জঠর পর্বঃ২০,২১

0
899

জঠর
পর্বঃ২০,২১
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি
পর্বঃ২০

ছোটো ছোটো চোখের পক্ষ্মচ্ছায়া( চোখের পল্লব) মেলে তাকিয়ে আছে পিউলী। নিমগ্ন দৃষ্টি তার। তন্দ্রায় বিভোর সুহাস। বিছানার সাথে বুক চেপে রেখেছে। পিউলী তার ছোটো ছোটো বাহুর নরম স্পর্শ আঁকে সুহাসের অনাবৃত প্রশস্ত পিঠে। নড়বড়ে ঘুমের মধ্যে মৃদু কুঞ্চন ওঠে সুহাসের পুরু ভ্রুযুগলে। অতি কষ্টে চোখের পল্লব মেলে ধরে সে। পাশ ফিরে চাইল। পিউলীর ইঁদুর দাঁতে প্রাণবন্ত হাসি। শ্রান্ত মুখে তাকায় সুহাস। চোখভর্তি ক্লান্ত হাসি। নম্র সুরে বলল—

“তুমি এখানে?”

পিউলী হি হি করে হাসে। খুশি খুশি গলায় বলল—

“তুমি এই পঁচা জিনিস কেন খাও আঙ্কল?”

বিছানার পাশে ছোট্ট টেবিলটার উপর সিগারেটের ছাঁইয়ের ছড়াছড়ি। কার্পেটের উপর ফিল্টার। সুহাস স্মিত হাসে। তার আড়ষ্ট শরীরকে সচল করে বা’হাতটা পিউলীর গালে স্পর্শ করে বলল—

“তুমি এখানে আর এসো না পিউ।”

“কেন?”

“এই যে আঙ্কল পঁচা জিনিস খাই।”

“তুমি আর খেয়ো না। ”

হেয়ালি হাসে সুহাস। তার উদ্দেশ্যহীন জীবন চলছেই নিকোটিনের ধোঁয়ায়। কলকলিয়ে হেসে ওঠে পিউলী। অকস্মাৎ সেই হাসিতে ভ্রু নাচায় সুহাস। চোখ পিটপিট করে বলল—

“হাসছ কেন পিউ?”

পিউলী মুখে হাত দেয়। তার চিকন দাঁতের হাসিতে প্রফুল্ল হয় সুহাসের অন্তঃকরণ(মন)। সুহাস চোখের চাহনি দৃঢ় করে। পিউলী সন্দিহান গলায় বলল—

“তুমি খালি গায়ে ঘুমাও কেন? তোমার জামা নেই?”

অধর জোড়া মুদিত অবস্থায় চওড়া করে সুহাস। বলল—

“আমার গরম লাগে।”

“ওই যে ফ্যান চলছে!”

সুহাস সিলিং ফ্যানের দিকে তাকায়। গাঢ় গলায় বলল—

“তবুও গরম লাগে।”

পিউলী একগাল হেসে বলল—

“তাহলে পাপাকে বলব তোমার ঘরে এসি লাগিয়ে দিতে। তারপর ঠান্ডা, ঠান্ডা।”

মুক্ত হাসে সুহাস। পিউলীর চোখের তারায় প্রাণাবেগ। সুহাস বিমোহিত হয়।

“তুমি এসি চিনো?”

“হুম। পাপার ঘরে আছে। ঠান্ডা, ঠান্ডা। ”

“তোমার ঘরে নেই?”

“না। আমি বড়ো হলে আমার ঘরে দেবে। তুমি আমার ঘরে যাওনি কেন? চলো, চলো, যাবে আমার ঘরে।”

পিউলী শায়িত সুহাসের হাত ধরে টানতে থাকে। সুহাস আপত্তি করে বলল—

“এখন না পিউ। পরে যাব।”

পিউলীকে চুমু খাওয়ার জন্য মুখ বাড়ায় সুহাস। পিউলী সরে আসে। চট করে বলল—

“না,না। তুমি ব্রাশ করোনি। যাও ব্রাশ করে আসো।”

সুহাস দিলখোলা হাসে। দুই হাতের ভর দিয়ে ওঠে বসে। ওয়াশরুমে যায়। হৃতি এসে সুহাসকে খুঁজতে থাকে। পেল না সে। টিমটিমে চোখে চেয়ে আছে পিউলী। তাকে জিজ্ঞেস করতেই হৃতি অবগত হয় সুহাসের ব্যাপারে। বিদ্যুৎ বেগে এক বুদ্ধি খেলে গেল হৃতির মস্তিষ্কের স্নায়ুতে। সে পিউলীকে কানে কানে কিছু একটা বলতেই উৎফুল্ল হয় পিউলী।

সুহাস ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে দেখে পিউলী এখনো দাঁড়িয়ে আছে। সুহাসের পায়ের কাছে এসে দাঁড়ায় পিউলী। একটা আঙুল দিয়ে সুহাসের পায়ে বেল বাজানোর মতো করে নক করে। সুহাস হাতের তোয়ালেটা রেখে নিচু হয়ে বসে। পিউলীর দুই হাতের বাজু ধরে স্থবির দৃষ্টিতে চেয়ে রইল। চকিতে নিজের অনাগত সন্তানকে দেখতে পেল সুহাস। যাকে সে আর কোনোদিনও দেখতে পাবে না। ছলছল করে ওঠে সুহাসের চোখ। পিউলী আদুরে গলায় বলল—

“আঙ্কল খাবে না? চলো।”

নিজের ধাতস্থ করে সুহাস। অধর বিস্তৃত করে বলল—

“না, পিউ। তুমি যাও।”

“না। সকালে খেতে হয়।”

পিউলী বাঁধা মানলো না। অবাধ্য শিশুকে যেমন মা জোর করে, ঠিক তেমনটাই করল পিউলী।
,
,
,
“পিউ কোথায়?”

নায়েলের করা প্রশ্নে হৃতি রয়ে সয়ে প্রত্যুত্তর করে—

“ও আমার ঘরে।”

“তুমি এখানে তো পিউ তোমার ঘরে কেন?”

“সুহাস আছে।”

চোয়াল শক্ত করে নায়েল। দাঁতে দাঁত নিষ্পেষন করতেই পিউলী গলার আওয়াজ ভেসে আসে।

” এসো আঙ্কল, এসো।”

নায়েলের বিক্ষুব্ধ দৃষ্টি। সুহাস তরল চোখে চাইল সবার দিকে। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল সায়েরা। ছেলেটাকে আজ নিজ চোখে খেতে দেখতে পাবে সে!

“হৃতি আনটি ওঠো। এখানে আঙ্কল বসবে।”

হৃতিকে উঠিয়ে সেখানে সুহাসের বসার ব্যবস্থা করে পিউলী। একপাশে নায়েল আরেকপাশে সুহাস বসেছে পিউলীর। হৃতির দৃষ্টিতে চঞ্চলতা। দুই পা দোলাতে থাকে পিউলী। উচ্ছ্বসিত সে। সুহাসের সরল কাঠখোট্টা চাহনি। পিউলী আবদার করে—

“মামুনি, আঙ্কলকে খেতে দাও।”

অর্হিতা হেসে বলল—

“দিচ্ছি পিউ। তুমি তোমার ব্রেড খাও।”

“না, আগে আঙ্কলকে দাও।”

অর্হিতা গরম দুধ নিয়ে পিউলীর পাশে এসে দাঁড়ায়। টেবিলে রাখতে যাবে তৎক্ষণাৎ পিউলী সামনের দিকে হাত বাড়াতেই গরম দুধের গ্লাসে ধাক্কা লেগে অর্হিতার হাত থেকে গ্লাস পড়ে যায় টেবিলে। গলগলিয়ে দুধের গ্লাস খালি হলো। তা টেবিল ক্লথ বেয়ে পড়ল নিচে, যেখানে ছিল পিউলীর পা। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে পিউলীর চেয়ারকে হাত দিয়ে ধাক্কা মারে সুহাস। তাতে পিউলীর চেয়ার খানিকটা পিছিয়ে যায় আর গরম দুধের বেশিরভাগ অংশ পড়ে সুহাসের হাতে। হঠাৎ ঘটা এই ঘটনায় চকিত সবাই। লাফিয়ে ওঠে সকলে। সায়েরা দ্রুত এসে সুহাসের হাত চেপে ধরে। সকলের উৎসুক দৃষ্টি।

“তুই ঠিক আছিস? জ্বলছে তোর হাত? দেখি কোথায় লেগেছে?”

সুহাস সকলের দিকে চোখ বোলাল। রোষিত গলায় বলল—

“হাতটা ছাড়ুন, ছাড়ুন বলছি।”

পিউলী ঝমঝমিয়ে কেঁদে ফেলে। তাকে কোলে নিয়ে নেয় নায়েল। ভয় পেয়েছে মেয়েটা। বুকের ভেতরের হৃৎপিন্ড লাফিয়ে যাচ্ছে। সুহাস গজগজ করে চলে যায় সেখান থেকে। খাওয়া হলো না তার। দেখা হলো না এক পিপাসার্ত মায়ের নিজের ছেলের খাওয়ার দৃশ্য।
,
,
,
ঘরময় পায়চারী করছে নায়েল। তার তাপিত মস্তিষ্কের কোণায় কোণায় অচ্ছুত( ছোঁয়া যায় না এমন) ত্রাসেরা আলোড়ন শুরু করেছে। জেঁকে ধরেছে তাকে এক কল্পনাতীত দুর্নিবার প্রলয়। সুহাস আশেপাশে থাকলেই কেন পিউলীর সাথে দুর্ঘটনা ঘটে! নায়েলের মনে হচ্ছে সে অদৃশ্য ঘাতক হয়তো পিউলীর আশেপাশেই আছে। চর্মচক্ষুতে তা দৃশ্যত নয়। বুকে কম্পন হয় নায়েলের। বোনের শেষ চিহ্নকে সে কোনোভাবেই আঘাতপ্রাপ্ত হতে দেবে না।
অর্হিতা দাঁড়িয়ে আছে বহুসময়। নিজের মাত্রাতিরিক্ত চিন্তায় বিভোর নায়েলের দৃষ্টিগোচর হলো না সে। অর্হিতা ধীর গলায় ডেকে উঠে—

“নায়েল!”

চকিত ধ্যাণ ছুটে নায়েলের। সামনে চোখ তুলে তাকায় সে। অর্হিতাকে কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে বলল—-

“পিউ কোথায়?”

অর্হিতা সহজ গলায় বলল—

“ও হৃতির ঘরে।”

“হৃতির ঘরে কেন?”

“জেদ ধরেছে সুহাসের কাছে যাবে।”

“ও বললেই যেতে দিতে হবে?”

নায়েল ক্রোধে আচ্ছন্ন হয়ে দমদম করে পা ফেলে নিচে আসে। অর্হিতা কিছু বলার সুযোগ পেল না।
,
,
,
বিছানায় আসন পেতে বসে আছে সুহাস। তার উরুর উপর বসে আছে পিউলী। গরম দুধ পড়ায় সুহাসের রোমশ হাত লালচে বর্ণ ধারণ করেছে। কুটকুট করে জ্বালা হচ্ছে হাতে। হৃতি বার্নল লাগিয়ে দিয়েছে। ফ্যানের নিচে হাত দিয়ে রেখেছে সুহাস। ছোট্ট লাল ঠোঁট দুটো বলয় করে সুহাসের হাতে মাতৃস্নেহের সাথে ফুঁ দিচ্ছে পিউলী।

“ব্যাথা করছে আঙ্কল?”

সুহাস ঘাড় বাকিয়ে পিউলীর নরম তুলতুলে গালে চুমু বসায়। আলতো গলায় বলল—

“না।”

“তুমি কেঁদো না। ভালো হয়ে যাবে।”

“জানি। সময়ের সাথে ক্ষত শুকিয়ে যায়, শুধু স্মৃতির পাতায় রয়ে যায় তার যন্ত্রণা!”

হৃতি ফ্যাকাশে দৃষ্টিতে তাকিয়ে সুহাসের কথার অর্থোদ্বারের চেষ্টা করল। কিন্ত পারল না।
নায়েল তটস্থ হয়ে হৃতির কক্ষে ঢোকে। পিউলী চট করে ওঠে দাঁড়ায়। গলা চড়িয়ে বলল—

“পাপা!”

নায়েল অস্থির হয়ে মেয়েকে কোলে নিয়ে নেয়। ঘরের দিকে ভালো করে তাকিয়ে সুশ্রী আনন গম্ভীর করে। কাষ্ঠ গলায় বলল—

“ঘরের একি অবস্থা হৃতি? বাসায় একটা বাচ্চা আছে, সেইটা নিশ্চয়ই তুমি জানো?”

সুহাস গূঢ় হাসে। খেয়ালিপনায় বলল—

“বড়ো ভাই, আপনার মেয়েকে আমি এখানে আসতে বলিনি। আর ঘরটা যেহেতু হৃতির ওকে ওর মতো থাকতে দিন।”

“ঘরটা হৃতির হলেও বাড়িটা আমার।”

সুহাস চাপা হাসে। শ্লেষাত্মক গলায় বলল—

“ব্যাগ গুছা হৃতি। তোর বড়ো লোক নায়েল ভাই…উফ! সরি। ভাই তো ডাকিস না। কে জানে, কী সম্পর্ক তোদের! চল, তোকে নিয়ে না হয় হোটেলেই থাকব।”

নায়েলের থিতিয়ে থাকা রাগ তরতর করে ছড়িয়ে পড়ল পুরো দেহপিঞ্জরে। রাগ গলার মধ্যে চেপে রেখে বলল—

“পিউ, মামুনির কাছে যাও। ”

পিউলীকে কোল থেকে নামাতেই সে ছুট লাগায়। নায়েল ধীরপায়ে এগিয়ে আসে সুহাসের কাছে। সুহাস বিছানা থেকে নেমে দাঁড়ায়।

“কী বললে তুমি ওকে?”

সুহাস বাঁকা হেসে বলল—

“চাইনিজ ভাষায় তো বলিনি। বাংলায় বলেছি। বুঝতে পারেননি বড়ো ভাই? আরেকবার বলব?”

“ওকে তুই কেন বললে?”

“আমার বউ, আমার যা ইচ্ছে বলব। তাতে কার বাঁড়া ভাতে পানি ঢাললাম!”

নায়েল ফুঁসে উঠে বলল—

“মানে কী এসবের? বউ হয় তোমার, কাজের লোক নয়। আর এই বাড়িতে কাজের লোকদেরও তাদের প্রাপ্য সম্মান দেওয়া হয়। ”

সুহাস ক্ষুব্ধ চোখে তাকিয়ে কটাক্ষ গলায় বলল—

“টাকার যারায় মানুষ বেচাকেনা করে তাদের মুখে এই কথা মানায় না বড়ো ভাই। নিজের চরকায় তেল দিন। আমারটা আমি বুঝব।
ভাবীজানকে তো টাকা দিয়েই কিনে এনেছেন। টাকায় কি না করে!”

নায়েল রাগে বিহ্বল হয়ে এক চড় বসায় সুহাসের গালে। সুহাস বিক্ষুব্ধ হয়ে নায়েলের কলার চেপে ধরে। ঘটনার আকস্মিকতায় পাথর বনে যায় হৃতি। একে অপরকে শাসানোর এক পর্যায়ে সায়েরা এসে ধাক্কা লাগায় নায়েলকে। দেয়ালে ছিটকে পড়ে নায়েল।

চলবে,,,

#জঠর
#পর্বঃ২১
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি

নিজের জ্বালাপোড়া হাতের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে আছে সুহাস। একটু আগে ঘটা ঘটনায় তার কোনো ভাবান্তর হলো না। হৃতির চোখে জোয়ার এসেছে। থরথরে গলায় বলল—

“তুমি নায়েলের গায়ে হাত দিলে কেন?”

শার্টের কলারটা ভাঁজ করল সুহাস। হাতাটা ফোল্ড করে অনায়তন গলায় বলল—

“তোর খারাপ লাগছে? নাগরের গায়ে হাত দিয়েছি তাই?”

হৃতি খটমটিয়ে উঠে বলল—-

” এসব কী বলছ তুমি? আমি ভাবতেও পারছি না তোমার চিন্তাধারা এত জঘন্য!”

বাঁকা হাসল সুহাস। কোনো প্রতিক্রিয়া করল না। হৃতি ফের চেঁচিয়ে উঠে—

“নায়েল ঠিক-ই করেছে। তোমাকে আসলেই এই বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া উচিত। ওর খেয়ে ওর বাড়িতে থেকে আবার ওর মুখে মুখে তর্ক করো। তোমার চেয়ে তো এই বাড়ির কুকুরও ভালো আছে।”

“হৃতি!”

“ঠিকই বলছি। কেন বিয়ে করেছ তুমি আমায়? যখন নিজে ইনকাম করে বউকে খাওয়াতেই পারবে না তখন বিয়ে কেন করেছ?”

” আমি তোকে বিয়ে করেছি? তুই কেন পায়ে পড়লি বিয়ের জন্য আমার?”

“তাহলে আমার জীবনটা কেন নষ্ট করলে তুমি?

অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে সুহাস। তীর্যক গলায় বলল—

“জীবন নষ্ট! হাহ! তোদের আবার জীবন! তোরা মেয়েরা পারিস শুধু ছিনিয়ে নিতে। জীবনের মানে তোরা কী বুঝিস? তোরা চিনিসই শুধু টাকা। টাকার জন্য ভালোবাসাকে পায়ে পিষে ধরিস। ”

“এতই যখন মেয়েদের ঘৃণা করো তাহলে আমাকে কেন বিয়ে করলে? শুধু নিজের চাহিদা পূরণের জন্য। তাহলে ব্রোথেলে যেতে। রোজ নতুন শরীরের স্বাদ পেতে। আমাকে জীবনটা কেন এভাবে ধ্বংস করলে?”

সুহাস স্থির থাকতে পারল না। চোখ,মুখ বিকৃত করে এক চড় বসায় হৃতির গালে। সায়েরার বক্ষস্থলে ঠাঁই হয় তার। সায়েরা গর্জে উঠে বলল—

“কোন সাহসে তুই ওর গায়ে হাত দিয়েছিস?”

সুহাস গাঢ় গলায় বলল—

” সাহসের কিছু নেই খাআআলামনি। আপনি আসতে পারেন।”

সায়েরার বুকটা ফেটে যাচ্ছে। তার ছেলে তাকে খালামনি বলে ডাকছে। ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠল তার। ছেলের মুখে মা ডাক কী এই জনমে শোনা হবে না তার।
,
,
,

ধাক্কা লাগায় ছিটকে পড়ে নায়েল। তার হাত গিয়ে পড়ে একটা ফুলদানির উপর। ছোট্ট, পাতলা কাঁচের হওয়ায় নায়েলের হাতের চাপ সহ্য করতে পারেনি। ভেঙে গিয়ে তা নায়েলের হাতেই ঢুকে পড়ে। নিকটস্থ হাসপাতালে গিয়ে টিটেনাস নিয়ে ব্যান্ডেজ করে আসে। স্বামীর পাশেই মুখটা পাংশুবর্ণ করে বসে আছে অর্হিতা। নায়েল মন আর মস্তিষ্কের দোলাচলে বিধ্বস্ত !
অর্হিতা সুক্ষ্ম গলায় বলল—

“আপনি কেন ওর গায়ে হাত তুলতে গেলেন! ও এ বাড়ির জামাই নায়েল। এভাবে গায়ে হাত তোলা কী ঠিক?”

নায়েল খলবলিয়ে উঠে বলল—

“ও কী বলেছে আপনি শুনেছেন?”

“যাই-ই বলুক, এভাবে ওর গায়ে হাত তোলা উচিত হয়নি আপনার।”

নায়েল ক্ষিপ্ত। রাগে তার ব্যাথা অনুভূত হচ্ছে না। মনে হচ্ছে আগুনের শিখা নির্গত হচ্ছে তার চোখ থেকে। নায়েল ক্ষোভিত গলায় বলে উঠে—

“আই ডোন্ট বিলিভ দিস, হৃতি এমন একটা ছেলেকে বিয়ে করল কী করে? শুধু হৃতির জন্য, না হলে ওকে আমি প্রথম দিনই এ বাড়ি থেকে বের করে দিতাম।”

নায়েলের চোখ টলটলে। অগ্নিশর্মা দুই আঁখি রঞ্জিত। অর্হিতা নায়েলের দুই হাত নিজের মুঠোয় নিয়ে তাতে আলতো চুমু খেয়ে বলল—

“শান্ত হোন নায়েল। আপনি শুধু আপনার দিকটাই ভাবছেন। একবার ওর জায়গা থেকে ভাবুন। একটা পরিবার একটা শিশুর জন্য কত বড়ো শক্তি তা ওকে দেখলেই বোঝা যায়। পিউকে তো আপনি সব দিয়েছেন। তবুও মায়ের স্নেহের অভাব আপনি পূরণ করতে পারেননি। আপনার মা না থাকার পরেও সায়েরা খালামনিকে পেয়েছেন, উচ্চ শিক্ষা পেয়েছেন, বাবার স্নেহের সাথে তার ছায়া পেয়েছেন। রাত হলে বাবার ভালোবাসার উষ্ণতা পেয়েছেন। আমি আর ভাইয়া বাবা-মাকে হারালেও থাকার জায়গা পেয়েছি, দিন হলে কারো সাথে দুটো মনের কথা বলতে পেরেছি। তবুও ভাইয়ার অবস্থা দেখুন! কিন্তু সুহাস! ও তো কিছুই পায়নি। বাবার ভালোবাসা পায়নি, মায়ের স্নেহ পায়নি। আর এতিমখানায় বাচ্চাদের সাথে কী ধরনের ট্রিট করা হয় আপনি জানেন? না পারে ওরা ঠিক মতো খেতে, না পারে ঘুমাতে। যদি না সোনাভাগ্য হয় তাদের। বেশিরভাগ এতিমখানা বাইরে থেকে যেমন দেখতে ভেতরে তেমন নয়।”

নায়েল নির্মেঘ আকাশের মতো স্বচ্ছ চোখে চেয়ে রয়। কথাগুলো সত্য হলেও তার মস্তিষ্ক মানতে চাইছে না। অর্হিতা শান্ত গলায় আবার বলল—

“ও কেন আমাদের পিউর ক্ষতি করবে? আপনি খেয়াল করেছেন, যে ছেলে বিয়ের পর একদিনও আমাদের সাথে খেতে আসেনি ওকে পিউ নিয়ে এসেছে। বাচ্চাদের মন পবিত্র হয় নায়েল। ওরা পবিত্র আত্মাকে চেনে। নাহলে আমাদের পিউ কেন বারবার সুহাসের কাছে ছুটে যাবে? সুহাস পিউকে ভালোবাসে। সুহাসের একটা পরিবার প্রয়োজন, প্রয়োজন একটা মানুষের। যে মানুষ ওকে নিয়ে ভাববে, ওকে নিয়ে চিন্তা করবে, দিনশেষে ওর ফেরার জন্য অপেক্ষা করবে, ওর যত্ন করবে। আমরা ওকে সে সুযোগটা দিতে পারি নায়েল। হৃতি ওর সেই মানুষটা হতে পারে। পরিবারবিহীন জীবন বটবৃক্ষের ছায়াহীন এক অনিশ্চিত জীবন। সূর্যের প্রখর তাপে ঝলসে যাবে, না হয় বৃষ্টির জলে ভেসে যাবে। আমরা ওকে একটা সুযোগ দিতে পারি নিজেকে শুধরে নেওয়ার, নিজেকে ভালোবাসার, নিজেকে মূল্যায়ণ করার। যে মানুষ নিজেকে ভালোবাসতে পারে না সে কাউকে ভালোবাসতে পারে না। সুহাসকে তার নিজেকে ভালোবাসতে হবে। তাহলে সে বুঝবে তার প্রয়োজনীয়তা কতটুকু অন্যের জীবনে।”

নায়েল বুক ফুলিয়ে শ্বাস নিল। অর্হিতার কথা হুরহুর করে তার মস্তিষ্ক বিদীর্ণ করে ঢুকে যাচ্ছে। কিন্তু সে নাখুশ।

“নায়েল!”

সায়েরার মর্মাহত গলায় চমকিত হয় নায়েল। অপরাধীর মতো মুখ করে আছেন তিনি। অনুনয়ের সুরে বলল—

“আমাকে ক্ষমা করো নায়েল। আমি না বুঝেই…।”

তার কথার মাঝেই থামিয়ে দেয় নায়েল। ওঠে দাঁড়ায় সে। সজীব গলায় বলল—

“ক্ষমা চাইতে হবে না খালামনি। ভুল আমার-ই ছিল। ওর গায়ে হাত তোলা উচিত হয়নি আমার।”

সায়েরা কণ্ঠে নমনীয়তা এনে বললেন—

“তুমি বয়সে ওর থেকে বড়ো। বড়ো ভাই হিসেবে ওকে শাষন করতেই পারো। কিন্তু ছেলেটা একটু পাগলা স্বভাবের। কখন কী করে বসে! হৃতি আমার মেয়ে না হলেও ওকে আমি আমার মেয়েই ভাবি। সুহাস কখন কী করে বসে ওর সাথে!”

নায়েল তপ্ত শ্বাস ফেলে। নেশাগ্রস্তরা বোঝে না তারা কী করছে। নায়েলকে সতর্ক থাকতে হবে। কাউকে আঘাত করলেই যে সে শুধরে যাবে তা নয়। ভালোবাসার শরীর আঘাতে বিচূর্ণ হয়।

“সরি খালামনি।”

“না,না। তু সরি বলো না। ভুল আমারই হয়েছে। হৃতিকে আমার আগেই সাবধান করা উচিত ছিল। ওই ছেলে ওর যোগ্য নয়। আজ ওর জন্য তোমার গায়ে….।”

সায়েরা বিড়বিড়াতে থাকল। অনুশোচনায় দগ্ধ হচ্ছে সে। না চাইতেও সে নায়েলকে আঘাত করেছে। হাজার হোক সুহাস তার নিজের রক্ত।
,
,
,
অম্বুরে আজ তারারা লুপ্ত। চক্ষুগোচর হচ্ছে না তা। বিশাল পূর্ণ বিধুর চন্দ্রাতপে( জ্যোৎস্না )আলোড়িত বহ্নিসখ। বাড়ি ফিরেছে সুহাস। সময় প্রহরি তখন ক্লান্ত। এগারোর ঘরে দাঁড়িয়েছে সে। ডোর বেল বাজাতেই দরজা খুলে কলরব। অর্হিতা তখন খাবার টেবিলের কাছে। সকলের খাওয়া শেষ হয়েছে বহুক্ষণ আগে। সুহাস সোজা নিজের কক্ষের দিকে যায়। অন্ধকার ঘরে কৃত্রিম বাতি জ্বালিয়ে শূন্য ঘরময় চোখ বুলায় সুহাস। হৃতির অস্তিত্ব শূণ্য। হাতে থাকা ব্যাগের উপর ক্ষোভ চড়ে তার। বাইরে বেরিয়ে এসে সায়েরাকে দেখে কটমটিয়ে তাকিয়ে বলল—

“হৃতি কোথায়?”

সায়েরা শক্ত স্বরে বললেন—

“ও উপরে। আজ থেকে ও আলাদা থাকবে।”

সুহাস বিক্ষুব্ধ হয়। ফুঁসলে উঠে বলল—

” আলাদা থাকবে মানে? বউ হয় আমার।”

সায়েরা চোখ রাঙিয়ে কিছু বলবে তার আগেই তাকে থামিয়ে দেয় অর্হিতা। সায়েরাকে চলে যেতে বলে। নিজের রাগ গিলে নেয় সুহাস। অর্হিতার বিপরীতে রুগ্ন চোখে চেয়ে রইল। অর্হিতা সরস গলায় বলল—

“বউ হয় তোমার, দাসী নয়। হৃতি ঘুমাচ্ছে এখন। না খেয়েই আছে দুপুর থেকে মেয়েটা। বয়সে বড়ো তুমি আমার, সম্পর্কে ছোটো। তাই তুমি করেই বলছি। দেখো ভাইয়া, স্ত্রী মানে সহচারী, সহযোগী, অর্ধাঙ্গীনি। জীবনে চলার পথে আমাদের একান্ত নিজের কাউকে প্রয়োজন হয়। সে একান্ত একজন অনেকে হতে পারে ক্ষেত্র বিশেষে। তোমার সম্পর্কে আমি যা শুনেছি হৃতি ছাড়া তোমার কেউ নেই।
স্বামী – স্ত্রীর মধ্যে মন কষাকষি হয়। কিন্তু তাই বলে তার গায়ে হাত তোলা সুপুরুষের কাজ নয়। হৃতি শুধু মাটি নয়, নরম কাঁদা মাটি। তুমি ইচ্ছে করলেই ওকে নিজের মতো গড়ে নিতে পারবে যেমনটা তুমি চাও। কিন্তু ওকে গড়ার আগেই ভেঙে ফেলো না। এতে তোমার ক্ষতি। আমি জানি না ওর প্রতি তোমার ভালোবাসা কতটুকু! কিন্তু এতটুকু জানি তোমার প্রতি ওর বিশ্বাস আর ভালোবাসা দুটোই নিরন্তর। যার সীমানা পরিমাপ করা সহজ নয়, হয়তো অসম্ভবও। তাই বলছি সম্পর্ককে একটু সময় দাও। রাগ, জেদ, ইগো ভালোবাসার অন্তরায়। এসব ছুড়ে ফেলো। হাত, মুখ ধুঁয়ে এসো। আমি খাবার দিচ্ছি।”

বদ্ধ শ্বাস ফেলল সুহাস। ভারী কণ্ঠে বলল—

“আমার খিদে নেই।”

অস্থির পদযুগলে ফিরে আসে কক্ষে। দরজা চাপিয়ে হাতে থাকা ব্যাগ ছুড়ে ফেলে অজানা উদ্দেশ্যে। ব্যাগের ভেতর থাকা দু ‘মুঠো সাদা আর গোলাপি রেশমি চুড়ি ভেঙে যাওয়ার ঝনঝন আওয়াজ ভেসে আসে। কিন্তু বিচলিত নয় সুহাস। তার একটা ঘুম প্রয়োজন।
,
,
,
প্রভাতের মিঠে রোদে ধরণী উত্তাল। ফুরফরে হাওয়ায় তীব্র সতেজ খুশবু। দরজা খোলা থাকায় দ্বিধান্বিত হলো না হৃতি। ভেতরে ঢুকে দেখল এলোমেলো হয়ে ঘুমোচ্ছ সুহাস। চকিতে পড়ার টেবিলে আঁখি নিবদ্ধ হয় হৃতির। নরম পায়ে হেঁটে গিয়ে অতি যত্নের সাথে অযত্নে পড়ে থাকা ব্যাগটা তুলে নিল। ভেতর থেকে বের করল সাদা জমিনের উপর গোলাপি রঙের ছোটো ছোটো অঙ্কিত ফুলের একটা শাড়ি। চুড়িগুলোর অবস্থা বেহাল ! কাগজ সরিয়ে নিতেই ঝুরঝুর করে নিচু পড়ল কিছু। কয়েকটা চুড়ির অবস্থা ভালো। শাড়িটাকে হাতে নিয়ে কাতর দৃষ্টিতে তাকাল সুহাসের দিকে। ছেলেটার হাবভাব সে বোঝে না।

শাড়িটা পরা যখন শেষ তখন হৃতির ঠাওর হলো এক জোড়া চোখ তার দিকে নিমেষহীন চেয়ে আছে। হৃতি তাকাতে পারল না। সলজ্জ চোখ দুটো অবনত। সুহাস বিছানা ছাড়ে। হৃতির পাশে দাঁড়াতেই মৃদু কম্পন শুরু তার লতানো দেহে। হৃতিকে পেছন থেকে আলতো করে জড়িয়ে ধরে সুহাস। কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল—

“কালকের জন্য সরি।”

হৃতির রাগ দ্রবিভূত হয় অতল সাগরে। ব্রীড়াময় শরীরে নিগূঢ় কম্পন। সুহাসের গাঢ় স্পর্শ চলে হৃতির শাড়ি ভেদ করে তার অনাবৃত উদরে। কাতর হয়ে উঠে সে। গভীর আশ্লেষে একে অপরের শ্বাসে আবদ্ধ হয়। হৃতি তরল সুরে বলল—

“সুহাস!”

“হুম।”

“আমরা বেবি প্ল্যানিং করি।”

সুহাস শীতল গলায় বলল—

“না। আমার সন্তানকে আমি পরগাছা হতে দেবো না। জবের জন্য ট্রাই করছি আমি। একটা কোম্পানি তাদের মার্কেটিং ডিপার্টমেন্টে কিছু লোক নেবে। ”

হৃতি খুশিতে আপ্লুত হয়ে বলল—

“সত্যি?”

“হুম। তারপর এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাব আমরা। থাকতে পারবে তো এই অনাথ স্বামীর সাথে?”

হৃতি খুশিতে আত্মহারা হয়ে বলল—

“পারব, খুব পারব।”

সুহাসের গভীর, অতলান্তিক স্পর্শে আড়ষ্ট হয়ে গেল হৃতি। সুহাসের অন্তঃকরণে জাগরণ হয় এক অদ্ভুত প্রশ্নের। একটা পাঁচশত টাকার শাড়ি আর দু’মুঠো চুড়িতেও কেউ ভুবন ভুলতে পারে। আর কেউ হাজার টাকায়ও সংখ্যার পেছনের শূন্য ছাড়া আর কিছুই দেখতে পায় না। আসলেই, টাকায় সুখ কেনা যায় না। টাকার জন্য তার সন্তানকে বাঁচাতে পারেনি সে। ভালোবাসার বিপরীতে পেয়েছে ধোঁকা। নিজের সন্তানের প্রতি যে অন্যায় হয়েছে তার শোধ সুহাস নেবে। তাদের কাউকে সুখে থাকতে দেবে না সে। কাউকে না।

চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here