জঠর পর্বঃ১২,১৩

0
1013

জঠর
পর্বঃ১২,১৩
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি
পর্বঃ১২

ঊষরের বুকে এক প্রশান্তির ছায়া হয়ে পিউলীর জীবনে নেমে আসে অর্হিতা নামের এক জলপ্রপাত। যার প্রতিটি ধাবহান স্রোতে সে তার মাতৃস্নেহের সমস্ত তৃষ্ণা মেটাতে সর্বদা তটস্থ।

প্রভাতের মিষ্টি রোশনাইয়ের ঝলমলে আবরণে আচ্ছাদিত বসুন্ধরা আজ উচ্ছ্বাসিত। কিন্তু খানিক বাদেই তার দখল নিয়ে নিল কুঞ্চিত কৃষ্ণাভ কাদম্বিনীর ভাঁজ। লুকিয়ে গেল প্রভাকর কৃষ্ণাভ কাদম্বিনীর আড়ালে। থেমে থেমে ইলশেগুড়ি বৃষ্টির সাথে অগ্নিসখের টান। শীতলতা বইছে প্রকৃতিতে। নিমগ্ন প্রকৃতিতে খেলছে বৃষ্টি আর অগ্নিসখের দোল।

ছোটো এক টুকরো রুটি পিউলীর মুখে দিতেই উচ্চলিত হয়ে তা দাঁত দিয়ে চিবিয়ে গিলে নিল সে। সাদা মুক্তোর মতো ঝকঝকে দাঁতের মিষ্টি হাসিতে বাতাসে দোল তোলে পিউলী। অর্হিতা সন্দিহান চোখে চেয়ে বলল—

“হাসো কেন?”

পিউলী খিলখিলিয়ে হাসে। অবারিত হাসি। বলল—

“তুমি সুন্দর।”

অর্হিতা কপট বিস্ময় নিয়ে বলল—

“ও মা! তাই না কি?”

“হুম।”

“কতটুকু সুন্দর?”

“অনেকটুকু।”

পিউলী তার দুই হাত ছড়িয়ে দেখায়। অর্হিতা মুচকি হাসে। তৎক্ষণাৎ কক্ষে ঢোকে নায়েল। একদম রেডি হয়েই এসেছে। পিউলীর দিকে তাকিয়ে ব্যগ্র গলায় বলল—

“চলো পিউ, পাপার দেরি হচ্ছে।”

পিউলী উঠে দাঁড়াতেই তার হাত ধরে অর্হিতা। নরম গলায় বলল—

“ওকে নিতে হবে না। আজ থেকে পিউ আমার কাছেই থাকবে।”

পিউলী দন্তপাটি সমান করে হাসে। তার চোখ দুটো মিলিয়ে আসে। উপচে পড়ে খুশি চোখের পল্লবে। নায়েল বিছানার কাছে এগিয়ে আসে। পিউলীকে টেনে নিজের কাছে এনে চোখে, মুখে টপাটপ চুমু খেয়ে বলল—

“খুশি? মামুনি তোমাকে তার কাছে থাকতে বলেছে।”

“হুম।”

“গুড গার্ল। দুষ্টুমি করবে না। মামুনিকে জ্বালাবে না ওকে?”

“হুম।”

“মাই হার্ট। পাপা যাচ্ছি। বাই।”

“বাই।”

নায়েলের বুকের ওপর থেকে যেন পাথর সরে আসলো। দীর্ঘ স্বস্তির সাথে বলল—

“অর্হিতা, পিউর খেয়াল রাখবেন।”

অর্হিতা কপট কটাক্ষ করে বলল—

“হ্যাঁ, হ্যাঁ। মেয়ের বডিগার্ড করেই তো এনেছেন।”

নায়েল ঠোঁট কামড়ে হাসে। ঝুঁকে অর্হিতার কানের কাছে গিয়ে বলল—

“তাহলে মেয়ের বাবার বডিস্প্রে হয় যান। আই ডোন্ট মাইন্ড।”

অর্হিতা দাঁত কিড়মিড় করে তাকায়। অসহ্য গলায় বলল—

“অশ্লীল !”

নায়েল ধুম করেই পিউলীর দিকে তাকায়। অর্হিতা জিব কামড়ে চোখ পিটপিট করে অস্ফুট গলায় বলল—

“সরিইইই। আর বলব না।”

নায়েল মাথা ঝাঁকায়। মিষ্টি হেসে বলল—

“পাপা যাচ্ছি পিউ। বাই।”

“ওকে।”

কলেজে যাওয়ার তাড়া হৃতির। কোনোমতে ছুটে চললেই যেন হলো। দরজার কাছ থেকে দেখতে পেল নায়েল নিচে নামছে। বুকে ধাক্কা লাগে হৃতির। কাতর চোখ দুটো ফিরিয়ে নিয়ে পা বাড়াতেই নায়েলের শক্ত কণ্ঠের আহ্বান।

“দাঁড়াও হৃতি।”

হৃতি থমকায়। ফিরে তাকায় ছলছল লোচনে। আগ্রহীসত্ত্বা অনঢ়। টলটলে গলায় বলল—

“কিছু বলবে?”

নায়েল সামনে এসে অনুদ্বেগ সুরে বলল—

“চলো, আজ আমি তোমাকে কলেজ পৌঁছে দিচ্ছি।”

হৃতির অবাকের মাত্রা অভ্রভেদী। লক্ষ্যভ্রষ্ট তীরের ন্যায় চিন্তিত চোখে চেয়ে বলল—

“কেন?”

“এমনি। ইচ্ছে হলো।”

হৃতি আপত্তি করে বলল—

“প্রয়োজন নেই। আমি একাই যেতে পারব।”

“আমি তোমাকে আমার সাথে যেতে বলেছি। চলো।”

“বললাম তো না।”

নায়েল শুনল না। খপ করে হৃতির হাত ধরে। হৃতি বদ্ধশ্বাসে তাকিয়ে রয়। বিস্মিত, বিমূঢ় সে। নায়েল কখনো এমন আচরণ করে না।
,
,
,
গাড়ির জানালা দিয়ে ফুরফুরে বাতাস। তাতে আছে সিক্ত সকালের মিষ্টি ঘ্রাণ। ঝকঝকে পরিষ্কার আকাশে তুলোর মতো মেঘের ছড়াছড়ি। কুসুমকোমল সূর্যের রশ্মি একটু একটু করে তার প্রতিফলন ঘটাচ্ছে হৃতির চোখে, মুখে। নায়েলের শক্ত দৃষ্টি ফ্রন্ট মিররে। কণ্ঠে কাঠিন্যতা রেখে বলল—

“এসব করলে কেন?”

চট করে নায়েলের দিকে নজর ফেলে হৃতি। চকচকে চাহনি রেখে বলল—

“কী করেছি আমি?”

নায়েল গাড়ি থামায়। স্টেয়ারিং থেকে হাত সরিয়ে কাত হয়ে হৃতির দিকে চেয়ে বলল—

“সেদিন তুমিই ছিলে সেখানে তাই না?”

হৃতি ফুঁসলে উঠে বলল—

“আমি ছিলাম বলে আমিই এসব করেছি তুমি ভাবলে কী করে?”

নায়েল তপ্ত শ্বাস ফেলে। নাকের পাটা ফুলিয়ে বিতৃষ্ণা গলায় বলল—

“তাতো তুমি ভালো করে জানো। সিঁড়ির উপর তেল ছিল। আর ঘরে একমাত্র তোমারই আনাগোনা রান্না ঘরে।”

হৃতি রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে বলল—

“রান্নাঘরে আমার যাতায়ত বলে আমিই এসব করেছি তুমি ভাবলে কী করে? রান্নাঘরে তো মাঝে মাঝে পিউলীও যায়। তাহলে ওকে কেন সন্দেহ করছ না?”

“জাস্ট শাটআপ ইয়ার। তুমি কী বলছ তা বুঝে বলছ তো?”

হৃতির চোখ বেয়ে ঝমঝমিয়ে শ্রাবণের ধারা নামে। নায়েল এভাবে তাকে বলতে পারে না। অবশ্য বলবেই না কেন? আশ্রিতাদের এর চেয়ে ভালো আচরণ আদৌ কী প্রাপ্য?
,
,
,
কুচকুচে আঁধারে অবগাহনে মত্ত বিভাবরী। তার আঁধার ফুঁড়ে মশাল জ্বালিয়ে স্বগৌরবে উঁকি দিচ্ছে সুধানিধি। ঘন কালো আঁধারে অস্পষ্ট আবছায়ায় বাসায় ফিরেছে নায়েল। জরুরি মিটিং থাকায় আজ একটু দেরি হয়েছে ফিরতে।

বসার ঘরের কৃত্রিম বাতির প্রখর আলো। সিঁড়ি বেয়ে নিজের কক্ষের উদ্দেশ্যে পা চালাতে থাকে নায়েল। ক্লান্ত, শ্রান্ত শরীরের উৎফুল্লতা প্রয়োজন। গায়ের ব্লেজার খুলে তোয়ালে হাতে ওয়াশরুমে ঢুকে নায়েল। লম্বা শাওয়ার নিয়ে বের হয়। সময় প্রহরী তখন জানান দিচ্ছে রাতের মধ্য প্রহরের। চুলের পানি শুকিয়ে একটা পাতলা টিশার্ট গায়ে গলিয়ে নেয় নায়েল। অর্হিতার কক্ষের সামনে দাঁড়িয়ে ইতস্তত বোধ হয় তার। পিউলীকে আনতে হবে। মেয়েটা মামুনিকে পাওয়ার খুশিতে যেন সব ভুলে গেছে। নক করতেই ভেতর থেকে সাড়া পায় নায়েল। জড়তা ঝেড়ে ফেলে ভেতরে ঢুকে একটু অবাক-ই হয় সে। পিউলী ঘুমোচ্ছে তার পাশে আধো জাগরিত অর্হিতা। তার চোখে, মুখ তন্দ্রালুভাব। নায়েল মৃদুমধুর গলায় বলল—

“সরি, আমার আসতে একটু দেরি হয়ে গেল। আমি পিউকে নিয়ে যাচ্ছি।”

অর্হিতা ঘুমো ঘুমো গলায় বাঁধা প্রদান করে বলল—

“না। আজ থেকে পিউ আমার কাছেই থাকবে।”

“ও আপনাকে ঘুমোতে দেবে না। রাতে জ্বালাবে।”

“এত চিন্তা! সেইটা তো আমাকে ওর মা বানানোর আগে ভাবা উচিত ছিল তাহলে।”

ট্রাউজারে এক হাত গুঁজে অনুতপ্ত চোখে তাকায় নায়েল। জিজ্ঞাসু গলায় বলল—

“পিউ খেয়েছে তো?”

“হ্যাঁ। খাইয়ে দিয়েছি।”

“আপনি খেয়েছেন?”

“আমি কার জন্য না খেয়ে থাকব? তেমন কেউ তো নেই।”

দীর্ঘশ্বাস ফেলল নায়েল। ঘুরে দাঁড়াতেই অর্হিতার কঠোর গলার প্রশ্ন—-

“আপনি খেয়েছেন?”

“নায়েল ফিরে তাকায়। নম্র স্বরে বলল—

“হ্যাঁ।”

অনেকটা বিনীতভাবেই বলে উঠে অর্হিতা—-

“আপনার কী একটু সময় হবে? আপনার সাথে একটু কথা ছিল।”

নায়েল অধর চেপে ধরে মাথা ঝাঁকায়। টুল টেনে একটু দূরত্বে বসে।

“বলুন।”

অর্হিতা ছড়ানো পা গুটিয়ে নিয়ে কণ্ঠ খাদে নামিয়ে বলল —-

“হৃতিকে আপনি কী বলেছেন?”

চোখে হাসে নায়েল। তার ভাবভঙ্গি এমন যেন সে জানত হৃতি এমনটা করবে।
নায়েল সরস গলায় বলল—

“কী বলেছে ও আপনাকে?”

“মেয়েটা যথেষ্ট ভালো। আপনার ওকে এভাবে দোষারোপ করা উচিত হয়নি।”

নায়েল তার উপরেরে ঠোঁট কামড়ে ধরে কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। পরক্ষণে সরল গলায় বলল—

“আমি জানি। হৃতি এমন কাজ করতে পারে না।”

“তাহলে?”

“আমি চাই ও এই বাড়ি থেকে দূরে থাকুক।”

“কিন্তু কেন?”

নায়েল পূর্ণ নজর ক্ষেপণ করে অর্হিতার দিকে। কিন্তু কোনো প্রতিক্রিয়া করল না। অর্হিতা গুমোট হাসল। ভাবাবেশ ছাড়া বলল—

“একটা মেয়ের পক্ষে একা একটা সমাজে বসবাস করা এত সহজ নয় নায়েল। ওকে আপনি হোস্টেলে যাওয়ার কথা বলেছেন। মেয়েটা বয়স হিসেবে এখনো অনেক নাজুক। কাজটা আপনার ঠিক হয়নি। পাথরকে আঘাত করলে হয় সে চূর্ণবিচূর্ণ হবে না হয় যে তাকে আঘাত করবে তাকে ভেঙে গুড়িয়ে দেবে। কিন্তু মোম! মোম গলে যাবে। তাকে তার স্থায়িত্ব অশিথিল রাখতে তাপ থেকে দূরে থাকতে হবে। হৃতি মেয়েটা মোমের মতো। আপনাকে ওর ছায়া হতে হবে। ওকে সমাজের অবাঞ্চিত তপ্ততা থেকে আপনাকেই রক্ষা করতে হবে। মেয়েটা আপনাকে অনেক ভরসা করে, হয়তো ভালোও বাসে। কিন্তু আপনার মনে হয়তো সেই ধরনের কোনো অনুভূতি নেই। অবশ্য থাকলেও এখন আর কাজ হবে না। আমার অধিকার আমি অন্য কাউকে দেবো না। এতটা উদার নই আমি।”

নায়েলের কপালের মাঝ বরাবর কুঞ্চিত হয়। অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে সে তাকাল অর্হিতার দিকে। অর্হিতা অক্ষিকোটর ঘুরিয়ে নিয়ে বলল—

“এখন আপনি আসতে পারেন। ঘুম পাচ্ছে আমার। আরো কিছু বলার ছিল। কাল বলব। রাত জাগলে আবার আমার খিদে লাগে। যান। গুড নাইট।”

নায়েল বিরক্ত হবে না-কি আফসোস করবে ভেবে পায় না। মেয়েটার ব্যবহারে দিনকে দিন সে অবাকই হচ্ছে। অধিকারের কথা বলে নায়েলের পুরুষ হৃদয়েও ঝড় তুলে দিলো। নায়েল হতাশ শ্বাস ফেলল। উঠে দাঁড়িয়ে দরজার কাছে যেতেই পাতলা চাদরের ভেতর থেকে ঘুমকাতুরে গলায় বলে উঠে অর্হিতা—

“লাইটটা অফ করে দিবেন প্লিজ। আলোতে ঘুম আসে না আমার।”

নায়েল ধীরগতিতে তাই করল। দরজা চাপিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসে সে। নিজের কক্ষে এসে বিছানায় শুয়ে পড়ে। কিন্তু ঘুম আর তার চোখের দর্পণে ধরা দিচ্ছে না। তার অবাধ্য মন ছুটে চলছে কোনো অজানা উদ্দেশ্যে। নায়েল বিভ্রান্ত। সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে সে অনেকদূর চলে এসেছে। এখন তো নিজেকে নিয়ে ভাবা উচিত তার।

চলবে,,,

#জঠর
#পর্বঃ১৩
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি

টেবিলের উপর মাথা দিয়ে বসে আছে হৃতি। অতন্দ্রি নক্তের শেষে এক ক্লান্ত প্রভাত। মাথায় আলতো স্পর্শে সচেতন হয় হৃতি। লালিমায় ছাওয়া দুই আঁখির মৃদু চাহনিতে মাথা তুলে দেখতে পেল নায়েল দাঁড়িয়ে আছে। হৃতি দ্রুত ওঠে দাঁড়ায়। বুকের ভেতর অযাচিত, অভাবনীয় যন্ত্রণা। তরতরিয়ে মেলছে তার শাখা-প্রশাখা। জল ছেপে এলো নেত্রকোটর হতে। তা স্বগৌরবে আটকে নিল। ব্যস্ততা দেখিয়ে সরে আসে নায়েলের কাছ থেকে। কঠিন মনোভাবের সাথে বলল—

“চিন্তা করো না। আমি ব্যাগ গুছিয়ে রেখেছি। আজই চলে যাব আমি।”

নায়েল অপ্রস্তুত চোখে চেয়ে বলল—

“কালকের জন্য আমি দুঃখিত।”

হৃতি জোরালো চাহনি নিক্ষেপ করল নায়েলের দিকে। নায়েল স্পষ্ট দেখতে পেল সে চাহনিতে এক সাগর তাচ্ছিল্য। তাতে হাবুডুবু খেতে লাগল নায়েল। আকণ্ঠ সে সমুদ্রজলে নিমজ্জিত নায়েল বিনীত সুরে বলল—

“আই এম এক্সট্রেমলি সরি। আমি তোমাকে ওভাবে বলতে চাইনি। আসলে অর্হিতাকে ওভাবে দেখে আমার মাথা ঠিক ছিল না।”

বিদ্রুপপূর্ণ হাসল হৃতি। নায়েল নিমগ্ন দৃষ্টি রেখে বলল—

“খাবে চলো।”

“আমার খিদে নেই।”

“রাগ করলে?”

হৃতি হেয়ালি গলায় বলল—

“তোমার ওপর রাগ করার অধিকার নেই আমার।”

নায়েল মুচকি হাসল। সরব গলায় বলল—

“অধিকার দিতে হয় না, অধিকার আদায় করে নিতে হয়।”

নতুন বসন্তের উত্তুরে হাওয়া যেন এক নিমিষে ছুঁয়ে গেল হৃতিকে। চকচকে চোখে চেয়ে বলল—

“তাহলে চলে যেতে বললে কেন?”

নায়েল বাম হাতে নিজের বাম কানের লতি টেনে ধরে এক চোখ বন্ধ করে স্নিগ্ধ স্বরে বলল—

“সরি!”

হৃতি উৎফুল্ল হাসল। এই মানুষটার সাথে সে রাগ করে থাকতে পারে না। তার প্রণয়িনী তো হতে পারেনি তবে তার চেয়ে একটু কম হলেও সে আছে। নায়েলের অস্তিত্বের কোথাও সে নিজেকে অনুভব করে। নায়েল প্রশ্বস্ত গলায় আদর মাখিয়ে বলল—

” এখন তো চলো। কলরব বলল সকালে খাওনি। ”

হৃতি দ্বিরূক্তি করল না। খাবার টেবিলে বসে আছে দুজন। হৃতির সামনে পরীক্ষা। তা নিয়েই কথা বলছে আর খেয়ে যাচ্ছে দুজন। সিঁড়ির ওপর থেকে তাদের দিকে একজোড়া তীক্ষ্ম চোখ তাকিয়ে আছে। অকারণেই মেজাজ তিরিক্ষি হচ্ছে অর্হিতার। এত হাসাহাসির কী আছে! খাচ্ছে তো খাবেই না। এত রঙ, ঢঙ কীসের? ফুঁসে যাচ্ছে নিজের অন্তর্জালায় অর্হিতা। টগবগ করছে তার মস্তিষ্ক। সিঁড়ি ভেঙে ধীরগতিতে নেমে আসে সে। হৃতির ঠোঁটের কোণে জ্যাম লেগে আছে। তা টিশু দিয়ে মুছে দেয় নায়েল। তা দেখে যেন মাথা ফেটে যাচ্ছিল অর্হিতার। বিড়বিড় করে বলল,”গিরগিটির হাবভাব দেখেছ, এমনি মনে হয় যেন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সাধু পুরুষ। আর এখন! সুযোগ পেয়ে কচি মেয়ের ঠোঁটে হাত! বেয়াদব গিরগিটি!”

দপদপ পা ফেলে টেবিলের সামনে এসে ঝাঁঝিয়ে উঠে অর্হিতা—

“আপনার সাথে কথা আছে আমার। ঘরে আসুন।”

চকিতে দুই জোড়া বিস্মিত চোখ অর্হিতার রঞ্জিত মুখটা দেখে ভ্রূকুঞ্চণ করে। নায়েল সংকীর্ণ গলায় বলল—

“কিছু হয়েছে?”

“না…হবে। আপনি ঘরে আসুন।”

হৃতি চোখের কোটর ছোট্ট করে নায়েলের দিকে তাকায়। নায়েল অবিচলিত। অর্হিতার কণ্ঠের ঠাঁট সে ধরতে পারলেও কারণ বুঝতে পারেনি। মাখন লাগানো ব্রেডে কামড় বসিয়ে প্রশ্ন ছুড়ে নায়েল—

“পিউ কোথায়?”

রাগে অর্হিতার চোখের পাতা অনুরণন হচ্ছে। ওষ্ঠাধর পলে পলে সংকুচিত, প্রসারিত হচ্ছে। ধারালো গলায় বলে উঠে—

“আপনার বাবার ঘরে।”

নায়েল মৃদুমধুর গলায় বলল—

“আমার বাবা কী আপনার কিছু হয় না?”

অর্হিতা রাগে বিহ্বল। কেন যেন তার মস্তিষ্ক কাজ করছে না। মন থেকে শুধু চাইছে নায়েল সরে যাক হৃতির কাছ থেকে। কিন্তু কেন? তার উত্তর নেই অর্হিতার কাছে। কর্কশ স্বরে নায়েলের কথার প্রত্যুত্তর করে সে।

“জানি না।”

নায়েল তপ্ত শ্বাস ফেলল। নিরুত্তেজ গলায় বলল—

“জানতে হয় অর্হিতা। নিজের জন্য জানতে হয়, সম্পর্কের জন্য জানতে হয়, সমাজের জন্য জানতে হয়। আপনি ঘরে যান, আমি খাওয়া শেষ করে আসছি।”

অর্হিতা দাঁত কিড়মিড় করে দপদপিয়ে যায়। হৃতির মোলায়েম দৃষ্টি। তাকে আশ্বস্ত করে নায়েল বলল—

“খাও। ওর কথায় কিছু মনে করো না।”
,
,
,
নিজের ঘরে তটস্থ পায়ে পায়চারী করছে অর্হিতা। রাগে নিজের চুল ছিড়ে ফেলতে ইচ্ছে হচ্ছে। না, হৃতির জন্য নয়। নিজের অদ্ভুত আচরণের জন্য রাগ হচ্ছে তার। কী বলল এসব সে! ছিঃ! অনুশোচনায় নিজেই দগ্ধ হচ্ছে অর্হিতা। দরজায় করাঘাত পড়ে। নিজেকে ধাতস্থ করে অর্হিতা। নায়েল ভেতরে এসে অমায়িক হেসে বলল—

“বলুন কী বলবেন?”

একটু আগের অনুশোচনার বাতি ফুস করে নিভে গেল। তেঁতে উঠল অর্হিতা। রিনরিনে গলায় বলল—

“কী করছিলেন হৃতির সাথে আপনি?”

নায়েল অবাক চোখে চেয়ে বলল—

“কী করছিলাম মানে?”

অর্হিতা তাপিত গলায় বলল—

“ওর গালে কেন হাত দিলেন?”

চাহনিতে শিথিলতা আনে নায়েল। চাপা হাসে সে। কিন্তু চেহারায় গাম্ভীর্যতা ধরে রেখে বলল—

“গালে হাত দিইনি তো, ঠোঁটে হাত দিয়েছি।”

অর্হিতার রাগ এবার আকাশ ছুঁল। কতবড়ো বেয়াদব! আবার বলছে ঠোঁটে হাত দিয়েছে! ভাবনাতীত কাজ করে বসল অর্হিতা। নায়েলকে ধাক্কা মেরে বলল—

” এই আপনি যান, যান এখান থেকে। আমার মুখ থেকে কখন কী বের হবে! তার আগেই বের হোন এখান থেকে।”

“আরে, আপনি আমার কথা তো শুনুন।”

নায়েলকে জবরদস্তি কক্ষ থেকে বের করে অর্হিতা। দ্রুত পায়চারী করতে করতে মাথার তালুতে ছোটো ছোটো চাপড় বসাতে থাকে। নিজেকেই নিজে বলতে থাকে,” কুল, কুল অর্হিতা। মাথা গরম করা যাবে না। গিরগিটি হলেও পুরুষ তো। তোকে মাথা ঠান্ডা রাখতে হবে।”

নিজের সান্ত্বনায় কাজ হলো না। ওয়াশরুমে ঢুকে শাওয়ারের নিচে দাঁড়ায় অর্হিতা। মাথাটা জ্বলে যাচ্ছে। এখন পানি না দিলে সে নির্ঘাত ভষ্ম হয়ে যাবে।
,
,
,
নীলাভ বাতির আবছায়ায় তন্দ্রায় আচ্ছন্ন অর্হিতা। তাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরেছে পিউলী। চোখের পল্লব মেলে চাইতে স্বরনালীতে টান পড়ল। অর্হিতার অনুভূত হলো সে তৃষ্ণার্ত। পিউলীকে নিজের কাছ থেকে একটু সরিয়ে ওঠে বসে। আজ সারাদিনেও নায়েলের সামনে যায়নি অর্হিতার। নায়েলের ওপর ভীষণ ক্ষেপে আছে সে। নায়েলও কিছু একটা নিয়ে ব্যস্ত বিধায় আর আসেনি। ঘুম ছুটতেই সবার আগে এইকথাগুলোই মাথা চাড়া দিয়ে উঠল অর্হিতার। ভাবতে চায় না সে এই বিষয়ে। তবুও অবাধ্য মন, মস্তিষ্ক কোনোটাতেই লাগাম লাগাতে পারছে না। স্বামী নামক পুরুষটার ওপর নামহীন এক কর্তৃত্ব চায় সে। কিন্তু তা কি সম্ভব?

বেডসাইড টেবিল হাতড়ে যখন বুঝতে পারল পানির জগ খালি, আরেক দফা বিষিয়ে ওঠল তার মন। জগ নিয়ে কক্ষের বাইরে আসে অর্হিতা। বসার ঘরে ক্ষীণ আলো জ্বলছে। কিন্তু তাতেও সে স্পষ্ট দেখতে পেল নায়েলকে। তড়িঘড়ি করে বের হচ্ছে সদর দরজা দিয়ে। অর্হিতা গাঢ় নজরে তাকায়। সিঁড়ি বেয়ে নরম পায়ে নিচে নেমে আসে। বসার ঘরের বড়ো দেয়াল ঘড়িতে ঝাপসা আলোয় দেখতে পেল রাত তিনটা। এত রাতে কোথায় গেল নায়েল। অর্হিতার মনে এক বিচ্ছিরি চিন্তার উদ্ভব হলো। সে না চাইতেও ভাবতে বাধ্য হলো সেই নোংরা বিষয়টা নিয়ে। নায়েলের সাথে তার সম্পর্কটাও এত গাঢ় হয়নি যে তাকে সাধু-সন্ন্যাসী ভাববে!
,
,
,
প্রাতের দিবাকর চোখ মেলেছে নিত্য নিয়মে। প্রকৃতি মুক্ত হয়েছে তমসা থেকে। অবসন্ন, অবসাদগ্রস্ত নায়েল বাসায় ফিরে। নিজের কক্ষে প্রবেশ করতেই চমকিত হয় সে। তার বিছানার একপাশে হাঁটু মুড়ে বসে আছে অর্হিতা। নায়েল বিচলিত হলো না। হাতঘড়ি আর মোবাইলটা ওয়্যারড্রোবের উপর রাখতেই চেঁচিয়ে উঠে অর্হিতা—

“কোথায় ছিলেন আপনি?”

নায়েল নম্র গলায় বলল—

“কাজ ছিল।”

“এমন কী কাজ যে আপনাকে রাতভর বাইরে থাকতে হলো?”

কপালে অমসৃণ ভাঁজ তোলে নায়েল। চোখের কোটর ক্ষীণ করে বলল—

“বললাম তো কাজ ছিল।”

অর্হিতা গনগনে আগুনের মতো জ্বলে উঠে বলল—

“এমন কী কাজ যা রাত তিনটার পর হয়? দিনের আলোতে যা করা যায় না।”

নায়েল মৃদু স্বরে কৌতূহলী হয়ে বলল—

“কী বলতে চান আপনি?”

অর্হিতা রোষে ফেটে পড়ে নায়েলের কাছে এসে দাঁড়ায়। তার বক্ষস্থলে খামচে ধরে ক্রোধিত গলায় বলল—

“বুঝতে পারছেন না কী বলতে চাই? কখনো ঘরে, কখনো বাইরে। যখন সব জায়গায় আগে থেকে রেডি করেই রেখেছেন তাহলে আমাকে কেন বিয়ে করেছেন? শুধু মেয়ের দেখাশোনার জন্য? কাজের লোক মনে হয় আপনার আমাকে?”

নায়েেরল চোখ বিদ্ধ হয় অর্হিতার রোদনভরা চোখে। ছলছল চোখের জল গড়িয়ে পড়ছে। নায়েল নিজেকে শান্ত রাখল। ধীরগতিতে অর্হিতার হাতটা সরিয়ে নিয়ে বলল—

“আপনি ভুল ভাবছেন অর্হিতা। আমি হসপিটালে ছিলাম। সারারাত সেখানেই কাটিয়েছি।”

অর্হিতার রাগে ভাটা পড়ল। সে নির্মেঘ চোখে চেয়ে বলল—

“কেন? কী হয়েছে?”

দীর্ঘশ্বাস ফেলল নায়েল। ভারাক্রান্ত গলায় বলল—

“লুবানা ইজ ডেড। শী ইজ নো মোর।”

মুখে হাত চাপা দেয় অর্হিতা। তার চোখে স্ফীত ধারা পূনরায় বেখেয়ালিভাবে ঝরতে লাগল। নায়েল ধীর গলায় বলল—

“হঠাৎ করে ওর হার্টবির্ট বাড়তে শুরু করল। তারপর কমতে। ডক্টর অনেক চেষ্টা করেছে। কিন্তু…।”

আর বলল না নায়েল। বুক ভার হলো তার। অর্হিতা ঝড়ের রাতের নীড়হারা পাখির মতো ছটফটাতে থাকল। মৃত্যু আর কত দেখবে সে?
ছুটে আসেন নওশাদ সাহেব। হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন—

“নায়েল!”

নায়েল গলায় দৃঢ়তা নিয়ে বলল—

“সরি বাবা। আমার আর কিছুই করার নেই। লুবানাকে আমি বাঁচাতে পারিনি।”

পিউলী তার পেছনেই ছিল। লুবানার মৃত্যুর কথা শুনে হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। অর্হিতা হাঁটু ভাঁজ করে পিউলীর সামনে বষে। চোখে, মুখে হাত বুলিয়ে বলল—

“কাঁদে না, কাঁদে না পিউ।”

পিউলী ঠোঁট ভেঙে বলল—

“লুবানা আনটিকে আল্লাহ্ বেশি ভালোবেসেছে। তাই নিয়ে গেছে।”

অর্হিতা মৃদু স্বরে বলল—

“এমনটা বলে না পিউ। আল্লাহ্ আমাদের সবাইকে ভালোবাসেন। তিঁনি যখন যাকে চাইবেন তখন তাকে নিজের কাছে ডেকে নেন। কে বলেছে আল্লাহ্ আমাদের ভালোবাসেন না? আল্লাহ্ পাক তাঁর সকল বান্দাদের ভালোবাসেন। তাঁর সৃষ্ট সকল জীবকে ভালোবাসেন। তিঁনি তোমাকেও ভালোবাসেন, যেমন তোমার মামুনিকে ভালোবাসেন। কেঁদো না। আল্লাহ্ যা করেন আমাদের ভালোর জন্যই করেন। তোমার নিহি মামুনির বদলে আল্লাহ্ তোমাকে আরেকটা মামুনি দিয়েছে তো। তুমি খুশি হওনি পিউ?”

“হুম।”

“তাহলে আর কেঁদো না। আল্লাহ্ কিন্তু ছোটো বাবুদের ভীষণ ভালোবাসেন। ছোটো বাবুরা যা চায় আল্লাহ্ তাদের তাই ই দেন। তুমি নিহি মামুনির জন্য আল্লাহ্ এর কাছে দোআ চাইবে। লুবানা আনটির জন্য দোআ চাইবে। আল্লাহ্ নিশ্চয়ই তোমার কথা শুনবে।”

“আচ্ছা।”

অর্হিতার গলা জড়িয়ে ধরে তার কাঁধে মাথা রাখে পিউলী। পিউলীকে কোলে নিয়ে ওঠে দাঁড়ায় অর্হিতা। নায়েলের দিকে তাকিয়ে বলল—

“ক্ষমা করবেন আমাকে। সেদিন রাগের মাথায় অনেককিছু বলে ফেলেছি। আসলে জীবনে এতকিছু দেখেছি সব কেমন ধোঁয়াশা মনে হয়। তবে মনে হচ্ছে আল্লাহ্ পাক যা করেছেন ভালোই করেছেন। সর্বদ্রষ্টা তিঁনি। যা আমার কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছেন তার চেয়ে তিনগুন বেশি ফেরত দিয়েছেন। তাঁর উপর ভরসা রেখে আমি আশাহত হইনি এবার। ধৈর্য ধরুন। হয়তো লুবানার মৃত্যু আমাদের নতুন পথ দেখাবে।”

অর্হিতা দুঃখী চোখে চাইল নওশাদ সাহেবের দিকে। আত্মবিশ্বাসের সাথে বলল—

“চিন্তা করবেন না বাবা। আজ থেকে আপনার নাতির সম্পূর্ণ দায়িত্ব আমার। জন্ম না দিয়েও ওর মা হয়ে উঠব আমি। দোআ করবেন।”

নওশাদ সাহেব বুকভরা আশা নিয়ে তাকালেন অর্হিতার দিকে।

চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here