জঠর পর্বঃ১,২

0
1860

জঠর
পর্বঃ১,২
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি
পর্বঃ১

” দশ লাখ টাকার জন্য নিজের বোনকে বিক্রি করে দিতে তোমার একটুও বাঁধলো না?”

অর্হিতার প্রশ্নের বিপরীতে তার ভাই অর্নিশ অবিচলিত গলায় বলল—

“বিক্রি বলছিস কেন? তোর বিয়ে ঠিক করেছি।”

“বিয়ে! একটা বিবাহিত, বাচ্চাওয়ালা পুরুষের সাথে নিজের কুমারী বোনের বিয়ের কথা ভাবতে তোমার একটুও খারাপ লাগল না?”

অর্নিশ ঠান্ডা স্বরে বলল—

“খারাপ লাগবে কেন? আর বিবাহিত পুরুষরা কি বিয়ে করে না? ছেলের অগাধ সম্পদ। তোর কোনো কিছুর অভাব হবে না।”

অর্হিতা গর্জে উঠে বলল—

“করব না আমি বিয়ে। একটা বিবাহিত ছেলেকে আমি কখনো বিয়ে করব না। চলে যেতে বলো তাদের।”

বসার ঘর থেকে অর্হিতার কর্কশ স্বর স্পষ্ট শুনতে পেল নায়েল। কিন্তু সে স্থির, নিষ্কম্প। নায়েলের পাশেই তার সাত বছরের মেয়ে পিউলী। অর্হিতার গলার স্বরে মৃদু কম্পন দিয়ে উঠল পিউলীর ছোট্ট হৃদপিন্ডটা। বাবার দিকে অসহায় চোখে চেয়ে রইল। নায়েল চোখে হাসল। মেয়েকে আশ্বস্ত করল তার বাবা সবসময় তার সাথে আছে। ছোট্ট করে মেয়েকে বলল—

“বি অ্যা ব্রেভ গার্ল! নট টু ওয়ারি।”

পিউলী তার সরু, শুষ্ক অধর বিস্তৃত করল। প্রসন্ন সে। ভেতর ঘর থেকে হনহনিয়ে আসলো অর্হিতা। জ্বলন্ত চোখে নায়েলের দিকে চেয়ে খলবলিয়ে বলল—

“আপনার সাহস তো কম না! আপনি আবার এসেছেন? আমি তো বলেছি। হবে না এই বিয়ে।”

মুচকি হাসল নায়েল। ওঠে দাঁড়াল সে। পকেটে দুই হাত গুঁজে মুখমন্ডলে ভারী ভাব আনে। ভ্রূকুটি করে অর্হিতা। লোকটা লাগামছাড়া বেয়াদব! চোখের কোণে নিগূঢ় হাসল নায়েল। নিরুদ্বেগ গলায় বলল—

“ইটস ওকে। বিয়ে না হলে আমার টাকা ফেরত দিন। রাইট নাও।”

শেষের বাক্য এমনভাবে বলল থরথরিয়ে উঠল অর্হিতা। রাগে ফুঁসে উঠে বলল—

“ভাইয়া, ফিরিয়ে দাও তার টাকা।”

বসার ঘরে একপাশে দাঁড়িয়ে আছে অর্হিতার মামা, মামি। তাদের মেয়ে রূমঝুমও আছে। অর্নিশ অর্হিতার আপন ভাই। বাবা, মায়ের মৃত্যুর পর মামা বাড়িতেই থাকে তারা। অর্নিশ ছোটো একটা ফার্মে চাকুরী করে। স্বল্প বেতনে তার অভিলাষ বিস্তীর্ণ ! সে অভিলাষের পূর্ণতার জন্য নিজের বোনকে একজন বিপত্নীক পুরুষের সাথে দশ লাখ টাকার বিপরীতে বিয়ে দিতে রাজি হয়েছে। কিন্তু এই বিয়ের ঘোর বিরোধী কনে নিজে। অর্হিতা কিছুতেই নায়েলকে বিয়ে করতে রাজি নয়।

বোনের মুখে টাকা ফেরত দেওয়ার কথা শুনে কলিজা ঝাঁঝরা হয়ে গেল যেন অর্নিশের। কলের পুতুলের মতো বলল—

“টাকা নেই। ফ্ল্যাট কেনার জন্য অলরেডি বায়না করে ফেলেছি আমি। সামনে মাসেই উঠব। বাকিটা কিস্তিতে শোধ করব।”

ভাইয়ের কথায় তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠল অর্হিতা। রাগে বিহ্বল হয়ে বলল—

“তুমি কী মানুষ! ভাই হয়ে কী করে পারলে এমনটা করতে? ঘৃণা হচ্ছে আমার।”

ছলছল করে উঠল অর্হিতার চোখ। তার ভাইটা এত লোভী কী করে হলো?

নায়েল নির্লিপ্ত হাসল। অত্যন্ত শান্ত স্বরে বলল—

“ওয়েল। আপনার কোনো বয় ফ্রেন্ড আছে মিস অর্হিতা?”

অর্হিতার রাগে যেন কেউ ঘি ঢেলে দিলো। গনগনে উত্তপ্তা ছড়িয়ে বলল—

“নেই। তা দিয়ে আপনার কী দরকার?”

তাচ্ছিল্য হাসল নায়েল। ফিচেল গলায় বলল—

“এই বয়সে এসেও একটা বয়ফ্রেন্ড জুটাতে পারলেন না?। ভেরি স্যাড! তো আর কী করার? জাস্ট গেট রেডি। বিয়েটা আজ-ই হবে। আর এ…খু…নি।”

অর্হিতা তার রাগের বিস্ফোরণ ঘটাল। দাপিয়ে উঠে বলল—

“আপনি বললেই হলো?”

নায়েল ধপ করে কাউচে বসল। ভীত পিউলীর দিকে চেয়ে তুচ্ছ গলায় বলল—

“দুই ঘণ্টা সময় দিলাম মি. অর্নিশ। হয় আমার টাকা ফেরত দিন না হলে কাজি ডেকে আনুন।”

অর্নিশ চকচকে গলায় বলল—

“আরে না, না। আপনি বসুন। আমি এখুনি কাজি ডেকে আনছি।”

অর্নিশ চলে যেতেই অর্হিতার মামা, মামি সেখান থেকে প্রস্থান করলেন। তারা নিশ্চুপ। কারণ, তাদেরকেও আলাদা করে টাকা দেওয়া হয়েছে।

অর্হিতা রাগে জ্বলে যাচ্ছে। ইচ্ছে হচ্ছে এই লোকটাকে ধাক্কা মেরে বাড়ি থেকে বের করে দিতে। পরক্ষণেই তার অন্ত:করণে অমাবস্যা ছেয়ে যায়। এই বাড়ির মানুষগুলোতো তাকে বের করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। সে তো একটা খড়কুটো। তার কী কোনো দাম আছে?
,
,
,
আধাঘণ্টা যাবৎ বসে আছে নায়েল। অর্নিশ এখনো ফেরেনি। অস্তাভা সূর্যের টগবগে লাল রঙে রক্তিম হয়ে উঠেছে শেষ বিকেল। ধূসর পশ্চিমাদেশ তখন রঞ্জিত। ম্লান চোখে বাবার দিকে তাকাল পিউলী। নায়েল আদুরে গলায় বলল—

“খিদে পেয়েছে আমার অ্যাঞ্জেলের?”

পিউলী নৈঃশব্দে মাথা ঝাঁকাল। নায়েল চোয়াল শক্ত করে। এই বাড়ির মানুষগুলোর গাফিলতির কারণে মেয়েটা তার না খেয়ে আছে এখনো। নায়েল ভারী গলায় ডেকে উঠে—

“তমাল! তমাল! ”

ড্রাইভার তমাল বাইরেই দাঁড়িয়ে ছিল। নায়েলের ভারী স্বরে হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ঢোকে। ব্যগ্র গলায় বলল—

“জি স্যার।”

“গাড়িতে খাবার রাখা আছে। নিয়ে এসো।”

তমাল দ্রুত চলতে শুরু করে। ঘর থেকে বেরিয়ে মিনিট দুয়েকের মধ্যে খাবার নিয়ে ফিরে আসে। পিউলীকে দিতেই ছোট্ট পিউলী নীরস হাসে। চোখ ভরা তার ক্লান্তি। নায়েলের বুক ভারী হয়। মেয়েটা আজ বিকেলে একটু ঘুমাতেও পারেনি।

অর্নিশ ফিরে আসে আরও মিনিট বিশেক পর। অর্হিতা কিছুক্ষণ চিৎকার চেঁচামেচি করে নিজেই শান্ত হয়ে যায়। গত একমাস ধরে চলছে এই বিয়ের গুঞ্জন। আজ- ই সে জানতে পেরেছে নায়েল মোটা অঙ্কের টাকা ছড়িয়েছে তার জন্য। ভাইয়ের এমন লোভাতুর কর্মকান্ডে আর কিছু ভাবতে পারল না অর্হিতা। লোকটার দোষ দিয়ে কী লাভ? বউ মরেছে বলে তো আর সারাজীবন একা কাটাতে পারে না? আরও টাকার কুমির। টাকা ছড়ালেই মেয়ের অভাব হবে না। তবে অর্হিতাও ববিতা আর শাবানা নয়। মালালা ইউসুফজাইও নয় সে। সে অর্হিতা। ওই বাচ্চাওয়ালা, কচি মেয়ে বিয়ের করার সাধ করা লোকটাকে যদি নাকানিচুবানি না খাইয়েছে তাহলে সেও শাবানার মতো সেলাই মেশিন নিয়ে গার্মেন্টস খুলে ফেলবে। পড়ে ধীরে ধীরে বড়োলোক্স হয়ে যাবে।

রাগের মাথায় বিব্রতকর চিন্তা ভাবনার উদয় হচ্ছে শুধু। কিন্তু সব কথার শেষ কথা, বিয়েটা তাকে করতে হচ্ছে।
,
,
,
বিয়ে সম্পন্ন হয় নির্বিঘ্নে। নায়েল আগেই মেয়েকে নিয়ে গাড়িতে বসে আছে। বাড়ির কারো সাথে একটা কথাও বলেনি অর্হিতা। নিজের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ব্যাগে ঢুকিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে। দরজা খুলেই ধপাস করে গাড়ির ভেতরে বসে সে। তমাল ভ্যাবাচাকা খেয়ে যায়। তার মনে হলো কোনো প্রাচীন যুগের ডায়নাসোর হামলা করেছে তার গাড়ির উপর। ঠোঁট চিপে হাসল নায়েল। মেয়েটাকে রাগলে সাধারণের মাঝেই অসাধারন লাগে!

পিউলী বসেছে নায়েল আর অর্হিতার মাঝে। অর্হিতার পাশ থেকে দূরত্ব কমিয় এনে তার হাতটা ছুঁয়ে বলল—

“মামুনি!”

অর্হিতা নগ্ন রাগের বর্ষণ ঘটালো। শাসিয়ে উঠে বলল—

“এই মেয়ে, একদম আমাকে মামুনি বলবে না। সরে বসো।”

পিউলী ঠোঁট ফুলিয়ে ফেলে। যেন এখনই কেঁদে কেটে সাগর বানিয়ে ফেলবে। তাকে কাছে টেনে নেয় নায়েল। বুকের বা’পাশে ঠেসে রেখে জোর গলায় বলে উঠে—

“তমাল, তোমার পাশের সিটে একটা খাম আছে। গিয়ে মিস. ওপস! সরি মিসেস অর্হিতার ভাইকে দিয়ে এসো। আর বলবে, আমি যেন তাদের কাউকে আমার বাড়ির আশেপাশে না দেখি। গো, ফাস্ট।”

রাগে অর্হিতার শরীর রি রি করে ওঠে। সহ্য হচ্ছে না এই লোকটাকে তার। এতটা জঘন্য মানুষ হয় কী করে!

নায়েল গুমোট শ্বাস ফেলল। তার মেয়ের মা প্রয়োজন। আর তার নিজের মেয়েকে প্রয়োজন। উদ্বিগ্ন নায়েল, নিজ জঠর থেকে জন্ম না দিয়েও কী কারো সত্যি কারের মা হওয়া যায়?

চলবে,,,
#জঠর
#পর্বঃ২
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি

শরতের বিকেলের শুভ্র নীলাভ ঝলমলে আকাশের মতো দুই চোখে চেয়ে আছে পিউলী। উচ্ছ্বাসিত অন্ত:করণে নিত্যতার অভিলাষ। বারংবার হৃদপ্রকোষ্ঠে মাতৃস্নেহের অনুপস্থিতিতে কাতর হওয়া দুঃখের সমুদ্রে পালতোলা নৌকা পেয়েছে সে। মা পেয়েছে পিউলী।

ঊষরে আকস্মিক মৃগতৃঞ্চিকার মতো নায়েলের বিয়ের কথা শুনেছিল হৃতি। কিন্তু সেই মৃগতৃঞ্চিকা সত্যরূপে তার সামনে দৃশ্যমান হতেই বিচলিত, উৎপীড়িত সে। ঘন বর্ষার অবিশ্রান্ত ঝুমঝুম বৃষ্টিতে সিক্ত তার আঁখিদ্বয়। হাঁপিয়ে উঠতেই নিজের ঘরের দিকে তটস্থ পায়ে ছুটে যায়। পিউলী বাবার মুখের তাকাল। তার চোখে উদ্ভূত প্রশ্নের উত্তর দিতে অপারগ নায়েল। মিষ্টি করে হেসে বলল—

“ঘরে যাও মামুনি। পাপা আসছি।”

মাথা ঝাঁকায় পিউলী। ছোট্ট ছোট্ট কদম ফেলে নিজ গন্তব্য হেঁটে চলে। রাগের নগ্ন প্রকাশ ঘটালেন সায়েরা। দগ্ধ গলায় বললেন—

“বিয়ে যখন করতেই হবে তাহলে আমার মেয়েটাকেই বিয়ে করতে। কম কীসে হৃতি? পিউলীর মা হওয়ার যোগ্যতা নেই ওর না- কি তোমার স্ত্রীর?”

নায়েল সংকীর্ণ গলায় প্রত্যুক্তি করে—

“খালামনি, আমি আপনাকে আগেও বলেছি। হৃতিকে সবসময় আমি বোনের মতোই দেখেছি। আমার পক্ষে ওকে বিয়ে করা কখনোই সম্ভব নয়।”

“তাহলে ওই বাইরের মেয়েটাকে বিয়ে করলে কেন?”

নায়েল অনুদ্বেগ গলায় বলল—

“কারণ, পিউলী চেয়েছে।”

নায়েল ওঠে পড়ে। নিজ কক্ষের দিকে পদযুগল বাড়ায়। সায়েরা সম্পর্কে নায়েলের মা হলেও তাকে সে খালামনি বলেই ডাকে। নায়েলের মা মারা যাওয়ার পর তার বাবা নওশাদ সাহেব সায়েরাকে বিয়ে করেন। সায়েরা ডিবোর্সী ছিল। হৃতি তার বোনের সন্তান। এখানে থেকে পড়ালেখা করে সে। হৃতির বাবা,মা গ্রামে থাকে। সায়েরা চেয়েছিলেন হৃতিকেই যেন নায়েল বিয়ে করে। কিন্তু তার সেই আশায় পানি ঢেলে দিল পিউলী।

নওশাদ সাহেব নির্লিপ্ত। উদাসীন হয়ে বসে আছেন তিনি। নায়েল তার মেয়েকে নিয়ে ওভার পজেসিভ। সায়েরা খসখসে গলায় বললেন—

“আপনি কিছু বলছেন না কেন? এসব ঝামেলার কী দরকার ছিল?”

নওশাদ সাহেব মাথা তুললেন। মিহি গলায় বললেন—

“কী বলতে চাইছ তুমি?”

জ্বলে ওঠল সায়েরা। রুষ্ট গলায় বলল—

“নায়েল কেন ওই মেয়েটাকে বিয়ে করে আনলো? আমার মেয়েকে বিয়ে করতে ওর কী সমস্যা?”

নওশাদ সাহেব শ্বাস ফেললেন। চাপা গলায় বললেন—

“পিউলী ওই মেয়েটাকেই ওর মা হিসেবে চেয়েছে। মেয়েটা আমাদের জন্য যা করেছে তা ভোলা যাবে না। আর বিয়ে করার ব্যাপারটা একান্ত নায়েলের সিদ্ধান্ত। তাতে হস্তক্ষেপ করা আমি সমীচীন মনে করছি না।”

সায়েরা সরোষে দাঁতে দাঁত চেপে বললেন—

“ভাবুন তো, যদি ওই মেয়ে কোনোভাবে নায়েলের সন্তানের মা হয় তখন কী হবে?”

শঙ্কিত আঁখিপল্লবে তীব্র ভয়ের প্রকট হলো। নওশাদ সাহেবের অন্তঃরিন্দ্রিয়তে উচাটন শুরু হলো। ত্রস্ত গলায় বলে উঠলেন—

“নায়েল সবকিছু ভেবেচিন্তে- ই করেছে। মেয়েটাকে সব জানিয়ে রাখবে হয়তো।”

“যদি আমার কথাই সত্যি হয় তখন? পুরুষ মানুষ ও। কতদিন নিজেকে আটকে রাখবে নারী দেহের স্বাধ থেকে?”

গর্জে উঠলেন নওশাদ সাহেব। দারাজ গলায় বললেন—

“মুখে লাগাম লাগাও। জন্ম না দিলেও সম্পর্কে ও তোমার ছেলে। একটু তো লেহাজ করো সম্পর্কের। আর ভুলে যেয়ো না লুবানা এখনো বেঁচে আছে।”

কাউচ থেকে হন্তিদন্তি হয়ে উঠলেন নওশাদ সাহেব। স্ত্রীর এমন বেহুদা কথায় তার মস্তিষ্কে যন্ত্রণা শুরু হলো।
,
,
,
হাজারো স্বপ্নের ভীড়ে মেয়েদের অন্যতম স্বপ্ন সংসার, স্বামী, সন্তান। নিজের হাতে গড়া ছোট্ট বাবুই পাখির বাসা, আদরে ভরা স্বামী, ভালোবাসার প্রতীক সন্তানকে নিয়ে সহস্র মেয়ের বুকের হৃদগহীনে থাকে সুপ্ত বাসনা। তা আজ এক নিমিষে শেষ হয়ে গেছে অর্হিতার।

অর্হিতার চোখে জল নেই। ভাগ্যকে দোষ দেওয়া ছেড়ে দিয়েছে সে অনেক আগেই, যখন তার বাবা, মা মারা গেছে তখন থেকে। আত্মীয়-স্বজনরা নামের সাহায্য করতেও এক পা এগিয়ে আসেনি। দুঃসম্পর্কের এই মামা, মামি-ই সেদিন তাদের দুই ভাইবোনকে আশ্রয় দিয়েছিল। পড়ালেখা করছে অতি কষ্টে। যখন থেকে নিজের উপর ভরসা তৈরি হলো তখন থেকেই টিউশনি করে নিজের পড়ার খরচ চালাতে শুরু করে। মামা, মামি এমনিতে তো তাকে দু’বেলা খেতে দেয়নি। বাড়ির সব কাজ করিয়ে নিয়েছে তার বিনিময়ে। নাজুক নারী হাত হয়েছে খরা মৃত্তিকা।

আফসোস হচ্ছে অর্হিতার। মাস খানেক আগ বান্ধবীর বাবাকে হাসপাতালে দেখতে গিয়েই পরিচয় নায়েলের সাথে। পরিচয় বললে ভুল হবে। পিউলীর জন্য দিগ্বিবিদিক শূন্য হয়ে রক্তের জন্য দৌড়ে বেরাচ্ছিল নায়েল। সেই পরিস্থিতিতেই স্বর্গদূত হয়ে উপস্থিত হয় অর্হিতা। তার রক্তেই নতুন জীবন পায় পিউলী।

ভেজানো দরজা মেলে ভেতরে ঢুকে নায়েল। তাকে দেখেই খলবলিয়ে ওঠে অর্হিতা। গজগজ করে বলল—

“উপকারের এই প্রতিদান দিলেন আপনি? ”

নায়েল ছোট্ট শ্বাস ফেলল। বিনয়ী গলায় বলল—

“আপনি আমার সামনে আর কোনো পথ রাখেননি।”

“তাই বলে ভাইয়াকে টাকার লোভ দেখাবেন?”

কৃত্রিম বাতির আলোকছটায় অর্হিতার উগ্রমূর্তি অক্ষিগোচর হলো নায়েলের। মেয়েটার রাগ যেন শিরায় শিরায় ধাবমান রক্তের সাথে মিশে আছে। নায়েল নরম গলায় বলল—

“আমি বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়েছি। আপনি রিজেক্ট করেছেন। তাই বাধ্য হয়েছি আমি।”

“কী ভাবেন আপনি নিজেকে?”

“কিছুই না।”

গায়ের ব্লেজারটা খুলে হাতে নিল নায়েল। দরজার পাশে টেবিল। তার সাথে লাগোয়া চেয়ারটা টেনে নির্বিঘ্নে বসল। শ্রান্ত গলায় বলল—

“বিয়ে করা কোনো অপরাধ নয়। তবে আই এম সরি।”

অর্হিতা উষ্ণ গলায় বলল—

” বিয়ে করা অপরাদ নয়। বউ মরা ছেলের কচি মেয়ে বিয়ে করা অপরাদ।”

অর্হিতা এহেন কথায় হাসি আটকাত বেগ পেতে হলো নায়েলে। এক ভ্রু উঁচু করে তার সেই হাসির কারণে টগবগ করে ওঠে অর্হিতা।

“আপনি কী বলতে চাইছেন বলুন তো? আপনার মেয়ের জন্য অন্য কোনো মা পেলেন না? আমাকেই আপনার বিয়ে করতে হলো।”

“ওকে তো আপনি বাঁচিয়েছেন। ও আপনাকেই ওর মা হিসেবে চায়।”

“কিন্তু আমি চাই না। আপনার মেয়েকে আমি চাইইইই না। বুঝতে পেরেছেন।”

দীর্ঘশ্বাস ফেলল নায়েল। ছোট্ট করে বলল—

“এছাড়া আপনার কাছে আর কোনো উপায় নেই। আপনাকে এই বাড়িতেই থাকতে হবে। আমার মেয়ের মা হয়েই থাকতে হবে।”

রাগে থরথর করছে অর্হিতার শরীর। লোকটা কতবড়ো অসভ্য!
চিৎকার করে উঠে অর্হিতা।

“আমি আপনার মেয়েকে বাঁচিয়েছি। সেই খুশিতে আপনি আমাকে মেরে ফেলতে চাইছেন?”

নায়েল ভ্রূকুঞ্চন করে অবাক গলায় বলল—

“আপনি ভুল ভাবছেন। আমি আপনাকে জোর করতে চাইনি। মেরে ফেলব কেন? বরঞ্চ বাঁচিয়েছি। আপনার ভাই বলল, আপনি বাইরের ক্রান্ট্রিতে গিয়ে হায়্যার স্টাডি করতে চান! আমি আপনার জন্য সব ব্যবস্থা করব। শুধু তার বিনিময়ে আমার মেয়েকে আপন করে নেবেন। দ্যাটস ইট।”

রাগে হতবিহ্বল অর্হিতা বিছানার পাশ টেবিল হতে টেবিল ল্যাম্পশেডটা নিয়ে ছুড়ে মারে নায়েলের দিকে। তা সোজা গিয়ে লাগে নায়েলের কপালে। কেটে যায় অনেকটা জায়গা। অর্হিতার রাগ কমলো না। মায়াও হলো না লোকটার জন্য। ভাবে কী নিজেকে। জোর করে বিয়ে করে একটা বাচ্চা ধরিয়ে দিলেই হলো! না। এমনিতেও ও বাড়িতে তার কোনো সম্মান নেই। এখানেও যদি তাই ই হয় তাহলে সে লড়বে। নিজের জন্য-ই লড়বে। অন্যের বাচ্চাকে সে কেন মাতৃস্নেহ দেবে?

কপালে হাত দিয়ে উজ্জ্বল চোখে চেয়ে আছে নায়েল। মেয়েটার এই ঝড়ো রাগের জন্য-ই এত কাঠখড় পুরিয়ে তাকে বিয়ে করেছে সে। তার প্রতি তিক্ততা এই সম্পর্কের মাঝে দেয়াল তুললেও তার মেয়েকে দেবে আশ্রয়। পিউলীর জীবন সংকটে এই মেয়ে-ই হবে তার হাতিয়ার। যে পিউলীকে রক্ষা করবে ওই অদৃশ্য শত্রুর হাত থেকে।

দশ মাস দশদিন একটা ভ্রুণকে যেমন মা তার জঠরে লালন করে পৃথিবীর ভয়াল আগ্রাসন থেকে রক্ষা করে, ঠিক তেমনভাবে অর্হিতাও তার পিউলীকে রক্ষা করবে সেই নামহীন ভয়ংকর প্রহেলিকা থেকে। যা এখনো বলয় হয়ে ঘিরে রেখেছে তার মেয়েকে। অর্হিতার এই রাগি, জেদি মনে তার মেয়ের জন্য জায়গা করে তুলতে হবে।

পাথরে ফুল ফোটা অসম্ভব। কিন্তু যদি ফোটে, তবে তা অবিশ্বাস্য ! অর্হিতা সেই পাথর, তার বুকে-ই ফুল হয়ে ফুটফে পিউলী। নায়েল সেই আশায় আশাবাদী।

চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here