জঠর পর্বঃ৩,৪

0
1209

জঠর
পর্বঃ৩,৪
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি
পর্বঃ৩

প্রভাতের মিষ্টি রোশনাই এলোথেলো হয়ে ঢুকে পড়ছে থাই গ্লাসের কাঁচ ভেদ করে। দেয়ালের সাথে লাগোয়া কৃষ্ণচূড়া গাছটায় কচিপাতার সয়ম্বর। শীতল, মিহি প্রভঞ্জনে সয়লাব হয়ে উঠেছে মেদিনী। প্রভাকরের হলদে রঙের দুষ্ট আলো যখন নায়েলের চোখের পল্লবে খেলছে, তখন তার মাথায় লাগা আঘাতের জায়গায় ছোটো ছোটো বারো সেন্টিমিটারের হাতের পাঞ্জার প্রগাঢ়, তুলতুলে স্পর্শে মত্ত হতে থাকে। আঁখি মেলে চাইতেই নায়েলের মুক্ত চাহনিতে ঘেরাও হয় পিউলীর ছোট্ট আনন। বিহঙ্গের মনোহারী হাসি। অলস হাসিতে ওঠে বসে নায়েল। পিউলীর কপালে আস্ত চুমু খেয়ে বলল—

“গুড মর্নিং লিটল বার্ড। ”

পিউলী মুক্তো ঝরা হাসে। কচি কচি ঠোঁটে ইঁদুর দাঁতের হাসি। ভাঙা ভাঙা গলায় বলল—

“গুড মর্নিং পাপা।”

চোখে হাসে নায়েল। তার সমস্ত অবসাদ, ব্যথা এক নিমিষে মিশে গেল বাতাসে। পিউলী ওঠে দাঁড়ায়। নায়েলের কপালের ক্ষত জায়গায়টায় হাত দিয়ে বারংবার ছোঁয়। কিন্তু অতি সন্তর্পনে। পাছে ব্যথা লেগে যায়! অর্হিতা তার রাগের বহিঃপ্রকাশ ঘটায় নায়েলকে আঘাত করে। নায়েল প্রতিবাদ করেনি। ড্রেসিং করে ওয়ান টাইম স্ট্রিপ লাগিয়ে নেয়। পিউলীর কক্ষেই জায়গা হয় তার।
বাবার ব্যথায় মন ভারাক্রান্ত হয় পিউলীর। ঠোঁট ফুলিয়ে বলল—

“ব্যথা পেয়ছ পাপা?”

নায়েল অধর ছড়ায়। আলতো অনুভূতিতে বলল—

“নো, মাই প্রিন্সেস। কাম।”

মেয়েকে পায়ের উপর বসিয়ে গালে চুমু খায় নায়েল। পিউলীর ছোট্ট চুলের অরন্যে হাত গলিয়ে বলল—

“ব্রাশ করেছ?”

“হুম।”

“খেয়েছ?”

“না।”

“কেন?”

শিয়র নত করে পিউলী। বিষণ্ণ গলায় বলল—

“আমি তোমার সাথে খাবো।”

মলিন হাসে নায়েল। নিরুত্তাপ গলায় বলল—

“যাও টেবিলে। পাপা ফ্রেশ হয়ে আসছি।”

“ওকে পাপা।”

দীর্ঘশ্বাস ফেলে নায়েল।
,
,
,
খাওয়ার টেবিলে সবাই উপস্থিত থাকলেও নেই অর্হিতা। মিঠে অভিমানে শান্ত পিউলী। তার মা কেন আসে না? বারবার সিঁড়ির দিকে চোখ ফেলছে সে। আচমকা পদধ্বনিতে উচ্ছল হাসে পিউলী। অর্হিতা এসে দাঁড়িয়েছে ডাইনিং স্পেস থেকে একটু দূরে। পিউলী উচ্ছ্বাসিত মেজাজে চেয়ার থেকে নেমে এসে ব্যাকুল হয়ে অর্হিতার আঙুল চেপে ধরে। ঝরঝরে হাসির ফোয়ারা বইয়ে বলল—

“মামুনি, এসো, এসো। খাবে চলো।”

অর্হিতার সুপ্ত রাগ বিক্ষিপ্ত হলো। ঝাঁড়া মেরে হাতটা ছাড়িয়ে বলল—

“এই মেয়ে, তোমাকে না বলেছি আমাকে মামুনি বলে ডাকবে না। আমি তোমার মা নই। যাও এখানে থেকে।”

শিরা ফুলে ওঠে নায়েলের। বাবার দিকে দুঃখী দুঃখী চোখে চেয়ে থাকে পিউলী। নায়েল গম্ভীর আওয়াজে বলল—

“নিজের জায়গায় বসো পিউ।”

পিউলী তার ছোট্ট কদমে ফিরে আসে নিজের জায়গায়। তাচ্ছিল্যভরা চাহনি অর্হিতার। উপহাস করে বলল—

“জুতো মেরে গুরু দান।”

ঘরের কেউ কোনো প্রতিক্রিয়া করল না। অর্হিতার মেজাজ চড়ে গেল দ্বিগুন। নওশাদ সাহেবের দিকে তাকিয়ে জ্বলন্ত গলায় বলে উঠে—

“আপনি তো তার বাবা তাই না? আপনি পারতেন নিজের অবিবাহিত মেয়ের সাথে একটা বিবাহিত ছেলের বিয়ে দিতে? পারতেন?”

নওশাদ সাহেব কোনো কথা বলল না। নায়েলের দিকে তাকিয়ে গিলে নিলেন কথা। সরোষে ফের বলে উঠে অর্হিতা—

“মেয়ে তো আপনাদের বাসাতেই ছিল। তাহলে আমাকে কেন জোর করে বিয়ে করল আপনার ছেলে?”

হৃতি মৃদু চোখে নায়েলের চক্ষুদর্পণে তাকাল। নায়েল প্রতিক্রিয়াহীন। যেন কিছু শোনেইনি সে। অর্হিতার রাগ মানলো না। রাগে হতবিহ্বল অর্হিতা চওড়া গলায় বলল—

“এই জন্যই হয়তো আপনার বউ মরে গেছে। টাকার প্রভাবে মানুষ কেনাবেচা করা যার স্বভাব তার সাথে এর চেয়ে আর ভালো কী হবে!”

নিজেকে কন্ট্রোল করার সমস্ত ক্ষমতা হারালো নায়েল। তীব্র ক্রোধে চেয়ার ছেড়ে ওঠে এসে সজোরে এক চড় বসিয়ে দেয় অর্হিতার গালে। উপস্থিত সকলে হতভম্ব। নায়েল সহজে রাগে না। আর নিজের মেয়ের সামনে তো কখনোই না। পিউলী কেঁপে ওঠে। তার চোখের পাতায় নামে শ্রাবণ মেঘের ঢল। সক্রোধে খেঁকিয়ে উঠে নায়েল—

“আপনার সাথে যা হয়েছে তার জন্য আমি দায়ী। এই ব্যাপারে পরিবারে কোনো মানুষের সামনে আঙুল তোলা যাবে না। এই বাড়ির কুকুরও আমার মেয়ের সামনে জোর গলায় ডাকে না। আর আপনি তো একটা মানুষ! মিনিয়াম ম্যানার্সটুকু আপনার নেই? একটা বাচ্চার সামনে কীভাবে কথা বলতে হয় আপনি জানেন না?”

ছলছল চোখে অর্হিতার ফোঁস ফোঁস করছে। তার চোখের দিকে দৃঢ়তার সাথে তাকিয়ে কাঠখোট্টা গলায় নায়েল বলে উঠে —

“পিউলীর খাবার বক্সে দিয়ে দাও। চলো পিউ।”

নীরবতায় আচ্ছন্ন হয় ঘর। কারো অন্ত:করণে তীব্র আক্রোশ, কারো চেহারায় মলিনতা। কেউবা উল্লাসিত!
,
,
,
খাবার সামনে নিয়ে বসে আছে পিউলী। চেয়ারে বসে ডেক্স ডিঙিয়ে মেয়ের দিকে কাতর চোখে চেয়ে আছে নায়েল। কেবিনের একপাশে ডিভান। সেখানে নির্বিকার বসে আছে পিউলী। নায়েল চেয়ার ছেড়ে ওঠে আসে। ছোট্ট টি টেবিলের উপর হাত রেখে হাঁটু ভাঁজ করে বসে। মর্মাহত গলায় বলল—

“খেয়ে নাও পিউ।”

“আমি খাবো না। তুমি মামুনিকে মারলে কেন?”

বুকের কার্ণিশ ছুঁইয়ে রক্তক্ষরণ হয় নায়েলের। ছোট্ট করে বলল—

“আই এম সরি।”

“তুমি মামুনিকে সরি বলোনি।”

ফোঁস করে শ্বাস ফেলল নায়েল। গাঢ় গলায় বলল—

“বলব।”

“আর সরি গিফ্ট?”

হতাশ শ্বাস ফেলে নায়েল। মেয়েটার গায়ে হাত তোলা তার ঠিক হয়নি। যে অপরাধে সে অর্হিতার গায়ে হাত তুলেছে সে একই অপরাধে সেও দোষী। নায়েল ভেবে পায় না, লুবানার সাথে দীর্ঘ সময় কাটিয়েও তার প্রতি পিউলীর কোনো মায়া তৈরি হয়নি। কিন্তু অর্হিতাকে প্রথম দেখাতেই তার প্রতি অমোঘ টান অনুভব করেছে পিউলী। হাসপাতালের সফেদ বিছানায় যখন শুয়েছিল পিউলী তখন পুরো পৃথিবীকে বিস্বাদ মনে হয়েছিল নায়েলের কাছে। চোখ পিটপিট করে চেয়ে প্রথমবার যখন পিউলী অর্হিতাকে দেখে আর জানতে পারে যে তার রক্তেই বেঁচে ওঠেছে পিউলী তখন থেকে এক অমীমাংসিত, অজ্ঞাত, আছোঁয়া মায়ায় আবিষ্ট হয় পিউলী। নায়েলকে বাধ্য করে বারবার অর্হিতার সামনে গিয়ে দাঁড়াতে। মায়ের আদরহীন এক সন্তানের আকুতি ফেলতে পারে না নায়েল। বেহায়ার মতো বারবার কড়া নেড়েছে অর্হিতার অন্ত:রিন্দ্রিয়ের বদ্ধদ্বারে। প্রতি বারেই সে ফিরে এসেছে রিক্তহস্তে। তাই বাধ্য হয়ে এমন গর্হিত কাজ করেছে সে। অর্থের প্রলোভন দেখিয়ে, ক্ষমতার জোর খাটিয়ে মেয়েকে মা এনে দিয়েছে।

কেন, জন্ম না দিলে কী মা হওয়া যায় না?

চলবে,,,

#জঠর
#পর্বঃ৪
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি

মগ্ন হয়ে উপন্যাস পড়ছে অর্হিতা। ‘চোখের বালি’ কেন যেন তার একটু বেশিই পছন্দ। বারকয়েক পড়েও যেন তৃপ্তি মেলে না। অর্হিতার জীবনেও অনেক চোখের বালি রয়েছে। সেখানে নতুন করে যোগ হলো ওই টাকার কুমির। উপুর হয়ে শুয়ে উপন্যাসে ধ্যান লাগিয়ে রেখেছে অর্হিতা। ছোটো ছোটো পায়ে তার পাশে পিউলী এসে দাঁড়িয়ে আছে তা অর্হিতা টের পায়নি। অর্হিতার খোলা চুলে পিউলীর হাতের স্পর্শেই সপ্রতিভ হয় সে। ক্ষুব্ধ চোখে পিউলী দেখেই বলল—

“তুমি! তুমি এখানে কেন?”

পিউলী গালভর্তি হেসে বলল—

“তোমার জন্য।”

পিউলীর হাতে একটা বক্স দেখতে পায় অর্হিতা। কন্ঠস্বরে নমনীয়তা এনে বলল—

“এইটা কী?”

“সরি গিফ্ট। পাপা তোমাকে সরি বলেছে।”

অর্হিতা তাচ্ছল্য চোখে চেয়ে কটাক্ষ গলায় বলল—

“তো! আমি কী করব?”

পিউলী শিয়র নত করে। অর্হিতার হঠাৎ করে কেন যেন মায়া লাগল। ওঠে বসে সে। দারাজ গলায় জিজ্ঞেস করল—

“তোমার পাপা কোথায়?”

পিউলী মিহি গলায় বলল—

“বাইরে।”

কটমট করে ওঠে অর্হিতা। থাপ্পড় মেরেছে নিজে আর মেয়েকে পাঠিয়েছে সরি বলতে! বেয়াদব লোক! অর্হিতা দৃঢ় গলায় বলল—

“যাও, তোমার পাপাকে ডেকে আনো।”

এক মুহুর্তেই সূর্য রশ্মিবিচছুরণ হলো পিউলীর ছোট্ট অধরে। দৌড়ে গিয়ে নায়েলকে নিয়ে আসে। কক্ষে ঢুকতেই নায়েলের ব্রীড়া দৃষ্টি। মেয়েটার গায়ে হাত তুলে ঠিক করেনি সে। পিউলী ঝলমলে গলায় বলল—

“পাপা এসেছে, মামুনি।”

কেন যেন এখন অর্হিতার মামুনি ডাকটায় রাগ হলো না। সমস্ত রাগ গিয়ে উপচে পড়ল নায়েলের গম্ভীর মুখটার দিকে। পা উঠিয়ে বিছানায় বসে অর্হিতা। উপন্যাসের বইটা হাতে নিয়েই চোখের সামনে ধরে। মেয়েটার ভাবগতি ঠিক ধরতে পারছে না নায়েল। পিউলী শঙ্কিত চোখে চাইল অর্হিতার দিকে। অর্হিতা গলা খাঁকরি দিয়ে বলল—

“সরি বলুন।”

পিউলী টুক করেই বাবার দিকে তাকাল। নায়েল বুক ফুলিয়ে শ্বাস নিয়ে বলল—

“সরি।”

“এভাবে নয়। হাঁটু মুড়ে বসে, তারপর বলবেন।”

পিউলীর বিমূঢ় চাহনি। নায়েলের চোয়াল শক্ত হয়ে আসে। দাঁতে দাঁত নিষ্পেষণ করে কটকট করে তাকিয়ে থাকে। অসহায় মুখে বলে উঠে পিউলী—

“পাপা!”

নায়েলের বুকের কোণে ব্যবচ্ছেদ ঘটে। সে আর কিছু ভাবল না। চাপা ক্ষোভ নিয়ে হাঁটু মুড়ে বসে বলল—

“সরি।”

অর্হিতা চোখের পাতা ঝাঁকিয়ে ঠোঁট প্রশ্বস্ত করে। শুষ্ক গলায় বলল—

“শুনতে পাইনি। জোরে বলুন।”

ফোঁস করে দম ফেলল নায়েল। পূর্বেকার ন্যায় পিউলীর ভারাক্রান্ত স্বর—

“পাপা, মামুনি শুনতে পায়নি।”

নায়েল নাকের পাটা ফুলিয়ে দম আটকে বলল—

“সরিইই।”

অর্হিতা কিঞ্চিৎ রাগ মিশ্রন করে গাঢ় গলায় বলল—

“কারো ওপর চড়ে বসার সময় তো আপনার গলায় অনেক জোর থাকে। এখন নেই কেন?”

“একটু বারাবারি হয়ে যাচ্ছে না মিসেস অর্হিতা নায়েল আনসারী?”

অনুপলেই ধক করে ওঠে অর্হিতা বুকটা। এই মানুষটা তার স্বামী ভুলেই গিয়েছে সে। বই থেকে চোখ সরিয়ে নায়েলের দিকে এক পলক তাকাল। মেয়ের জন্য হাঁটু মুড়ে বসে পর্যন্ত গেল! আজব বাবা! চোখ সরায় অর্হিতা। নায়েল শক্তপোক্ত গলায় বলল—

“সঅঅঅরিইই।”

“ওকে। ডান। উঠুন, আর এখন যেতে পারেন। দ্বিতীয়বার আমার গায়ে হাত তুললে খবর আছে। যান এখন।”

“তুমি ক্ষমা করেছ পাপাকে, মামুনি?”

পিউলীর দিকে পূর্ণ নজরে তাকাল অর্হিতা। মেয়েটার চোখ দুটো ভারি সুন্দর! চেহারাটাও কী মায়াবী! কিন্তু ওকে দেখেই অর্হিতার মস্তিষ্ক আবার বিগড়ে গেল। খিটখিটে গলায় বলল—

“তোমার পাপা সরি বলেছে। আমি শুনেছি। এখন যাও। পরে জানিয়ে দেবো আমি ক্ষমা করব কি না।”

“আচ্ছা। এইটা নাও। তোমার সরি গিফ্ট।”

অর্হিতা আপত্তি করল না। পিউলীর হাত থেকে বক্সটা নিয়ে নেয় অর্হিতা। নায়েল ক্রোড়ে তুলে নিল পিউলীকে। বাবার কাঁধে মাথা রেখে বিদুর চোখে চেয়ে রইল অর্হিতার দিকে। অর্হিতার মধ্যে কোনো ভাবাবেশ হলো না।
,
,
,
পিউলীর মুখের সামনে খাবার ধরে রেখেছে নায়েল। বাচ্চা মেয়েটা বাবার ওপর ভীষণ অভিমান করেছে। সেই হেতু সকাল থেকে না খেয়ে আছে পিউলী। নায়েলের আবেগ মিশ্রিত বিদুর কন্ঠ—

“খেয়ে নাও পিউ। পাপা সরি বলেছি তো।”

পিউলী খানিকক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে রইল। কোমল সুরে মৌনতা ভেঙ্গে বলল—

“তুমি প্রমিজ করো আর কখনো মামুনিকে বকা দেবে না, মামুনিকে মারবে না। তুমি মামুনিকে মারলে আমিও আকাশের তারা হয়ে যাব। নিহি মামুনির মতো আর কখনো তোমার কাছে আসব না। তোমাকে পাপাও বলব না। আড়ি।”

নায়েলের চোখ ভরে আসে। আঁখি নিমীলিত হতেই টুপ করে এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে।

নায়েল বদ্ধশ্বাসের দ্বার খোলে। বুক ফুলিয়ে শ্বাস নিয়ে কান ধরে আদুরে গলায় বলল—

“প্রমিজ করছি পাপা। আর কখনো মামুনিকে বকা দেবো না, মারবও না। এখন খেয়ে নাও মাই হার্ট। প্লিজ?”

পিউলী তার মাছের মতো মুখটা হা করতেই নায়েল প্রাণখোলা হাসে।
,
,
,
“তুমি যা করেছ তা একদম ঠিক করোনি নায়েল।”

নায়েল অনুতাপের সুরে বলল—

“আমি চাইনি বাবা। বাধ্য হয়েছি।”

নওশাদ সাহেব গম্ভীর গলায় বললেন—

“এইটা জাহিলিয়াত যুগ নয়। টাকার বিনিময়ে মানুষ বেচাকেনা হবে! ”

নায়েল পূর্ণ চোখে তাকাল। নম্র গলায় বলল—

“আমার সামনে কোনো পথ খোলা ছিল না। অর্হিতা কিছুতেই এই বিয়ের জন্য রাজি হচ্ছিল না। তার উপর ওর ওই নোংরা ভাই একটা আধ বুড়োর সাথে ওর বিয়ে দিতে চাইছিল। লাখ টাকার বিনিময়ে। তাই আমি….।”

নায়েলের কথা মাঝেই বলে উঠলেন নওশাদ সাহেব—

“তো, তুমিও তো তাই করেছ। টাকার বিনিময়ে কিনে এনেছ ওই মেয়েকে।”

নায়েল তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলল। তার বাবা তাকে সামাজিক শিক্ষা ঠিক-ই দিয়েছে। কিন্তু উদ্ভুত অনেক পরিস্থিই মানুষকে বিবেক বিবর্জিত কাজ করতে বাধ্য করে। নায়েল মৃদু গলায় বলল—

“জানি। কিন্তু একবার ভাবো বাবা, যদি ওই লোকটার সাথে অর্হিতার বিয়ে হতো তাহলে কী হতো? মানছি আমি যা করেছি ঠিক করিনি। কিন্তু ওর ভাই, মামা-মামি যা করত তা কী ঠিক হতো?”

নওশাদ সাহেব সচেতন গলায় বললেন—

“তাহলে তুমি ওকে কেন সত্যিটা বলছ না? ও তোমাকে ঘৃণা করছে।”

“ইচ্ছে করে বলিনি। তাহলে ও ওর পরিবারকে আরও বেশি ঘৃণা করবে। পরিবার ছাড়া মানুষ বাঁচতে পারে না বাবা।”

নওশাদ সাহেব বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ালেন। জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়াতেই আকাশে পূর্ণ প্রকাশিত চাঁদের ফিনকি আলো তার চোখে লাগল। তিনি সেই আলোয় নিজের স্ত্রীকে দেখতে পেলেন! ভারী গলায় বললেন—

“ও তোমাকে ঘৃণা করলে পিউলীকে কখনো ভালোবাসতে পারবে না।”

নায়েল নত স্বীকার করে বলল—

” আমার প্রতি অর্হিতার ঘৃণা আমাদের দুজনকে আলাদা রাখবে। পিউলী নিজ যোগ্যতায় অর্হিতার মনে জায়গা করে নেবে। পিউলীর যেমন অর্হিতাকে প্রয়োজন, তেমনই অর্হিতার আমাকে প্রয়োজন। ও আমাকে মেয়েকে সেফ রাখবে, আমি ওকে।”

“আর যদি লুবানা ফিরে আসে? তার আগেই যদি তোমার প্রতি অর্হিতার কোনো অনুভূতির তৈরি হয়?”

নায়েল কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। পরমুহূর্তে মিহি গলায় বলল—

“অর্হিতাকে আমি সব জানিয়ে রাখব। লুবানার ফিরে আসা নিয়ে ডক্টরাও সন্দিগ্ধ! তুমি জানো ওর অবস্থা কতটা ভয়ানক! ভাগ্যক্রমে সেদিন পিউলীর বেশিকিছু হয়নি। আর ওকে বাঁচাতে দেবদূত হয়ে এসেছিল অর্হিতা। ওর প্রতি আমি সারাজীবন কৃতজ্ঞ। আমি যা করেছি ওর ভালোর জন্যই করেছি।”

“সমাজ বলে কথা আছে নায়েল? কতজনের মুখ আটকাবে তুমি?”

“বিয়েতে কারো সর্বনাশ হয়ে যায় না বাবা! আমি ওর কোনো ক্ষতি করছি না। আমি শুধু আমার মেয়ের সেফটি চাই। যার সাথে অর্হিতার বিয়ে ঠিক করেছে ওই লোক এর আগেও তিনবার বিয়ে করেছে। ব্রোথেলে রেগুলার আসা যাওয়া তার। এই যুগে স্বার্থ ছাড়া কেউ কিছু করে না বাবা। পিউলীর জন্য বডিগার্ড, ন্যানি যাই- ই রাখি না কেন ওরা শুধু ততটুকুই করবে যতটুকু ওদের দায়িত্ব। টাকার কাছে তো আর জীবন বিলিয়ে দেবে না! কিন্তু আমার পিউলীর জন্য একটা ভরসার ছায়া প্রয়োজন। আর অর্হিতা হবে সেই ছায়া।”

নওশাদ সাহেব দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। বললেন—

“মেয়েটা বড্ড কঠিন নায়েল। ওর মনে জায়গা করা সহজবোধ্য কাজ নয়।”

“জানি। যা পাওয়া দুর্লভ, তার তেজ তত বেশি বাবা।অর্হিতাকে পুরো দুই মাস স্টাডি করেছি আমি। যেই মেয়ে ভিক্ষুককে বিশ টাকা দেওয়ার দরুণ পায়ে হেঁটে বাসায় ফেরে, ভাবো তো আমার মেয়েকে একবার মেয়ে বলে মেনে নিলে ওর জন্য কী করতে পারে? তুমি আমাকে স্বার্থবাদী বলতে পারো বাবা। আমার পিউলীর জন্য আমাকে যা করতে হবে আমি করব। আমি করব বাবা।”

নায়েলের সিক্ত চোখের দিকে অনিমেষ চেয়ে রইলেন নওশাদ সাহেব। যেন নিজেকে দেখলেন তিনি।

চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here