, আগ্রহসত্ত্বা। মিহি গলায় বলল—
“তুমি এভাবে কেন কথা বলো?”
অর্হিতা মাথার বালিশটা কোলের মধ্যে গুঁজে নিয়ে বলল—
“কেমন করে?”
“এই যে, কেমন যেন! নায়েল এসব পছন্দ করে না।”
“কেন?”
“নায়েল সবসময় পিউলীর সাথে নম্রস্বরে কথা বলে।”
ফিক করে হেসে ফেলে অর্হিতা। হৃতি চোখের পাল্লা নাচিয়ে বলল—
“হাসছ যে?”
“হাসছি তোমাদের টাকার কুমির নায়েলের কথা ভেবে। মেয়েকে ভালো কথা শেখাবে তাই বাড়ির সবাইকে একরকম বন্দুকের মুখেই রাখেন। আর দেখো, কাকে বিয়ে করে নিয়ে এসেছে!
না আছে আমার কথার ছিরি না আছে চাল চলনের। তবে আমি এমনই। কিচ্ছু করার নাই।”
ফুরফুরে হাসে অর্হিতা। হৃতি মনে মনে সন্দিগ্ধ হয়। এত পাংচুয়াল ছেলে নায়েল এমন একটা মেয়েকে বিয়ে কেন করল?
অর্হিতা চুপ হয়। গলার স্বরে গভীরতা আনে। বলল—
“কোন ক্লাসে তুমি?”
“থার্ড ইয়ার।”
“তাই না কি? তাহলে তো তুমি করে বলা-ই যায়। কতদিন ধরে আছ এই বাড়িতে? আমি যতটুক শুনেছি তুমি নায়েলের কাজিন। তাই না?”
“হ্যাঁ। আমি এস. এস. সি পাশ করেই এখানে এসে সিটি কলেজে ভর্তি হয়েছিলাম। তখন থেকে এই বাড়িতেই।”
“ও আচ্ছা। পিউলীর মা-কে তুমি দেখেছ? নায়েল আর তার বিয়ে কবে হয়েছিল বলতে পারবে? না মানে জানতে চাচ্ছিলাম, বেচারা বোধহয় বউকে খুব ভালোবাসে। তাই হয়তো এতদিন একাই ছিল। আফটার অল পুরুষ মানুষ! আর কত!”
অর্হিতা বাঁকা হাসল। সেই হাসিতে খুশি ছিল না। ছিল প্রস্ফুটিত এক বিতৃষ্ণা, বিষণ্ণতা। হৃতি কথার তালে এক অপ্রকাশিত ঘটনা ব্যক্ত করতে শুরু করল।
“আরে বউ আসবে কোথা থেকে? নায়েল তো বিয়েই করেনি। পিউলী তো ওর…..।”
মুখ চেপে কথা গিলে নেয় হৃতি। কী বলে ফেলল সে? এখন কী হবে? অর্হিতা চোখ পিটপিট করে কৌতূহলী গলায় বলল—
“কী বললে তুমি? নায়েল বিয়ে করেনি? তাহলে পিউ?”
“আমি জানি না। আমি জানি না।”
বিনা সময় ব্যয়ে সেই স্থান থেকে চলে গেল হৃতি। চট করে ওঠে দাঁড়ায় অর্হিতা। বিস্ময়ে চোখ ফুলে ওঠে তার। অর্হিতার ধারণা হলো, নায়েল বিয়ে করেনি! তাহলে পিউলী? পিউলী নিশ্চয়ই নায়েলের অবৈধ সন্তান! নিজের কথায় যেন নিজেই মূর্ছা যায় অর্হিতা! এমনি এমনি আর টাকার কুমির বলি! এই ব্যাটা নিশ্চয়ই বিয়ের আগে ঘোল ঘুলিয়েছে। আর এখন আমাকে ফাঁসাতে চাইছে। কত্তবড় সাহস!
,
,
,
হাই ভোল্টেজে এক চড় বসালেন সায়েরা হৃতির গালে। হৃতির গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ল জল। আর্দ্র গলায় বলল—
” আমি কী ইচ্ছে করে বলেছি! মুখ ফসকে বেরিয়ে গেছে।”
সায়েরা উত্তেজিত হয়ে বললেন—
“তোর মুখ দিয়ে আর কিছু বের হলো না? এই কথা-ই বের হতে হলো! গাধি! তোর কিচ্ছু হবে না জীবনে। এমনিতেই ওই মেয়ে ধূর্ত! তার উপর যদি জানতে পারে পিউলী নায়েলের মেয়ে নয় তখন হুমড়ি খেয়ে পড়বে!”
হৃতি গালে হাত ঘষতে ঘষতে অসহায় গলায় বলল—
“নায়েল এমনিতেও আমাকে বিয়ে করবে না।”
সায়েরা হৃতির মাথায় চাটি মেরে বললেন—
“তোকে কেন খাওয়াই আমি? এই তোর বুদ্ধি? ভালো-ই হয়েছে তোর বাবা তোকে ছেড়ে চলে গেছে। না হলে তোর মতো গাধিকে নিয়ে কী করত ও। আর ফাঁসিয়ে গেছে আমাকে।”
হৃতি হু হু করে কেঁদে বুক ভাসায়। সায়েরা ধমকে উঠলেন।
“এই একদম কাঁদবি না। যা আমার চোখের সামনে থেকে। যা বলছি।”
হৃতির আত্মারাম কেঁপে ওঠে সায়েরার ধমকে। চোর বিড়ালের মতো ছুটে পালায়। সায়েরা বিধ্বস্ত। এই মেয়েটাকে নিয়ে কী করবে সে? কিছু বোঝে না। একা ছাড়তেও পারবে না কোথাও।
,
,
,
ঘরময় চঞ্চল পায়ে পায়চারী করছে অর্হিতা। রাগে তার মাথা ফেটে যাচ্ছে। নায়েল তাহলে তাকে সত্যিই ধোঁকা দিয়েছে। নিজের অবৈধ সন্তানের মা বানানোর জন্য তাকে নিয়ে এসেছে। এসব ভেবে ভেবে অর্হিতার গা দিয়ে যেন আগুনের লেলিহান শিখা বেরোচ্ছে। নিজের কক্ষ থেকে বের হয়ে নায়েলের কক্ষের দিকে এগিয়ে যায় সে। ভেতরে উঁকি দিতেই হতাশ হয় সে। নায়েল নেই। তাই আর ভেতরে ঢুকল না। সিঁড়ির উপর থেকে নিচের দিকে তাকায়। বসার ঘরে কেউ নেই। পা দুটো সমানতালে কাঁপছে অর্হিতার। হাত ঘেমে পিচ্ছিল হয়ে আছে। চোখ দিয়ে আগুনের কুন্ডলি জ্বলছে। সরোষে সিঁড়ি বেয়ে সামনে চোখ রেখে নামছে অর্হিতা। রক্তিম চোখে জমেছে জলপুকুর। যেকোনো সময় উছলে পড়বে। সিঁড়ির নিচের দিকে আসতেই এক আর্ত চিৎকারে দৌড়ে আসে কলরব। তার প্রসারিত দৃষ্টি সিঁড়ির দোরগোড়ায়। কলরবের অস্থিমজ্জাসহ ভয়ে আঁতকে ওঠে। অর্হিতার চিৎকারে ছুটে আসে নায়েল। বিপন্ন গলায় বলে উঠে—
“ও শিট! অর্হিতা!”
সিঁড়ির উপর শুয়ে আছে অর্হিতা। তার মাথার নিচে হাত দিয়ে তাকে আগলে নেয় নায়েল। মাথার নিচ থেকে হাত সরিয়ে আনতেই তাতে শোণিতের জমাটসিন্ধু। নায়েল চেঁচিয়ে উঠে—
“অর্হিতা! অর্হিতা! চোখ খুলুন। অর্হিতা!”
ফুরিয়ে আসছে চোখের আলো। অর্হিতার দৃষ্টি ক্রমশ ঝাপসা হতে লাগল। নিভুনিভু চোখে নায়েলের উদ্বেলিত, ব্যাকুল, নিভন্ত চেহারাটা দেখতে লাগল। নায়েলে চেঁচিয়েই যাচ্ছে।
“অর্হিতা চোখ খুলুন। প্লিজ, গড সেক। চোখ খুলুন বলছি।”
ডাইনিং এর সামনে দাঁড়িয়ে আছে হৃতি। হিমশীতল হিমালয় সে। চোখের সামনে সম্পূর্ণ ঘটনা ঘটতে দেখে তার শরীরের সব রক্ত যেন ফুরিয়ে গেছে। নওশাদ সাহেবের সাথে আসে পিউলী। অর্হিতাকে এই অবস্থায় দেখে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে। হাত, পা ছড়িয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে কাঁদছে সে। পিউলীর দিকে নজর পড়তেই চোখে ভিজে ওঠে নায়েলের। হতভম্ব নওশাদ সাহেব হিতাহিত জ্ঞানশূন্য। কী করবেন কিছুই বুঝে উঠতে পারছেন না। নায়েল ভরাট গলায় বলল—
“বাবা, পিউলীকে নিয়ে যাও এখান থেকে। প্লিজ।”
পিউলীকে জোর করে টেনে কোলে তুলে নিলেন নওশাদ সাহেব। পিউলী কিছুতেই যাবে না। নায়েল কোনোমতেই পিউলীকে অর্হিতার কাছে আসতে দিতে চায় না। নায়েল কঠোর গলায় বলে উঠে—
“কলরব, তমালকে গাড়ি বের করতে বলো। গো, ফাস্ট।”
কলরব অশান্ত পায়ে ছুটে যায় বাইরে। অর্হিতাকে ক্রোড়ে তুলে নিল নায়েল। নিশ্চেতন অর্হিতা ওভাবেই পড়ে রইল। গাড়িতে বসতেই নায়েলের মনে পড়ল নিহিতার কথা। তার বোনের রক্তাক্ত দেহ। আর ভাবতে ইচ্ছে হলো না নায়েলের। তমাল দ্রুতবেগে গাড়ি চালাচ্ছে। অর্হিতার মাথা বুকের সাথে চেপে ধরেছে নায়েল। বুকের সুক্ষ্ম ব্যাথাগুলো বিস্তৃত হচ্ছে। শ্বাসভারী হচ্ছে তার। অগোচরে নেমে গেলে চোখের নোনতা এক ফোটা জল। স্বগতোক্তি করল নায়েল—
“প্লিজ অর্হিতা, এভাবে ছেড়ে যাবেন না। আপনাকে যে আমার অনেক কথা বলার আছে। চোখ খুলুন অর্হিতা। সবাই এভাবে আমাকে ছেড়ে যেতে পারে না অর্হিতা। আমার পিউটা মরে যাবে আপনাকে ছাড়া। প্লিজ, দয়া করুন। আপনার গিরগিটির উপর একটু দয়া করুন।”
দুই হাত দিয়ে নিজের সাথে পিষে ধরে অর্হিতাকে নায়েল। যেন বুকের এই দুর্ভেদ্য পাটাতন ভেঙে অর্হিতাকে ঢুকিয়ে নেবে বক্ষপিঞ্জিরায়।
চলবে,,,
#জঠর
#পর্বঃ১১
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি
মুখের ভেতর এক দলা ভাত নিয়ে বসে আছে পিউলী। কিছুতেই খেতে চাইছে না বাচ্চাটি। নওশাদ সাহেব জোর করে মুখে লোকমা ঠুসে দেওয়ার দরুণ ওভাবেই চুপ করে বসে আছে। নওশাদ সাহেব আদুরে গলায় বললেন—
“খেয়ে নাও পিউলী, পাপা রাগ করবে।”
পিউলী অসহায় মুখ করে চেয়ে রইল। মুখের ভেতরের খাবারটুকু কষ্টের সাথে গিলে নিয়ে বলল–
“আমি খাবো না। মামুনির কাছে যাব।”
নওশাদ সাহেব আশ্বাসের সুরে বললেন—
“খেয়ে নাও সোনা। খাওয়া হলেই দাদু নিয়ে যাব। না খেলে পাপা রাগ করবে।”
পিউলী তার আধো আধো গলায় আপত্তি করে বলল—
“না। আমি মামুনির কাছে যাব। না হলে খাবো না। খাবো না। খাবো না।”
কান্না জুড়ে দেয় পিউলী। হতচকিত নওশাদ সাহেব। মেয়েটা আজকাল বড্ড জেদি হয়ে যাচ্ছে! কারো কথাই শুনে না।
,
,
,
ধুম ধরে বসে আছে নায়েল। প্রায় মিনিট পনেরো যেন পুরো পৃথিবী থমকে গেছে তার জন্য। আধশোয়া বসে পা সটান করে ছড়িয়ে রেখেছে অর্হিতা। মাথায় গোলাকার গজ বাঁধা। দুই পাশে ছড়ানো চুলের মাঝ গলিয়ে নিগূঢ় দৃষ্টিতে চেয়ে আছে নায়েলের দিকে। নায়েল স্থির, নিষ্কম্প, শান্ত। তার সমান্তরাল চাহনি নিজের মুঠোয় পুরে রাখা অর্হিতার হাতে। অর্হিতা লম্বা শ্বাস ফেলে বলল—
“চুপ করে আছেন কেন নায়েল? আপনি প্রশ্নের উত্তর দেননি।”
সিঁড়ি বেয়ে নামতে গিয়ে পায়ে পিচ্ছিল জাতীয় কিছু একটার সংস্পর্শে আসতেই পেছন দিকে হেলে পড়ে অর্হিতা। ভাগ্য সহায় বলে, সিঁড়ির রেলিং ধরার কারণে মাথার পেছনে সামান্য জায়গা কেটে যায় যাতে তিনটা স্টিচের প্রয়োজন পড়ে। প্রায় এক সপ্তাহ জোর করেই হাসপাতালে রাখা হয় অর্হিতাকে। তারপর বাসায় নিয়ে আসা হয়। তার দেখাশোনার সমস্ত দায়িত্ব নায়েলের ওপর। সব মিলিয়ে আজ পনেরো দিন।
নায়েল অবনত মুখটা তুলে বলল—
“আমি দুঃখিত। যা হয়েছে সবটার জন্য আমি ক্ষমাপ্রার্থী।”
অর্হিতা অসহনীয় গলায় বলল—
” আপনাকে ক্ষমা চাইতে বলিনি। আমি আমার প্রশ্নের জবাব চেয়েছি।”
নায়েল নৈঃশব্দে শ্বাস ফেলে বলল—
“হ্যাঁ। পিউলীর জন্মদাতা আমি নই। ও আমার বোন নিহিতার মেয়ে। কিন্তু পিউলী তা জানে না। আর আমিও চাই না ও কখনো জানুক যে আমি ওর পাপা নই।”
হেয়ালি গলায় বলে উঠে অর্হিতা—
“লুকিয়েছেন কেন আমার কাছ থেকে? কেন বলেননি এসব?”
“সুযোগ হয়নি। আমি যতবার আপনার সাথে দেখা করতে গিয়েছি পিউ ছিল আমার সাথে।”
ফিচেল হাসে অর্হিতা। ক্যাটক্যাটে গলায় বলল—
“আপনি কী সত্যিই গিরগিটি না-কি? মোবাইল ছিল না আপনার কাছে? আসলে আপনি ইচ্ছে করেই বলেননি। ইচ্ছে তো করছে আপনাকে….।”
এক অবিশ্বাস্য কাজ করে বসে নায়েল। ঝট করে ওঠে অর্হিতাকে বুকপাঁজরে জড়িয়ে ধরে। অর্হিতার রক্তপ্রবাহ যেন থমকে যায়। শ্বাসরুদ্ধ করে ঘটনার আকস্মিকতা আন্দাজ করতে সময় লেগে যায় তার। কণ্ঠে প্রখর আবেগ নিয়ে বলতে থাকে নায়েল—
“প্লিজ অর্হিতা, আমি আমার সব কাজের জন্য ক্ষমা চাইছি। প্লিজ, কোথাও যাবেন না। প্লিজ।”
অর্হিতার কী যেন হলো। সে কিছুই বলতে পারল না। কাঁপন শুরু হলো তার দেহে। তরতর করে তার ভেতরের শীতলতা উষ্ণ হতে লাগল। বিগলিত হলো সমস্ত রাগ, অভিমান। নিজের অজান্তেই আঁকড়ে ধরল নায়েলকে। অদ্ভুত, অবোধ্য, অপ্রমত্ত অনুভূতির সাগরে তলিয়ে গেল সে। অনাস্বাদিত এক প্রগাঢ়, অতলান্তিক ভালোবাসায় আচ্ছন্ন হলো অনুপলেই। যখন বুঝতে পারল নিজেকে সংকুচিত করে নিল অর্হিতা। অবিচ্ছিন্ন পুরুষালী সৌরভে অর্হিতার নারীমন অসহায় হয়ে পড়ে। সে মিষ্টি সুরে বলল—
” এইটা আবার সরি বলার কোন পদ্ধতি! সরুন মি. গিরগিটি।”
নায়েল কেঁপে ওঠে। অপ্রস্তুত হয়ে দ্রুততার সাথে সরে আসে। ব্রীড়াময় চাহনি। মিচকি হাসি অর্হিতার অধরের কোণে। ছেলেমানুষ এত লজ্জা পায়! তার সুপ্ত মন যেন আকাশ কাঁপিয়ে হাসছে। কিন্তু তার আভাস পায় না নায়েল। নায়েলের দিকে মজার দৃষ্টিতে তাকিয়ে সশব্দে হেসে ওঠে অর্হিতা। হেসে হেসে বলল—
“চিন্তা করবেন না। এত সহজে আপনার পিছু ছাড়ছি না। আর মরছিও না। পিউ বলল, আপনি না-কি বলেছেন আল্লাহ যাদের বেশি ভালোবাসেন তাদের নিজের কাছে ডেকে নেন! আমার ক্ষেত্রে তার ভালোবাসার পরিমাণ একটু কম। আমাকে তিনি এত তাড়াতাড়ি নিবেন না। এই যে দেখুন, দিব্যি আপনার সামনে বসে আছি। আব্বুর হার্টে ছিদ্র ছিল। টাকা ছিল না। বিনা চিকিৎসায় মারা যান আব্বু। আব্বুর শোকে মাস দুয়েকের মধ্যে আম্মুও মারা যায়। তারপর দুই ভাইবোন এদিক ওদিক ঘুরতে ঘুরতে পৃথিবী আর তার মানুষকে চিনতে শুরু করলাম। যার কেউ নেই পুরো পৃথিবীটাই তার। তাই না বলুন। এই পৃথিবীটাও আমার। ভাববেন না, রোগে-শোকে নিজের আত্মাহুতি দেবো। এত সাহস নেই আমার। নিজের জীবন নেওয়া কী এত সোজা! বেঁচে আছি, বেঁচে থাকব। যতক্ষণ না ওই ওপরওয়ালার পেয়ারি না হই। সো, ডোন্ট ওয়ারি মি. গিরগিটি। ”
কথা শেষ করেই মুক্ত হাসে অর্হিতা। তার ঝরা হাসিতে নায়েলের উদ্বিগ্ন মনে জলপ্রপাত নামে। অর্হিতা থমকে যায়। সন্ধানী গলায় প্রশ্ন ছুড়ে—
“পিউর বাবা কোথায়?”
নায়েল কাতর চোখে তাকায়। একটু সময় নেয়। চাপা দীর্ঘশ্বাসের সাথে বলল—
“মাহিম জানে না পিউর কথা। ডিবোর্সের পর আর কখনো ও এখানে আসেনি। আমিও খোঁজ নেইনি। পিউর কথাও জানাইনি।”
“ও আচ্ছা। আপনার বাবা হওয়ার সুপ্ত বাসনা পূর্ণ হলো তাই। সাবাশ!”
নায়েলের কাঁধে হাত দিয়ে সাবাশি দেওয়ার ভঙ্গিমায় চাপড় মারতেই ভ্রূকুঞ্চন করে নায়েল। মেয়েটা এত অদ্ভুত কেন?
চলবে,,,